নিশাত খুব ভোরে জেগে উঠলো।

তখনো অন্ধকার কাটেনি। পূবের আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। ঘন কুয়াশা চারদিকে। নিশাত দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। মাথার যন্ত্রণা আর নেই। শরীর ঝরঝরে লাগছে। প্রচণ্ড ক্ষিধে। এত ভোরে নিশ্চয়ই আর কেউ জাগেনি।

নিশাত টুথব্রাশ হাতে বারান্দায় হাঁটতে লাগলো। এত সুন্দর বাড়ি। রাতে ঠিক বোঝা যায়নি। নিশাত হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের দিকে চলে এলো। প্রকাণ্ড পুকুরটি চোখে পড়লো তখন। কুয়াশার জন্যে পুকুরটি পুরোপুরি দেখা যায় না। মনে হয় বিশাল সমুদ্র। পানি দেখলেই ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। নিশাত এগিয়ে গেলো।

এই ভোরেও পাতলা একটা উইণ্ডব্রেকার পরে বাঁধানো ঘাটে সাব্বির বসে আছে। তার পাশেই স্ট্যাণ্ড-ক্যামেরা বসানো। নিশাত বললো—এত ভোরে ক্যামেরায় কার ছবি তুলছেন?

কুয়াশার ছবি। আপনার জ্বর সেরে গেছে?

হ্যাঁ।

নিশাত সিঁড়ি বেয়ে শেষ পর্যন্ত নেমে গেলো। হাত বাড়িয়ে পানিতে আঙ্গুল ডুবালো। তার ধারণা ছিল পানি বরফ-শীতল হবে। কিন্তু তেমন ঠাণ্ডা নয়।

আপনি যেমন বসে আছেন ঠিক তেমনিভাবে বসে থাকুন, আমি আপনার একটা ছবি তুলবো।

অনুমতি প্রার্থনা নয়। যেন আদেশ। নিশাত বললো—মুখ টুথব্রাশ ঝুলতে থাকবে?

হ্যাঁ। থাকুক। আপনি হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করছেন। এটাই আমার ছবির থীম।

সাব্বির ক্যামেরা হাতে কয়েক ধাপ নেমে এলো। নিশাতের কি রাগ করা উচিত না, বলা উচিত, এভাবে আমি ছবি তুলি না। কিন্তু নিশাত রাগ করতে পারছে না। কেন পারছে না সেও এক রহস্য। সাব্বির বললো—আজ ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই মনে হচ্ছিলো ছবির জন্যে একটা ভাল কম্পোজিশন পাবো।

আপনি ছবি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না?

ভাবতে পারি হয়তো কিন্তু ছবির কথা ভাবতেই ভালো লাগে।

নিশাত হাসতে হাসতে বললো—আপনার মাথার মধ্যে শুধু কম্পোজিশন ঘুরে তাই না? সাব্বির তার জবাব দিলো না। ক্রমাগত ছবি তুলতে লাগলো। পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে রইলো নিশাত। সে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো—সাব্বির অন্য ফটোগ্রাফারদের মতো নয়। অন্য ফটোগ্রাফাররা বলতো—একটা বাঁ দিকে ফিরুন, একটু হাসুন। মাথাটা একটু উপরে তুলুন। শাড়ির আঁচল টেনে দিন। সাব্বির কিছুই বলছে না। শুধু ছবি তুলছে। নিশাত হাসতে হাসতে বললো—এত ছবি তুলছেন একটা তো ভালো হবেই।

সব সময় হয় না। ছত্রিশটি ছবির মধ্যে যার একটি ছবি ভালো হয় সে একজন বড় ফটোগ্রাফার।

আপনি একজন বড় ফটোগ্রাফার।

হ্যাঁ।

নিশাত লক্ষ্য করলো সে হ্যাঁ বলছে খুব জোরের সঙ্গে। যেন সে মনেপ্রাণে কথাটা বিশ্বাস করে। সাব্বির বললো—যে ছবিটি দিয়ে আমি প্রথম নাম করি তার কথা শুনতে চান?

বলুন।

ছবিটির নাম সরলতা। ইনোসেন্স।

সাব্বির সহজভাবেই নিশাতের পাশে বসলো। যেন দীর্ঘদিনের পরিচিত কেউ পাশাপাশি বসছে।

আমি তখন থাকি নর্থ ডেকোটায়। একবার রুজভেল্ট ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে গিয়েছি। একা একা গভীর বনে ঢুকে পড়লাম। সেখানে দেখলাম ছোট্ট একটা জলা জায়গা। চারদিকে বড় বড় সব উইলি গাছ। উইলি গাছের ছায়া পড়েছে পানিতে। অপূর্ব পরিবেশ। এবং সেই অপূর্ব পরিবেশে অল্প বয়সী একটি মেয়ে লাঞ্চবক্স হাতে নিয়ে বসে আছে। ওর বন্ধুটি বোধ হয় কাছেই কোথাও গেছে। আমি মেয়েটিকে বললাম—তোমার কয়েকটি ছবি তুলতে চাই। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আমি বললাম—তুমি কি ঘুমিয়ে পড়ার মত একটা ভঙ্গি করতে পার? সে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। অসংখ্য ছবি তুললাম, কিন্তু মনে হলো কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। ছবিটিও অসম্পূর্ণ। ঠিক তখন একটা বুনো প্রজাপতি এসে বসলো লাঞ্চবক্সে, তৈরী হয়ে গেলো ছবি। বিখ্যাত ছবি।

বুনো প্রজাপতি আবার কী? সব প্রজাপতিই তো বুনো। পোষা প্রজাপতি আবার আছে নাকি?

ঐ প্রজাপতিটির পাখায় কোন রঙ ছিলো না। কালো কালো দাগ। কাজেই বুনো প্রজাপতি বলেছি। আপনি কি ঐ ছবিটি দেখতে চান?

আছে আপনার কাছে?

হ্যাঁ। বসুন আপনি, আমি নিয়ে আসছি।

সাব্বির সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো।

সাব্বিরকে নিশাত কি আগে ভালো করে লক্ষ্য করেনি নাকি? বেশ লাগছে একে। মনে হচ্ছে এর মধ্যে ভান নেই। শুধু কথাবার্তা নয় চোখের দৃষ্টিও বেশ স্বচ্ছ। মেয়েদের মত বড় বড় চোখ। না কথাটা ঠিক হলো না। সব মেয়েদের চোখ বড় বড় নয়। বরং বলা উচিত মেয়েলী চোখ। পুরুষ মানুষকে এত বড় বড় চোখে মানায় না। না এটাও ঠিক হলো না। সাব্বির সাহেবকে তো ভালই মানিয়েছে। নিশাত বেশ আগ্রহ নিয়ে ছবির বইটির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। যেন এই আগ্রহ থাকাটা ঠিক নয়। এটা অন্যায়।

 

এত চমৎকার একটা ফটোগ্রাফির বই নিয়ে সাবির ফিরবে নিশাত আশা করেনি। সে দু’বার বললো—এ বইয়ের সব ছবি আপনার তোলা?
হ্যাঁ। ব্যাক কভারে ফটোগ্রাফারের ছবি আছে। দেখুন না।

আপনি তো বিখ্যাত ব্যক্তি।

হ্যাঁ। মোটামুটি বিখ্যাত। ঐ দেশে অনেকেই আমাকে চেনে।

নিশাত পাতা উল্টাতে লাগলো। অপূর্ব সব ছবি। মন খারাপ করিয়ে দেবার মত ছবি।

তিপান্ন পৃষ্ঠায় ঐ ছবিটি আছে। দেখুন। ঐ ছবিটি দিয়ে আমি ফটোগ্রাফির জগতে প্রথম এণ্ট্রি পাই।

নিশাত তিপ্পান্ন পৃষ্ঠা খুলে অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলো না।

ছবিটা ভাল লেগেছে?

হ্যাঁ। কিন্তু মেয়েটার গায়ে কোন কাপড় ছিলো না এই কথা আপনি আগে বলেননি। ও কি এইভাবে বনে বসেছিলো?

হ্যাঁ।

এবং আপনি ছবি তুলতে চাইতেই রাজি হয়ে গেলো? কোন আপত্তি করলো না?

না কোন আপত্তি করেনি।

ঐ মেয়েটির কি নাম?

নাম জানি না। ছবির জন্যে মেয়েটির নামের কোন প্রয়োজন নেই।

আমার মেয়েটির নাম জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।

সাব্বির হেসে উঠলো। রোদ উঠে গেছে। কুয়াশা মিলিয়ে যাচ্ছে। কেমন চমৎকার লাগছে চারদিক। নিশাত নরম গলায় বললো—এই বইটি আমার কাছে থাকুক?

থাকুক।

নিশাত উঠে দাঁড়ালো। নিচুস্বরে বললো—যাই। সাব্বির বললো—আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।

বলুন।

দয়া করে রাগ করবেন না বা মন খারাপ করবেন না।

এমন কি কথা যে আমি রাগ করব?

সাব্বির অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বললো—আপনার আমার ভাল লেগেছে। শুধু ভাল লেগেছে বললে কম বলা হয়। আমার আরো কিছু বলা উচিত। কিন্তু আমি গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমার ভাল লাগার ব্যাপারটা আপনার মা’কে বলতে পারি।

নিশাত ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো, কিন্তু কিছু বললো না, ঘাটের ধাপ ভেঙে উপরে উঠে এলো।

আপা, তুমি এখানে আর আমি সারা বাড়ি খুঁজছি।

কেন?

দিলু হাত নেড়ে নেড়ে বললো—আমরা সবাই মিলে শিকারে যাচ্ছি।

কোথায় যাচ্ছিস?

শিকারে। বালিহাঁস মারবো আমরা। এসো তাড়াতাড়ি নাশতা খেয়ে নাও। রোদ বেশী কড়া হলে হাঁস পাব না।

বাবু কোথায় রে?

জানি না কোথায়। তোমার জ্বর নেই তো?

নাহ্‌।

তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেন আপা?

সুন্দর সেই জন্যে সুন্দর লাগছে।

নিশাত হাসলো। আজকের দিনটি চমৎকারভাবে শুরু হয়েছে।

কুয়াশা নেই। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। আকাশ, চৈত্রের আকাশের মত ঘন নীল। আহ্‌ চমৎকার একটি দিন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ