০৬.

রাতে বজলুর রহমান কিছু খেলেন না। তাঁর গায়ে জ্বর নেই। কিন্তু শরীর খারাপ লাগছে। মাথা ঘুরছে। প্রেসারটা একবার দেখানো উচিৎ, মনে হচ্ছে সমস্যটি প্রেসার-ঘটিত। গত রাতে ঘুম হয়নি। প্রেসার রোগিদের একরাত ঘুম না হলে অনেক সমস্যা হয়। বজলুর রহমান রাত নটা বাজার আগেই হিপনল নামের একটা ঘুমের অষুধ এবং আধকাপ দুধ খেয়ে বিছানায় চলে গেলেন। বাতি নিভিয়ে দিলেন। মনোয়ারাকে বলে দিলেন–কেউ যেন হৈ-চৈ না করে। হৈ চৈ করলে কারবালা হয়ে যাবে।

বজলুর রহমানের আশংকা ছিল আজও ঘুম আসতে চাইবে না। আয়োজন করে ঘুমুতে গেলে ঘুম আসে না–এটাই নিয়ম। ঘুমের অষুধ আরো সমস্যা করে। তিনি যে কবার ঘুমের অষুধ খেয়েছেন, সে কবারই সারারাত জেগে কাটিয়েছেন। এক ফোঁটা ঘুম হয়নি।

আজ রাতে সে রকম হল না। দেখতে দেখতে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এল। তৃপ্তির ঘুম। এমন আরাম করে তিনি বহুকাল ঘুমাননি। তাঁর ঘুম ভাঙল গভীর রাতে। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল। তিনি দেখলেন–মেঝে ছেয়ে গেছে তেলাপোকায়। তারা এগুচ্ছে তাঁর খাটের দিকে। কুড়ি-পঁচিশটা না, হাজারে হাজারে পোকা। সবাই একসঙ্গে শুঁড় নাড়ছে। পা ফেলছে তালে তালে। অনেকটা সৈন্যদের মার্চের ভঙ্গিতে। তিনি ঘুমের মধ্যেই বললেন, এই, স্টপ, স্টপ।

পোকাদের বাহিনী থমকে গেল। তারপর আবার এগুতে শুরু করল। তিনি ঘুম ভেঙে বিছনায় উঠে বসলেন। কাঁপা গলায় ডাকলেন, মনোয়ারা! মনোয়ারা!

মনোয়ারা উঠে বসলেন।

 বাতি জ্বাল।

মনোয়ারা বাতি জ্বাললেন। বজলুর রহমান ভীত গলায় বললেন, দেখ তো মেঝেতে কিছু আছে না কি।

কিছু নেই।

না দেখে কথা বলবে না। কষ্ট করে বিছানা থেকে নাম। তারপর বল। তোমার কোমরে তো বাত হয়নি যে বিছানা থেকে নামা যাবে না।

মনোয়ারা বিছানা থেকে নামলেন।

কিছু দেখছি না তো।

খাটের নিচটা দেখ।

খাটের নিচেও কিছু দেখা গেল না। বজলুর রহমান বললেন, ঠাণ্ডা পানি দাও। পানি খাব।

মনোয়ারা চিন্তিতমুখে পানি আনতে গেলেন। লোকটার হয়েছে কি? স্বপ্ন দেখেছে এটা বোঝা যাচ্ছে। এই বয়সে স্বপ্ন দেখে কেউ এমন বিকট চিৎকার দেয়?

বজলুর রহমান শান্তমুখে পানি খেলেন। মনোয়ারা বললেন, খিদে হয়েছে? কিছু খাবে?

না।

কি স্বপ্ন দেখেছ?

বজলুর রহমান কিছু বললেন না। স্ত্রীর সব প্রশ্নের জবাব তিনি দেন না। খামাখা সময় নষ্ট। মনোয়ারা জবাবের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বাথরুমে গেলেন অজু করতে। রাত শেষ হয়ে আসছে। ফজরের নামাজের অজু করে রাখা যায়। মনোয়ারা বাথরুমের বাতি জ্বালিয়ে বিকট চিৎকার করলেন।

বজলুর রহমান বললেন, কি হয়েছে?

কিছু না।

কিছু না, তাহলে চিৎকার করছ কেন?

পোকা।

কি বললে?

হাজারে বিজারে তেলাপোকা। ওয়াক থু। কি ঘেন্না!

মনোয়ারা ধড়াম করে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন। তাঁর গা গুলাচ্ছে। তিনি তাঁর বাহান্ন বছর জীবনে একসঙ্গে এত তেলাপোকা দেখেননি। বজলুর রহমান বললেন, গাধাটাকে ডাক।

কাকে ডাকব?

আলতাফকে ডাক।

 ওকে ডাকব কেন?

 যা করতে বলছি কর।

মনোয়ারা আলতাফকে ডাকতে গেলেন।

আলতাফ মরার মত ঘূমায়। ঘুম ভাঙানো দুঃসাধ্য ব্যাপার। সঙ্গদোষে মানুষ নষ্ট। দুলারীর ঘুমও এখন ভাঙে না। মনোয়ারা প্রাণপণে দুজা ধাক্কাচ্ছেন। কারো কোন সাড়া নেই। অনেকক্ষণ পর দুলারী জড়ানো গলায় বলল, কে?

আমি।

 কি হয়েছে মা?

আলতাফকে তোর বাবা ডাকছে।

কেন?

 বাথরুম ভর্তি তেলাপোকা।

তেলাপোকা তো বাথরুমেই থাকবে। এর জন্যে শুধু শুধু বেচারার ঘুম ভাঙাব? সারাদিন অফিস করে আসে।

ডেকে তোল না মা। তোর বাবা রাগ করবে।

করুক রাগ। আমি ডাকতে পারব না। আর ডাকলেও লাভ হবে না। ওর ঘুম ভাঙবে না।

মনোয়ারা ফিরে এসে দেখেন, বজলুর রহমান বাথরুমে কিল দেম স্প্রে করছেন। তাঁর চোখে-মুখে হিংস্র আনন্দ। তিন হৃষ্ট গলায় বললেন, মেরে সাফ করে দিয়েছি। গুষ্টি নাশ করে দিয়েছি। সান অব এ বিচ। ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি।

মনোয়ার বাথরুমে উঁকি দিয়ে চমকে উঠলেন। সত্যি সত্যি সব পোকা মরে পড়ে আছে। বাথরুমের মেঝেটাকে মনে হচ্ছে মেরুন কার্পেটে ঢাকা। বজলুর রহমান বললেন, দেয়াশলাই নিয়ে আসি, আগুন জ্বালিয়ে দেব। বোন ফায়ার হবে।

মরেই তো গেছে, আগুন জ্বালানোর দরকার কি?

দরকার আছে, তুমি বুঝবে না। তোমাকে যা করতে বলছি কর। কেরোসিন আর আগুন নিয়ে আস। কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বেলে দেব।

শেষে ঘরে আগুন-টাঙ্গুন লেগে একটা কাণ্ড হবে।

তোমাকে যা করতে বলেছি কর। ফালতু তর্ক যথেষ্ট করেছ। Enough is enough.

মনোয়ারা কেরোসিন আর দেয়াশলাই আনতে গেলেন। আগুন লাগানোর উত্তেজনায় বজলুর রহমান আলতাফের কথা ভুলে গেছেন এটা একটা বড় ব্যাপার। নয়তো আরো যন্ত্রণা হত। ঘরে এখন কেরোসিন আছে কিনা কে জানে। বোতলের ভেতর খানিকটা থাকার কথা, না থাকলে ভয়াবহ কাণ্ড হবে।

কেরোসিন ছিল। মনোয়ারা কেরেসিনের বোতল এবং দেয়াশলাই নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দেখেন, সব তেলাপোকা একত্র করে বেসিনে রাখা হয়েছে। বেসিন প্রায় আধাআধি ভরা। বজলুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, ক’টা পোকা আছে বল তো?

মনোয়ারা বললেন, ছয় হাজার।

 তোমার আন্দাজ বলে কিছু নেই। এখানে পোকা আছে মোট ২১৩টা।

তুমি বসে বসে গুনেছ?

 না গুনলে জানব কি করে?

বজলুর রহমান কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলেন। পট পট শব্দ হতে থাকল। উৎকট গন্ধে ঘর ভরে গেল। মনোয়ারা বললেন, শব্দ হচ্ছে কিসের?

পেট ফেটে যাচ্ছে তার শব্দ। পেট ফেটে সাদা সাদা কি যেন বের হচ্ছে।

মনোয়ারা বললেন, ওয়াক থু!

তাঁর নাড়িভুড়ি উল্টে বমি আসছে। ঘরময় উৎকট গন্ধ। মনোয়ারা অনেক কষ্টে বমি আটকে রাখছেন। বমি করলে বজলুর রহমান রেগে যেতে পারেন।

ফরিদা।

হুঁ।

আগুন হল পোকার একমাত্র অষুধ। Only Medicine.

হুঁ।

বজলুর রহমান হাসিমুখে বললেন, সব পোকা মেরে ফেলা ঠিক হয়নি। দু একটা রেখে দেয়া উচিত ছিল। মিসটেক হয়ে গেছে। বিগ মিসটেক।

দু-একটা রেখে দিলে কি হত?

 ওরা গিয়ে অন্যদের খবর দিত। অন্যদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত। হা হা হা।

বজলুর রহমান বেসিনে আরো কেরোসিন ঢেলে দিলেন। গন্ধ আরো বিকট হল। ফরিদা বললেন, ওয়াক থু! বজলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কথায় কথায় ওয়াক থু বলবে না। ওয়াক থু র কি আছে?

গন্ধে টিকতে পারছি না।

 টিকতে না পারলে চলে যাও। দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে কে?

ফরিদা মেয়ের ঘরে চলে গেলেন। মেয়েকে সব জানানো দরকার। তাঁর কিছুই ভাল লাগছে না। মানুষটা এরকম করছে কেন? দুলারী জেগেই ছিল। ফরিদা একবার ডাকতেই উঠে এল। বিরক্ত গলায় বলল, কি হয়েছে?

তোর বাবার কাণ্ডকারখানা আমার ভাল লাগছে না।

 কি করছে বাবা?

পোকা পুড়াচ্ছে।

সেটা আবার কি?

তুই নিজের চোখে না দেখলে বুঝবি না।

দুলারী নিচে নেমে এল। বজলুর রহমান মেয়েকে দেখে হাসিমুখে বললেন, একটা কলম আর ফুলস্কেপ কাগজ অন তো।

পোকা মারার পাকা হিসাব থাকা দরকার। মোট ২১৪টা খতম। দিনের বেলা মারলাম একটা, রাতে মেরেছি দুইশ তের। সব মিলিয়ে টু হানড্রেড এন্ড ফর্টিন।

আচ্ছা।

মেরে সব সাফ করে দেব। রোজ রাতে বোন-ফায়ার হবে। জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো।

দুলারী বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আনন্দে বজলুর রহমানের চোখ ঝলমল করছে? দুলারী বলল, তোমার কি হয়েছে বাবা?

কি হবে আবার?

 কেমন যেন অদ্ভুত করে তাকাচ্ছ!

 তোকে খাতা-কলম আনতে বলছি, আন।

দুলারী কাগজ কলম আনতে গেল। যাবার সময় শুনল–তার বাবা গুনগুন করে গানের সুর ভাজছেন। হিন্দি গানের সুর–লালা লা লালা লা। হচ্ছেটা কি? বাবা কি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন?

.

০৭.

দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের সময় মনসুর আলী তাঁর বেয়ারাকে বললেন, আলতাফ সাহেবকে আসতে বল। বেয়ারা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল। আলতাফের কাছে গিয়ে অন্যদিনের মত তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল না। চোখ বড় বড় করে বলল, বড় সাব আপনেরে ডাকে। এক্ষণ চলেন। এক্ষণ।

আলতাফ টিফিন বক্স খুলেছে। দুটা আটার রুটি, একটা ডিম, একটা কলা। এক কোণায় সামান্য আচার। সে কখনো আচার খায় না। তারপরও দুলারী প্রতিদিন টিফিন বক্সের এক কোণায় খানিকটা আচার দিয়ে দেয়। আলতাফ কলাটি বের করল। ফল সবার শেষে খাওয়া উচিত। সে সবার আগে খায়। ধীরে ধীরে কলার খোসা ছাড়াতে তার ভাল লাগে।

আলতাফ কলার খোসা ছাড়াচ্ছে, বেয়ারা বিরক্ত হয়ে বলল, বড় সাহেব ডাকছেন তো। আলতাফ সহজ গলায় বলল, এখন যেতে পারব না। খাচ্ছি।

বেয়ারা এমন চোখে তাকাচ্ছে যেন তার জীবনের সবচে আশ্চর্যজনক ঘটনাটি সে এই মুহূর্তে ঘটতে দেখছে। গনি সাহেব উঠে এসে বললেন, কি হয়েছে?

বড় সাহেব খবর দিলেন, উনি যাবে না।

 যাবেন না কেন আলতাফ সাহেব?

 খাচ্ছি তো।

আপনার মাথাটা খারাপ কিনা সেটাই তো বুঝতে পারছি না। পরে খাবেন। খাওয়া পালিয়ে যাবে না। যান শুনে আসুন।

আলতাফ অনিচ্ছার সঙ্গে ওঠে দাঁড়াল। গনি সাহেব কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ভয় পাবেন না, আমরা পেছনে আছি। We are behind you আলতাফ বিস্মিত হয়ে বলল, ভয় পাব কেন? গনি সাহেব গলা আরো নামিয়ে দিয়ে বললেন, বড় সাহেবরা কেরানীদের সঙ্গে প্রেমালাপ করার জন্যে ডাকে না। এটা শুধু খেয়াল রাখবেন, তাহলেই বুঝবেন ভয় পাবার কিছু আছে কি না।

.

বড় সাহেব বললেন, কি খবর আলতাফ সাহেব?

আলতাফ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, খবর ভাল স্যার।

বসুন। করছিলেন কি?

 টিফিন খেতে যাচ্ছিলাম স্যার।

খেয়ে ফেলেননি তো?

জ্বি না।

গুড। আমার সঙ্গে খাবেন। খেতে খেতে আপনার কথা শুনি। ঐদিন ঠিকমত শোনা হয়নি।

মনসুর আলী সাহেব নিজেই প্লেট এগিয়ে দিলেন। বড়লোকের খাবার খুব সাধারণ হয়। স্যান্ডউইচ এবং চা। আলতাফের পেটের একটা কোণা শুধু ভরল। সে দুপুরে চা খায় না। চা খাওয়ার জন্যে কেমন জানি লাগছে। পেটে ভুটভট শব্দ হচ্ছে।

আলতাফ সাহেব।

জি স্যার।

ঐ দিন পোকাদের ব্যাপারে কি যেন বলছিলেন, আবার বলুন।

কি বলেছিলাম মনে নেই স্যার।

পোকারা আপনাকে লেখার ব্যাপারে সাহায্য করে–এইসব।

তা স্যার করে।

একটু বুঝিয়ে বলুন। বলতে কোন বাধা নেই তো?

 জি না। তবে কাউকে বলি না।

বলেন না কেন?

দুলারী পছন্দ করে না। দুলারীর ধারণা, এই সব শুনলে লোকে আমাকে পাগল ভাববে।

দুলারীটা কে?

আমার মামাতো বোন। লালমাটিয়া কলেজে বি এ, পড়ে।

পোকার ব্যাপারটা শুধু সেই জানে?

আমার মামা-মামীও জানেন। তাঁ

রা কি আপনাকে পাগল ভাবেন?

জি না, ভাবেন না। তাঁরা আমাকে খুব স্নেহ করেন।

এবার বলুন আপনার পোকার কথা।

বলার মত কিছু নাই স্যার। পোকাদের আমরা খুব তুচ্ছ করি। ওদের তুচ্ছ করা ঠিক না। এরকম তুচ্ছ করলে এরা রেগে যেতে পারে। এরা সহজে রাগে না। একবার রেগে গেলে মুশকিল।

ও আচ্ছা।

মানুষের চেয়ে ওদের বুদ্ধি অনেক অনেক বেশি।

ও আচ্ছা। আপনার কি ধারণা ওদের স্কুল-কলেজ আছে?

ওদের ব্যাপারটা ঠিক আমাদের মত না। ওরা সবাই একসঙ্গে চিন্তা করে, একসঙ্গে ভাবে। এইভাবে তারা শেখে। যেমন স্যার, মনে করুন, একটি তেলাপোকা আপনার রান্নাঘরে আছে, আরেকটা আছে আমাদের অফিসে। রান্নাঘরের পোকাটা কি ভাবছে তা আমাদের পোকাটা জানে।

আপনি এইসব থিওরি ভেবে ভেবে বের করেছেন?

ওরা আমাকে বলেছে।

ও আচ্ছা। কি ভাবে বলল? ডেকে বলল?

 মাঝে মাঝে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখায়।

 সবই তাহলে স্বপ্নে পাওয়া?

 স্বপ্ন ছাড়াও ওরা আমাকে বলে।

মনসুর আলী সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। আলোচনা তিনি চালিয়ে যাবেন কি না বুঝতে পারছেন না। কোন প্রয়োজন অবশ্য নেই। তবে কথা শুনতে মজা লাগছে। পৃথিবীতে বিচিত্র ধরনের মানুষ আছে। সেই বিচিত্র মানুষদের একজন এই মুহূর্তে তাঁর সামনে বসে আছে, যাকে পোকারা অনেক কিছু বলে।

আপনি কি সিগারেট খান আলতাফ সাহেব?

জ্বি না, স্যার।

 সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারে কি পোকাদের কোন বিধি-নিষেধ আছে?

জি না, স্যার।

কথাটা বলেই মনসুর আলীর একটু খারাপ লাগল। কারণ তিনি এই মানুষটাকে নিয়ে মজা করছেন। বিচিত্র মানুষদের নিয়ে সবাই মজা করে। এটা এদের স্বাভাবিক পরিণতি। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো দেখা যাবে অফিসের সবাই একে ডাকছে–পোকাবাবু। তিনি আলতাফ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। নির্বিরোধি লোক। অফিসের কাজে অতিদক্ষ। কাজকর্ম ফেলে রেখেই এই লোকটি যদি পোকা পোকা করতো তাহলে ভিন্ন কথা ছিল। তা তো করছে না। পোকা হল লোকটার পাষ্ট টাইম।

আলতাফ সাহেব।

জ্বি স্যার।

আপনার এই পোকার ব্যাপারটা কতদিনের? অর্থাৎ কতদিন থেকে আপনি পোকাদের ব্যাপারগুলি বুঝতে পারছেন?

অনেক দিনের ব্যাপার স্যার। খুব ছোটবেলার।

বলুন তো শুনি।

আমি স্যার বলতে পারব না।

বলতে কি কোন নিষেধ আছে?

নিষেধ নেই কিন্তু বলতে ইচ্ছা করে না। এটা স্যার আমি দুলারীকেও বলি নাই।

দুলারী নামের আপনার মামাতো বোনকে আপনি সবকিছুই বলেন?

জি স্যার, বলি। হঠাৎ হঠাৎ গভীর রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন বলতে ইচ্ছা করে। শেষ পর্যন্ত বলা হয় না। আমার মনে হয় পোকারাই বাধা দেয়। ওরা তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা বুঝতে পারি না।

পোকারা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে?

জ্বি স্যার করে। এই যে আপনি এত ক্যান্ডিডেট থাকতে আমাকে চাকরি দিয়েছেন। পোকাদের কারণে দিয়েছেন। পোকারা আপনাকে বাধ্য করেছে। বোর্ডের মেম্বাররা আমাকে চাকরি দিতে চায়নি। আপনি জোর করে দিয়েছেন।

আপনার তাই ধারণা?

ধারণা না স্যার, এটাই সত্যি। এই যে আপনি কালো চশমা পরে থাকেন, পোকারা সেটা করেছে।

বুঝতে পারছি না।

আপনার ঘরভর্তি ছোট ছোট পোকা। আপনি যাতে এদের দেখতে না পারেন এই জন্যে পোকারা আপনাকে কালো চশমা পরিয়ে রাখে। আপনি মনে করছেন, আপনি নিজের ইচ্ছায় কালো চশমা পরছেন। আসলে তা না।

এইগুলি পোকারা আপনাকে বলেছে?

 জ্বি না স্যার, এইগুলি আমার অনুমান।

মনসুর আলী গম্ভীর গলায় বললেন, আচ্ছা যান। কাজ করুন, অনেক গল্প করা হল। আলতাফ নিজের চেয়ারে ফিরে আসামাত্র গনি সাহেব ছুটে এলেন। গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, সমস্যাটা কি?

কোন সমস্যা নেই।

স্যার কি নিয়ে আলাপ করলেন?

পোকা নিয়ে।

গনি সাহেব মনে মনে বললেন, হারামজাদা, আমার সঙ্গে রসিকতা! আমি তোর পাছা দিয়ে পোকা ঢুকায়ে দেব। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। এমিতে অবশ্যি সহজ গলায় বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা। পোকা নিয়ে কথা বলা খুব ভালো। বলুন, কথা বলুন।

মনসুর আলী বেলা তিনটার দিকে চোখ থেকে কালো চশমা খুললেন। তাঁর চোখ জ্বালা করতে লাগল। আলো তাঁর একেবারেই সহ্য হয় না। বেয়ারাকে বললেন জানালার পর্দা সরিয়ে দিতে। পর্দা সরোনোর পরেও ঘরে তেমন আলো হল না। কারণ জানালা বন্ধ এবং জানালার কাঁচে নীল রঙ করা। জানালা খুলতে হলে এয়ারকুলার বন্ধ করতে হয়। মনসুর আলী এয়ারকুলার বন্ধ করে জানালা খুলতে বললেন। জানালা খোলা খুব সহজ ব্যাপার হল না। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সব জং ধরে গেছে। মিস্ত্রী ডাকিয়ে জানালা খুলতে হল। মনসুর আলী তার রিভলভিং চেয়ারে বসে দেখলেন, সারি সারি পোকা তাঁর টেবিলের পা বেয়ে উপরের দিকে উঠছে। তার প্রথমে মন হল পিপড়া। এরা বর্ষার সময় ডিম নিয়ে শুকনো আশ্রয়ের খোঁজে যায়। ভাল করে লক্ষ করে দেখলেন, পিপড়া না, অন্য কোন পোকা। লালচে রঙ। দশটা করে পা। শুধু যে টেবিলেই পোকা তা না। মেঝেতে পোকা। দেয়ালে পোকা। দেয়ালের পোকাগুলির রঙ সাদা। দেয়ালের রঙের সঙ্গে মিশে আছে, খুব ভাল করে লক্ষ না করলে বোঝাই যায় না! মেঝেতেও পোকা। এদের রঙ আবার নীলচে। মেঝের কার্পেটের সঙ্গে সেই রঙের কিছু মিল আছে। তাঁর মাথা ধরে গেল। প্রচণ্ড মাথা ধরল। মাথাধরার অবশি যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। অনেকদিন পর চোখে কড়া আলো এসে লেগেছে। নিয়মের ব্যতিক্রম করে মনসুর আলী আজ অফিস ছুটি হওয়ার এক ঘণ্টা আগেই বাড়ি চলে গেলেন।

.

০৮.

আলতাফ বাড়ি ফিরে দেখে দুলারী শুকনো মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আলতাফ বলল, কি হয়েছে? দুলারী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কিছু হয়নি। আলতাফ বলল, তুমি আজ কলেজে যাও নাই?

কলেজে কি করে যাব? বাসায় কত কাণ্ড হচ্ছে।

কি কাণ্ড?

বাবার মাখা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে।

ও আচ্ছা।

আলতাফ এমনভাবে ও আচ্ছা বলল যেন মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। রোজই হয়। দুলারী বলল, তুমি তাড়াতাড়ি একজন ডাক্তারের কাছে যাও।

আচ্ছা।

আমিও যাব, বাবার কি হয়েছে ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলব। তুমি বলতে পারবে না। বাবাকে সঙ্গে নেয়া যাবে না।

আচ্ছা।

কোন্ ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায় বল জে?

বিধুবাবু পাড়ার হোমিওপ্যাথি। ভাল ডাক্তার। রোগির ভিড় লেগেই আছে। আগে তাঁর ফী ছিল পাঁচ টাকা। সম্প্রতি দশ টাকা করেছেন। তবে পুরানো রোগিদের বেলায় এখনো পাঁচ টাকা।

.

বিধুবাবু দুলারীকে দেখেই বললেন, তোর বাবার গলার কাটা দূর হয়েছে তো? গলার কাটার একটাই অষুধ। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাশাস্ত্রে গলার কাটার আর কোন অষুধ নেই।

বিধুবাবুর এই এক সমস্যা–একবার কোন অষুধ দিলে বছরের পর বছর মনে থাকে। চার-পাঁচ বছর পরেও বিধুবাবুর সঙ্গে যদি দুলারীর দেখা হয় তিনি হাসিমুখে বলবেন, তোর বাবার গলার কাঁটাটার অবস্থা কি?

তাঁর অষুধে কাঁটা দূর হয়নি এটা বললে ঘণ্টাখানিক বক্তৃতা শুনতে হবে। দুলারী সে কারণেই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল। করুণ গলায় বলল, চাচা, বাবাকে একটা অষুধ দিন।

হয়েছে কি?

মাথা গরম হয়েছে। বাবা চারদিকে শুধু তেলাপোকা দেখতে পাচ্ছেন।

ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।

দুপুরবেলা ঘুমুতে গিয়েছেন, চাদর গায়ে দিয়েই চিৎকার শুরু করলেন, পোকা! পোকা। আমরা ছুটে গেলাম। দেখি, বাবা থরথর করে কাঁপছেন। অথচ একটা পোকাও নেই। কিন্তু বাবা চারদিকে পোকা দেখছেন।

ও আচ্ছা।

 বাথরুমে যখন যান তখন সেখানেও পোকা দেখেন। বেসিনে পোকা, মেঝেতে পোকা, কমোডে পোকা, কিন্তু আমরা দেখি না।

হুঁ।

ঘুমের মধ্যেও তেলাপোকা দেখেন। বিকেলে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছি, হঠাৎ জেগে উঠে বললেন, আমার সারা শরীরে পোকা উঠে গেছে। দেখতে পাচ্ছিস না?

বিধুবাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ও কিছু না, বিকার হয়েছে। পেট গরমের জন্যে হয়েছে। হজমের গণ্ডগোল হলে হয়। পিত্ত নষ্ট হয়ে যায়। সেখান থেকেই বিকার। আর্নিকা টু হানড্রেড একফোঁটা খাইয়ে দে, আর দেখতে হবে না। আর্নিকা হল বিকারের বাবা।

এক ফোঁটাতেই কাজ হবে?

আধা ফোঁটাতেও হবে। আধা ফোঁটা করা যায় না বলেই এক ফোঁটা। হোমিওপ্যাথির মজা এইখানেই। তাহলে এক গল্প শোন। নাইনটিন ফিফটি থ্রি-র ঘটনা …

গল্পটা আরেক দিন শুনব চাচা।

আরে শুনে যা, পরে মনে থাকবে না। আমার কাছে একবার এক রোগি এসেছেন। আমি অনেক বিচার-বিবেচনা করে তাঁকে দিলাম কেলিফস ফোর হানড্রেড। আমি তাকে বললাম, অষুধ নিয়ে যান, খেতে হবে না। দৈনিক একবার শুকবেন। এতেই রোগ আরোগ্য হবে।

হয়েছিল?

 হবে না মানে? কি বলিস তুই? এটা কি এলোপ্যাথি পেয়েছিস যে ইনজেকশন দিয়ে দিয়ে শরীর মোরব্বা বানিয়ে ফেলব, তারপরেও রোগ সারবে না? তোর বাবাকে যে অষুধ দিলাম নিয়ে যা, দুটা ডোজ পড়ুক, তারপর দেখবি হানিম্যানের মাহাত্ম।

.

বিধুবাবুর অষুধ বজলুর রহমান খেতে রাজি হলেন না। রাগী গলায় বললেন, আমার কি হয়েছে? অষুধ দিচ্ছিস কেন?

দূলারী ক্ষীণ গলায় বলল, তুমি চারদিকে পোকা দেখছ এইজন্যে অষুধ।

আমাকে অষুধ দিচ্ছিস কোন বিবেচনায়? পোকাদের অষুধ দে যেন ওরা আমার সামনে না আসে।

বাবা, তুমি চোখে ভুল দেখছ।

আমি চোখে ভুল দেখছি। আর তোরা সব শুদ্ধ দেখছিস? ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার। যা আমার সামনে থেকে।

দুলারী পালিয়ে গেল। বজলুর রহমান সন্ধ্যাবেলা পোকা মারার আরো সব অষুধ কিনে আনলেন। বিষাক্ত সব অষুধ। খালি হাতে স্প্রে করা যায় না। গ্লাভস পরে নিতে হয়। তিনি গ্লাভসও কিনে আনলেন। রাতে খেতে বসে ভাতের নলা মুখের কাছে নিয়ে নামিয়ে রাখলেন, মনোয়ারা বললেন, কি হয়েছে?

ভাতে তেলাপোকার গন্ধ। মুখে নেয়া যাচ্ছে না।

নতুন চালের ভাত গন্ধ হবে কেন?

 সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? ভাতকে জিজ্ঞেস কর।

 ঘরে পোলাওয়ের চাল আছে। দেই তোমাকে চারটা ফুটিয়ে?

 দাও।

বজলুর রহমান সেই চালের ভাতও খেতে পারলেন না। মুখের কাছে নিয়ে ফেলে দিলেন। ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, এখন তো আরো বেশি গন্ধ। মনে হচ্ছে তেলাপোকা সিদ্ধ করে নিয়ে এসেছ।

রাতে কিছু না খেয়েই তিনি বিছানায় গেলেন। বালিশে মাথা রেখেই লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বলেন। মনোয়ার ভয়ে ভয়ে বললেন, কি হয়েছে?

বজলুর রহমান থমথমে গলায় বললেন, বিছানা-বালিশ ধুতে মনে থাকে না? কর কি সারাদিন? পোকার গন্ধে ঘরে থাকা যায় না।

ধোয়া একটা চাদর দেই?

 কিছু দিতে হবে না।

দুলারী ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা, তুমি বুঝতে পারছ না তোমার শরীর খারাপ করেছে। বিধু চাচার অষুধটা খেয়ে নাও। তোমার পায়ে পড়ি বাবা।

বজলুর রহমান বললেন, নিয়ে আয় তোর অষুধ!

বর্জলুর রহমান বাকি রাতটা বারান্দার চেয়ারে বসে কাটালেন। তাঁর সঙ্গে জেগে রইলেন মনোয়ারা এবং দুলারী। শুধু আলতাফ যথাসময়ে ঘুমুতে গেল। দুলারী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবার এতবড় অসুখ, তুমি দিব্যি ঘুমুতে যাচ্ছ! তোমার কি মায়া দয়া নেই?

আলতাফ হাই তুলতে তুলতে বলল, পোকাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওরা মামার উপর রাগ করেছিল। আমি বুঝিয়ে বলেছি! সকালবেলা ঠিক হয়ে যাবে।

দুলারী রাগ চাপতে চাপতে বলল, পোক বিষয়ে তুমি আর কোন কথা আমাকে বলবে না।

আচ্ছা।

একজন মানুষ পোকার ভয়ে মারা যেতে বসেছে আর তুমি আরাম করে ঘুমুতে যাচ্ছ।

পোকাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওরা মানুষের ক্ষতি করে না।

কে বলল তোমাকে?

ওরাই বলেছে। ওরা জানে মানুষ খুব অসহায়, এই জন্যেই ওরা মানুষকে রক্ষা করে চলে। পোকারা যদি ঠিক করে তাহলে তারা একদিনে পৃথিবীর সব মানুষ শেষ করে দিতে পরে?

আজেবাজে কথা বলবে না তো। তোমার ঘুম দরকার, তুমি ঘুমাও।

আলতাফ ঘুমিয়ে পড়ল।

.

বিধুবাবুর আর্নিকা টু হানড্রেড অষুধের জন্যেই হোক কিংবা আলতাফের কারণেই হোক ভোরবেলায় বজলুর রহমান নিতান্তই সাধারণ মানুষ। আগ্রহ করে সকালের নাশতা খেলেন। মনোয়ার ভয়ে ভয়ে বললেন, রুটিতে তেলাপোকার গন্ধ পাচ্ছ না তো?

বজলুর রহমান ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, সব সময় উদ্ভট কথা। রুটিতে তেলাপোকার গন্ধ হবে কেন? রুটি কি তেলাপোকার পাউডার দিয়ে বানায়?

মনোয়ারা তৃপ্তির হাসি হাসলেন।

.

০৯.

বেলা এগারোটা।

মনসুর সাহেব আলতাফকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেছেন। তাদের দুজনের সামনেই কফির মগ। আলতাফ কফিতে একটা চুমুক দিয়েই মগ নামিয়ে রেখেছে। সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না এমন কুৎসিত জিনিস মানুষ কি করে খায়।

মনসুর সাহেবের ঘর অন্ধকার। চোখে কালো চশমা। গতকাল কিছু সময় চশমা ছাড়া ছিলেন। এতেই মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। এখনো তার রেশ আছে। অফিসের কাজে মন বসছে না বলেই আলতাফকে ডেকে এনেছেন। লোকটিকে তার যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। লোকটি এতে প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে কি না কে জানে! এদের প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না। প্রশ্রয় পেলেই মানুষ ঘাড়ে উঠে যেতে চেষ্টা করে। মনসুর সাহেব ঠিক করে রেখেছেন, আজই শেষ দিন। আর কোন গল্পগুজব হবে না।

আলতাফ সাহেব!

জি স্যার।

কফি খাচ্ছেন না যে?

 ভাল লাগছে না স্যার।

অভ্যাস না থাকলে ভাল না লাগারই কথা। আপনি কি ধূমপান করেন?

 জি না।

ধূমপানও অভ্যাসের ব্যাপার। অভ্যাস না থাকলে সিগারেটের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসবে। আবার যারা অভ্যস্ত তারা পাগল হয়ে থাকে এই ধোয়াটার জন্য।

জি-স্যার।

মনসুর সাহেব সিগারেট ধরিয়ে তার রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিলেন। খানিকটা ইতস্তত করে বললেন–পোকাদের ভাষায় যে কাগজে কিছু লেখা লিখেছিলেন সেটার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলুন।

মনসুর সাহেব ড্রয়ার থেকে কাগজটা বের করলেন। আলতাফ কাগজটা হাতে নিল। নিচু গলায় বলল, স্যার, আমি তো ওদের সাহায্য ছাড়া পারব না।

ওদের সাহায্য নিয়েই করুন।

তাহলে আমার নিজের টেবিলে চলে যাই?

যান। লাঞ্চ টাইমে আসবেন। তখন দেখব।

আলতাফ উঠে দাঁড়াল। মনসুর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, পোকা প্রসঙ্গে এটাই হবে আপনার সঙ্গে আমার শেষ বৈঠক।

জি আচ্ছা, স্যার।

আপনার টেবিলে একটা ফাইল পাঠিয়েছি সকালবেলায়। পেয়েছেন?

পেয়েছি স্যার।

ফাইলটা খুব জরুরি। আপনি কাজকর্ম সাবধানে করেন বলে আপনাকে পাঠানো হল। ফাইলে নোট দেয়া আছে। সেই নোট দেখে কাজ শেষ করবেন। আজ বাসায় যাওয়ার সময় ফাইলটা নিয়ে যাব।

জ্বি আচ্ছা।

মনসুর সাহেব বিরক্ত বোধ করছেন। বিরক্তিটা নিজের উপর। সামান্য বিষয় নিয়ে তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন। সামান্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। তিনি চোখ থেকে কালো চশমা খুললেন। চোখ জ্বালা করতে লাগল। টেবিলের পায়ে সারি সারি পোকা দেখা যাচ্ছে। অথচ কাল বেয়ারাকে বলে দিয়েছেন সারা ঘরে যেন খুব ভাল করে এরোসল স্প্রে করে দেয়। এরোসল কিনে আনার টাকাও দিয়েছেন।

আসলে এই ঘরটাই স্যাঁতস্যাঁতে। ট্রপিকেল দেশের একটা ভেজা ঘরে পোকা থাকবেই। ঘরের কার্পেট রোদে দেয়া দরকার। আজ দেয়া যেত। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে, বৃষ্টি নামতে পারে। তাকে অপেক্ষা করতে হবে রোদের জন্যে। কড়া রোদের জন্যে। কড়া রোদ উঠলেই এই ঘরের যাবতীয় আসবাব তিনি ছাদে নিয়ে যাবেন। শুধু অফিসের আসবাব না–নিজের বাড়ির আসবাবও। বাড়িতেও একই অবস্থা। গতকালই প্রথম লক্ষ করলেন।

তিনি আলো সহ্য করতে পারেন না। কাজেই বাড়িও অন্ধকার করে রাখেন। চোখের সমস্যাটা দীর্ঘদিন ধরে বিব্রত করছে। দেশের এবং বিদেশের অনেক ডাক্তারই দেখিয়েছেন। সর্বশেষ যিনি দেখেছেন তার নাম প্রফেসর জেনিংস। আমেরিকান ডাক্তার। তিনি এক পর্যায়ে বললেন, তোমার চোখে কোন ত্রুটি নেই। সমস্যাটা মানসিক। তুমি একজন মানসিক রোগের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বল। মনসুর সাহেব ডাক্তারের কথায় রেগে গিয়েছিলেন। আমেরিকান ডাক্তারদের এই সমস্যা। যখন কিছু ধরতে পারে না তখন বলে বসে–সমস্যাটা মানসিক।

সেই মানসিক রোগের ডাক্তার তিনি দেখিয়েছিলেন। তিনিও কিছু ধরতে পারেননি। ধরতে পারার কথা নয়। তার জীবনে বড় কোন দুর্ঘটনা কিংবা বড় কোন আঘাতের ঘটনা ঘটেনি। প্রথম যৌবনে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। সে তো অনেকেরই হয়। তিনি আর বিয়ে করেননি। চোখের সমস্যা তখনি দেখা দিতে শুরু করে।

মনসুর সাহেবের চোখ জ্বালা করছে। অনেকক্ষণ হল তার চোখে চশমা নেই। চোখ জ্বালা করারই কথা। তিনি চশমা চোখে দিয়ে ডাকলেন–মকবুল।

তাঁর ব্যক্তিগত বেয়ারা মকবুল ছুটে এল।

কাল ঘরে এরোসল দিয়েছিলে?

একটা পুরা বোতল দিছি স্যার।

কাছে আস তো।

মকবুল ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে এল। মনসুর সাহেব সহজ গলায় বললেন, টেবিলের গায়ে এই যে পোকা, এদের দেখতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি স্যার।

কি পোকা এগুলি জান?

জানি না স্যার।

একটা পরিষ্কার বোতল জোগাড় কর। বোতলে কয়েকটা পোকা ভর।

জি আচ্ছা স্যার।

মকবুল বোতল আনতে ছুটে গেল। মনসুর সাহেব টেলিফোন হাতে তুলে নিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে টেলিফোন করবেন। ভঃ ওসমান সেখানে আছেন। বিলেতে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ভাল পরিচয়। বিদেশের অন্তরঙ্গতা দেশে এলে থাকে না। তাদের রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তাদের কথা হয়। মনসুর সাহেব ঠিক করলেন ওসমানকে জিজ্ঞেস করবেন–এই পোকাগুলির নাম কি? এতে লাভ কি হবে? আপাতত তিনি কোন লাভ দেখতে পাচ্ছেন না। জানার জন্যেই জানা। মকবুল খালি বোতল নিয়ে এসেছে। বোতলে পোকা ভরার চেষ্টা করছে। ফাঁকে ফাঁকে বড় সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। মনসুর সাহেব খুব বিরক্তি বোধ করছেন।

.

গনি সাহেব লক্ষ্য করলেন আলতাফ চোখ বন্ধ করে আছে। দীর্ঘ সময় চোখ বন্ধ করে থাকে, তারপর চোখ খুলে–কাগজে কি-সব যেন লিখে–আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। গনি সাহেব এগিয়ে গেলেন।

কি করছেন আলতাফ সাহেব?

আলতাফ চোখ মেলে শান্ত গলায় বলল, এখন যান।

 করছেনটা কি?

একটা জরুরি কাজ করছি।

আমি তো দেখছি চোখ বন্ধ করে আছেন, মাঝে মাঝে বিড় বিড় করছেন।

 প্লীজ, এখন বিরক্ত করবেন না।

এমন কি কাজ যে চোখ বন্ধ করে থাকতে হয়। চোখ বন্ধ করে একটা কাজই ভাল করে করা যায়। তার নাম ঘুম।

গনি সাহেব, দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না।

আচ্ছা ভাই, আচ্ছা। আর বিরক্ত করব না। আপনি বড় সাহেবের পেয়ারের লোক। বিরক্ত করে শেষে কোন ঝামেলায় পড়ি! শেষে দেখা যাবে চাকবিই খতম। নো জব। ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

আলতাফ কিছু বলল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল। তাকে পোকাদের সাহায্য নিয়ে লেখাটা শেষ করতে হচ্ছে। তারা তেমন সাহায্য করে না। একটা শব্দ বলে আবার সেটা দিয়ে অন্য শব্দ বলে। আলতাফ লিখেছে–

হে মানব সম্প্রদায়। তোমাদের জন্যে আছে অন্ধকার ভবিষ্যৎ। কারণ তোমরা অন্ধকারের জীব। তোমাদের সৃষ্টি হয়েছিল অন্ধকারের জন্যে। তোমরা সেখানেই ফিরে যাবে। ফিরে যেতে হবে শুরুতে।

একই লেখা আবার অন্যভাবে লিখতে হয়েছে। কারণ পোকারা কিছু কিছু শব্দ বদলে দিয়েছে। আলতাফ আবার লিখল–

অভিবাদন মানব সম্প্রদায়! তোমাদের জন্য আছে মঙ্গলময় অন্ধকার। কারণ তোমাদের মঙ্গল অন্ধকারে। মঙ্গলের জন্য তোমাদের সৃষ্টি। তোমরা সৃষ্টিতে ফিরে যাবে। এক বিন্দুতেই আদি ও অন্ত।

এ নিয়ে মোট চারটা অনুবাদ তৈরী হল। আলতাফ এই চারটার মধ্যে কোনটা রাখবে বুঝতে পারছে না। পোকারা বলছে–কোনটা ফেলা যাবে না। প্রতিটিই সত্য। সত্য এক ও অভিন্ন নয়। সত্যের অনেক ছবি। প্রতিটি ছবি আলাদা আলাদা সত্য।

.

১০.

ডঃ ওসমান বোতলে ভর্তি পোকাগুলির দিকে তাকিয়ে আছেন। মনসুর বললেন, এদের নাম কি?

ডঃ ওসমান হাসিমুখে বললেন, এদের নাম হল পোকা। ইনসেক্ট।

কি পোকা?

 বৈজ্ঞানিক নাম চাও, না সাধারণ নাম হলেই চলবে?

 সাধারণ নাম জানলেই হবে।

এরা এক ধরনের উইপোকা। উইপোকার অনেক ভ্যারাইটি আছে। এটা হল বিশেষ এক ভ্যারাইটি। এরা সাধারণত মৃত জীবজন্তুর গায়ে ঘুরে বেড়ায়। দেখতে পিঁপড়ার মত হলেও পিপড়াদের সঙ্গে তাদের খানিকটা প্রভেদ আছে। পিপড়ার মৃত জীবজন্তু খেয়ে ফেলে। এরা খায় না। শুধু ঘুরে বেড়ায়।

কেন?

 কেন তা জানি না। ওদের জিজ্ঞেস করা হয়নি।

ডঃ ওসমান শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগলেন। মনসুর সাহেব বন্ধুর হাসিতে যোগ দিতে পারলেন না। রসিকতা কখনোই তাঁকে আকর্ষণ করে না। হাসি থামিয়ে ওসমান সাহেব বললেন, মুনসুর!

হু।

হঠাৎ পোকা নিয়ে মেতেছ কেন? পোকা তোমার বিষয় না।

মানুষের বিষয় তো বদলায়। তোমার কি বদলেছে?

বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আরেকটা কথা–পোকাদের কি বোধশক্তি আছে? মানে চিন্তা বা কল্পনা করার ক্ষমতা আছে?

বোধ চিন্তা কল্পনা এইসব উচ্চমার্গের বিষয়ের জন্যে দরকার মস্তিষ্ক, ঘিলু। তা পোকাদের নেই বললেই হয়। ওরা বেঁচে থাকে instinct-এর উপর। ওদের চালিকাশক্তি instinct, মস্তিষ্ক নয়।

ঘিলুর পরিমাণ বেশি থাকলেই বোধ চিন্তা এবং কল্পনা এইসব বেশি থাকবে?

অবশ্যই।

গরু এবং গাধার মাথায় তো অনেকখানি মগজ থাকে। অন্তত মুরগির চেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু গরুর বোধ বা বুদ্ধি কোনটাই মুরগির চেয়ে বেশি না।

ডঃ ওসমান কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার মূল সমস্যাটা বল। তারপর যুক্তিতর্কে যাওয়া যাবে।

সমস্যা কিছু না।

কিছু না বললে তো হবে না। কিছু-একটা তো আছেই। What is that?

মনসুর সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমাদের অফিসের একজন কর্মচারি–তার ধারণা, সে পোকাদের সঙ্গে কমুনিকেট করতে পারে। পোকার তার সঙ্গে কথা বলে।

ওসমানি সাহেব মোটেই চমকালেন না। স্বাভাবিক গলায় বললেন, পৃথিবীতে অনেক লোক আছে যারা জ্বীন, পরী বিশ্বাস করে। এদের সঙ্গে তারা কথা বলে। অনেকে আছে যারা প্রেতাত্মার সঙ্গে কথা বলে। তাতে কি যায় আসে। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ। তাদের অতি ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশ কি বলছে না বলছে তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের স্থান হওয়া উচিত পাগলাগারদে।

পাগলাগারদে?

অবশ্যি পাগলাগারদে।

 শুধু শুধু একটা লোক কেন বলবে–সে পোকাদের কথা বুঝতে পারে?

অন্যদের বোকা বানানোর জন্যে বলবে। তোমার অফিসের ঐ কর্মচারি তোমাকে এই কথা বলেছে, কারণ, সে তোমাকে বোকা বানাতে চেয়েছে। তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তুমি বোকা বনেছ। কারণ তুমি খানিকটা হলেও ব্যাপারটা বিশ্বাস করেছ।

আমার অফিসের ঐ কর্মচারিটা বোকা ধরনের। আমার মনে হয় না সে আমাকে বোকা বানাতে চায়।

তাহলে ধরে নিতে হবে–তোমার ঐ কর্মচারিটির মাথা খারাপ। কায়দা করে তাকে দু-একটা প্রশ্ন করলেই পুরো ব্যাপার বের হয়ে যাবে। তুমি কি তাকে জেরা করেছ?

না।

জেরা কর। সহজ জেরা না। ঘাঘু উকিলের জের। দেখবে সব বের হয়ে আসবে। তারপর তাকে গলাধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দাও। এ জাতীয় লোক প্রতিষ্ঠানের জন্যে ক্ষতিকর।

মনসুর সাহেব চুপ করে রইলেন। ওসমান সাহেব বললেন, তোমার হয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করতে পারি। করব?

বেশ তো কর। এখনি চল আমার সঙ্গে। যাবে?

ওসমান সাহেব বললেন, যাওয়া যেতে পারে।

.

তাঁরা অফিসে পৌঁছলেন পাঁচটার কিছু পরে। আলতাফকে পাওয়া গেল না। সে ঠিক পাঁচটায় অফিস থেকে বের হয়ে গেছে।

ওসমান সাহেব বললেন, লোকটার বাসায় যাওয়া যায়। সেটাই ভাল হবে। বাসার ঠিকানা জানা আছে?

মনসুর সাহেব বললেন, ঠিকানা বের করা কোন সমস্যা না। তুমি কি সত্যি যাবে?

হ্যাঁ যাব।

 চল যাই। যদিও আমার এখন মনে হচ্ছে আমরা খানিকটা বাড়াবাড়ি করছি।

ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। তার মুখের বিরক্ত ভাব আরো স্পষ্ট হল। তিনি কোন রকম আগ্রহ বোধ করলেন না। তবে তা মনসুর সাহেবকে জানাতে চান না। ক্ষমতাবান বন্ধুদের সামান্য আগ্রহকেও বড় করে দেখতে হয়। এটাই নিয়ম। একটা লোক পোকার সঙ্গে কথা বলে–ব্যাপারটাই হাস্যকর। হাস্যকর জেনেও তিনি প্রশ্রয় দিচ্ছেন, কারণ মনসুরকে প্রশ্রয় দিতে হয়। সবাই দেবে। সমাজ এটা ঠিক করে দিয়েছে।

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ