রাধানাথ বাবুর বয়স পঁয়ষট্টি। তার মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুলের দিকে তাকালেই শুধু বয়স বোঝা যায়। চুলে কলপ করা হলে বয়স ত্রিশের কোঠায় নেমে আসত। সবল সুঠাম বেঁটেখাটো মানুষ। চোখ বড় বড় বলে মনে হয় তিনি সারাক্ষণ বিস্মিত হয়ে আছেন। তাঁর গাত্রবর্ণ অস্বাভাবিক গৌর। তার মাসি বলতেন, আমার রাধুর গা থেকে আলো বের হয়। রাতেরবেলা এই আলোতে তুলসি দাসের রামায়ণ পড়া যায়।

চিরকুমার এই মানুষটি নীলক্ষেতের একটা দোতলা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকেন। একতলায় তাঁর প্রেস। প্রেসের নাম ‘আদর্শলিপি’ প্রেসের সঙ্গে জিংক ব্লকের একটা ছোট্ট কারখানাও আছে। প্রেসের লোকজন তাকে ডাকেন সাধুবাবা। সাধুবাবা ডাকার যৌক্তিক কারণ আছে। তাঁর আচার-আচরণ, জীবনযাপন সাধুসন্তদের মতো।

বাড়ির চিলেকোঠায় তাঁর প্রার্থনার ব্যবস্থা। পশমের আসনে বসে চোখ বন্ধ করে তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রার্থনায় বসেন। তাঁর সামনে থাকে ভুষাকালির একটা বাঁধানো পায়ের ছাপ। এই পায়ের ছাপে বুড়ো আঙুল নেই। এই ছাপটা কার পায়ের তা তিনি কাউকে এখনো বলেন নি। প্রার্থনার সময় পায়ের ছাপের সামনে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলে। ধূপ পোড়ানো হয়। কোনো কোনো দিন প্রার্থনা দ্রুত শেষ হয়, আবার দীর্ঘসময় নিয়েও প্রার্থনা চলে। সারা রাত প্রার্থনা চলেছে এমন নজিরও আছে।

সাধুবাবা রাধানাথ শুচিবায়ুগ্রস্ত। কিন্তু তিনি মানুষের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলেন। তার পরিচিত সবাই বিষয়টি জানে। খুব সাবধানে থাকে। দৈবাৎ কারও গায়ের সঙ্গে গা লেগে গেলে তিনি তৎক্ষণাৎ স্নান করেন। স্নানের পর ভেজা কাপড় বদলান না। ভেজা কাপড় গায়ে শুকান।

তিনি নিরামিষাশি এবং একাহারি। সূর্য ডোবার আগে আগে খাবার খান, তবে সারা দিনই ঘনঘন চা খান, লেবুর শরবত খান। বেদানা তার প্রিয় ফল। পাথরের বাটিতে সব সময়ই দানা ছড়ানো বেদানা থাকে।

 

রাধানাথ বাবুর সামনে দৈনিক ইত্তেফাক হাতে শফিক বসে আছে। সে এই বাড়িতে প্রতিদিন সকাল ন’টার মধ্যে এসে পড়ে। তার দুটি দায়িত্বের একটি রাধানাথ বাবুকে খবরের কাগজ পড়ে শোনানো এবং অন্যটি হলো তাঁর ডিকটেশন নেওয়া। কিছুদিন হলো রাধানাথ বাবুর চোখের সমস্যা হচ্ছে। পড়তে গেলে বা লিখতে গেলে চোখ কড়কড় করে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। তিনি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ডাক্তার বলেছে চোখের পাতায় খুশকি হয়েছে। চিরকাল তিনি জেনেছেন খুশকি মাথায় হয়। খুশকি যে চোখের পাতায়ও হয় তা তার জানা ছিল। জগতের কতকিছুই যে জানেন না তা ভেবে সেদিন তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।

শফিক বলল, আগে কি হেডলাইনগুলি পড়ব?

রাধানাথ বললেন, পত্রিকায় সবচেয়ে ভালো খবর আজ কী ছাপা হয়েছে সেটা পড়ো। এরপর পড়বে সবচেয়ে খারাপ খবর। ভালো ও মন্দে কাটাকাটি হয়ে যাবে।

শফিক বলল, ভালো খবর তেমন কিছু পাচ্ছি না। রাধানাথ বললেন, একটা জাতীয় দৈনিকে ভালো কোনো খবর ছাপা হবে না তা হয় না। ভালোমতো খুঁজে দেখো, নিশ্চয়ই কিছু-না-কিছু আছে। রিকশাওয়ালার সততা, মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেয়ে ফেরত দিয়েছে টাইপ কিছু থাকার কথা।

শফিক বলল, একটা পেয়েছি। লবণের দাম কিছু কমেছে। আগে ছিল ষাট টাকা কেজি, এখন হয়েছে পঞ্চাশ টাকা কেজি। সরকার স্থলপথে ইন্ডিয়া থেকে লবণ আমদানির নির্দেশ দিয়েছেন।

রাধানাথ বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি তো খুবই খারাপ একটা খবর পড়লে। কক্সবাজার ভর্তি সামুদ্রিক লবণ। অথচ লবণ আনতে হচ্ছে ইন্ডিয়া থেকে। হোয়াট এ শেম! এখন ভালো খবরটা পড়ো।

শফিক বলল, দুটা এক শ’ টাকার নোটের ছবি পাশাপাশি ছাপা হয়েছে। নোট দুটার নম্বর এক খবরে বলেছে, বাংলাদেশের কারেন্সি ইন্ডিয়া ছেপে দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, তারা দুই সেট কারেন্সি ছাপে। এক সেট বাংলাদেশকে দেয়, অন্য সেট তারা বাংলাদেশি পণ্য নেওয়ার জন্য ব্যবহার করে।

রাধানাথ বললেন, এটা তো খুবই ভালো খবর।

ভালো খবর?

অবশ্যই ভালো খবর। বাংলাদেশ সরকার গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে। ইন্ডিয়ার প্রতি নির্ভরতা কমাবে।

শফিক বলল, আপনার যুক্তি অদ্ভুত, কিন্তু ভালো।

রাধানাথ বললেন, যুক্তিবিদ্যা অতি দুর্বল বিদ্যা, সবদিকে এই বিদ্যা খাটানো যায়। যাই হোক, তুমি চলে যাও, আজ আমি ডিকটেশন দেব না।

আপনার কি শরীর খারাপ?

হুঁ। চোখের যন্ত্রণা বাড়ছে। মনে হয় অন্ধ হওয়ার পথে এগুচ্ছি। এটা ভালো। কীভাবে ভালো?

জগতের রূপ দেখতে হয় চোখ বন্ধ করে। হাছন রাজা তাই বলেছেন, “আঁখি মুঞ্জিয়া দেখো রূপ রে।” জগতের রূপ দেখার জন্য তৈরি হচ্ছি, খারাপ কী? ড্রয়ারটা খোলো।

শফিক ড্রয়ার খুলল।

রাধানাথ ক্লান্ত গলায় বলল, তোমার চল্লিশ টাকা পাওনা হয়েছে। পঞ্চাশ টাকার নোটটা নিয়ে যাও। দশ টাকা পরে ফেরত দিয়ে। টিসিবির একটা রসিদ আছে দেখো। রসিদে হয় শার্টের জন্য আড়াই গজ কাপড় দিবে, নয়তো প্যান্টপিস দেবে। রসিদ দেখিয়ে তোমার যেটা প্রয়োজন নিয়ে নিয়ে। এখন বলো, মানুষের সবচেয়ে কঠিন অভাব কোনটা?

খাদ্যের অভাব।

হয় নাই। বস্ত্রের অভাব। ক্ষুধার্ত অবস্থায় তুমি পথে বের হতে পারবে। ভিক্ষা চাইতে পারবে। নগ্ন অবস্থায় সেটা পারবে না। তোমাকে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে হবে।

শফিক বলল, আপনার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

রাধানাথ বললেন, দেখে কি মনে হচ্ছে না গভীর দুঃখে আমি কাঁদছি?

মনে হচ্ছে।

রাধানাথ আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ধর্মপাশার একজন সাধুর নাম ‘অশ্রুবাবা’। তিনি ভক্তদের দেখলেই চোখের জল ফেলতেন। অশ্রুবাবার নামডাক শুনে একবার তাকে দেখতে গেলাম। তিনি দু’হাতে আমার ডানহাত জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। আমি আবিষ্কার করলাম, তার চোখের কোনো সমস্যার কারণে তিনি অশ্রুবর্ষণ করেন। ভক্তের দুঃখে আপুত হয়ে বা তার প্রতি মমতাবশত অশ্রুবর্ষণ করেন না। তার হাতটা আমার দেখার শখ ছিল। আমি বললাম, বাবা, আপনার হাতটা একটু দেখি। আমি একজন শখের হস্তরেখাবিদ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত মুঠো করে চোখমুখ শক্ত করে ফেললেন। অশ্রুবাবা এরকম কেন করলেন জানো?

না।

তিনি নিশ্চয়ই বড় কোনো পাপ করেছেন। তার ধারণা হয়েছিল আমি হাত দেখে সেটা ধরে ফেলব।

শফিক বলল, আপনি আমার হাতটা একদিন দেখে দেবেন না।

রাধানাথ বললেন, না। হাতের রেখায় মানুষের ভাগ্য থাকে না। মানুষের ভাগ্য থাকে কর্মে। তোমার কর্ম তো আমি দেখছি।

শফিক বলল, হাতের রেখা বিশ্বাস করেন না, তাহলে হাত দেখেন কেন?

রাধানাথ বললেন, পাঁচ হাজার বছর ধরে মানুষ ভুলের পেছনে কেন ছুটছে, কেন এই বিদ্যার চর্চা এখনো হচ্ছে, তা জানার জন্যে। এখন তুমি বিদায় হও। আজ একদিনে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আজকের কথা বলার কোটা শেষ। আজ আর কথা বলব না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব।

‘অতিভুক্তিরতী বোক্রিঃ
সদ্যঃপ্রাণাপহারিণী’

এর অর্থ—অতিরিক্ত ভোজন এবং অতিরিক্ত বাচালতা সদ্য প্রাণনাশক।

 

রাধানাথ বাবু দরজা-জানালা বন্ধ করে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন। তিনি চিলেকোঠায় মেঝেতে পাতা শীতলপাটিতে ঘুমান। এই ঘরে কখনো না। এটা অতিথি-অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার ঘর। দেয়ালে যামিনী রায়ের দুটি দুর্লভ ছবি আছে। দুই ছবির মাঝখানে রামকিংকর বেইজের ড্রয়িং। ছবিগুলি যত্নে আছে তা না। যামিনী রায়ের হুক খুলে গেছে বলে তিনি ফাঁস নেওয়ার মতো দেয়ালে ঝুলছেন।

রাধানাথ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমালেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন, তাকে একটা প্রকাণ্ড কাঁঠালগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। গাছভর্তি বিষপিঁপড়া। অর্ধেকটা লাল অর্ধেকটা কালো। বিষপিঁপড়ারা তাঁকে কামড়াচ্ছে। হাত-পা বাঁধা বলে তিনি গা থেকে পিঁপড়া তাড়াতে পারছেন না। আশপাশে কেউ নেই যে তিনি সাহায্যের জন্যে ডাকবেন।

এই স্বপ্নটা তিনি এর আগেও কয়েকবার দেখেছেন। প্রতিবার স্বপ্নেই কিছু পার্থক্য থাকে, কিন্তু মূল বিষয় এক। তিনি গাছের সঙ্গে বাঁধা। পিঁপড়া তাঁকে কামড়াচ্ছে। এই স্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা কি আছে? কেউ তাকে কোনো বিষয়ে সাবধান করে দিতে চাচ্ছে? সেই কেউটা কে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি পিতা? সেই আদি পিতাকে কে সৃষ্টি করেছে? তিনি স্বয়ম্ভু। নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন। সেটা কী করে সম্ভব!

রাধানাথ ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন। আজ আর চিলেকোঠার প্রার্থনাঘরে যাওয়া হবে না। ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ে সন্দেহজনক কোনো চিন্তা মাথায় এলে তিনি অস্থির বোধ করেন। সেদিন আর তার প্রার্থনাঘরে যাওয়া হয় না। এক-দু’দিন সময় লাগে মন ঠিক করতে। মন ঠিক হওয়ার পর জীবনযাপন স্বাভাবিক হয়ে আসে।

দরজা খুলে প্রেসের পিয়ন মাথা বের করল। তার চোখে ভয়। সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন পড়লে সে কোনো কারণ ছাড়াই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ে।

কিছু বলবি ফণি?

বাবু, চা দিব?

না।

আপনার কি শরীর খারাপ?

না।

আপনার কাছে একজন ভদ্রলোক আসছে। এক ঘণ্টার উপরে হইল বইসা আছেন। আপনার সঙ্গে নাকি বিশেষ প্রয়োজন। আমি কী বলব, আপনি ঘুমে আছেন?

আমি তো ঘুমাচ্ছি না। মিথ্যা বলবি কেন? ঘরে বাতি জ্বালা। ভদ্রলোককে এখানে নিয়ে আয়।

বাবু, আপনাকে কি লেবুর শরবত বানায়ে দিব?

আচ্ছা দে।

 

ভদ্রলোকের পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল। অত্যন্ত সুপুরুষ। এই সন্ধ্যাবেলাতেও তাঁর চোখে কালো চশমা। রাধানাথের বিছানার কাছে রাখা কাঠের চেয়ারে তিনি মোটামুটি শক্ত হয়ে বসে আছেন। চেয়ারের হাতলে হাত রাখা, সেই হাতও শক্ত। রাধানাথ বললেন, আমার কাছে কী প্রয়োজন?

ভদ্রলোক ইতস্তত করে বললেন, শুনেছি আপনি খুব ভালো হাত দেখেন। আমি আপনাকে হাত দেখাতে এসেছি।

রাধানাথ বললেন, আমি নিজের শখে মাঝে মধ্যে হাত দেখি। অন্যের শখে দেখি না।

ভদ্রলোক ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। রাধানাথ বললেন, হাত দেখার এই অপবিজ্ঞানে আমার কোনো আস্থা নেই। দুর্বল মানুষ এর পেছনে ছোটে। আপনি দুর্বল হবেন কেন?

ভদ্রলোক বললেন, আমি আপনার জন্যে সামান্য কিছু উপহার এনেছি। দার্জিলিংয়ের চায়ের দুটা প্যাকেট। আপনি উপহার গ্রহণ করলে আমি খুশি হব।

রাধানাথ বললেন, আমি উপহার গ্রহণ করলাম, কিন্তু আপনার হাত দেখব। প্রেসে ফণি বলে এক কর্মচারী আছে, তার কাছে চায়ের প্যাকেট দিয়ে যান।

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। বিনীত গলায় বললেন, স্যার, তাহলে যাই। আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে লজ্জিত।

রাধানাথ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, বসুন। দু’হাত মেলুন। তার আগে আমার টেবিলের ড্রয়ারে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস আছে, সেটা আমাকে দিন। সন্ধ্যাবেলা কেউ আমার কাছ থেকে মন খারাপ করে চলে যাবে তা হবে না। সন্ধ্যা হলো বিশ্বপিতার মাহেন্দ্রক্ষণ।

স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ।

 

ছাদ থেকে ঝুলন্ত চল্লিশ ওয়াট বাল্বের আলো রাধানাথের জন্যে যথেষ্ট না। রাধানাথ ম্যাগনিফাইং গ্লাস হাতে ঝুঁকে আছেন। তাঁর চোখও সমস্যা করছে। রুমালে বারবার চোখ মুছতে হচ্ছে।

আপনার নাম কী?

ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসলেন। জবাব দিলেন না। রাধানাথ বললেন, নাম বলতে কি সমস্যা আছে? সমস্যা থাকলে বলতে হবে না। নামে কিছু আসে যায়। আসে যায় কর্মে। যিশুখ্রিষ্টকে বিশুব্রিষ্ট ডাকলেও তার যিশুত্ব কিছুমাত্র কমবে।

আমার নাম ফরিদ।

রাধানাথ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আসল নাম গোপন করলেন, তাই না? ফরিদ নামেও চলবে। আপনি সেনাবাহিনীতে আছেন? আপনার হাভভাব, চোখের কালো চশমায় এরকম মনে হচ্ছে। আপনি সেনাবাহিনীতে আছেন এমন তথ্য হাতে লেখা নেই। অনুমানে বললাম।

আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম, এখন নেই।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন?

হুঁ।

খেতাবধারী?

হুঁ।

কতক্ষণ আর হুঁ হুঁ করবেন? দু’-একটা কথা বলুন শুনি। কী খেতাব পেয়েছেন? হাত দেখে মনে হচ্ছে বড় খেতাব। বীরউত্তম নাকি?

আপনার অপঘাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল। ফাঁসিতে মৃত্যু। বিশেষ আর কিছু জানতে চাইলে কুষ্ঠি তৈরি করতে হবে। চা খাবেন?

না।

আপনি সাহসী, একরোখা, জেদি এবং নির্বোধ। আপনার সুবিধা হচ্ছে, নিজের নির্বুদ্ধিতার বিষয়ে আপনি জানেন, অন্যরা জানে না। যদি সম্ভব হয় একটা রত্ন ধারণ করবেন। রত্নের নাম গোমেদ, ইংরেজিতে বলে গার্নেট। দশ রতির মতো হলেই চলবে।

আপনার এখানে পাওয়া যায়?

না। আমি রত্নব্যবসা করি না।

রত্ন কোথায় পাওয়া যাবে?

ঢাকায় পাবেন না। কলকাতা থেকে সগ্রহ করলে ভালো হয়।

রাধানাথের চোখের যন্ত্রণা হঠাৎ অনেকখানি বাড়ল। তিনি রুমালে চোখ ঢাকতে ঢাকতে বললেন, আপনি কি বিশেষ কিছু জানতে চান?

যুবক ইতস্তত করে বললেন, মানুষের ভাগ্য কি পূর্বনির্ধারিত?

রাধানাথ বললেন, এই জটিল প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আপনাদের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে পূর্বনির্ধারিত। সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ বলছেন, আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় নেকলেসের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।

আপনি কোরানশরিফ পড়েছেন?

অনুবাদ পড়েছি।

আগন্তুক বলল, আপনার দেয়ালে অতি মূল্যবান কিছু ছবি দেখতে পাচ্ছি।

রাধানাথ বললেন, এই পৃথিবীতে মূল্যবান শুধু মানুষের জীবন, আর সবই মূল্যহীন।

আগন্তুক দার্শনিক কথাবার্তার দিকে না গিয়ে বলল, ছবিগুলি অযত্নে আছে। ধুলা মাকড়শার ঝুল। আমি কি আপনার প্রেসের ছেলে ফণিকে বলে ঠিক করে দিয়ে যাব?

না।

আপনার কাছে নাম গোপন করেছিলাম বলে দুঃখিত। আমার নাম শরিফুল হক। আচ্ছা জনাব, যাই।

ডাকনাম ডালিম?

আমাকে ডালিম নামেই বেশির ভাগ চেনে।

আপনি তাহলে ডালিম কুমার?

যুবক জবাব দিলেন না। রাধানাথ কোনো কারণ ছাড়াই খানিকটা অস্থির বোধ করলেন। যুবক কি তার নিজের অস্থিরতা খানিকটা তাকে দিয়েছে। এই সম্ভাবনা আছে। মানুষ চুম্বকের মতো। একটি চুম্বক যেমন পাশের চুম্বককে প্রভাবিত করে, মানুষও করে।

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। শুক্রবার। ভোরবেলা বাংলাদেশ বেতার থেকে ডালিমের কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল। এই যুবক আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করেছিল, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী মুজিব সরকারকে এক সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে। সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি করা হলো।’

এই প্রসঙ্গ আপাতত থাক। যথাসময়ে বলা হবে। দুঃখদিনের গাথা একসঙ্গে বলতে নেই। ধীরে ধীরে বলতে হয়।

 

রাত আটটা।

শফিক অবন্তির পড়ার ঘরে বসে আছে। তাকে চা দেওয়া হয়েছে, সে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। অবন্তি এখনো আসে নি। তার দাদা সরফরাজ খান একটা বই হাতে বেতের চেয়ারে বসে আছেন। শফিক কখনো তাকে অবন্তির পড়ার ঘরে দেখে নি।

সরফরাজ বললেন, মাস্টার, তোমার ছাত্রীর পড়াশোনা কেমন চলছে?

শফিক বলল, ভালো।

সরফরাজ বললেন, গৃহশিক্ষক বিষয়টাই আমার অপছন্দ। আইন করে গৃহশিক্ষকতা উঠিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কেন জানো?

জি-না।

ছাত্রছাত্রীরা গৃহশিক্ষকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নিজেরা কিছু বুঝতে চায় না। কষ্ট করতে চায় না। আমার কথায় যুক্তি আছে না?

জি আছে।

সরফরাজ বললেন, নৈতিকতার বিষয়ও আছে। ছাত্রীরা প্রেম শেখে গৃহশিক্ষকের কাছে। তোমাকে কিছু বলছি না। তুমি আবার কিছু মনে কোরো না। আমি ইন-জেনারেল বলছি। গৃহশিক্ষক ও ছাত্রীর প্রেম কোথায় শুরু হয় জানো?

শফিক অস্বস্তির সঙ্গে বলল, না।

শুরু হয় টেবিলের তলায় পায়ে পায়ে ঠোকাঠুকি থেকে। তারপর বই লেনদেন। বইয়ের পাতার ভেতরে চিঠি।

সরফরাজ হয়তো আরও কিছু বলতেন, তার আগেই অবন্তি ঢুকল। সে অবাক হয়ে বলল, দাদাজান, তুমি এখানে কেন?

সরফরাজ বললেন, আমি এখানে থাকতে পারব না?

না। তুমি থাকবে তোমার ঘরে।

মাস্টার তোকে কীভাবে পড়ায় দেখি। একেকজনের পড়ানোর টেকনিক একেক রকম। শফিকের টেকনিকটা কী জানা দরকার।

অবন্তি বলল, কোনো দরকার নেই। তা ছাড়া আজ আমি পড়ব না। স্যারের সঙ্গে গল্প করব।

গল্প করবি? সবদিন পড়তে ভালো লাগে না। তখন গল্প করতে হয়।

সরফরাজ বললেন, কী গল্প করবি আমিও শুনি। শ্রোতা যত ভালো হয় গল্প তত জমে।

অবন্তি বলল, দাদাজান, আমি একেকজনের সঙ্গে একেক ধরনের গল্প করি। তুমি ওঠো তো।

সরফরাজ উঠে দাঁড়ালেন। অবন্তি বলল, যাওয়ার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাবে এবং অবশ্যই বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে না।

সরফরাজ বিড়বিড় করে কিছু বললেন, পরিষ্কার বোঝা গেল না। অবন্তি শফিকের সামনে বসতে বসতে বলল, দাদাজানের স্বভাব মাছির মতো। খুব বিরক্ত করতে পারেন।

শফিক জবাব দিল না। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় সে ব্রিত বোধ করছে। সে তার দুই পা যথাসম্ভব ভেতরের দিকে টেনে বসেছে। মনে করার চেষ্টা করছে—কখনো কি অবন্তির পায়ের সঙ্গে তার পা লেগেছে?

অবন্তি কালো রঙের চামড়ার ব্যাগ নিয়ে বসেছে। সে ব্যাগ খুলে পারফিউমের শিশি টেবিলে সাজাচ্ছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শফিক। অবন্তি বলল, স্যার, এখানে ষোলটা শিশি আছে। আপনি প্রতিটি পারফিউমের গন্ধ শুকবেন, তারপর বলবেন সবচেয়ে সুন্দর গন্ধ কোনটা, সবচেয়ে কম ভালো গন্ধ কোনটার।

শফিক বলল, আচ্ছা ঠিক আছে।

অবন্তি বলল, আমার মোলতম জন্মদিন উপলক্ষে আমার মা ষোলটা পারফিউম পাঠিয়েছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন কোনটার গন্ধ আমার সবচেয়ে ভালো লাগল।

শফিক বলল, উনি নিশ্চয়ই জানতে চান নি আমার কোনটা ভালো লাগল।

অবন্তি বলল, উনি জানতে চান নি, কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি। আচ্ছা স্যার, আপনি কি জার্মান ভাষা জানেন?

শফিক বলল, বাংলা ভাষাই ঠিকমতো জানি না, জার্মান কীভাবে জানব? কেন বলো তো?

অবন্তি বলল, আমি একটা লেখা লিখেছি। আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। আমি এই লেখাটা আমার মাকে পড়াতে চাই। মা স্প্যানিশ ও জার্মান ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন না। তিনি যখন আমাকে চিঠি লেখেন তখন সেই চিঠি কাউকে দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে দেন। অবশ্য মূল চিঠি সবসময় সঙ্গে থাকে।

শফিক বলল, আমার পরিচিত একজন আছেন, নাম রাধানাথ। তিনি পৃথিবীর অনেক ভাষা জানেন। বিরাট পণ্ডিত মানুষ। তবে জার্মান ভাষা জানেন কি না আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নেব।

অবন্তি বলল, চুপ করে বসে থাকবেন না স্যার, গন্ধ পরীক্ষা শুরু করুন। ভালো কথা, আপনি কি বাসি পোলাও খান? আমার জন্মদিনে একগাদা খাবার রান্না করা হয়েছে। শুধু একজন গেস্ট এসেছে, আর কেউ আসে নি। আপনাকে কি টিফিন ক্যারিয়ারে করে কিছু খাবার দিয়ে দেব?

শফিক বলল, দাও। একটা পেন্সিল দিতে পারবে?

পারব। পেন্সিল দিয়ে কী করবেন?

শফিক ইতস্তত করে বলল, তোমার একটা ছবি আঁকব। পেন্সিল পোট্রট।

আপনি পোট্রট করতে পারেন?

পারি।

কোত্থেকে শিখেছেন?

নিজে নিজেই শিখেছি। কিছু বিদ্যা আছে মানুষের ভেতর থাকে। সে নিজেও তা জানে না।

অবন্তি আগ্রহ নিয়ে পেন্সিলের সন্ধানে গেল।

 

শফিক কাদেরের চায়ের দোকানে বসা। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে শফিক চায়ের দোকানে এসেছে। দুজনেই আগ্রহ করে নিঃশব্দে খাচ্ছে।

কালাপাহাড়কেও খাবার দেওয়া হয়েছে। সে পোলাও খাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে আরামে মাংসের হাড় চিবাচ্ছে। কাদের বলল, ভাইজান, আপনি আজিব মানুষ।

শফিক বলল, আজিব কেন?

খানা নিয়া আমার এইখানে চইলা আসলেন! আমি আপনের কে বলেন? কেউ না। ভাইজান, এত আরাম কইরা অনেকদিন খানা খাই না। আমি আপনেরে দেশের বাড়িতে নিয়া যাব। গ্রামের নাম তালতলি, কেন্দুয়া থানা। আমার স্ত্রী বেগুন দিয়া টেংরা মাছের একটা সালুন রান্ধে। এমন স্বাদের সালুন বেহেশতেও নাই। আপনেরে খাওয়াব। আমার সাথে দেশের বাড়িতে যাবেন না?

শফিক বলল, যাব।

কাদের বলল, আপনের সঙ্গে আমি ভাই পাতাইলাম। আইজ থাইকা আপনে আমার ছোটভাই। আমি খুবই গরিব মানুষ। ভাইয়ে-ভাইয়ে আবার ধনী-গরিব কী? ঠিক না ছোটভাই?

শফিক হাসল।

 

সরফরাজ খান একদৃষ্টিতে তার হাতের কাগজের দিকে তাকিয়ে আছেন। কাগজে পেন্সিলে এক পরী আঁকা হয়েছে। পরীর নাম অবন্তি। পেন্সিলে আঁকা একটা ছবি এত সুন্দর হয়! তাও সম্ভব। অবন্তিকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! দুষ্টুমি করে সে নিচের ঠোঁট সামান্য বাঁকা করে রেখেছে। তাও বোঝা যাচ্ছে।

যে মাস্টার এত সুন্দর ছবি আঁকে সে শয়তানের ঘনিষ্ঠ স্বজন ছাড়া কিছু না। ছবি আঁকা বিদ্যা দিয়ে সে নিশ্চয়ই মেয়েদের ভুলায়, এটা বোঝাই যাচ্ছে। মেয়েদের স্বভাবই হচ্ছে হালকা জিনিস নিয়ে মাতামাতি করা। যে ছবি ক্যামেরায় তোলা যায় সেই ছবি পেন্সিলে আঁকার কিছু নেই। বদের হাড্ডি।

সরফরাজ খান সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন—মাস্টারের চাকরি শেষ। পত্রপাঠ বিদায়। ছবিটাও নষ্ট করে ফেলতে হবে।

অবন্তি তার দাদাজানের পাশে এসে দাঁড়াল। সরফরাজ খান ছবি নামিয়ে রাখলেন। অবন্তি বলল, টাসকি খেয়েছ দাদাজান?

টাসকি আবার কী?

টাসকি হচ্ছে কোনো-একটা জিনিস দেখে ঘাবড়ে যাওয়া। তুমি কি ছবি দেখে টাসকি খেয়েছ?

টাসকি খাওয়ার মতো কোনো ছবি না।

দাদাজান, তুমি হিংসা করছ।

আমি হিংসা করছি? গরুর নাদিকে আমি হিংসা করব?

গরুর নাদি বলছ কেন?

যে যা আমি তাকে তা-ই বলি।

আমার স্যার গরুর নাদি?

ইয়েস।

চিন্তাভাবনা করে বলছ, নাকি আমাকে রাগানোর জন্যে বলছ?

চিন্তাভাবনা করেই বলছি।

দাদাজান শোনো। আমি তোমার সঙ্গে বাস করব না।

কোথায় যাবে?

আমি আমার স্বামীর কাছে চলে যাব।

কার কাছে চলে যাবি?

স্বামীর কাছে। To my beloved husband,

সরফরাজ খান কঠিন চোখে অবন্তির দিকে তাকিয়ে আছেন। অবন্তিও তাকিয়ে আছে, তবে অবন্তির মুখ হাসি হাসি।

সরফরাজ উঠে দাঁড়ালেন। অবন্তি বলল, কোথায় যাচ্ছ?

সরফরাজ বললেন, ঘুমাতে যাচ্ছি। আর কোথায় যাব

আমার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ কেন? ছবি রেখে যাও। এই ছবি আমি বাধিয়ে আমার শোবার ঘরে রেখে দেব।

সরফরাজ খান বিরক্ত গলায় বললেন, বাড়াবাড়ি করিস না। কোনোকিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করা ঠিক না।

অবন্তি বলল, এই কথা তোমার জন্যেও প্রযোজ্য। তুমিও কোনোকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না।

 

সরফরাজ বিছানায় শুয়েছেন। তার হাতে ইছামতি বই। বইটা পড়ে কোনো আরামই পাচ্ছেন না। জটিল ভাষা। অর্থহীন কথাবার্তা। তারপরেও বই শেষ করতে হবে। নিশ্চয়ই বইয়ের কোথাও-না-কোথাও বদ মাস্টার কোনো ইশারা দিয়েছে। পেন্সিল দিয়ে আন্ডারলাইন করেছে।

সরফরাজ ইছামতি পড়ছেন—

রাজারামের ভগ্নি তিনটির বয়স যথাক্রমে ত্রিশ, সাতাশ ও পঁচিশ। তিলুর বয়স সবচেয়ে বেশি বটে, কিন্তু তিন ভগ্নির মধ্যে সে-ই সবচেয়ে দেখতে ভালো, এমনকি তাকে সুন্দরী শ্রেণীর মধ্যে সহজেই ফেলা যায়। তিলুর মধ্যে পাকা সবরি কলার মতো একটু লালচে ছোপ থাকায় উনুনের তাতে কিংবা গরম রৌদ্রে মুখ রাঙা হয়ে উঠলে বড় সুন্দর দেখায় ওকে। তন্বী, সুঠাম, সুকেশী—বড় বড় চোখ, চমৎকার হাসি। তিলুর দিকে একবার চাইলে হঠাৎ চোখ ফেরানো যায় না। সরফরাজ বই বন্ধ করলেন। মাস্টারের ব্যাপারটা এখন বোঝা যাচ্ছে। অবন্তি হচ্ছে তার তিলু। আরও কিছুদূর এগুলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। দেখা যাবে তিলু প্রেমে পড়েছে তার গৃহশিক্ষকের। এই গৃহশিক্ষক আবার পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে পারে। সরফরাজ মনে মনে বললেন, হারামজাদা! ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখো নি। তুমি আমাকে চেনো না। আমি সরফরাজ খান। দাঁড়াও, তোমার শিক্ষাসফরের ব্যবস্থা করছি, বইটা আগে শেষ করি।

সরফরাজ পাঠে মন দিলেন–

তবে তিলু শান্ত পল্লীবালিকা, ওর চোখে যৌবন চঞ্চল কটাক্ষ নেই, বিয়ে হলে এতদিন ছেলেমেয়ের মা ত্রিশ বছরের অর্ধপ্রৌঢ়া গিন্নি হয়ে যেত তিলু। বিয়ে না হওয়ার দরুণ ওদের তিন বোনই মনেপ্রাণে এখনো সরলা বালিকা। আদরে আবদারে, কথাবার্তায়, ধরন ধারণে সব রকমেই।

দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। হাতের বই নামিয়ে সরফরাজ বললেন, কে?

অবন্তি বলল, তোমার জন্যে পান আর চা নিয়ে এসেছি।

সরফরাজ বললেন, ফরগেট ইট!

অবন্তি বলল, দরজাটা খোলো। তোমার টেবিলে রেখে যাই, তারপর তুমি ফরগেট ইট’ করে ফেলবে।

সরফরাজ দরজা খুললেন। অবন্তি পান আর চা নামিয়ে রেখে মিষ্টি করে হাসল। সরফরাজ বিরক্ত মুখে বললেন, হাসছিস কেন? হাসি বন্ধ।

অবন্তি বলল, তোমার হাসতে ইচ্ছা না করলে হাসবে না। তবে আমার এই হেসে যাওয়াতেই আনন্দ।

কী বললি?

বললাম, আমার হেসে যাওয়াতেই আনন্দ।

এর মানে কী?

অবন্তি বলল, খুব সহজ মানে দাদাজান। কেউ হেসে আনন্দ পায়। কেউ কেঁদে আনন্দ পায়। আনন্দটাই প্রধান। হাসা বা কাঁদাটা কোনো ব্যাপার না।

সরফরাজ বললেন, সারাক্ষণ এমন উদ্ভট কথা কেন বলিস?

অবন্তি বলল, আমার এই উদ্ভট কথাতেই আনন্দ।

রাগ করতে গিয়েও সরফরাজ খান রাগ করতে পারলেন না। হেসে ফেললেন।

অবন্তি বলল, দাদাজান, তুমি যখন হাসো তখন তোমাকে কী সুন্দর যে লাগে! অথচ তুমি সারাক্ষণ মুখটাকে রামগরুড়ের ছানা করে রাখো।

রামগরুড়ের ছানা আবার কী?

অবন্তি বলল, যাদের হাসতে মানা, তারাই রামগরুড়ের ছানা। দাদাজান, গুড নাইট স্লিপ টাইট।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ