শহরের বাড়িগুলির সুন্দর সুন্দর নাম থাকে–দাদাজানের বাড়িটার কোন নাম নেই। একটা নাম থাকলে সুন্দর হত। শাহানা নীতুকে নিয়ে হাঁটছে আর মনে মনে এই প্রকাণ্ড বাড়িটার একটা নাম ভাবছে। কোন নামই পছন্দ হচ্ছে না–নিদমহল, সুখানপুকুর প্যালেস, কুঠিবাড়ি… ইরতাজুদ্দিন সাহেব নাতনীদের একা একা দেয়ালের বাইরে যাবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তারা এখন একা নয়, দুজন। কাজেই দেয়ালের বাইরে যেতে পারে। শাহানা ঠিক করেছে আজ সে দ্বীপের মত এই গ্রামটা পুরো চক্কর দেবে। তার সঙ্গে একটা খাতা ও কলম আছে। গাছের নাম লিখবে। গেটের কাছে এসে নীতু থমকে দাঁড়াল। সরু গলার বলল, কোথায় যাচ্ছ আপা?

শাহানা বলল, কোথাও না। হাঁটতে বের হয়েছি। হাঁটব।

হাঁটবে কেন?

শরীর নামে আমাদের যে যন্ত্র আছে সেই যন্ত্র ঠিক রাখার জন্যে হাঁটাহাঁটির দরকার আছে।

আমার শরীর ঠিকই আছে। আমি হাঁটব না। তুমি যাও।

আয় তো নীতু, একা একা বেড়াতে ভাল লাগে না।

নীতু বলল, পুষ্পকে সঙ্গে নিয়ে নি? তিনজনে বেড়াতে অনেক ভাল লাগবে।

না।

নীতু বিরক্ত মুখে হাঁটছে। শাহানা বলল, দাদাজানের এই বাড়িটার জন্যে সুন্দর একটা নাম ভাব তো।

পাষাণপুরী।

কাঠের বাড়ি, এর নাম পাষাণপুরী হবে কেন?

নীতু বলল–পাষাণপুরী পছন্দ না হলে নাম রাখ কাষ্ঠপুরী।

আচ্ছা, আপাতত কাষ্ঠপুরী নাম থাক তুই তোর মুখটা এমন পাষাণের মত করে রেখেছিস কেন?

তোমার সঙ্গে আমার বেড়াতে ভাল লাগছে না, এই জন্যে মুখটা পাষাণের মত করে রেখেছি।

পুষ্প মেয়েটা আসার পর থেকে তুই আমাকে এড়িয়ে চলছিস। তোর দেখাই পাওয়া যাচ্ছে মা। সারাক্ষণ পূষ্পকে নিয়ে ঘুরছিস। মেয়েটা কেমন?

ভাল।

বোকা না বুদ্ধিমতী?

মাঝে মাঝে মনে হয় খুব বুদ্ধিমতী, মাঝে মাঝে মনে হয় বোকা। বেশ বোকা।

সব বুদ্ধিমান মানুষকেই মাঝে মাঝে বোকা মনে হয়।

তুমি জ্ঞানের কথা বলো না তো আপা। তোমার জ্ঞানের কথা আমার অসহ্য লাগে।

পুষ্প কখনো তোকে জ্ঞানের কথা বলে না?

না।

ও গুটুর গুটুর করে তোর সঙ্গে কি গল্প করে বল তো শুনি?

ঐ গল্প তোমার ভাল লাগবে না।

তোর ভাল লাগে?

হুঁ।

তাহলে আমারও ভাল লাগতে পারে। ওর দু-একটা গল্প বল শুনি।

নীতু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উৎসাহের সঙ্গে বলল, পুষ্পের যে মেজো বোন তার নাম পদ্ম। একটা দুষ্ট জ্বীন পদ্মকে পানিতে ড়িবিয়ে মেরে ফেলেছিল।

শাহানা তীক্ষ্ণ চোখে বোনকে দেখছে। সে খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল, এরকম একটা অস্বাভাবিক গল্প নীতু বিশ্বাস করেছে। নীতু তো চট করে কিছু বিশ্বাস করার মেয়ে না। তার মানে পুষ্প মেয়েটা তার উপর ভালই প্রভাব ফেলেছে।

ঐ জ্বীনটা কিন্তু এখনও ওদের বাড়িতেই থাকে। মাঝে মাঝে যে পুর্পের বড়। বোনের উপর ভর করে। পুষ্পের বড় বোনের নাম কুসুম।

তুই এইসব বিশ্বাস করছিস?

না।

তোর কথা বলার ভঙ্গি থেকে মনে হয় বিশ্বাস করছিস। শোনা এক কথা আর গল্প বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ অন্য কথা। চট করে কোন কিছু বিশ্বাস করতে নেই।

নীতু কথা পাল্টানোর জন্যে বলল, আপা, আমরা কি কোন বিশেষ দিকে যাচ্ছি, না শুধু হাঁটছি?

বিশেষ দিকে যাচ্ছি। আমরা পুরো দ্বীপটা চক্কর দেব। তারপর–মতি বলে যে ভদ্রলোক আমাদের পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন তাকে খুঁজে বের করব।

কেন?

আমাদেরকে উনার গান শুনাবার কথা। সেটা মনে করিয়ে দিতে হবে।

তুমি কি তার বাড়ি চেন?

না। খুঁজে বের করব। জিজ্ঞেস করে করে উপস্থিত হব।

কাউকে তো জিজ্ঞেস করছ না।

করব, জিজ্ঞেস করব…।

উনার বাড়ি হল পুষ্পদের বাড়ির কাছে। পুষ্প উনাকে চেনে। পুষ্পকে সঙ্গে নিয়ে এলে চট করে বাড়িটা খুঁজে পাওয়া যেত।

পুষ্পকে না আনা তাহলে ভুল হয়েছে–তবে বাড়ি খুঁজে বের করতে খুব সমস্যা হয়ত হবে না। উনি গায়ক মানুষ–সবাই নিশ্চয়ই তাঁকে চেনে।

নীতু বলল, পুষ্প উনার সম্পর্কে খুব অদ্ভুত একটা কথা বলেছে।

কথাটা কি? তার সঙ্গেও একটা জ্বীন থাকে?

না।

তাহলে কি পরী থাকে?

ঐসব কিছু না, অন্য ব্যাপার। তোমাকে বলা যাবে না।

শাহানা চিন্তিত বোধ করছে। পুষ্প মেয়েটা এমন কি কথা গোপনে বলা শুরু করেছে? যৌনতা বিষয়ক কিছু না তো?

নীতু।

হুঁ।

পুষ্প তোকে আজেবাজে কোন গল্প বলে তো?

ওর সব গল্পই তো আজেবাজে। ও কি বলেছে জান? ও বলেছে, জ্বীনের দশটা করে ছেলেমেয়ে হয়। জ্বীনরা মারা যায় না। সব জ্বীন মারা যাবে কেয়ামতের দিন, তার আগে না।

পুষ্প মনে হচ্ছে জীন বিশেষজ্ঞ।

জীন সম্পর্কে সে অনেক কিছু জানে।

ওর সঙ্গে তোর মাখামাখিটা বেশি হচ্ছে নীতু।

নীতু গম্ভীর মুখে বলল, তুমি দাদাজানের মত কথা বলছ আপা। ও গরীব বলে ওর সঙ্গে মাখামাখি করা যাবে না। ব্যাপারটা তো তাই জাস্টিস ইমরান সাহেবের মেয়ে মৃদুলার সঙ্গে আমি যখন মাখামাখি করি তখন তোমরা কেউ কিছু বল না। ওকে ডেকে তুমি নিজেও হেসে হেসে অনেক কৃথক পুষ্পের সঙ্গে এখন পর্যন্ত তুমি একটি কথাও বলনি।

শাহানা বলল, পুষ্পের সঙ্গে তোকে মাখামাখি কম করতে কেন বলছি জানিস? ও গ্রামের মেয়ে তো–ওদের কাছে পৃথিবীর কুৎসিত দিকগুলি আগে ধরা পড়ে। ঐসব নিয়ে গ্রামের মেয়েরা গল্প করতেও ভালবাসে। হয়ত জ্বীনের গল্প করতে করতে এমন এক গল্প তোকে বলে ফেলবে যে গল্প শোনার মত মানসিক প্রস্তুতি তোর নেই।

শহরের মেয়েরা এরকম কিছু করবে না?

না।

নীতু গলার স্বর কঠিন করে বলল, মৃদুলা কিন্তু কুৎসিত কুৎসিত গল্প করে। ওর কাছে চারটা ভয়ংকর কুৎসিত ছবি আছে। ও লুকিয়ে রেখে দিয়েছে।

শাহানা স্তব্ধ হয়ে গেল। নীতু বলল, পুষ্পের একটা গল্প তোমাকে আমি বলতে রাজি হইনি আর তুমি ভাবলে সে আমাকে কুৎসিত কথা বলেছে। সে কি বলেছে জানতে চাও?

না জানতে চাচ্ছি না। তুই এমন রেগে গেলি কেন?

তুমি সরি বল, তাহলে আর রাগ করে থাকব না।

শাহানা আন্তরিকভাবেই বলল, সরি। শুধু যে বলল তাই না–কৌতূহলী চোখে নীতুকে দেখল। এতদিনের চেনা নীতুকে আজ অচেনা লাগছে। এই অচেনা নীতু শান্ত সহজ কিন্তু ভয়ংকর তেজী।

নীতু, তোর রাগ কি কমেছে?

হুঁ।

তাহলে বল দেখি এই গাছটার নাম কি?

এই গাছের নাম হচ্ছে আমলকি।

ধ্যাৎ, তুই বানিয়ে বানিয়ে বলছিস।

বানিয়ে বানিয়ে বলব কেন, এটা হল আমলকি গাছ।

আর ঐ গাছগুলির নাম কি?

নীতু গম্ভীর গলায় বলল–ইপিল ইপিল।

যা মনে আসছে বলে ফেলছিস। ইপিল ইপিল গাছের নাম হয়?

হ্যাঁ হয়। তুমি যেমন অনেক কিছু জান যা আমি জানি না–আমিও তেমনি অনেক কিছু জানি যা তুমি জান না। যে কোন গাছের পাতা এনে দাও, আমি নাম বলে দেব।

শিখলি কোথায়?

আমি আর মিতু আপা প্রায়ই বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে যাই না? আমাদের কাজই তো হচ্ছে গাছের নাম মুখস্থ করা।

কেন?

এটা আমাদের একটা খেলা। আমি আর মিতু আপা দুজনে মিলে খেলি–তবে মিতু আপা আমার সঙ্গে পারে না।

শাহানা বলল, তুই সব গাছ চিনিস এটা যেমন বিশ্বাস করতে পারছি না আবার তেমনি অবিশ্বাসও করতে পারছি না–ঐ বড় বড় পাতাওয়ালা গাছটার কি নাম?

কাঠবাদাম।

আচ্ছা দাঁড়া, স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখি। ঐ বুড়োকে জিজ্ঞেস করব?

কর।

বুড়ো মানুষটা শাহানাদের কেমন ভীত চোখে দেখছে। শাহনা ভেবে পেল না–তাদের দেখে ভয় পাবার কি আছে। সবাই তাদের ভয় পাচ্ছে কেন? শাহানা এগিয়ে গেল–হাসিমুখে বলল, আচ্ছা শুনুন, এই গাছটার নাম কি?

আম্মা, এইটা হইল কাঠবাদাম গাছ। সাদা সাদা ফুল হয়। বড় সৌন্দর্য।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি কি গায়ক মতির বাড়িটা চেনেন?

আমরার মতি মিয়া?

হ্যাঁ, আপনাদের মতি মিয়া।

আইয়েন লইয়া যাই।

নিয়ে যেতে হবে না। আমাদের বলে দিন–আমরা যেতে পারব।

বুড়ো মানুষটা তারপরেও সঙ্গে গেল। বাড়ির সামনে তাদের দাঁড়া করিয়ে তারপর গেল। এই কাজটি করতে মানুষটাকে খুব আনন্দিত মনে হল।

মতি ভাত চড়িয়েছে। উঠানের চুলায় রান্না হচ্ছে। চুলা ভেজা, প্রচুর ধোয়া হচ্ছে। আগুন বার বার নিভে যাচ্ছে। রান্না সামান্য–ভাত, ভাতের হাড়িতেই দুটা আলু সেদ্ধ করতে দেয়া হয়েছে। ভাত–আলুভর্তা। সঙ্গে ডাল থাকলে জমিয়ে খাওয়া হত। ডাল ঘরে নেই। মতি চুলার পাশে বসে উঁচু মার্গের চিন্তা-ভাবনা করছে।

খিদে নামক একটা জটিল ব্যাপার দিয়ে আল্লাহপাক মানুষকে যে বিপদে ফেলেছেন এই নিয়েই সে এখন ভাবছে। খিদে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মানে পরাধীন হয়ে জন্মানো। খিদে না থাকলে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে মানুষ জন্মাত। আল্লাহপাকের মানুষকে পুরোপুরি স্বাধীন করার ইচ্ছা ছিল না। ইচ্ছা থাকলে তিনি অবশ্যই একটা উপায় করতেন।

পায়ের শব্দে মতি পেছনে ফিরে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। শাহানা হাসিমুখে বলল, কি করছেন?

মতি জবাব দিতে পারল না। তার উঠে দাঁড়ানো উচিত, সে দাঁড়াতে ভুলে গেছে। শাহানা বলল, হুট করে আপনার বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছি। রাগ করেননি তো? অবশ্যি হুট করে ঢুকে পড়া ছাড়া উপায়ও নেই। গ্রামে তো আর কলিংবেল নেই যে প্রথমে বেল বাজাব।

মতি উঠে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েই-বা সে কি করবে? এদের কোথায় বসতে দেবে? ঘরে কোন চেয়ার নেই। উঠানের এক মাথায় একটা জলচৌকি পড়ে আছে। বৃষ্টির কাদায় সেটা মাখামাখি।

শাহানা বলল, আপনি আমাদের জন্যে ব্যস্ত হবেন না, বিব্রতও হবেন না। আমরা চলে যাব। আপনি বলেছিলেন গান শুনাবেন। তারপর তো আর আপনার কোন খোঁজ নেই। গানের ব্যবস্থা হচ্ছে?

জ্বি জ্বি।

ও আচ্ছা। আমি ভাবলাম বোধ হয় ভুলে গেছেন।

জ্বি না, ভুলি নাই। আমার ইয়াদ আছে।

আমরা তাহলে যাই, আপনি রান্না করুন।

মতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। জটিলতার উপর জটিলতা–সে আছে খালি গায়ে। নীতু বলল, আপনি কি রাঁধছেন?

ভাত।

ভাত তো না। চাল রাঁধছেন। চাল ফুটে ভাত হবে। ভাতের সঙ্গে তরকারি কি?

আলু সিদ্ধ দিছি।

আলুসিদ্ধ আর ভাত? দুটাই তো কার্বোহাইড্রেট–প্রোটিন কোথায়? মানুষের শরীরে প্রোটিন দরকার। তাই না আপা?

মতি ক্ষীণ স্বরে বলল, মানুষের তো অনেক কিছুই দরকার। সব তো আর হয় না।

শাহানা বলল, আমরা যাচ্ছি, আপনি রান্না করুন। রান্নার মাঝখানে বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না।

শাহানা নীতুকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মতি আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। তার উচিত ছিল এগিয়ে দেয়া, তাও সে করল না। চূলা নিভে প্রচুর ধোঁয়া উঠছে। ধোঁয়ায় মতির চোখ জ্বালা করছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ