১৬.

ভিকি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা খবরটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারল না। তাকে দ্বিতীয়বার খরবটি পড়তে হল। শিরোনাম হচ্ছে একক যুদ্ধ। অসীম সাহসী একজন প্রৌঢ়, যার নাম জামশেদ, সে একাকী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এমন সব অপরাধীর বিরুদ্ধে, যাদেরকে পুলিশ কিছুই বলে না বা বলবার ক্ষমতা রাখে না। বেশ বড় খবর। সেখানে অ্যানির মৃত্যু-প্রসঙ্গ আছে। এবং ভয়ংকর দুজন অপরাধী যারা অল্প কিছুদিনের ভেতর মারা গেল তাদের কথাও আছে। নিমো নামের মেয়েটার ক্ষুদ্র একটি সাক্ষাৎকারও আছে।

ভিকি দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইল চেয়ারে। আজ ছুটির দিন, রুনকে নিয়ে তার বে ল্যান্ডে যাবার কথা। সেখানে একটি ছোট্ট কটেজ ভাড়া নেয়া হয়েছে। কিন্তু ভিকির আর যেতে ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে করছিল, রুনকে পাশে বসিয়ে অ্যানির পুরানো দিনের ছবিগুলি দেখে। কিংবা কবরখানায় গিয়ে অ্যানির ছোট্ট কবরটিতে কিছু ফুল দিয়ে আসে। ফুলের সঙ্গে থাকবে এই খবরের কাগজটি যেখানে অনাত্মীয় একটা বিদেশীর কথা আছে। যে ছোট্ট অ্যানির ভালোবাসার উত্তর দিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ভিকির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। রুন ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?

এই খবরটা পড়ো।

রুন নিঃশব্দে পড়ল। তার চেহারা দেখে মনে হল না তার কোনো ভাবান্তর হয়েছে। ভিকি মৃদুকণ্ঠে বলল, বে লান্ডে যাবে আজ?

নাহ।

কী করবে? সিমেট্রিতে যাবে?

নাহ। বলেই অনেক দিন পর গভীর ভালোবাসায় রুন তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমার মেয়ে আর অন্ধকার কফিনে শুয়ে শুয়ে কাঁদবে না। অন্তত একজন তার ভালোবাসার সম্মান রেখেছে। আমার মামণির আজ খুব আনন্দের দিন।

.

রিনালো অফিসে এসেই শুনল তাকে কবার টেলিফোনে খোঁজ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে অফিসে পৌঁছামাত্রই যেন সে এই নাম্বারে যোগাযোগ করে। বিশেষ প্রয়োজন।

রিনালো দেখল নাম্বারটা অপরিচিত। কে হতে পারে? ডায়াল ঘোরানো মাত্রই মৃদু স্বর শোনা গেল, ভিকামডিয়া বলছি।

আমি রিনালো, কী ব্যাপার?

আজকের খবরের কাগজ দেখেছেন, মিঃ রিনালো?

হ্যাঁ।

বিশেষ কোনো খবর আপনার চোখে পড়েছে কি?

 কোনটির কথা বলছেন? লাওসের হাঙ্গামা?

না। লাওস নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আপনি কি দেখেননি খবরের কাগজের লোকরা কীভাবে একজনকে হিরো বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে?

জামশেদের কথা বলছেন?

 হ্যাঁ।

দেখেছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাকে টেলিফোন করবার কারণটা ঠিক ধরতে পারছি না।

আপনার কি মনে হয় না ব্যাপারটা নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে?

আপনি ভুল জায়গায় টেলিফোন করছেন। আমি খবরের কাগজের লোক নই।

 মিঃ রিনালো, আমি ঠিক জায়গাতেই টেলিফোন করেছি।

তার মানে?

আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন কোনো কাগজেই এত বড় একটা হিরোর কোনো ছবি ছাপা হয়নি। এবং আমি যতদূর জানি পুলিশ বিভাগ ছবি ছাপাতে নিষেধ করেছে।

পুলিশ বিভাগের স্বার্থ?

লোকটা বিদেশী। ছবি ছাপা হলেই সে পরিচিত হয়ে পড়বে। দ্রুত ধরা পড়বে। আপনারা চান না সে ধরা পড়ুক।

আপনার এরকম অনুমানের কোনো ভিত্তি আছে কি?

কিছুটা আছে। আমরা ওর ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে চেয়েছিলাম। পত্রিকাওয়ালারা সেটা ছাপতে রাজি নয়। অপরাধীকে ধরিয়ে দিন এই শিরোনামে বিজ্ঞাপন।

আপনারা এইজাতীয় বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেছেন?

বিজ্ঞাপনটা দেয়া হয়েছিল উদ্বিগ্ন জনসাধারণের নামে।

ও, তা-ই বুঝি।

হ্যাঁ, মিঃ রিনালো। আমরাও জনগণ। ট্যাক্স দিয়ে বাস করছি।

মিঃ ভিকানডিয়া।

বলুন।

আমার কেন জানি ধারণা হচ্ছে, এই একটা লোকের জন্যে আপনারা কিছুটা বিচলিত হয়েছেন।

মোটেই না। পত্রিকাওয়ালারা জিনিসটাকে একটা সেন্টিমেন্টালে রূপ দিতে চাচ্ছে, সেখানেই আমার আপত্তি।

লোকটা কিন্তু সহজ পাত্রও নয়, মিঃ ভিকানডিয়া।

আড়াল থেকে গুলি করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি দেখি না।

বাহাদুরি দেখানোর তার কোনো ইচ্ছাও বোধহয় নেই। ভালো কথা, আপনি এখনও হয়তো খবর পাননি, নিওরোর মৃতদেহ পাওয়া গেছে।

কী বলছেন?

নিওরো, যে অ্যানির কিডন্যাপিং-এ জড়িত ছিল, তার ডেডবড়ি পাওয়া গেছে। বুলেটের সাইজ থেকে মনে হয় সেটা বেরেটা থার্টি টু জাতীয় অস্ত্র থেকে এসেছে।

কখন পাওয়া গেছে ডেডবডি?

অল্প কিছু আগে। ঘণ্টাখানেক হবে।

বস ভিকানডিয়া দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বলল, আপনাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে।

 পুলিশের লোক সহজে খুশি হয় না, অখুশিও হয় না।

জামশেদকে ধরবার কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?

 এসব পুলিশের ব্যাপার। ও নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ না করাই ভালো।

আমার মনে হচ্ছে পুলিশ ওকে ধরবার কোনোরকম চেষ্টাই করছে না। করছে কি?

রিনালো শব্দ করে হাসল। জবাব দিল না।

হ্যালো রিনালো!

রিনালো টেলিফোন নামিয়ে রাখল।

প্রতিটি প্রভাতী সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় নিওরোর মৃত্যুসংবাদ চাপা হল। ছবি ছাপা হল অ্যানির। অ্যানির হত্যাকাণ্ড ও মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কীভাবে সাজা পাচ্ছে সে-বিবরণ লেখা হল। শুধুমাত্র জামশেদের কোনো ছবি নেই। তার চেহারার কোনো বিবরণও নেই। একটি পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়েল লেখা হল জামশেদকে নিয়ে। সম্পাদক লিখলেন–আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কখনো সমর্থন করি না। যারা আইন নিজের হাতে নেয় তারা আমাদের কাছে অপরাধী। কিন্তু যখন দেখি বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে, আইন অপরাধীদের স্পর্শ করে না তখন ব্যথিত হই। সে সময় কোনো সাহসী মানুষ যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তখন তাকে সমর্থন না করলেও একধরনের শ্রদ্ধা ও মমতা বোধ করি তার জন্যে। সেও অপরাধী। কিন্তু অপরাধী হলেও তাকে ঘৃণা করতে আমাদের বিবেক সায় দেয় না। আমরা আশা করছি আমাদের জীর্ণ পুলিশবাহিনী জামশেদের ঘটনা থেকে একটা বড় শিক্ষা গ্রহণ করবে। তাদের ভবিষ্যৎ কর্মধারী এরকম হবে যেন আমাদের অপরাধীদের ওপর আস্থা স্থাপন করতে না হয়।

লা বেলে পত্রিকায় আরেকটি মজার খবর ছাপা হল। দুটি নাগরিক কমিটি বৈঠকে বসে ঠিক করেছে জামশেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা সবরকম সাহায্য দেবে। বৈঠকের শেষে তার জামশেদের জন্যে বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করেছে।

শহরে এখন অনেক গাড়ি দেখা যেতে লাগল যেগুলোর গায়ে নতুন ধরনের সব স্টিকার, জামশেদ, আমরা আছি তোমার সাথে। তুমি চালিয়ে যাও, জামশেদ। এই গাড়িটিতে জামশেদের জন্যে একটি আসন আছে।

.

সকাল থেকেই মেঘ করেছিল।

দুপুরের দিকে ঝুপঝপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। এতরা একবার ভাবল আজ আর মা’র কাছে যাবে না। টেলিফোনে খোঁজ নেবে। এই ভাবনা অবিশ্যি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আজ মঙ্গলবার মা’র কাছে না গেলেই নয়। এতরা বিরক্তমুখে গাড়ি বের করতে বলল। দিনকাল এমন হয়েছে হুটহাট করে কোথাও যাওয়া যায় না। তিন চারজন দেহরক্ষী সঙ্গে রাখতে হয়। গাড়িতে বসতে হয় মাথা নিচু করে। সবসময় একটা আতঙ্ক। এরকম অবস্থায় মানুষ থাকতে পারে? সবচেয়ে ভালো হয় মাসখানেকের জন্যে অন্য কোথাও চলে গেলে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই সব ঝামেলা মিটে যাবে। একটিমাত্র মানুষ কী করে একরম একটা ঝামেলা সৃষ্টি করে কে জানে! খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। অবিশ্যি ক্যানটারেলা বলেছে তিন দিনের মাথায় লোকটিকে খুঁজে বের করা হবে। এবং জীবিত অবস্থায় চামড়া তুলে নিয়ে সমুদ্রের নোনা জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখা হবে। ক্যানারের কথায় বিশ্বাস করা যায়, এতরা ফালতু কথা কম বলে

এতরা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই নিচে থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল, স্যার, আমরা তিনজনই কি সঙ্গে যাব?

হ্যাঁ

তা হলে কুকুর সামলাবার জন্যে কেউ থাকবে না। কুকুর দুটো কি চেইন দিয়ে আটকে রাখব।

রাখো। সবকিছুই আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে কাজ করবে।

এতরা ভ্রূ কুঞ্চিত করল। যে-তিনজন দেহরক্ষী রাখা হয়েছে তাদের বুদ্ধিবৃত্তি নিম্নস্তরের বলেই এতরার ধারণা। সারাক্ষণ কথাবার্তা বলছে। ফুর্তিবাজের ভঙ্গি। কোথায়ও যখন বের হয় এমন ভাব করে যেন পিকনিকে যাচ্ছে। ইডিয়েটস। এতরা ভারী গলায় বলল, কুকুর বাধা হয়েছে?

জি স্যার।

ভালো করে বাঁধ। আর শোনো, দিনের বেলা এ যেন বাঁধা থাকে। এদের ছাড়বে সন্ধ্যা সাতটার পর। বুঝতে পারছ?

খুব পারছি, স্যার।

এতরা বিষণ্ণ ভঙ্গিতে নিচে নেমে এল। কুকুর দুটো তাকে দেখামাত্র গোঁগোঁ শব্দে একটা রাগী আওয়াজ করল। এতরার ভ্রূ দ্বিতীয়বার কুঞ্চিত হল। এই কুকুর দুটোকে সে পছন্দ করে না। এদের শীতল চোখের দিকে তাকালেই এতরার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। এরকম একটা ভয়াবহ জীবকে মানুষের বন্ধু নাম দেয়ার কী মানে? এতরা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। সময়টা তার খারাপ যাচ্ছে। যেসব জিনিস সে পছন্দ করে না তার চারপাশেই এখন সেসব জিনিস। অটোম্যাটিক অস্ত্র হাতে কয়েকন নির্বোধ অথচ ভয়াবহ মানুষ। দুটো হিংস্র কুকুর যারা মনিবকে দেখে গোঁগোঁ শব্দে গর্জন করে। কোনো মানে হয়?

এতরার মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখ হাসিহাসি, এর মানে ঘরে কেউ লুকিয়ে নেই। তবু একটা ক্ষীণ সন্দেহ থেকে যায়। হয়তো সাবমেশিনগান হাতে জামশেদ নামের কুকুরটা ঘাপটি মেরে বসে আছে রান্নাঘরে। বিচিত্র কিছুই নয়। ওই কুকুরটার পক্ষে সবই সম্ভব। এতরা ক্ষীণস্বরে বলল, তোমরা দুজন গিয়ে ভালো করে খুঁজে দেখবে, কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কি না। তারপর গাড়িতে বসে না থেকে বাড়ির চারপাশে ঘুরবে। চোখকান খোলা রাখবে।

বৃষ্টি পড়ছে সিনোর।

পড়ুক।

দুজন গম্ভীরমুখে নেমে গেল। কী বিরক্তিকর অবস্থা! স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায় না। সারাক্ষণ একটা দম-বন্ধ-করা আতঙ্ক। এরকম কিছুদিন চললে পাগল হয়ে যেতে হবে।

এতরার মা ব্যাপারস্যাপার দেখে খুবই অবাক। হচ্ছে কী এসব?

কিছুই হয়নি। একটু সাবধানে চলাফেরা করছি। এতে অবাক হবার কী আছে?

হঠাৎ করে এত সাবধানতারই-বা কী আছে?

এতরা জবাব দিল না। মুখ কালো করে বসে রইল।

আমার মনে হয় তোমার ওজনও কমেছে। দশ পাউন্ড ওজন কমেছে।

ওজন ঠিকই আছে।

মোটেই ঠিক নেই। আমি ওজনের যন্ত্র আনছি, মেপে দ্যাখো।

থাক, মাপতে হবে না।

অবশ্যই হবে। কথার ওপর কথা বলবে না। যা বলছি করো।

বুড়ি ওজনের যন্ত্র নিয়ে এল। দেখা গেল সত্যি আট পাউন্ড ওজন কম।

সাত দিনে আট পাউন্ড ওজন কমেছে, এর মানে কী?

কমেছে, আবার বাড়বে। এই নিয়ে এত হৈচৈ কেন?

 ইদানীং তোমার কোনো শত্রু তৈরি হয়েছে কি?

 নাহ্।

ঠিক করে বল।

দুএকজন হয়তো আছে, সে তো সবারই খাকে। দুষ্ট লোকের অভাব আছে নাকি পৃথিবীতে!

তা ঠিক।

বুড়ি কফি তৈরি করতে লাগল। ক্রিম মেশাতে মেশাতে আড়চোখে দুএকবার তাকাল ছেলের দিকে। এতরার চোখে কেমন যেন দিশাহারা ভাব। বুড়ি কফির কাপ নামিয়ে রেখে বলল, পৃথিবীতে ভালো লোকও আছে।

আছে নাকি?

হ্যাঁ। ঐ বিদেশী লোকটার কথাই ধরো।

কার কথা বলছ!

ঐ যে জামশেদ না কী যেন নাম।

এতরা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, ও ভালো লোক সে-ধারণা তোমার হল কোত্থেকে

সবাই তো বলছে।

সবাই মানে পত্রিকাওয়ালার বলছে। ওরা দিনকে রাত করতে পারে। একটা খুনি বদমাশকে স্বর্গীয় দূত বানিয়ে দেয়।

একটা বিদেশী লোক একা একা যুদ্ধ করছে এটা তোমার চোখে পড়ে না!

এতরা কফির কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল।

কী, কথা বলছ না যে?

মানুষ মারাটা কোনো স্বর্গীয় দূতের কাজ না।

যাদের মারছে তারা কি মানুষ? তারা তো পশুরও অধম।

এতরা গম্ভীর হয়ে গেল। বাইরে বৃষ্টির বেপ বাড়ছে। বৃষ্টি দেখে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বুড়ি বলল, আরেক কাপ কফি দেব?

না

চিলি দিয়ে বিন বেঁধেছি, দুপুরে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে।

উঁহু, আমার কাজ আছে।

এইরকম আবহাওয়ায় আবার কিসের কাজ? দুর্যোগের দিনে কাজ থাকে শুধু দুষ্ট লোকের।

স্বর্গীয় দূতদের কোনো কাজ থাকে না?

 তুমি মনে হয় কোনো কারণে লোকটার ওপর রেগে আছ?

না, রাগব কেন?

লোকটা স্বর্গীয় দূত হয়তো না, কিন্তু বিরল একজন মানুষ। চার্চে ওর জন্যে প্রার্থনা করা হয়েছে।

প্রার্থনা করা হয়েছে?

হ্যাঁ।

এতরা সরু চোখে তাকিয়ে রইল।

কী প্রার্থনা করা হয়েছে?

প্রার্থনা করা হয়েছে যাতে তার কোনো বিপদ-আপদ না হয়।

একজন ভয়ংকর খুনির নিরাপত্তার জন্যে আজকাল তা হলে গির্জায় প্রার্থনাও হয়? পবিত্র খ্রিস্টান ধর্মের প্রচুর উন্নতি হয়েছে দেখি!

বুড়ি কিছু বলল না। রান্নাঘরে চলে গেল। লাঞ্চ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনটে বেজে গেল। মেঘ কেটে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। আরামদায়ক শীতলতা চারদিকে। এরকম দিনে ঘুমুতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ঘুমানো যাবে না। অনেক কাজ আছে। দেশের বাইরে চলে যাবার একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। এরকম আতঙ্কের সঙ্গে সহবাস করা যায় না। এর চেয়ে পাসপোর্ট নিয়ে এক্ষুনি কোনো ট্রাভেল এজেন্সিতে যাওয়া দরকার। যদি সম্ভব হয় তা হলে আজ বিকেলেই ইংল্যান্ড চলে যাওয়া যায়। এখানে আর কিছুদিন থাকলে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যেতে হবে।

এতরা ঘরে ঢোকামাত্র তার সেক্রেটারি বলল, স্যার, আপনাকে এক্ষুনি মিঃ ভিকির বাড়িতে যেতে হবে। খুব জরুরি।

ব্যাপার কী?

 তা স্যার জানা যায়নি। মিসেস রুন দুবার টেলিফোন করেছেন। শুধু বলেছেন খুব জরুরি।

এতরার প্রথমেই মনে হল এটা একটা ট্র্যাপ। কেউ রুনের মুখের ওপর পিস্তল ধরে টেলিফোন করিয়েছে। সস্তা ধরনের ট্র্যাপ বলাই বাহুল্য। অবিশি একটা কিন্তু থেকে যায়। দিনদুপুরে এরকম ফাঁদ পাতে না কেউ। ফাঁদ পাতা হয় অন্ধকারে।

কীরকম জরুরি তার কোনো আভাসও দেয়নি কেউ?

না স্যার।

ঠিক আছে, গাড়ি বের করতে বলো।

আরেকটি কথা স্যার।

বলো।

 লয়েড ইনস্যুরেন্স থেকে দুজন লোক এসেছিলেন।

কী ব্যাপারে?

পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। তবে আমার অনুমান মিঃ ভিকির মেয়ে অ্যানির নিরাপত্তা ইনস্যুরেন্স প্রসঙ্গে কিছু বলতে চান। তারা আজ সন্ধ্যার পর আসবেন বলে গেছেন।

আমি সন্ধ্যার পর কারো সঙ্গে দেখা করি না। ওরা এলে ফিরে যেতে বলবে।

ঠিক আছে স্যার।

.

বেল টিপতেই রুন নিজে এসে দরজা খুলল। মনে হল সে এতক্ষণ এতরার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। রুনের সাজসজ্জা সাধারণ তবু এতেই তাকে অপরূপ লাগছে। পারিবারিক চূড়ান্ত বিপর্যয়ের ছাপ কোথায়ও নেই। একটু রোগা হয়েছে তাতে তার বয়স যেন আরো কম লাগছে। এতরা হালকা গলায় বলল, কেমন আছ রুন?

ভালো।

একটু মনে হয় ওয়েট লুজ করেছ।

তা করেছি।

ভিকি কেমন আছে?

ও ভালো নেই। ওর জন্যেই তোমাকে ডেকেছি।

কী হয়েছে ভিকির?

চলো, নিজেই দেখবে।

ভিকি বারান্দায় একটি রকিংচেয়ারে দোল খাচ্ছিল। তার হাতে নেভানো একটা চুরুট। এতরা বলল, হ্যালো ভিকি। ভিকি তাকাল একবার তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এতরা বলল, শরীর ঠিক আছে তো, ভিকি? ভিকি কোনো উত্তর দিল না। তার দৃষ্টি অস্বাভাবিক স্থির। যেন এ-জগতের কোনোকিছুর সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই।

রুন বলল, অবস্থাটা বুঝতে পারছ?

পারছি। কবে থেকে এরকম হয়েছে?

গতরাত থেকে। হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে পড়েছে। কারো সঙ্গে কোনো কথাবার্তা নেই। কাল সারারাত ঘুমায়নি। যতবার আমার ঘুম ভেঙেছে আমি দেখেছি সে বারান্দায় রকিংচেয়ারে বসে আছে।

ডাক্তার দেখিয়েছ?

না।

দেরি না করে ডাক্তার ঢাকা উচিত।

আমি বড় ভয় পাচ্ছি এতরা

ভয়ের কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাবে।

রুন ক্লান্তস্বরে বলল, একটার পর একটা আঘাতে ওর এরকম হয়েছে। ওর ব্যবসাটা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে, জান বোধহয়?

না, জানি না।

সব জলে গেছে। লিও স্ট্রিটের বাড়িটাও বিক্রি করতে হয়েছে। বাড়ি মর্টগেজড ছিল, টাকাপয়সাও তেমন পাওয়া যায়নি।

এতরা চুপ করে রইল।

 রুন বলল, এসো ভেতরে গিয়ে বসি। কফি খাবে?

খেতে পারি।

তোমার নিজের স্বাস্থ্যও খুব খারাপ হয়েছে।

এতরা ক্ষীণস্বরে বলল, নানান ঝামেলা যাচ্ছে।

তোমার আবার ঝামেলা কিসের?

এতরা চুপ করে গেল।

রুন কফির কাপ নামিয়ে রেখে স্বাভাবিক স্বরে বলল, আমার ধারণা ছিল ভিকির প্রতি আমার প্রেমট্রেম কিছুই নেই। ধারণাটা সত্যি নয়। ওকে আমি ভালোবাসি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। অ্যানির মৃত্যুর পর ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তে দুটো লোককে আমি ভালোবাসি। একজন হচ্ছে ভিকি, অন্যজন হচ্ছে অ্যানির বিদেশী দেহরক্ষী।

এতরা কিছু বলল না।

রুন থেমে থেমে বলল, ঐ বিদেশী মানুষটার প্রতি আমি খুব অবিচার করেছি। শেষের দিকে ওকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেছি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি ওকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিতে।

তা-ই নাকি?

হ্যাঁ।

এতরা একটা সিগারেট ধরিয়ে সরু গলায় বলল, ঐ বিদেশীর সঙ্গে কি এখন তোমার কোনো যোগাযোগ আছে?

না

কখনো টেলিফোন করেও কিছু বলেনি তোমাকে?

না। ওরা ভিন্ন ধরনের মানুষ এতরা। নিজের বিশ্বাসের জন্যে কাজ করে। কারো ধার ধারে না।

এতরা উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, আমাকে জরুরি কাজে ইংল্যান্ডে যেতে হচ্ছে রুন। হপ্তাখানেকের মধ্যে আসব।

রুন কোনো জবাব দিল না। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল ঠিকই। কিন্তু আগের মতো যাবার আগে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার কোনো আগ্রহ দেখাল না।

রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটে থাই এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে করে এতরা ইতালি ছেড়ে গেল।

রাত বারোটার লেট নাইট বুলেটিনে জানানো হল, জামশেদ নামের বিদেশী দেহরক্ষীটিকে পুলিশ পোর্ট সিটির এক বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছে। বাড়িটা শহর থেকে প্রায় দেড়শো মাইল দূরে। ফ্রান্স সীমান্তে। ইতালি থেকে সে পালাতে চেয়েছিল কি না কে জানে!

১৭.

বস ভিকনিডিয়াকে রাত আটটার পর জাগাবার নিয়ম নেই। বছর তিনেক আগে যখন দুটো বড় পরিবারের ভেতর হঠাৎ করে যুদ্ধ বেধে গেল তখনই শুধু তাকে একবার রাত তিনটেয় ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়েছিল। ভিকানডিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, সব মিলিয়ে এ-পক্ষের কজন মারা গেছে? উত্তর শুনে ঘুমুতে গিয়েছিল। ভঙ্গিটা এমন যেন কিছুই হয়নি।

জামশেদের গ্রেফতার হবার খবর সে তুলনায় তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়। কিন্তু তবু কী মনে করে যেন তাকে জাগানো হল। ভিকানডিয়া খবর শুনে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে পড়ল। এটিও তার স্বভাববিরুদ্ধ। ভিকানডিয়া কখনো গম্ভীর হয় না। তার বড় ছেলে এবং ছোট মেয়ের জামাই ক্যানটারেলা পরিবারের সাথে এক সংঘর্ষে নিহত হয়। সে-খবর পেয়েও ভিকানডিয়ার কোনো বাহ্যিক পরিবর্তন হয়নি। সহজ স্বরে বলেছিল–যে-মৃত্যু হঠাৎ করে আসে সে-মৃত্যুসংবাদ হচ্ছে সুসংবাদ। দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করে মরে অভাগারা।

হয়তো ভিকামডিয়ার বয়স হয়ে যাচ্ছে। বয়স হলেই মন দুর্বল হয়। তখন জামশেদের মতো প্রায় তুচ্ছ একজন মানুষের গ্রেফতারের সংবাদে মুখ অন্ধকার হয়।

ভিকানডিয়া গরম এক কাপ কড়া কফি দিতে বলল। ক্যানটারেলাকে খবর দিতে বলল। বিশেষ জরুরি, যেন এখনিই চলে আসে।

ক্যানটারেলালকে পাওয়া গেল না। যে-কয়েকটি জুয়ার আড়ায় তার যাতায়াত সেগুলোর কোনোটাতেই সে নেই। পতিতাপল্লীতে তাকে পাওয়ার কথা নয়। মেয়েদের ব্যাপারে তার উৎসাহ নেই। দুষ্ট লোকের ধারণা ক্যানটারেলা পুরুষত্বহীন। এরকম হাতির মতো জোয়ান একটি লোককে নিয়ে এজাতীয় অপবাদ কী করে রটে কে জানে!

ভিকামডিয়া রাত দুটোয় আবার খোঁজ করল ক্যানিটারেলাকে পাওয়া গেছে কি না।

না, পাওয়া যায়নি। সবকটা নাইট ক্লাবে দেখা হয়েছে। শহরের ভেতরের ব্রথেলগুলোতেও দেখা হচ্ছে। ভিকামডিয়া গম্ভীরমুখে বলল, ফাজিনকে আসতে বলল।

ফাজিন ভিকামডিয়ার ভাইয়ের ছেলে। ভিকানডিয়ার মৃত্যুর পর এ-পরিবারের অনেক দায়ি ফাজিনের ওপর বর্তাবে। সেই হিসেবে ফজিনের গুরুত্ব অনেকখানি। ভিকানডিয়া এমন সব জিনিস নিয়ে ফাজিনের সঙ্গে কথা বলে যা কোনো মাফিয়া বসু কখনো করে না। তা ছাড়া ফাজিন ভিকানডিয়ার বাড়ির একতলাতে থাকে। এটিও একটি অদ্ভুত ব্যাপার। কোনো বস পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকে না।

ফাজিন ঘুমুচ্ছিল। সে হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলাল। এত রাতে যখন তাকে ডেকে তোলা হয়েছে তখন নিশ্চয়ই জরুরি কিছু হয়েছে। হয়তো এক্ষুনি বেরুতে হবে। তৈরি হয়ে যাওয়াটাই ভালো।

চাচা আমাকে ডেকেছেন?

হু, বসো। জামশেদ গ্রেফতার হয়েছে, শুনেছ?

জি।

এই প্রসঙ্গে তোমার মতামত কি?

ফাজিন বুঝতে পারল না ঠিক কী জানতে চাচ্ছে ভিকানডিয়া। জামশেদ গ্রেফতার হয়েছে, এর আবার মতামত কী!

মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে তোমার কোনো মতামত নেই?

 আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী জানতে চাচ্ছেন।

বুঝতে না পারার তো কিছুই নেই। আমি সহজ ইতালিয়ান ভাষাতেই প্রশ্ন করছি। নাকি মাতৃভাষা ভুলে গেছ?

ফাজিন চুপ করে রইল।

ভিকানডিয়া গম্ভীর গলায় বলল, সমস্ত ব্যাপারটাই যে বানানো, তুমি বুঝতে পারছ না?

বানানো?

তোমাকে যতটা বুদ্ধিমান আমি ভাবতাম তুমি ততটা বুদ্ধিমান নও।

ফাজিন চোখ নামিয়ে নিল।

 ভিকমিডিয়া একটা চুরুট ধরিয়ে শান্তুম্বরে বলল, সমস্ত ব্যাপারটাই পুলিশের একটা চাল। একটা বড়রকমের ধাপ্পাবাজি।

তা-ই কি?

হ্যাঁ, তা-ই। যে-লোকটিকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না, ইতালিয়ান পুলিশ ফট করে তাকে গ্রেফতার করে ফেলল? আমাদের পুলিশ এত কর্মদক্ষ কোনোকালেই ছিল না।

এরকম একটা চাল দেবার পিছনে যুক্তিটি কী?

খুব সহজ যুক্তি। আমাদের বিভ্রান্ত করা। পুলিশের ভেতর কিছু-কিছু অর্বাচীন ছোকরা ঢুকে গেছে যারা আমাদের কেচোর মতো ঘেন্না করে। জামশেদকে গ্রেফতারের খবর এইসব ছোকরারা ছড়িয়েছে, যাতে আমরা অসতর্ক হই এবং আরো কয়েকজন মারা পড়ি। বুঝতে পারছ?

পারছি।

ওরা দেখাতে চায় যে মাফিয়ারা সর্বেসর্বা নয়। আমার মনে হয় ঐসব অর্বাচীন ছোকরাদের একটা শিক্ষা দেয়া দরকার।

কীরকম শিক্ষা দিতে চান?

ওদের মধ্যে রিনালো নামে এক ছোকরা আছে যে নিজেকে বিশেষ বুদ্ধিমান বলে মনে করে। তাকে নিশ্চয়ই চেন?

হ্যাঁ, চিনি।

ওর দুটো মেয়ে আছে–যমজ। ঐ দুটো মেয়ের একটাকে কাল দুপুরের আগেই মেরে ফেলবে এবং রিনালোকে টেলিফোন করে মিষ্টি গলায় বলবে ভবিষ্যতে যেন সে আরো সাবধানে কাজকর্ম করে তাকে বলবে, সবাইকে সন্তুষ্ট রাখার ক্ষমতা একটা ভালো ক্ষমতা।

ফাজিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আপনি যা বলছেন তা করা হবে, কিন্তু তা করার আগে আমাদের বোধহয় নিশ্চিত হওয়া উচিত যে জামশেদের গ্রেফতারের ব্যাপারটা একটি ধাপ্পা। হয়তো সে সত্যি সত্যি গ্রেফতার হয়েছে।

সে গ্রেফতার হয়নি। আর না হলেও কিছু যায় আসে না। ঐ ছোকরাকে একটু ভড়কে দেয়া দরকার।

ঠিক আছে। আমি কি এখন উঠব।

হ্যাঁ। রাতদুপুরে অকারণে আমার সামনে বসে থাকার কোনো কারণ দেখি না।

১৮.

জামশেদকে রাখা হয়েছে কড়া পাহারায়। কিন্তু তাকে মোটেই ভয়াবহ মনে হচ্ছে না। বরং ফুর্তিবাজ ধরনের লোক বলেই মনে হচ্ছে। ক্রমাগত কফি খাচ্ছে, চুরুট টানছে। জিপসি মেয়েদের নিয়ে চমকার অশ্লীল রসিকতা করে সবাইকে হাসিয়েছে। কে বলবে এই সেই ভয়াবহ লোক। যে-অফিসার তাকে গ্রেফতার করেছে সে ক্রমেই চিন্তিত হতে শুরু করল। কোথাও ভুল হয়নি তো?

ভুল হবার কথা অবিশ্যি নয়। সে গভীর রাতে একটি টেলিফোন পেয়ে দলবল নিয়ে ছুটে গেছে। ফোনকলটা ছিল সংক্ষিপ্ত—-জামশেদ অমুক ঠিকানায় রাত কাটাবে। আপনারা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এলে তাকে ধরতে পারবেন। সে তখুনি নয়জনের একটি স্কোয়াড নিয়ে গিয়েছে। আর সত্যি আউটহাউসে একজনকে পাওয়া গেছে। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল।

তাকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করা হল : কী নাম?

লোকটি বলল, জামশেদ।

দেশ?

বাংলাদেশ।

তুমিই কি সেই বিখ্যতি জামশেদ?

বিখ্যাত কি না জানি না তবে আমিই সেই লোক।

তোমার সঙ্গে অস্ত্রটস্ত্র কী আছে?

আপাতত একটা বারো ইঞ্চি ড্যাগার ছাড়া কিছুই নেই।

তোমাকে গ্রেফতার করা হল।

ভালো কথা। এতে কি তোমার প্রমোশনের কোনো সুবিধা হবে?

গ্রেফতারের ঘটনাটা এক ঘণ্টার ভেতর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। পুলিশ কমিশনার বিশেষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেবার জন্যে আদেশ দিলেন। পুলিশি তদন্ত সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পত্রিকা, রেডিও বা টিভি ইন্টারভিউ যেন না দেয়া হয় সেরকম নির্দেশ দেয়া হল। তদন্তকারী অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হল হমিসাইঙ ইন্সপেক্টর রিনালো ও কিনসিকে। এদের পাঠানো হল পোর্ট সিটিতে।

রিনালো এসে পৌঁছাল ভোর ছটায়। তার সঙ্গে জামশেদের কথাবার্তা হল এরকম—

রিনালো : তুমি জামশেদ?

জামশেদঃ হ্যাঁ।

রিনালো : জামশেদ যখন হাসপাতালে ছিল তখন প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। তোমাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

জামশেদঃ (নিশ্চুপ)

রিনালোঃ এই কাণ্ডটি কেন করেছ?

জামশেদঃ (নিশ্চুপপ)

রিনালোঃ তোমার নিজের বুদ্ধিতেই করেছ, না অন্য কারোর বুদ্ধিতে?

জামশেদ: নিজের বুদ্ধিতে। আসল জামশেদকে সাহায্য করবার জন্যে করেছি।

রিনালো : তোমার ধারণা এতে তার সাহায্য হবে?

জামশেদ :, আমার তা-ই ধারণা।

রিনালো : তুমি একটি মহাবেকুব। তুমি যে কী পরিমাণ জটিলতার সৃষ্টি করেছ সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই।

রিনালো মহা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই এল টেলিফোন। মিহি সুরে একজন বলল, ভিকানডিয়া আপনাকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছেন। এবং আশা করছেন আপনি ভবিষ্যতে এমন কিছু করবেন না যাতে এজাতীয় দুঃখ আপনাকে আরো পেতে হয়।

রিনালো কিছুই বুঝতে পারল না। তার যমজ মেয়েদের একটি মারা গেছে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে, এই খবর তখনও তার কাছে এসে পৌঁছায়নি।

১৯.

ক্যানটারেলা কয়েক মুহূর্ত নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। এটা কি স্বপ্ন না চোখে ভুল দেখছে? সন্ধ্যা থেকে এ পর্যন্ত তিন-চার পেগ হুইসকি খেয়েছে শুধু। এতে তার কোনো নেশা হয় না। কিন্তু নেশা ছাড়া এরকম একটি দৃশ্য দেখা সম্ভব নয়। ক্যানটারেলা দেখল তার সোফায় একজন কে বসে আছে। ঘর অন্ধকার। তবু বোঝা যাচ্ছে লোকটার হাত খালি নয়। লোকটি বলল, আমাকে চিনতে পারছ?

হ্যাঁ। তুমি কেমন আছ?

ভালো। তুমি ভালো আছ, ক্যানটারেলা?

ভালোই আছি। এ-জায়গার ঠিকানা কোথায় পেলে, জামশেদ?

বলছি। তার আগে তুমি পকেট থেকে তোমার ছোট্ট মিসিমার পিস্তলটা আমার পায়ের কাছে ফেলে দাও। অন্য কিছুই করতে চেষ্টা করবে না।

ক্যানটারেলা পিস্তুলটা বের করে ছুড়ে দিল। মৃদুস্বরে বলল, তুমি ওস্তাদ লোক, জামশেদ। সাহসী ও বুদ্ধিমান। দুটো জিনিস একসঙ্গে হয় না। সাহসী লোকরা হয় বোকা। আমি বুদ্ধিমান, সে কারণেই আমার সাহস কম। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তা হলে আমি এক পেগ হুইসকি খেতে চাই। আমার চিন্তা করার শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্যানটারেলা অনুমতির অপেক্ষা না করেই দক্ষিণের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। ছোট্ট একটি ঘরোয়া ধরনের বার আছে সেখানে।

জামশেদ, তুমিও কি একটু চেখে দেখবে?

মদ খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি।

এরকম একটা পরিস্থিতিতে খাওয়া উচিতও নয়। ভালো কথা, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে? কথাবার্তা খোলাখুলি হওয়া প্রয়োজন।

জামশেদ ভারী গলায় বলল, না, তোমাকে আমি মারব না।

আমিও তা-ই ভাবছিলাম। তুমি অনেক খোঁজখবর নিয়েছ, কাজেই আমি নিশ্চিত ছিলাম অ্যানি অপহরণ এবং মৃত্যুর ব্যাপারে আমার ভূমিকার কথা তুমি জান।

আমি জানি।

কতটুকু জান?

আমি জানি তুমি প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করেছ। অ্যানির মৃত্যুর খবর পেয়ে তুমি ছুটে গিয়েছিলে এতরাকে গুলি করে মারবার জন্যে। ভিকানডিয়া হস্তক্ষেপ না করলে এতরা সেই রাতেই মরত।

হ্যাঁ, তুমি অনেক খবরই রাখ। তবে আমি নিজে এতরাকে মারার জন্য যাইনি। লোক পাঠিয়েছিলাম। নিজের হাতে আমি মানুষ কখনো মারিনি। আমার সাহস কম।

জামশেদ বলল, আমি কয়েকটি জিনিস তোমার কাছ থেকে জানতে চাই।

আমার মনে হয় না আমি তোমাকে কিছু বলব।

বলবে। আমি জানি মানুষের কাছ থেকে কী করে কথা আদায় করতে হয়।

 তোমার কায়দাটা কী?

খুব সহজ কায়দা, ক্যানটারেলা। আমি চুলের কাটা দিয়ে তোমার বাঁ চোখটি উপড়ে ফেলব। আমার ধারণা তা করবার আগেই তুমি কথা বলা শুরু করবে।

তা ঠিক। সত্যি কথা বলতে কি আমি এখুনি কথা বলতে চাই। কী জানতে চাও?

মূল পরিকল্পনাটি কার?

বস ভিকামডিয়ার। তবে পরিকল্পনাটা কার্যকর করেছে ফাজিন। এরা দুজনেই ঘটনার মূল নায়ক। এতরা হচ্ছে খলনায়ক।

এখন বলো কীভাবে ভিকানডিয়াকে হত্যা করা সম্ভব, কীভাবে তার কাছে যাওয়া যায়?

বলছি। তার আগে তুমি কি দয়া করে বলবে এ-বাড়ির ঠিকানা কী করে পেলে? বস ভিকামডিয়া এবং তার লোকজন পর্যন্তু এ-বাড়ির ঠিকানা জানে না। আমি যখন পালিয়ে থাকতে চাই তখনই শুধু এ-বাড়িতে আসি।

জামশেদ ভারী গলায় বলল, আমাকে এ-শহরের অনেকেই এখন সাহায্য করতে চায়। অচেনা লোকজনের কাছ থেকেও এখন আমি খবরাখবর পাই।

তুমি খুবই ভাগ্যবান, জামশেদ। তবে আজ তোমার ভাগ্যটা খারাপ।

ক্যানটারেলার কথা শেষ হবার আগেই জামশেদ ছিটকে পড়ল মেঝেতে। কখন যে অন্ধকারে দুজন মানুষ সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে জামশেদ কিছুই বুঝতে পারেনি। ক্যানটারেলা বলল, ওকে ভালো করে বেঁধে ফ্যালো।

ঠিক আছে সার।

জ্ঞান আছে কি?

না, জ্ঞান নেই। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে।

নিচের ঘরে নিয়ে বদ্ধ করে রাখ। আর একজন ডাক্তার ডাকো।

ডাক্তার?

হ্যাঁ, ডাক্তার। কারণ আমি একজন ভদ্রলোক। আর একটি কথা, তোমরা আসতে এত দেরি করলে কেন? আমি তো ঘরে মানুষ দেখেই বেল টিপলাম।

দেরি করিনি স্যার। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই এসেছি, সুযোগের অপেক্ষা করছিলাম।

ভালো। খুব ভালো। তোমরা ভালো পুরস্কার পাবে। ক্যানটারেলা এগিয়ে গিয়ে খানিকটা নির্জলা হুইসকি ঢালল গলায়।

২০.

জামশেদের জ্ঞান ফিরল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। সে তাকাল চারদিকে। ছোট্ট একটি ঘর। সে শুয়ে আছে বিছানায়। তার গায়ে একটি পরিষ্কার চাদর। মাথার কাছে চল্লিশ পাওয়ারের একটি বাল্ব জ্বলছে। পায়ের কাছে ছোট্ট একটি টেবিলে এক জগ পানি। শক্ত লোহার দরজা। ভারী দুটো তালা ঝুলছে সেখানে। এ-ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। জামশেদ কয়েকবার ডাকল; কেউ আছে এখানে? কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। জামশেদ ঢকঢক করে পুরো জগ পানি খেয়ে ঘুমুতে গেল। বড় ঘুম পাচ্ছে।

ভিকনিডিয়ার সঙ্গে ক্যানটারেলার দেখা হয় পরদিন সকাল দশটার দিকে। ভিকানডিয়া গর্জে উঠল, কোথায় ছিলে কাল সারারাত সমস্ত শহর চষে ফেলা হয়েছে তোমার জন্যে।

ক্যানটারেলা চুপ করে রইল।

ভিকানডিয়া বলল, ঘটনা খুব দ্রুত ঘটছে, বুঝতে পারছ তো?

পারছি।

পুলিশ জানিয়েছে ওরা যে-লোকটাকে ধরেছে সে জামশেদ নয়।

 ভোরবেলার খবরের কাগজে তা-ই পড়লাম।

এখন আমাদের কাজ কী বুঝতে পারছ? যেভাবেই হোক জামশেদকে ধরা।

ক্যানটারেলা শান্তুম্বরে বলল, সে যদি এ-শহরে থাকে তা হলে ধরা পড়বেই।

তোমার ধারণা সে এ-শহরে নেই?

এই বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।

শহর থেকে বেরুবার সব কটা পয়েন্টে আমাদের লোক থাকবে। এবং আমাদের আরেকটি কাজ করতে হবে। জামশেদের ছবি বড় করে ছাপিয়ে সমস্ত শহরময় ছড়িয়ে দিতে হবে।

ছবি পাওয়া গেছে?

হ্যাঁ, ছবি জোগাড় হয়েছে। ছবির নিচে লেখা থাকবে, ওকে ধরিয়ে দিন।

তাতে কোনো লাভ হবে না। এ-শহরের লোকজন ওকে ধরিয়ে দেবে না।

ভিকানডিয়া সরু গলায় বলল, তোমার বুদ্ধিবৃত্তির ওপর থেকে আমার আস্থা কমে যাচ্ছে। আমরা শুধু ছবিই ছাপাব না। ছবির সঙ্গে এ-ও লিখে দেব, একে ধরিয়ে দিতে পারলে পঁচিশ হাজার ইউ এস ডলার পুরস্কার দেয়া হবে। পুরস্কারের টাকাটা আমরা একটা ব্যাংকে জমা করে দেব। তাও লেখা থাকবে।

ক্যানটারেলা চুপ করে রইল।

ভিকানডিয়া বলল, তোমার ধারণা এতে কাজ হবে?

 হতে পারে।

সন্দেহ থাকলে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে পঞ্চাশ হাজার ইউ এস ডলার করে দাও। টাকায় সবই হয়।

তা হয়।

আমি এই ঝামেলার দ্রুত নিষ্পত্তি দেখতে চাই।

আমরাও চাই, ভিকানডিয়া।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ