মেঘ বলেছে যাব যাব

একদল হাঁসের সঙ্গে সে হাঁটছে।

তার মানেটা কী? সে হাঁসদের সঙ্গে হাঁটবে কেন? সে তো হাঁস না। সে মানুষ। তার নাম হাসানুর রহমান। বয়স আটাশ। মোটামুটি সুদৰ্শন। লাল রঙের শার্ট পরলে তাকে খুব মানায়। সে কেন হাঁসদের সঙ্গে ঘুরছে?

হাঁসের দল জলা জায়গায় নেমে পড়ল। সেও তাদের সঙ্গে নামল। হাঁসিরা শামুক গুগলি জাতীয় খাবার খাচ্ছে। সেও খাচ্ছে। কপি কপি করে খাচ্ছে। ঝিনুকের খোল খুলতে তার কষ্ট হচ্ছে। একটা হাঁস তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। হাঁসটার চোখ মানুষের চোখের মতো বড় বড়। কাজল পরানো। হচ্ছেটা কী? এটা কি কোনো দুঃস্বপ্ন? দুঃস্বপ্ন তো বটেই।

হাসান প্ৰাণপণ চেষ্টা করতে লাগল দুঃস্বপ্নটা থেকে জাগতে। হাঁস না, তাকে স্বাভাবিক মানুষ হতে হবে। শামুক খেতে তার অসহ্য লাগছে। দুঃস্বপ্নটা কাটছে নাবরং আরো গাঢ় হচ্ছে। জলা জায়গাটা এখন নদীর মতো হয়ে গেছে। নদীতে প্রবল স্রোত। সে স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে না। স্থির হয়ে ভাসছে–যদিও সে সাঁতার জানে না। ব্যাপারটা তাহলে স্বপ্ন। স্বপ্লেই মানুষ আকাশে উড়তে পারে, প্ৰবল স্রোতেও স্থির হয়ে ভাসতে পারে।

আহ্ এই দুঃস্বপ্নের ঘুম ভঙে না কেন? হাসান পাশ ফিরল। পাশ ফিরতেই সিগারেট লাইটারের খোঁচা লাগল। পিঠে। সে চোখ মেলল। ভাগ্যিস পাশ ফিরেছিল। পাশ ফেরার কারণে ঘুম ভাঙল।

স্বপ্নের কর্মকাণ্ডের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। স্বপ্ন নিয়ে রাগ করারও কোনো মানে হয় না। কিন্তু হাসানের রাগ লাগছে। এমন উদ্ভট স্বপ্ন সে কেন দেখবে?

তার জীবনে উদ্ভট ব্যাপার অবশ্যি মাঝেমধ্যেই ঘটে। ঢাকা শহরে নিশ্চয়ই ঠেলাগাড়ির নিচে কেউ পড়ে নি। সে পড়েছে। মালিবাগ রেলক্রসিঙের কাছে হঠাৎ হুড়মুড় করে একটা ঠেলাগাড়ি তার গায়ে উঠে গেল। এক সময় সে বিস্মিত হয়ে দেখে ঠেলাগাড়ির দুই চাকার মাঝখানে সে প্রায় গিন্টু পাকিয়ে পড়ে আছে। চারপাশে প্রচণ্ড ভিড়। ট্রাফিক জ্যাম লেগে গেছে। পুলিশের সার্জেন্ট বাঁশি বাজাচ্ছে। ঠেলাগাড়ির নিচ থেকে তাকে বের করা মোটেই সহজ হয় নি। গাড়ি বোঝাই লোহার রড। সব রড নামিয়ে লোকজন ধরাধরি করে ঠেলাগাড়ি উঁচু করল, তারপরও সে বেরোতে পারল না। কারণ তার বা পা ভেঙে গেছে। তাকে পুরো এক মাস পায়ে প্লাস্টার বেঁধে শুয়ে থাকতে হলো। তার এম.এ. পরীক্ষা দেয়া হলো না। সেই পরীক্ষা এখনো দেয়া হয় নি। আবার কখনো দেয়া হবে–সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

হাসান বিছানায় উঠে বসল। তার ইচ্ছে করছে আগুনগরম এক কাপ চা খেতে। সবার বাড়িতে যদি খানিকটা হোটেল ভাব থাকত তাহলে ভালো হতো। খাটের পাশে টেলিফোন। টেলিফোন তুলে গষ্ঠীর গলায় বলা–হ্যালো রুম সার্ভিস! এক কাপ আগুনগরম চা৷

এ বাড়িতে সকালবেলা এক কাপ চা পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। নাশতা খাওয়া শেষ হবার পর সবার জন্যে যখন গণ-চা হবে তখনই পাওয়া যাবে। তার আগে না।

রান্নাঘরে দু বার্নারের একটা গ্যাসের চুল। সকালবেলা গ্যাসের চাপ কমে যায়। একটা চুলা অনেক কষ্টে ধিকি ধিকি করে জ্বলে। সেই চুলায় নাশতা তৈরি হয়। রুটি-ভাজি, কিংবা রুটি-হালুয়া। হাসানের বড় ভাই তারেক ভাত খেয়ে অফিসে যান। তার জন্যে ভাত রান্না হয়। তারেকের দুই পুত্রের স্কুলের টিফিন বানানো হয়। চুলা কখনো খালি থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে সকালে বেড-টি চাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবার কথা।

কোনো একটা ব্যাপার মাথার ভেতর ঢুকে গেলে সেটা আর বেরোতে চায় না। গ্রামোফোনের কাটা রেকর্ডের মতো বাজতেই থাকে। ‘এক কাপ আগুনগরম চা–এই বাক্য হাসানের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। হাসান বিছানা থেকে নামল। বাসার সামনের রাস্ত পার হলেই ইস্কান্দর মিয়ার চায়ের দোকান। এক কাপ চা চট করে খেয়ে আসা যায়। সকাল বেলার বিরক্তিকর কর্মকাণ্ড, যেমন–দাঁত ব্ৰাশ, দাড়ি কামানো আপাতত স্থগিত থাকুক।

হাসান লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরল। লুঙ্গি পরে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। রীনা ভাবি একগাদা কথা শুনিয়ে দেবে। রীনা ভাবির প্রেস্টিজজ্ঞান খুব বেশি।

বারান্দায় বের হতেই হাসান রীনার মুখোমুখি হয়ে গেল। রানার হাতে লাল রঙের প্লাষ্টিকের বালতি। বালতিভর্তি কাপড়। এই কাপড়ে সে নিজ হাতে সাবান মাখিয়ে কলতলায় রেখে আসবে। কাজের মানুষের হাতে সাবান ছেড়ে দিলে দুদিনে একটা করে সাবান লাগবে।

রীনা শান্ত গলায় বলল, হাসান তুমি আজ অবশ্যই তোমার কোটিপতি বন্ধু রহমানের বাড়িতে যাবে। তার দাদি খুব অসুস্থ। তিনি তোমাকে দেখতে চান।

আচ্ছা।

আচ্ছা না, অবশ্যই যাবে। রহমান কাল সন্ধ্যাবেলা এসে বলে গেছে। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। রহমানের দাদির ব্যাপারটা কী? উনি প্রায়ই তোমাকে দেখতে চান কেন?

জানি না ভাবি।

তোমার বন্ধু আজ যে গাড়ি নিয়ে এসেছিল, সেই গাড়ি গলি দিয়ে ঢোকে না। গলির মোড়ে রেখে আসতে হয়েছিল।

হাসান হাসল, কিছু বলল না। রীনা কলতলার দিকে রওনা হতে গিয়েও হলো না। হাসিমুখে বলল, আমি নতুন একটা শাড়ি পরেছি, তুমি তো কিছু বললে না।

নতুন শাড়ি?

হ্যাঁ। ছেলেদের নতুন শার্ট-প্যান্ট আর মেয়েদের নতুন শাড়ি আলাদা ব্যাপার। মেয়েদের নতুন শাড়ি পরা মানে একটা বিশেষ ঘটনা। সেই ঘটনা যখন ঘটে তখন লক্ষ করতে হয়।

তোমাকে নতুন শাড়িতে খুবই সুন্দর লাগছে ভাবি।

রীনা এমনিতেই সুন্দর। আজ আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ঘুম থেকে উঠেই সে গোসল করেছে। সুন্দর করে সেজেছে। ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে। কাজলদানিতে কাজল ছিল না। থাকলে কাজলও দিত।

রীনা বলল, সুন্দর মানুষকে সুন্দর লাগবে না?

তুমি রাজকন্যা সেজে ধোপানীর মতো কাপড় ধুতে যাচ্ছে–এটা মানাচ্ছে না।

মালচন্দন নিয়ে কদমগাছের নিচে বসে থাকলে মানাত—-তাই না?

রীনা হাসতে হাসতে কলতলার দিকে চলে গেল। যদিও সে হাসছে কিন্তু তার মনটা খুব খারাপ। আজ একটা বিশেষ উপলক্ষে সে নতুন শাড়ি পরেছে। আজ তাদের বিয়ের সে ভুরু কুঁচকে খবরের কাগজ পড়ছে। রীনা আজকের দিনের ব্যাপারটা কায়দা করে মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে–বলেছে, তুমি তো রোজই শার্ট-প্যান্ট পরে অফিসে যাও। আজ এক কাজ কর, পায়জামাপাঞ্জাবি পরে যাও। তোমার জন্যে একটা পাঞ্জাবি কিনেছি। তারেক খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বিরক্ত গলায় বলেছে–অফিস কি শ্বশুর বাড়ি নাকি যে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে চোখে সুরমা দিয়ে যাব? মাঝে মাঝে কী অদ্ভুত কথা যে তুমি বল!

রীনার মুখে কঠিন কিছু কথা এসে গিয়ছিল, সে নিজেকে সামলাল। কী দরকার কঠিন কথা বলার? আজ সারাদিন সে মেজাজ খারাপ করবে না। কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। রাতে পোলাও রান্না করবে। হঠাৎ পোলাও কেন জিজ্ঞেস করলে বলবে–বাচ্চারা অনেকদিন থেকেই পোলাওয়ের জন্যে ঘ্যানঘ্যান করছিল, ওদের ঘ্যানঘ্যাননি থামানোর জন্যে পোলাও। মিথ্যা বলা হবে না, তার দুটা বাচ্চাই পোলাওয়ের জন্যে পাগল। রোজই খেতে বসে বলবে–মা, পোলাও খাব।

চায়ের স্টলে ঢুকতে গিয়ে হাসান ছোটখাটো একটা ধাক্কার মতো খেল। তার বাবা রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট এডুকেশন অফিসার জনাব আশরাফুজ্জামান সাহেব চায়ের স্টলে বসে আছেন। তিনি বেশ আরাম করে পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছেন। তাঁর সামনে দুটা বাটিএকটায় সবজি, অন্যটায় রসে ডোবানো একটা রসগোল্লা। আশরাফুজ্জামান চোখ মেলে ছেলেকে দেখলেন। অপ্ৰস্তুত ভঙ্গিতে চোখ নামিয়েও নিলেন। মনে হলো তাঁর গলায় পরোটা বেজেও গেল। তিনি খুক খুক করে কাশতে লাগলেন।

বয়সের সঙ্গে মানুষ কত দ্রুত বদলায় বাবাকে দেখে হাসান ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। এক সময় এই মানুষটার সংসার অন্ত প্ৰাণ ছিল–ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার আগে নফল রোজা করতেন। ফাইনাল পরীক্ষার আগে তারা যেন রাত দুটা পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে জন্যে নিজে ঘুম ঘুম চোখে পাশে বসে থাকতেন।

সেই মানুষের এখন আর কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই। বড় ছেলের বাসায় তাঁর একটা ঘর আছে, তিনি সেখানে বাস করছেন–এই তো যথেষ্ট। ছেলেদের কার চাকরি আছে, কার নেই তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে? পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় হয়ে গেছে, এখন শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবা যায়। ক্ষিধে লাগলে চুপিচুপি চায়ের স্টলে বসে–পরোটা রসগোল্লা দিয়ে নাশতা। মন্দ কী?

আশরাফুজ্জামান বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, কী-রে চা খাবি?

হাসান কিছু বলল না। তার উচিত চলে যাওয়া, যাতে তিনি আরাম করে খাওয়াটা শেষ করতে পারেন। কিছু না বলে চলে যেতেও অস্বস্তি লাগছে। আশরাফুজ্জামান বললেন, মর্নিং ওয়াক শেষ করে এমন ক্ষিধে লাগিল–বাসার নাশতা কখন হয় তার নেই ঠিক। গরম গরম পরোটা আছে খা-না। আমি দাম দিচ্ছি।

হাসান বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। এ কী অদ্ভুত কথা–আমি দাম দিচ্ছি। হাসান বাবার সামনে বসল। একই বাড়িতে দুজন বাস করে, কিন্তু দু’জন এখন কত দ্রুত দুদিকে চলে যাচ্ছে! এই দূরত্ব এখন বোধহয় আর দূর হবার নয়।

আশরাফুজ্জামান আনন্দিত গলায় বললেন, পরোটা কী দিয়ে খাবি? মুরগির লটপটি দিয়ে খাবি? বেশ ভালো।

মুরগির লটপটিটা কী?

কলিজা গিলা পাখনা এইসব দিয়ে ঝোলের মতো বানায়। বেশ ভালো।

তুমি কি প্রায়ই এখানে নাশতা কর?

মাঝে মাঝে খাই। বৃদ্ধ বয়সে রুচি নষ্ট হয়ে যায়। তখন রুচি বদলের জন্যে হোটেল মোটেলের খাবার খাওয়া। রসগোল্লা খাবি?

তুমি কি নিয়মিত রসগোল্লাও খাচ্ছ? তোমার ভয়াবহ ডায়াবেটিস…

শেষ সময় এখন আর ডায়াবেটিস নিয়ে ভেবে কী হবে? তোকে একটা রসগোল্লা দিতে বলব?

বল।

এখানে যে নাশতা করি।—বউমা যেন না শোনে। রাগ করবে। মেয়েরা অগ্র-পশ্চাৎ ধ্ৰুরা না করেই রাগ করে। এদের সঙ্গে তর্ক করাও বৃথা। তুই আরেকটা পরোটা নিবি?

না।

নাশতা শেষ করে হাসান বাসায় ফিরল না। বেকার মানুষ একবার ঘর ছেড়ে বেরোলে রাত গভীর না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরতে পারে না। সে রওনা হলো রহমানদের বাসার দিকে। রহমানরা থাকে উত্তরায়–সকালবেলা ওইদিকে আরাম করে যাওয়া যায়। বাস ফাঁকা থাকে। জানালার পাশে একটা সিটি দখল করে হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া। সমস্যা হচ্ছে-যেতে ইচ্ছা করছে না। না যাবার মতো কোনো অজুহাত যদি থাকত। বাস ড্রাইভার্স এসোসিয়েশন স্ট্রাইক ডেকেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে বন্ধ। রহমানকে বলা যাবে–খুব ইচ্ছা ছিল, বাস নেই, করব কী?

সমস্যা হচ্ছে হাসান মিথ্যা কথা বলতে পারে না। একেবারেই পারে না। দু’ ধরনের মানুষ মিথ্যা বলতে পারে না। সবল মনের মানুষ এবং দুর্বল মনের মানুষ। হাসানের ধারণা সে দুর্বল মনের মানুষ। রহমানদের বাড়িতে তার যেতে ইচ্ছা করছে না, কিন্তু সে জানে শেষ পর্যন্ত সে উপস্থিত হবে। দুর্বল মনের মানুষরা তাই করে।

রহমানের দাদি আম্বিয়া খাতুনের বয়স প্রায় নব্বই। গত পাঁচ বছর প্যারালিসিস হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। চোখে দেখেন না, তবে কান এবং নাক অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। আম্বিয়া খাতুন হাসানকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। কেন করেন। সেই কারণ খুব স্পষ্ট না। হাসান নিজেও কারণ খুঁজতে যায় নি। স্নেহমমতার পেছনে কারণ খুঁজতে যাওয়ার মধ্যে ছোটলোকামি আছে। হাসান দুর্বল মনের মানুষ হলেও ছোটলোক না।

রহমানের বাবা সেকান্দর আলি পুলিশের সাবইন্সপেক্টর ছিলেন। ঘুস খাবার অপরাধে তাঁর চাকরি চলে যায়। তিনি ব্যবসা শুরু করেন এবং দেখতে দেখতে ফুলে ফোঁপে একাকার হয়ে যান। উত্তরায় দশ কাঠা প্লটে তিনি যে বাড়ি করেছেন তা দেখলে পুলিশের সব সাবইন্সপেক্টরই ভাববে–ঘুস খাবার অপরাধে কেন আমাদের চাকরি যাচ্ছে না।

টাকা-পয়সার সঙ্গে মানুষের রুচি এবং মানসিকতা বদলায়। সেকান্দর আলি সাহেবের পরিবারের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি ঘটেনি। তারা আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে। সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড বাড়ির সদস্যরা যদি নাভিতে সরিষার তেল দিয়ে রোদে শুয়ে থাকে তাহলে কেমন যেন মানায় না। সেকান্দর আলী সাহেবের পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকালে মনে হয় তারা সবাই যেন নীরবে বলছে-দূর ভালো লাগে না, আগে যখন গরিব ছিলাম। তখনই ভালো ছিলাম।

হাসান রহমানদের রাজপ্রাসাদে পৌঁছাে সকাল এগারটায়। পোজপাজ আগে যা ছিল তার চেয়েও বেড়েছে। পোশাক পরা দুই দারোয়ান— একজনের হাতে ব্যাটন।

রহমান বাসায় ছিল না। সেটা কোনো সমস্যা না। হাসানকে এ বাড়ির সবাই চেনে। সে যে আজ আসবে, এটাও সবাই জানে। সেকান্দর আলি সাহেব বিরক্ত মুখে বারান্দার সোফায় বসে আছেন। তাঁর খালি গা। বিশাল ভূঁড়ি ওঠানামা করছে। সকালবেলা দেখার মতো কোনো সুন্দর দৃশ্য না। সেকান্দর আলি সাহেব তাকে দেখে বললেন, যাও দেখা দিয়ে আসা। তোমার জন্যে দম আটকে আছে কি না কে জানে; পরশু থেকে তোমার কথা বলছে। আধাপাগল তো, একবার মাথায় কিছু ঢুকে গেলে আর বের হয় না।

এখন অবস্থা কী?

অবস্থা আর কী, অক্সিজেন চলছে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। কাল রাত তিনটায় শ্বাস উঠল— আমি ভাবলাম ঘটনা বুঝি ঘটেই যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়ে আনালাম। ভোরবেলা আবার দেখি সামলে উঠেছেন। দুঃখ-কষ্টে মানুষ হয়েছেন তো, শক্ত শরীর।

হাসান কিছু বলল না। সেকান্দর আলি বিরক্ত গলায় বললেন, গত তিন দিন ধরে কাজকর্ম বাদ দিয়ে ঘরে বসে আছি। কোনো একটা কাজে যাব–মারি দম বের হয়ে যাবে। শেষ সময়ে দেখা হবে না। ঠিক বললাম না?

জ্বি ঠিক বলেছেন।

তুমি যাও দেখা করে আস।

উনার জ্ঞান আছে তো?

জ্ঞান আছে মানে? টনটনা জ্ঞান। এখনো তার সাথে তুমি কথায় পারবে না। তুমি একটা কথা বললে তোমাকে দশটা কথা শুনিয়ে দেবে।

আম্বিয়া খাতুন বোধহয় ঘুমোচ্ছিলেন। সাধারণত তাঁর ঘরে পা দেয়ামাত্র তিনি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কে? আজ একেবারে বিছানার পাশে এসে দাড়াবার পর বললেন, কে?

হাসান বলল, দাদিমা আমি হাসান।

তোকে খবর দিয়েছে কখন?

কাল সন্ধ্যায়।

এখন বাজে কয়টা?

এগারটা।

কতক্ষণ পর দেখা করতে এলি?

সতের ঘণ্টা পর।

এত দেরি হলো কেন?

দাদিমা আমি খবর পেয়েছি আজ সকালে।

তোর চাকরি বাকরি এখনো কিছু হয় নি?

না।

ব্যবসা পাতি করবি?

না।

না কেন? ব্যবসা কি খারাপ? আমাদের নবীজী কি ব্যবসা করেন নি?

আমি তো তাঁর মতো না দাদিমা। সাধারণ মানুষ।

সাধারণ মানুষ না। তুই গাধামানুষ।

হতে পারে।

তোর বন্ধুবান্ধব সব চাকরি বাকরি পেয়ে গেল তুই পেলি না। এটা কেমন কথা!

পেয়ে যাব।

কবে পাবি? খবরটা তো শুনেও যেতে পারব না যে তোর চাকরি হয়েছে। দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বিছানার পাশে বোস-নাকি রোগীর বিছানায় বসতে ঘেন্না লাগে!

হাসান বসল। বৃদ্ধ এক হাতে হাসানের হাত ধরলেন, ক্লান্ত গলায় বললেন, ব্যবসাপাতি যদি করতে চাস, বল, আমি সেকান্দরকে বলব। সেকান্দর আমার কথা ফেলবে না। পাপী ছেলে তো এই জন্যেই ফেলবে না। পাপী ছেলেপুলে বেশি মাতৃভক্ত হয়। তাদের মন থাকে দুর্বল। সব সময় মনে করে–মা মনে কষ্ট পেলে সর্বনাশ হবে। আসলে হয় না কিছুই। আল্লাহপাক কপালে যা লিখে রেখেছেন তাই হয়। মাকে ভক্তি করলেও হয়, মাকে ভক্তি না করলেও হয়। হাসান!

জ্বি।

দুপুরে খেয়ে যাবি। ওরা আজ আমার রোগমুক্তির জন্যে ফকির খাওয়াচ্ছে। খিচুড়ি রান্না হয়েছে। দুই পদের খিচুড়ি হয়েছে –ফকির মিসকিনদের জন্যে ইরি চালের খিচুড়ি, আর ঘরের মানুষের খাবারের জন্যে কালিজিরা চালের খিচুড়ি।

আমি কোন খিচুড়ি খাব?

তুই তো ফকির মিসকিনের মতোই। তুই খাবি ইরি চালের খিচুড়ি। রাগ করলি?

জ্বি না।

আমি সেকান্দরকে ডেকে বললাম, বাবা দুই পদের খিচুড়ি করলি কোন আন্দাজে? গরিব মানুষকে খাওয়াবি-ভালো কিছু খাওয়া। সে বলল, মা চিকন চালের খিচুড়িতে ওদের পেট ভরে না। এই জন্যেই মোটা চাল। আমি তখন বললাম, খুব ভালো বুদ্ধি করেছিস। শোন বাবা, তুই আজ মোটা চালের খিচুড়ি খাবি। এটা আমার আদেশ। এই শোনার পর থেকে সেকান্দর আলি মুখ শুকনা করে বসে আছে। তার কত বড় ভূঁড়ি হয়েছে দেখেছিস। চার-পাঁচ বালতি চর্বি আছে ওই ভুঁড়ির ভেতর। হিহিহি।

আম্বিয়া খাতুন শব্দ করে হাসতে লাগলেন। হাসির দমকে নাক থেকে অক্সিজেনের নলটা ছুটে গেল। নার্স এসে নল লাগিয়ে হাসানকে কঠিন গলায় বলল–রোগীকে শুধু শুধু হাসাবেন না। ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনের রোগী। আপনি এখন যান।

হাসান বের হয়ে এল। আম্বিয়া খাতুন তখনো হাসছেন। মহিলার কি মাথা আউলা হয়ে গেছে? দাঁত নেই মানুষের হাসিতে অশরীরী ভাব থাকে। গা ছমছম করে। হাসানের গা ছমছম করছে।

সেকান্দর আলি বললেন, চলে যাচ্ছে নাকি?

হাসান বলল, জ্বি না।

মা’র সঙ্গে দেখা তো হয়েছে। শুধু শুধু বসে থেকে কী করবে, চলে যাও।

দাদিমা খেয়ে যেতে বললেন। মোটা চালের খিচুড়ি খেতে বললেন।

ও আচ্ছা, তাহলে খেয়ে যাও। দেরি হবে কিন্তু। এখন ফকির মিসকিনদের খাওয়াবে। রান্না হয় নি। এখানো। রান্না হবে তার পর। ফকির ব্যাচ শেষ হলে আমাদের খাওয়া। তিনটা বেজে যাবে। থাকবে এতক্ষণ?

জ্বি।

বেশ থাক। এখন করছ কী?

কিছু করছি না।

রহমান যে বলল হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে কী কাজ করছি।

তেমন কিছু না। যা করছি তাকে চাকরি বলা যায় না।

কোনো কাজকেই ছোট করে দেখবে না হাসান। কোনো কাজই ছোট না। শিক্ষিত ছেলেপুলেদের এই এক সমস্যা হয়েছে। চাকরির জাতিভেদ করে ফেলেছে। কাজ হচ্ছে কাজ।

জ্বি।

তিনটা পৰ্যন্ত চুপচাপ বসে না থেকে তুমি বরং ঘুরে টুরে এসো। দুটা-আড়াইটা নাগাদ চলে এসো। অসুস্থ মানুষের বাড়িতে বসে থাকাও তো যন্ত্রণা।

আমার কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না।

সেকান্দর সাহেব বললেন, তাহলে থাক। লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে বোস। বইটিই পড়। লাইব্রেরি ঘরটা নতুন করেছি। কনকর্ডকে দিয়ে ডিজাইন করানো। চার লাখ টাকা নিয়েছে লাইব্রেরি করতে। অল বার্মাটিক। ‘এখন তো আর বই পড়া হয় না। শেষ বয়সে পড়ব এই জন্যে লাইব্রেরি বানানো। যাও দেখা গিয়ে–শেলফ থেকে বই যদি নামাও তাহলে যেখানকার বই সেখানে তুলে রাখবে।

জ্বি আচ্ছা।

চার লাখ টাকা দামের বামটিকের লাইব্রেরি দেখার ব্যাপারে হাসানের উৎসাহ দেখা গেল না। সে লাইব্রেরি ঘরের চেয়ারে চুপচাপ বসে রইল। সামনে খবরের কাগজ আছে কিন্তু পড়তে ইচ্ছা করছে না। বেকার মানুষ খবরের কাগজ পড়তে পারে না–এই তথ্যটা কি কেউ জানে? মনে হয় জানে না। নতুন বেকাররা অবশ্যি পত্রিকা হাতে নেয়, আগ্ৰহ নিয়ে কর্মখালি বিজ্ঞাপন পড়ে। পুরনো বেকাররা তাও করে না! সে পুরনো বেকার।

খবরের কাগজে মজা কিছু কি আছে? বাণী চিরন্তনী, কিংবা শব্দ জট, এস ওয়ার্ড পাজল?

চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে এই সবের ওপর চোখ বোলানো যায়। শব্দজট পাওয়া গেল। শব্দগুলো উলটাপালট করে লেখা–মূল শব্দ খুঁজে বের করতে হবে। হাসান অনাগ্ৰহ নিয়ে শব্দগুলো দেখছে–
কুলাশান্ত
ণত্রারিপ
জ্ঞভিতাঅ

শেষের দুটা পারা গেলা–পরিত্রাণ এবং অভিজ্ঞতা। প্রথমটা কী? ধাঁধা-শব্দজট এই ব্যাপারগুলো ভয়াবহ, একবার মাথায় ঢুকে গেলে আর বেরোতে চায় না। মাথায় ঘুরতে থাকে। খুবই অস্বস্তি লাগে। হাসানের মাথায় ঘুরছে কুলাশান্ত কুলাশান্ত, কুলাশান্ত, কুলাশন্ত। আসল শব্দটা কী? পারমুটেশন কম্বিনেশনে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না–
লাশন্তকু
কুশলান্ত
স্তশলাকু

কিছুই তো হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে হাসানের মাথা ধরে গেল। সে মাথা ধরা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। আশ্চর্য কাণ্ড ঘুমের মধ্যে আবারো সেই উদ্ভট স্বপ্ন!! সেই হাঁসের দলের সঙ্গে সে। এবারের হাঁসগুলো মানুষের মতো কথা বলছে। সদিবসা গলায় খ্যাস খ্যাস করে কথা। হাসান তার পাশের হাঁসটিকেজিজ্ঞেস করল-তুমি শব্দজট ছাড়াতে পার?

হাঁসটা বলল, জ্বি স্যার পারি।

‘কুলাশান্ত জট ছাড়ালে কী হবে?

এটা পারব না। এটা পারব না।

তোমাদের মধ্যে কেউ পারবে না?

জ্বি না। তবে একজন পারতে পারে–তার খুব বুদ্ধি।

সে কে? তার নাম শকুন্তলা।

হাঁসের নাম শকুন্তলা।

জ্বি। আপনাদের যেমন নাম আছে–আমাদেরও আছে। ওই যে শকুন্তলা, ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন।

জিজ্ঞেস করতে হবে না। শব্দ জট দূর হয়েছে। কুশলান্ত হলো শকুন্তলা।

হাসানের ঘুম ভাঙল। আশ্চর্য! বেলা পড়ে এসেছে। ঘড়িতে বাজছে চারটা দশ। এত লম্বা ঘুম সে দিল কীভাবে? সে কি অসুস্থ? অসুস্থ মানুষরাই সময়ে-অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে উদ্ভট এবং জটিল স্বপ্ন দেখে।

বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ফকির মিসকিনরা কি খিচুড়ি খেয়ে চলে গেছে? তাকে কেউ ডাকে নি। রেডক্রস আঁকা একটা গাড়ি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আম্বিয়া খাতুনকে দেখতে কোনো ডাক্তার বোধহয় এসেছেন। হাসানের পেট চক্কর দিয়ে উঠছে। সে রাস্তার পাশে বসে হাড় হড়া করে বমি করল।

শরীরটা আসলেই খারাপ করেছে। মাথা টলমল করছে। বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না। কী হবে বাসায় ফিরে?

স্যার আপনের কী হইছে?

খালি একটা রিকশা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। প্রশ্নটা করছে রিকশাওয়ালা। তার গলায় কৌতুহলের চেয়েও মমতা বেশি। একজন মানুষ তার সমগ্র জীবনে একশ’ বার সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে মমতা ও করুণায় আৰ্দ্ধ কথা শুনবে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ বাড়িয়ে দেবে সাহায্যের হাত। এই রিকশাওয়ালা কি সেই একশ’ জনের এক জন?

স্যার আপনার কী হইছে?

কিছু না। হঠাৎ শরীরটা খারাপ করেছে।

বাড়িত যান। বাড়িত গিয়া ঘুমান। আহেন রিকশাত উঠেন, লইয়া যাই।

রিকশা করে যাবার ভাড়া নেই রে ভাই।

ভাড়া লাগব না, আহেন।

হাসানের কাছে রিকশা ভাড়া আছে। রিকশাওয়ালা সেই একশ জনের এক জন কি না তা পরীক্ষা করার জন্যেই কথাগুলো বলা। মনে হচ্ছে এই রিকশাওয়ালা সেই এক শ জনের এক জন।

স্যার যাইবেন কই?

হাসান কিছু বলল না। রিকশায় উঠলেই তার মানসিকতা একটু যেন বদলে যায়। নির্দিষ্ট কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। রিকশাওয়ালা তার ইচ্ছেমতো নানা জায়গায় নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে রিকশা থামিয়ে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে চা খাবে। আনন্দময় মন্থর ভ্ৰমণ। স্কুলে রচনা আসে–এ জানি বাই ট্রেন, এ জানি বাই বোট। জানি বাই রিকশা রচনাটা আসে না কেন?

স্যার যাইবেন কই?

হাসান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল–চলতে থাক। রিকশাওয়ালা হাসল। তবে কথা বাড়াল না। সে ধীরে সুস্থে প্যাডেল চাপছে। হাসান হুড ধরে চুপচাপ বসে আছে। তার মাথা খানিকটা টালমাটাল করছে। বমি করার পর মুখ ধোয়া হয় নি। সমস্ত শরীরই কেমন অশুচি অশুচি লাগছে। কোনো একটা ফোয়ারার পাশে রিকশা থামিয়ে ফোয়ারার পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। ফোয়ারাগুলো নাকি কোটি কোটি টাকা খরচ করে বানানো হয়েছে। শহরের সৌন্দর্যবর্ধন করা হচ্ছে। হাসান আকাশের দিকে তাকাল। মেঘে মেঘে আকাশ কালো। রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইন মনে আসছে–মেঘের পরে মেঘ জিমেছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কখনো রিকশায় চড়েছেন? মনে হয় চড়েন নি। রিকশায় চড়লে সুন্দর একটা বৰ্ণনা পাওয়া যেত। হাসানের পেট আবার পাক দিচ্ছে। আবারো কি বমি হবে? ঝুম বৃষ্টি নামলে খুব ভালো হতো। বৃষ্টিতে নেয়ে ফেলা যেত। কদিন ধরেই রোজ বিকেলে মেঘ করছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না।

 

রীনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সকালবেলার নতুন শাড়িটা তার গায়ে নেই। সে পুরনো একটা শাড়ি পরেছে। বেগুনি এবং গোলাপির মাঝামাঝি রং।। নতুন অবস্থায় শাড়িটা পরলে নিজেকে খুব চকচকে লাগত। পুরনো হয়ে শাড়িটা সুন্দর হয়েছে। এই শাড়ি পরে রীনা দাঁড়িয়ে আছে, কারণ একদিন তারেক বলেছিল–বাহ্‌! শাড়িটায় তো তোমাকে খুব মানিয়েছে। রানার ধারণা তারেকের এটা কথার কথা। হঠাৎ কী মনে হয়েছে—বলেছে। শাড়ির দিকে ভালোমতো না তাকিয়েই বলেছে। স্বামীরা স্ত্রীদের খুশি করার জন্যে মাঝে মাঝে এ ধরনের কথা বলে। যে শাড়িটা পরার জন্যে স্বামী খুব সুন্দর বলে সেই শাড়ি পরে ঘুরলে স্বামী ফিরেও তাকায় না।

রাত দশটার মতো বাজে। তারেকের জন্যে অপেক্ষা। অফিস থেকে বিকেলে বাসায় ফিরেছে। এক কাপ চা খেয়ে হাসিমুখে বলেছে–রীনা আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, আধঘণ্টার মধ্যে ফিরব। রীনা বলেছে, যাচ্ছে কোথায়? তারেক জবাব দেয় নি। মুখ টিপে হোসেছে। রীনা ধরেই নিয়েছে–তারেকের শেষ মুহুর্তে বিয়ের দিনের কথাটা মনে পড়েছে। সে যাচ্ছে কিছু একটা কিনতে। পাঁচ-ছটা সস্তার মরা মরা গোলাপ কিনবে। বেলিফুলের মালা ভেবে যে মালাটা কিনবে সেটা আসলে রজনীগন্ধা ফুলের মালা। যা ইচ্ছা কিনুক–বিয়ের দিনের কথাটা মনে পড়েছে এই যথেষ্ট।

এখন মনে হচ্ছে তারেক উপহার। কিনতে যায় নি। কোনো কলিগের বাসায় গিয়েছে। বিয়ের দিনের কথাটা তার মনেও নেই। আসলে বিয়ের দিনটাকে মেয়েরা যত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ছেলেরা হয়তো ততটা করে না। ঘরে সে আজ পোলাও রান্না করেছে। বাচ্চা দুটার এত শখের পোলাও! ওরা না খেয়েই ঘুমিয়েছে। ব্যাপারটা ঘটেছে রীনার জন্যে। ওরা খেতে চেয়েছে–রীনা বলেছে, বাবা আসুক তারপর খাবে। বাবার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বেচারারা ঘুমিয়ে পড়েছে। এদের ঘুম অসম্ভব গাঢ়। একবার ঘুমেলে। আর জাগবে না। তারেকও নিশ্চয়ই খেয়ে আসবে। বিয়ের দিনে যে পোলাও রান্না হয়েছে সেটা কেউ খাবে না।

ভাবি, অন্ধকারে দাড়িয়ে আছ কেন?

রীনা মুখ ফিরিয়ে তাকাল। লায়লা চুপিচুপি কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই মেয়ে কোনো রকম শব্দ না করে হাঁটতে পারে।

লায়লা বলল, ভাইয়ার জন্যে অপেক্ষা করছ?

না। গরম লাগছিল, তাই বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। কী অসহ্য গরম পড়েছে দেখেছ?

আজ এত মেঘ করেছিল! ভাবলাম— বৃষ্টি হবে, বৃষ্টিতে ভিজব।

খবরদার ভাবি বৃষ্টিতে ভিজবে না, চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে।

চামড়া নষ্ট হবে কেন?

শহরের বৃষ্টি মানেই হলো এসিড রেইন। গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া বৃষ্টির সঙ্গে গায়ে এসে পড়ে চামড়ার বারোটা বাজিয়ে দেবে।

রীনা হাসল। তার এই ননদ শরীরের চামড়া, মাথার চুল, চোখ এইসব ব্যাপারে খুব সাবধান। শরীর ঠিক রাখার নানা কায়দা-কানুন সে করে।

ভাবি, চামড়ার সবচে’ ক্ষতি কীসে হয় তুমি জান?

না।

সবচে’ ক্ষতি করে আলট্রা ভায়োলেট রে। সূর্যের আলোয় যে মেয়ে সবচে’ কম আসবে তার চামড়া থাকবে সবচে’ সুন্দর।

তারেক আসছে। হেঁটে হেঁটে আসছে। মুখে পান। পানের পিক ফেলল-তার মানে খেয়ে এসেছে। লায়লা বলল, ভাবি ভাইয়া চলে এসছে।

তাই তো দেখছি।

তুমি ভাইয়াকে বলে আমার জন্যে দুশ টাকা নিয়ে রেখো তো ভাবি। আমাদের ক্লাসে পিকনিক হচ্ছে–দুশ টাকা করে চাদা। ছেলেরা এক শ আর মেয়েরা দু শি। মেয়েদের হাতে নাকি টাকা বেশি থাকে এই জন্যে চাঁদা বেশি। টাকাটা কাল সকালেই দিতে হবে ভাবি।

আচ্ছা আমি টাকা নিয়ে রাখব।

তারেক হাতমুখ ধুয়ে সরাসরি শোয়ার ঘরে চলে এল। রীনা বলল, ভাত খাবে না?

তারেক হাই তুলতে তুলতে বলল, না।

খেয়ে এসেছ?

হুঁ। আমাদের এক কলিগের মেয়ের আকিকা ছিল। খাসির রেজালা ফেজালা করে হুলস্থূল করেছে।

ও আচ্ছা।

রান্নাও হয়েছে ভালো। এমন খাওয়া খেয়েছি যে হাঁসফাস লাগছে। লবণ দিয়ে লেবুর শরবত করে দাও তো। পানিটা কুসুম কুসুম গরম করে নিও।

রীনা রাতে কিছু খেল না। একা একা খেতে ইচ্ছা করে না। বিয়ের দিন উপলক্ষে সে খুব আগ্রহ করে পোলাও রান্না করেছিল। আশ্চৰ্য, সেই পোলাও কেউ খেল না। লায়লা পোলাও খায় না। হাসানের শরীর খারাপ, সে না খেয়েই শুয়ে পড়েছে। রীনার শ্বশুর। গিয়েছেন কল্যাণপুর তাঁর মেয়ের বাসায়। রীনার কান্না পাচ্ছে। এত তুচ্ছ ব্যাপারে কাদা ঠিক না। রীনার সমস্যা হচ্ছে বড় বড় দুঃখের ব্যাপারে তার কান্না পায় না। ছোট ছোট ব্যাপারে চোখে পানি চলে আসে।

রীনা ঘুমোতে যাবার আগে হাসানের ঘরে উঁকি দিল। হাসানের ঘরের দরজা খোলা-ঘর অন্ধকার। হাসানের এই অভ্যাস–মাঝে মাঝে দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

হাসান।

জ্বি ভাবি।

দরজা খোলা রেখে ঘুমোচ্ছ। দরজা লাগাও।

ঘুমোচ্ছি না ভাবি। জেগে আছি।

শরীরের অবস্থা কী?

অবস্থা ভালো। এখন একটু যেন ক্ষিধে ক্ষিধে লাগছে।

কিছু খাবে? পোলাও আছে, গরম করে দেব?

পাগল হয়েছ! দরজার বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছি কেন ভাবি, ভেতরে এস।

রীনা ঘরে ঢুকল। হাসান টেবিল ল্যাম্প জ্বালাল। রীনা খাটের পাশে বসতে বসতে বলল, তুমি ভালো একজন ডাক্তার দেখাও হাসান। দুদিন পরপর তুমি অসুখ বাঁধাচ্ছ।

হাসান দেয়ালে হেলান দিয়ে খাটে বসেছে। অন্ধকারে খালি গায়ে শুয়েছিলভাবিকে দেখে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে, সেই পাঞ্জাবি উল্টো হয়েছে। বুক চলে গেছে পেছনে। হাসান বিব্রত ভঙ্গিতে পাঞ্জাবি দেখতে দেখতে বলল, ভাবি আমার অসুখটা হলো মনে। মনটা ঠিক নেই, এই জন্যেই শরীর ঠিক থাকছে না।

মন ঠিক নেই কেন?

চাকরি টাকরি পাচ্ছি না–এই জন্যেই মন ঠিক নেই।

তুমি না বললে হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিতে একটা কাজ করছি।

ওইটা কোনো কাজ না ভাবি। সপ্তাহে একদিন যাই, ভদ্রলোকের কথা শুনি। খাতায় নোট করি। ওই প্রসঙ্গ থাক। আচ্ছা ভাবি হাঁস স্বপ্নে দেখলে কী হয়? ইদানীং খুব হাঁস স্বপ্নে দেখছি। ঘুমোলেই দেখি এক ঝাক হাঁসের সঙ্গে হাঁটছি, সাঁতার কাটছি।

রীনা তাকিয়ে আছে। তার খুব মায়া লাগছে। হাসানকে অসহায় দেখাচ্ছে। রীনার যদি চেনাজানা কোনো মন্ত্রী থাকত। তাহলে সে হাসানের চাকরির জন্যে মন্ত্রী সাহেবের পা ধরে বসে থাকত।

ভাবি যাও ঘুমোতে যাও।

রীনা উঠে দাঁড়াল। হাসান বলল, ভাবি এক সেকেন্ড। তোমার জন্যে সামান্য কিছু উপহার এনেছিলাম। টেবিলের ওপর রেখেছি, নিয়ে যাও। আমি গরিব মানুষ–এরচে’ বেশি কিছু দেবার আমার ক্ষমতা নেই।

রীনা বিস্মিত হয়ে দেখল টেবিলে গোলাপ ফুলের সুন্দর একটা তোড়া। তোড়ায় নাটা গোলাপ। তাদের বিয়ের ন’ বছর আজ পূর্ণ হয়েছে। হাসান বলল, হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভারসারি ভাবি।

রীনা বলল, থ্যাংক য়ু।

তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। গোলাপগুলো এত সুন্দরা মনে হচ্ছে, এইমাত্র বাগান থেকে ছিঁড়ে আনা হয়েছে।

 

হাসানের ঘুম আসছে না। সে এপাশ ওপাশ করছে। কাল বুধবার। হিশামুদিন সাহেবের সঙ্গে কাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। উনাকে কি মুখ ফুটে সে বলে ফেলবে–স্যার, আমি খুব কষ্টে আছি। আমাকে পার্মানেন্ট একটা চাকরি দিন। আপনার কাছে এটা কোনো ব্যাপারই না।

হিশামুদিন সাহেবের কথা ভাবতে ভালো লাগছে না। ঘুমোবার আগে সুন্দর কিছু ভাবা দরকার। তিতলীর কথা ভাবা যায়। তার সঙ্গে খানিকক্ষণ কাল্পনিক কথাবার্তাও বলা যায়।

তিতলী কেমন আছ?

ভালো আছি।

আজ কী গরম পড়েছে দেখেছি?

হুঁ।

তুমি কি জান আমি যে ঘরে ঘুমোই সে ঘরে কোনো ফ্যান নেই।

জানি না, আমি তো তোমার ঘরে কখনো ঢুকি নি।

আমি করি কী জান? ঘরের দরজা-জানালা সব খুলে ঘুমোই। রীনা ভাবি খুব রাগ করে। রীনা ভাবির ধারণা, দরজা খোলা থাকলেই চোর ঢোকে। চোর ঢুকলেও কোনো অসুবিধা নেই। আমার ঘরে এমন কিছু নেই যে চোর এসে নিয়ে যাবে।

অন্য কিছু নিয়ে কথা বল তো। চোর নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না।

হাঁস নিয়ে কথা বলি? শোন তিতলী, হাঁস স্বপ্নে দেখলে কী হয় তুমি জান? ইদানীং আমি ঘুমোলেই শুধু হাঁস স্বপ্নে দেখছি

কী হাঁস—রাজহাঁস?

আরে না। আমি ছোট মানুষ, আমার স্বপ্নগুলোও ছোট ছোট–আমি স্বপ্নে দেখি পুড়ি একটা দুটা না-হাজার হাজার পাতিহাঁস। আমার ধারণা, আমি পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছি।

তিতলী হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। হাসান কল্পনায় একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে কিন্তু তার হাসি এত জীবন্ত! হাসান তিতলীর হাসি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। আশ্চর্য তো!

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ