প্রায় ন মাস পর বাড়িতে গিয়েছি।

নিখুঁত হিসাব হল আট মাস সতেরো দিন। নোমান আমার সঙ্গে আসতে পারে নি। তার ছবির কাজ পুরোদমে চলছে। তাদের না-কি দু মাসের মধ্যে ছবি শেষ করতে হবে। চল্লিশ মিনিটের ছবি। তারা চেকোস্লোভাকিয়ায় শর্ট ফ্রিম ফেষ্টিভ্যালে ছবি পাঠাবে। সময় পেলে ইংরেজিতে ডাব করবে। সময় না পেলে সাব টাইটেল করা হবে।

নোমানের উৎসাহ এবং ব্যস্ততা দেখার মত। মনে হচ্ছে সে-ই ছবির পরিচালক, সে-ই নায়ক এবং সে-ই ক্যামেরাম্যান। যদিও আমার ধারণা তার মূল কাজ ছোটাছুটি করা এবং অন্যদের ধমক খাওয়া। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের দেখলেই মনে হয় এদের ধমক দিলে এরা রাগ করবে না। এদের ধমক দেয়া যায়। শুধু ধমক না, অতি তুচ্ছ কাজও এদের দিয়ে করিয়ে নেয়া যায়। নোমান সেই জাতীয় একজন মানুষ।

আমাদের সঙ্গে মদিনাও দেশের বাড়িতে যাচ্ছে। তার গায়ে নতুন জামা। পায়ে নতুন রবারের জুতা। তার আনন্দ চোখে দেখার মত। মনে হচ্ছে এই মেয়েটির জীবনে এমন আনন্দময় মুহুর্ত আর আসে নি।

আমাদের নিয়ে যাচ্ছে অন্তু। নোমান স্টেশনে তুলে দিতে এসেছে। ট্রেন আজ এক ঘণ্টা লেট আমরা অনেক আগে ভাগে এসে পড়েছি। নোমানের মুখ শুকনো। বুঝতে পারছি তার মন খারাপ লাগছে। সে এই মন খারাপ ভাবটা লুকাতে পারছে না। সে অন্তুকে বলল, তোমাদের টিকিট দুটা দাওতো অন্তু।

অন্তু বলল, টিকিট দিয়ে কি করবেন?

আহা দাও না।

অন্তু টিকিট দিল। সে টিকিট নিয়ে হন হন করে চলে গেল। অন্তু বলল, আপা দুলাভাই টিকিট দিয়ে কি করবে?

আমি বললাম, জানি না।

দুলাভাই সঙ্গে গেলে খুব ভাল হত। সবাই আশা করে আছে, তোমরা দুজন একসঙ্গে যাবে।

ছবি নিয়ে ব্যস্ত। ছবি না থাকলে যেত।

কি ছবি?

ওর বন্ধু একটা শর্ট ফ্রিম বানাচ্ছে।

তাতো জানি। গল্পটা কি?

নির্দিষ্ট কোন গল্প নেই। গ্রামের একটা মেয়ে পুকুরে গোসল করতে করতে একসময় ঠিক করল সে তার স্বামীকে খুন করবে। ঠিক করার পর থেকে খুন করার আগ পর্যন্ত মেয়েটার মনের অবস্থা।

স্বামীকে খুন করবে কেন?

সেটা কখনো বলা হয় না। ছবির জন্যে এটা না-কি অপ্রয়োজনীয়।

অভিনয় কারা করছে?

একজনই অভিনেত্রী। সফিক সাহেবের স্ত্রী অভিনয় করছেন। তার নাম অহনা।

ছবিটা কি ভাল হচ্ছে?

নোমানের ধারণা অসাধারণ হচ্ছে। এই ছবি দেখলে না-কি মৃণাল সেনের ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে যাবে। সত্যজিৎ রায়ের মাইন্ড স্ট্রোক হবে।

নোমান আসছে। তার হাতে একগাদা ম্যাগাজিন। দু প্যাকেট বিসকিট। পানির বোতল। অন্তু বলল, টিকিটগুলো কি করলেন দুলাভাই?

চেঞ্জ করে নিয়ে এসেছি। ফার্স্টক্লাস করে আনলাম। আরাম করে যাও। তোমরা চা খাবে না-কি?

অন্তু বলল, না।

ট্রেন ছাড়তেতো এখনো দেরী আছে চল না।যাই। এখানে ভাল রেস্টুরেন্ট আছে।

অন্তুর যাবার তেমন ইচ্ছা নেই। আমি বললাম, অন্তু তুই জিনিসপত্র নিয়ে এখানে বসে থাক। আমি চা খেয়ে আসি, আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে।

আমরা চা খেলাম। ও একটা সিগারেট ধরিয়ে শুকনো মুখে টানতে লাগল। আমি বললাম, তুমি কি ছবি বানানোর এক ফাঁকে চলে আসতে পারবে?

মনে হয় না। আমি চলে এলে কাজ কর্মের খুব ক্ষতি হবে।

ক্ষতি হলে থাক।

এদিকে অহনাকে আবার সামলে সুমলে রাখতে হয়। ওর মেজাজেরতো কোন ঠিক নেই।

তুমি ছাড়া আর কেউ ওকে সামলাতে পারে না?

তা না। ও আমার কথা শুনে। অনেকদিন থেকে দেখছি তো।

ও আচ্ছা।

তারপর ধর হঠাৎ তার মাথায় এসে গেল কোন একজন পামিস্টের কাছে যাবে তখন তাকে সেখানে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। কে নিয়ে যাবে?

সেটা বিরাট সমস্যাতো বটেই। তাহলে তুমি একটা কাজ কর তাঁকে বল নেত্রকোনায় বড় একজন পামিস্ট আছে তাহলে দেখবে সব ছেড়ে ছুড়ে তোমাকে নিয়ে নেত্রকোনায় চলে আসবে।

সে কিছু বলল না। চুপ করে রইল। আমি বললাম, ট্রেন ছাড়তে কত দেরি?

এখনো কুড়ি মিনিট। আরেক কাপ চা খাবে?

আমি বললাম, খাব। আর দেখতো আমার জ্বর কি-না কেমন জানি জ্বর জ্বর লাগছে। সে আমার আমার কপালে হাত রেখে বলল, জ্বর নাতো!

আমি হেসে ফেললাম। সেও হাসল। জ্বর দেখার আমাদের এই পুরানো এবং একান্ত গোপন কৌশল ব্যবহার করতে এত ভাল লাগে। রেস্টুরেন্ট ভর্তি মানুষ–এরা কেউ কিছু ভাববে না। সবাই জানবে একজন অসুস্থ মানুষের জ্বর পরীক্ষা করা হচ্ছে।

 

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ও প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে। ওর দিকে তাকাতে আমার খুব কষ্ট লাগছে। আমি ব্যস্ত হয়ে ম্যাগাজিনের ছবি দেখছি। শুধু অন্তু গলা বের করে খুব হাত দুলাচ্ছে। হঠাৎ অন্তু বিস্মিত গলায় বলল, আপা দেখ দেখ দুলাভাই কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ও সত্যি সত্যি পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মুছছে। আমাকে দেখে সে চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। আমি অন্তুকে বললাম, তোর দুলাভাইকে এইভাবে হাঁটতে নিষেধ কর— পরে হুমড়ি খেয়ে ট্রেনের চাকার নিচে পড়বে।

বলতে বলতে আমার গলা ধরে গেল। চোখ ভিজে উঠল। ট্রেনের গতি বাড়ছে আমার মনে হচ্ছে। আমি এই পৃথিবীর সব প্রিয়জন ছেড়ে—অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। ট্রেনের চাকায় ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। ট্রেনটা যেন তালে তালে বলছে–ভালবাসি। ভালবাসি।

আমাকে দেখে বাড়িতে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে বাবা ভুরু কুঁচকে বললেন, মরা কান্না জুড়ে দিলে কেন? বড়ই যন্ত্রণা হল তো। ইরা তোর মাকে নিয়ে যাতো। মা আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

কেউ আমাকে ছাড়ছে না। সবারই মনে অসংখ্য কথা জমা হয়ে আছে। সবাই আমাকে একসঙ্গে সব কথা শুনাতে চায়।

ইরা চাচ্ছে আমাকে নিয়ে ছাদে চলে যেতে। তার নাকি অসম্ভব জরুরি কিছু কথা এক্ষুণি না বললেই না। তার জরুরি কথার আভাস পেয়েছি। মা কাঁদতে কাদতেই এক ফাঁকে আমাকে বলে ফেলেছেন। ইরার ভাঙা বিয়ে আবার জোড়া লেগেছে। ইরার ভাবি বর না-কি বলেছে, এই মেয়ে ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করবে না। প্রয়োজন হলে সবার অমতে সে কোর্টে বিয়ে করবে।

এদিকে বাবারও অনেক কথা বলার আছে–তিনি আবার ইলেকশন করবেন বলে স্থির করেছেন। তবে এবার স্বতন্ত্র না। আওয়ামী লীগের টিকিটে। নমিনেশন পাওয়া যাবে এই বিষয়ে তিনি নিশ্চিত।

বুঝলী নবনী ময়মনসিংহের যে কুদ্দুস সাহেব আছেন এডভোকেট। উনি হলেন বঙ্গবন্ধুর ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। শেখ হাসিনা তাকে দেখলে ছুটে এসে কদমবুচি করেন। কুদ্দুস সাহেবই বললেন, নমিনেশনের ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। এটা কোন ব্যাপারই না।

আমি বললাম, আওয়ামী লীগের টিকিট পেলেতো মনে হয়। জিতে যাবে।

জেতাটা বড় কথা না। ইলেকশনে জেতা আমার উদ্দেশ্য না। আমার উদ্দেশ্য এই দেশের জন্যে কিছু করা। বড়ই অভাগা দেশ।

তুমি এবার তাহলে খুব জোড়ে সোড়ে ইলেকশন করছ?

মানুষের চাপে পড়ে করতে হচ্ছে। সবাইতে চায় সৎ লোক পাস করে আসুক। চাওয়াটাতো অন্যায় না।

তাতো বটেই।

এদিকে তোর বড় মামা চিঠি লিখেছে। আমি যেন ইলেকশন নিয়ে মাথা না ঘামাই। কঠিন ভাষায় লেখা চিঠি। আশ্চর্য কথা আমি কি করব না করব এটা বাইরের একজন এসে বলে দেবে কেন?

বড় মামাতো বাইরের কেউ না বাবা।

অবশ্যই বাইরের। আর বাইরের না হলেও আমার স্বাধীন চিন্তায় তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। ফার্মেসি থেকে এক পয়সা আয় হয় না–বিক্রি করে দিতে চাচ্ছি। বিক্রি করতে দেবে না। এই সম্পত্তিগুলো আমার না তাঁর তাইতো বুঝলাম না।

সবচে ভাল লাগছে ইরাকে দেখতে। সে খুব সুন্দর হয়েছে। মনে হচ্ছে এই আটমাসে সে খানিকটা লম্বাও হয়েছে। ইরা ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। গা ধুতে বাথরুমে গিয়েছি সে তোয়ালে হাত বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছে। এত কথাও থাকে একটা মানুষের পেটে? তার সব কথাই তার বিয়ে নিয়ে। সব নদী যেমন সমুদ্রে পড়ে তার সব কথাই তেমনি বিয়েতে গিয়ে শেষ হয়।

বুঝলে আপা একদিন সন্ধ্যাবেলা ছাদে হাঁটছি— নতুন কাজের মেয়েটা এসে বলল, একটা লোক আসছে। আপনারে ডাকে। আমিতো অবাক! এই সন্ধ্যাবেলা আমাকে কে ডাকবে। নিচে নেমে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ও বসে আছে।

ও টা কে?

ওটা কে তুমিতো বুঝতেই পারছি। আমি স্তম্ভিত। বিয়েতো ভেঙেই গেছে। এখন আমার সঙ্গে কি কথা? রাগও লাগছে। এদিকে দেখি বাবু আবার খুব সেজে গুজে এসেছেন। গায়ে সেন্ট দিয়েছেন। সেন্টের গন্ধে চারদিক ভুড় ভুড় করছে। আমি ভাণ করলাম যেন চিনতে পারছি না। বললাম, আপনি কাকে চাচ্ছেন? হি হি হি…

 

স্যার যে ঘরে থাকতেন। সেখানে দেখি একজন কে। অল্প বয়সী একটা ছেলে। ব্যাংকে চাকরি করে। একদিন তাঁকে দেখতে গেলাম। আপা বসুন, আপা বসুন বলে সে খুব খাতির যত্ন করল। আমি বললাম, আপনার কাছে কি একটা বুড়ো কাক আসে?

সে বিস্মিত হয়ে বলল, কাক আসবে কেন? আমি বললাম, এম্নি বলেছি। ঠাট্টা করছি।

 

রাতে ঘুমের সময় খুব অসুবিধা হতে লাগল। মা আমার সঙ্গে ঘুমাতে চান। ইরা কিছুতেই দেবে না। সে আমার সঙ্গে শুবো। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করবে। আমাকে চোখের পাতা এক করতে দিবে না।

মা একদিন সুযোগ পেলেন। গভীর রাতে আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন, কোন খবর আছে রে মা?

কি খবর জানতে চাও মা?

নতুন কোন খবর। খোকা খুকুর খবর।

চুপ করতো মা।

বল না রে মা। আছে কোন খবর?

তুমিতো বড্ড বিরক্ত করছ মা। সেদিন মাত্র বিয়ে হল এখনই কিসের খবর।

আমি যে স্বপ্নে দেখলাম।

রাখতো তোমার স্বপ্ন। ঘুমাও।

মা ক্লান্ত গলায় বললেন, তোর একটা খোকা খুকু হলে বেশ হয়। বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত বিয়েকে বিয়ে বলে মনে হয় না।

মা চুপ করবে?

নবনী তোর অসুখটা তো আর হয় না?

না।

আর হবে না। আচ্ছা শোন জামাই কি তোর স্যারের ব্যাপারে কোনদিন কিছু জানতে চেয়েছে?

না।

এতদিন যখন চায় নি আর চাইবে না।

মা ঘুমাও।

মা ঘুমালেন না। অনেক রাত পর্যন্ত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

 

সাতদিনের জন্যে বাড়ি গিয়েছিলাম। সাতদিনের জায়গা দশদিন কাটিয়ে ফিরছি। রওনা হবার সময় মার কাছে একটা চিঠি লিখে গেছি। শর্ত হচ্ছে এই চিঠি মা ট্রেন ছাড়ার আগে পড়তে পারবে না।

চিঠিতে লিখেছি–-

মা, তুমি খবর জানতে চেয়েছিলো। হ্যাঁ খবর আছে। তুমি ঠিকই স্বপ্নে দেখেছ। মুখে বলতে লজ্জা লাগল। তোমার পায়ে পড়ি মা— আর কাউকে জানিও না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ