তিনটা খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় আলাউদ্দিনের ছবি ছাপা হয়েছে। তাদের সংবাদ শিরোনাম–

প্রধান শিক্ষক কর্তৃক
ছাত্রী ধর্ষিত।

কোচিং সেন্টারে প্রধান শিক্ষক
কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের চেষ্টা।
শিক্ষক হাজিতে।

কন্যাসম ছাত্রী
শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার।
ধর্ষণের চেষ্টাকালে শিক্ষক ধৃত।

মুহিব হাজতে তার বাবার সামনে বসে আছে। সে তার বাবার দিকে তাকাতে পারছে না। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আলাউদ্দিন সিগারেট খান না। তার হাতে সিগারেট। ভুস ভুস করে ধোয়া ছাড়ছেন। তার চোখ রক্তবর্ণ। চুল উসকোখুসকো। একটা চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে।

মুহিব বলল, মারধোর করেছে না-কি বাবা?

আলাউদ্দিন বললেন, হুঁ। ওসি সাহেবকে টাকা খাওয়াতে হবে। টাকা খাওয়ালে মারধোর হবে না। চেকবই আনতে বলেছিলাম, এনেছিস?

হুঁ।

ব্যাংকে এক লাখ বিশ হাজার টাকা আছে। চেক লিখে দেই। পুরাটাই তুলবি। ওসি সাহেবকে দিবি দশ হাজার। হাতেপায়ে ধরে বলবি, এর বেশি দেওয়ার সামর্থ্য নাই। পায়ে ধরতে পারবি না?

পারব।

অশ্রুকে সাথে নিয়ে আসিস। সেও যেন ওসি সাহেবের পায়ে ধরে। এক লাখ বিশ থেকে দশ চলে গেল। বাকি থাকল এক লাখ দশ। দশ দিবি উকিলকে। হমিদুজ্জামান নামে আমার পরিচিত এক ক্রিমিনাল লইয়ার আছে। ঘাগু লোক। ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি, তার সঙ্গে দেখা করবি।

আচ্ছা।

এক লাখ টাকা নিয়ে ঐ মেয়েটার সঙ্গে দেখা করবি। তোর মাকে সাথে নিয়ে যাবি। মামলা যাতে তুলে নেয় সেই ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখবি। টাকা আগেই দিবি না। যদি বলে মামলা তুলে নিবে তখন দিবি। মনে হয় তুলবে না।

মেয়েটার নাম কী?

সালমা। বাবার নাম আশরাফ। তার ঠিকানা জানি না। মিরপুরে কিসের যেন দোকান আছে। খুঁজে বের করবি। কোচিং সেন্টারের রেজিষ্টারে ঠিকানা আছে। বের করতে পারবি না?

পারব।

আলাউদ্দিন হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা ধরলেন। কিছুক্ষণ কাশলেন, তারপর লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, তুই অন্যদিকে তাকিয়ে আছিস কী জন্যে? কোনোরকম ঘটনা ঘটে নাই। মিথ্যা মামলা।

মিথ্যা মামলা?

অবশ্যই। যে-কোনো গাধা বুঝবে মিথ্যা মামলা। তোর বৃদ্ধি গাধারও নিচে বলে ভেবেছিস সত্যি। বাবার দিকে তাকাচ্ছিস না। অথচ আমি তোর জন্মদাতা পিতা। এক হাদিসে আছে— রসুলুল্লাহ সাল্লালাহে আলায়হেস সালাম বলেছেন, আমি যদি আল্লাহপাক ব্যতীত অন্যকাউকে সেজদা দেয়ার হুকুম দিতাম সে হতে জন্মদাতা পিতা। বুঝেছিস?

জি।

মামলা যে মিথ্যা প্রমাণ দেই। যদিও তোর কাছে প্রমাণ দেয়ার কিছু নাই। তুই তো হাকিম না। প্রমাণ করতে হবে কোটে। যাই হোক শোন, ঘটনা ঘটেছে বেলা বারোটায়। বারোটায় কোচিং-এর ক্লাস হচ্ছে। চারদিকে ছাত্র-ছাত্রী। এর মধ্যে আমি এক মেয়েকে ঘরে ঢুকাব। দরজার ছিটকানি লাগাব। এটা কি সম্ভব? আর ঐ হারামজাদি সালমা দেখছে আমি দরজা বন্ধ করছি, সে কিছুই বলবে না? সে একটা চিৎকার দিলেই তো সব ছুটে আসে। দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করতে হয় না। বুঝতে পারছিস?

হুঁ।

মিথ্যা মামলাটা কেন করেছে শোন। কোচিং সেন্টারে আমার শেয়ার ফিফটি, বাকি ফিফটি হিশামের। চলে আমার নামে আলাউদ্দিন কোচিং সেন্টার। সবাই একনামে চিনে। গত বছর থেকে টাকা আসা শুরু হয়েছে। আমাকে আউট করা দরকার। পুরা ঘটনা সাজায়েছে হিশাম। সালমা মেয়েটা তার আত্মীয়। ভাগ্নি না কী যেন হয়।

আমি কি হিশাম চাচার সঙ্গে দেখা করব?

করতে পারিস। যা করবি বিবেচনা করে করবি। গাধার মতো কিছু করবি। মাথা ঠান্ডা রাখবি। যে-কোনো বিপদ থেকে উদ্ধারের একটাই পথ— মাথা ঠান্ডা রাখা। You got to keep your head cool, চেকবইটা দে। এক কাপ চা জোগাড় করা যায় কি না দেখ।

 

ক্রিমিনাল লইয়ার হামিদুজ্জামানের চেহারা ক্রিমিনালদের মতো। মুখভর্তি খোচা খোচা দাড়ি। ছোট ছোট চুল। মাথা কামানো। যখন কথা বলেন না তখন ঠোট উল্টে রাখেন। তার টেবিলে ছোট্ট আয়না আছে। ঠোট উল্টে আয়নায় নিজেকে দেখেন। চেয়ারের পাশে পিতলের পিকদানি। কিছুক্ষণ পরপর সেখানে থুথু ফেলেন।

মুহিব বলল, স্যার। বাবা বলেছেন, মিথ্যা মামলা।

হামিদুজ্জামান থুথু ফেলে কিছুক্ষণ ঠোট উল্টা করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, বাবারে, সত্য মামলা মিথ্যা মামলা বলে কিছু নাই। মামলা হলো জজ সাহেব। উনি যখন বলবেন মামলা মিথ্যা, তখন সত্য মামলাও মিথ্যা। টাকাপয়সা কী এনেছ?

দশ হাজার টাকা এনেছি।

যেখানে এক সমুদ্র পানি লাগে সেখানে এক চামচ পানি নিয়ে উপস্থিত হয়েছ। মামলার ধরন খারাপ। নন বেলেবল। জামিন হবে না। সেখানে কোর্টে চালান করা মাত্র জামিনে ছাড়ায়ে নিয়ে আসব। আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য দিয়ে তো আনতে পারব না। টাকা দিয়ে ছুটায়ে আনতে হবে। মেয়ের ডাক্তারি পরীক্ষা কি হয়েছে?

জানি না।

ভোমার জানার প্রয়োজনও নাই। যদি মামলা আমি নেই তখন আমিই জানব। ডাক্তারকে টাকা খাওয়ায়ে সার্টিফিকেট বের করব ধর্ষণের আলামত সনাক্ত করা যায় নাই। এই বাবদই শুধু লাগবে পঞ্চাশ হাজার। বুঝেছ?

জি। এত টাকা তো আমাদের নাই চাচা।

হামিদুজ্জান থুথু ফেললেন। ঠোট উল্টে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, তাহলে তো বাবা কিছু করার নাই। তোমার পিতাজিকে কম করে হলেও সাত বছর জেলে থাকতে হবে। তোমাকে পরিষ্কার বলি, ক্রিমিনাল লইয়ার হিসাবে আমার নামডাক আছে। লোকে বলে, ফাঁসির দড়ির ভেতর থেকে আমি আসামি খালাস করে আনতে পারি। কথার মধ্যে কিছু সত্য আছে। তবে লইয়ার আমি ভালো না। আমি টাকা খাওয়ানোতে ভালো। কাকে টাকা খাওয়াতে হবে, কীভাবে টাকা খাওয়াতে হবে, এটা আমি জানি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা নৃত্যনাট্য আছে, নাম মায়ার খেলা। কোর্টের নৃত্যনাট্য হলো— টাকার খেলা। তুমি যাও, তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে। ব্রুতে মিনিমাম এক লাখ টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে আসবে। ব্যবস্থা করতে না পারলে আসবে না। তোমার বাবা আমার পূর্বপরিচিত, এটা ঠিক আছে। পরিচয়ে কিছু হবে না। তোমার বাবাকে কি কোর্টে চালান দিয়েছে? চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে হাজির করার নিয়ম। রিমান্ডের অর্ডার যদি পুলিশ বের করে ফেলে তাহলে সাড়ে সর্বনাশ।

মুহিব বলল, দশ হাজার টাকা নিয়ে এসেছি চাচা, টাকাটা কি রাখবেন?

হামিদুজ্জামান থুথু ফেলতে ফেলতে বললেন, না।

মুহিব উঠে দাড়াল। এখন সে যাবে আলাউদ্দিনের কোচিং বিজনেসের পার্টনার হিশাম সাহেবের কাছে। মুহিব তাকে ভালো করেই চেনে। অনেকবার তাদের বাড়িতে এসেছেন। শান্ত-ভদ্র চেহারা। হজ্জ করে আসার পর দাড়ি রেখেছেন। চোখে সুরমা দেন। গলার স্বর মিষ্টি।

 

হিশাম সাহেব কোচিং সেন্টারেই ছিলেন। মুহিকে দেখে বললেন, তুমি আসবে জানতাম। কী ঘটনা ঘটে গেছে দেখেছ? কেউ কি আর এই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হবে? ছিঃ ছিঃ, কী কেলেংকারি! সালমা মেয়েটা আমার আপন ভাগ্নি। তার সামনে মুখ দেখাতে পারি না। আমি তাকে বললাম, দরজা ভেঙে তোকে বের করতে হলো কেন? আগে চিৎকার দিলি না কেন? গাধি মেয়ে বলে, লজ্জায়। এখন লজ্জা কই গেল! দুনিয়ার পত্রিকার তোক বাড়িতে আসছে। এক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক এসেছে ক্রাইম রিপোর্টিং করবে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

মুহিব বলল, চাচা, আমি কি সালমা মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে পারি?

কী কথা বলবে?

মুহিব চুপ করে রইল। হিশাম বললেন, তোমার তো কথা বলার কিছু নাই। তোমার বাপ এত বড় একটা ঘটনা ঘটায়েছে— তুমি ছেলে হয়ে তার সামনে যাকে কীভাবে?

মুহিব বলল, তাও ঠিক।

হিশাম বললেন, জানাজানি বেশি হয়ে গেছে। জানাজানি কম হলে ঘটনা ধামাচাপার ব্যবস্থা করতাম। এখন সেই পথও নাই।

চাচা, মেয়েটার সঙ্গে কি আমি টেলিফোনে কথা বলতে পারি?

তুমি কথা বলার জন্য কেন অস্থির হয়েছ বুঝলাম না। তোমার কথা বলার তো কিছু নাই।

মুহিব বলল, বাবার হয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম। পায়ে ধরে পড়ে থাকতাম।

তুমি কি ভেবেছ পায়ে ধরে পড়ে থাকলেই সে মামলা তুলে নিবে?

মামলা তুলতে তো চাচা বলছি না। মামলায় বাবার যা হয় হবে। আমরা উকিলও দেই নাই।

দাও নাই কেন?

উকিল যত টাকা চায় অত টাকা নাই। আমি ধরেই নিয়েছি বাবার সাত বছরের জেল হবে।

হিশাম বললেন, তুমি সালমার সঙ্গে কথা বলতে চাও দেখি কী করা যায়। কয়েকটা দিন যেতে দাও। পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক। মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। জামাই জনতা ইনস্যুরেন্সের ক্যাশিয়ার। বিয়ে ভেঙে গেছে। এই নিয়েও বাড়িতে কান্নাকাটি। এই মেয়ের আর বিয়ে হবে বলে মনে হয় না।

 

সন্ধ্যাবেলা মুহিব গেল লীলার কাছে। লীলা চমকে উঠে বলল, কী হয়েছে? তোমাকে এরকম লাগছে কেন?

মুহিব বলল, আজকের কাগজ পড়েছ? কাগজের ফ্রন্ট পেজে বাবার ছবি ছাপা হয়েছে। কয়জনের বাবার ছবি ফ্রন্ট পেজে ছাপা হয়? এই আনন্দেই আমার

চেহারা অন্যরকম হয়ে গেছে।

লীলা বলল, উনার নাম কি আলাউদ্দিন?

হ্যাঁ।

লীলা বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, তুমি দুপুরে কিছু খেয়েছ?

না।

বাথরুমে যাও, হাত-মুখ ধোও। তারপর টেবিলে আস। মাংস রান্না করা আছে। পরোটা ভেজে দেবে। নতুন একটা মেয়ে পেয়েছি। আসমা নাম। ভালো পরোটা বানায়। বসে আছ কেন? হাত-মুখ ধুতে যাও।

মুহিব খেতে বসেছে। লীলা বসেছে তার সামনে। এত আগ্রহ করে খাচ্ছে, লীলার চোখ ভিজে ওঠার উপক্রম হলো। লীলা বলল, ডেভিড ব্রেইনের নাম শুনেছ?

না।

উনি একজন ম্যাজিশিয়ান। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের পথে পথে তিনি ম্যাজিক দেখান। স্ট্রীট ম্যাজিশিয়ান। কী ম্যাজিক দেখান জানো?

কী ম্যাজিক?

শূন্যে ভাসার ম্যাজিক। তুমি শিখবে?

মুহিব বলল, না। আমি তো শূন্যে ভেসেই আছি।

তুমি যখন শূন্যে ভেসেই আছ, তোমার জন্যে সুবিধা হবে। আমি তোমাকে আহসান সাহেবের কাছে পাঠাব। তিনি তোমাকে শিখিয়ে দেবেন। আজ যেতে পারবে? রাত আটটার পর।

শূন্যে ভেসে থাকার ম্যাজিক শিখে কী করব?

মাঝে মাঝে আমার সামনে শূন্যে ভেসে থাকবে। আমি দেখে মজা পাব। যেতে পারবে? বলব উনাকে টেলিফোন করে?

বলো।

পরোটা কেমন হয়েছে?

খুব ভালো। দুটা পরোটা আর মাংস কি প্যাকেট করে দিতে পারবে?

কেন?

বাবার জন্যে নিয়ে যাব।

দিয়ে দেব। পরোটা মাংস ছাড়া আর কিছু কি লাগবে?

না। তারপরই মুহিব বলল, তোমাকে একটা কথা বলার জন্য এসেছি। বাবা এই নোংরা কাজটা করেন নি।

লীলা বলল, তুমি যখন বলছ করেন নি, তাহলে অবশ্যই করেন নি। তুমি কি এখন তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাবে?

হ্যাঁ।

রাত আটটায় আহসান সাহেবের কাছে যাবে, মনে আছে?

মনে আছে।

কাগজে ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। এক কাজ করি, তোমাকে গাড়ি দিয়ে দেই। ড্রাইভার তুমি যেখানে যাবে নিয়ে যাবে। দেই?

না।

লীলা বলল, তোমার হাত-পা কাঁপছে? কেন? জানি না কেন?

তোমার সঙ্গে গাড়িটা থাকুক প্লিজ। আরেকটা কথা শোন, মনে কর তোমার বাবা এই কাজটা করেছেন, তার জন্যে আমি কখনো, কোনোদিনও তোমাকে দায়ী করব না। Never ever.

মুহিব বলল, আমি সেটা জানি।

সত্যি জানো?

হ্যাঁ। আমি আমার জীবনে নিজের অজান্তেই কোনো একটা মহাপুণ্য করেছিলাম বলে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।

মহাপুণ্যটা কী তুমি জানো না?

না।

লীলা হাসতে হাসতে বলল, আমি কিন্তু জানি। তুমি আমাকে নর্দমা থেকে টেনে তুলেছ। এইটাই মহাপুণ্য।

 

আলাউদ্দিন মাংস-পরোটা খাচ্ছেন। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, কোন রেস্টুরেন্ট থেকে এনেছিস?

মুহিব বলল, লীলা হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট।

ওয়ান্ডারফুল রান্না। পরোটা হয়েছে মাখনের মতো মোলায়েম। ঘি দিয়ে ভেজেছে মনে হয়, ঘিয়ের গন্ধ পাচ্ছি।

বাবা, আরাম করে খাও।

ওসি সাহেবের টাকাটা এনেছিস?

এনেছি।

পায়ে ধরার কথা মনে আছে তো?

মনে আছে।

বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যে পায়ে ধরা যায়। দোষ হয় না।

তুমি কখনো কারো পায়ে ধরে বাবা?

না। হামিদুজ্জামান সাহেবকে টাকা দিয়েছিস? ঘাগু লইয়ার। কেইস পানি করে ছেড়ে দিবে।

মুহিব বলল, উনি শুরুতেই এক লাখ টাকা চান।

বলিস কী? সস্তা কাউকে খুঁজে বের করা দরকার। বদ মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিস?

না।

গাধার মতো কাজ করলে হবে মাথায় এত বড় বিপদ।

মুহিব বলল, তার বাবার সূত্রে টেলিফোনে কথা বলেছি। কোচিং সেন্টার থেকে উনার নাম্বার জোগাড় করেছিলাম।

আলাউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, টেলিফোনে কথা চালাচালি কী জন্যে? সামনাসামনি কথা বলবি। না-কি আমার কারণে মুখ দেখাতে লজ্জা হয়? ঐ লোক কী বলেছে?

উনি টাকা দিতে রাজি হয়ছেন।

রাজি হয়েছে?

হুঁ। উনি পাঁচ লাখ টাকা চান। পাঁচ লাখ দিলে মামলা তুলে নিবেন বলেছেন। তার বিজনেস খারাপ যাচ্ছে, এইজন্যে টাকাটা দরকার।

আলাউদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, পাঁচ লাখ কই পাব?

মুহিব বলল, উনি টাকা নিলেন, তারপর মামলা তুললেন না?

আলাউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, আগেই কু ডাক ডাকা শুরু করলি? জায়গাটা বেচে দে। চার কাঠা জায়গা। পাঁচ ছয় লাখ পাওয়ার কথা।

আমরা থাকব কোথায় বাবা?

আমি জেল থেকে বের হই। একটা কিছু ব্যবস্থা করবই। জায়গা বেচে দে। দ্রুত ব্যবস্থা করা মামলা কোর্টে ওঠার আগেই ব্যবস্থা করা দরকার। তোর মা আছে কেমন?

ভালো?

আমার বিষয়ে কিছু বলে? বোকা মেয়েমানুষ। যা শুনবে সবই বিশ্বাসী করবে। ধরেই নিয়েছে আমি এই কাজ করেছি। ধরে থাপড়ানো দরকার।

মুহিব বলল, মা তো কিছুই বলছে না। শুধু শুধু তাঁকে থাপড়ানোর কথা কেন

বলছ?

কথার কথা বলছি। দুই প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে আয়। মশার কামড়ে রাতে এক ফোঁটা ঘুম হয় না। সারারাত জেগে থাকি আর সিগারেট খাই।

মুহিব উঠে দাঁড়াল। বাবার এখান থেকে সেযাবে আহসান সাহেব নামে এক লোকের কাছে। তিনি তাকে শূন্যে ভেসে থাকা শেখাবেন। তারপর সে কী করবে? বাসায় ফিরে যাবে? আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকা মা এবং বোনের সামনে বসে থাকবে। মোটেই ইচ্ছা করছে না। তারচেয়ে বরং নিলি ম্যাডামের কাছে যাওয়া যায়। তিনি নিশ্চয়ই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন জন্মদিনের উপহার পেয়ে ছেলে কী করেছে তা জানার জন্যে।

হয়তো নিলি ম্যাডাম বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না। তখন সে রাস্তায় হাঁটবে। পুরোপুরি হিমু হয়ে যাবে। টহল পুলিশ যদি জিজ্ঞেস করে সে বলবে, আমি হিমু।

পুলিশ জিজ্ঞেস করবে, যাচ্ছেন কোথায়?

সে বলবে, জানি না। হিমুরা কোথায় যায় তারা জানে না।

 

নিলি ম্যাডামের গেটের দারোয়ান মুহিবকে চিনল। মুখভর্তি করে হাসল।

স্যার, ভালো আছেন?

মুহিব বলল, ভালো আছি।

যান ভেতরে চলে যান।

লেখাপড়া করতে হবে না?

দারোয়ান বলল, না, ম্যাডাম বলে দিয়েছেন আপনার ব্যাপারে কিছু লাগবে। চলে যান।

দরজা খুলে নিলি মোটেই অবাক হলো না। তার ভাব দেখে মনে হলো সে অপেক্ষা করছিল। নিলি বলল, আপনি নিশ্চয় কোনো সমস্যায় পড়েছেন। আপনাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।

মুহিব বলল, সমস্যায় পড়ি নি। আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে এসেছি। দেখিয়ে চলে যাব।

কী দেখাবেন?

সোফায় বসুন। দেখাচ্ছি। জিনিসটা দেখাবার জন্যে আমাকে একটা বিশেষ জায়গায় দাড়াতে হবে।

নিলি সোফায় বসেছে। তার চোখেমুখে একই সঙ্গে শঙ্কা এবং কৌতূহল।

মুহিব বলল, আপনার ড্রয়িংরুমে আলো বেশি। কিছু কমিয়ে দেই?

দিন।

মুহিব কয়েকটা বাতি নিভিয়ে নিলির সামনে দাঁড়াল। ক্লান্ত গলায় বলল, আপনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকুন। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখবেন আমি শূন্যে ভাসছি।

নিলি বলল, পাগলের মতো এইসব কী বলছেন? আপনার কী হয়েছে? সমস্যাটা কী?

মুহিব বলল, এই দেখুন ভাসছি।

নিলি হতভম্ব গলায় বলল, আসলেই তো ভাসছেন! কী আশ্চর্য! কতক্ষণ ভেসে থাকতে পারেন?

বেশিক্ষণ পারি না।

মিলি বলল, এইসব কী দেখাচ্ছেন? আমি জীবনে এত অবাক হই নি। নেমে পড়ুন। দেখে মনে হচ্ছে আপনার কষ্ট হচ্ছে। আসলেই শূন্যে ভেসেছেন, নাকি এটা কোনো Tricks?

মুহিব শূন্য থেকে নামল। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ম্যাডাম যাই? অনেক রাতে এসেছি বলে কিছু মনে করবেন না।

নিলি বলল, যাবেন মানে? আপনি আমার সঙ্গে ডিনার করবেন। আমি কয়েকবার আপনাকে টেলিফোন করেছি। আপনি টেলিফোন ধরেন নি, লাইন কেটে দিয়েছেন। গতকাল আপনার শুটিং ছিল, আপনি আসেন নি। কী হয়েছে আপনার জানতে পারি?

আমার কিছু হয় নি ম্যাডাম। আমি ভালো আছি।

আপনার বান্ধবী রূপা।–সে কি ভালো আছে?

ওর নাম লীলা।

লীলা ভালো আছে?

মুহিব বলল, লীলা ভালো আছে। ওর দুই ময়ূর চিত্রা এবং মিত্রা ভালো আছে। শুধু তার বাঁদরটার শরীর খারাপ করেছে। কাশি হয়েছে। মানুষের মতো খক খক করে কাশছে। লীলার বাবা শওকত সাহেব কলার ভেতর হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দানা ভরে তাকে খেতে দিচ্ছেন। তার চিকিৎসা চলছে।

নিলি বলল, মুহিব, আপনি বসুন তো। কথা না বলে চুপ করে বসুন। আমি যা জিজ্ঞেস করব শুধু তার জবাব দেবেন! Something is very Wrong. I can feel it. টেবিলে খাবার দেয়া হোক। এর মধ্যে আমরা গল্পগুজব করি। আপনাকে পেয়ে ভালো লাগছে। আমি একা খেতে পারি না। সব পশু একা খেতে পছন্দ করে, শুধু মানুষ এবং পাখি এই দুই শ্রেণী একা খেতে চায় না।

মুহিব বলল, এটা আমি জানতাম না। পাখিদের বিষয়ে শুধু একটা বিষয় জানি। লীলার বাবা বলেছেন, পাখিরা আগে সরীসৃপ ছিল পরে পাখি হয়েছে।

নিলি বলল, এই তথ্য আবার আমি জানি না। ভালোই হয়েছে, exchange of ideas. এখন বলুন, আপনি কি কোনো বিপদে পড়েছেন?

মুহিব বলল, আমি বিপদে পড়ি নি। আমার বাবা বিপদে পড়েছেন। মহাবিপদে। তিনি এখন থানা হাজতে ঘাপটি মেরে বসে আছেন। আপনাকে যেমন মশা কামড়ায়, বাবাকেও কামড়াচ্ছে।

নিলি বলল, আমি কি কোনো সাহায্য করতে পারি? অবশ্য আমার তেমন কানেকশন নেই। পদ্মর বাবার অনেক কানেকশন। সে যেমন মানুষকে বিপদে ফেলতে পারে, আবার বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে। আমি একটা কথা বললে সে ফেলবে না।

মুহিব বলল, ম্যাডাম! আপনাকে কিছু বলতে হবে না।

নিলি বলল, পদ্মর বাবা টেলিফোনে আপনার প্রশংসা করছিল। আপনি নাকি সজিরনকে ধমকাধমকি করে এসেছেন। ও বলছিল, যে ছেলে খাচায় ঢুকে বাঘকে খোচা দেয়ার সাহস রাখে, সেই ছেলের সাহসের তারিফ করতে হয়। আপনি চাইলেই সে আপনাকে ভালো একটা চাকরি দিয়ে দেবে। তাকে বলব?

না।

না কেন?

ম্যাডাম, আমি দুষ্ট লোকের চাকরি করি না। আমি হিমু হতে চাচ্ছি। হিমুরা দুষ্ট লোকের অধীনে কাজ করে না।

আমি কোনো চাকরি দিলে করবেন? আমি ম্যানেজার জাতীয় একজনকে খুঁজছিলাম।

ম্যাডাম, আপনার চাকরিও করব না।

আমি তো দুষ্ট লোক না। আমার চাকরি কেন করবেন না?

মুহিব বলল, এখন আপনি আমাকে দেখছেন খানিকটা বন্ধুর মতো। আমাকে নিয়ে টেবিলে খেতে বসছেন। আপনার চাকরি নেবার পরপর আপনি আমাকে দেখবেন বেতনভুক্ত কর্মচারীর মতো। আমাকে এক টেবিলে নিয়ে খেতে বসবেন। আমি যদি অভিনয় করি, আমার বিপরীতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করবেন।

নিলি বলল, খাওয়া দেয়া হয়েছে। খেতে আসুন। আর যদি আপনার আপত্তি না থাকে, আপনার বাবা কী সমস্যায় পড়েছেন সেটা বলুন।

মুহিব বলল, আমার বাবা একটা মেয়েকে রেপ করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। এখন হাজতে আছেন।

এই নিউজটাই কি পত্রিকায় এসেছে?

জি। ম্যাডাম, আমি কিছু খাব না। আমার মা এবং বোন সারাদিন আমার জন্যে অপেক্ষা করেছে। তাদের সঙ্গে দেখা হয় নি। তারা নিশ্চয়ই না খেয়ে আছে। ম্যাডাম, যাই! আপনার ছেলেটাকে দেখে এত ভালো লেগেছিল। কী মিষ্টি যে তার কথা! বলে কী— গোলাপ ফুল আমাকে গোঁতা দিয়েছে।

 

মুহিব বাসায় ফিরল না। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে থাকল। প্রথম উপস্থিত হলো আলাউদ্দিন কোচিং সেন্টারে। সাইনবোর্ড এখনো আছে। সাইনবোর্ড নামানো হয় নি। কাল-পরশুর মধ্যে নিশ্চয়ই নামিয়ে ফেলবে। কোচিং সেন্টারের চারদিকে তিনবার চক্কর দিল। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে গেল লীলাদের বাড়িতে। পুরো বাড়ি অন্ধকার, শুধু লীলার ঘরে বাতি জ্বলছে। অর্থাৎ লীলা জেগে আছে। মুহিব ঠিক করল, লীলার ঘরের বাতি না নেভা পর্যন্ত সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে। বাতির দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিছু না, একটা খেলা। অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তার সময় ছেলেমানুষী খেলা খেলতে ভালো লাগে।

মুহিব বাসায় ফিরল রাত তিনটায়। তার মা এবং অশ্রু দুজনই না খেয়ে অপেক্ষা করছে। ভয়ে এবং দুঃশ্চিন্তায় দুজনই অস্থির।

রাজিয়া বেগম বললেন, কোথায় ছিলিরে বাবা?

মুহিব বলল, রাস্তায় হাঁটছিলাম। গরম পানির ব্যবস্থা কর তো মা, গোসল করব। তোমরা খাওয়াদাওয়া করেছ?

না।

ঘরে রান্না কী?

রান্না হয় নাই। ডিম ভাজি করে দেই?

দাও।

তোর বাবার অবস্থা কী?

মুহিব বলল, বাবার আলাপ এখন থাকুক। বাবা ভালো আছেন। সিগারেট খাওয়া ধরেছেন। একজন হাজতি পাওয়া গেছে যে সিগারেটের বিনিময়ে বাবার পা টিপে দিচ্ছে।

রাজিয়া বললেন, আমাকে নিয়ে যাবি? দেখা করতাম।

দেখা করে কী বলবে?

রাজিয়া জবাব দিলেন না। গরম পানির ব্যবস্থা করতে গেলেন। অশ্রু ভাইয়ের পাশে বসে রইল।

মুহিব বলল, তোর ভূতটার খবর কী? এখনো খাটের নিচে বসে থাকে?

অশ্রু বলল, বাবার ঐ ঝামেলার পর ভূতটাকে দেখছি না।

মুহিব বলল, বাবার ঘটনায় তুই বিশাল এক ধাক্কার মতো খেয়েছিস। সেই ধাক্কা ভূত বাবাজির গায়েও লেগেছে, ভূত পালিয়েছে। আমার মনে হয় না তুই এই ভূত আর দেখবি। সব মন্দের একটা ভালো দিক আছে।

অশ্রু বলল, ভাইয়া, তোমার গা থেকে বিকট সিগারেটের গন্ধ আসছে।

মুহিব বলল, একটার পর একটা সন্তী সিগারেট খেয়ে যাচ্ছি। গন্ধ তো আসবেই। এখন একটা ধরাব। পানি গরম না হওয়া পর্যন্ত সিগারেট ব্রেক।

মুহিব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, শূন্যে ভাসা খেলা দেখবি?

শূন্যে ভাসা খেলা কী?

মুহিব বলল, আমি তোর চোখের সামনে শূন্যে ভেসে থাকব।

অশ্রু বলল, ভাইয়া, আমার মনে হয় তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

মুহিব বলল, সম্ভাবনা আছে। ইচ্ছা করছে সারাক্ষণ শুন্যে ভেসে থাকি।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ