০৯.

ভোরবেলাটা অস্বস্তিকর এক দৃশ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। আমাদের উঠোনে রাণী দাঁড়িয়ে কাঁদছে। পাশে তার ট্রাঙ্ক। পান্নাভাবী সবার সামনে তার ট্রাঙ্কের তালা খুলছেন। রাণীকে বিদেয় করে দেয়া হয়েছে। বিদায় মুহূর্তে তার বিছানা তার ট্রাংক তল্লাসি করা হচ্ছে। এই তল্লাসি করা হচ্ছে বেশ আয়োজন করে। পান্নাভাবীর বাড়ির কাজের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের ড্রাইভার আছে। কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে বাবলু। একটু দূরে শুকনো মুখে নাজমুল ভাই দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন –তল্লাসি আড়ালে করলে হত না?

পান্নাভাবী ফোঁস করে বললেন –চুরি আড়ালে করা হয়। তল্লাসি আড়ালে হয় না। তোমার বাড়তি মায়া কেন? তোমার খারাপ লাগলে চলে যাও। তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলেছে?

নাজমুল ভাই চলে যেতে ধরলেন। পান্নাভাবী বললেন, না, তুমি যাবে না। তুমি দাঁড়াও। নাজমুল ভাই দাঁড়িয়ে পড়লেন।

রাণীর বিছানায় কিছু পাওয়া গেল না। ট্রাঙ্ক খোলা হল। ট্রাঙ্কের এক কোণে রুমালে মোড়া পান্নাভাবীর সোনার বালা পাওয়া গেল। রাণী চেঁচিয়ে কাঁদতে শুরু করল। পান্নাভাবী বালাটার দিকে হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছেন।

বাবলু বলল, এমি এমি ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না ভাবী। পুলিশে হ্যান্ডঅভার করে দিতে হবে।

পান্নাভাবী কঠিন গলায় বললেন, তুই চুপ করে থাক। কি করতে হবে না করতে হবে আমি জানি। এই রাণী, মরাকান্না কাঁদবি না। খবর্দার।

রাণী কাঁদতে কাঁদতে বলল, আম্মা, আমি কিছুই জানি না।

তোকে কিছু জানতে হবে না। কাঁদতে হবে না। তুই চলে যা। তোকে যেন এ বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি।

পান্না ভাবী তাকে এক মাসের বেতন দিয়ে দিলেন। রোজার ঈদের আগে একবার এসে জাকাতের শাড়ি নিয়ে যেতে বললেন। নাটকের অবসান ঘটিয়ে আমাকে বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে –রাত্রি, আমার সঙ্গে একটু আস। ছাদে আস।

কথা শোনার জন্যে ছাদে যেতে হবে কেন? এইখানেই বলুন।

না, এখানে বলা যাবে না –জরুরী কথা। অসম্ভব জরুরী।

আমি বিরক্তমুখে পান্নাভাবীর অসম্ভব জরুরী কথা শোনার জন্যে ছাদে গেলাম। সকালের কড়া রোদে আমার কখনো ছাদে যেতে ইচ্ছা করে না। ছাদ হল রাতের জন্যে। সকালের জন্যে বারান্দা এবং দুপুরের জন্যে দরজা-জানালা বন্ধ ঘর।

আপনার জরুরী কথাটা কি পান্নাভাবী?

রাণীকে বিদেয় করে দিলাম।

 সে তো দেখতেই পেলাম।

কোন একটা বড় অজুহাত না দিয়ে তো বিদায় করা যায় না –এই জন্যেই চুরির ব্যাপারটা নিয়ে এসেছি।

ও তাহলে চুরি করেনি?

না, হাতের বালাটা রুমালে ঢুকিয়ে আমি এর ট্রাঙ্কে রেখে দিয়েছিলাম। মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র খারাপ হলেও চুরির অভ্যাস নেই।

ভাবী, এরকম একটা নোংরা কাজ কেন করলেন?

সেটাই তোমাকে বলার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছি। তোমার ভাইকে শায়েস্তা করার জন্যে এটা করেছি। তোমার ভাইকে বলেছি রাণীর প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ এসেছে। এবং আমি তোমার ভাইকেই সন্দেহ করছি। এতে হবে কি –সারাজীবন সে ভয়ে আধমরা থাকবে।

তাঁর দায়দায়িত্ব থাকলে তবেই ভয়ে আধমরা থাকবেন। তাঁর কোন দায়-দায়িত্ব নেই যখন তখন যা হবে –তিনি ক্রমেই আপনাকে অপছন্দ করতে থাকবেন।

তুমি এরকম আজেবাজে কথা বলবে না।

ভাবী, আমি কোন আজেবাজে কথা বলছি না। যা সত্যি সেটাই বলছি। একটা মানুষকে আপনি ক্রমেই দেয়ালের দিকে চেপে ধরছেন। এক সময় তার নিঃশ্বাস নেবার জায়গাও থাকবে না। তখন ভয়াবহ ব্যাপার হবে।

কি ভয়াবহ ব্যাপার হবে? সে আমাকে মেরে ফেলবে?

না, তা উনি করবেন না। মানুষের স্বভাব অতি বিচিত্র। এত কিছুর পরেও তিনি আপনাকে ভালবাসেন। সেই ভালবাসার কারণে আপনি বেঁচে যাবেন। সমস্যা হবে তাঁর। তিনি নিজে ভয়ংকর কিছু করে বসবেন। একদিন দেখবেন ফ্যানের সিলিং-এ ঝুলছেন, কিংবা ছাদ থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে গেছেন।

পান্নাভাবী কঠিন গলায় বললেন, তোমার এত বুদ্ধি, তোমার এত বিবেচনা কিন্তু নিজের সংসারে এই বুদ্ধি-বিবেচনা কাজে লাগল না কেন? তোমাকে কেন গলাধাক্কা। দিয়ে বের করে দিল?

আমি অবাক হয়ে পান্নাভাবীর দিকে তাকিয়ে আছি। তাকে এখন দেখাচ্ছে ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মত। কুদ্ধ বাঘিনী কেমন দেখতে আমি জানি না কিন্তু পান্নাভাবীর রাগে টকটকে লাল হওয়া মুখ আর বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে বাঘিনীর কথাই মনে পড়ল।

রাত্রি শোন –তোমাকে আমি ছোটবোনের মত দেখি –তোমাকে স্নেহ করি। সেই জন্যেই এতদিন কিছু বলিনি –কিন্তু তলে তলে তুমি কি করছ তা-কি আমি জানি না? ভাল করেই জানি।

আমি কি করছি?

রাত দুটা-তিনটায় তোমার নাজমুল ভাইয়ের সঙ্গে গুজগুজ, ফুসফুস-এর অর্থ কি আমি জানি না? আমি ঠিকই জানি।

প্লীজ ভাবী, আপনি চুপ করুন। আপনি কি বলছেন আপনি নিজে বুঝতে পারছেন না?

আমি কচি খুকী। আমি এখনো বোতলে করে দুদু খাই। কাজেই আমি কিছু বুঝতে পারি না। আর তুমি সব বোঝ। সব জান। তুমি ভেবেছে কি? এত সহজে তোমাকে ছেড়ে দেব? হাটে হাড়ি ভেঙে দেব না? আমাকে এত সহজ মেয়ে মনে করবে না। তুমি আমার সংসার ভেঙেছ। আমিও তোমার সংসার ভাঙব।

ভাবী, আমার কোন সংসার নেই, কাজেই ভাঙার প্রশ্ন আসে না। তাছাড়া আপনার সংসার ভাঙেনি। ভাঙার কোন সম্ভাবনা নেই।

পান্নাভাবীর চোখ জ্বলছে। হাত-পা কাঁপছে। এ কী ভয়ংকর অবস্থা!

শোন রাত্রি, আমার সংসার ভাঙার জন্যে আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি– তুমি কোনদিন তোমার ছেলেকে কাছে পাবে না। কোনদিন না। কোনদিন না।

আমি পান্নাভাবীর কথায় রাগ করলাম না। সহজ গলায় বললাম– ছেলেকে কাছে না পেলে না পাব। আপনি দয়া করে শান্ত হোন।

পান্নাভাবী হাউমাউ করে কাঁদছেন। আমি নিচে চলে এলাম। পান্নাভাবীর পাশে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকার কোন অর্থ হয় না। বাবাকে নিয়ে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে। যেতে হবে। তার চোখে না-কি সমস্যা হচ্ছে। ভাল দেখতে পাচ্ছেন না। তার নিজের কোন অভিযোগ নেই। টিভি ছেড়ে তিনি টিভির সামনে বসে থাকেন। কিন্তু তার চোখ-মুখ দেখ মনে হয় তিনি কিছু দেখছেন না।

ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের ডাক্তার বললেন –আপনার চেখের অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি তো কিছুই দেখছেন না। এতদিন আসেননি কেন?

বাবা বললেন, আমার তেমন অসুবিধা হচ্ছে না।

চোখে দেখচ্ছেন না আর আপনার অসুবিধা হচ্ছে না এসব আপনি কি বলছেন?

অনেক তো দেখলাম। আর কত? আমার কোন আফসোস নেই ডাক্তার সাহেব। আমি ভাল আছি। সুখেই আছি।

আপনিই খুবই অদ্ভুত কথা বলছেন– যাই হোক, সেটা আপনার ব্যাপার– আমার যা বলার বলি। আপনার বা চোখে এখনো কিছু দৃষ্টিশক্তি আছে। তবে ছানি পড়েছে। ছানি কেটে দিতে হবে। আপনি অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হবেন।

জি আচ্ছা, হব।

বাবাকে নিয়ে রিকশায় করে ফিরছি। বাবা ডান হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। ভাবটা এরকম যেন রিকশা থেকে ঝাঁকুনি খেয়ে পড়ে গেলে আমাকে রক্ষা করবেন।

খুকী?

জ্বি বাবা।

সুন্দর একটা সংসার শুরু করেছিলাম। সব একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। চোখ দিয়ে আমি কি করব বল? কি দেখব আমি?

সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। বাবলুর বিয়ে হলেই সংসারের চাকা ঘুরে যাবে।

 এই কথা কেন বলছিস?

আমার মন বলছে। বীনু মেয়েটার ভেতর সংসার সাজানোর ক্ষমতা আছে। ও যেখানে থাকবে সেখানেই আনন্দ তৈরি হবে।

তোর মধ্যেও তো সেই ক্ষমতা ছিল।

হ্যাঁ আমার মধ্যেও ছিল। ক্ষমতা কাজে লাগানোর ব্যাপার আছে। সবাই ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারে না। বীনু পারবে। কাজেই চোখ ঠিক করতে হবে। ওদের সাজানো সংসার তোমাকে দেখতে হবে না?

তা তো হবেই। খুকী!

 জ্বি বাবা।

একটু পার্কের দিকে বেড়াতে যাবি? তোরা তো জানিস না তোর মার এই একটা শখ ছিল –আমাকে নিয়ে পার্কে ঘোরা। তোরা শুনলে হাসাহাসি করবি। এই জন্যে তোদের লুকিয়ে সে পার্কে যেত। গাছপালা তার এত পছন্দ ছিল!

চল পার্কে যাই। বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবে?

চল যাই। আরেকটা কথা তোকে বলি খুকী– ডাক্তার আমার চোখ যত খারাপ বলছে আমার চোখ তত খারাপ না। রাতে দেখতে কষ্ট হয় কিন্তু দিনের বেলা আমি ভালই দেখি।

আমাকে দেখতে পাচ্ছ?

অবশ্যই পাচ্ছি।

বাবা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি সম্ভবত ডুব দিয়েছেন নিজের জগতে। সব মানুষকেই কখনো না কখনো নিজের জগতে ডুব দিতে হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই জগতে ডুবে থাকার সময় ক্রমেই বাড়তে থাকে। মৃত্যু বোধহয় পুরোপুরি ডুবে যাওয়া। বাবার এই নিজস্ব জগক্টা কেমন কে জানে! আজকাল আমার জানতে ইচ্ছে করে। খুব জানতে ইচ্ছে করে। বাবা গাঢ় স্বরে বললেন, ও খুকী!

কি বাবা?

তোকে নিয়ে ঘুরছি। খুব ভাল লাগছে রে মা।

ভাল লাগলে আজ সারাদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসে থাকব। আর পথে পথে হাঁটব।

বাবা এক হাতে চোখ মুছলেন। গভীর আনন্দে তার চোখে পানি এসেছে কি না বুঝতে পারছি না। আজকাল এম্নিতেই তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ে।

.

১০.

আমি দোতলার বারান্দা থেকে দেখলাম ইস্তিয়াক, বাবলু এবং বীনু গজফিতা নিয়ে টানাটনি করছে। মাঝ-উঠোনে একটা টেবিল বিছানো হয়েছে। সেই টেবিলে। পেপারওয়েটে চাপা দেয়া কিছু কাগজপত্র, একটা পেনসিল। ইস্তিয়াক মাঝে মাঝে টেবিলের কাছে যাচ্ছে –কি সব লিখছে আবার মাপামাপি হচ্ছে। শুরুতে শুধু ইস্তিয়াক এবং বাবলু ছিল। বীনু এসেছে কিছুক্ষণ আগে। সে দোতালায় উঠতে যাচ্ছিল, বাবলু ধমকের মত গলায় বলল, বীনু, ফিতার মাথাটা ধর তো।

আমি দোতলা থেকে বীনুর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না, সে সম্ভবত হাসল, কারণ বাবলুর কঠিন গলা শুনলাম, হাসছ কেন? একটা কাজ করতে বলছি এর মধ্যে হাসির কি আছে? না-কি ফিতার মাথা ধরলে মানহানি হবে।

বীনুর গলা শুনলাম। সে বলল, মানহানি হবে না, দিন ধরছি।

বাবলু বলল, এ হচ্ছে ইস্তিয়াক। স্কলার ছেলে। ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। ডিজাইন বলে একটা ব্যাপার আছে, সেই ডিজাইনে রেকর্ড মার্ক পেয়েছে। ইস্তিয়াক আমার বাড়ির প্ল্যান করে দিচ্ছে। একটা পয়সা নিচ্ছে না।

বীনু বলল, এত সুন্দর বাড়ি আপনারা ভেঙে ফেলবেন?

বাবলু বিরক্ত গলায় বলল, সুন্দরের তুমি কি দেখলে? অন্ধকার বাড়ি। আলো নেই, বাতাস নেই, চারদিকে ঘর।

আমার এরকম বাড়িই ভাল লাগে।

তোমার ভাল লাগলে তো হবে না। সবার ভাল লাগতে হবে। তুমি আবার কোথায় রওনা হলে?

আপার সঙ্গে দেখা করে আসি।

আপা তো পালিয়ে যাচ্ছে না। কাজের মাঝখানে চলে যাওয়া আমার খুবই অপছন্দ।

আচ্ছা যাচ্ছি না। এখন কি করতে হবে বলুন?

ইস্তিয়াক যাই বলবে তুমি তাই করবে। আমি এই ফাঁকে চট করে দোকান থেকে চা নিয়ে আসি। ইস্তিয়াকের আবার মিনিটে মিনিটে চা লাগে। আপাকে কতবার আর বলব?

আমি দেখলাম বাবলু ফ্লাস্ক নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে যাচ্ছে। সে যে কি আনন্দে আছে তা দূর থেকেও আমি বুঝতে পারছি। ইস্তিয়াক ছেলেটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। এই ছেলে বাবলুর ভেতর স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে। স্বপ্ন তৈরি করা সহজ ব্যাপার না। বড় লেখক, বড় কবি এবং মহাপুরুষরাই শুধু স্বপ্ন জাগাতে পারেন।

বীনু এতক্ষণ পর আমাকে দেখল। হাসল। আমি বললাম, কি খবর বীনু?

আপা, আপনি নাকি আমাকে খবর দিয়েছেন, খুব জরুরি?

আমি হাসলাম। বীনু সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল।

 জরুরি খবরটা কি?

আমি আবারও হাসলাম। বীনু বলল, বাবলু ভাই যে মিথ্যেমিথ্যি আমাকে আসতে বলেছেন সেটা তখনি বুঝেছি।

বেশি বেশি বুঝা ভাল না বীনু। যারা বেশি বুঝে তাদের অনেক সমস্যা।

যারা কম বুঝে তাদের আরো অনেক বেশি সমস্যা।

আমার ভাইটাকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?

বীনু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসল। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, ইস্তিয়াক সাহেব কি উনার বন্ধু?

এখন তো সেরকমই মনে হচ্ছে। তবে সম্পর্কটা ঠিক বন্ধুর মত না। অনেকটা গুরু-শিষ্যের মত। ইস্তিয়াককে সে পীরের মত দেখছে।

আমারও তাই মনে হয়েছে।

বাবলু চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে এসে আবার বের হয়ে গেছে। তার অতি ব্যস্ত ভঙ্গি। নিশ্বাস ফেলার সময়ও নেই এমন ভাব। আমি নিচে নেমে এলাম। আমারও দোকানের চা খেতে ইচ্ছা করছে। চা খেতে খেতে ইস্তিয়াকের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা যাক। নিজের কাজকর্ম ফেলে ও যে ভাবে আমাদের এখানে পড়ে আছে দেখে মায়াই লাগে।

ইস্তিয়াকের খবর কি?

তেমন কোন খবর নেই আপা। মোটামুটি ড্রয়িং একটা পঁড়া করিয়েছি। এক সপ্তাহের মধ্যে ফাইনাল করে ফেলব।

কি রকম হচ্ছে ডিজাইন?

সহজ, কিন্তু সুন্দর। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কেউ চোখ বড় বড় বলবে না — আরে, এটা কি? আবার বাড়িটার দিকে না তাকিয়ে কেউ চলে যাবে তাও হবে না।

জিনিসটা হবে কেমন?

একতলায় অর্ধেক হবে ফাঁকা। গাড়ির গ্যারেজ, বাকি অর্ধেকে বাবলু সাহেবের ভিডিও, স্টুডিও, কিছু দোকানপাট। দোতলা, তিনতলা, চারতলায় এ্যাপার্টমেন্ট। প্রতি দোতলায় দুটা করে মোট ছটা। ছাদটা হবে রিক্রিয়েশন স্পট।

সেখানে কি থাকবে?

একটা সুইমিং পুল থাকবে, ব্যাডমিন্টন কোর্ট এবং টেনিস কোর্ট থাকবে। হেথ ক্লাব থাকবে।

বল কি?

আরো আছে– বাচ্চাদের একটা সেকশন আছে

 তুমি দেখি ভয়াবহ কাণ্ডকারখানা শুরু করেছ।

ভয়াবহ কিছু করছি না আপা। আমি যা করছি তা হল অসম্ভব সুন্দর একটা ডিজাইন দিয়ে যাচ্ছি। যদিও জানি আপনারা এই বাড়ি কখনোই ভাঙবেন না।

ইস্তিয়াকের কথায় আমি চমকালাম। আমার চমক ইস্তিয়াকের চোখ এড়াল না। সে সহজ গলায় বলল, আপনারা কেন এই বাড়ি ভাঙবেন না সেটাও আমি জানি। এই বাড়ি ঘিরে আপনাদের অনেক স্মৃতি। বাড়ি ভাঙা মানে স্মৃতি নষ্ট করে ফেলা। স্মৃতির ব্যাপারে মানুষ খুব স্পর্শকাতর। সে সবকিছু নষ্ট করতে রাজি, স্মৃতি নষ্ট করতে রাজি না। এ ছাড়া আছে সাহসের অভাব। অভ্যস্ত পরিবেশ থেকে নতুন পরিবেশে যেতে যে সাহস লাগে আমাদের সেই সাহস নেই বললেই হয়।

বীনু বলল, আপনি যখন নিশ্চিত এই বাড়ি ভাঙা হবে না তাহলে কষ্ট করে ডিজাইন করছেন কেন?

করছি, কারণ ডিজাইন শেষ করবার পর, ডিজাইন দেখিয়ে আমি আপনাদের বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে প্রভাবিত করতে পারব ভেবেই করছি। আমার আত্মবিশ্বাস প্রবল।

আমি বললাম, তুমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে — দাঁড়িয়ে আছ। চা খাচ্ছ না।

ইস্তিয়াক বলল, আমি চা একেবারেই খাই না। বাবলু সাহেবকে এই কথা কয়েকবার বলেছি, তারপরেও কেন জানি উনার মাথায় ঢুকে গেছে আমি মিনিটে মিনিটে চা খাই। উনি চায়ের কাপ আমার হাতে দেন। আমি এক-দুচুমুক খেয়ে। ফেলে দেই। চা-টা যে আমি ফেলে দিচ্ছি সেটাও উনার চোখে পড়ছে না।

আমি বললাম, ইস্তিয়াক! তুমি আজ দুপুরে আমাদের সঙ্গে খাবে। তেমন কিছু না, আমরা যা খাই তাই খাবে। ডাল ভাত। ভাল কথা, বাবলু কি তোমার সঙ্গে বীনুর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে?

না, পরিচয় করিয়ে দেননি। তবে উনার কথা শুনেছি।

কোথায় শুনেছ?

 বাবলু সাহেব বলেছেন।

 বীনু বিস্মিত হয়ে বলল, কি বলেছেন?

বলেছেন –বীনু মেয়েটার বিশ্রী কিছু অভ্যাস আছে। রাতের বেলা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করা। রোজ রাতে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে। চুল শুকায় না –ঠাণ্ডা লেগে যায়। আপনি নাকি দুদিন পরে পরেই জ্বরজারি বাঁধিয়ে ফেলেন।

আমি তাকালাম বীনুর দিকে। সে খুব লজ্জা পাচ্ছে। আবার খুব আনন্দও পাচ্ছে। লজ্জা ও আনন্দে তার চোখ চকচক করছে।

ইস্তিয়াক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপা, আপনি আমার একটা কথা মন দিয়ে শুনুন। বাড়ি ভেঙে ফেলুন। ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা আমি করে দেব। এর ফল শুভ হবে।

আমি চাপা গলায় বললাম, বাড়ির দক্ষিণে যে বকুল গাছ আছে সেই বকুলতলায় আমার মার করব আছে।

আপনার মা মাটির নিচে বাস করছেন না। তাঁর শরীর মাটিতে মিশে গেছে। তার পরেও বলছি –আপনার মার কবরের জায়গাটার উপর কোন স্ট্রাকচার উঠবে না। ডিজাইনে এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

ইস্তিয়াক এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন এই মুহূর্তেই সে আমার কাছ থেকে হ্যাঁ বা না জাতীয় কিছু শুনতে চায়। তাও কি সম্ভব?

ইস্তিয়াক বলল, আপা, কিছু বলুন।

আমি বললাম, এই বাড়ি ভাঙা হবে না। আমার বা বাবার আপত্তির কথা তুমি বাদ দাও। বাবলুও কখনো এই বাড়ি ভাঙতে পারবে না। ধর, বাড়ি ভাঙার জন্যে মিস্ত্রী ডাকা হল। মিস্ত্রী যেই মুহূর্তে শাবলের একটা ঘা দেবে সেই মুহূর্তে বাবলু ছুটে এসে বলবে– না না, থাক থাক। যেমন আছে তেমন থাক।

আপনার এই ধারণার কারণ কি?

এই ধারণার মূল কারণ হল –মানুষ হিসেবে আমি এবং বাবা, আমরা দুজনই অনেক আধুনিক। বাবলু সেই তুলনায় অনাধুনিক ওর বয়স তো কম হয়নি –এই বয়সেও সে খুব কষ্ট পেলে কি করে জান? মার কবরের কাছে চলে যায়। বিড় বিড় করে মাকে তার কষ্টের কথা বলে। যে ছেলে এই কাজ করে সে কোন দিনই তার সারাজীবনের স্মৃতির বাড়ি ভাঙবে না।

ইস্তিয়াক বলল, আপা, আপনি যা বললেন তা ঠিক না। বাবলু সাহেবের মনে। নতুন বাড়ির ছবি ঝলমল করছে। তিনি এক ধরনের ঘোরের মধ্যে চলে এসেছেন। ঘোরের কারণেই বাড়ি ভাঙতে তিনি আপত্তি করবেন না। বাড়ি তৈরি হলে পর ঘোর কাটবে। তখন হয়ত মন খারাপ হবে। সেই মন-খারাপও সাময়িক ব্যাপার হবে। আপনি কি আমার সঙ্গে বাজি রাখবেন?

না, আমি বাজি রাখব না। বাজি রাখলেই হারব। আমি কখনো বাজি জিততে পারি না।

.

১১.

বাবাকে আজ চোখের হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি খানিকটা ভয় পেয়েছেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠেই বললেন, অপারেশনটা না করালে হয় না? আমি তো তেমন প্রয়োজন দেখছি না। ভালই দেখি তো। ডাক্তাররা সব কিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে।

তোমার কি ভয় লাগছে বাবা?

নাহ।

ভয়ের কিছু নেই। চোখের ছানি কাটিয়ে অপারেশন কোন অপারেশন না।

তুই তো মা ডাক্তারের মত কথা বলছিস।

তোমার যদি খুব বেশি ভয় লাগে তাহলে আজ যেতে হবে না। আরেকদিন যাবে।

না না, আজই যাব।

বাবা গম্ভীর হয়ে বারান্দায় বসে রইলেন। তিনি যেমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসেন সেরকম বসা না –শক্ত হয়ে বসে থাকা। যেন মেহমান হিসেবে এসেছেন। আমি বললাম, বাবা, তোমাকে তো বিকেলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। তুমি সকাল থেকেই বারান্দায় এমন শক্ত হয়ে বসে আছ কেন? বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম কর।

শুতে ইচ্ছা করছে না। বসে থাকতে ভালই লাগছে।

 বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে এই খবর আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা জেনে গেছেন। ঢাকায় আমাদের আত্মীয়-স্বজন তেমন নেই। যারা আছেন, তারা সবাই একবার করে দেখে ফেলেছেন। কেউ আবার কলা-টলাও নিয়ে আসছেন। একজন হরলিক্স নিয়ে এলেন।

আত্মীয়-স্বজন আমাদের বাড়িতে এলে আমার ভাল লাগে না। অবধারিতভাবে তারা আমার দুঃখময় জীবন নিয়ে আফসোস করেন। আফসোস করাটা তাঁরা দায়িত্ববোধের কারণেই করেন। কঠিন গলায় মামুনের কিছু সমালোচনা করা হয়। লোকটা পিশাচ না শয়তান এ নিয়ে গবেষণা হয়। কেউ কেউ আমাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করেন। আমার সান্ত্বনার প্রয়োজন নেই এই কথাটা কেউ বুঝতে চান না। এই ভাবে জীবন পার করা উচিত না — বিয়ে করা উচিত। যা ঘটেছে, ঘটেছে। এটা। নিয়ে বসে থাকলে তো হবে না।

আমার দূর সম্পর্কের এক চাচা আছেন যার কাজই হচ্ছে আমার বিয়ের জন্যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ছেলের খোঁজ আনা। একবার এক ছেলের খোঁজ আনলেন। সে অষ্ট্রেলিয়ায় থাকে। বেলজিয়ামের ছেলে। বাংলাদেশে অনেকদিন ছিল। ভাল বাংলা জানে। বাঙালী মেয়েদের তার খুব পছন্দ। সে একটা বাঙালী ডিভোর্সড মেয়ে বিয়ে করতে চায়।

আমি বললাম, ডিভোর্সড কেন? কুমারী মেয়ে বিয়ে করতে অসুবিধা কি?

অসুবিধা কি তা তো এত ডিটেল জানি না। তুই রাজি থাকলে তখন না হয় খোঁজ-খবর করব।

এই জাতীয় মানুষদের পছন্দ করার কোনই কারণ নেই। এদের অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবারও উপায় নেই। বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হবে এই খবরে যারা উদ্বিগ্ন হয়ে আসছেন সঙ্গত কারণেই হাসিমুখে তাদের সঙ্গে আমার কথা বলতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যতই দিন যাচ্ছে ততই আমি অভিনয় কলায় পারদর্শী হয়ে উঠছি। কি সুন্দর অভিনয় করে যাচ্ছি! যে আসছে তার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলছি।

বিকেলে বাবাকে নিয়ে বেরুবার আগে আগে পান্নাভাবী এলেন। আমার সঙ্গে রাগারাগি হৈচৈ-এর পর এই প্রথম তিনি আমাদের বাড়িতে এলেন। বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে বললেন –চাচা, আপনি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন কেউ আমাকে এই খবর দেয়নি। আপনাদের বাসায় সকাল থেকে লোকজন আসছে কেন খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম। আমরা কি আপনার পর?

বাবা অপ্রস্তুত গলায় বললেন, না না, তোমরা পর হবে কেন মা?

আপনারা বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি বানাচ্ছেন। বাড়ি ভাঙলে আমরা যাব কোথায়? আমরা কিছুই জানি না। এদিকে বাড়ি ভাঙা হচ্ছে।

বাবা আমার দিকে তাকালেন। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।

পান্নাভাবীর চোখে পানি এসে গেল। তিনি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন –আমার বাবা নেই, আপনাকে বাবার মত দেখে এসেছি।

তা তো বটেই, তা তো বটেই।

রাত্রিকে আমি নিজের বোনের চেয়েও আপন জানি। সে আমার সঙ্গে কথা বলে না।

বাবা আবারও অসহায়ের মত তাকালেন আমার দিকে। পান্নাভাবী আরো শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। আমি বললাম, ভাবী, এখন আমাদের রওনা হতে হয়। পাঁচটার আগেই বাবাকে হাসপাতালে নিতে বলেছে।

আমি চাচাজানের সঙ্গে দুটা কথা বলব। চাচাজান শুনুন– আপনি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মানুষের জীবন-মরণের কোন ঠিক নেই। কাজেই আপনাকে আমি সব কথা বলতে চাই –আমি রাত্রির সামনেই বলব –আমি কোন লুকোছাপা করব না। আমি লুকোছাপার মেয়ে না –আমি কাউকে কেয়ারও করি না। কেন কেয়ার করব? কার জন্যে কেয়ার করব– যে মেয়ের স্বামী থেকেও নেই সে কেন ..

পান্নাভাবীর কথা শেষ হবার আগেই নাজমুল ভাই চলে এলেন। পান্নাভাবী তাকে দেখে চুপ করে গেলেন। এরকম কখনো হয় না।

নাজমুল ভাই শান্ত গলায় বললেন –পান্না, তুমি ঘরে যাও।

পান্নাভাবী আপত্তি করলেন না। চোখ মুছে বের হয়ে গেলেন।

নাজমুল ভাই বললেন, আপনাদের হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে আমি গাড়ি রেখে দিয়েছি। চলুন দিয়ে আসি। পান্নার কোন কথাতেই আপনারা কিছু মনে করবেন না। ও পুরোপুরি অসুস্থ। চিকিৎসা শুরু হয়েছে। ডাক্তাররা চিকিৎসা করছেন।

বাবা কখনো কিছু জানতে চান না। এখনো জানতে চাইলেন না। নাজমুল ভাইয়ের গাড়িতে করেই আমরা হাসপাতালে গেলাম। নাজমুল ভাই বসলেন ড্রাইভারের পাশে। আমি বাবাকে নিয়ে পেছনের সীটে। আমি সারাক্ষণই বাবার হাত ধরে থাকলাম। এক সময় বললাম –ভয় লাগছে বাবা?

বাবা বললেন, হ্যাঁ।

বাবা তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। মনে হচ্ছে খুব আগ্রহ নিয়ে তিনি জনস্রোত দেখছেন।

.

আমার ইচ্ছা ছিল বাবার সঙ্গে রাতে হাসপাতালে থাকব। বাবা কিছুতেই তা করতে দিলেন না। তিনি একা থাকবেন। বাবাকে ভর্তি করিয়ে নাজমুল ভাইয়ের গাড়িতে করেই আমি ফিরে আসছি। নাজমুল ভাই ফেরার সময়ও ড্রাইভারের পাশে বসতে যাচ্ছিলেন –আমি বললাম, আপনি পেছনে আসুন নাজমুল ভাই। গল্প করতে করতে যাই। নাজমুল ভাই পেছনে এসে বসলেন ঠিকই। কিন্তু কোন গল্প গুজবে গেলেন না। সারা পথ চুপ করে রইলেন। বাড়ির কাছাকাছি যখন এসেছি। তখন খুব নিচু গলায় বললেন –তোমার পান্নাভাবীর এখন ধারণা হয়েছে। হাসপাতালে তার একটি মেয়ে হয়েছিল। মেয়েটি চুরি হয়ে যায়। এই ঘটনা সবাই মিলে তার কাছ থেকে গোপন করেছে।

নাজমুল ভাই ছোট করে নিঃশ্বাস ফেললেন।

আমি বললাম, আপনি চিন্তা করবেন না নাজমুল ভাই। সমস্যা আসে, সমস্যা চলেও যায়। পান্নাভাবীর এই সমস্যা দূর হয় যাবে। কত ভাল চিকিৎসা এখন বের হয়েছে। আপনি ভাবীকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যান।

নাজমুল ভাই ক্লান্ত গলায় বললেন –তাই করব। ডাক্তারও সে রকম সাজেস্ট করেছেন। আমি ওকে নিয়ে নেপাল যাচ্ছি।

খুব ভাল করছেন। আপনি আরেকটি কাজ করুন –আপনার সব বইপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুরো সময়টা ভাবীকে দিন। শরীরের অসুখের অসংখ্য চিকিৎসা আছে। মনের অসুখের একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে মমতা, ভালবাসা। আপনি ভালবেসে পান্নাভাবীর হাত ধরুন, দেখবেন তাঁর অর্ধেক অসুখ সেরে গেছে।

ওকে আমি কি পরিমাণ ভালবাসি তা তুমি জান না রাত্রি।

আপনি ঠিক বলেননি নাজমুল ভাই। আপনার ভালবাসা থাকলে আজ ভাবীর এই অবস্থা হত না।

নাজমুল ভাই তাকিয়ে আছেন। বিরক্ত চোখেই তাকিয়ে আছেন। আমি তার বিরক্তি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললাম– পান্নাভাবী আপনার সম্পর্কে কিছু নোংরা কথাও বলেন। সেই কথাগুলিও সত্যি বলেই আমার ধারণা।

নাজমুল ভাই শান্ত গলায় বললেন, গাড়িতে একজন ড্রাইভার আছে। আমি চুপ করে গেলাম।

পান্নাভাবীর কথাগুলি যে সত্য তা জোর গলায় বলার পেছনে আমার কারণ। আছে। উনার সঙ্গে প্রচণ্ড রাগারাগি হবার পর সেই রাতেই তিনি আমার কাছে একটা খাম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই খামে রাণীর প্রেগনেন্সি রিপোর্ট, সঙ্গে ছোট্ট চিঠি –রাত্রি, রিপোর্টটা দেখ। পজেটিভ। শুরুতে তোমাকে অন্যকথা বলেছিলাম। তোমার নাজমুল ভাইকে ছোট করতে ইচ্ছা করছিল না বলেই। তোমার সঙ্গে রাগারাগির জন্যে আমি মোটেও দুঃখিত নই। দয়া করে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে না। আমি কোন কথা বলতে আগ্রহী না।

.

বাসায় এসে দেখি বাবলু ফিরেছে। সে খুব উত্তেজিত। তার উত্তেজনার প্রধান কারণ ইস্তিয়াক প্ল্যান দিয়ে দিয়েছে। ডিআইটি এ্যালুভেলের জন্যে দেয়া এগারো কপি প্ল্যান। সেই সঙ্গে বাড়িটি তৈরি হবার পর কেমন দেখাবে সেই মডেল।

বাবলু বলল, কি অসাধারণ কাজ করেছে দেখেছিস আপা?

আমি বললাম, হ্যাঁ দেখলাম।

 রাতদিন খেটে কাজটা করেছে। চলে যাবে তো — এই জন্যেই করা।

কোথায় যাবে?

কানাডায় চলে যাচ্ছে। হাইরাইজ বিল্ডিং টেকনিকে পি-এইচ. ডি করবে। আপা, মডেলটা দেখ– মডেলটা করতে ওর নিশ্চয়ই অনেক টাকা লেগেছে। এই টাকাটা ওকে দিয়ে দেয়া দরকার। তাই না?

হ্যাঁ।

কত টাকা লেগেছে মডেলে জেনে নেয়া দরকার। জিজ্ঞেস করা হয়নি।

আমি অবাক হয়ে বাবলুকে দেখছি। বাবাকে আমি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে এসেছি। এই সম্পর্কে সে কিছুই জানতে চাচ্ছে না। আশ্চর্য কাণ্ড! সে কাপড় পরছে –ইস্তিয়াকের কাছেই যাচ্ছে বোধহয়।

কোথায় যাচ্ছিস?

মডেলটা বীনুকে দেখিয়ে আনি। ও খুব খুশি হবে। ওর দারুণ আগ্রহ। ভাবছি ইস্তিয়াককে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ও যেতে চাইবে কিনা কে জানে। ও সঙ্গে গেলে সুন্দর করে সব কিছু এক্সপ্লেইন করতে পারত। ভাল কথা আপা, তোর একটা চিঠি আছে। টেবিলে রেখে দিয়েছি –এক লোক এসে দিয়ে গেছে।

কার চিঠি?

জানি না কার। জিজ্ঞেস করিনি। আপা শোন, আমি ঠিক করেছি ডিআইটি প্ল্যান কালই জমা দিয়ে দেব। কাল ভাল দিন আছে– শুক্রবার।

শুক্রবারে অফিস বন্ধ থাকার কথা না?

ও আচ্ছা আচ্ছা। ভুলে গেছি। এত খুশি লাগছে, বুঝলি আপা –মাথা আউলা হয়ে গেছে — হা হা হা।

.

দামী খামের ভেতর ছোট্ট চিঠি। মামুন লিখেছে —

রাত্রি,
টুকুন এসেছে। কাল ভোরে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। সারাদিন থাকুক। রাতে থাকতে চাইলেও রেখে দিতে পার। ব্যাগে অষুধপত্র আছে। কোন্টা কখন খাওয়াতে হবে তা লিস্ট করা আছে। ভাল থেকো।
–মামুন

এটা কি স্বপ্ন? আমি কি স্বপ্ন দেখছি। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে –অপ্রত্যাশিত যে আনন্দ আমি এই মুহূর্তে পেলাম সেই আনন্দের জন্যে আমি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিতে পারি।

টুকুন আসছে! টুকুন!

কত বড় হয়েছে টুকুন? তিন বছরে একটা শিশু কত বড় হয়? ও আমাকে দেখে প্রথম বাক্যটা কি বলবে? ও কি আমাকে লজ্জা পাবে? অষুধপত্রের কথা বলছে কেন? ওর কি অসুখ? আমার বাবুর অসুখ হবে কেন?

আমি সারারাত বারান্দায় বসে রইলাম। অসহ্য যন্ত্রণায় শরীর জ্বলছে। সেই যন্ত্রণাতেও তীব্র আনন্দ।

ঢাকা শহরের সব মানুষ ঘুমুচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে যাই। ওদের ঘুম ভাঙিয়ে বলি –আপনারা ঘুমুচ্ছেন কেন? টকুন আসছে। টুকুন। আপনারা কেউ ঘুমুতে পারবেন না। আপনাদের সবাইকে জেগে থাকতে হবে।

.

১২.

দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে টুকুন দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে ধবধবে শাদা প্যান্ট, শাদা শার্ট। পায়ের জুতাজোড়াও শাদা –কিন্তু মোজা টকটকে লাল। তার হাতে একটা ইংরেজি ছড়ার বই। তার পাশে নীল রঙের বড়সর একটা ব্যাগ। আমি দোতলার সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি।

টুকুন বোধহয় লজ্জা পাচ্ছে। সে সরাসরি আমার দিকে তাকাচ্ছে না। একবার তাকিয়েই চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। উঠোনে দুটা কাক বসেছে। সে এখন তাকিয়ে আছে কাকের দিকে।

আমি ডাকলাম –টুকুন!

টুকুন চমকে আমার দিকে তাকিয়ে আবার কাক দেখতে লাগল। আমি সিঁড়ির মাথাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে আমার পা জমে গেছে। আমি নড়তে পারছি না।

টুকুন, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?

সে কাকের দিকে তাকিয়ে থেকেই হা-সূচক মাথা নাড়ল।

আমি কে বল তো?

সে উত্তর দিল না। কাকটা উড়ে গিয়ে রান্নাঘরের বারান্দার কার্নিশে বসেছে। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে সেদিকে। কোন রকম আবেগ এই মুহূর্তে দেখানো ঠিক হবে না। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে সহজ স্বাভাবিক গলায়। যেন সে কয়েক দিনের জন্যে বেড়াতে গিয়েছিল, এখন এসেছে। মাঝখানের দু বছরের কথা ভুলে যেতে হবে। আমার বাবুর ছোট্ট হৃদয় তীব্র আবেগ সহ্য করতে পারবে না। চিৎকার করে কাঁদবে। আমি তাকে কাঁদবে না। আমি নিজেও কাঁদব না। আমি এই পৃথিবীর সেরা অভিনেত্রীদের একজন। আমি আজ অস্কার পাওয়ার মত অভিনয় করব।

আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। টুকুনের সামনে দাঁড়িয়ে সহজ গলায় বললাম, তোমার হাতে এটা কি বই বাবা?

টুকুন বলল –রাইমের বই।

এই হচ্ছে আমার সঙ্গে তার প্রথম কথা। কি মিষ্টি গলা! শুধু কি মিষ্টি –একই সঙ্গে স্বরটা করুণ ও বিষণ্ণ।

বইটা কি তুমি আমার জন্যে এনেছ?

না।

তোমার জন্যে?

 হ্যাঁ।

তুমি বই পড়তে পার?

 হ্যাঁ।

 এটা তো ইংরেজি বই, তুমি কি বাংলা পড়তে পার?

না।

আচ্ছা, তোমাকে আমি শিখিয়ে দেব। তুমি কি আমার কোলে উঠবে?

না।

এসো একটু কোলে নিয়ে দেখি।

কোলে উঠব না। ঐটা কি কাক?

 হ্যাঁ কাক।

কাকটা এখানে বসে আছে কেন?

 কাকটা তোমাকে দেখছে।

এই বাড়িতে কি মাছ আছে?

না।

আমাদের বাড়িতে মাছ আছে।

 লাল মাছ?

একটা আছে কালো মাছ।

এসো তোমাকে একটু কোলে নেই।

 না।

বাবা, তোমাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে যে।

টুকুন দু হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম –পাখির মত হালকা শরীর। এত রোগা কেন আমার ছোট্ট ময়না?

টুকুন দু হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। তার শরীর কাঁপতে শুরু করছে। আমার বাবু কাঁদছে। এত কান্না জমা ছিল তার ছোট্ট বুকে? কঁদুক, আমার বাবু কাঁদুক। আমি কাঁদব না। আমি কিছুতেই কাঁদব না। আমি শুধু পৃথিবীর না– এই বিশব্রহ্মাণ্ডের সব শ্রেষ্ট অভিনেত্রীর মত হাসিমুখে কথা বলে যাব। আমার বাবু যেন তার মার চোখের এক বিন্দু অশ্রুও না দেখে।

টুকুন দেখ দেখ, আরেকটা কাক এসেছে।

টুকুন মুখ গুঁজে আছে। সে এখন আর কিছুই দেখবে না। অপরূপ পৃথিবীর কোন দৃশ্য দেখারই এখন আর তার প্রয়োজন নেই।

টুকুন ঘুমুচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সে আমার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি। ছড়ার বইটা এখনো তার হাতে ধরা। মনে হয় এই বইটা তার খুব প্রিয়। আমি টুকুনের পাশে বসে তার নীল ব্যাগ দেখছি। নীল ব্যাগে অনেক জিনিসের সঙ্গে খামে মোড়া একটি চিঠি আছে। চিঠিটা এই নিয়ে দ্বিতীয়বার পড়লাম। মামুন লিখছে–

টুকুনকে পাঠালাম।
 তোমাকে কয়েকটা ব্যাপার বলা হয়নি। প্রধান ব্যাপারটা হল টুকুন অসুস্থ, ভাল রকম অসুস্থ। তাকে দেশের বাইরে দীর্ঘদিন রাখার পেছনের এটাই মূল কারণ। তোমাকে বলা হয়নি কারণ শুধু শুধু তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করাটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছি। ওর হার্টে একটা অপারেশন হয়েছে– অপারেশটা ভাল হয়নি –আবারও করতে হবে। তার জন্যে তার শরীর সারানোর প্রয়োজন। ওকে দেশে আনা হয়েছে। তুমি ওর সঙ্গে থেকে –ওকে সঙ্গ দিয়ে ওর শরীর সারাবার ব্যাপারে সাহায্য করে।
আরো একটি জরুরি ব্যাপার তোমার জেনে নেয়া ভাল। আমি বিয়ে করেছি। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে এক রাতে তুমি টুকুনের খোঁজে আমার বাড়িতে এসে দেখলে একটা পার্টি হচ্ছে। পাটিটা ছিল বিয়ে উপলক্ষ দেয়া ঘরোরা পার্টি। তোমাকে এই খবর তখন দেইনি কারণ তুমি মনে কষ্ট পেতে।
আমি জানি তুমি শক্ত ও কঠিন ধরনের মেয়ে। জীবনের বাস্তবতাকে কষ্ট হলেও স্বীকার করে নেবার ক্ষমতা তোমার আছে।….

ঘুমের মধ্যেই ঠোঁট বাঁকিয়ে টুকুন কান্নার মত করছে। খুব যখন ছোট ছিল তখন সে এরকম করত। আমার বাবু কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে? না, আর দুঃস্বপ্ন নয়। আমার সোনামণির জীবন থেকে সব দুঃস্বপ্ন দূর হয়ে যাক। আমি নিচু হয়ে তার গালে চুমু খেলাম। টুকুনের বাকা ঠোঁট আবার ঠিক হয়ে গেল।

.

১৩.

ডাক্তার সাহেব আজ বাবার চোখের ব্যান্ডেজ খুলবেন। দশটায় ব্যান্ডেজ খোলার কথা, আমি এবং বাবলু সকাল সাতটা থেকে বসে আছি। বাবাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। তিনি ঘামছেন। একটু পর পর পানি খেতে চাচ্ছেন। তার তীব্র উদ্বেগের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে না।

বাবা বললেন, টুকুন কেমন আছে রে?

আমি বললাম, ও ভাল আছে বাবা।

 ওকে নিয়ে এলে ভাল করতি। চোখ মেলেই টুকুনকে দেখতাম।

ও বাবা তার বাবার সঙ্গে দিনাজপুর গিয়েছে। কয়েকদিন ওদের গ্রামের বাড়িতে থাকবে। দিনাজপুর থেকে এসে আমাদের সঙ্গে থাকবে।

আমাকে চিনতে পারবে কিনা কে জানে!

 চিনতে পারবে। চিনতে না পারার কি আছে?

চিনতে না পারলেও ক্ষতি নেই। দ্রুত ভাব করে ফেলব।

আমার মনে হল বাবা আজ যেন অন্যদিনের চেয়েও অনেক বেশি কথা বলছেন। এত কথা বলা তার স্বভাবে নেই। উদ্বেগের কারণেই কি কথা বেশি বলছেন?

বাবলুর সঙ্গেও বাবার অনেক কথা হল। বাবা নিজেই বললেন –বাড়ির প্ল্যান নাকি খুব সুন্দর হয়েছে?

বাবলু বলল –শুধু সুন্দর বললে ইস্তিয়াককে খাটো করা হয়। ইস্তিয়াক হচ্ছে একটা জিনিয়াস ছেলে। ও থাকলে ভাল হত, বাড়িটা সুপারভাইজ করতে পারত।

ও থাকছে না?

না থাকছে না। কানাডা চলে যাচ্ছে। সামনের মাসেই চলে যাচ্ছে। তোমাকে । বলিনি?

না।

খুব ভাল অফার পেয়েছে।

যাচ্ছে কবে?

সামনের মাসে। টিকিট এখনো কনফার্ম করেনি। অসাধারণ একটা ছেলে বাবা। আমার লোনের সব ব্যবস্থা করে গেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। টাকাপয়সা কিচ্ছু নেয়নি। মডেল যে করেছে সেই মডেলের পয়সাও নেয়নি।

বলিস কি?

আমি কি ঠিক করেছি জান বাবা –একটা এপার্টমেন্ট ওকে আমি গিফট করব। আমার অনেক লস হয়ে যাবে। এপার্টমেন্ট মানে তো পঁচিশ-ত্রিশ লাখ টাকা। সহজ ব্যাপার না। তারপরেও মনস্থির করেছি।

ভাল।

টুকুনকেও একটা এপার্টমেন্ট দিয়ে দেব। মামার তরফ থেকে সামান্য উপহার। চারটা না, পাঁচ না, একটাই ভাগ্নে …।

টুকুন কি তোকে পছন্দ করেছে?

 না। ডাকলে কাছে আসে না। আমার মধ্যে পছন্দ করার তো কিছু নেই।

বাবা হাসলেন। চোখ বাঁধা মানুষের হাসি সম্পূর্ণ অন্যরকম। হাসিটা কান্নার মত দেখায়। মানুষ হাসার সময় ঠোঁট এবং চোখ ব্যবহার করে। কাদার সময় শুধুই চোখ।

বাবলু বলল, বাবা, আমি কি ডিআইটি প্ল্যান জমা দিয়ে দেব?

 দে।

তোমাকে সই করতে হবে। জমি তো তোমার নামে।

জমি আমি লিখে দিয়ে দেব। তবে তোর নামে লিখব না। তুই বিয়ে কর। তারপর তোর স্ত্রীর নামে লিখব। তোর নামে লিখলে তুই বিক্রি করে আমাদের সবাইকে পথে বসাবি।

বাবলু দরাজ গলায় বলল, আচ্ছা দেখা যাক। তোমার কাছে যেটা ভাল মনে হয় সেটাই করবে। বাড়িটা হলেই হল।

.

ডাক্তার সাহেব বাবার চাখের ব্যান্ডেজ খুললেন। শান্ত গলায় বললেন, দেখতে পাচ্ছেন?

বাবা বললেন, হ্যাঁ।

আমার আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলুন কটা আঙুল।

বাবা ক্লান্ত গলায় বললেন –আমি দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কিন্তু … কটা আঙুল ঠিক বুঝতে পারছি না।

আপনি সত্যি দেখতে পাচ্ছেন? ফাম্বল করবেন না, দেখতে পাচ্ছেন?

 বাবা চুপ করে রইলেন।

.

আমরা অন্ধ বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। তাকে তার পুরানো জায়গায় — বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসিয়ে দিলাম। বাবা বললেন, তোরা আমার ব্যাপারে মোটেও মন খারাপ করবি না। চোখে অনেকদিন দেখেছি। অল্প কিছুদিন না দেখলে কিছু যায় আসে না। অন্ধ হবার কিছু সুবিধাও আছে। অন্ধদের কনসানট্রেশন ভাল হয়। এখন নামাজে যখন দাঁড়াব –খুব কনসানট্রেশন নিয়ে দাঁড়াব। খুকী, তুই বাবলুকে কান্নাকাটি করতে নিষেধ কর। ও ভেউ ভেউ করে কাঁদছে খুব বিরক্ত লাগছে। এ রকম মরাকান্নার কি আছে? তুই ওকে বুঝিয়ে শান্ত কর, আর বীনু মেয়েটাকে খবর দিয়ে নিয়ে আয়। ওকে দেখলে বাবলু তার হৈ-চৈ কান্না বন্ধ করবে। বাবলুকে আমার কাছে আসতে বল।

.

বাবলু কাঁদছে মার কবরের কাছে বসে। যেন সে তার কান্নাটা মাকে শুনাতে চায়।

আমি ডাকলাম, বাবলু!

 বাবলু রাগী গলায় বলল, বিরক্ত করিস না আপা!

 বাবা ডাকছেন।

বাবা ডাকলেই আমাকে যেতে হবে?

আমি বাবলুকে মার কবরের পাশে বসিয়ে রেখেই চলে এলাম। কাঁদুক, সবাই কাঁদুক। আমি কাঁদব না, আমি কিছুতেই কাঁদব না। আমি বরং হাসিমুখে বাবার সঙ্গে গল্প করব। আমি বাবার কাছে গিয়ে বললাম, চা খাবে বাবা?

খাব।

 দুধ চা না লেবু চা?

দুধ চা।

.

রাতের বেলা অবাক হয়ে দেখি, বাবলু বালিশ হাতে বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছে। আমি বললাম, ব্যাপার কি রে?

বাবলু ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি বাবার সঙ্গে ঘুমুব। অন্ধ মানুষ। কখন কি দরকার হয়।

যা ঘুমো।

আর আমি ঠিক করেছি বাড়িঘর ভাঙব না। এই বাড়ির কোথায় কি আছে বাবা চেনেন –দেয়ালে ধরে ধরে যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পারবেন –তাই না?

আমি হাসলাম। বাবলু বিরক্ত হয়ে বলল, হাসছিস কেন? হাসির কি বললাম?

 তুই ছেলেটা খারাপ না।

আমি খারাপ হব কেন?

 বীনু তোকে বিয়ে করে সুখী হলেও হতে পারে। কিছু সম্ভাবনা আছে।

বাবলু রাগী গলায় বলল, অন্ধ বাবা ঘরে পড়ে আছেন এর মধ্যে তুই বিয়ের কথা তুললি। আশ্চর্য কান্ড। হার্ট বলে কোন বস্তু কি তোর নেই?

আমি হাসছি।

 ঠিক মার মত হাসার চেষ্টা করছি।

.

১৪.

ভোরবেলায় বীনু এসে উপস্থিত। ওকে দেখেই মনে হচ্ছে ও সারারাত ঘুমুয়নি। চুল উস্কখুস্কু। চোখের নিচে কালি। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।

আমি বললাম, ব্যাপার কি বীনু?

 বীনু ক্ষীণ স্বরে বলল, কিছু না।

কিছু তো বটেই, সেই কিছুটা কি?

 আপা, পানি খাব।

আমি তাকে পানি এনে দিলাম। সে এক চুমুক দিয়েই গ্লাস নামিয়ে রাখল।

তুমি কি আমাকে কিছু বলতে এসেছ বীনু?

না।

আমার মনে হয় তুমি কিছু একটা বলতে এসেছ। বলে ফেল।

বীনু শুকনো গলায় বলল, বলতে পারছি না।

 এমন কি ঘটল যে বলতে পর্যন্ত পারছ না?

বীনু নিচু গলায় বলল, ইস্তিয়াক সাহেবের বাবা-মা কাল সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তারা তাদের ছেলের জন্যে আমাকে পছন্দ করে গেছেন। ছেলেই নাকি তাদের পাঠিয়েছে। তারা চাচ্ছেন এক সপ্তাহের মধ্যে যেন বিয়েটা হয়। যাতে ভিসা নিয়ে আমি ইস্তিয়াক সাহেবের সঙ্গেই বাইরে চলে যেতে পারি।

বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে আমি বললাম, তোমার বাবা-মা দারুণ খুশি?

হ্যাঁ খুশি। মা কাল সারারাত নফল নামাজ পড়েছেন। বাবা মিষ্টি কিনে আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন আছেন সবার বাড়িতে পাঠিয়েছেন। এখন আমি কি করব আপনি বলে দিন।

তুমি কি করবে তা তোমাকেই চিন্তা করে বের করতে হবে। আমি এখানে কেউ না।

আমি চিন্তা করে কিছু পাচ্ছি না। আপনি বলে দিন। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।

দেখ বীনু, ইস্তিয়াক চমৎকার ছেলে। জীবনে সে অনেক বড় হবে। আর আমার ভাই হচ্ছে বখা একটা ছেলে– তিনবার পরীক্ষা দিয়েও আই. এ. পাশ করতে পারেনি। কোন কিছুতেই তার স্থিরতা নেই। প্রায়ই নেশা করে বাড়ি ফেরে . . .

আপা প্লীজ, এই ভাবে বলবেন না।

সত্যকে সত্যের মত করেই বলতে হয় বীনু। মিথ্যা দিয়ে ঢেকে সত্য বলা যায় না।

উনি আমাকে খুব পছন্দ করেন।

বাবলু অবশ্যই তোমাকে পছন্দ করে। ইস্তিয়াকও কিন্তু করে। না করলে সে তার বাবা মাকে পাঠাতো না।

আমি কি করব আপা আপনি বলে দিন।

আমরা কেউ মহাপুরুষ না বীনু। আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা আমাদের নিজেদের সুখই প্রধান করে দেখব। তোমারও তাই করা উচিত। ইস্তিয়াককে বিয়ে করলে তুমি অনেক সুখী হবে বলে আমার ধারণা। তবে তুমি আমার ধারণা মিথ্যাও প্রমাণ করতে পার। সাধারণ মানুষদেরও অসাধারণ সব ক্ষমতা থাকে।

বীনু বলল, আপা, আমি যাই।

আচ্ছা যাও।

এই প্রথম বীনু একবারও না হেসে আমাদের বাড়ি থেকে বিদেয় হল। বাবলু ঘর থেকে বের হয়ে বলল, বীনুর গলা শুনলাম। ওকি এসেছিল না-কি? আমি বললাম –না।

.

১৫.

মামুন পাজেরো জীপ পাঠিয়ে দিয়েছে। জীপের ড্রাইভার বিজ বিজ করে যা বলল তার অর্থ হল –আমি যেন এক্ষুণি চলে যাই। টুকুন অসুস্থ। দিনাজপুর থেকে ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে ভর্তি করা হয়েছে পিজি হাসপাতালে। অবস্থা ভাল না। অবস্থা খুবই খারাপ।

কি বলছে ড্রাইভার এসব? আমি ব্যাকুল হয়ে ডাকলাম –বাবলু! বাবলু। বাবলু ছুটে এল। যে ভীত গলায় বলল, আপা, কি হয়েছে?

আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম, আমার টুকুন মরে যাচ্ছে। আমার পাশে কেউ নেই। –তুই আমাকে হাত ধরে গাড়িতে তুলে দে–। বাবা ইজিচেয়ার থেকে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন –মা কি হয়েছে? কি হয়েছে? আমি বাবার কথার জবাব দিলাম না। আমার পৃথিবী শব্দ শূন্য হয়ে যাচ্ছে –বাবা আরো কি যেন বলছেন, আমি শুনতে পাচ্ছি না।

.

হাসপাতালের গেটে মামুন দাঁড়িয়ে। তার পাশে শান্ত চেহারার এই মেয়েটা কে? তার স্ত্রী? বাহ, মিষ্টি চেহারা তো মেয়েটির! কি লম্বা চুল।!

মামুন আমার কাছে এগিয়ে এল। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল –টুকুনকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে। অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। ডাক্তাররা বলেছেন, অবস্থা ক্রিটিক্যাল। এই ধাক্কাটা কোনক্রমে যদি সামলাতে পারে তাহলে ওকে সঙ্গে সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দেব। তুমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াও।

ওর কি জ্ঞান আছে?

হ্যাঁ, জ্ঞান আছে?

আমি ইনটেনসিভ কেয়ারে ঢুকলাম। আমার ছোট্ট বাবু কাত হয়ে শুয়ে আছে। তার নাকে অক্সিজেনের নল। বাবুর ছোট্ট বুক ওঠা-নামা করছে। দুজন ডাক্তার তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন বৃদ্ধ ডাক্তার দোয়া পড়ছেন। এটা কোন সূরা? সূরা ইয়াছিন? আমি বললাম, –আমি কি আমার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে থাকতে পারি? অক্সিজেনের নল-টল যে রকম আছে সে রকম থাকবে। আমি কোন কিছুতেই হাত দেব না।

বৃদ্ধ ডাক্তার বললেন— আপনি আপনার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসুন।

আমার কোলে তুলে দিতেই টুকুন চোখ মেলে আমাকে দেখল। আমি বললাম, বাবা, তোমার কোথায় ব্যথা?

সে তার বুক দেখিয়ে দিল।

আমি তার ছোট্ট বুকে হাত রাখলাম।

এখন আমি কি করব? প্রার্থনা? না, আমি কোন প্রার্থনা করব না। কেন আমি প্রার্থনা করব?

বাবা, ব্যথা কি খুব বেশি?

টুকুন তীব্র ব্যথা নিয়ে হাসার চেষ্টা করল। আমার সামনে মনিটার। সেখানে আলোর বিন্দু ওঠা-নামা করছে, জীবন এবং মৃত্যুর সীমা নির্দেশ করে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি আমার টুকুনের দিকে।

আমি কাঁদব না। আমি কিছুতেই কাঁদব না।

মামুনকে ছেড়ে আসার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কোনদিন চোখের পানি ফেলব না। সেই প্রতিজ্ঞা আমাকে রাখতেই হবে। তাছাড়া আমাকে কাঁদতে দেখলে আমার সোনা ভয় পেতে পারে।

কতক্ষণ কাটিয়েছি আমি জানি না। একসময় বৃদ্ধ ডাক্তার বললেন –আপনার ছেলের ইসিজি নরম্যাল হয়ে গেছে। ও এখন ভাল আছে। ঘুমুচ্ছে। ক্রাইসিস কেটে গেছে। আপনি যান, বিশ্রাম করুন। আর ভয়ের কিছু নেই।

বাইরে এসে দেখি বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে বাবলু কাঁদছে। আমি বললাম –কাঁদিস না। ও ভাল আছে। চল, বাবাকে খবরটা দিয়ে আসি।

আমরা দুই ভাইবোন হাত ধরাধরি করে সিঁড়ি দিয়ে নামছি। মামুন তার স্ত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির গোড়ায়। তার সমস্ত আত্মীয়-স্বজনরাও আছে। তারা সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।

আমি মনে মনে বললাম, হে পৃথিবীর সুখী মানুষরা, তোমরা এই দুই দুঃখী ভাইবোনের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থেকো না। তোমরা আমাদেরকে আমাদের মত থাকতে দাও।

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ