সরফরাজ খান দোতলায় জানালার পাশে বসে আছেন। জানালার কাঠের খড়খড়ি খানিকটা নামানো। তিনি খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বাড়ির বাইরের উঠান খানিকটা দেখতে পাচ্ছেন। সরফরাজ খানের অনেক বিচিত্র অভ্যাসের মধ্যে একটি হলো জানালার পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা। এই তাকিয়ে থাকা অর্থহীন। তাঁর বাড়িতে কেউ ঢোকে না, কেউ বেরও হয় না। বাড়ির দারোয়ান কালাম মাঝে মধ্যে পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। বিলাপের সুরে শব্দ করে। মনে হয় গান করে। কালামের গান শোনার আগ্রহে সরফরাজ খান অপেক্ষা করেন—এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই।

সকাল এগারটা। গত রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া ঠান্ডা। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ের মতো হয়েছিল। প্রচুর পাতা পড়েছে। পাতা পরিষ্কার করা হয় নি। পাতার ওপর পা ছড়িয়ে কালাম বসে আছে। সাইকেলের ঘণ্টার ক্রিং ক্রিং শব্দ হলো। সরফরাজ জানালার খড়খড়ি আরও খানিকটা তুললেন। সাইকেল আরোহীকে যদি দেখা যায়।

আরোহীকে দেখা গেল। সরফরাজ ভেবেছিলেন পোস্টঅফিসের পিয়ন। পোস্টঅফিসের পিয়নরা লাল রঙের সাইকেলে করে চিঠি বিলি করে। তা না। মায়া মায়া চেহারার শ্যামলা একটি মেয়ে সাইকেলে চড়ে এসেছে। মেয়েটি ছেলেদের মতো শার্ট-প্যান্ট পরেছে। শার্ট-প্যান্ট দু’টার রঙই কালো। এই মেয়ে কে?

কালাম হাসিমুখে এই মেয়েকে সালাম দিল। সদর দরজা খুলে দিল। মেয়েটি কালামের হাতে সাইকেল ধরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। এর একটাই অর্থ, মেয়েটি কালামের পূর্বপরিচিত।

সরফরাজ খানের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। তিনি প্রায় সারা দিন বাড়িতে থাকেন, তারপরেও এ বাড়িতে কিছু লোকজন আসে যাদের বিষয়ে তিনি জানেন না। নিশ্চয়ই এই মেয়ে অবন্তির কাছে এসেছে। অবন্তি তাকে কিছু জানায় নি। অবন্তির অপরাধ ক্ষমা করা যায়। সে অনেক কিছুই গোপন করে। মেয়েদের স্বভাবই হচ্ছে গোপন করা। বয়ঃসন্ধিকালে তারা শরীর গোপন করতে শেখে। গোপন করার এই অভ্যাস তাদের মাথায় ঢুকে যায়। তখন তারা সবই গোপন করে।

কালাম হারামজাদা কেন গোপন করেছে? পাছায় লাথি দিয়ে বদটাকে বিদায় করা দরকার। বদটা এখন ক্রি ক্রিং শব্দে সাইকেলের বেল বাজাচ্ছে। যেন হাতে খেলনা পেয়েছে। সরফরাজ জানালার পাট খানিকটা খুলে ডাকলেন, কালাম!

কালাম ওপরের দিকে তাকাল। সরফরাজ বললেন, ওপরে আসো। বলেই জানালা বন্ধ করলেন। তবে তিনি এখনো খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে কালাম বদটাকে দেখতে পাচ্ছেন। বদটা যে ভয় পেয়েছে তা না। এখনো সাইকেলের ঘণ্টি বাজাচ্ছে। সরফরাজ খান মনে মনে বললেন, তোমার সুখের দিন আজই শেষ। পত্রপাঠে বিদায়।

 

দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় সরফরাজের ঘর অন্ধকার। কিছুদিন হলো তাকে অন্ধকারে থাকতে হচ্ছে, কারণ তার চোখ উঠেছে। আলোর দিকে তাকালেই চোখ কড়কড় করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের সব মানুষের চোখে এই রোগ হয়েছিল। তখন রোগের নামকরণ হয়েছিল জয়বাংলা রোগ’। সরফরাজ খানের তখন এই রোগ হয় নি, এখন হয়েছে। মানসিক টেনশনের সঙ্গে কি এই রোগের কোনো যোগ আছে?

প্রবল মানসিক চাপের কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় সবার এই রোগ হয়ে গেল। তিনি কোনো মানসিক চাপে ছিলেন না বলে তার হয় নি। এখন মানসিক চাপে আছেন বলে চোখে জয়বাংলা রোগ হয়েছে। মানসিক চাপটা অবন্তিকে নিয়ে।

কালাম তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতে সে কুঁজো না। বুক টান করে হাঁটে। শুধু তার সামনেই কুঁজো হয়ে দাঁড়ায়। সরফরাজ বললেন, সাইকেলে করে এসেছে মেয়েটা কে?

শামিমা আপু।

শামিমা আপু বললে তো আমি কিছু বুঝব না। শামিমা আপুটা কে?

অবন্তি আপুর বান্ধবী। ফ্রেন্ড!

সরফরাজ বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি কোনোদিন এই মেয়েকে দেখলাম না। অবন্তির কাছে তার নাম শুনলাম না। সে হয়ে গেল অবন্তির বান্ধবী?

শামিমা আপু পেরায়ই আসেন।

প্রায়ই যদি আসে আমার সঙ্গে দেখা হয় না কেন?

আপনি দুপুরে খানার পরে যখন ঘুম যান, তখন শামিমা আপু আসে।

সরফরাজ কঠিন গলায় বললেন, তুমি ওই মেয়ের কাছে যাও। তাকে আসতে বলো।

কালাম বলল, এখন যাওয়া যাবে না।

এখন যাওয়া যাবে না কেন?

উনারা দুইজন দরজা বন্ধ কইরা কী জানি করেন।

সরফরাজ খানের মাথায় চক্কর দিল। দরজা বন্ধ করে কী জানি করে, এর মানে কী? খুব খারাপ কিছু না তো? কী সর্বনাশ! কী সর্বনাশ!

সরফরাজ খান নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, যাও, বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। যখন দরজা খুলবে তখন তাকে নিয়ে আসবে।

জি আচ্ছা।

দরজার সঙ্গে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। ওরা কী কথা বলে তা আমার জানা দরকার।

জি আচ্ছা স্যার।

সরফরাজ তিক্ত গলায় বললেন, দরজা বন্ধ করে গল্প করার কী আছে তাও তো বুঝলাম না।

কালাম বলল, শামীমা আপু ছিগরেট গাঁজা এইগুলা খায় তো, এইজন্যে দরজা বন্ধ রাখে।

সরফরাজ হতভম্ব গলায় বললেন, কী বলো!

কালাম বলল, কথা সত্য স্যার। আমি দুইবার উনারে ছিগরেট আইনা দিছি। উনি খায় কেটু ছিগারেট। কড়া আছে। পাকবাহিনী এই ছিগারেট খাইত।

সরফরাজ নিজেই একতলায় নেমে এলেন, অস্বস্তি নিয়ে বন্ধ দরজার পাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ভেতর থেকে কোনো কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না, তবে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার ইচ্ছা করছে লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে শামীমা মেয়েটিকে বের করেন। এই কাজটা করলে অবন্তির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক চিরতরে নষ্ট হবে বলে কাজটা করতে পারছেন না।

 

ছেলেদের মতো পোশাক পরা মেয়েটির নাম শামীমা না। তার নামও ছেলেদের মতো। শামীম। পুরো নাম শামীম শিকদার। সে মাওবাদী সিরাজ সিকদারের ছোটবোন। পেশায় ভাস্কর। কিছুদিন আগে ভাস্কর্যে সে প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছে।

শামীম সিকদারের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রের লেকচারার হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা আছে। শামীম শিকদার হুমায়ূন আহমেদের প্রথম গ্রন্থ নন্দিত নরকের প্রচ্ছদ শিল্পী। বইয়ের দুটি মুদ্রণে শামীম শিকদারের প্রচ্ছদ ছাপা হয়। তারপর প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। শামীম শিকদারকে প্রায়ই দেখা যেত সাইকেল চালিয়ে (মাঝে মাঝে মোটর সাইকেল) হুমায়ূন আহমেদের বাবর রোডের বাসায় (শহীদ পরিবার হিসেবে সরকার থেকে পাওয়া) উপস্থিত হতো। সে সারাক্ষণ হুমায়ূন আহমেদের মায়ের সঙ্গে থাকত। গলা নিচু করে গুটুর গুটুর গল্প করত।

অবন্তির সঙ্গে শামীম সিকদারের পরিচয়ের সূত্র হচ্ছে, অবন্তি আর্ট কলেজ থেকে তাকে ধরে এনেছে। শামীম শিকদারের দায়িত্ব মাটি দিয়ে অবন্তির একটি আবক্ষ মূর্তি তৈরি করা। অবন্তি এই মূর্তি পাঠাবে তার মাকে।

 

সরফরাজ মোটামুটি বিচারকের আসনে বসে অবন্তির বান্ধবীর অপেক্ষা করছেন। বসেছেন কাঠের চেয়ারে। সোফায় আয়েশ করা বসা না। তার হাতে দৈনিক ইত্তেফাক। গোল করে চোঙার মতো করা। চোঙা কী কাজে আসবে তা বোঝা যাচ্ছে না।

অবন্তি ঘরে ঢুকে হালকা গলায় বলল, আমাকে ডেকেছ?

সরফরাজ বললেন, তোকে তো ডাকি নি। তোর বান্ধবী কোথায়?

চলে গেছে।

চলে গেছে মানে কী? তাকে বলা হয়েছে আমার সঙ্গে দেখা করতে।

অবন্তি বলল, সে তোমার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে নি। চোখমুখ শক্ত করে বসে থাকবে না। কী জানতে চাও, আমাকে জিজ্ঞেস করো। আমি বলে দেব।

ওই মেয়ে নাকি গাঁজা খায়?

হুঁ, খায়।

গাঁজা খাওয়া ক্যাটাগরির একটি মেয়ের সঙ্গে তোর পরিচয় কীভাবে?

অবন্তি বলল, তুমি এত উত্তেজিত হয়ো না। এই মেয়ে গাঁজা খাচ্ছে তাতে কী হচ্ছে? আমি তো তার কাছ থেকে গাঁজা খাওয়ার ট্রেনিং নিচ্ছি না।

সরফরাজ খান বললেন, তুই কিসের ট্রেনিং নিচ্ছিস?

অবন্তি হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি কোনো ট্রেনিং নিচ্ছি না। আমি শুধু তার সামনে এক ঘণ্টা নেংটো হয়ে বসে থাকি।

কী বললি?

অবন্তি বলল, কী বলেছি তা তুমি ভালোই শুনেছ। দ্বিতীয়বার বলব না। আমার বান্ধবী আমার আবক্ষ মূর্তি বানাচ্ছে। আমি নিশ্চয়ই লেপ-তোষক গায়ে দিয়ে মূর্তির জন্যে সিটিং দেব না।

তুই ওই মেয়ের সামনে নগ্ন হয়ে বসে থাকিস?

হ্যাঁ।

আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বলিস?

বিশ্বাস করতে না চাইলে করবে না।

অবন্তি ঠোঁট গোল করে শিস বাজানোর চেষ্টা করল। এই চেষ্টার পেছনের উদ্দেশ্য একটাই—দাদাজানকে রাগানো। তবে আজ মনে হয় তিনি রাগবেন না। বিস্ময়ে হতভম্ব হওয়া মানুষ রাগতে পারে না।

অবন্তি দাদার দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে কুঁ কুঁ শব্দ করতে লাগল। সরফরাজ অবাক হয়ে বললেন, এমন করছিস কেন?

অবন্তি বলল, ভেঙাচ্ছি।

But why?

তোমার ওপর রাগ লাগছে, এইজন্যে ভেঙাচ্ছি।

হতভম্ব সরফরাজ বললেন, কেন রাগ লাগছে, সেটা কি জানতে পারি?

না, জানতে পারো না। কারণ আমি নিজেই জানি না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি, আমার কিসের ব্যথা যদি জানতেম তাহলে তোমায় জানাতেম।’ কথাগুলি মনে হয় উলট-পালট হয়ে গেল। স্যারের কাছ থেকে জানতে হবে।

তোর স্যার সব জানে?

সব জানে না, তবে যা জানার তা জেনে দিতে পারে।

তাহলে তো বিরাট কৰ্মীপুরুষ।

ঠাট্টা ঠাট্টা গলায় কথা বলছ কেন দাদাজান? পুলিশের এসপি হয়ে তুমি যেমন কর্মীপুরুষ, রাস্তার মোড়ে যে প্রৌঢ়া সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একমনে ইট ভাঙে সেও কমীমহিলা।

দরজায় কড়া নড়ছে। সরফরাজ নিজেই দরজা খুলতে গেলেন। এই সময় পিয়ন আসে। পিয়নের হাত থেকে চিঠি সংগ্রহ করা তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন। চিঠি পড়ার পর যার যার চিঠি তিনি তাকে দেন। চিঠি Edit-ও করা হয়। অপছন্দের কিছু লাইন কেটে দেওয়া হয়। সব চিঠি যে প্রাপকের কাছে দেওয়া হয় তাও না। নষ্ট করে ফেলা হয়। খাম খোলার যাবতীয় সরঞ্জাম তার কাছে আছে।

চিঠি এসেছে দুটা। একটা পাঠিয়েছেন অবন্তির মা ইসাবেলা। হঠাৎ করে চিঠি আসার অর্থ কী তিনি বুঝতে পারছেন না। এই বদ মহিলা বছরে দু’টা, খুব বেশি হলে তিনটা, চিঠি পাঠায়। সরফরাজ খান ভুরু কুঁচকে চিঠি সরিয়ে রাখলেন। সময় নিয়ে খুলতে হবে, সময় নিয়ে পড়তে হবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

দ্বিতীয় চিঠি দেখে সরফরাজ খানের ভুরু কুঁচকালো এবং তার ঘাড় ব্যথা করতে লাগল। হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে তার ঘাড় ব্যথা করে। চিঠি লিখেছে গদিনশীন পীর হাফেজ জাহাঙ্গীর। অবন্তিকে লেখা চিঠি। বদমাইশ এখনো অবন্তিকে তার স্ত্রী মনে করছে। বদমাইশটাকে জুতাপেটা করা দরকার।

সরফরাজ খান চিঠি নিয়ে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

চিঠি খুললেন। এই চিঠি খুলতে সাবধানতার কিছু নেই। চিঠি অবন্তির কাছে দেওয়া হবে না। ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। এতে দোষের কিছু নেই। পরিবার হলো রাষ্ট্রের মতো। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ থাকে। তারা রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করে। পরিবারেও গোয়েন্দা বিভাগ থাকা বাঞ্ছনীয়। এই গোয়েন্দা বিভাগ পরিবারের কল্যাণে কাজ করবে।

চিঠি হুবহু তুলে দেওয়া হলো—

আমার প্রাণপ্রিয় পত্নী মায়মুনা
ওরফে অবতি!

সরফরাজ মনে মনে বিড়বিড় করলেন, বদমাইশ! নামটাও জানে না। বলে অবতি। এদিকে প্রাণপ্রিয় পত্নী। তোকে যদি নেংটা করে চক্কর না দেওয়াই আমার নাম সরফরাজ খান না।

পরসমাচার এই যে, আল্লাহপাকের অসীম মেহেরবানিতে আমি ভালো আছি। সোবাহানাল্লাহ। সোবাহানাল্লাহ। সোবাহানাল্লাহ।

তোমার স্বাস্থ্যও নিশ্চয় ভালো আছে। আমি প্রতি বৃহস্পতিবার আছরের ওয়াক্তে তোমার জন্য খাস দিলে দোয়া করিতেছি।

 

প্রতি মাসের প্রথম শনিবারে জ্বিনসহ যে দোয়া করা হয় তাহাতেও তোমার নাম উল্লেখ করি। গত বুধবার তিন ঘটিকায় তোমার পত্র পাইয়া আমি যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছি। বলিলে বিশ্বাস হইবে না, আমার দুই চোখেই পানি আসিয়াছে। গদিনসীন পীর হিসাবে আমি কী করি এবং তোমার শ্বশুরের মৃত্যুর পর হুজরাখানা কেমন চলিতেছে তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছ। আলহামদুলিল্লাহ, সোবাহানাল্লাহ।

শ্রাবণ মাসের ৭ তারিখ বাদ-আছর হুজরাখানায় আমার পিতার মৃত্যুদিবসে ওরস উদ্যাপন হইবে। ইনশাল্লাহ।

এই উপলক্ষে তুমি চলিয়া আসো। তোমার দাদাজান মনে হয় তোমাকে পাঠাইতে রাজি হইবেন না। এমতাবস্থায় তোমাকে নেওয়ার জন্য বিশ্বস্ত কাউকে পাঠাইতে পারি। কিংবা আমি নিজেও আসিতে পারি।

তোমার ভরণপোষণের টাকা আমি নিয়মিত পাঠাই। ইহাতে রাগ করিও না। স্বামী হিসাবে আমার ইহা কর্তব্য।

জ্বিন কর্তৃক জানিয়াছি, সামনে তোমার বড় ফাড়া আছে। আমি তোমাকে একটা তাবিজ পাঠাইলাম। তাবিজটি পঞ্চধাতুর কবজে ভরিয়া তোমার শোবার ঘরের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে ঝুলাইয়া রাখিবে।

তাবিজ ঝুলাইবার পর পর ঘরে বিড়ালের উপদ্রব হইতে পারে। ভয় পাইও না এবং অবশ্যই বিড়ালগুলিকে কোনো খাবার দিবে না। তাহাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করারও প্রয়োজন নাই।

ইতি
জাহাঙ্গীর খতিবি
গদিনসীন পীর, খতিবনগর হুজরাখানা

সরফরাজ খান সঙ্গে সঙ্গে চিঠি টুকরা টুকরা করে ডাস্টবিনে ফেললেন। তারপরই চিঠির টুকরা ডাস্টবিন থেকে তুলে আলাদা করলেন। আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। একটা টুকরাও যেন অবন্তির হাতে না যায়। কোনো কাজে দেরি করতে নেই। সরফরাজ খান দিয়াশলাই জ্বালিয়ে চিঠির টুকরা পোড়ালেন। মুসলমান মাতার গর্ভে এবং মুসলমান পিতার ঔরসে জন্ম নেওয়ার কারণেই হয়তো তাবিজটা পোড়াতে পারলেন না। তাবিজটা এ রকম—

তিনি এই তাবিজ পঞ্চধাতুর কবচে ভর্তি করে গোপনে অবন্তির শোবার ঘরের দক্ষিণের দেয়ালে ঝুলাবার ব্যবস্থাও করলেন। নানান ঝামেলায় তার সারা দিন গেল বলে অবন্তির মা ইসাবেলার চিঠি পড়ার সুযোগ হলো না। তিনি ঠিক করলেন, এই চিঠি রাতে ঘুমুবার সময় ঠান্ডা মাথায় পড়বেন। এখন মাথা কিঞ্চিৎ গরম হয়ে আছে।

 

অবন্তি দাদাজানকে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসেছে। আজ রান্না হয়েছে পাখির মাংস। খালেদ মোশাররফ চাচু ছয়টা ঘুঘু পাখি দিয়ে গেছেন। ছয়টাই রান্না হয়েছে। সরফরাজ খান আনন্দ নিয়ে খাচ্ছেন। অবন্তি খাচ্ছে ডিমভাজা দিয়ে। সরফরাজ খান বললেন, পাখি খাচ্ছিস না?

অবন্তি বলল, আমি পাখি খাই না। বিশেষ করে ঘুঘু খাওয়া তো অসম্ভব। হেমন্তের ওই গানটা মনে করো—’ছায়া ঢাকা, ঘুঘু ডাকা গ্রামখানি ওই…’

অবন্তিকে থামিয়ে সরফরাজ বিরক্ত গলায় বললেন, মোরগ, হাঁস এইসব তো খাস?

হুঁ।

ওরা পাখি না? ওরা সুন্দর না?

না। মোরগ কু কু করে ডাকে, আর হাঁস প্যাক প্যাক করে। অসহ্য! এই দুই পাখি আবার মানুষের বিষ্টা খায়।

সরফরাজ বিরক্ত গলায় বললেন, তোর সঙ্গে আর্গুমেন্টে যাওয়া আর একটা কাতল মাছের সঙ্গে আর্গুমেন্টে যাওয়া একই। আমরা দুইজন দুই জগতের বাসিন্দা।

অবন্তি বলল, ঠিকই বলেছ। ভেরি রাইট। তুমি স্থলচর আমি জলচর। এখন বলো, জলচর প্রাণীর কাছে জনৈক স্থলচর প্রাণীর চিঠিটা কি নষ্ট করে ফেলেছ?

তার মানে?

অবন্তির খাওয়া শেষ হয়েছে। সে হাত ধুতে ধুতে বলল, দুপুরে আমি তোমার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কাগজ পোড়ার গন্ধ পেলাম। তোমার ঘরের দরজা কখনো বন্ধ থাকে না। মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করে তুমি নিষিদ্ধ কিছু কাজ করে বলে আমার ধারণা।

সরফরাজ খান বললেন, কাগজ পোড়ার গন্ধ থেকে তুই বুঝে ফেললি আমি তোর চিঠি পোড়াচ্ছি?

হ্যাঁ। কারণ আমি জলচর প্রাণী হলেও আমার বুদ্ধি স্থলচরদের চেয়েও বেশি। ভালো কথা, দাদাজান, আমি দু’দিনের জন্যে এক জায়গায় বেড়াতে যাব। কোথায় যাব জিজ্ঞেস করবে না। কারণ আমি বলব না।

একা যাবি?

একা যাব না। সঙ্গে চড়নদার আছে।

চড়নদার লাগবে কেন? আমি তোকে নিয়ে যাব। তোকে আমি চড়নদারের সঙ্গে ছাড়ব না।

আমি তোমাকে নেব না। প্রয়োজনে একা যাব, কিন্তু তোমাকে নেব না।

চড়নদারটা কে? আমাদের মাস্টার?

হতে পারে। সম্ভাবনা আছে। উনি যদি আমার সঙ্গে না যান, তাহলে একাই যাব।

তোর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তোর চিকিৎসা দরকার।

অবন্তি বলল, ঠিক বলেছ। যেদিন মাথা পুরোপুরি খারাপ হবে সেদিন ছাদ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ব। ঠিক কোন জায়গাটায় লাফিয়ে পড়ব তাও ঠিক করে রেখেছি। একদিন তোমাকে দেখাব।

সরফরাজ খান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। অবন্তি বলল, পান দিব? পান খাবে? বেশি করে জর্দা দিয়ে পান খেয়ে আরাম করে ঘুমুতে যাও। তোমার ঘুম দরকার।

 

সরফরাজ খান অনেক ঝামেলা করে অবন্তির মা’র চিঠি খাম থেকে বের করলেন। স্টিম দিয়ে গাম নরম করা, ব্লেড দিয়ে খামের মোড়ক খোলা। নানান ঝামেলা। অবন্তি যেন কিছুতেই টের না পায় যে খাম খোলা হয়েছিল।

অবন্তির মা’র চিঠি।

হ্যালো, প্রিটি!

তোমার শিক্ষকের স্কেচের হাত খুব ভালো শুনে আনন্দিত হয়েছি। তবে তাকে দিয়ে নগ্ন পোট্রেট করানোর কিছু নেই। সে পিকাসো না, মনেট না। সাধারণ গৃহশিক্ষক। তার সামনে কেন নিজেকে প্রকাশ করবে?

তাকে বিয়ে করলে ভিন্ন কথা। তখন সারাক্ষণ তার সামনে নেংটো হয়ে ঘুরবে, তখন দেখবে—ছবি আঁকা দূরে থাক, তোমার স্বামী ফিরেও তাকাচ্ছে না। মনে রেখো, চোখে যা দেখা যায় তা দ্রুত তার রহস্য হারায়। চোখে যা দেখা যায় না, যেমন ‘মন’, অনেক দিন রহস্য ধরে রাখে।

তোমার দাদাজানের বিষয়ে আমি এই মুহূর্তে একটি কঠিন সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি। এই সাবধানবাণী নিয়ে হেলাফেলা করবে না। তোমার দাদাজানের মতো সেক্স স্টারভড় বৃদ্ধেরা রূপবতী নাতনিদের প্রতি তীব্র লালসা পোষণ করে। তারা যে-কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটায়। তুমি শুনলে নিশ্চয় চমকে উঠবে, আমি এই জাতীয় ঘটনার ভুক্তভোগী। আমার পুরো জীবন যে এলোমেলো হয়ে আছে অতীতের ভয়ংকর ঘটনা তার একটা কারণ। আমি চাই না আমার মেয়ের জীবন এলোমেলো হোক।

ইতি
ইসাবেলা

পুনশ্চ তোমার গৃহশিক্ষকের আঁকা যে পোট্রেটে তুমি অভিভূত তা আমাকে পাঠাও।

ইসাবেলার চিঠি হাতে অনেক রাত পর্যন্ত সরফরাজ বসে রইলেন। তার ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর পর শরীর কেঁপে উঠতে লাগল। বিছানায় শুতে গেলেন শেষরাতের দিকে। আধো ঘুম আধো জাগরণে মনে হলো, বাড়িভর্তি বিড়াল। মিউ মিউ শব্দ করে অস্থির করে তুলছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ