মনোয়ারা বড় মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে এসেছেন। আজ রাতে মনে হয় জমিয়ে শীত পড়েছে। লেপের নিচেও শরীর গরম হচ্ছে না। মীরার শীত সহ্য হয় না। সে লাল টুকটুকে কার্যে মাথা কান ঢেকে শুয়েছে। ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। বারান্দায় একশ ওয়াটের বাতি জ্বলছে। যদিও তেমন আলো হচ্ছে না। ঘরের ভেতরে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলছে না। ঘরে হারিকেনের আলো। মীরার কাছে না-কি হারিকেনের আলো অনেক আপন লাগে।

মনোয়ারা লেপের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বললেন, আজ মাঘ মাসের কত তারিখ বলতে পারবি?

মীরা বলল, পারব, ন তারিখ।

মাঘ মাসের অমাবস্যায় সবচে শীত পড়ে। আজ কি অমাবস্যা?

অমাবস্যা না মা, কাল রাতেই না তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুকিদের মতো চেঁচিয়ে বললে, ওমা কী সুন্দর চাদ! বাবাকে খুশি করার জন্যে বললে। বাবাও সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে গেল, কারণ তার গ্রামের চাদ সুন্দর।

মনোয়ারা বিরক্ত গলায় বললেন, তোর ধারণা আমি যা করি সব তোর বাবাকে খুশি করার জন্যে?

হ্যাঁ আমার তাই ধারণী। আগের জন্মে তুমি কী ছিল জানো মা? আগের জন্মে তুমি ছিলে কোনো মহারাজার প্রধান চাটুকার। ইয়েস ম্যান। এই জন্যেও সেই স্বভাব রয়ে গেছে।

চুপ করবি?

না চুপ করব না। তোমার উপর আমার খুব রাগ লাগে মা। তোমার। কোনো স্বাধীন সত্তা কেন থাকবে না।

আমার স্বাধীন সত্তা নেই?

না নেই। এই যে আমি বললাম, তুমি আমার সঙ্গে যুমাও—ওমনি তুমি বাবাকে ছেড়ে চলে এলে যদিও তোমার মন পড়ে আছে বাবার কাছে। দুজনে শুয়ে থাকতে, বাবা বস্ত্রাপচা কোনো বোরিং গল্প শুরু করত। তুমি রোমাঞ্চিত এবং শিহরিত হবার ভান করতে। তুমি হঠাৎ করে মরে গেলে বাবার কী হবে তাই ভাবছি।

মনোয়ারা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, মানুষটা অচল হয়ে পড়বে।

মীরা বলল, মোটেই অচল হবে না। পুরুষমানুষ কখনো অচল হয় না।

মেয়ের কঠিন কঠিন কথা শুনতে মনোয়ারার ভালো লাগছে না। অনেক দিন পর তিনি বড় মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে এসেছেন। কোথায় গভীর রাত পর্যন্ত দুজনে মিলে মজা করে গল্প করবেন, তা না মেয়ে কঠিন কঠিন সব কথা বলা শুরু করেছে। মনোয়ারার ইচ্ছা করছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে থাকতে সাহসে কুলুচ্ছি না। মেয়ে হয়তো রেগে যাবে। বড় হলে মেয়েরা খুব আশ্চর্যরকম। ভাবেই বদলে যায়। মীরা যখন ছোট ছিল তাকে জড়িয়ে ধরে না থাকলে ঘুমুতে পারত না। শুধু যে জড়িয়ে ধরা তা না, তার হাতের মুঠিতে মনোয়ারার শাড়ির আঁচল ধরা থাকত। রাতে বাথরুমে যাওয়া ও সমস্যা। মেয়ের হাত থেকে। শাড়ির আঁচল খুলতে গেলেই মেয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত।

মনোয়ারা নিজের মনে ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, খুব শীত লাগছে। শরীর গরম হচ্ছে না। মনে হচ্ছে লেপের ভেতর কেউ বরফগলা পানি ঢেলে দিয়েছে।

মীরা বলল, এক কাজ কর মা। আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকো।

মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর কাছে আসতেই আমার ভয় লাগে না। তুই আমার শরীরে গোবরের গন্ধ, ঘাসের গন্ধ এইসব নাকি পাস।

মীরা হাসতে হাসতে বলল, তোমাকে রাগাবার জন্যে বলি মা। তোমার গায়ে খুব সুন্দর গন্ধ। সুন্দর না টাটকা গন্ধ।

টাটকা গন্ধ আবার কী?

নতুন বই খুললে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় তেমন গন্ধ।

তোর অদ্ভুত কথাবার্তার আমি কিছুই বুঝি না। আমার গায়ে বইএর গন্ধ। আসবে কেন? বই এর সঙ্গে কি আমার কোনো সম্পর্ক আছে? তোর বাবার গা। থেকে বইএর গন্ধ এলেও একটা কথা ছিল। সে দিনরাত বই নিয়ে থাকে। তোর এখানে আসার সময় দেখেছি এত মোটা এক বই নিয়ে বসেছে। আমি বললাম, শুয়ে পড়। রাত হয়েছে। সে বলছে দুটা পাতা পড়েই শুয়ে পড়বে। আমার ধারণা এখনো বই পড়ছে।

মা যাও দেখে আস বাবা এখনো বই পড়ছে কি-না। যদি দেখ এখনো পড়ছে তাহলে হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দেবে। এবং চেক করবে পায়ে মোজা পরেছে কি-না।

মীরা কথাগুলি বলল ঠাট্টা করে কিন্তু মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নেমে গেলেন। মীরা উঠে বসল। সে অবাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে আছে। মনোয়ারা মেয়ের দিকে ফিরলেন না বলে মেয়ের অবাক দৃষ্টি দেখলেন না।

 

আজহার সাহেব সত্যি সত্যি বই পড়ছেন। স্ত্রীকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হলেন না। তিনি জানতেন মনোয়ারা আরেকবার খোঁজ নিতে আসবেন। ঘরের দরজা খুলে রেখেছেন এইজনেই। মনোয়ারা হতি থেকে বই নিয়ে নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, রাত একটা বাজে। এই বয়সে অনিয়ম করা একদম ঠিক না। দরজা লাগাও, দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়।

তোমরা অনিয়ম করতে পারবে আর আমি পারব না?

আমরা কী অনিয়ম করছি?

এই যে মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে যাচ্ছ। সারা রাত গল্প করবে। করবে না?

না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, গিয়েই শুয়ে পড়ব।

আমার উপর মীরার যে রাগ ছিল, সেটা কি একটু কমেছে?

তোমার উপর রাগ থাকবে কেন?

মীরার হাত থেকে বই নিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম।

কী যে তুমি বল। এইসব কি সে মনে করে রেখেছে? মেয়েটা তোমাকে কী যে পছন্দ করে যদি জানতে তাহলে আজেবাজে প্রশ্ন করতে না।

খুব পছন্দ করে?

মুখে বলে না কিন্তু…

কে বেশি পছন্দ করে—মীরা না শেফা?

দুজনই তোমার জন্যে পাগল, তবে আমার ধারণা তোমার দিকে মীরার টানটাই বেশি। আমি তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। মীরাই আমাকে পাঠাল দেখে আসার জন্যে তুমি এখনো বই পড়ছ কি-না। আমাকে বলল, তুমি অবশ্যই বাবার হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে বাবাকে শুইয়ে দেবে। বাবা মোজা পরেছে কি-না দেখবে। ভালো কথা, তুমি মোজা পরেছ?

হুঁ।

এসো দরজা বন্ধ কর। আমি চলে যাব।

আজহার সাহেব বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, সারাক্ষণ বকাবকি করি, তারপরেও মেয়ে দুটা আমাকে এত পছন্দ করে কেন এই রহস্যটাই বুঝলাম না।

আনন্দে আজহার সাহেবের চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তার চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। পৃথিবীর দশজন সুখী মানুষের তালিকা করা হলে তার নাম সেই তালিকায় থাকবে। উপরের দিকেই থাকবে।

 

মনোয়ারা মেয়ের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, কিরে তুই বসে আছিস কেন?

মীরা হাসিমুখে বলল, তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে বসে আছি।

আমার তো ঘুম আসছে।

ঘম এলে ঘুমিয়ে পড়। সারাদিন পরিশ্রম করেছ। ছোটাছুটি-রান্নাবান্না।

মনোয়ারা লেপের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে হালকা গলায় বললেন, সাবের ছেলেটার সঙ্গে তোর কি ঝগড়া টগড়া হয়েছে?

না। আমার সঙ্গে কারোর ঝগ হয় না।

মাঝে মাঝে ঝগড়া হওয়া ভালো। ঝগড়া হচ্ছে ঝড়ের মতো–ঝড়ে যেমন ধুলা ময়লা উড়ে যায়, ঝগড়াতেও মনের ধুলা ময়লা উড়ে যায়।

মা প্লিজ জ্ঞানের কথা বলবে না। বাবার সঙ্গে থেকে তোমারও দেখি জ্ঞানের কথা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা আমি আর কোনো কথাই বলব না। তুই গল্প কর আমি শুনি। বলে আছিস কেন? আয় শুয়ে শুয়ে গল্প করি।

তুমি শুয়ে থাকে। আমি বসে বসে গল্প করি। একটা শর্ত আছে মা।

কী শর্ত?

গল্পটা শেষ করেই আমি ঘুমুতে যাব।

কি যে তোর পাগলের মতো কথা। গল্প শেষ করে ঘুমুতেই তো যাবি। জেগে বসে থাকবি নাকি?

আমি জেগে বসে না-থাকলে ও তুমি থাকবে। এবং আমার ধারণা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার চেষ্টা করবে। দয়া করে এই কাজটা করবে না।

মনোয়ারা বিস্মিত হয়ে বললেন, কী এমন গল্প?

গল্পের শুরুটা ইন্টারেস্টিং শেষটা তেমন ইন্টারেস্টিং না। মা শুরু করব?

হ্যাঁ শুরু কর।

তুমি কিন্তু গল্পের মাঝখানে একটা কথাও বলবে না। হ্যাঁ, হু বলারও দরকার নেই। আসলে আজ যে আমি তোমাকে আমার সঙ্গে ঘুমুতে বলেছি— এই গল্পটা করার জন্যেই বলেছি।

মনোয়ারা উঠে বসলেন। তার বুক ধড়কড় শুরু হয়েছে। সামান্যতেই আজকাল তার এই সমস্যা হয়। মেয়ে একটা গল্প বলবে, সেই গল্পের ভনিতা শুনেই তার বুক ধড়ফড় কবে কেন?

মা শোনো, গল্পটা খুব সাধারণ। আমি এক মিনিটে ও বলতে পারি আবার ইচ্ছা করলে এক ঘণ্টা লাগিয়েও বলতে পারি।

এক মিনিটে বলতে হবে না। তুই সময় নিয়ে বল্।

তোমাকে তো বলেছি মা গল্পের মাঝখানে ইন্ট্রারেট করতে পারবে না। একটি কথাও না। বুঝতেই পারছ গল্পটা আমাকে নিয়ে। বুঝতে পারছ না?

হ্যাঁ বুঝতে পারছি।

মীরা হেসে ফেলে বলল, এই তো মা তুমি কথা বললে। শর্ত কী ছিল তুমি কথা বলতে পারবে না।

আর বলব না। তুই এত প্যাঁচাচ্ছিস কেন?

আচ্ছা যাও আর প্যাঁচাব না—গল্পটা আমাকে আর সাবেরকে নিয়ে। আমার ক্লাসের যে কটা ছেলেকে আমি অপছন্দ করতাম তার মধ্যে সাবের একজন। তাকে অপছন্দ করার অনেক কারণ আছে। তার সবকিছুই সস্তা। কথাবার্তা সস্তা, রসিকতাগুলি সস্তা। সবকিছুতেই চালবাজি। গ্রাম থেকে যারা হঠাৎ করে ইউনিভার্সিটিতে আসে তাদের মধ্যে এই ব্যাপারটা খুব দেখা যায়। অতিরিক্ত অতিরিক্ত স্মার্টনেস দেখাতে চেষ্টা করে। ক্লাস চলার সময় লুকিয়ে সিগারেট টানার মধ্যে অনেক বাহাদুরি। আমার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় ধমকের মধ্যে। একদিন হ্যান্ডব্যাগ খুলে দেখি-ব্যাগের ভেতর দুটা গোলাপ ফুল। স্কচ টেপ দিয়ে গোলাপ উঁটার সঙ্গে একটা চিরকুট। সেখানে লেখা–বলুনতো কে?

আমি ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র তাকে ধরলাম এবং কঠিন গলায় বললাম, আপনার কি ধারণা লুকিয়ে মেয়েদের ব্যাগে ফুল রেখে দেয়া বিরাট পৌরুহের কাভা?

সে আমতা আমতা করে রসিকতার লাইন ধরতে চেষ্টা করল। আমি ধমক দিয়ে বললাম, আপনার সস্তা রসিকতাগুলি অন্যদের জন্যে রেখে দিন। আমার জন্যে না।

দামী কোনো রসিকতা যদি মাথায় আসে তাহলে কি করতে পারি?

আমি বললাম, হ্যাঁ পারেন। রসিকতা আমি পছন্দ করি। তবে আপনি যা করেন তার নাম ছ্যাবলামি। ছ্যাবলামির মধ্যে কোনো স্মার্টনেস নেই।

আমি ভেবেছিলাম তার সঙ্গে এটাই হবে আমার শেষ কথা। তা হল না, কারণ সে আমাকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় রসিকতা শুরু করল। সবাইকে বলে বেড়াল—আমি তার সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি যদি আমার ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা না চাই তাহলে সে চুল দাড়ি কিছুই কাটবে না। যেদিন আমি ক্ষমা চাইব সেদিনই সে চুল দাড়ি কাটবে। আমি ব্যাপারটাকে মোটেই পাত্তা দিলাম না। সে সত্যি সত্যি চুল দাড়ি কাটা বন্ধ করে দিল এবং দেখতে দেখতে তার চেহারা কিম্ভুত কিমাকার হয়ে গেল। ব্যাপারটাতে কাসের সবাই খুব মজা পেতে লাগল। শুধু যে ছাত্ররা মজা পেল তা না, টিচাররাও মজা পেলেন। একদিন ক্লাসে মোতালেব স্যার বললেন, সাবের তোমার এই অবস্থা। কেন? সন্ন্যাস নিয়েছ।

সাবের সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জ্বি না স্যার। আমার দাড়ি গোঁফ হচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা। ক্লাসের একজন আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। সে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত দাড়িগোঁফ কাটব না।

স্যার বললেন, প্রতিবাদের এই প্রক্রিয়া খারাপ না। অহিংস পদ্ধতি। আমার মতে যার কারণে এই ঘটনা তার ক্ষমা চাওয়া উচিত।

স্যারের কথা শেষ হওয়া মাত্র সব ছাত্র-ছাত্রী একসঙ্গে আমার দিকে তাকাল। স্যারের জানতে বাকি রইল না কার কারণে এই প্রতিবাদ। তারপর থেকে ক্লাসে এসেই তিনি সাবেরকে জিজ্ঞেস করেন এখনো ক্ষমা চায়নি? সবাই হো হো করে হেসে উঠে। কিছুক্ষণ হাসাহাসির পর ক্লাস শুরু হয়। গল্পটা কেমন লাগছে মা? ইন্টারেস্টিং না?

হ্যাঁ ইন্টারেস্টিং।

তারপর একদিন আমি মহৰিরক্ত হয়ে ভাবলাম—তাকে বলব দাড়িগোক কামিয়ে ভদ্র হতে। ক্লাসে তাকে কিছু বলা যাবে না। আমাকে সাবেরের সঙ্গে কথা বলতে দেখলেই চারদিকে হাসাহাসি হয়ে যাবে। আমি ঠিক করলাম একদিন তার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলব।

সাবের হলে থাকে না?

মহসিন হলে তার সীট আছে কিন্তু সে হলে থাকে না। তার বড় মামার বাড়িতে থাকে–পাহারাদার।

পাহারাদার মানে?

ওর মামা উত্তরায় একটা বাড়ি করেছেন। বাড়ি করার পর পর ফ্যামিলি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছেন। সেই বাড়ির জন্যে দারোয়ান আছে। তারপরেও তিনি সাবেরকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন মাঝে মাঝে গিয়ে দেখেশুনে আসতে। সাবের পুরোপুরি স্থায়ী হয়ে গেছে।

তুই সেই বাড়িতে একা-একা গেলি?

হ্যাঁ। বাবার গাড়ি নিয়ে গেলাম। সে আমাকে দেখেই বলল—আপনি এসেছেন এই যথেষ্ট। আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আপনি পাচটা মিনিট বসুন। আমি সেলুন থেকে দাড়িগোঁফ ফেলে দিয়ে আসছি। আপনাকে চা দিয়ে যাবে। চা খেতে যতক্ষণ লাগে।

আমি বসলাম। চা খেলাম। সে দাড়িগোঁফ কামিয়ে ভুদ হয়ে ফিরে এল। আমরা মিনিট পাঁচেক কথা বললাম। সে-ই হড়বড় করে কথা বলল, আমি শুনলাম। যখন চলে আসছি তখন সে বলল, চল তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। তুমি একা-একা এতদূর যাবে।

তুমি করে বলল?

হ্যাঁ তুমি করে বলল। অতিরিক্ত স্মার্টনেস দেখাতে হবে তো। তাও ভাগ্যবান সে আমাকে তুমি বলছে। অন্য মেয়েদের তুই করে বলে।

বলিস কী!

আঁৎকে উঠার কিছু নেই মা। বর্তমানে ইউনিভার্সিটির এটাই চুল। যাই হোক সে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল আমি এখন একা-একা যাব তুমি আমাকে এগিয়ে দাও। তার এই কথাটা কেন জানি আমার খুব ভালো লাগল।

তুই তাকে এগিয়ে দিলি?

হুঁ দিলাম।

তারপর?

তারপর হঠাৎ একদিন দেখি আগে তার যেসব ব্যাপার অসহ্য লাগত সেগুলি ভালো লাগতে শুরু করেছে। তার সস্তা রসিকতায় সবচে আগে আমি হাসতে শুরু করেছি। আমার ব্যাগে অজান্তে গোলাপফুল ঢুকিয়ে রাখলে আমার অসম্ভব ভালো লাগে। তার হাতে লেখা ছোট ছোট চিরকুট গুলি আমি জমিয়ে রাখি। যতবার পড়ি ততবারই আমার ভালো লাগে। চোখে পানি এসে যায়। আমি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তার সঙ্গে ঘুরতে শুরু করলাম। রমনা পার্কে এবং চন্দ্রিমা উদ্যানে ছেলেমেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে শুটুর গুটুর করে গল্প করছে এই দৃশ্য, আমার সব সময় অসহ্য লাগত। সেই ব্যাপারগুলি আমি নিজেই করতে লাগলাম এবং একসময় খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে তার উত্তরার বাসায় যেতে শুরু করলাম। নির্জন বাড়িতে আমরা দুজন সময় কাটাতে লাগলাম।

মনোয়ারা নিচু গলায় বললেন, কাজটা ঠিক হয়নি।

মীরা তীব্র গলায় বলল, কেন ঠিক হবে না? আমি তাকে পছন্দ করি। সে আমাকে করে, আমরা একসঙ্গে সময় কাটালে অসুবিধা কী?

ভুল করে ফেলতে পারিস তো মা সেইজন্যে বলছি।

মীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। মার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বলল, তুমি যে ভুলের কথা বলেছ সেই ভুলই করেছি। যখন করেছি তখন ভুল মনে হয়নি। তখন মনে হয়েছে যা করছি ঠিক করছি। শুদ্ধতম কাজটি করছি। এখন বুঝতে পারছি। এখন বুঝে তো কোনো লাভ নেই মা। যে ভুল করা হয়েছে সে ভুল শুদ্ধ করার আর উপায় নেই।

মনোয়ারা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, তার মানে?

মীরা ক্লান্ত গলায় বলল, সবই তো বললাম মা। এর পরেও মানে জানতে চাচ্ছ কেন? তুমি কি দেখছ না এখন আমার শরীর খারাপ। আমি কিছু খেতে পারি না। যা খাই বমি হয়ে যায়। আমি পর পর দুটা সাইকেল মিস করেছি।

মনোয়ারা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মীরা বলল, আমি সাবেরকে সব জানিয়েছি। শুরুতে সে বলেছে আমি যখন বলব তখনি সে আমাকে বিয়ে করবে। এখন বলছে তা সম্ভব না। তার মাথার উপর অনেক দায়িত্ব। পাশ করে চাকরিবাকরি না-করা পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না। আমাকে বলছে কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। এইসব নাকি এখন কোনো ব্যাপারই না। মা শোনো তুমি এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে না। আমি ভয়ংকর একটা ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবে বলে ফেললাম। এ ছাড়া আমার উপায়ও ছিল না। তোমাকে সব বলে ফেলার পর আমার খুব শান্তি লাগছে। আমি গত দুমাসে আরাম করে রাতে ঘুমুতে পারিনি। আমি নিশ্চিত আজ আমার খুব ভালো ঘুম হবে।

মনোয়ারা বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। মীরা বুঝতে পারল না। তিনি কী বলেছেন তা জানতেও চাইল না। সে বিছানায় শুয়ে গলা পর্যন্ত লেপ টানতে টানতে বলল, মা আমি দুটা জিনিস ঠিক করেছি। এক, আমি কখনোই কোনো অবস্থাতে সাবেরকে বিয়ে করব না। সে যদি কুকুরের মতো এসে আমার পা চাটতে শুরু করে তাহলেও না। দুই, আমি আমার পেটের সন্তানটি নষ্ট করব না। আমি তাকে আমার মতো করে বড় করব।

মীরা চোখ বন্ধ করে ফেলল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ