আপনি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছেন?

মতিন থতমত খেয়ে বলল, অবশ্যই অবশ্যই। যদিও সে মন দিয়ে শুনছিল না। তার সামনে বসা মুনা নামের অস্বাভাবিক রূপবতী মহিলা তার মধ্যে কিছু সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সে মহিলার মুখের দিকে ঠিকমতো তাকাতে পারছে না, আবার চোখও ফিরিয়ে নিতে পারছে না। মুনার আজকের পোশাক আরো উগ্র। আবার এ-ও হতে পারে–ইনি যে সমাজে বাস করেন সেই সমাজে এই পোশাকই শালীন পোশাক।

মতিন সাহেব!

জি ম্যাডাম।

কমলের সঙ্গে আপনার দেখা করানোর আগে তার আচার-আচরণ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া প্রয়োজন। তাই না?

জি ম্যাডাম।

মতিন জি ম্যাডাম বলেছে ঠিকই, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ বুঝতেই পারল না কমলটা কে। কমল নামটি অনেকবার তার সামনে উচ্চারিত হয়েছে। সে অটিসটিক শিশু কমলের সঙ্গী হিসেবে চাকরি পেয়েছে, এই ব্যাপারগুলি তার মাথায় স্থায়ী হচ্ছে না। তার সামনে বসা মহিলার রূপ আরেকটু কম হলে মতিনের জন্যে সুবিধা হতো। ব্লাউজের কাট এত না হলেও সুবিধা হতো। ব্লাউজের নিচে মহিলা কিছু পরেন নি তা বোঝা যাচ্ছে। এই সমাজে বোধহয় ব্রা পরার চল নেই।

মতিন সাহেব!

জি ম্যাডাম।

একটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন, কমল অসম্ভব বুদ্ধিমান। সে অতি দ্রুত তার। বুদ্ধিতে আপনাকে বিচার করবে।

ও আচ্ছা!

আপনার ত্রুটিগুলি সে ধরতে চেষ্টা করবে। তারপর আপনার ত্রুটিগুলি সে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে।

ত্রুটি মানে?

আপনি যদি ভীতু হন তাহলে সেটা আপনার একটা ক্রটি। আপনার ভীতিটা সে কাজে লাগাবে। আপনি যদি রাগী মানুষ হন সে আপনার রাগটা কাজে লাগাবে।

বুঝতে পারছি না।

একজন ভীতু মানুষকে সে কাবু করবে ভয় দেখিয়ে। একজন রাগী মানুষকে সে আরো রাগিয়ে দেবে। সে অগ্রসর হবে অতি ঠাণ্ডা মাথায়।

ও আচ্ছা!

আপনি যত সহজে ও আচ্ছা বললেন, বিষয়টা তত সহজ নয়। একটি Autistic শিশুর কিছু আচরণ পূর্ণবয়স্ক মানুষদের মতো।

Autistic সব শিশুই কি একরকম?

না, একেকজন একেক রকম, তবে তাদের কমন কিছু মিল আছে। যেমন, এরা অতি বুদ্ধিমান। তাদের প্রধান চেষ্টা থাকে আশেপাশের সবাইকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে। আপনাকে কিছু বইপত্র দেব, বইপত্রগুলি মন দিয়ে পড়বেন।

জি আচ্ছা।

ইন্টারনেটে এই ধরনের শিশুদের বিষয়ে বেশ কয়েকটা ওয়েবসাইট আছে, আপনি সেগুলি দেখতে পারেন।

ইন্টারনেট কীভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি জানি না।

এমন কোনো জটিল ব্যাপার না। আপনাকে শিখিয়ে দেয়া হবে। আপনি কি এখন ছেলের সঙ্গে দেখা করার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত?

জি ম্যাডাম।

আপনার মনে কি কোনো প্রশ্ন আছে?

মতিন ইতস্তত করে বলল, এই ধরনের শিশুরা কি ভায়োলেন্ট হয়?

মুনা বললেন, হয়। তবে বেশিরভাগ এই ভায়োলেন্স নিজের প্রতি দেখায়। অন্যের প্রতি না। কমল রেগে গিয়ে আপনাকে কামড়ে ধরবে এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই। ভয় পাবেন না।

আমি ভয় পাচ্ছি না।

মুখে ভয় পাচ্ছি না বললেও মতিন ভয় পাচ্ছে। সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পা থপথপ করে একটা ছেলে এসে চেয়ার ধরে দাঁড়াবে। তার চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ। সে দড়ি দিয়ে বাঁধা জন্তুর মতো থেমে থেমে বড় বড় নিঃশ্বাস নেবে। তার মুখ হা হয়ে থাকবে। মুখ থেকে মাঝে মধ্যেই লালা। গড়িয়ে পড়বে।

মুনা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে।

মতিন উঠে দাঁড়াল, তবে তার মাথা সামান্য ঝিমঝিম করে উঠল। মুনা উঠে দাঁড়ানো মাত্র দমকা বাতাস গায়ে লাগার মতো সেন্টের গন্ধ নাকে এসে লেগেছে। গন্ধটার মধ্যেই গা ঝিম ধরানোর ব্যাপার আছে। মতিন ভেবে পাচ্ছে না, এই মহিলা উঠে দাঁড়ানো মাত্র গন্ধটা তার নাকে এসে লাগল কেন? তিনি গায়ে সেন্ট মেখেছেন, সেই সেন্ট তো বসে থাকা অবস্থাতেও গায়ে ছিল।

 

মতিন কমলের ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটা বেশ বড়। মাঝখানে কাঠের পার্টিশন আছে। পার্টিশনে অতি সূক্ষ্ম কারুকাজ। নিশ্চয়ই খুব দামি জিনিস। পুরো ঘরে হালকা নীল রঙের কার্পেট। জানালার পর্দা নীল। দরজার পর্দাও নীল। মতিন

যে ঘরে দাঁড়িয়ে আছে এই ঘরটা মনে হয় কমলের খেলার ঘর। কিছু খেলনা। আছে। স্টাফড অ্যানিমেল। কম্পিউটার আছে। নিচু একটা টেবিল আছে। টেবিলে ছবি আঁকার রঙতুলি। কাগজ। বেশ কয়েকটা কাগজে গাঢ় হলুদ রঙ মাখানো।

পার্টিশনের ওপাশটা মনে হয় কমলের শোবার ঘর। বিছানার একটা কোনা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। বিছানার নিচে এবং উপরে প্রচুর বইপত্র ছড়ানো। দুটি বইয়ের নাম পড়া যাচ্ছে–FUN IN ALGEBRA, THE DARK BY PASS।

মতিন সাহেব!

জি ম্যাডাম।

আপনি পার্টিশনের এই পাশে থাকবেন। ঐ পাশে কখনো যাবেন না বা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টাও করবেন না। কমল এটা পছন্দ করে না। একেবারেই পছন্দ করে না।

জি আচ্ছা।

মুনা গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, হ্যালো বাবু, এসো এদিকে।

পার্টিশনের ওপাশ থেকে শান্ত গলায় একটি শিশু বলল, No.

মনা বললেন, এসো বলছি। তোমার সঙ্গে একজনের পরিচয় করিয়ে দেব।

শিশুটি আগের মতোই শান্ত গলায় বলল, No,

যাকে নিয়ে এসেছি তার নাম মতিন। উনি তোমার খুব ভালো কোম্পানি হবেন। তুমি তার সঙ্গে গল্প করতে পারবে। উনি তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন।

শিশুটি বলল, তাকে জিজ্ঞেস করো ফিবোন্নাক্কি সিরিজের ফোর্থ সংখ্যা কী?

মতিন হতভম্ব হয়ে মুনার দিকে তাকাল। ফিবোনাক্কি সিরিজের নাম সে তার জনো শোনে নি। মুনা তিনটা আঙুল বের করে মতিনকে দেখিয়ে ইশারা করছেন। মতিন যন্ত্রের মতো বলল, তিন।

তখনি কমল পার্টিশন ধরে দাঁড়াল। সে তাকিয়ে আছে মতিনের দিকে।

মতিন একটা ধাক্কার মতো খেল। এত সুন্দর শিশু সে তার জীবনে দেখে নি। কোনোদিন দেখবে এরকমও মনে হচ্ছে না। গায়ের রঙ কাঁচা হলুদের মতো বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। মতিন কাঁচা হলুদ কখনো দেখে নি, তবে এখন তার মনে হচ্ছে এই শিশুটির গায়ের রঙকেই কাঁচা হলুদ বলে। পাতলা ঠোঁট। দেখে মনে হচ্ছে একটু আগে হালকা গোলাপি রঙ দিয়ে কেউ ঠোঁট এঁকেছে। বড় বড় চোখ। সেই চোখ শান্ত এবং হয়তো বা কিছুটা বিষাদ মাখা। মাথাভর্তি এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল। মতিনের ইচ্ছা করছে চিরুনি এনে ছেলের চুল আঁচড়ে দিতে।

মতিন বলল, কেমন আছ?

কমল বলল, পরাখা মিতু। পরাখা বখু মিতু!

মতিন হকচকিয়ে গেল। এর মানে কী? হিজিবিজি কী কথা সে বলছে? মতিন মুনার দিকে তাকাল। মুনা কিছু বলছেন না।

কমল বলল, ওযা লেচ। ওযা লেচ নিক্ষুএ।

মতিন এই বিচিত্র ভাষার অর্থ হঠাৎ করেই বের করে ফেলল। ছেলেটা উল্টো করে বাক্যগুলি বলছে।

পরাখা মিতু হলো–তুমি খারাপ। পরাখা বখু মিতু হলো–তুমি খুব খারাপ। একটু আগে সে বলেছে ওযা লেচ, এর অর্থ চলে যাও। ওযা লেচ নিক্ষুএ-র অর্থ এক্ষুনি চলে যাও।

যে উল্টো করে বাক্য বলছে তার সঙ্গে কথা বলতে হলে উল্টো করে বাক্য বলা দরকার। মতিন কী বলবে বুঝতে পারছে না। তুমি কেমন আছ? এই কথা জিজ্ঞেস করা যায়। তুমি কেমন আছর উল্টো কী হবে? ছআ নমকে মিতু? ঠিক আছে তো? মনে মনে পুরো বাক্য উল্টানো মুশকিল। কাগজে লিখতে  পারলে ভালো হতো। কাগজে লিখে আয়নায় ধরা। আয়নায় লেখা যেভাবে আসে সেভাবে বলা।

মতিন বলল, ছআ নমকে মিতু?

কমল স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি ভালো আছি। থ্যাংক য়্যু ফর আসকিং। ফিবোনাক্কি সিরিজের ফিফথ টার্মটা কী? সে এখন আর মা

কমল উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছে। তবে সে এখন আর সামনের দিকে তাকিয়ে নেই। সে তাকিয়ে আছে তার হাতের গোল বলটার দিকে। বলটা আসলে একটা মিনিয়েচার গ্লোব। কাচের ভেতরের স্থলভাগ ও জলভাগ ঘুরছে। বলটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় পৃথিবী ঘুরছে, যদিও কাচের বলটা স্থির।

কমল আবারো বলল, দেরি করছ কেন? বলো ফিবোনাক্কি সিরিজের ফিফথ টার্মটা কী?

মতিন তাকাল মুনার দিকে। মুনা কিছু বলছেন না তবে তাকে সামান্য চিন্তিত মনে হচ্ছে। আঙুলের ইশারায় কিছু দেখালে মতিন সেখান থেকে কিছু বলতে পারত। তিনি কিছু দেখাচ্ছেন না। মতিন বলল, আমি জানি না।

কমল বলল, তুমি জানো না?

মতিন বলল, না। ফিবোনাক্কি সিরিজ কী, এইটাই আমি জানি না।

কমল বলল, ফোর্থ টার্মটা তো তুমি ঠিক বলেছ। তখন কি কেউ তোমাকে সাহায্য করেছে?

মতিন বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ।

কমল বলল, তুমি একজন লায়ার। আমি লায়ার পছন্দ করি না।

মতিন চুপ করে রইল। কমল বলল, তুমি আমার সঙ্গে ট্রিকস করছ। আমি ট্রিকস পছন্দ করি না।

কমলের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎচমকের দ্রুততায় একটা ঘটনা ঘটল। কমল তার হাতের গ্লোব ছুড়ে মারল। লাগল বাঁ-দিকের কপালে। তার কাছে মনে হলো তার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। সে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই।

 

রাত দশটা।

মতিন বিছানায় শুয়ে আছে। রাজকীয় শয়ন বলা যেতে পারে। ঘরে এসি চলছে। গায়ে রাখা হালকা চাঁদরেও শীত মানছে না। মনে হচ্ছে চাদরটা আরেকটু ভারি হলে ভালো হতো।

বালিশের পাশে রাখা মোবাইল টেলিফোন বেশ কয়েকবার বেজেছে। মতিনের ধরতে ইচ্ছা করছে না। আরামদায়ক আলস্যে তার শরীর ডুবে আছে। উলিফোনে কথা বলে সে আলস্য নষ্ট করা ঠিক না। টেলিফোনে কথা বলার কাজটা যথেষ্টই পরিশ্রমের। পরিশ্রমটা মানসিক।

টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। রিংটোনে সুন্দর বাজনা। এই বাজনা নিশুর ঠিক করে দেয়া। কিছুদিন পর পর সে বাজনা বদলে দেয়। এই ব্যাপারে তার যুক্তি হচ্ছে, কাপড় যেমন নোংরা হয়ে যায় বাজনাও তেমন নোংরা হয়। কাপড় ধোয়ার ব্যবস্থা আছে, বাজনা ধোয়ার ব্যবস্থা নেই বলেই বাজনা বদল।

কে বারবার টেলিফোন করছে? বোতাম টিপে ইচ্ছা করলেই জানা যায়, সেই ইচ্ছাটাও কেন জানি করছে না। যে তাকে ডাকছে সে ডাকতে থাকুক।

দরজায় ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হচ্ছে। এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা। এমন আধুনিক বাড়ির দরজা হবে মাখনের মতো। নিঃশব্দে খুলবে। নিঃশব্দে বন্ধ হবে। ক্যাচক্যাচানি হবে না।

দরজা খুলেছে রহমত। রহমত তিনতলার খেদমতগার। তার শরীর কুস্তিগিরের মতো। কুস্তিগিরদের চোখের দৃষ্টিতে বোকা বোকা ভাব থাকে। কাঠিন্য থাকে না। রহমতের চোখের দৃষ্টি কঠিন। রহমতের সামনে চমৎকার একটা ট্রলিতে এককাপ কফি। এই কফির কাপ হাতে করে আনা যেত। তাতে অবশ্যি বড়লোকি কায়দার প্রকাশ ঘটত না।

মতিন বলল, আমি রাত দশটার পর চা-কফি কিছুই খাই না। এত রাতে চা-কফি খেলে ঘুম হয় না। ক্যাফিনঘটিত সমস্যা।

রহমত বলল, ডিকেফিনেটেড কফি দিব স্যার?

বেয়ারা শ্রেণীর কারো মুখে ডিকেফিনেটেড শব্দটা শুনলে ধাক্কার মতো লাগে। সে এই শব্দটা যে শুনে শুনে শিখেছে তা-না। সে এই শব্দের মানেও জানে।

মতিন বলল, তোমার পড়াশোনা কী?

রহমত বলল, ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি।

ভালো করেছ, এখন ট্রলি নিয়ে বিদায় হও, আমি ঘুমাব।

রহমত বলল, বড় সাহেব কিছুক্ষণ আগে ফিরেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন।

কী কথা?

উনি কী কথা বলবেন সেটা তো স্যার আমি জানি না। তবে মনে হয় আজকের ঘটনা নিয়ে কথা বলবেন। এই যে আপনার মাথা ফাটল, স্টিচ দেয়া। লাগল।

মতিন বলল, তুমি তোমার বড় সাহেবকে বলল যে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।

রাতে আর কথা হবে না।

মিথ্যা কথা বলব স্যার?

তুমি মিথ্যা বলো না?

নিজের কারণে বলি, অন্যের কারণে বলি না।

তাহলে যাও সত্য কথাটাই বলো।

সত্য কথাটা কী?

সত্য কথাটা হলো, আমি এখন কথা বলতে চাচ্ছি না। একটা ঘটনা ঘটেছে, ঘটনাটা হজম করছি। গুরুপাক ঘটনা তো, হজম করতে সময় লাগছে। এই কথাটা গুছিয়ে বলতে পারবে?

পারব স্যার।

মতিন শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল, রহমত, তোমার কি কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে?

জি স্যার আছে।

রাত দশটার পর কফি খাও?

জি স্যার খাই।

তাহলে চেয়ারটা টেনে আমার সামনে বসো। কফি খাও। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি।

রহমত বলল, চেয়ারে বসতে হবে না স্যার। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি খাব।

মতিন বলল, তুমি চেয়ারে বসে আরাম করে কফি খাও। এতে আমার সম্মানের কোনো হানি হবে না। আমি কোনো সম্মানিত ব্যক্তি না। বেকার গ্রাজুয়েট। বেকার গ্রাজুয়েটকে সম্মান করতে হয় না।

রহমত চেয়ারে বসতে বসতে বলল, শুকরিয়া।

মতিন বলল, কতদিন ধরে এ বাড়িতে আছ?

রহমত কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, তিন বছর।

কমল ছেলেটির সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে?

আছে।

যোগাযোগটা কোন পর্যায়ের? ভালো যোগাযোগ?

জি স্যার। উনি আমাকে ডাকেন আংকেল ফলিয়া।

ফলিয়াটা কে?

জানি না। উনি নিজের মনে অনেক কিছু বানান।

তোমার সঙ্গে তার গল্প হয়?

জি স্যার।

কী নিয়ে গল্প?

উনি যখন যেই বই পড়েন সেই বই নিয়ে গল্প।

ফিবোনাক্কি সিরিয়েল কী জানেন?

জি স্যার। ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, …। ছোট সাহেব আমাকে বলেছেন, আমি মুখস্থ করেছি।

এই সংখ্যাগুলির বিশেষত্ব কি তুমি জানো?

জানি স্যার। ছোট সাহেব বলেছেন, এর প্রতিটি সংখ্যা আগের দুটা সংখ্যার যোগফল।

এরকম সিরিয়েল আরো আছে?

জি স্যার আছে। যেমন ১, ৪, ৯, ১৬, ২৫…

এর বিশেষত্ব কী?

বিশেষত্ব জানি না স্যার।

অঙ্ক ফঙ্ক ছাড়া আর কী নিয়ে কথা হয়?

নানান বিষয়।

আজ কথা হয়েছে?

জি হয়েছে।

কী নিয়ে কথা হলো?

বিজ্ঞানের কথা।

বিজ্ঞানের কথাটা কী?

শব্দের গতি।

শব্দের গতি মানে কী?

রহমত কফির কাপ ট্রলিতে রাখতে রাখতে বলল, শব্দ ঘণ্টায় সাতশ পঞ্চাশ মাইল বেগে যায়। শব্দের গতি এর চেয়ে বেশি হলে আমাদের কী সুবিধা হতো এই নিয়ে কথা।

কী সুবিধা হতো?

ছোট সাহেব বলেছেন কী সুবিধা হতো। আমি বুঝতে পারি নাই। উনার বেশিরভাগ কথাই আমি বুঝতে পারি না।

কিন্তু তুমি ভাব কর যেন বুঝতে পারছ।

জি ভাব করি, কিন্তু ছোট সাহেব বুঝতে পারেন যে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

আজকের ঘটনা নিয়ে কথা হয়েছে? আমার মাথা ফাটার ঘটনা?

জি-না।

আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এখন যাও।

রাতে স্ন্যাকস জাতীয় কিছু খাবেন স্যার? দিয়ে যাব?

না, শুধু এসিটা এমন করে দাও যেন ঘর আরো ঠাণ্ডা হয়।

একুশ সেন্টিগ্রেডে দেয়া আছে।

এমন কর যেন শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমাতে পারি।

আঠারো দেই?

দাও।

রহমত বলল, টেম্পারেচার কীভাবে কন্ট্রোল করে আপনাকে শিখিয়ে দেই স্যার–যদি বেশি ঠাণ্ডা লাগে তাহলে নিজে নিজে ঠিক করতে পারবেন।

না। আমি শিখব না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা শিখতে চায় না। আমি তাদের দলে।

রহমত ঘর থেকে বের হবার আগে আগে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, বড় সাহেব লাইব্রেরি ঘরে আছেন। দুই মিনিটের জন্যে কি আসবেন? বড় সাহেব খুব খুশি হবেন।

মতিন হাই তুলতে তুলতে বলল, উনার সঙ্গে এখন দেখা হলে আমি খুব অখুশি হবো। আমার কাছে আমার খুশিটা অনেক ইম্পোর্টেন্ট। কাজেই দেখা হবে না।

জি আচ্ছা স্যার।

ঘর অতি দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মতিনের গায়ের চাঁদরে শীত মানছে না। কাবার্ডে হলুদ রঙের একটা কম্বল আছে। মনে হচ্ছে কম্বল গায়ে দিতে হবে। মতিনের মোবাইল টেলিফোন আবার বাজছে। ধরব না ধরব না করেই মতিন টেলিফোন ধরল। তার ধারণা ছিল নিশু টেলিফোন করেছে। তা-না, টেলিফোন করেছেন মতিনের বড় বোন সালেহা। তাঁর গলা কাঁপা কাঁপা।

এই নিয়ে তোকে এগারোবার টেলিফোন করলাম। তুই কোথায়?

মতিন বলল, বড় আপা, আমি একটা ডিপ ফ্রিজের ভেতর শুয়ে আছি।

সালেহা আতঙ্কিত গলায় বললেন, কোথায়?

ডিপ ফ্রিজের ভেতর। তোমরা যেখানে মাছ-মাংস রেখে বাসি কর সেখানে।

তোর কোন কথাটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা, কোনটা ঠাট্টা কোনটা সিরিয়াস আমি কিছুই বুঝি না। এখন আর বুঝতে চাই না। তৌহিদার কাছ থেকে শুনলাম তুই বাসায় এসেছিলি। কী জন্যে?

ফ্রিজের ভেতর ঢোকার আগে তোমার কাছ থেকে দোয়া নিতে এসেছিলাম।

ফাইজলামি রেখে সত্যি কথা বল, তোর টাকার দরকার?

না।

দরকার থাকলে বল।

দরকার নেই।

তুই তৌহিদাকে কিছু বলেছিস?

কী বলব?

সেটা তো আমি জানি না। কিছু বলেছিস কি-না? সে কান্নাকাটি করছে। আমি যতবার বলি, কী হয়েছে, ততবারই ফুঁপিয়ে ওঠে। তোদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছে?

সমস্যা হবার জন্যে সামান্য হলেও ঘনিষ্ঠতা লাগে। সেই ঘনিষ্ঠতা তো তৌ-এর সঙ্গে আমার নেই।

তৌটা কে?

তৌহিদাকে ছোট করে তৌ ডাকি। তৌ যে হবে আমার বৌ।

তুই কি সত্যিই তৌহিদাকে বিয়ে করবি?

অবশ্যই।

কবে?

তৌ যখন বলবে তখন। তৌ যদি বলে আগামী পরশু তাতেও আমি হর্ষু।

হর্ষ মানে কী?

হর্ষু মানে হর্ষিত। আনন্দিত।

আমার সঙ্গে এরকম ফাজলামি করে কথা বলিস কেন? আমি তোর বড় বোন। আমি কি তোর ইয়ার বন্ধু? এখন সত্যি করে বল, তুই কোথায়?

একজন ভয়ঙ্কর বড় লোকের বাড়ির এসি দেয়া ঘরে শুয়ে আছি। এসির টেম্পারেচার আঠারোতে দেয়া বলেই ঘরটা ডিপ ফ্রিজের মতো ঠাণ্ডা। এই জন্যেই তোমাকে বলেছি ডিপ ফ্রিজের ভেতর শুয়ে আছি।

এত বড় লোকের বাড়িতে ঘুমাচ্ছিস কেন?

কারণ এই বাড়ির একটা গুণ্ডা ছেলের দেখভালের চাকরি পেয়েছি। থাকা খাওয়া ফ্রি। মাসিক বেতন পনের হাজার।

গুণ্ডা ছেলে মানে কী?

গুণ্ডা ছেলে মানে গুণ্ডা ছেলে। সে বাড়ি দিয়ে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। দুটা স্টিচ দিতে হয়েছে। আপা, তোমার সঙ্গে আমি আর কথা বলতে পারব না। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি। মোবাইল অফ করে আমি এখন কম্বলের ভেতর ঢুকে যাচ্ছি।

মতিন মোবাইল অফ করে গুটিসুটি মেরে চাঁদরের ভেতর ঢুকে গেল। বিছানা থেকে নেমে কম্বল আনার মতো পরিশ্রম করতেও ইচ্ছা করছে না। এখন সে সরীসৃপদের মতো নিজের গায়ের উত্তাপে নিজেকে গরম করবে।

নতুন জায়গায় চট করে তার ঘুম আসে না। তবে আজ মনে হয় ঘুম আসবে। এখনই চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। এসির একঘেয়ে শো শো শব্দটাও কাজে আসছে। Montony is sleeps carriage. একঘেয়েমি ঘুম হ্রদ। ভালো নাম মনে এসেছে তো! ঘুম হ্রদ। এই নামে উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম অবশ্যই একটা কবিতা লিখতে পারেন–

ঘুম্র হ্রদ

অঘুমো রাজকন্যা ছিল ঘুম্রহ্রদে
তাকে ঘিরে জল নাচে শোঁ শোঁ শব্দ হয়
রাজকন্যার ভয় হয় তার শরীরে অসুখ
অসুখের নাম কী? প্রশ্ন করে জলপাখি
অঘুমা রাজকন্যা দেয় না উত্তর।

উত্তর-এর সঙ্গে মিল হয় এমন একটা শব্দ দরকার। শব্দ মাথায় আসছে না।

দেয় না উত্তর
… … নির্ভর
… … মর
… … পর
… … সর
… … ঝড়

আচ্ছা ঝড় নিয়ে কাজ করা যায়। উত্তরের সঙ্গে ঝড় ভালোই মিলে।

অঘুমা রাজকন্যা দেয় না উত্তর
তখন হ্রদ জেগে ওঠে
জেগে ওঠে দক্ষিণের ঝড়॥

ঠিক হলো না। উত্তর শব্দটা ছিল বলেই মাথায় দক্ষিণ ঘুরঘুর করছে। এই উত্তর সেই উত্তর না।

কবিতাটা উল্টো করে লিখলে কেমন হয়? কমলের মতো শিশুদের জন্যে উল্টো কবিতা। মিল থাকবে শুরুতে। সেটা কঠিন হবে। কবিতা যা আছে তাকেই উল্টানো যাক।

দহ্র ম্রঘু

দেহ্র ম্রঘু লছি ন্যাকজরা মোঘুখ
য়হ ব্দশ শোঁ শোঁ চেনা লজ রেঘি কেতা
খসুঅ রেরীশ রঁতা য়হ য়ভ রন্যাকজরা
খিপালজ রেক শ্নপ্র? কী মুনা রখেসুঅ।
রত্তউ না য়দে ন্যাকজরা মাঘুঅ।

মতিন লক্ষ করল উল্টো করে কবিতা লিখে সে বেশ মজা পাচ্ছে।

আচ্ছা নিশুকে টেলিফোন করে কিছু উল্টো কথা বললে কেমন হয়? রাত অনেক হয়েছে। রাত কম হলে অ্যাক্সপেরিমেন্ট করা যেত। নিশুকে উল্টালে হয় শুনি। শুনি নামটাও তো সুন্দর।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ