সাতদিনের জায়গায় দশদিন পার করে নোমান ফিরল। রোদে পুড়ে চেহারা এমন হয়েছে যে তাকানো পর্যন্ত যায় না। এর সঙ্গে আছে কাশি। খুক খুক, খুক খুক কাশি লেগে আছে। ঘরে ঢোকার পর থেকেই কাশছে।

খুব পরিশ্রম হচ্ছে নবনী। ছবি তৈরি যে কি কঠিন কাজ তুমি ধারণাই করতে পারবে না। একটা সাধারণ দুই মিনিটের দৃশ্য করতে লাগল সারাদিন। দৃশ্যটা কি জান? দৃশ্যটা হল— নায়িকা পুকুর ঘাটে গোসল করতে গিয়েছে। একটা সবুজ কচুপাতায় তার গায়ে মাখা সাবানটা রাখা। হঠাৎ বাতাস লেগে সাবানটা পানিতে পড়ে গেল। নায়িকা পানিতে ড়ুব দিয়ে সাবান খুঁজছে।

অহনা তোমাদের নায়িকা?

হুঁ। আমাদের ছবিতে ওর নাম হল জাহেদা। গ্রামের মেয়ে হিসেবে তাকে যে কি মানিয়েছে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। স্টিল ছবি নেয়া আছে, তোমাকে দেখাব। এখন ভাল করে চা করা দেখি, চা খাব। আউট ডোরে থেকে থেকে চায়ের অভ্যাস হয়েছে।

আমি চা বানিয়ে এনে দেখি খাটে পা বুলিয়ে সে ভোস ভোঁস করে সিগারেট টানছে। তার শুধু যে চায়ের অভ্যাস হয়েছে তাই না। সিগারেটের অভ্যাসও হয়েছে।

নবনী!

উঁ।

গোসলের পানি দাও। গোসল করে বেরুব। অহনার খোঁজে যেতে হবে। ও রাগারগি করে কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছে। আমরাতো কিছুই জানি না। সন্ধ্যাবেলা স্যুটিং। জাহেদা হাতে এক মুঠি পাঠখড়ি নিয়ে যাচ্ছে। পাটখড়ির মাথায় আগুন, সেই আগুনের আভায় পথ চলছে… দারুণ দৃশ্য। লাইট ফাইট করতে রাত দশটার মত বেজে গেল। সফিক আমাকে বলল, যা অহনাকে নিয়ে আয়। আমি আনতে গিয়ে শুনি সে সন্ধ্যাবেলা ব্যাগ গুছিয়ে স্টেশনের দিকে গেছে। বোঝ অবস্থা।

তোমাদের স্যুটিং হল না?

কিভাবে হবে? রাতে যে ফিরে আসব সেই উপায়ও নেই… ট্রেন হল পরদিন ভোর সাতটায়।

নোমান প্ৰায় এক ঘণ্টা লাগিয়ে গোসল করল।

মাথায় পানি ঢালে আর কাশে। কি বিশ্ৰী কাশি। এর মধ্যে এত ঠাণ্ডা লাগানো কি উচিত হচ্ছে? বাথরুম থেকে বের হয়ে সে কেমন জবু থবু হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে কিছুতেই উৎসাহ নেই। বাসায় যে নতুন একটা কাজের মেয়ে আছে সেদিকে তার চোখ পড়ল না। তার পোষা ময়না সম্পর্কেও সে তেমন উৎসাহ দেখালো না। একবার শুধু বলল, ময়নাটাকে ঠিকমত খাওয়া দাওয়া দেয়া হয়েছে। নবনী? ব্যাস এই পর্যন্তই।

নোমান বলল, আরেক কাপ চা দাও নবনী। গোসল করে শরীরটা ফ্রেস হয়ে গেছে। তোমার একা একা অসুবিধা হয়নিতো?

না।

সফিক একবার বলছিল, তুই তোর বৌকে নিয়ে আয়–সে একা আছে।

নিয়ে গেলেই পারতে।

অহানা রাজি হল না।

রাজি হলেন না কেন?

অহনাকে বোঝা মুশকিল। ও কখন কি করে খুব স্ট্রেঞ্জ মেয়ে। ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ.। অনার্স, এম. এ. দুটাতেই ফার্স্টক্লাস। ইউনিভার্সিটিতে চাকরি পেয়েছিল— বলল চাকরি করবে না। ঘর সংসার করবে। বছর বছর বাচ্চা দিয়ে–ঘর ভর্তি করে ফেলবে, ছেলেপুলেয়… হা হা হা। এই যুগের কোন মেয়ের মুখে এই জাতীয় কথা শুনেছ?

না।

ওর আরো অদ্ভুত ব্যাপার আছে। এক সময় বলব। কই চা দিলে না?

আমি চা এনে দিলাম। নোমান চা শেষ করেই বের হয়ে গেল। তার চোখ টকটকে লাল। কে জানে হয়ত জ্বর এসেছে। মদিনা বলল, আম্মা লোকটা কে?

আমি বললাম, কেউ না।

ইচ্ছা করে বলা না। মুখ ফসকে বলে ফেলা।

নোমান জ্বর গায়ে রাত নয়টার দিকে ফিরল। চোখ লাল, জ্বরের ঘোরে শরীর কেঁপে উঠছে। আমি বললাম, অহনাকে পাওয়া গেল?

দেখা হয় নি, তবে খোঁজ পাওয়া গেছে। চলে গেছে রাজশাহী। তোমাকে বলেছি না–অদ্ভুত মেয়ে।

এসো শুয়ে থাক। তোমার জ্বর বাড়ছে। ঘরে কি থার্মোমিটার আছে?

আছে। তবে কাজ হয় না।

কাজ হবে না কেন?

থার্মোমিটারের মাথাটা ভাঙা।

আমি অবাক হয়ে বললাম, মাথা ভাঙা থার্মোমিটার রেখে দিয়েছ কেন?

ফেলতে মায়া লাগে।

রাতে সে কিছু খেল না। মাঝরাতের দিকে তার জ্বর খুব বাড়ল। আমি তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছি। সে বিড়বিড় করে নানান কথা বলছে—। জ্বরের ঘোরে বলছে বলেই আমার ধারণা।

কোটিপতি হওয়া কঠিন কিছু না। ইচ্ছা করলে হওয়া যায়। দরকারটা কি বল? কোন দরকার নাই। অহানার কথাই ধর–অহনাও কিন্তু কোটিপতি। গরিব ঘরের মেয়ে ছিল। কি যে ভয়ঙ্কর গরিব চিন্তাই করতে পারবে না। অথচ এমন ভাল ছাত্রী। পড়াশোনার এত আগ্রহ। ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়ত তখন হলের সীটরেন্ট দেয়ার পয়সা নেই। সফিক আমার হাত দিয়ে টাকা পাঠাতো। সফিক একটা কথা বলে—নো ফ্ৰী লাঞ্চ। এই পৃথিবীতে সব কিছুই নগদ অর্থে কিনতে হবে। হো হো হো। বুঝতে পারছ কিছু?

বুঝতে পারছি না। বুঝতে চাচ্ছিও না। টাকা দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে সফিক কিনেছে। এখন চাকা ঘুরে গেছে মেয়েটা কিনে নিয়েছে সফিককে। ঢাকা শহরে যত প্রোপার্টি সফিকের আছে সব কিন্তু ঐ মেয়ের নামে। এখন একবার যদি এই মেয়ে সফিককে ছেড়ে যায়–সফিক পথে বসবে। আজিমপুর কবরস্থানে বসে ভিক্ষা করতে হবে। সুর করে গান গাইতে হবে–আল্লাহুম্মা, সাল্লেআলা সাইয়াদেনা, মৌলানা মোহাম্মদ!

প্লিজ চুপ করে থাক। ঘুমানোর চেষ্টা কর।

আহা কথা বলতে ভাল লাগছে তো। শোন না কি বলি–দারুণ ইন্টারেস্টিং। আমি করতাম কি মাসের দুই তিন তারিখে টাকা নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। হল গেইট থেকে স্লীপ পাঠাতাম–জাহেদা খাতুন, সেকেন্ড ইয়ার অনার্স— রুম নাম্বারা…।

উনার নামতো অহনা।

অহনা পরে হয়েছে–তখন তার নাম ছিল জাহেদা খাতুন। বিয়ের পর হল অহনা। বুঝলে নবনী। খামে ভর্তি করে টাকা নিয়ে যেতাম। সব নতুন চকচকে নোট। জাহেদা টাকাগুলো হাতে নিত। আমি সঙ্গে করে মনিঅৰ্ডার ফরম নিয়ে যেতাম। এইখানে বসেই সে মনিঅৰ্ডার ফরম পূরণ করত। দেশে টাকা পাঠাতো। মনিঅৰ্ডার ফরমে লিখত–মা, তোমাকে কিছু টাকা পাঠালাম। এখানে দুটা মেয়েকে প্রাইভেট পড়িয়ে যা টাকা পাই তাতে আমার চলে গিয়েও কিছু থাকে।

পানি খাব নবনী। পানি দাও।

আমি পানি এনে দিলাম। দুচুমুক খেয়েই রেখে দিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, একটা ফ্রিজ কেনা দরকার। জ্বর জ্বরি হলে ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছা করে। একটা ফ্রিজ কিনতে হবে। ফ্রিজ কেনার টাকা আছে। কালই একটা ফ্রিজ কিনে ফেলব। কি বল?

আচ্ছা।

আর একটা ক্যাসেট প্লেয়ার। তুমি একা একা থাক গান শোনার একটা কিছু থাকলে সময় কাটবে।

আচ্ছা কেনা হবে।

ড্রেসিং টেবিলটা এখনো দিয়ে যায় নি?

না।

কি রকম হারামজাদা চিন্তা করে দেখতো। ইচ্ছা করছে পিটায়ে লাশ বানায়ে ফেলি। জ্বর কমলে কাল সকালে একবার যাব।— এমন পিটন দিব। অবশ্যি অহনাকে আনার জন্যে কাল রাজশাহীও যেতে হতে পারে। আমি হলাম তার চড়নদার। বুঝতে পারছ?

পারছি।

সপ্তাহের ছুটি যখন হত তখন অহনাকে আমি সফিকের কাছে পৌঁছে দিতাম। যেতাম রিকশা করে। ওর আবার সেই সময় পেট্রোলের গন্ধ সহ্য হত না। প্রথম প্রথম রিকশা করে যাবার সময় খুব কাঁদতো। এই মেয়ে যে কি পরিমাণ কাঁদতে পারে তুমি বিশ্বাসও করবে না। আচ্ছা নবনী তুমি কি রকম কাঁদতে পারো?

আমি জবাব দিলাম না। জ্বরের ঘোরে ও ঝিমিয়ে পড়ল। আমি পাশেই জেগে বসে আছি। একটু দূরে হাতপা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে মদিনা। মেয়েটা খুবই শান্ত। দোষের মধ্যে একটাই হঠাৎ দেখা যায় কাজ কর্ম বন্ধ রেখে কাঁদতে বসে। আমি যখন জিজ্ঞেস করি— কাঁদছিস কেনরে? সে দুহাতে চোখ মুছে কান্না বন্ধ করে ফিক করে হেসে ফেলে বলে, এম্নেই কান্দি। অভ্যাস।

ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। আমি কাঁদি কি-না। না। আমি কাঁদি না। অতি বড় দুঃসময়েও না। কি হবে কেঁদে? প্রবল জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে সে পড়ে আছে। আমি চুপচাপ বসে আছি তার মাথার কাছে। মানুষ কি আশ্চর্য প্রাণী। আজ আমি যার মাথার পাশে বসে আছি তার বদলে অন্য একজনের মাথার পাশেও বসতে পারতাম। পারতাম না? বিয়ে নামের একটা ব্যাপার দুজন অচেনাকে একসঙ্গে করে দিয়েছে। আমিতো স্যারের মাথার পাশেও বসে থাকতে পারতাম।

স্যারের কথা এই মুহূর্তে ভাবটা কি ঠিক হচ্ছে। মুহূর্তে বানান কি যেন? হয়ের নীচে দীর্ঘ উকার। শুনুন স্যার, এই বানান আমি আর কোন দিন ভুল করিনি। করবও না শব্দটা মনে হলেই আপনাকে মনে পড়ে।

একজন মানুষ কি তার প্রতিটি মুহূর্ত আলাদা করতে পারে? আমি পারি। স্যারের সঙ্গে মুহূর্তগুলি আমি পারি। যদিও তাঁর সঙ্গে আমার তখন দেখাই হয় না। চাটাইয়ের যে ঢাকনি তিনি দিয়েছেন তা তিনি সরান নি। একদিন দেখি উত্তরের দরজাটাও তিনি তার দিকে থেকে বন্ধ করে দিয়েছেন। তখন তার ঘরে যেতে হলে বাইরে দিয়ে যেতে হবে।

আমি নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা এসে গেছে। দরজা বন্ধ করে রাত দিন পড়ার ভাণ করি। বই এ একেবারেই মন বসে না। চিঠি লেখার একটা খাতা করেছি। রোজ একটা করে চিঠি লিখি। মজার মজার সব চিঠি। কোনটাতে হাসির কথা থাকে। কোনটাতে রাগের কথা থাকে। কোন কোন চিঠি লিখে নিজেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। ঠিক করে রেখেছি। এক বছরে ৩৬৫টা চিঠি লিখব। চিঠি লেখা শেষ হলে একদিন খাতা নিয়ে স্যারের কাছে যাব। তাকে বলব— স্যার দেখুন তো এখানে কি কি বানান ভুল আছে।

অতিথিপুরে আমার ছোটখালার ননদের বিয়ে। খালা খবর পাঠিয়েছেন আমি যেন অবশ্যই যাই। মেয়েকে সাজিয়ে দিতে হবে। মা বললেন— নবনী যাবি?

আমি বললাম পাগল হয়েছ? আমার পরীক্ষা না? ইরাকে পাঠিয়ে দাও। ইরা যাক।

যা না মা এত করে লিখেছে। তোকে তোর খালা কত পছন্দ করে। না গেলে মনে কষ্ট পাবে।

আমার যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু যাব কি করে? যদি যাই তাহলে কি আর রোজ একটা করে চিঠি লিখতে পারব? তাছাড়া স্যারকে ফেলে রেখে আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। তার সঙ্গে আমার কথা হয় না। রোজ দেখাও হয় না। তবুওতো আমরা পাশাপাশি আছি। উত্তরের দরজার পাশে দাঁড়ালে তার হাঁটার শব্দ কানে আসে। এটাই বা কম কি?

ঠিক হল ইরা যাবে। বাবা তাকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। যেদিন যাবার কথা সেদিন দেখি বাবা যাচ্ছেন না। ঠিক হয়েছে। ইরাকে পৌঁছে দেবেন। আমাদের স্যার। আমার বুক ধ্বক করে উঠল। আমি মাকে গিয়ে বললাম— মা শোন, ইরা থাক। আমি যাব। আমি না গেলে ছোটখালা মনে কষ্ট পাবেন।

মা বললেন, ইরা সব কাপড় গুছিয়ে রেখেছে–এখন তুই যাবি কি?

আমি বললাম, আমার কাপড় গোছাতে এক মিনিট লাগবে।

না না তুই থাক, পড়াশোনা করছিস কর।

ইরা স্যারের সঙ্গে চলে গেল। আমার মনে হল আমি যদি একটা ধারালো ছুরি দিয়ে ইরাকে ফ্যালাফ্যালা করে ফেলতে পারতাম! আমার জীবনের সবচে কষ্টের মুহূর্ত কি যদি কেউ জানতে চায় আমি বলব—স্যারের সঙ্গে ইরার অতিথিপুরে যাবার সময়টা।

তখন ঝমোঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বাবা একটা রিকশা ডেকে এনেছেন। ইরা রিকশায় উঠে বসেছে। স্যার বললেন, আমি আরেকটা রিকশা নিয়ে আসি। বাবা ধমকের স্বরে বললেন, আরেকটা রিকশা লাগবে কেন? তুমি এইটাতেই উঠতো মাস্টার। তোমাদের বড় বাড়াবাড়ি।

তারা দুজন একটা রিকশায় করে চলে যাচ্ছে। আমি পাথরের মত মুখ করে তাকিয়ে আছি।

ইরা ফিরে এসে কত গল্প, আপা জান তোমার স্যার কিন্তু দারুণ রসিক লোক। এমিতে বোঝা যায় না। কিন্তু এমন সব রসিকতা করেন যে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে হয়। একদিন কি হয়েছে শোন, ছোটখালা স্যারকে খেতে দিয়েছেন। পাংগাশ মাছের বড় একটা পেটি দেয়া হল। তখন স্যার…

আমি বললাম, চুপ করতো ইরা। কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করিস না। পড়ার চেষ্টা করছি দেখছিস না?

একদিন খুব কষ্ট লাগল। বড় মামা একটা টাঙ্গাইলের শাড়ি পাঠিয়েছেন। সবুজের উপর কালো ডোরা। শাড়ি পরার পর মা বললেন, ও আল্লা তোকে তো পরীর মত সুন্দর লাগছে রে। ইরাকে নিয়ে যা তো স্টুডিও থেকে একটা ছবি তুলে আয়। বিয়ের কথাবার্তায় কাজে লাগবে।

আমি ছবি তুলতে গেলাম না। তবে আমাদের বাড়ির সামনের বাগানে হাঁটতে গেলাম। বাগান থেকে স্যারের ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। আমার মন বলছিল। ভেতর থেকে স্যার আমাকে দেখতে পাবেন এবং অবশ্যি বাইরে বের হয়ে আসবেন।

সে রকম কিছুই হল না। আমি দেখলাম গভীর মনযোগে তিনি কি যেন পড়ছেন। জানালার সামনে দিয়ে আমার বার বার যাওয়া আসা তার মনযোগ নষ্ট করতে পারল না। আমার ইচ্ছা করছে তাঁর ঘরে গিয়ে ঢুকি। তীব্র গলায় বলি– বেহেশতে আপনি যেসব পরী পাবেন তারা কি আমার চেয়েও সুন্দর? আপনি দিনের পর দিন আমাকে অগ্রাহ্য করবেন তা হবে না। না না না।

এই সময় স্যার অসুখে পড়লেন। বাসার কেউ বুঝতে পারল না। কিন্তু আমি বুঝলাম। বুঝেই বা কি করব? আমি তাঁকে ঘর থেকে বের হতে দেখি না। তিনি কলেজেও যান না। আমি কলেজের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম অসুস্থতার জন্যে তিনি ছুটির দরখাস্ত করেছেন। আমার ভয়ঙ্কর খারাপ লাগছে। একটা মানুষ অসুখ হয়ে পড়ে আছে। এ বাড়ি কেউ সেটা বুঝতে পারছে না কেন? এ বাড়ির সবাই কি অন্ধ? মার কি উচিত না খোঁজ-খবর করা? আমি নিজ থেকে কাউকে কিছু বলব না। মরে গেলেও না।

একদিন মা বললেন, কিরে তোর স্যারের কি অসুখ বিসুখ করল না-কি? একজন ডাক্তারকে মনে হয় ঢুকতে দেখলাম।

আমি বললাম, অসুখ বিসুখ করেছে কি-না জানি না। করতেও পারে। আল্লাহর পিয়ারা বান্দাদেরওতো অসুখ বিসুখ হয়।

খোঁজ নিয়ে আয়তো।

আমি খোঁজ নিতে পারব না, মা। আমার এত মাথা ব্যথা নেই। অন্তুকে পাঠাও।

অন্তু খোঁজ নিয়ে এল— চোখ বড় বড় করে হাসি মুখে বলল, মওলানা ফ্ল্যাট হয়ে গেছে বুঝলে মা–ছয়দিন ধরে বিছানায় শোয়া। কথা বলে চিঁচিঁ করে।

মা বললেন, তাতে হাসির কি হল। হাসছিস কেন?

উনি কেমন চিঁচিঁ করে কথা বললেন ঐ জন্যেই হাসছি। উনার কথা শুনলে মনে হবে মানুষ কথা বলছে না। চিকা কথা বলছে। কথা শুনলে তুমিও হাসবে।

মা তৎক্ষণাৎ তাঁকে দেখতে গেলেন। পৃথিবীর সমস্ত মাদের মত তিনিও খুব দুঃখিত হলেন। একটা লোক দিনের পর দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে তিনি বলতেও পারেন না। এই লজ্জাতেই মা অস্থির। মা বললেন, কেন তুমি আমাদের কোন খবর দেবে না? তুমি রান্না করে কিছু খেতে পার না, আমাদের বলবে আমরা ব্যবস্থা করব। না-কি ইসলাম ধর্মে এরকম নিয়ম নেই?

তিনি মিনমিন করে বললেন, আপনাদের কষ্ট দিতে চাই নি। ভেবেছি সেরে যাবে।

এখন থেকে তোমার সব খাওয়া দাওয়া এ বাড়ি থেকে যাবে। বুঝতে পারছি? কি খাও তুমি?

বার্লি আর সাগু। এই দুটা ছাড়া আর কিছু খেতে পারি না।

তোমার হয়েছে কি? ডাক্তার কি বলল?

ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। এখনো কিছু বলতে পারছেন না।

দুপুরে আমি খাবার নিয়ে গেলাম।

মামার পাঠানো সেই সবুজ শাড়িটা পারলাম। চোখে কাজল দিলাম। হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে এক বাটি বার্লি এক গ্লাস দুধ। স্যার আমাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন। পৃথিবীর আশ্চৰ্যতম ঘটনাটা তিনি যে ঘটতে দেখলেন। বিছানায় উঠে বসতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেলেন। আমি বললাম, স্যার আপনি উঠবেন না। চুপ করে শুয়ে থাকুন। আপনার খাবার নিয়ে এসেছি।

শুকরিয়া। অশেষ শুকরিয়া। রেখে দাও।

আপনি নিজে নিজে খেতে পারবেন? না-কি আমি চামচ দিয়ে খাইয়ে দেব?

না না পারব। আমি পারব।

স্যার আমার চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে কিন্তু অসুবিধা নেই। আপনি যদি অস্বস্তি বা লজ্জা বোধ না করেন আমি খাইয়ে দিতে পারি। যদি পাপ হয় আমার হবে। আপনার হবে না। আপনি ঠিকই বেহেশতে যাবেন।

তিনি দুঃখিত গলায় বললেন, তুমি আমার ধর্ম কর্মটাকে এমন কঠিন দৃষ্টিতে দেখ কেন? আমিতো কারো কোন ক্ষতি করছি না। আমি নিজের মতো থাকি। এই নিজের মতো থাকতে গিয়ে তোমাকে যদি কোন কারণে কষ্ট দিয়ে থাকি তুমি কিছু মনে রেখ না।

আমি অস্বস্তির সঙ্গে বললাম, আপনি কষ্ট দেবেন। কেন? আমি কথার কথা বললাম। স্যার আমি যাই।

একটু বোস নবনী। বসতে ইচ্ছা না হয়–দাঁড়িয়ে থাক। আমি কয়েকটা কথা বলব। এই কথাগুলো তোমার জানা খুব জরুরি। আমি মানুষ হয়েছি এতিমখানায়। এতিমখানার জীবনটাতো আদর ভালবাসার জীবন না। কষ্টের জীবন। আমাদের একজন হুজুর ছিলেন আমরা ডাকতাম মেজো হুজুর। তিনি আমাদের সবাইকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ধর্ম কর্মের প্রতি আমার এই অনুরাগ তার কাছ থেকে পাওয়া। আমি মনে করি না এটা ভুল। মাদ্রাসা থেকে উলা পাস করে আমি কলেজে ভর্তি হই। আমার ভাগ্য ভাল ছিল, ইন্ডিয়া সরকারের একটা স্কলারশীপ পেয়ে যাই। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. করার একটা সুযোগ ঘটে। এম. এ. পাস করি।

আমি বললাম, স্যার আমাকে এত কথা বলার দরকার নেই।

তিনি খানিকটা উত্তেজিত গলায় বললেন, দরকার আছে। দরকার আছে বলেই বলছি–তোমরা আজ যে পোশাকে আমাকে দেখছি সব সময় এই পোশাকেই আমি সারা জীবন পরেছি। মেজো হুজুর সেই নির্দেশ আমাকে দিয়েছেন।

কোন দিলেন?

কারণ আমাদের নবী এই লেবাস পরতেন।

নবী আরবে জন্মেছিলেন বলে এই লেবাস পরতেন। তিনি যদি তুন্দ্ৰা অঞ্চলে জন্মাতেন তাহলে নিশ্চয়ই এই লেবাস পরতেন না। তখন গায়ে পরতেন সীল মাছের চামড়ার পোশাক। এই অবস্থায় আপনি কি করতেন? আপনিও কি সীল মাছের চামড়ার পোশাক জোগাড় করতেন?

নবীজী যেহেতু তুন্দ্ৰা অঞ্চলে জন্মাননি কাজেই সেই প্রশ্ন আসে না। তাছাড়া নবীজীর পোশাক পরার অন্য একটা অর্থ হল— তাকে সম্মান দেখানো। সম্মান দেখানোয়তো দোষের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথকে সম্মান দেখাতে গিয়ে এক সময় অনেকে লম্বা দাড়ি রাখত বাবড়ি চুল রাখতো।

আমি চুপ করে গেলাম। স্যার সহজ ভঙ্গিতে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে যুক্তিতে পারবে না। নবনী। বোধহয় তোমার ধারণা ছিল এই জাতীয় পোশাক পরা টুপীওয়ালা লোক সব অল্প বুদ্ধির হয়। এই রকম মনে করার কোন কারণ নেই। আমার বুদ্ধি ভালই আছে। আমার পড়াশোনাও অনেক। তোমাকে এত কথা বললাম কারণ… কারণ…।

কারণটা কি বলুন?

আরেকদিন বলব। আজ একদিনে অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছি।

আপনি গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।

না নবনী আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তবে খুব গুছিয়ে চিন্তা করতে পারি।

একটা কাক যে আপনার কাছে আসতো সেটা কি আর আসে না?

আসে। বিকালের দিকে আসে। একা আসে না–তার কয়েকটা বন্ধুবান্ধব জুটেছে। সব কটাকে নিয়ে আসে। এরা কেউই আমাকে ভয় পায় না।

আপনাকে বোধহয় কাক মনে করে।

করতে পারে। পশুপাখির মনের কথা বোঝা বড়ই দুষ্কর। তবে কাক আমার খুব প্রিয় পাখি। এতিমখানায় যখন ছিলাম তখনও আমার কয়েকটা পোষা কাক ছিল।

কাক আপনার প্ৰিয় পাখি?

হুঁ।

কেন?

কাকই একমাত্র পাখি যে মানুষের কাছাকাছি থাকে, অন্য কোন পাখি কিন্তু মানুষের কাছে আসে না। তারা দূরে দূরে থাকে।

আপনার কি ধারণা আমাদের সবার কাক পোষা উচিত?

উনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হো হো করে হেসে উঠলেন। কোন মানুষকে এত আনন্দিত ভঙ্গিতে আমি হাসতে শুনি নি। আমার ইচ্ছা করতে লাগল। আমি আরো কিছু হাসির কথা বলে স্যারকে হাসিয়ে দি।

স্যার হাসি থামিয়ে বললেন, এক হাসিতে আমার অসুখ অনেকখানি কমে গেছে। এখন ঘরে যাও নবনী।

না। আমি ঘরে যাব না।

তোমার পড়াশোনা আছে। পড়াশোনা কর। রুগীর পাশে এতক্ষণ থাকা ঠিক না।

আমার ঠিক অঠিক আমি বুঝব আপনাকে এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

তিনি একটু যেন ভয়ে ভয়ে বললেন, তুমি আমার কাছে কি চাও বলতো নবনী।

আমি কিছু চাই না। স্যার অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে ক্লান্ত গলায় বললেন, আমার কাছে দুটি চিঠি কি তুমি লিখেছিলে?

জানি না। লিখতেও পারি।

শোন নবনী, তুমি একটা অসম্ভব ভাল মেয়ে। আমি চাই না আমার কারণে তোমার কোন ক্ষতি হোক।

আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, ক্ষতির কথা আসছে কেন? কি আবোল তাবোল কথা বলছেন? স্যার আরেকটা কথা আমি কোন চিঠি ফিঠি কাউকে লিখিনি— আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই মৌলবীকে চিঠি লিখব। অসুখে আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আপনার এখানে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।

স্যার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, আমি আর আপনার কাছে খাবার নিয়ে আসব না।

সেদিন রাতে খুব বৃষ্টি। আমি আবার তাঁর খাবার নিয়ে গেলাম। স্যারের ঘরে পা দেয়া মাত্র ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। স্যার ব্যস্ত গলায় বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও মোমবাতি আছে। মোমবাতি জ্বালাচ্ছি।

আমি অদ্ভুত গলায় বললাম–না মোমবাতি জ্বালাতে হবে না। অন্ধকারই ভাল।

স্যার চমকে উঠে বললেন, নবনী ঘরে যাও। প্লীজ ঘরে যাও। আমি বললাম, না।

কি প্ৰচণ্ড ঝড় হল সে রাতে। আমাদের শিরীষ গাছের একটা ডাল প্ৰচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ে গেল। হোক যা ইচ্ছা হোক। আজ আমার আর কিছুই যায় আসে না। প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। হোক বর্ষণ। সারা পৃথিবী তলিয়ে যাক।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ