বিবাহিত পুরুষ সন্ধ্যার পর ঘরে থাকবে

বিবাহিত পুরুষ সন্ধ্যার পর ঘরে থাকবে। সন্ধ্যায় সে ঘরে ফিরবে। স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যাদের নিয়ে সময় কাটাবে। মনোয়ারার এই কথাগুলো রীনার খুব মনে ধরলেও সে জানে এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। পুরুষমানুষ মানেই–একটা অংশ ঘরের বাইরে। ভালো না লাগলেও এটা স্বীকার করে নিতে হবে। রীনা স্বীকার করে নিয়েছে।

তারেককে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে জামাকাপড় পরতে দেখেও চুপ করে রইল। তারেক বলল, দেখি একটা চিরুনি দাও তো চুলটা আঁচড়াই। রীনা চিরুনি এনে দিল এবং হঠাৎ লজ্জিত মুখে বলল, মাথাটা নিচু করা–চুল আঁচড়ে দেই। বিয়ের পর অনেক দিন রীনা তারেকের চুল আঁচড়ে দিয়েছে। তারপর এক সময় সংসারে টগর-পলাশ এলোরীনা ব্যস্ত হয়ে পড়ল সংসার নিয়ে। অফিসে যাবার সময় স্বামীর চুল আঁচড়ানো বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হওয়াটা ঠিক হয় নি। তার অবশ্যই উচিত ছিল স্বামীর জন্যে কিছুটা সময় আলাদা করে রাখা; রাখলে তারেকের বাইরে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসটা নিশ্চয়ই কিছু কমত।

তোমার চুল খুব লম্বা হয়েছে। চুল কাটাও না কেন?

কাটাব।

সন্ধ্যাবেলা যাচ্ছে কোথায়?

তারেক বলল, নাপিতের কাছে যাব। চুল কাটাব। চুল লম্বা হয়ে কানে লাগছে–অসহ্য।

রীনার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তারেক মিথ্যা কথা বলছে। সন্ধ্যাবেলা সে নাপিতের কাছে চুল কাটাতে যাচ্ছে না। চুল কাটার প্রসঙ্গ উঠছে বলেই সে ফিট করে বলল। চুল কাটাতে যাচ্ছি। মানুষটা গুছিয়ে মিথ্যা কথাও বলতে পারে না। বেচারা।

তারেক বলল, জুতার ব্রাশটা দাও তো জুতাজোড়া কালি করি।

রীনা নিজেই জুতা কালি করতে বসল। তারেক মোজা পায়ে অপেক্ষা করছে। রানার কেমন যেন মায়া লাগছে। এই মায়ার উৎস সে জানে না। রীনা বলল, সেজোগুজে নাপিতের কাছে চুল কাটাতে যাচ্ছে?

তারেক বলল, সাজের কী দেখলে ঐ জুতা ময়লা হয়েছিল।

ফিরতে দেরি হবে?

দেরি হবে কেন? চুল কাটাতে যতক্ষণ লাগে।

রানার মনে হলো সে শুধু শুধুই সন্দেহ করছিল। বেচারা আসলে চুল কাটাতেই যাচ্ছে। সরল ধরনের মানুষের কর্মকাণ্ডও সরলু প্রকৃতির হয়। নাপিতের দােকানে যে জুতা ব্ৰাশ করে যাবার দরকার নেই তা মনে থাকে না।

তারেক চলে যাবার পর রীনার নিজেকে খুব একলা মনে হতে লাগল। সবাই কাজকর্ম করছে শুধু তার কিছু করার নেই। টগর-পলাশ তার দাদুভাইয়ের সঙ্গে পড়তে বসেছে। তার শাশুড়ি বসেছেন জায়নামাজে। ন’টার আগে তিনি উঠবেন না।

লায়লা পড়ছে। তার পড়া বাচ্চাদের মতো। শব্দ করে সে পড়া মুখস্থ করে।

হাসান আজ বের হয় নি। ঘরে আছে। তার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করা যায়। রীনার ইচ্ছা করছে না। মাকে চিঠি লিখবো। অনেকদিন মাকে চিঠি লেখা হয় না। রকিবের দেয়া কলামটায় এখনো কিছু লেখা হয় নি। রানার মনে হলো প্রথম চিঠিটা মাকে না লিখে তারেককে লিখলে কেমন হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার সে তার স্বামীকে এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি লেখে নি। চিঠি লেখার প্রয়োজন হয় নি। বিয়ের আগে তাদের পরিচয় ছিল না যে চিঠি লেখালেখি হবে। বিয়ের পর থেকে তো তারা একসঙ্গে আছে। চিঠি লেখার দরকার কী? আজ একটা চিঠি লিখে ফেললে কেমন হয়? রীনা কাগজের খোজে লায়লার ঘরে ঢুকাল। লায়লা সঙ্গে সঙ্গে বই বন্ধ করে হাসিমুখে তাকাল।

এক টুকরা কাগজ দিতে পারবে লায়লা?

হ্যাঁ পারব। ভাবি তোমাকে আজ এমন দুঃখী দুঃখী লাগছে কেন?

দুঃখী দুঃখী লাগছে?

খুব দুঃখী দুঃখী লাগছে। বোস, বল তোমার কী দুঃখ?

আমার কোনো দুঃখ নেই লায়লা।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। তোমার মনে কি কোনো দুঃখ আছে?

হুঁ।

কী দুঃখ?

বলা যাবে না, বললে তুমি হাসবে।

মানুষের দুঃখ শুনে আমি হাসব। আমি কি এতই খারাপ?

লায়লা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার দুঃখ খুবই হাস্যকর। আমার সব সময় মনে হয় আমার বিয়েটিয়ে হবে না।

বিয়ে হবে না?

চেহারা ভালো না। রঙেও ময়লা।

তোমার চেহারা ভালো না কে বলল? আর শ্যামলা মেয়েদের বুঝি বিয়ে হয় না? সবচে’ ভালো বিয়ে হয় শ্যামলা মেয়েদের এটা কি তুমি জান?

না জানি না। সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। তোমার বিয়ে নিয়ে তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না তো লায়লা। যথাসময়ে বিয়ে হবে।

আমার বিয়ে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। কোনো সম্বন্ধ আসে না। তোমরা তো কখনো কিছু বল না।

তোমার সামনে বলি না। তবে আড়ালে সব সময় বলি। অনেক ছেলে দেখাও হয়েছে।

সত্যি ভাবি?

অবশ্যই সত্যি। দেখি এখন আমাকে একটা কাগজ দাও।

লায়লা কাগজ দিতে দিতে লজ্জিত গলায় বলল, ভাবি নিজের বিয়ে নিয়ে এতগুলো কথা বললাম, আমার এখন খুব লজ্জা লাগছে।

লজ্জার কিছু নেই। তুমি পড়াশোনা কর।

লায়লা সঙ্গে সঙ্গে গুনগুন করতে শুরু করল। লায়লার জন্যে রীনার খুব মায়া লাগছে। তার বিয়ে নিয়ে আসলেই কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না। হওয়া উচিত। রীনা নিজের ঘরে ঢুকে চিঠি লিখতে বসল। সে দীর্ঘ সময় নিয়ে তার স্বামীকে ছোট্ট একটা চিঠি লিখল। সে চিঠি পড়ে নিজেই খুব লজ্জা পেল। চিঠিটা ড্রয়ারের অনেক নিচে লুকিয়ে রাখল। আজই চিঠি দিতে হবে এমন না। কোনো এক সময় দিলেই হবে। রীনা বারান্দায় এসে বসল। তার এক ভাবটা কাটছে না।

 

হাসানের ঘর বন্ধ। সে বিছানায় উপুড় হয়ে চিঠি লিখছে। তিতলীর কাছে চিঠি। তেমন এগোচ্ছে না। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ এ ছাড়া তিতলীকে তার লেখার কিছু নেই। সে কোনো বড় লেখক বা কবি হলে এই বাক্যটি ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে দীর্ঘচিঠি লিখতে পারত। লেখালেখির হাত তার একবারেই নেই। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ ছাড়া তিতলীকে তার আর কী লেখার আছে? ‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে’–হ্যাঁ এই বাক্যটাও লেখা যায়। তিতলীকে তার সবসময় দেখতে ইচ্ছা করে। বিয়ের পরেও কি এই ইচ্ছাটা থাকবে? নাকি প্রেমে ভাটা পড়বে? দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখমুখ শক্ত করে ঝগড়া করবে? হাসান লিখল,

তিতলী
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।

হাতের লেখাটা ভালো হলো না। অক্ষরগুলো কেমন জড়িয়ে গেছে। তার হাতের লেখা ভালো না। তিতলীর হাতের লেখা অপূর্ব। গোটা গোটা অক্ষর। জড়ানো না, পেঁচানো না। প্রতিটা অক্ষর আলাদা। প্রতিটি শব্দ হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে।

দরজায় টক টক শব্দ হলো। হাসান ভুরু কুঁচকে তাকাল। যতক্ষণ দরজা খোলা থাকে। কেউ আসে না। দরজা বন্ধ করা মাত্র দরজা ধাক্কাধাকি শুরু হয়। সে কাগজ-কলম নিয়ে বসার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনবার উঠে দরজা খুলতে হয়েছে। এবারেরটা নিয়ে হবে চতুর্থবোর। অথচ মাত্র একটা লাইন লেখা হয়েছে।

কে?

রীনা।

হাসান ধড়মড় করে বিছানা থেকে নামল। রীনা ভাবির কিছু কিছু ব্যাপার আছে বেশ মজার। সবাই ‘কে?’ প্রশ্নের জবাবে বলে আমি। একমাত্র রীনা ভাবিই ‘কে?’-র উত্তরে বলবে—রীনা।

দরজা বন্ধ করে কী করছিলে?

কিছু করছিলাম না। উপুড়পটাং হয়ে পড়েছিলাম

উপুড়পটাং আবার কী?

চিৎপটাং-এর উল্টোটা উপুড়পটাং।

চিঠি লিখছিলে?

হুঁ।

তোমার সেই তিতলী বেগমকে?

হুঁ।

মেয়েটাকে একদিন নিয়ে আসতে পার না?

পারি।

একদিন নিয়ে এসো। জমিয়ে আডডা দেব।

আচ্ছা।

তোমার এই চিঠি কি এক্ষুণি লিখতে হবে, না কিছুক্ষণ পর লিখলেও হবে?

পরে লিখলেও হবে।

আমি আসলে তোমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। বাচ্চারা পড়ছে। একা একা আমার দেখি কিছু ভালো লাগছে না।

গল্প কর–আমি শুনি।

রীনা খাটের এক মাথায় বসতে বসতে বলল, আমি কোনো গল্প করব না। আমার কাছে গল্প নেই। তুমি সারা শহর ঘুরে বেড়াও তুমি গল্প কর আমি শুনি।

হিশামুদিন সাহেবের গল্প বলব? তাঁর জীবন কাহিনী।

দূর দূর–তার জীবন কাহিনী শুনে কী হবে? একটা লোক একগাদা টাকা করেছে বলেই তার জীবন কাহিনী শুনতে হবে?

কমলার মা ট্রে নিয়ে ঢুকল। ট্রেতে দু কাপ চা। রীনা বলল, গল্প করার প্রস্তুতি দেখছি। কমলার মাকে বলেছি–আধঘণ্টা পর পর দু কাপ করে চা দিয়ে যেতে।

হাসান বুলল, তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুমি আসলে গল্প শুনতে আস নি। কিছু বলতে এসেছ? সেটা কী?

তুমি কি মিসির আলি হয়ে গেছ? ভাবভঙ্গি দেখে মনের কথা বলে ফেলছি। শুনুন মিসির আলি সাহেব–আমি গল্প শুনতেই এসেছি–কিছু বলতে আসি নি।

ভূতের গল্প শুনবে ভাবি?

ভূতের গল্প শোনা যেতে পারে। তবে ঝড়বৃষ্টির রাত ছাড়া ভূতের গল্প জমে না। তুমি জমাতে পারবে তো?

পারব। আমি যে কজনকে এই গল্প বলেছি তারা সবাই সেই রাতে ঘুমোতে পারে নি। গল্পটা ঠিক ভূতেরও না। একটা ফ্যামিলিতে দুটা কিশোরী মেয়ে খুন হয় তার গল্প।

বল শুনি।

দাঁড়াও একটা সিগারেট খেয়ে নি।

হাসান সিগারেট বের করল। রীনা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, গত কয়েকদিন ধরে তোমার ভাই একটা অদ্ভুত ব্যাপার করছে–এর মানেটা কী বল তো।

অদ্ভুত ব্যাপারটা কী?

যেমন ধর–পরশুদিন রাতে ঘুমোতে গেছি। বাতি নিভিয়ে মশারির ভেতর ঢুকতেই সে বলল-লাবণী আমার মনে হয় মশারির ভেতর মশা আছে। বাতি জ্বলিয়ে মশাগুলো মেরে নাও।

হাসান তাকিয়ে আছে। ভাবির গল্প করতে আসার কারণটা এখন তার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।

হাসান।

জ্বি ভাবি।

তোমার ভাইয়ের এই অদ্ভুত আচরণের অর্থ কী? মশারির ভেতর শুয়ে শুয়ে সে নিশ্চয়ই লাবণী নামের কোনো মেয়ের কথা ভাবছিল। মাথার মধ্যে সেই নামটা ঘুরছিল। ফস করে মুখ দিয়ে বের হয়ে পড়েছে।

তুমি কিছু জিজ্ঞেস কর নি?

না। আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই বাতি জ্বলিয়ে মশা মারলাম। তারপর বাথরুমে হাত ধুয়ে ঘুমোতে গেলাম। সারারাত আমার এক ফোঁটা ঘুম হলো না। তোমার ভাই অবশ্যি তার স্বভাবমতো কিছুক্ষণের মধ্যে নাক ডাকিয়ে ভস ভস করে ঘুমোতে শুরু করল।

সামান্য একটা কারণে তোমার সারারাত ঘুম হলো না?

কারণটা তুমি যত সামান্য ভাবিছ তত সামান্য না। আরো একবার এ রকম হয়েছে। আমাকে রীনা ডাকার বদলে লাবণী ডেকেছে।

সেটা কবে?

সপ্তাহখানেক আগে। সকালে নাশতা খেতে বসেছে–হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, লাবণী দেখ তো খবরের কাগজ দিয়ে গেছে কিনা। আমি খবরের কাগজ এনে দিলাম। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে খবরের কাগজ পড়তে লাগল।

আর তুমি চিন্তায় অস্থির হলে? চিন্তায় অস্থির হওয়াটা কি অন্যায়? অবশ্যই অন্যায়। ভাইয়াকে তুমি চেন। চেন না? মানুষকে চেনা কি এতই সহজ? ভাইয়াকে চেনা খুবই সহজ। ভাইয়া হচ্ছে পানির মতো। হাসান তুমি একটা ভুল উপমা দিলে। পানি মোটেই সহজ বস্তু না। পানি অতি জটিল। পানি একমাত্র দ্রব্য যা কঠিন হলে আয়তনে বাড়ে।

পানি আয়তনে বাড়লেও ভাইয়া বাড়ে না। ভাইয়া খুব সাধারণ সহজ সরল একজন মানুষ। লাবণী ফাবনী নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না তো ভাবি।

রীনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ওদের অফিসে লাবণী নামে একটা মেয়ে আছে। ওদের সঙ্গে কাজ করে। নতুন এসেছে।

হাসান হাসতে হাসতে বলল, ব্যাপারটা তো তাহলে আরো সহজ হয়ে গেল। ভাইয়া মেয়েটাকে চেনে। তার নামটা মনে আছে। সে হয়তো দেখতেও অনেকটা তোমার মতো। থুতু দেখে যক্ষ্মা ভেবে বসবে না ভাবি। মেয়েদের স্বভাব হচ্ছে থুতু দেখলে যক্ষা ভাবে।

আর ছেলেদের স্বভাব।কী? যক্ষ্মা দেখলে থুতু ভাবা?

আমার ভূতের গল্পটা কি তোমাকে এখন বলব?

বল।

তাহলে পা তুলে খাটে হেলান দিয়ে আরাম করে বাস।

বসলাম।

তোমার মুখের চামড়া এখনো শক্ত আছে। রিল্যাক্স করা।

তুমি তোমার গল্প শুরু কর তো।

দাঁড়াও আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নি।

হাসান তুমি আজকাল বেশি সিগারেট খাচ্ছি। সিগারেটের গন্ধে তোমার ঘরে ঢোকা यां का!

হাসান গল্প শুরু করল। সে লক্ষ করল রীনা মন দিয়ে কিছু শুনছে না। তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু অন্য কিছু ভাবছে। অমনোযোগী শ্রোতাকে দীর্ঘ গল্প শোনানো খুবই কষ্টের ব্যাপার। হাসান বলল, গল্পটা কেমন লাগছে ভাবি?

ভালোই তো।

শেষ করব, না বাকিটা আরেকদিন শুনবে?

কেমন যেন মাথা ধরেছে। বাকিটা আরেক দিন শুনব। তুমি আজ বরং তোমার চিঠি শেষ কর।

ভাবি তোমার কি মন খারাপ?

না মন খারাপ না। কেমন যেন একা একা লাগছে।

ভাইয়া বাসায় নেই??

উহুঁ। নাপিতের কাছে চুল কাটাতে গেছে।

রাত দুপুরে চুল কাটাচ্ছে?

রীনা হালকা গলায় বলল, নাপিতের কথা বলে অন্য কোথাও যেতে পারে। আচ্ছা! হাসান ছেলেরা ঘরের চেয়ে বাইরে থাকতে বেশি পছন্দ করে, কারণটা কী?

জানি না ভাবি।

আমি মনে মনে একটা কারণ খুঁজে বের করেছি। আমার ধারণা, অতি প্রাচীনকালে মানুষ যখন পশু শিকার করে বেঁচে থাকত তখন থেকেই ব্যাপারটা শুরু। পুরুষরা শিকারে বের হতো। মেয়েরা সন্তানের দেখাশোনা করত। ওই যে পুরুষদের বাইরে থাকা অভ্যাস হয়ে গেল–সেই অভ্যাস আর যায় নি।

ভালো বলেছ তো ভাবি!

রীনা উঠে তার ঘরে চলে গেল। হাসান চিন্তিত মুখে বসে রইল। তিতলীর চিঠিটা শুরু করা দরকার। ঘোর কেটে গেছে। লিখতে ইচ্ছে করছে না।

 

তারেক বাসায় ফিরল রাত এগারটায়। তার হাতে দড়িবাধা মাঝারি সাইজের একটা কাতল মাছ। রীনা বলল, রাতদুপুরে মাছ আনলে কোত্থেকে?

আড়ঙের সামনে হাতে নিয়ে নিয়ে মাছ বিক্রি করে। ধানমণ্ডি লেকের মাছ। এক ব্যাটা জোর করে গছিয়ে দিয়েছে। সস্তা পড়েছে–এক শ টাকা।

তুমি খেয়ে এসেছ?

হুঁ।

কী দিয়ে খেলে?

তারেক কাপড় ছাড়তে ছাড়াতে বলল, সাধারণ খাবার–ভাজ্যভুজি। তবে নতুন একটা জিনিস খেলাম কালিয়াজিরার ভর্তা। একটু তিতা তিতা। তবে খেতে ভালো। কালিয়াজিরা ভর্তা দিয়ে এক প্লেট ভাত খেয়ে ফেলেছি।

লাবণীর কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে এসো, আমি কালিয়াজিরা ভর্তা বানাব।

তারেক অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, আচ্ছা। বলেই চমকে গেল। রীনার কাছে সে বলে গেছে নাপিতের কাছে যাচ্ছে। সেখানে রীনা। হুট করে লাবণীর প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছে এবং সেও স্বীকার করে ফেলেছে। তারেক অসহায় ভঙ্গিতে বলল, এক কাপ চা খাব রীনা।

রীনা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, হাত মুখ ধোও চা নিয়ে আসছি।

চিনি দিও না। একটা বয়সের পরে চিনি ছেড়ে দেয়া দরকার।

আচ্ছা চিনি কমই দেব।

তারেক শোবার ঘরের চেয়ারে বসে আছে। বিছানায় টগর এবং পলাশ দুই ভাই জড়ােজড়ি করে শুয়ে আছে। তারা ঘুমোয় দাদাদাদির সঙ্গে, আজ এখানে চলে এসেছে। ওদেরকে দাদির ঘরে পার করতে হবে। কাজটা করতে হবে খুব সাবধানে— একবার ঘুম ভেঙে গেলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে।

রীনা চা এনে তারেকের সামনে রাখল। টগরকে খুব সাবধানে কোলে নিয়ে রওনা হলো। তারেক বলল, হাসানের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে এসো তো। রীনা বলল, আচ্ছা।

তারেক চায়ে চুমুক দিচ্ছে। সে খুবই অসহায় বোধ করছে। রানা যদি আবারো লাবণীর প্রসঙ্গ তোলে সে কী বলবে। হুট করে রীনা লাবণীর প্রসঙ্গ তুললই বা কেন? হাসান কি তাকে কিছু বলেছে? বলার তো কথা না।

এই নাও সিগারেট।

থ্যাংক য়্যু।

তুমি দেখি পুরোপুরি সিগারেট ধরে ফেলছ।

আরে না টেনশনের সময় দু-একটা খাই।

এখন কি তোমার টেনশানের সময়?

কী যে বল টেনশনের কী আছে! তুমি কি ভাত খেয়েছ?

না, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

ব্যাপারটা কী তোমাকে বলি

কিছু বলতে হবে না।

আরে শোন না। বোস তো খাটে।

রীনা খাটে বসল। তারেক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল–আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশিয়ার শামসুল কাদের সাহেবের গলব্লাডার অপারেশন হয়েছে। সাকসেসফুল অপারেশন, হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছে। বাসায় এসে আবার আগের মতো ব্যথা। ডাক্তার বলল ব্যথাটা সাইকোলজিক্যাল। ব্যথা হবার কোনো কারণ নেই। যাই হোক আমি দেখতে গেলাম, গিয়ে দেখি আমাদের অফিসের লাবণী। সেও দেখতে এসেছে। তার বাসা কদের সাহেবের বাসার সামনে। রাস্তার এমাথা ও মাথা। ফেরার সময় লাবণী বলল, স্যার আমার বাসাটা দেখে যান। এমন ধরল না যাওয়াটা অভদ্রতা মুগেলাম। লাবণীর বাবা ছিলেন বাসায় তিনি না খাইয়ে ছাড়বেন না। এই হলো

রীনা বলল, তোমার সিগারেট খাওয়া তো হয়েছে। চল শুয়ে পড়ি।

তারেক হাই তুলতে তুলতে বলল, চল। সে খুবই ভালো বোধ করছে। খুব গুছিয়ে সে সুন্দর একটা মিথ্যা গল্প ফেধেছে। গল্পটা বলেছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। রীনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে গল্পটা বিশ্বাস করছে। মেয়েরা সত্যির চেয়ে মিথ্যাটাকে সহজে গ্ৰহণ করে।

রীনা।

হুঁ।

একটা পান দাও না। চা খেয়ে মুখটা মিষ্টি হয়ে আছে। ঘরে পান আছে না?

আছে।

রীনা পান আনতে গেল। তারেক বেশ আয়েশ করে পা নাচাচ্ছে। সে বেশ আনন্দিত। তাৎক্ষণিকভাবে জটিল একটা মিথ্যা তৈরির আনন্দ। রীনা। এই গল্পটা বিশ্বাস করেছে জটিলতার কারণে। কারণ রীনা জানে তার ভেতরে কোনো জটিলতা নেই।

রীনা পান দিয়ে মশারির ভেতর ঢুকল। মশারি ভর্তি মশা। এত মশা ঢোকে কীভাবে কে জানে। মশারিতে কোনো ফুটা কি আছে? ফুটা তো চোখে পড়ছে না।

পান খাওয়া শেষ হলে বাতি নিভিয়ে ঘুমোতে এসো।

আচ্ছা।

বাড়িওয়ালার টাকাটা তুমি এখনো দিচ্ছ না। উনি আজো এসেছিলেন।

দিয়ে দেব।

কবে দেবে সেটা পরিষ্কার করে বল, আমি সেই ভাবে তাকে বলব। রোজ আসেন, বিশ্ৰী লাগে।

সামনের সপ্তাহে দেব। শনি-রোববারে আসতে বলো।

আচ্ছা।

নাপিতের কাছে আর যাও নি না?

গিয়েছিলাম, এত ভিড়!

রীনা জেগে আছে। বিছানায় শোয়ামাত্র তার ঘুম আসে না। গভীর রাত পর্যন্ত সে জেগে থাকে। আজ তার ঘুম একেবারেই আসবে না। তারেকের মতো একটা মানুষ কী করে জটিল একটা গল্প ফাদল এটা তার মাথাতেই আসছে না। খুব সহজ যে মানুষ, তার ভেতরেও কি জটিল একটা অংশ লুকিয়ে থাকে। ঠিক তেমনি ভয়াবহ জটিল মানুষের একটা অংশে কি থাকে শিশুর সারল্য? পুরোপুরি সহজ কিংবা পুরোপুরি জটিল মানুষ কি এই পৃথিবীতে হয় না?

তারেক বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম। সুখী মানুষের নিদ্রা। মানুষটা কি সত্যি সুখী ঐ একজন সুখী মানুষকে জটিল মিথ্যা গল্প বানাতে হয় না। জটিল সব গল্প অসুখী মানুষেরা তৈরি করেন।

রীনা সাবধানে খাট থেকে নামল। তার কেমন যেন গা জ্বালা করছে। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে থাকলে গা জ্বালা ভাবটা হয়তোবা কমবে।

হাসানের ঘরে বাতি জ্বলছে। সে মনে হয় চিঠি লিখছে। ভালবাসার চিঠি। রীনা তার এই জীবনে ভালোবাসার কোনো চিঠি পায় নি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ তাকে কখনো বলে নি–আমি তোমাকে ভালোবাসি। তারেকও না। সোজা সরল মানুষরা ন্যাকামি ধরনের কথা বলে না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ