তাঁবুর বাইরে পায়ের আওয়াজ। কে আসবে এত ভোরে? ভিক্ষুকশ্রেণীর ছেলেপুলে আগে এরকম আসত। তাঁবুর পাশে ঘুরঘুর করত। ফেলে দেয়া বিয়ারের ক্যান, কোকের ক্যান নিয়ে যেত। এমন কি সিগারেটের খালি প্যাকেটের প্রতিও তাদের আগ্রহ। ইদানীং সিকিউরিটি টাইট হয়েছে। বিদেশীদের তাঁবুর পাশে কাউকে আসতে দেয়া হয় না। তাহলে এত ভোরে কে আসবে? রহমত উল্লাহ বাবুর্চি মগ ভরতি গরম কফি নিয়ে এসে ঘুম ভাঙায়। সেই সময়ও হয় নি। ঘড়িতে বাজছে সাতটা। বাবুর্চির আসার সময় ঠিক আটটায়। নি পোর্টার বলল, Who is there? কে?

পয়সা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি।

নি পোর্টার তৎক্ষণাৎ তাঁবুর বাইরে এসে চিন্তিত গলায় বলল, তুমি? Is anything wrong? কোনো বিপদ হয়েছে?

পয়সা বলল, না।

এসো, ভেতরে এসো।

পয়সা তাঁবুর ভেতর ঢুকল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খুবই অস্বস্তি লাগছিল। সবাই কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছিল। তাঁবুর ভেতর ঢুকে সেই অস্বস্তি পুরোপুরি কেটে গেল। সার্কাসের মেয়ে এমনিতেই তাঁবুর ভেতর স্বস্তি বোধ করে। তাদের জীবনই কাটে তাঁবুতে। তার উপর এই তাবুটা নি পোর্টারের। অন্য কারোর না।

মিস কয়েন, ভোরবেলা তোমাকে দেখে বিস্ময় পেয়েছি।

পয়সা বলল, আমি ভোরবেলা হাঁটতে বের হয়েছিলাম। তখন ভাবলাম আপনার তাঁবুর পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন দেখে যাই আপনি কী করছেন।

নি পোর্টার বলল, তোমার অন্য দুবোন কোথায়? ওরা তোমার সঙ্গে হাঁটতে বের হয় নি?

না।

মিস কয়েন, তুমি যে এই ভোরবেলা হাঁটতে বের হয়েছ এটা ঠিক না। তোমাদের দেশের মেয়েরা এত ভোরে একা একা হাঁটতে বের হয় না।

আমি আমাদের দেশের অন্য মেয়েদের মতো না। আমি আলাদা।

তুমি আলাদা কেন?

আমি সার্কাসের মেয়ে এই জন্যে আমি আলাদা।

নি পোর্টার বলল, আচ্ছা তাহলে আমার ত্রুটি হয়েছে। তুমি সকালে মর্নিংওয়াক করতে বের হয়েছিলে। হঠাৎ মনে হলো–বিদেশী সাহেবের সঙ্গে কফি খাব। তখন চলে এসেছ।

হ্যাঁ তাই।

কফি খাবার জন্যে আটটা বাজা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কফি আসবে আটটায়। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবে?

পয়সা জবাব দিল না। সে তার মাথায় প্যাচানো নীল রঙের স্কার্ফটা খুলে ফেলল। আঁকি দিয়ে মাথার চুল ঠিক করল। তার খুবই অদ্ভুত লাগছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে এই তাবুটাই তার ঘরবাড়ি।

মিস কয়েন, আমার মনে হয় তুমি আমাকে কিছু বলতে এসেছ। যা বলতে এসেছ বলে ফেল।

পয়সা বলল, আপনার চোখের যে নীল রঙ সেটা সব সময় এক রকম থাকে। কখনো বাড়ে কখনো কমে। এটা কি আপনি জানেন?

তুমি কি এই কথাটাই বলতে এসেছ?

হ্যাঁ।

চোখের নীল রঙ কি তোমার পছন্দ?

না।

তোমার কী রঙ পছন্দ?

কালো।

আচ্ছা বেশ, আমি চোখ কালো করে ফেলব।

পয়সা বিস্মিত হয়ে বলল, কীভাবে?

কালো রঙের কনট্যাক্ট লেন্স পরলেই চোখ কালো হয়ে যাবে। আবার ধর তুমি যদি নীল রঙের কোনো কনট্যাক্ট লেন্স পর তাহলে তোমার চোখ…

পয়সা আগ্রহের সঙ্গে বলল, দিন আমার চোখ নীল করে। দেখি নীল চোখে আমাকে কেমন লাগে।

আমার সঙ্গে কনট্যাক্ট লেন্স নেই। লেন্স লাগানোর জন্যে ঢাকায় যেতে হবে। আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করব।

কবে ব্যবস্থা করবেন?

যত দ্রুত পারি ব্যবস্থা করব। শোন মিস কয়েন, একটু আগে তুমি বলছিলে নীল রঙ তোমার পছন্দ না। এখন আবার বলছ তোমার নিজের চোখ নীল করতে চাও। ব্যাপারটা কী বলো তো?

পয়সা বলল, একটু আগে আমি মিথ্যা কথা বলছিলাম। নীল রঙ আমার পছন্দ।

নি পোর্টার বলল, মিথ্যা কথা দিয়ে দিন শুরু করলে সারা দিন মিথ্যা কথা বলতে হয়, এটা কি তুমি জানো?

না।

এটা হলো আমার দাদিমার কথা। আমার ধারণা কথাটা ঠিক। আমি অনেকবার লক্ষ করেছি যেদিনই আমি সকালে মিথ্যা কথা বলেছি, সেদিন ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্ত আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। এসো মিস কয়েন, একটা চুক্তি করি। তুমি আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে না। যা জিজ্ঞেস করি তার সত্যি জবাব দেবে।

আমি সব সময় সত্যি কথা বলি, শুধু আপনার সঙ্গেই মিথ্যা বলি।

কেন?

আমি জানি না কেন?

আমার ধারণা তুমি জানো।

না, আমি জানি না।

এই তো আবার মিথ্যা কথা বলছ।

পয়সা হেসে ফেলল। কোনো কারণ নেই অথচ তার কী যে আনন্দ লাগছে! একটা বড় সমস্যা হয়েছে তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সাহেবের সামনে কেঁদে ফেলা মোটেই ঠিক হবে না। ব্যাটা একগাদা প্রশ্ন করবে। সত্য কথা বলা হচ্ছে না-কি মিথ্যা বলা হচ্ছে এই নিয়ে ঝামেলা করবে। পয়সার যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে ব্যাটা যাতে কিছু বুঝতে না পারে সেইভাবে মাথার স্কার্ফটা হাতে নিতে হবে। সেই স্কার্ফ মাথায় জড়াবার সময় কৌশল করে এক ফাঁকে চোখ মুছে ফেলতে হবে। সেটা কি সম্ভব হবে।

পয়সা, তুমি কাঁদছ কেন?

কাঁদছি না।

অবশ্যই কাঁদছ। তোমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কেন কাঁদছ?

জানি না কেন কাঁদছি।

অবশ্যই তুমি জানো।

জানলে জানি। আপনার কী?

আমাকে বলবে না?

না, আমি বলব না।

আটটা বেজে গেছে। বাবুর্চি কফি নিয়ে এসেছে। সে এমনভাবে পয়সার দিকে তাকাচ্ছে যেন চোখের সামনে ভূত দেখছে। সার্কাসের একটা মেয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে বসে আছে। ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। এর মানে কী?

নি পোর্টার বলল, রহমত উল্লাহ, তুমি আরেক কাপ কফি নিয়ে এসো। মিস কয়েন আমার সঙ্গে নাশতা করবে সেই ব্যবস্থা কর। আজ আমার সাইটে যেতে দেরি হবে এই খবরটা দিয়ে এসো। আর শোন, তুমি এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছ কেন? কারো দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে খুব অস্বস্তি বোধ করে। এবং এটা অদ্রতা।

রহমত উল্লাহ পয়সার মুখ থেকে চোখ না নামিয়েই বলল, জি স্যার।

পয়সা নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে এখন সহজ এবং স্বাভাবিক। গুট গুট করে গল্প করছে। হাসছে। যেন এই তাবুই তার ঘরবাড়ি। গল্প শেষ করেই সে যেন তাবু গুছাতে শুরু করবে। ময়লা কাপড় ধোয়ার জন্যে আলাদা করবে।

পয়সা বলল, আচ্ছা আপনি কি লক্ষ করেছেন আমরা তিন বোন যখন দড়ির খেলা দেখাই তখন একটা সময় তিন বোন দড়ির মাঝামাঝি চলে আসি এবং কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আমাদের তিন বোনেরই চোখ বন্ধ থাকে।

আমি লক্ষ করি নি।

সার্কাস দেখতে আরেকদিন যখন আসবেন তখন লক্ষ করবেন।

অবশ্যই লক্ষ করব।

আমরা তিন বোন চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি কেন জানতে চান?

হ্যাঁ, জানতে চাই।

আমরা তিন বোন তখন আল্লাহর কাছে একটা প্রার্থনা করি। আমরা আল্লাহকে বলি–আল্লাহপাক, তুমি আমাদের বাবা-মাকে ফিরিয়ে এনে দাও। আবার যেন আমরা এক সঙ্গে হতে পারি।

তোমার বাবা-মা কোথায় গেছেন?

জানি না কোথায় গেছেন। প্রথমে মা চলে গিয়েছিলেন। মাকে ফিরিয়ে আনতে বাবা গিয়েছেন।

তোমরা রোজ দড়িতে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা কর যেন তারা ফিরে আসেন?

রোজ করি না। যেদিন সার্কাসের খেলা থাকে সেদিন করি। আমরা তিন বোন ঠিক করে রেখেছি যত দিন আমরা সার্কাসে খেলা দেখাব ততদিনই দড়ির উপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করব।

তোমাদের ধারণা প্রার্থনায় ফল হবে? হারানো বাবা-মা ফিরে আসবেন?

পয়সা গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলল, অবশ্যই তারা ফিরে আসবে। আমরা তিন বোন তো আল্লাহর কাছে আর কোনো কিছুই চাই না। একটা জিনিসই চাই।

পয়সা।

জি।

তোমার গল্পটা যে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী তা-কি তুমি জানো? আমি মোটামুটি কঠিন মানুষ কিন্তু আমার চোখে পানি এসে গেছে। আমি নিশ্চিত তুমি তোমার বাবা-মাকে ফেরত পাবে।

পয়সা চোখ মুছল। এখন তার চোখ ভর্তি পানি, তবে চোখের পানি নিয়ে এখন সে আর ব্ৰিত না। সে স্কার্ফ দিয়ে চোখ মুছল। নি পোর্টার বলল–তোমাদের মিলন দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছে। সেই দৃশ্য কতই না আনন্দময় হবে!

পয়সা বলল, আমি এখন যাই।

নি পোর্টার বলল, অবশ্যই তুমি এখন যাবে না। আমরা ব্রেকফাস্ট করব, তারপর আমি তোমাকে নিয়ে স্পিডবোটে করে ঘুরতে বের হবো। তোমাকে নিয়ে আমার বিশেষ পরিকল্পনা আছে। আজ তোমার অনেক ছবি তোলা হবে। সেই ছবি আমি দেশের বাড়িতে পাঠাব। আচ্ছা মেয়ে শোন, তুমি দেখি কেঁদেই যাচ্ছ। এত কাঁদছ কেন?

পয়সা বলল, যে যত হাসে তাকে কাঁদতে হয়। আমি খুব বেশি হাসি, এই। জন্যেই আমাকে খুব কাঁদতে হয়। রামসন্যা বলেছেন—

যত হাসি তত কান্না
বলে গেছেন রামসন্যা।

রামসন্যা কে?

আমি জানি না উনি কে। তবে উনার কথা খুব সত্যি হয়।

কথাটা আবার বলো তো, আমি আমার নোটবুকে লিখে রাখি।

পয়সা গম্ভীর গলায় বলল–

যত হাসি তত কান্না
বলে গেছেন রামসন্যা।

 

হারুন সরকার চোখে স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। অথচ ঘরে আলো আছে। তার চোখে ছানিও পড়ে নি। তাহলে এরকম হচ্ছে কেন? মৃত্যু কি এসে গেছে? খাটের নিচে আজরাঈল বসে আছে ঘাপটি মেরে? খাটের নিচ থেকে আজরাঈল তার ঠাণ্ডা হাত বের করে হারুন সরকারকে ছুঁয়ে দেবে। তখন শীতে শরীর কাঁপতে থাকবে। মৃত্যুর আগে আগে মানুষ হঠাৎ শীতে কাতর হয়। হারুন সরকারের এখনো শীত লাগছে না, তবে শীত লাগার সময় মনে হয় হয়ে গেছে।

হারুন সরকারের সামনে যে দাড়িয়ে আছে সে যে তিন বোনের একজন তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কোন জন? তিনটি বোনের চেহারাই এক রকম। এই জন্যেই কি হারুন সরকার ধরতে পারছে না?

তুমি কে? নাম কী?

জামদানী।

হারুন সরকার বলল, তুমি ভালো আছ?

জামদানী ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আপনার এ কী অবস্থা!

হারুন সরকার বলল, হাসপাতাল থেকে চলে আসা ঠিক হয় নাই। ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমি সারা জীবন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জামদানী তুমি বসো।

জামদানী বিস্মিত হয়ে বলল, আমি তো বসে আছি। আপনার সামনের চেয়ারটায় বসে আছি। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?

হারুন সরকার হতাশ গলায় বলল, সব কিছু ঝাপসা লাগছে। মনে হয় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অনেক কষ্ট করে সার্কাসটা করেছিলাম। সার্কাস ফেলে চলে যাব–এই জন্যেই খারাপ লাগছে। তৈয়বকে পাঠাও। তৈয়বের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।

সময় কতটা পার হয়েছে হারুন সরকার বলতে পারছে না। তৈয়ব সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে অন্যদিনের চেয়েও নয়া লাগছে। হারুন সরকার বলল, কেমন আছ তৈয়ব?

তৈয়ব বলল, আপনি কথা বলবেন না। আপনাকে সদর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।

মরতে হলে এইখানেই মরব। হাসপাতালে মরব না। শোন তৈয়ব, আমি এখনো হাতির বাচ্চাটাকে দেখি নাই। হাতির বাচ্চাটাকে এখানে নিয়ে আস।

তৈয়ব চলে গেছে। হারুন সরকার হাতির বাচ্চাটার জন্যে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে। আসমানী এবং জামদানী–এই দুই বোন এখন তার সামনে। এদের দুজনকে মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তৃতীয়জন গেল কোথায়? হারুন গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, তোমরা কেমন আছ?

আসমানী এবং জামদানী কেউ কিছু বলল না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। হারুন সরকার বিড়বিড় করে বলল, তোমাদের ছোটবেলায় দড়ির খেলা শিখাবার জন্যে খুব কষ্ট দিয়েছি, তোমরা কিছু মনে রেখ না।

আসমানী বলল, আপনি কথা বলবেন না। আপনি চুপ করে থাকুন।

খুব কষ্ট করে সার্কাসটা গুছিয়েছিলাম। যদি সম্ভব হয় এটাকে টিকিয়ে রাখবে।

হারুন সরকার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনল। সে আগ্রহ নিয়ে বলল, কে কাঁদে?

দুই বোনের কেউ জবাব দিল না। হারুন সরকারের মনে হলো দুই বোনই কাঁদছে। সে কে? সে কেউ না। তার জন্যেও মানুষ কাঁদছে। এরচে আনন্দের। আর কী হতে পারে?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ