এরকম যে কিছু ঘটবে রানা জানত। বিপদের ইঙ্গিত মানুষের কাছে আগে আগে পৌঁছে। আল্লাহপাক মানুষকে ইশারা দেন। রানাকেও দিয়েছেন। রানা সেই ইশারা বুঝতে পারে নি। চিটাগাং রওনা হবার সময় সে দেখেছে টেবিলে খালি পানির জগ। এটা হলো প্রথম ইশারা। দ্বিতীয় ইশারা হলো, সে যে বেবিট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলো মাঝপথে সেটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। কার্বোরেটার দিয়ে তেল পাস করছে না। এটা হলো দ্বিতীয় ইশারা। সে নিতান্ত বেকুব বলেই পরিষ্কার ইশারাও ধরতে পারে নি। এতক্ষণে তারা কক্সবাজার পৌঁছে যেত। তার বদলে থানা-হাজতে বসে আছে।

রানার আবার বাথরুম পেয়েছে। এক রাতের টেনশানে ডায়াবেটিস হয়ে গেল নাকি? টেনশানে নানান ধরনের অসুখ-বিসুখ হয়, ডায়াবেটিসও হতে পারে। ঢাকায় পৌঁছেই সুগার টেস্ট করাতে হবে। হাজতে ঢোকার পর এর মধ্যে দুবার বাথরুমে গেছে। তৃতীয় বার যেতে চাওয়া কি ঠিক হবে? শেষে এরা বিরক্ত হয়ে বলবে—পিসাব-পায়খানা যা করার এইখানেই করেন। থানাওয়ালাদের এখন বিরক্ত করা যাবে না। কিছুতেই না। এই সাধারণ সত্যটা দলের কেউ বুঝতে পারছে না। তাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, তারা এখানেও পিকনিক করছে। এদের ধরে ধরে চাবকাতে হবে।

মোতালেব এর মধ্যে পুলিশ-সেন্ট্রিকে হাত ইশারা করে ডেকে বলেছে—মটু ভাইয়া, চায়ের ব্যবস্থা করা যায়? এই পুলিশের স্বাস্থ্য একটু ভালোর দিকে। ভালোর দিকে বলেই তাকে মটু ভাইয়া বলতে হবে? পুলিশের হাজতে বসে পুলিশকে মটু ভাইয়া বলা! রানা ভেবে পাচ্ছে না। এদের সবার একসঙ্গে ব্ৰেইন শটি সার্কিট হয়ে গেছে কি-না। এত বড় একটা বিপদ যাচ্ছে, সেই বিপদ নিয়ে চিন্তা নেই। কী করে উদ্ধার পাওয়া যায় তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। মেয়েগুলিকে আলাদা করে ফেলেছে এটাও চিন্তার বিষয়। বিরাট চিন্তার বিষয়। কে চিন্তা করবে? সব চিন্তা কি সে একা করবো? শুভ্ৰ গাধাটা একটা বই নিয়ে কোণায় বসে আছে। এটা কি বই পড়ার সময়? বল্টু কম্বলে হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে ঘুমুচ্ছে। সঞ্জুকে দেখেও মনে হচ্ছে না। সে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছে। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁলে বত্রিশ ঘা—এই সত্য যে কোনো বাচ্চাছেলেও জানে। এরা মনে হয় জানে না।

সঞ্জু বলল, রানা কটা বাজে?

রানা জবাব দিল না। ফালতু কথা বলার সে কোনো প্রয়োজন দেখছে না। কটা বাজে এটা জেনে হবে কী?

কথা বলছিস না কেন?

চুপ থাক গাধা।

সঞ্জু বলল, তুই আমার ওপর রাগ করছিস কেন? আমি কি তোদের এনে জেলে ঢুকিয়েছি?

বললাম তো চুপ করে থাক।

রানার কথাবার্তা বলতে ভালো লাগছে না। উদ্ধার পাওয়ার বুদ্ধি বের করতে হবে। মাথায় কোনো বুদ্ধি আসছে না। সবার আগে যা করতে হবে তা হলোথানাওয়ালার সঙ্গে একটা আন্ডারাষ্ট্যান্ডিংয়ে আসা। যদি হাজতে রাত কাটাতে হয়—তাহলে কম্বল-টম্বল লাগবে। খাওয়াদাওয়া লাগবে। এইসব কাজে পয়সা খরচ করতে হয়।

রানা বলল, বান্টু ঘুমাচ্ছে নাকি? আশ্চর্য! সঞ্জু, বল্টুটাকে কানে ধরে তোল তো।

কেন? ঘুমাচ্ছে ঘুমাক না। ট্রেনে সারারাত ঘুম হয় নি।

তোল বললাম।

তুই এমন টেনশানে আছিস কেন? কী হয়েছে?

কী হয়েছে বুঝতে পারছিস না?

না।

ভালো। তাহলে তুই আর শুধু শুধু জেগে আছিস কেন? তুইও ঘুমিয়ে পড়। আয়, আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমা।

শুধু শুধু টেনশান করে তো কোনো লাভ নেই।

শুভ্র বই থেকে মুখ তুলে বলল, ওরা একটা ভুল করেছে। ভুলটা যখন ধরা পড়বে তখন লজ্জিত হয়ে আমাদের ছেড়ে দেবে।

রানা বলল, গাধার মতো কথা বলবি না। শুভ্ৰ। গাধামি কথা বন্ধ করে যা করছিস তাই কর। বই পড়। জ্ঞান বাড়া। কী বই এটা?

ব্ৰিফ হিষ্টরি অব টাইম। সময় ব্যাপারটা আসলে কী তা বলার চেষ্টা করা হয়েছে।

মোতালেব কৌতূহলী হয়ে বলল, সময় ব্যাপারটা কী?

শুভ্ৰ বেশ আগ্রহের সঙ্গে সময় কী তা বলতে শুরু করল। সঞ্জু এবং মোতালেব দুজনই শুনছে। বেশ মন দিয়েই শুনছে।

রানা ভেবে পাচ্ছে না কেন সে একদল গাধাকে নিয়ে রওনা হলো? এই বুদ্ধি কে তাকে দিল? সে ঠিক করেছে, এই ঝামেলা থেকে একবার বের হতে পারলে কানে হাত ধরে দশ বার উঠ-বোস করবে। কোরান শরিফ হাতে নিয়ে পশ্চিম দিকে মুখ করে বলবে, আর কোনোদিন এই জাতীয় দায়িত্ব নেবে না।

সেন্ট্রি-পুলিশ পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। রানা বলল, ভাই সাহেব, কাইন্ডলি একটু শুনবেন? ওসি সাহেবের সঙ্গে একটু প্রাইভেট কথা বলতে চাই—একটু কি বলবেন ওসি সাহেবেকে?

ওসি সাহেব চেয়ারে নাই।

চেয়ারে যখন আসবেন তখন কি বলবেন?

আচ্ছা দেখি।

দেখাদেখি নয়। ভাই, এই কাজটা করতেই হবে। ছোট ভাই হিসেবে এটা আপনার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট, আবদার। আর শুনুন ভাই, একটু কাছে আসুন।

সেন্ট্রি-পুলিশ কাছে এলো।

রানা দলা পাকিয়ে একটা একশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, রেখে দিন, পান খাবেন।

পান খাবার ব্যাপারে পুলিশের কোনো আপত্তি দেখা গেল না। রানা চোখ বন্ধ করে ভাবছে। পরিষ্কার কিছু ভাবতে পারছে না। মাথা জ্যাম হয়ে আছে। শুধু জ্যাম না-যন্ত্রণাও করছে। শুভ্ৰ বকবক করেই যাচ্ছে–

বস্তুর গতি যখন আলোর গতির সমান হয়ে যায়, তখন আইনস্টাইনের রিলেটিভিস্টিক সূত্র অনুযায়ী বস্তুর ভর হয় অসীম। সূত্রটা হচ্ছে—এম ইকুয়েলস টু এম নট, স্কয়ার রুট অব …

রানা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এরা সুখেই আছে। কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। সে ঘড়ি দেখল—এগারোটা বাজে। প্ৰায় সাড়ে তিন ঘণ্টা কেটে গেল হাজতে …।

দেখতে দেখতে দুপুর হবে, তারপর সন্ধ্যা হবে, রাত হবে, সকাল হবে, আবার দুপুর হবে, আবার সন্ধ্যা…

রানার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। বাথরুমের বেগ প্ৰবল হয়েছে। আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। এখন একবার যেতেই হবে। সে সেন্ট্রিকে হাসিমুখে ডাকল, এই যে পুলিশ সাহেব, পুলিশ সাহেব।

কি হইছে?

একটু ভাই বাথরুমে যাওয়া দরকার।

টাট্টি করবেন?

জ্বি না। ছোটটা করব।

একটু আগেই তো করছেন। মিনিটে মিনিটে পিসাব করলে তো হবে না।

রানা হতভম্ব হয়ে দেখল। সেন্ট্রি পুলিশ চলে যাচ্ছে। অথচ তাকে একটু আগে পান খাওয়ার জন্যে একশ টাকা দেয়া হয়েছে। রানা শুকনো মুখে সিগারেট ধরাল। বল্টু উঠে বসেছে। মনে হচ্ছে, সে চোখ ব্ৰঞ্জ করে মটকা মেরে পড়ে ছিল। বল্টু রানার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, রানা শোন, বেগ খুব বেশি হলে এখানেই ছেড়ে দে। খামাখা রিকোয়েস্ট করে লাভ কী? যে দেশের যে নিয়ম। ওদের টাইম টেবিল অনুযায়ী তো আর আমাদের পিসাব ধরবে না। কী আর করা।

রানা শুনেও না শুনার ভান করল। শুভ্ৰ সমানে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে— আমাদের প্রচলিত ধারণা হলো, সময় প্রবহমান। নদী যেমন প্রবাহিত হচ্ছে–সময়ও প্রবাহিত হচ্ছে। সময়ের প্রবাহ শুরু হয়েছিল সৃষ্টির আদিতে at the time of Big Bang, সেই প্রবাহ চলছে। নদীর প্রবাহ শেষ হয় সমুদ্রে-সময়ের প্রবাহের শেষ কোথায়? এখন ব্যাপারটা বোঝার জন্যে একটা কাজ করা যাকএকটা থািট এক্সপেরিমেন্ট করা যাক …

রানার ইচ্ছা হচ্ছে, থাবড়া মেরে শুভ্রের বক্তৃতা বন্ধ করে দিতে। এই প্যাচাল বেশিক্ষণ শোনা সম্ভব না। সময়ের শুরু কোথায় হয়েছে তা দিয়ে কিছু যায়-আসে না। তাদের সময়টা কীভাবে যাচ্ছে এটাই বড় কথা।

ব্লাডারের চাপ যে হারে বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে দুটা ছোট ছোট এক্সপ্লোশান হবে এবং দুটা ব্লাডারই ফেটে যাবে। মানুষের ব্লাডার কাটা থাকে? দুটা, না একটা? এই তথ্যটা শুভ্রের কাছ থেকে জেনে নেয়া দরকার। যে সময় নিয়ে এত প্যাচাল পাড়তে পারে সে নিশ্চয়ই মানুষের ব্লাডারের সংখ্যা জানে।

রানা করুণ গলায় ডাকল—পুলিশ সাহেব! ভাই, একটু কাইন্ডলি শুনে যান তো!

সেন্ট্রি অন্য দিকে তাকিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে। সে এখন মনে হয় কোনেও শুনতে পারছে না। পান খাওয়ার জন্যে একশ টাকা না দিয়ে দুশ টাকা দেয়ার দরকার ছিল। অ্যামাউন্ট কম হয়েছে।

এই যে ভাই, প্লিজ। ছোট একটা কথা শুনে যান।

সেন্ট্রি গভীর মনোযোগে দাঁত খোঁচাচ্ছে। দাঁত খোঁচানো শেষ হলো নিশ্চয়ই কান খোঁচাবে। খোঁচাখুঁচি যাদের স্বভাব তারা স্থির থাকতে পারে না। তাদের সবসময় কিছু-না কিছু খোঁচাতে হয়।

রানা আবার করুণ গলায় ডাকল–পুলিশ সাহেব। ব্রাদার। একটু শুনবেন?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ