পচা মাছের মাথা খেয়ে আমাদের কিছু হলো না, বাবার খুব শরীর খারাপ করল। পেট নেমে গেল, সেই সঙ্গে যুক্ত হল বমির উপসর্গ। ভাইয়া বলল, কলেরা বাঁধিয়ে বসেছ নাকি বাবা?

বাবা ক্ষীণ স্বরে বললেন, বাঁচব না রে। বাঁচব না। আমার দিন শেষ।

বাবার এই ঘোষণায় আমরা বিশেষ বিচলিত হলাম না কারণ সামান্য অসুখ বিসুখেই তিনি এজাতীয় ঘোষণা দেন যা মাকে খুব কাবু করে ফেলে। মা এবারো খুব কাবু হয়ে পড়লেন, ভাইয়াকে কাদো কাদো গলায় বললেন, একটা ভাল ডাক্তার আন। মানুষটা মরে যাচ্ছে দেখছিস না?

ভাইয়া সহজ গলায় বলল, যে কোন ডাক্তারই আসুক বাবাকে স্যালাইন ওয়াটারই দেবে। কাজেই চুপ করে বসে থাক। চিন্তার কিছু নেই। বাবার শরীর থেকে পচা মাছের সর্বশেষ অংশটা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত দাস্ত এবং বমি চলতেই থাকবে।

কি করে বুঝলি? তুই কি ডাক্তার?

এসব বুঝার জন্যে ডাক্তার হওয়া লাগে না মা। এগুলি হচ্ছে কমন সেন্স। আমার অন্য কোন সেন্স না থাকলেও কমন সেন্স খুব ভাল। কাল পরশুর মধ্যে দেখবে বাবা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছে।

যদি না বসে?

তখন ডাক্তার আনব।

বড় ডাক্তার আনতে হল না। বাবা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বরিশাল যাবার জন্য। বরিশাল থেকে সুপারি কিনে আনতে হবে। এইটাই নাকি ঠিক সময়।

মা অবাক হয়ে বললেন, এই শরীর নিয়ে তুমি বরিশাল যাবে কি করে?

বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি তো আর সাঁতার দিয়ে যাব না। লঞ্চে করে যাব। ডেকে বিছানা করে হাওয়া খেতে খেতে যাব।

মা বললেন, তোমাকে আর ছোটাছুটি করতে হবে না, ঘরে বসে থেকে যা পার কর। সংসার তুমি যতদিন পেরেছ টেনেছ। এখন রঞ্জু টানবে।

বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, ও টানবে কেন? এটা কি ওর সংসার না আমার সংসার? আমার ব্যবসার যা ধারা–ঘরে বসে থাকলে চলবে না জায়গায় জায়গায় যেতেই হবে।

ঠিক আছে। শরীর সারুক তারপর যাবে। এখন রঞ্জুকে গুছিয়ে বলে দাও ও সুপারি কিনে আনবে।

ও সুপারি কি কিনবে? সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। ঢাকা শহরে ভ্রাম্যমান পাগল কত প্রকার ও কি কি ওকে জিজ্ঞেস কর–ও বলে দেবে। সুপারির দর জিজ্ঞেস কর বলতে পারবে না।

শরীর পুরোপুরি না সারতেই বাবা বরিশাল যাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। আমরা সবাই প্রবল আপত্তি করলাম। শুধু আপা বলল–বাবা বাইরে গেলে ভালই হবে। অনেকদিন ঘরে থেকে মনটন খারাপ হয়ে আছে। আগের মত ঘোরাঘুরি শুরু করলে শরীর আরো তাড়াতাড়ি সারবে।

বাবার সবগুলি প্যান্ট ঢিলা হয়ে গেছে। পিছলে পড়ে যায়। বেল্ট নেই কাজেই পায়জামার দড়ি দিয়ে প্যান্ট পরা হল। তিনি এক হাতে স্যুটকেস অন্য হাতে দুটির ছোট্ট টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বিকেল চারটায় রিক্সায় উঠে বসলেন। তাঁর লঞ্চ দু টায়। ট্রাফিক জামে পড়ে যেন লঞ্চ মিস না করেন সে জন্যেই এত সাবধানতা।

চার দিনের মাথায় চলে আসব। খুব বেশী হলে এক সপ্তাহ। চিন্তার কোন কারণ নাই–আল্লাহ হাফেজ।

বাবা বাড়ি থেকে বেরুলেই মা মন খারাপ করেন। এবার অনেক বেশী মন খারাপ করলেন কারণ আগের রাতে তিনি নাকি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। মার দুঃস্বপ্নগুলি সাধারণত খুব জটিল হয়।

এটা তেমন জটিল না।

এক অন্ধ লোক ভিক্ষা চাইতে এসেছে। বাবা ভিক্ষা দিতে যাচ্ছেন, মা আপত্তি করছেন–ওর কাছে যেও না, ও আসলে ভিক্ষুক না, খুনী। ও তোমাকে খুন করবে। বাবা মার কথা শুনলেন না। কাছে গেলেন। অন্ধলোকটা তখন বিকট শব্দে হেসে উঠল। মার ঘুমও ভেঙ্গে গেল।

বাবার রিকশা বড় রাস্তায় পড়ার আগেই মা আমাদের কাজের মেয়েটিকে একটা কালো রঙের মুরগী কিনতে পাঠালেন। আগামীকাল ভোরে এই মুরগী কোন একজন অন্ধ ভিখারীকে ছদকা দেয়া হবে।

 

রাত বারোটার দিকে আমরা সবাই যখন ঘুমুতে যাচ্ছি–বাবা এসে উপস্থিত। ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, ব্যাপার কি? বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ব্যাপার কিছু না। হঠাৎ একটা জিনিস মনে পড়ল চলে এলাম।

কি মনে পড়ল?

না মানে, আগামীকাল দিনটা একটা বিশেষ দিন। ভুলেই গিয়েছিলাম …. লঞ্চে উঠে মনে পড়ল, চলে এলাম। একদিন পরেই যাই একদিনে কি হবে?

বিশেষ দিন মানে? কি হয়েছিল এই দিনে?

সে বিরাট ইতিহাস। আরেক দিন বলব।

আরেক দিন বললে হবে না। আজই বলতে হবে।

দেখা গেল–তেমন বিরাট ইতিহাস কিছু না। এই দিনে বাবা মার সঙ্গে প্রথম কথা বলেছেন। সেই কথাও নিতান্ত গদ্য ধরনের কথা। বাবা মার বাড়িতে অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাক্কি করার পর মা দরজা খুললেন। বাবা বললেন, এটা কি জয়নাল সাহেবের বাড়ি?

মা বললেন, হুঁ।

উনাকে একটু ডেকে দাও।

উনি বাড়িতে নাই।

বাবা চলে এলেন এবং আধঘণ্টা পর আবার গেলেন। আবারো একই কথাবার্তা হল। বাবা ফিরে এসে আবার আধঘণ্টা পর গেলেন। এইবার মা হেসে ফেলে বললেন, আপনি বার বার চলে যাচ্ছেন কেন? বসেন। বাবা বসলেন।

ভাইয়া বলল, ঐদিনই কি তোমরা দুজন দুজনের প্রেমে পড়লে?

আহ কি সব প্রশ্ন। তোর মা-কি ঘুমুচ্ছে না-কি? ডেকে তো। বিশেষ দিনটার কথা তোর মার মনে আছে কিনা কে জানে।

বিশেষ দিনটার কথা মারও মনে ছিল। তবে দিনটির প্রসঙ্গে মার বর্ণনা এবং বাবার বর্ণনা এক না। মার কথা মত বাবা পরপর তিনবার জয়নাল সাহেবের খোজ করলেন এবং প্রতিবারই বললেন, এক গ্লাস পানি খাব। শেষবার মা পানি দেন নি। লেবুর সরবত বানিয়ে দিয়েছিলেন। পানি ভেবে বাবা এক চুমুক দিলেন–তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। মুখ তুলে মার দিকে তাকাতেই মা হেসে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন।

মার দৌড়ে পালিয়ে যাবার ব্যাপারটা অবশ্যি আমার অনুমান। ঘটনা এমনই ঘটার কথা। আমার ভেবে খুব অবাক লাগে যে বাবা-মার চরিত্রের অসম্ভব রোমান্টিক দিকটি আমাদের তিন ভাই বোন কারোর মধ্যেই নেই। আপার মধ্যেতো ছিটেফোটাও নেই। ভাইয়ার মধ্যেও নেই–থাকলে দুলু আপার আবেগ তাঁর চোখে পড়ত। আমার নেই এইটুকু বলতে পারি। ছেলেরা যখন ভাব জমানো কথা বলে আমার কেন জানি গা জ্বলে যায়।

আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজন বান্ধবী আছে, মেরিন। তার বড় ভাই আর্কিটেকচারে ফোর্থ ইয়ারে পড়ে। আমাকে দেখলেই গদগদ ভাব করে। এমন বিশ্রী লাগে! সেদিন বলল, তোমার রেনু নামটা আমার পছন্দ না। তোমাকে এখন থেকে স্বর্ণরেনু ডাকলে কি তোমার খুব আপত্তি আছে?

আমি বললাম, কোন আপত্তি নেই, তবে আমিও এখন থেকে আপনাকে কবীর ভাই না ডেকে ডাকব–তাম্ৰ কবীর ভাই। আপনার আপত্তি নেই তো?

কবীর ভাই খুবই হকচকিয়ে গেলেন। মেয়েরা কথার পিঠে কথা বললে ছেলেরা ঠিক তাল রাখতে পারে না। তাদের চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। অকারণে রাগও করে। কবীর ভাই যে ঐ দিন খুব রাগ করেছিলেন তার প্রমাণ হল পরদিনই মেরিন আমাকে বলল, রেনু তুই আমার ভাইয়াকে অপমান করেছিস, ব্যাপার কি?

আমি বললাম–অপমান করিনি তো।

তুই ভাই, আমাদের বাসায় আর আসিস না। ভাইয়া খুব রাগ করেছে।

আমি মেরিনদের বাসায় আর যাই নি তবে কবীর ভাইয়ের সঙ্গে একদিন রাস্তায় দেখা হল। তিনি রিকশায় করে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন–আমি রাস্তার সবাইকে সচকিত করে ডাকতে লাগলাম–তাম্র ভাই, তাম্র ভাই।

রাগ, দুঃখ এবং বিস্ময়ে বেচারার মুখ কাল হয় গেল। তিনি রিকশা থামালেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, কোন দিকে যাচ্ছেন?

কেন?

আমার পথের দিকে হলে, আপনার সঙ্গে খানিকটা যেতাম। দুপুর রোদে হাঁটতে ভাল লাগছে না।

তুমি কোনদিকে যাবে?

এলিফেন্ট রোড।

আমি ঐদিকে যাচ্ছি না। আর শোন একটা কথা–তাম্র ভাই, তাম্র ভাই করছ কেন?

তাম্র কবীর ভাই বললে অনেক বড় হয়ে যায় এই জন্যে শর্ট করে বলছি। আপনি রাগ করলে আর বলব না।

কবীর ভাই তীব্র দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাপা কাপা গলায় বললেন–বেয়াদবী করবে না। বেয়াদবী করার বয়স তোমার এখনো হয় নি।

আমি কিন্তু বেয়াদবী করতে চাই নি। মজাই করতে চেয়েছিলাম। মজা করারও বোধ হয় বয়স আছে। সব বয়সে মজা করা যায় না। আমি ঠিক করে রেখেছি এর পরে যদি কখনো কবীর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় আমি খুব বিনয়ী ব্যবহার করব। হেসে হেসে কথা বলব। এখনো তার সঙ্গে দেখা হয় নি।

 

বাবা বরিশাল চলে যাবার পর পরই মা অসুখে পড়লেন। তেমন কিছু না, জ্বর।

ভাইয়া বলল, এই জ্বরের নাম হচ্ছে বিরহ-জ্বর। বাবার বিরহে কাতর হয়ে মার জ্বর এসে গেছে। হা-হা-হা।

মার শরীর খারাপ হওয়ায় আমার একটা লাভ হয়েছে–আমি এখন রাতে মার ঘরে ঘুমুচ্ছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাবা যখন থাকেন না তখনো মা তার ঘরে একা থাকেন। আমাকে বা আপাকে তার সঙ্গে ঘুমুবার জন্যে বলেন না। কোন ছোটবেলায় মার সঙ্গে ঘুমিয়েছি মনেই নেই। বড় হয়ে ঘুমুতে এসে লক্ষ্য করলাম, আমার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগছে। একটু সংকোচও লাগছে। যেন আমি অনধিকার প্রবেশ করছি। এই ঘরটা মার নিজের একটা জগৎ। এই জগতে আমার বা আমাদের কোন স্থান নেই। ঘরটা মা এবং বাবার।

মার সঙ্গে ঘুমানোর প্রাথমিক সংকোচ দ্বিতীয় রাতেই কেটে গেল। লক্ষ্য করলাম মা এমন ভাবে আমার সঙ্গে গল্প করছেন যেন তিনি আমার একজন বান্ধবী। বাতি নিভিয়ে গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, মীরা মাঝে মাঝে খুব কান্নাকাটি করে। কেন করে তুই জানিস?

না।

কাঁদে যে সেটা জানিস?

জানি।

কখনো জিজ্ঞেস করিস নি?

না।

জিজ্ঞেস করা উচিত না?

তুমি যদি বল তাহলে জিজ্ঞেস করব।

থাক, জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। বলার হলে নিজেই বলবে।

এই ভেবেই আমি কিছু জিজ্ঞেস করি নি মা।

ভাল করেছিস। আচ্ছা, রঞ্জু কি বিয়ে টিয়ের কথা কিছু ভাবছে?

জানি না তো মা।

দুলু মেয়েটাকে কি ও পছন্দ করে?

করে নিশ্চয়ই, তবে খুব করে বলে মনে হয় না।

মা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আর পছন্দ করলেই বা কি। ওরা তো আর বঞ্জুর সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেবে না। ওরা কোথায় আর আমরা কোথায়। আচ্ছা রেনু, দুলুর বাবা মন্ত্রী হচ্ছে এটা কি সত্যি?

জানি না তো। কে বলল তোমাকে?

শুনলাম।

হতেও পারে। খুব টাকা-পয়সাওয়ালা মানুষজনই তো মন্ত্রী হয়। উনার তো টাকা পয়সার অভাব নেই।

মন্ত্রী হলে ভাল হয়।

ভাল হবে কেন?

উনাকে ধরলে হয়ত তখন রঞ্জুর চাকরির একটা ব্যবস্থা হবে। আমরা প্রতিবেশী, আমাদের একটা কথা কি আর উনি ফেলবেন?

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, মন্ত্রীর কারো কথাই ফেলেন না মা। তাদের বিশাল একটা কালো বাক্স আছে–সবার কথাবার্তা তাঁরা ঐ বাক্সে রেখে তালা দিয়ে দেন। ঐ তালা আর খুলেন না।

মা হাসতে হাসতে বললেন, তুইও দেখি রঞ্জুর মত হয়ে যাচ্ছিস। মজা করে কথা বলিস। আচ্ছা শোন, রঞ্জু ঐ দিন আভা নামের কি একটা মেয়ের কথা বলছিল। ঐ মেয়েটিকে কি তার পছন্দ?

জানি না মা। ভাইয়া হচ্ছে এমন এক জাতের ছেলে কাউকেই যাদের খুব অপছন্দও হয় না আবার পছন্দও হয় না। এরা পছন্দ করে শুধু নিজেকে আর কাউকে না।

মা হাসতে হাসতে বললেন, তুই বুঝলি কি করে?

আমি বললাম, আমি নিজেও অবিকল ভাইয়ার মত, এই জন্যে বুঝেছি।

সাত দিনের ভেতর বাবার ফেরার কথা, তিনি ফিরলেন না। তার একটা চিঠি এল। এবার পোস্ট কার্ড না। খামে ভরা চিঠি। বিশেষ কাউকে লেখা না। সবার উদ্দেশ্যে লেখা–

পর সমাচার এই যে সুপারি কিনিতে পারি নাই। এইবার সুপারির দর অত্যধিক। ঝড়ে ফলন হয় নাই। অধিকাংশ সুপারির গাছ নষ্ট হইয়া গিয়াছে। অধিক দামে সুপারি ক্রয় করিতে পারি–তাহাতে খুব লাভ হইবে না। কারণ বেনাপোল দিয়া পার্টনার সুপারি দেশে আসিতেছে। তা দামেও সস্তা। কাজেই সিদ্ধান্ত নিয়াছি খুলনায় যাইব, অন্য কোন ব্যবসার সন্ধান দেখিব। সেখানে মধু সস্তা তবে মধুর তেমন বাজার নাই। প্রচুর বিদেশী মধু দেশে পাওয়া যায়। বিশেষ করিয়া অষ্ট্রেলিয়ার মধু দামেও সস্তা, গুণগত মানও খারাপ না। যাই হউক, এইসব নিয়া তোমরা চিন্তা করিবে না। আমি ভাল আছি। খাওয়া দাওয়া খুব সাবধানে করিতেছি। বাহিরের খাদ্য গ্রহণ করিতেছি না। স্বপাক আহার করিতেছি। আল্লাহর অসীম করুণায় স্বপাক খাইবার ব্যবস্থা হইয়াছে। খুব শীঘ্র তোমাদের সহিত সাক্ষাত হইবে। ইতি …

মার জ্বর সেরে গেছে। তিনি কাজকর্ম শুরু করেছেন। তবে তাকে দেখলে খুব দুর্বল এবং মামরা মনে হয়। তাঁর রাতে ঘুম হয় না। যতবার আমি জাগি, দেখি মা একটা হাতপাখা দুলাচ্ছেন। এই ঘরের একটা সিলিং ফ্যান ছিল, সেটা নষ্ট। ঠিক করানো হচ্ছে না কারণ আমরা আবার টাকা পয়সার কষ্টে পড়ে গেছি। ভাইয়ার শতদল পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেছে। এত খাটাখাটনি করে, ঢাকা শহরের ভ্রাম্যমান পাগল নিয়ে যে লেখাটা সে লিখেছে তা কোথাও ছাপা হয়নি। ঘরে পড়ে আছে। ভাইয়া কাজ জুটানের জন্যে খুব ছোটাছুটি করছে, লাভ হচ্ছে না।

আমি দুলু আপার কাছ থেকে প্রথমে তিনশ পরে দূশ টাকা এনেছি। সেই টাকাও শেষ। চরম দুঃসময়েও আমরা খুব স্বাভাবিক থাকতে পারি, এখন তাই আছি। ভাইয়া ত্যাগের মতই হাসি তামাশা করছে। সেদিন ভাত খাবার সময় বলল, ঢাকা শহরে সবচে সুখে কারা বাস করে জানিস খুকী? ঢাকা শহরে সবচে সুখে আছে–ভ্রাম্যমান পাগলের দল।

কেন?

এদের রোজগার খুব ভাল। যার কাছেই টাকা চায় সেই ভয়ে অস্থির হয়ে টাকা দিয়ে দেয়। পাগল মানুষ, কি করে ঠিক নেই তো। যে কোন রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ালে রেস্টুরেন্টের মালিক কিছু একটা খাবার হাতে ধরিয়ে দেয় যাতে তাড়াতাড়ি বিদেয় হয়। পুলিশ এদের কিছু বলে না। তাদের আছে পূর্ণ স্বাধীনতা। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা।

আপা বলল, ভিক্ষা না করে লোকজন পাগল সাজলেই পারে।

তা পারে। তবে পাগল সাজা খুব সহজ কাজ না। কঠিন কাজ। বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ব্যাপার আছে। পাগল হিসেবে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করার প্রথম শর্ত হচ্ছে সব কাপড় চোপড় খুলে ফেলতে হবে। যাতে দেখামাত্র লোকজন বুঝতে পারে এ পাগল। ঢাকা শহরের ভ্রাম্যমান পাগলদের শতকরা ৭০ ভাগ হল দিগম্বর। বানিয়ে বলছি না। হিসাব করে বলছি।

আমি বললাম, এর মধ্যে নকল পাগল নেই?

আছে। বেশ কয়েকটা নকল পাগল আছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে পাগলামীর অভিনয় করতে করতে অল্পদিনের মধ্যে এরা পাগল হয়ে যায়। এটা বেশ স্ট্রেঞ্জ একটা ব্যাপার।

তুমি দেখি ভাইয়া পাগল বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছ।

তা হয়েছি। বেশ কয়েকটা পাগলের সঙ্গে আমরা খাতিরও হয়েছে। শিক্ষা ভবনের সামনে ছালা গায়ে একটা পাগল বসে থাকে, আমাকে দেখলেই দৌড়ে এসে হাত ধরে টানতে টানতে চায়ের দোকানে নিয়ে যাবে। চা খাওয়াবে। সিগারেট খাওয়াবে।

আসল পাগল না নকল?

ওয়ান হানড্রেড পারসেন খাটি পাগল। এর বাবা এডভোকেট, ভাই বোন আছে। এক বোন গ্রীনলেজ ব্যাংকের ম্যানেজার।

এইসব জানলে কোত্থেকে? পাগল তোমাকে বলেছে?

আরে না। পাগল কোন কথা বলে না। খালি হাসে। এর নাম আমি দিয়েছি হাস্যমুখী। এইসব তথ্য আমি জেনেছি যেখানে চা খাই সেই দোকানের মালিকের কাছ থেকে। পাগলের বাবা ঐ দোকানে খাতা খুলে দিয়েছে। ছেলে যত কাপ চা খায় হিসাব থাকে। মাসের শেষে টাকা দিয়ে যান।

আমি বললাম, ওদের সঙ্গে এত ঘোরাঘুরি করো না তো ভাইয়া। শেষে তুমি নিজেও পাগল হয়ে যাবে।

পাগল হইনি তোকে বলল কে? গভীর রাতে তোরা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়িস তখন হা-হা করে আমি পাগলের মত হাসি।

আমি বললাম, পাগলরা হা হা করে হাসে না।

ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, দ্যাটস কারেক্ট। পাগলরা আসলেই হা হা করে হাসে না। অথচ আমরা কথায় কথায় বলি, পাগলের মত হা হা করে হাসছে। ওরা চিক্কার করে কাঁদেও না। আমার ধারণা কি জানিস যে মানুষ যত সুস্থ সে তত শব্দ করে হাসে, এবং কাঁদে।

আমি বললাম, অন্য কোন আলাপ কর তো ভাইয়া। এই প্রসঙ্গ আমার ভাল লাগছে না। প্রসঙ্গ পাল্টও।

পাল্টাচ্ছি। তুই কি তোর দুলুনী আপার কাছে থেকে আমাকে তিনশ টাকা এনে দিতে পারবি?

পারব।

আমার কথা বলবি না।

তোমার কথা বললে অসুবিধা কি?

অসুবিধা আছে। তুই বলবি তোর নিজের দরকার।

আমি টাকা আনতে গেলাম। কার দরকার কিছুই বলতে হল না। দুলু আপা। ড্রয়ার থেকে টাকা বের করতে করতে বললেন, রেনু তোদের কি খুব অসুবিধা যাচ্ছে?

আমি বললাম, । তবে সাময়িক। বাবার একটা বড় বিল আটকে আছে। কয়েকদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে।

ও আচ্ছা।

ভাইয়া যদি একটু সংসারী হত তাহলে কোন সমস্যাই হত না। সে একবার বিদেশী কোম্পানীর চাকরির অফার পেয়েছিল। বেতন শুনে তুমি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

কত বেতন?

কুড়ি। টুয়েন্টি থাউজেন্ড।

বলিস কি?

ভাইয়া রাজি হল না। বলে দূর দূর–।

দূর দূর বলল কেন?

জাহাজের চাকরি তো। জাহাজে জাহাজে থাকতে হয়। ভাইয়ার পছন্দ না।

দুলু আপা মৃদু স্বরে বললেন, জাহাজের চাকরি তো খুব ইন্টারেস্টিং হওয়ার কথা। সব সময় পানির উপর থাকা। চাকরিটা নিলেই পারত।

আমরা অনেক বুঝিয়েছি। ভাইয়া রাজি হয়নি।

কথাবার্তা চালিয়ে যেতে আমার অস্বস্তি লাগছে। যা বলছি সবই মিথ্যা। কে ভাইয়াকে কুড়ি হাজার টাকার চাকরি দেবে? টাকা তো এত সস্তা এখনো হয় নি।

মিথ্যা কথা বলার আমার এই বিশ্রী স্বভাবটার কথা কি আপনাকে বলেছি? বলেছি বোধ হয়। মিথ্যা বলতে আমার খুব যে ভাল লাগে তা না তবু হঠাৎ হঠাৎ বলতে হয়। দুলু আপার সঙ্গে যখন মিথ্যা বলি তখন সত্যি খুব খারাপ লাগে।

এই যেমন এখন লাগছে। ইচ্ছা করছে তার হাত ধরে বলি–আপা যা বলেছি সব কিছু মিথ্যা। কিছু মনে করো না।

দুলু আপা বলল, বাদামের সরবত খাবি?

বাদামের আবার সরবত হয় নাকি?

হয়। পেস্তা বাদাম হামা দিস্তায় পিষে সরবত বানায়।

সেই সব সরবত তো পালোয়ানরা খায় বলে জানি।

খেয়ে দেখ, খেতে খুব ভাল।

না আপা সরবত খাব না। এখন যাব।

দুলু আপা অন্যমনস্ক গলায় বলল, আচ্ছা শোন, তোর ভাইয়া মাঝে মাঝে গভীর রাতে এমন হা হা করে হাসে কেন?

জানি না কেন? মনে হয় পাগল হওয়ার চেষ্টা করছে।

দুলু আপা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত স্বরে বললেন, পাগল হবার চেষ্টা করছে মানে?

ঠাট্টা করছি আপা।

না, তুই ঠাট্টা করছিস না–ব্যাপারটা কি বল তো?

ব্যাপার কিছু না। ভাইয়া পাগলদের উপর গবেষণা করছে তো। কাজেই মাঝে মাঝে পাগলের মত আচরণ করে। হা হা করে হাসে। তবে আপা হা হা করে হাসি কিন্তু পাগলের লক্ষণ না। পাগলেরা হা হা করে হাসতে পারে না।

কে বলল?

ভাইয়া বলেছে।

দুলু আপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন–ঐ দিন তোর ভাইয়াকে রাস্তায় দেখলাম। সঙ্গে রোগামত একটি মেয়ে। দুজন খুব হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে। ঐ মেয়েটা কে?

খুব সম্ভব আভা। সেও একজন পাগল বিশেষজ্ঞ। ওরা দুজন মিলে পাগল খুঁজে বেড়ায়।

কি যে কথা তুই বলিস না রেনু। তুই কি সব সময় এমন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলিস?

আমি কিছু বললাম না। ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলাম। এমন হাসি যার অনেক রকম অর্থ হতে পারে। দুলু আপা বললেন, তোরা তিন ভাইবোন সম্পূর্ণ তিন রকম। কারোর সঙ্গে কারোর মিল নেই।

উঠি আপা?

না না বোস। আরেকটু বোস। পা উঠিয়ে আরাম করে বোস। তুই এসেই শুধু যাই যাই করিস কেন?

আচ্ছা ঠিক আছে। আজ আর যাব না। থাকব তোমার এখানে। রাতে ঘুমাব।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

তাহলে আয় ছাদে পাটি পেতে সারারাত কাটিয়ে দি। বৃষ্টির মধ্যে পাটি পেতে শুয়ে দেখেছিস? দারুন ইন্টারেস্টিং। শুদু বাতাস যখন বয় তখন খুব ঠাণ্ডা লাগে।

আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি কিন্তু আপা একজন গ শ্রেণীর পাগল।

গ শ্রেণীর পাগল মানে?

তিন ক্যাটাগরীর পাগল আছে। ক, খ ও গ। তুমি গ ক্যাটাগরী।

কি সব উদ্ভট তোর কথাবার্তা। অন্য গল্প কর।

অন্য কি গল্প?

ঐ মেয়েটির কথা বল।

কোন মেয়েটির কথা?

আভা।

আভার কথা কি বলব?

যা জানিস সব বলবি।

আমি কিছুই জানি না। ঐ মেয়েটিকে কখনো দেখিনি।

সে কি?

সত্যি দেখিনি। এ বাড়িতে কখনো আসে নি।

দুলু আপা আগ্রহ নিয়ে বললেন, এলে তুই কি আমকে খবর দিবি?

হুঁ দেব।

অনেষ্ট।

অনেষ্ট।

আভার সঙ্গে দেখা হল পরদিন। দুপুর বেলা দরজা খট খট করছে। আমি দরজা খুলতেই রোগমত মেয়েটি বলল, রেনু ভাল আছ? শুরুতেই মেয়েটা আমাকে খানিকটা হকচকিয়ে দিল। হয়ত ইচ্ছা করেই দিল। মানুষকে হকচকিয়ে দিতে সবাই পছন্দ করে। আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম, আমি ভাল আছি।

তুমি কি আমাকে চেন?

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, না। যদিও আমি তাঁকে খুব ভাল করেই চিনেছি। রোদে ঘুরে মুখ লাল টকটকে হয়ে আছে। মাথার চুল উড়ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব তৃষ্ণার্ত। তৃষ্ণার্ত মানুষের ঠোঁট শুকিয়ে থাকে।

রঞ্জু কি ঘরে আছে?

আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়ে ভাইয়ার চেয়ে খুব কম করে হলেও চার পাঁচ বছরের ছোট। অথচ কত অবলীলায় বলছে, রঞ্জু কি ঘরে আছে?

আমি শুকনো গলায় বললাম, না।

আমাকে একটা জিনিস দেবার কথা। তোমাকে কিছু বলে যায় নি?

না তো।

আমি খানিকক্ষণ বসি? বসুন।

আমি তাঁকে ভাইয়ার ঘরে নিয়ে গেলাম। আভা বিছানায় বসতে বসতে বলল, তুমি আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াও। ঠাণ্ডা পানি। তোমাদের বাসায় কি ফ্রীজ আছে?

না, ফ্রীজ নেই।

দুলুদের বাসায় নিশ্চয়ই আছে। ওদের কাছ কাছ থেকে ঠাণ্ডা এক বোতল পানি এনে দেবে? তৃষ্ণায় আমার সমস্ত শরীর শুকিয়ে গেছে। খুব ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছে করছে।

আমি পানি আনতে গেলাম। এক সঙ্গে দুটি কাজ হবে। দুলু আপাকেও বলা হবে–আভা এসেছে। আভার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কথা বলতে পারবেন।

দুলু আপা বাসায় ছিলেন না। তাঁর নানুর বাড়ি গিয়েছেন। সন্ধ্যার আগে ফিরবেন না। আমি পানির বোতল নিয়ে ফিরে এসে দেখি ভাইয়ার টেবিল থেকে একটা পেপারওয়েট নিয়ে আভা তার স্যাণ্ডেলে কি যেন ঠুকঠাক করছে। আমাকে দেখে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল–পেরেক উঁচু হয়ে আছে? পা কেটে রক্তারক্তি। আজকাল কোন স্যাণ্ডেলে পেরেক থাকে না। গাম দিয়ে জোড়া লাগানো হয়। আমার ভাগে কি করে যেন পড়ল পেরেক লাগানো স্যাণ্ডেল।

নিন, পানি নিন।

টেবিলের উপর রাখ। তোমাদের বাসায় লোকজন নেই? খালি খালি লাগছে।

না। আমি একাই আছি।

বাকিরা কোথায়?

এক বিয়েতে গেছেন?

কার বিয়ে?

আমি নিতান্তই বিরক্তি বোধ করছি। কার বিয়ে তা দিয়ে উনার প্রয়োজনটা কি? আমি বললাম, যার বিয়ে তাকে আপনি চিনবেন না।

আমি তোমাদের সব আত্মীয়-স্বজনকে চিনি। রঞ্জু আমাকে বলেছে।

বললামতো তাকে আপনি চিনবেন না। সে আমাদের কোন আত্মীয় নয়–আপার বান্ধবী। আপা একা কোথাও যায় না বলেই মাকে নিয়ে গেছে।

আভা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, মীরার বান্ধবী? ইয়াসমিনের কথা বলছ? যার এক ভাই জাপান এম্বেসীর ফার্স্ট সেক্রেটারী?

আমি শুকনো গলায় বললাম, হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন।

রঞ্জু আর আমি কিছুদিন দীর্ঘ সময় এক সঙ্গে ঘোরাঘুরি করেছি–তখন কথা হয়েছে। আমি বললাম না–তোমাদের সব কথা জানি। তুমি তো আমার কথা বিশ্বাস করনি।

এখন করছি। আপনি কিন্তু পানি খান নি।

খাব। আচ্ছা শোন রেনু, তুমি কি আমাকে বিসর্কিট বা এই জাতীয় কিছু দিতে পারবে? ঘরে আছে? সারাদিন কিছু খাইনি তো। সেই ভোর সাতটায় দুকাপ চা আর একটা টোস্ট বিসকিট খেয়েছি। এখন বাজে দুটা। সাত ঘণ্টা। খালি পেটে চা খেলে কি হবে জান? হড় হড় করে সব বমি হয়ে যাবে।

আপনি কি ভাত খাবেন? আমি এখনো খাইনি, আমার সঙ্গে খেতে পারেন।

তোমার কম পড়বে না তো আবার?

না কম পড়বে না। তবে খাওয়ার তেমন নি

আভা হাসতে হাসতে বলল, কিছু লাগবে না। তুমি বোধ হয় জান না আমি শুধু ভাত খেতে পারি। খুব গরম ভাত লবণ ছিটিয়ে খেয়ে দেখো, ইন্টারেস্টিং লাগে। ভাতের আসল স্বাদ পাওয়া যায়। তরকারী দিয়ে খেলে ভাতের আসল স্বাদ পাওয়া যায় না।

আপনি কি হাত মুখ ধুবেন?

হ্যাঁ ধোব। তুমি যদি রাগ না কর তাহলে আমাকে একটা শাড়ি দাও। গোসল করে ফেলি। ঘামে সারা শরীর চটচট করছে। গা না ধুয়ে কিছু খেতে পারব না। আমার কথাবার্তায় তুমি রাগ করছ না তো।

না রাগ করছি না।

রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছ কিন্তু।

আমার চোখগুলিই ও রকম।

তোমার চোখ খুব সুন্দর। আমি মন-রাখা কথা বলি না। সত্যি কথা তোমাকে বললাম।

নিতান্তই অপরিচিত একটা বাসায় কোন মেয়ে এত সহজ স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। খুব বোকা ধরনের মেয়েরা হয়ত করলেও করতে পারে। কিন্তু আভা বোকা নয়। চালাক মেয়ে।

সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গোসল সারল। চিরুনী দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াতে আচড়াতে বলল–এই বুঝি তোমাদের সেই একের ভেতর দুই আয়না? বা সুন্দর তো!

খেতে বসতে বসতে আমাদের তিনটা বেজে গেল।

অভা খেতে পারল না। অল্প চারটা ভাত মুখে দিয়েই বলল, রেনু, আমি (খতে পারছি না। আমার জ্বর আসছে।

কেউ জ্বর আসছে বললে হাত বাড়িয়ে তার গায়ের উত্তাপ পরীক্ষা করা ভদ্রতা। আমার তা করতে ইচ্ছা করল না। আমি চুপ করে রইলাম। আভা থালা সরিয়ে উঠে পড়ল।

রেনু, আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি?

থাকুন।

খাওয়া শেষ হলে তুমি আমার গায়ে একটা চাদর টাদর কিছু দিয়ে দিও তো। খুব শীত লাগছে।

ঘরে প্যারাসিটামল আছে। খাবেন?

না। আমি ট্যাবলেট খেতে পারি না। বমি হয়ে যায়।

আমি খাওয়া শেষ করে থালা বাসন গুছিয়ে ভাইয়ার ঘরে গিয়ে দেখি–আভা তার পুরানো কাপড়গুলি পরে চুপচাপ বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, বাসায় চলে যাব রেনু। জ্বর খুব বাড়বে। আমার মনে হয় এখনি বেড়েছে। দেখ, গায়ে হাত দিয়ে দেখ।

এরপর জ্বর না দেখলে খারাপ দেখায়। আমি গায়ে হাত দিয়ে রীতিমত চমকে উঠলাম। গা পুড়ে যাচ্ছে। এতটা জ্বর নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কেউ কথা বলছে কি করে কে জানে।

অপা আপনি শুয়ে থাকুন।

পাগল। এখন শুয়ে থাকা যাবে না। শোন বেনু, আমাকে রিকশা ভাড়া দিতে পারবে? এই অবস্থায় হেঁটে যাওয়া সম্ভব না। আমি এসেছিলাম কি জন্যে জান? টাকা ধার করতে। রঞ্জুকে বলেছিলাম শ তিনেক টাকা জোগাড় করে রাখতে। যার সঙ্গেই আমার সামান্য পরিচয় হয় তার কাছেই আমি টাকা ধার চাই। কি বিশ্রী অবস্থা। আমি ভেবেছিলাম রঞ্জুর কাছে কোনদিন ধার চাইব না। মানুষ যা ভাবে তা করতে পারে না।

ভাইয়া সম্ভবত আপনার জন্য টাকার ব্যবস্থা করেছে।

বলেছিল করবে। তোমাকে দিয়ে দুলুর কাছ থেকে আনবে। এই দেখ, তোমাদের সব কথা আমি জানি। রেনু, আমাকে রিকশা ভাড়া দাও। আমি চলে যাই। আর শোন, এই কাজে আমার বাসার ঠিকানা লিখে দিলাম–রঞ্জকে দেবে।

ভাইয়া তো আপনার বাসা চেনে।

এই বাসাটা চেনে না। আমরা বেশী দিন এক বাসায় থাকি না। ভাড়া জামে যায়, তারপর বাসা বদলাই।

আভা হেসে ফেলল যেন খুব মজার কোন কথা।

আমার কাছে একটা দশ টাকার নোট ছিল। আগামীকাল কলেজে যাবার ভাড়া। নোটটা এনে দিলাম।

আভা বলল, রেনু যাই। রঞ্জুকে কাগজটা দিও।

দুঃখের ব্যাপার কি জানেন? ভাইয়াকে আমি কাগজটা দিতে পারলাম না। টেবিলের উপর বই-চাপা দিয়ে রেখেছিলাম–ভাইয়া বাসায় ফিরলে কাগজটা পেলাম না। পুরো টেবিল দু তিনবার খোঁজা হল। কাগজ পাওয়া গেল না। ভাইয়া বলল, বাদ দে। আভাই আসবে। আমার সমস্যা আছে। আমি ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারি না। ঠিকানা থাকা না থাকা আমার কাছে একই।

এত জ্বর নিয়ে গেল তুমি তাকে দেখতে যাবে না?

ঠিকানা নাই, যাব কি করে? টাকাটা খামে ভরে তোর কাছে দিয়ে দিচ্ছি। এর পর যখন আভা আসবে তাকে দিয়ে দিবি। ও কালই আসবে।

উনি কাল আসবেন না। তুমি যদি না যাও উনি আসবেন না।

কে বলল তোকে?

আমি জানি।

তোদের বয়েসী মেয়েদের সবচে বড় সমস্যা কি জানিস? তোদের বয়েসী মেয়েরা মনে করে তারা পৃথিবীর সব কিছুই জানে। আসলে কিছুই জানে না। আভা কালই আসবে। দশ টাকা বাজি।

আভা এল না। এক মাস পার হয়ে গেল–তারপরেও না। ভাইয়া পুরানো বাড়িওয়ালার কাছে খোঁজ নিতে গিয়েছিল। সে রেগে ভূত হয়ে আছে। ভাইয়াকে এই মারেতো সেই মারে অবস্থা।

এই মেয়ে কি আপনার আত্মীয়? স্ট্রেট জবাব দেন। ভয়ংকর মেয়ে–রাত আটটার সময় আমাকে বলল, চাচা কাল দুপুরে বারটার মধ্যে চারমাসের ভাড়া দিয়ে দেব। খুব লজ্জিত, এত দেরী করলাম। বেশ কিছু টাকা পেয়েছি। চেক। ব্যাংকে জমা দিয়েছি। কাল ক্যাশ হবে। প্রথম টাকাটা তুলেই আপনাকে দেব।

আমি বললাম, ভাল কথা। তারপর মেয়েকে চা-টা খাওয়ালাম। সে হাসি মুখে খাওয়া-দাওয়া করল। আমার ছেলে ভিডিও ক্লাব থেকে উত্তম-সুচিত্রার পুরানো বাংলা ছবি এনেছে। মেয়ে বলল, ছবিটা এখন দিও না। একটু পরে দাও। আমিও দেখব।

আমার ছেলে বলল, আচ্ছা। তারপর মেয়ে করল কি সবাইকে নিয়ে বেবী টেক্সি করে বিদায়। ঘরবাড়ি খা খা করছে। বিছানা বালিশ সব আগেই সরিয়েছে। একটা একটা করে সরিয়েছে। কিছু টের পাই নাই।

অনেক মেয়ে দেখেছি জীবনে। এমন মেয়ে কিন্তু দেখি নাই। এখন আপনি বলেন–তার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কি।

কোন সম্পর্ক নেই।

সম্পর্ক নেই বললে তো হবে না। আপনি জোয়ান ছেলে আর সেও সুন্দরী মেয়ে। সম্পর্ক আছেই–তবে সাবধান করে দিচ্ছি। চার নম্বর দূরবর্তী বিপদ সংকেত। যত দূরে থাকবেন–তত ভাল থাকবেন। বৃদ্ধ মানুষের এই উপদেশ মনে রাখবেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ