চুকচুক শব্দ হচ্ছে।

পয়সা দুধ খাচ্ছে। দুধের বাটিতে কড়ে আঙুল ডুবিয়ে সেই আঙুল ঠোটের কাছে ধরতেই পয়সা আঙুল মুখে নিয়ে চুকচুক শব্দ করছে। বড়ই মজার দৃশ্য। জামাদানীর খুব ইচ্ছা সেও বড়বোনের মতো দুধ খাওয়ায়। কথাটা বলতে কেন জানি তার লজ্জা করছে। তার লজ্জা একটু বেশি; তবে সে মোটামুটি নিশ্চিত আসমানী দয়াপরবশ হয়ে এক সময় বলবে, নে তুই দুধ খাওয়া। জামদানী সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে।

দুধ খাওয়ানো উৎসব হচ্ছে বাড়ির উঠোনে। অনেক আয়োজন করা হয়েছে। পাটি বিছানো হয়েছে। কাঁথা বালিশ আনা হয়েছে। জলচৌকিতে রাখা হয়েছে দুধের বাটি এবং সরিষার তেলের বাটি। দুধ খাওয়ানো শেষ হলেই পয়সার গায়ে তেল মাখিয়ে রোদে শুইয়ে রাখা হবে। সমস্ত শরীরটা থাকবে। রোদে, শুধু মাথার উপর ছায়া ফেলে একজনকে ছাতা ধরে রাখতে হবে। জমির আলী সেই নির্দেশ দিয়ে গিয়েছে।

আঙুল চুবিয়ে দুধ খাওয়ানোর কৌশলটা আসমানী বের করেছে। আগে ন্যাকড়া দুধে ডুবিয়ে মুখে ধরা হতো। এতে সময় লাগত অনেক বেশি। আঙুল পদ্ধতিতে সময় কম লাগছে। পুরো ব্যাপারটায় আনন্দও আছে। এই আনন্দ স্থায়ী হবে না। জমির আলী বলেছে–এক মাস কষ্ট কর। এক মাস পরে আবু শিশি দিয়া দুধ খাইব। তখন নয়া আবুর মুখে শিশি ধরার কষ্ট ছাড়া আর কষ্ট নাই। তখন খালি আরাম। আসমানী এবং জামদানীর কাছে আঙুল দিয়ে দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটা কষ্টের না, বরং আনন্দের। এই আনন্দ এক মাসের মধ্যে

শেষ হয়ে যাবে ভাবতে ভালো লাগে না।

জামদানী অনেকক্ষণ হলো চুপচাপ বসে আছে। আসমানী তাকে কিছুই বলছে না। লজ্জা ভেঙে সে নিজেই মিনমিন করে বলল, বুবু, আমি দুধ খাওয়াই?

আসমানী গম্ভীর গলায় বলল, হাত ধুইয়া আয়। ভালোমতো ধুবি।

জামদানী প্রায় দৌড়ে গেল হাত ধুতে। এই ফাঁকে আসমানী তার বোনের সঙ্গে কিছু গল্পগুজব করল–এখন তোমারে কে দুধ খাওয়াইব জানো? তোমার ভইন। তার নাম জামদানী। হে তোমারে খুবই পেয়ার করে। ও আমার পয়সা ভইন, তোমার মনটা খারাপ কেন গো? মার জন্যে পেট পুড়ে? আহারে লক্ষ্মী। আহারে কুটুরা পক্ষী। মা চইল্যা আসব। কয়েকটা দিনের মামলা। মা আইস্যা তোরে কুলে নিয়া খালি হাঁটব, খালি হাঁটব। হাঁটতে হাঁটতে গীত গাইব। গীত শুইন্যা তুই ঘুমাইয়া পড়বি।

বোনের হাতে দায়িত্ব দিয়ে আসমানী উঠে পড়ল। তার অনেক কাজ। কলসিতে খাওয়ার পানি নাই। টিউব কল থেকে জগে করে পানি এনে এনে কলসি ভরতে হবে। তাকে আসা যাওয়া করতে হবে পনের বার। কলসি ভরতে পনের জগ পানি লাগে। সব তার হিসাব করা।

গাঙ্গের পাড়ে কচুগাছে প্রচুর লতি এসেছে। লতি তুলে আনতে হবে। রুস্তমের ভিটার সবরি গাছে সবরির বান ডাকছে। সেইখানে একলা যাওয়া যাবে না। ভয় লাগে। বাপজানকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। জঙ্গলার ভেতর লটকন গাছ ঝেপে লটকন এসেছে। এখনো পাকে নি, তবে পাকার সময় হয়ে এসেছে। রোজ একবার খবর না নিলে পাকা লটকন অন্য কেউ নিয়ে যাবে। জঙ্গলা থেকে খড়ির ব্যবস্থাও করতে হবে। রান্ধাবাড়ার ঝামেলা অবশ্যি নাই। জমির আলী সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে রাঁধতে বসবে। রান্না হয় একবেলা, তাতে কষ্ট হয় না। দুইবোন চিড়া খেয়ে থাকে। চিড়া খুবই গুণের খাদ্য। গুড় দিয়ে দুই মুঠ চিড়া খেয়ে ভরপেট পানি খেলে সারাদিন আর ক্ষিধে লাগে না। ক্ষিধা লাগতে থাকে আছরের পর থেকে। সন্ধ্যাবেলায় ক্ষিধায় চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। তখন গরম গরম ভাত কী যে ভালো লাগে!

টিউব কলটা সরকার বাড়ির পিছনে। সরকার বাড়ির বড় বউ রমিলা টিউব কলে কাপড় ধুচ্ছিল। আসমানীকে দেখে বলল, আসমানী, তোর ভইন কেমন আছে?

আসমানী বলল, ভালো। তোর মার কোনো খোঁজ আছে?

না।

সংসার ফালাইয়া তোর মা গেল কই?

আসমানী জবাব দিল না। জবাব দেবার কিছু নেই। তার মা কোথায় গিয়েছে সে জানে না।

তোর বাপও তো বাদাইম্যা। শইল্যে শক্তি আছে, অসুখ নাই বিসুখ নাই–করে ভিক্ষা। এমন মানুষরে কানে ধইরা গেরামের বাইরে বাইর কইরা দেওন। দরকার। ছিঃ ছিঃ!

আসমানীর মনটা খারাপ হলো। তার বাপজানরে কেউ কিছু বললে মন খারাপ লাগে। রাগ হয়। সে রমিলা চাচির উপর রাগ করতে পারছে না। রমিলা চাচি অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। সব সময় তাদের খোঁজখবর করছে। এটা সেটা দিচ্ছে। সে এখন যে হলুদ জামাটা পরে আছে এটাও রমিলা চাচির দেওয়া।

রমিলা বলল, তুই কেমন মেয়েরে আসমানী, তোর বাপরে নিয়া দুইটা মন্দ কথা বললাম সাথে সাথে মুখ কালা। যে মন্দ তারে মন্দ বলব না?

আসমানী নিচু গলায় বলল, বাপজান মন্দ না।

রমিলা হাসি মুখে বলল, আচ্ছা যা তোর বাপজান মন্দ না। হে রসগোল্লা। রসের মইধ্যে ডুইব্যা আছে। কি খুশি হইছস?

আসমানী কিছু বলল না। রমিলা বলল, একটা মুরগি ছদগা দিছি। মনে কইরা নিয়া যাবি।

ছদগা কী জন্যে দিছেন? বিপদ আপদ হইছে?

রমিলা বিষণ্ণ গলায় বলল, তোর চাচা থাকে বৈদেশে। তার জন্যে মনটা সব সময় খারাপ থাকে। তার যেন বিপদ আপদ না হয় এই জন্যে ছদগা দিলাম। গত রাইত একটা খারাপ খোয়াবও দেখছি। মনটা পেরেশান। খোয়াবে দেখলাম তোর চাচা সাদা চাদ্দর গায়ে দিয়া বিছানায় শুইয়া আছে। একটু পরে পরে বলতেছে–বৌ, আমারে পানি দেও। বড় তিয়াস লাগছে। আমি পাগলের মতো পানি খুঁজতেছি। পানি পাইতেছি না। সবই আছে, পানি নাই। তখন ঘুম ভাঙ্গছে, সারা রাইত আর ঘুম হয় নাই।

আসমানী কলপাড়ে বসল। রমিলা চাচির সঙ্গে গল্প-গুজব করতে তার খুব ভালো লাগে।

রমিলা বলল, চুলে তেল দেস না? চুলে জট পইড়া গেছে। সাবান দিয়া ভালোমতো গোসল দিবি। চুলে তেল দিবি। রাজরানীর মতো চেহারা, ময়লা মাইখ্যা ঘুইরা বেড়াস। ঘরে সাবান আছে?

না।

সাবান নিয়া যাইস। বিকালে আইস্যা সাবান আর মুরগি নিয়া যাবি।

আইচ্ছা।

আসমানী বসে আছে। রমিলা কাপড় ধুচ্ছে। রমিলার চোখে পানি। স্বামীর প্রসঙ্গে কথা বললেই রমিলার চোখে পানি আসে।

রমিলা বলল, চুপচাপ বইস্যা থাকবি না। এখন সামনে থাইক্যা যা। নয়া আবুর কিছু লাগলে আমারে খবর দিস।

আসমানী চলে গেল না। বসে রইল। রমিলা চাচি কাঁদছে। তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে আসমানীর খুব মায়া লাগছে।

জামদানী হাঁটুগেড়ে পয়সার কাছে বসে আছে। তার দুধ খাওয়া শেষ হয়েছে। এখন সে হাত-পা ছুঁড়ছে। মাঝখানে সে একবার কান্না থামিয়েছে। জামদানী তার বাবার কাছ থেকে ভিক্ষার গান শিখেছে। টেনে টেনে সুর করে ভালোই গায়। এই ধরনের গানের বিষয়ে জমির আলীর বক্তব্য হলো–ফকিরি গানে এক সঙ্গে তিন কাম হয়–গান গাইয়া আনন্দ, যে শুনে তার আনন্দ, আর গানের মধ্যে আল্লাহ খোদা নবিজির নাম থাকে বিধায় সোয়াবও হয়।

জামদানী বোনকে ফকিরি গান শুনিয়ে কান্না একবার থামিয়েছে। সে মনে হয় আবার কান্না শুরু করবে। মুখ বাকাচ্ছে। জামদানী গান ধরল—

দিনের নবি মুস্তফায়
রাস্তা দিয়া হাইট্যা যায়
একটা পাখি বইস্যা ছিল গাছেরও ছেমায় গো
গাছেরও ছেমায়…

 

আষাঢ় মাসের কড়া রোদ উঠেছে। কোথাও ছায়া নেই। রোদে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। রোদ মাথায় নিয়ে জমির আলী খেয়াঘাটে বসে আছে। কাছেই বড় ছাতিম গাছ আছে। ছাতিম গাছের নিচে বসলে ছায়া পাওয়া যায়। সেটা করা যাচ্ছে না। যে ভিক্ষুক আরাম করে গাছের ছায়ায় বসে আছে তাকে কেউ ভিক্ষা দেবে না। যে ভিক্ষুক রোদে-পুড়ে কষ্ট করছে তার প্রতি মানুষের দয়া হবে।

রোদে ভাজা ভাজা হয়ে তেমন লাভ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত জমির আলী মানুষের দয়ার কোনো লক্ষণ দেখছে না। মাঝে মাঝে খারাপ দিন আসে–সারাদিন বসে থেকেও কিছু পাওয়া যায় না। আজ মনে হচ্ছে সে-রকম খারাপ একটা দিন। জমির আলী চিন্তিত বোধ করছে। আধা কেজি চালের পয়সাটা তো উঠা দরকার। বউ চলে যাওয়ায় একটা সুবিধা হয়েছে চালের খরচ কমেছে। এখন আধা কেজি চালে তিনজনের ভালোমতো হয়ে যায়। সব খারাপ জিনিসের মধ্যে আল্লাহপাক ভালো একটা জিনিস ঢুকিয়ে দেন, আবার ভালোর মধ্যে খারাপও ঢুকিয়ে দেন। শুধু মন্দ কিংবা ভালো বলে কিছু তার কাছে নেই।

রোদের কষ্ট ভোলার জন্যে জমির আলী চিন্তা-ভাবনার লাইনে যাবার চেষ্টা করল। কোনো চিন্তা-ভাবনাই পরিষ্কার আসছে না। গরমে সব আউলায়ে যাচ্ছে। জমির আলী আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ঝকঝকে নীল। মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। ছোটখাট একটা মেঘের টুকরা থাকলেও আশায় আশায় রোদে বসে থাকা যেত–এই মেঘের টুকরা এক সময় বড় হবে। রোদের পাছায় লাথি মেরে রোদ দূর করবে। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় নামবে ঝুম বৃষ্টি।

গরম কাটান দিতে গরম লাগে। আগুন গরম এক কাপ চা খেলে গরম কাটবে। জমির আলী মজিদের চায়ের স্টলের দিকে রওনা হলো। এক সময় মজিদ তার বন্ধু মানুষ ছিল। এক সঙ্গে মাটি কেটেছে। এখন চায়ের স্টল দিয়ে ভদ্রলোক হয়ে গেছে। কাপড়-চোপড় পরে ভদ্রলোকের মতো, কথাবার্তাও বলে ভদ্রলোকের মতো। দোকানে সে একটা সাইনবোর্ডও টানিয়েছে বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না। তারপরেও জমির আলী তার চায়ের স্টলে চা খেতে গেলে সে পয়সা নেয় না। তবে মুখটা গম্ভীর করে রাখে।

মজিদ চায়ের কাপ জমির আলীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, তোমার স্ত্রীর কোনো সন্ধান পেয়েছ? চেহারা ছবি ভালো মেয়ে হারায়ে গেলে খারাপ পাড়ায় দাখিল হয়। ঘণ্টায় দশ টেকা হিসাবে ভাড়া খাটে।

জমির আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মজিদ তার বন্ধু মানুষ। বন্ধু মানুষ হয়ে বন্ধুর স্ত্রীকে নিয়ে এ ধরনের কথা কী করে বলে? তার কাছে চা খেতে আসাই উচিত না। হাতের চায়ের কাপের গরম চা মজিদের উপর ঢেলে। দিলে ভালো হতো। সেটা উচিত হবে না। একজন মন্দ হলেই যে আরেকজনের মন্দ হতে হবে তা না। জমির আলী চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, তোমার ভাবির খবর পেয়েছি। (সবই মিথ্যা কথা। মান রাখার জন্যে মিথ্যা বলা।) সে সুসং দুর্গাপুরে তার বোনের বাড়িতে আছে। তারা বিরাট বড়লোক। বাজারে টিনের ঘর আছে তিনটা। তারা তোমার ভাবিকে খুবই পেয়ার করে বলে আসতে দেয় না।

মজিদ বিরস গলায় বলল, আসতে না দিলে তোমারই গিয়া নিয়া আসা উচিত। বড়লোকের কায়-কারবার ভিন্ন। দেখা গেল তোমার স্ত্রীর সাথে লটরপটর শুরু কইরা দিছে। কিছুই বলা যায় না, তারে বিবাহও কইরা ফেলতে পারে।

জমির আলী চা শেষ না করেই উঠে পড়ল। বসল আগের জায়গায়। সকালের দিকে কিছু পাওয়া যায় নি। এখন যদি পাওয়া যায়! জমির আলী ঠিক করেছে একটা টাকাও যদি পাওয়া যায় সে টাকাটা দিয়ে আসবে মজিদকে। চায়ের দাম। মজিদকে বলবে–ফকির জমির আলী দয়ার চা খায় না।

 

সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে। দুপুরের গাড়ি চলে আসার সময় হয়ে এসেছে। এখন জমির আলী যাবে রেলস্টেশনে। যদি পাওয়া যায় তাহলে কুলির কাজ করবে। যাত্রীদের ব্যাগ-সুটকেস নামাবে। আজকাল যাত্রীরাও চালাক হয়ে গেছে। খালি হাতে ঘুরাফিরা করে। ব্রিফকেস হাতে নিয়ে নেমে যায়। দুনিয়াটা চলে যাচ্ছে চালাকের হাতে। বিরাট আফসোস!

শুধু যে কুলির কাজের জন্যে জমির আলী স্টেশনে যায় তাও না। তার মনে। আশা কোনো একদিন সে দেখবে আসমানীর মা ট্রেন থেকে নামছে। তখন জমির আলী কাছে এগিয়ে যাবে, কিছুই হয় নি এমন ভাব ধরে বলবে–কেমন আছ বউ? এদিকে খবর সবই মঙ্গল। কোনো চিন্তা করবা না। বউকে নিয়ে বাড়িতে রওনা হবার আগে আগে রেলস্টেশনের টি-স্টলে টোস্ট বিস্কিট দিয়ে এক কাপ চা খাওয়াবে। এরা চা-টা ভালো বানায়। আসমানীর মার সঙ্গে সে অতি ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করবে। কেন সে কাউকে না বলে বাড়ি থেকে চলে গেল, কোথায় গিয়েছিল–এইসব কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। কী দরকার? ফিরে এসেছে এই যথেষ্ট। আল্লাহপাকের দরবারে হাজার শুকুর।

দুপুরের ট্রেনে কোনো যাত্রী নামল না। এটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। একটা এত বড় ট্রেন–এলো, চলে গেল–একজন যাত্রীও নামল না। এরকম ঘটনা কি আগে কখনো ঘটেছে? মনে হয় ঘটে নাই। স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে। স্টেশনমাস্টারের এইসব হিসাব থাকে। জমির আলী এগিয়ে গেল। কোনো যাত্রী ট্রেন থেকে নামে নি এমন ঘটনা আগে ঘটেছে কি-না তা না জেনে গেলে মনে একটা খুঁতখুঁত থাকবে। জেনে যাওয়াই ভালো।

স্টেশনমাস্টার ধমক দিয়ে জমির আলীকে বিদায় করলেন। গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে বললেন–যা ভাগ, এক থাপ্পর খাবি।

জমির আলী বিস্মিত হয়ে বলল, থাপ্পর খাওনের মতো অপরাধ কী করলাম? মনের মধ্যে একটা জিজ্ঞাসা ছিল…

আবার কথা বলে! ভাগ!

জমির আলীর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কোনো কারণ ছাড়াই মানুষ এত খারাপ ব্যবহার কী জন্যে করে? ভালো ব্যাবহার করার জন্যে তো টাকা খরচ করা লাগে না। মুখের মিষ্ট কথা নিঃখরচা জিনিস। এক লাখ মিষ্ট কথার দাম শূন্য। জমির আলীর মন এতই খারাপ হলো যে মন খারাপ ভাব কাটাবার জন্যে মিষ্ট কথার সন্ধানে বের হলো। একটা তিক্ত কথা কাটান দিতে একটা মিষ্ট কথা লাগে। তিক্ত কথা কাটান না দেয়া পর্যন্ত মনে অশান্তি থাকবে। কী দরকার মন অশান্ত রেখে! জমির আলী ইয়াকুব সাহেবের সন্ধানে বের হলো।

ইয়াকুব সাহেব কী একটা এনজিওর কাজ নিয়ে এসেছেন। থানা কমপ্লেক্সের পাশে টিনের একচালা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকেন। অতি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। মধুর ব্যবহার। রমিজ আলীর ধারণা এই মানুষটা শুধু মধুর ব্যবহারের কারণে বেহেশতে যাবে।

খাওয়া-দাওয়ার পর ইয়াকুব সাহেব কিছুক্ষণ ঘুমান। জমির আলী ঠিক করে ফেলল সে যদি গিয়ে দেখে ইয়াকুব সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন তাহলেও চলে আসবে না। ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করবে। দুটা মিষ্ট কথা শুনে মনটা ঠিক করবে।

ইয়াকুব সাহেব জেগেই ছিলেন। বারান্দায় রাখা টানা বেঞ্চের এক মাথায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। জমির আলীকে দেখে তিনি হাসিমুখে বললেন, ভিক্ষুক সাহেবের খবর কী? রোজগারপাতি কিছু হয়েছে?

জমির আলীর মন ভালো হয়ে গেল। একে বলে ভদ্রলোক। শরিফ খানদান। জমির আলী বলল, স্যারের শরীরের অবস্থা কী?

অবস্থা ভালোই, তোমার খবর কী? বউ ফিরেছে?

জে-না।

কোথায় আছে খোঁজ-খবর কিছু করেছ?

বাপের বাড়িতে যায় নাই, সে খবর পেয়েছি। মনে হয় সুসং দুর্গাপুরে আছে। তার এক বোনের বিবাহ হয়েছিল সুসং দুর্গাপুরে। আমার বিশ্বাস সেইখানেই আছে।

চলে যাও। বউ নিয়ে আস।

বেকায়দায় পড়ে গেছি স্যার। ঘরে ছোট আবু। কার কাছে রাখি!

তোমার বাচ্চাটা আছে কেমন? কী যেন তার নাম–পয়সা না?

জে স্যার, আপনার দেখি সবই ইয়াদ থাকে।

জমির আলী, দুপুরের খাওয়া হয়েছে? না হয়ে থাকলে অল্প কিছু ভাততরকারি আছে। খেয়ে নাও। খাবে?

জে স্যার।

 

যাওয়ার সময় থালাবাসন ধুয়ে যেও।

জে আচ্ছা।

জমির আলী মনে মনে বলল, হে আল্লাহপাক! তোমার দরবারে দরখাস্ত করলাম–ইয়াকুব সাহেবরে তুমি বেহেশত নসিব করবে। তাকে বেহশত নসিব না করলে আমি তোমার বেহেশতে ঢুকব না। এইটা আমার ওয়াদা।

জমির আলী যে বেহেশতে যাবে এ বিষয়ে সে নিশ্চিন্ত। কারণ সে স্বপ্নে একবার নবিজিকে দেখেছে। যারা নবিজিকে স্বপ্নে দেখে তাদের বেহেশত নসিব হয়। মুনশি মোল্লার কথা।

খাওয়া-দাওয়ার পর রান্নাঘরেই জমির আলী কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। ভাত ঘুমের মতো আরামের ঘুম আল্লাহপাক তৈরি করেন নাই। ভরপেট খাওয়ার পর বিসমিল্লাহ বলে শুয়ে পড়া। পেট যত ভরা থাকবে ঘুম হবে তত আরামের। ইয়াকুব আলী যদিও বলেছেন–অল্প ভাত তরকারি আছে। ঘটনা ভিন্ন। সব কিছুই পরিমাণ মতো ছিল। ডাল টকে গিয়েছিল, এতে স্বাদ বরং বেড়েছে।

ঘুমের মধ্যে জমির আলী ভালো একটা স্বপ্ন দেখল। আসমানীর মা ফিরে এসেছে। ট্রেন থেকে নামার সময় সে গলা বাড়িয়ে চিৎকার করছে–কুলি! কুলি! এইখানে কুলি আছে? আমার অনেক মাল-সামান। জমির আলী এগিয়ে গেল। আছিয়া তাকে চিনতে পারল না। আলীশান এক ট্রাঙ্ক তার মাথায় তুলে দিল। মাথায় ট্রাঙ্ক, এক হাতে স্যুটকেস, এক হাতে বিরাট এক পুটলি নিয়ে জমির আলী যাচ্ছে। পেছনে পেছনে আছিয়া আসছে। স্বপ্ন বলেই এতগুলি মালসামান নিয়ে এত সহজে হাঁটা যাচ্ছে। জমির আলী বলল, বউ তোমার খবর কী? অমনি আছিয়া রেগে গিয়ে বলল, ঐ ব্যাটা মাডি লাউগরা, তুই আমারে বউ ডাকস কোন সাহসে? লাথ মাইরা তোর কোমর ভাঙব। জমির আলী হাসতে হাসতে বলল, লাথ মার তো! দেখি তোমার ঠ্যাঙে কত জোর! আছিয়া সত্যি সত্যি লাথ মারার জন্যে এগিয়ে এসে জিভে কামড় দিয়ে বলল, ও আল্লা! আপনে? বিরাট অন্যায় করেছি, মাপ দেন। জমির আলী দরাজ গলায় বলল, স্বামী যেমন স্ত্রীর উপর অন্যায় করতে পারে, স্ত্রীও পারে। এতে দোষ হয় না। তারপর বউ বলো—ট্রাঙ্কে কইরা কী আনছ? আছিয়া বলল, টেকা আনছি। ট্রাঙ্ক ভরতি টেকা। আইজ থাইক্যা আপনের ভিক্ষা বন্ধ। ট্রাঙ্ক খুইল্যা টেকা বাইর করবেন আর খরচ করবেন।

স্বপ্নের এই পর্যায়ে জমির আলীর ঘুম ভেঙে যায়। তার মনটা হয় উদাস। স্বপ্নে আছিয়াকে খুবই সুন্দর লাগছিল। কানে ছিল স্বর্ণের দুল। এই দুল জোড়া আসমানীর অসুখের সময় বিক্রি করতে হয়েছে। দুল আর কিনে দেয়া হয় নি। বিবাহিত মেয়েদের গায়ে স্বর্ণের ছোঁয়া না থাকলে দোষ লাগে। এক আনা সোনা হলেও গায়ে রাখতে হয়। সেটা করা সম্ভব হয় নি বলেই আছিয়ার গায়ে দোষ লেগে গেছে। সে সংসার ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েদের যেমন স্বর্ণ পুরুষদের তেমন আকিক পাথর। নবিজি নিজে আকিক পাথর পরতেন।

জমির আলী বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার মুখে মুখে। বাড়িতে পা দিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। সব ঠিক-ঠাক আছে। কলসি ভর্তি পানি আছে। উঠান পরিষ্কার। চুলার কাছে শুকনা খড়ি সাজানো। অজু করার জন্যে জলচৌকির কাছে বদনা ভর্তি পানি। উঠানের খুঁটির সঙ্গে সাদা রঙের একটা মুরগি বাঁধা।

জমির আলী বিস্মিত গলায় বলল, এই মুরগি কার?

আসমানী বলল, আমরার মুরগি। ছদগা পাইছি। বাপজান, তুমি আস্তে কথা বলো, পয়সা হবে ঘুমাইছে।

বাবার সাড়া পেয়ে জামদানী গামছা হাতে বের হয়ে এসেছে। সে বাবার হাতে গামছা দিতে দিতে লজ্জিত গলায় বলল, পোলাও দিয়া মুরগির সালুন। খাইতে মনে চায় বাপজান।

জমির আলী দরাজ গলায় বলল, মনে চাইলে খাবি। আইজ রাইতেই খাবি। এইটা কোনো বিষয় না।

সত্যই?

অবশ্যই সত্য। জমির আলী ফকির হইলেও তার কথার দাম রাজা-বাদশার কথার দামের সমান। পোলাও কোর্মা আইজ রাইতেই হবে।

পোলাও-এর চাউল, ঘি গরম মশল্লা কই পাইবা?

এইগুলা নিয়া তোর চিন্তা করনের প্রয়োজন নাই। এইগুলা আমার বিষয়। মেয়েছেলে করব সংসার, পুরুষ করব চিন্তা–এইটা জগতের নিয়ম। এখন কথা বাড়াইস না। মাগরেবের ওয়াক্ত চইল্যা যাইতেছে। মাগরেবের ওয়াক্ত অতি অল্প সময়ের জন্যে থাকে। যদি দেখস গায়ের পশম দেখা যাইতেছে না তাহলে বুঝবি ওয়াক্ত শেষ হয়েছে।

 

সত্যি সত্যি পোলাও-কোরমা রান্না হয়েছে। দুই বোন নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। জমির আলী পয়সাকে কোলে নিয়ে পাশেই বসে আছে। আনন্দিত চোখে মেয়ে দুটির খাওয়া দেখছে। সে নিজে খেতে বসে নি। পোলাও-এর পরিমাণ কম। তিনজন খেলে কম পড়বে। শুধু দুই বোন যদি খায় আরাম করে খেতে পারবে। আসমানী বলল, বাপজান, তুমি খাইবা না?

জমির আলী বলল, না। আমার শইল জুইত নাই। শইল ঠিক করনের জন্যে উপাস দিব। শইল ঠিক করনের জন্যে উপাসের উপরে কোনো ওষুধ নাই। পোলাও-কোরমা খাইতে কেমন হইছে?

আসমানী বলল, অইত্যাধিক ভালো হইছে।

কই আমার মা জামদানী তো কিছু বলে না। ও জামি, খাদ্য কেমন হইছে?

জামদানীর মুখ ভর্তি খাবার। তার কথা বলার উপায় নেই। মুখে খাবার না থাকলেও সে কথা বলতে পারত না। খুব আনন্দের সময় সে কথা বলতে পারে না, তার চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ে। জমির বলল, আরাম কইরা খাও গো কইন্যারা। খাওয়া একটা ইবাদত। যত আরাম কইরা খাইবা ইবাদত তত শক্ত হইব। আল্লাহ সোয়াব দিয়া ভাসাইয়া দিব।

আসমানী বলল, তুমি কিছু খাইবা না এইটা কেমন কথা? এক মুঠ হইলেও খাও। দেই মুখে তুইল্যা?

জমির আলী উদাস গলায় বলল, দে।

আসমানী বাবার মুখে এক মুঠ খাবার তুলে দিল।

কন্যাদের সঙ্গে নিয়ে এটাই ছিল জমির আলীর শেষ খাওয়া। পরদিনই সে স্ত্রীর সন্ধানে দুর্গাপুর চলে যায়। সেখানে খবর পায় আছিয়া, আরো দুটা মেয়ের সঙ্গে বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। জমির আলীও রাতের অন্ধকারে বর্ডার পার হয়। সেও নিখোঁজ হয়ে যায়।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ