আমি ঢাকায় ওর বাসায় উঠে এলাম।

সেগুন বাগিচায় অফিসের সাথেই বাসা। একতলা দোতলা জুড়ে অফিস। দোতলার পেছন দিকে ওর বাসা। একটা মোটে ঘর। বারান্দার খানিকটা অংশ আলাদা করে রান্নাঘর। গ্যাসের ব্যবস্থা নেই। কেরোসিনের চুলায় রান্না। বারান্দায় অন্য মাথায় বাথরুম। বাথরুম এবং রান্নাঘরের মাঝের ফাঁকা জায়গাটার আট-দশটা ফুলের টব। সপ্তম আশ্চর্যের মত সেখানে একটা পাখির খাঁচায় ময়না পাখি।

ও খুব আগ্রহ করে বলল, বুঝলে নবনী! এই ময়না মানুষের চেয়ে সুন্দর করে কথা বলে। দুদিন যাক, দেখবে তোমার গলা হুবহু নকল করবে। ও নকলে খুব ওস্তাদ।

ময়না বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাকে দেখছে। কোন কথা বলছে না। আমি বললাম, কই, কথা বলছে না তো?

হঠাৎ তোমাকে দেখেছে— এই জন্যে। কয়েকদিন যাক, তারপর দেখবে ওর কথার যন্ত্রণায় থাকতে পারবে না। আমার বাড়ি-ঘর তোমার পছন্দ হয় নি, তাই না নবনী?

হয়েছে।

পছন্দ যে হয় নি সেটা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। একা মানুষ তো, বিরাট বাড়ি নিয়ে কি করব? তাছাড়া বাড়িটা কিন্তু ভাল। খুব হাওয়া। ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি আছে। ছাদে যাওয়া যায়। ছাদে যাবে? আচ্ছা, পরে তোমাকে নিয়ে যাব। টায়ার্ড হয়ে এসেছ, এখন রেষ্ট নাও। আমি চা নিয়ে আসি।

ও ঘর থেকে ফ্লাস্ক নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে নেমে গেল। এই বাসার সব কিছুই ছোট ছোট। সে যে ফ্লাস্কটা নিয়ে বের হয়েছে সেটিও ছোট। এক কাপ চা ধরবে কি-না কে জানে। আমি ঘুরে-ফিরে তার সংসার দেখতে লাগলাম।

শোবার ঘরে একটা খাট। সেই খাটে একটাই বালিশ। আমার জন্যে দ্বিতীয় বালিশ কেনে নি। হয়ত আজি সন্ধ্যাবেলা বালিশ কিনতে যাবে। কিংবা কে জানে হয়তো একটা বালিশেই দুজনকে ভাগাভাগি করে ঘুমুতে হবে। একটা লেখার টেবিল খাটের সঙ্গে লাগানো। টেবিলের সঙ্গে চেয়ার নিই। কাজই ধরে নেয়া যায় লেখালেখির কাজ খাটে বসে। সারা হয়। টেবিলের পাশে মিটাসেফের মত আছে। সেখানে নতুন একটা টি-সেট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই টি-সেট এখনো ব্যবহার করা হয় নি। কাপড় রাখার আলনা আছে। আলনায় কাপড় নেই। কয়েকটা তোয়ালে এবং গামছা–ভাজ করে রাখা। কে জানে হয়ত তোয়ালে রাখার জন্যেই এই আলনা।

দেয়ালে কিছু বাঁধানো ছবি আছে। একটি তার বাবার ছবি। চেহারার মিল থেকে বলে দেয়া যায়। তার পাশের ছবিটি বোধহয় তার মার। এই মহিলা খুব রূপবতী ছিলেন।

ফ্রেম বাধানো নজরুল ইসলামের একটা হাতে আঁকা ছবি আছে। ছবির নিচে লেখা Art by Noman Class VIII, Section B. সাহেব তাহলে ছেলেবেলায় শিল্পী ছিলেন।

খাটের নিচে রাজ্যের জিনিস। তার মধ্যে মাটির পালকি এবং পুতুল আছে। এইগুলি কি জন্যে রাখা কে জানে। জিজ্ঞেস করতে হবে।

আমি হাত-মুখ ধোবার জন্যে বাথরুমে ঢুকলাম। বাথরুমটা ঝকঝকে। আমাদের নেত্রকোনার বাড়ির বাথরুমের মত অন্ধকার এবং স্যাঁতসেঁতে নয়। সবচে বড় কথা-বাথরুমের উপরের দিকে ভেন্টিলেটারের মত আছে, যে ভেন্টিলেটার দিকে আকাশ দেখা যায়। গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে আকাশ দেখার মত আনন্দের আর কি আছে?

মুখে পানি ঢালতেই শরীর জুড়িয়ে গেল। হঠাৎ করে মনে হল আমাদের দুজনের জন্য এরকম একটা ঘরেরই দরকার ছিল।

ও শুধু চা আনেনি, একটা ঠোঙায় কিছু জিলাপী। আরেক ঠোঙায় কিছু নোনতা বিসকিট। সে মিটসেফ থেকে কাপ বের করছে। আমি দেখলাম, দুটা না, সে একটা কাপ বের করেছে। ঐ কাপটি সে এগিয়ে দিল আমার দিকে। নিজে চা ঢালিল ফ্লাস্কের মুখে। যেন আমি খুব সম্মানিত একজন মেহমান। বাইরের কেউ।

নবনী! টি-সেটটা নতুন কিনেছি। সুন্দর না?

হ্যাঁ, খুব সুন্দর।

সেট হিসেবে কিনলে দাম বেশি লাগে। আমি আলাদা আলাদা কিনে সেট বানিয়েছি অনেক সস্তা পড়েছে।

আচ্ছা।

বিকালে তোমাকে নিয়ে বের হতে হবে। টুকটাক অনেক জিনিস কিনতে হবে। তোমার কি কোলবালিশ লাগে?

না।

তোমার জন্য একটা ড্রেসিং টেবিল কিনেছি। এগার তারিখ ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিল, নিতে গেলাম, বলে–পালিশ হয় নাই। এখন বোধহয় পালিশ হয়ে গেছে, নিয়ে আসব। আরেকটু চা দেই, ফ্লাস্কে চা আছে। তিন কাপ চা আটে।

আমি ওকে খুশি করার জন্যেই আরেকটু চা নিলাম। শরবতের মত মিষ্টি চা। মুখে দিলেই পেটের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত মিষ্টি হয়ে যায়।

নবনী শোন, আমি অফিসে যাই। কিছু জরুরি কাজ ছিল। তুমি একা থাকতে পারবে তো?

পারব।

গোসল সেরে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়। তুমি টায়ার্ড হয়ে আছ তোমার ঘুম দরকার।

ও আচ্ছা।

এক-একা ভয় পাবে না তো?

ভয় পাবার কিছু আছে কি?

ভয় পাবার কিছুই নেই। খুব সেইফ জায়গা। অফিসের তিনজন দারোয়ান আছে। এরা সব সময় পাহারা দেয়। আর আমি তো আছিই। আমি মাঝে মাঝে খোঁজ নিয়ে যাব।

খোঁজ নিতে হবে না। আমি ভালই থাকব।

ছোট বাসা দেখে তোমার মন খারাপ হয়নি তো নবনী?

না।

দিন এরকম থাকবে না। নিজেই এক সময় ব্যবসা শুরু করব। এ্যাড ব্যবসার ব্যাপার-স্যাপার। আমি এখন সবই জানি। সাহস করে শুরু করলেই হয়। আরেকটু চা দেই? ফ্রাস্কে আছে খানিকটা।

ও চা ঢেলে দিল। তার মুখ হাসি-হাসি। বারান্দায় ময়নাটার কাছে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে বলল–কথা বল, এই ময়না, কথা বল। বল দেখি– নবনী! নবনী!

ময়না খাঁচার ভেতর ছটফট করছে। কথা বলছে না। আমি খাটে বসে। দেখছি, ও পকেট থেকে কলা বের করে খোসা ছাড়িয়ে সে ময়নাকে দিচ্ছে। গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে প্রায় অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলছে–কথা বল না রে বাবা। বলী–নবনী! নবনী! কি হয় কথা বললে?

আমাকে শুনানোর জন্যেই বেচারার এই চেষ্টা। এই পৃথিবীতে তার যা কিছু দেখানোর আছে সবই সে আমাকে দেখাতে চায়। আমাকে অভিভূত করাই তার व्लझा। ऊाद्ध अgशा७न छिल्ल না।

আমি বললাম, নজরুলের এই ছবি কি তোমার আঁকা? সে লজ্জিত গলায় বলল, হুঁ। ফেলে দেয়া উচিত। ফেলতে পারি না। মায়া লাগে।

ফেলার দরকার কি সুন্দর ছবিতো। এখনো কি ছবি আঁক?  না না। কিযে তুমি বল। স্কুলে পড়ার সময় খুব আঁকতাম। নবনী আমি যাই। তাড়াতাড়ি চলে আসব।

সম্পূর্ণ নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। অচেনা ঘরের অচেনা খাটে আমি শুয়ে আছি। ঘরের আলো কমে এসেছে। আবারও মেঘ করেছে। মনে হয়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। নামুক বৃষ্টি, সব ভাসিয়ে নিয়ে যাক। বৃষ্টি নামলে ময়নাটা ভিজবে। আমি কি ওকে নিয়ে আসব ভেতরে? না-কি ওর পানিতে ভিজে অভ্যাস আছে?

নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন না, একটা পাখির কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। গাঢ় ঘুম। ঘুমের মধ্যেই শুনলাম বৃষ্টি পড়ছে। ঘুমের মধ্যেই পাখিটার ছটফটানি কানে গেল এবং একসময় পাখিটা নবনী নবনী বলে আমাকে ডাকতেও লাগল। এটা হয়ত আমার ভুল। হয়ত আমার স্বপ্নের ক্ষুদ্র অংশ। কিছু কিছু সময়ে মানুষের স্বপ্ন ও সত্য মিলে-মিশে এক হয়ে যায়। পাখিটা আমাকে ক্ৰমাগত ডাকছে— নবনী, নবনী। কি মিষ্টি, কি সুরেলা তার গলা! বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে চারদিক।

আমার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। বৃষ্টি নেই— চারদিক খটখট করছে। পুরোটাই তাহলে স্বপ্ন ছিল? আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। নোমানকে দেখা যাচ্ছেহাতে পলিথিনের দুটা ব্যাগ। ব্যস্ত ভঙ্গিতে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। সে কি অফিস থেকে আবার বাজারে গিয়েছিল?

বারান্দার দরজা খুলে আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি। ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। ও আসুক। ও এলেই বাতি জ্বালাব।

নবনী, খুব দেরি করে ফেললাম। অফিস থেকে বের হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। নতুন একটা পার্টি এসেছে। কাজ নেই, শুধু বকর বকর করে। অফিস থেকে বের হয়েই একবার উঁকি দিয়েছি। দরজা বন্ধ কয়েকবার ঠিক ঠক করলাম। দরজা খুলল না। বুঝলাম তুমি ঘুমোচ্ছ চলে গেলাম ড্রেসিং টেবিলটার খোঁজে। ওদের সঙ্গেও নানান ঝগড়া।

ঝগড়া কেন?

আর বল কেন? এখনো পালিশ হয় নি। কারিগর না-কি ছুটিতে গেছে। পুরো টাকা অ্যাডভান্স দেয়া, নয়ত অন্যখান থেকে কিনতাম। তোমার ঘুম হয়েছে?

হ্যাঁ।

চল আমরা বের হই। মেলা কাজ। টুকটাক জিনিস কিনব। রাতে আবার দাওয়াত।

দাওয়াত খেতে ইচ্ছা করছে না।

ইচ্ছা না করলেও যেতে হবে। উপায় নেই। আমার বস দাওয়াত দিয়েছে। সফিক। তোমাকেতো আগেই বলেছি আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। তারই এ্যাড ব্যবসা। সফিকের আমার বিয়েতে যাবার কথা ছিল। যেতে পারল না–ব্যাংকক যেতে হল। ও আজ সকালের ফ্লাইটে এসেছে।

তোমার খুব ভাল বন্ধু?

অবশ্যই ভাল বন্ধু। তুই তোকারি সম্পর্ক। আমি যে এত ছোট একটা কাজ করি এটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। শুধু যে আমার সাথেই এই ব্যবহার তা না, সবার সাথে। অফিসের দারোয়ানের মেয়ের বিয়ে। অফিসের কেউ যায় নি–সফিক গিয়েছিল। তোমাকে নিয়ে এসেছি শুনে তৎক্ষণাৎ সে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চলে আসছিল। তুমি ঘুমোচ্ছ ভেবে আনি নি।

এলে সমস্যাও হত। তাকে বসাতে কোথায়? শোবার ঘর ছাড়া এখানে আর ঘর কোথায়?

শোবার ঘরেই বসতাম। সমস্যা নেই। ও পা মেলে মেঝেতে বসে কতদিন চা খেয়েছে। মানুষ হিসেবেও অসাধারণ। দেখলেই বুঝবে। ফ্লাস্কটা দাও তো নবনী। চা নিয়ে আসি। চা খেয়েই বের হয়ে পড়ি।

ঘরে চা বানানোর ব্যবস্থা নেই?

না। আজ সব কিনব। আমি চা খাই না তো, এই জন্যে ব্যবস্থা রাখি নি। তুমি তো আবার খুব চা খাও।

কে বলল?

বাসররাতে তোমার ছোটখালা চা নিয়ে এলেন, তুমি খুব আরাম করে খেলে— সবটা চা শেষ করলে। সেখান থেকেই বুঝলাম।

ও হাসছে। সুন্দর করে হাসছে। আমার গোপন রহস্য ধরে ফেলেছে, সেই রহস্যভেদের হাসি। আনন্দ ও তৃপ্তির হাসি।

ফ্লাস্ক নিয়ে যাবার পথে ও আবার ময়নাটার সামনে দাঁড়াল। আবার সেই অনুনয়-বিনয়–বল ময়না, বল, বল— নবনী। বল তো দেখি। সুন্দর করে বল— নবনী। ন-ব-নী। কলা খেতে দেব। কলা।

ময়না কথা বলার সেই আশ্চর্য বিদ্যা গোপন করেই রাখল। একবার ডেকে ফেললে কি হয়? বেচারা এত চেষ্টা করছে। কে জানে আমার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই সে হয়ত নবনী ডাক শেখানোর চেষ্টা করছে।

ও ফ্লাস্ক নিয়ে চলে যাবার পরপরই ময়না ডেকে উঠল। অবিকল ওর মত গলায় ডাকল— নবনী! নবনী! আমার সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। শরীর ঝিম ঝিম করতে লাগল। কি অদ্ভুত ব্যাপার!

নোমান গেটের কাছ থেকে আবার ফিরে আসছে। হনাহন করে আসছে। পাখির কথা শুনতে পেয়ে আসছে বলে মনে হয় না। পাখির গলা এতদূর যাবে না। অন্য কিছু হবে। হয়ত মানিব্যাগ ফেলে গেছে।

নবনী!

কি?

তোমার জ্বর-টর আসে নি তো? অফিস থেকে ফিরে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল জ্বর এসেছে।

না, জ্বর আসে নি। তুমি কি জ্বরের খোেজ নেবার জন্যে ফিরে এসেছ?

হ্যাঁ। দেখি কাছে আস তো। জ্বর আছে কি-না দেখি।

আমি ওর কাছে এগিয়ে এলাম। ও আমার কপালে হাত রাখল। বেচারা আমার শরীর ছুঁয়ে দেখার জন্যে ছুটে এসেছে। জ্বরের মত একটা বাজে অজুহাত তৈরি করেছে। আমার বলতে ইচ্ছা করছে— শোন, তোমার যখনই আমাকে ছয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে, ছয়ে দেখবে। লজ্জা, দ্বিধা বা সঙ্কোচের কোন কারণ নেই। আমি তা বলতে পারলাম না। কিছু কথা আছে যা অতি প্ৰিয়জনদেরও বলা যায় না। তবে ওর এই ছেলেমানুষী কৌশল আমি আমার পরবর্তী জীবনে অনেক অনেকবার কাজে লাগিয়েছি।

যখন আমার নিজের ইচ্ছে করেছে ও আমাকে ছুঁয়ে দেখুক, তখনি বলেছিএই, দেখ তো আমার জ্বর কি-না। শরীরটা ভাল লাগছে না। ও আমার কপালে হাত রেখে বলেছে— গা পানির মত ঠাণ্ডা, জ্বর নেই তো।

আমি হোসে ফেলেছি। ও আমার হাসি দেখে হকচকিয়ে গেছে। তবে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। বড়দের ছেলেমানুষী এক খেলা।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ