ঝড় থেমে গেছে।

আমাদের লঞ্চ ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি একটা জায়গায় থেমে আছে। জায়গাটা দেখাচ্ছে খানিকটা সুন্দরবনের বাড়ির মতো। সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আকাশ মেঘশূন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে রূপার থালার মতো প্রকাও চাদ উঠলেও আমি বিস্মিত হব না।

প্রবল উত্তেজনার অবসান হলে শরীরে কোমল আলস্য নেমে আসে। লেখকের ভাষায় কোমল আলস্য বললাম। সাধারণ ভাষায় শরীর ছেড়ে দেয়। আমার শরীর মন দুইই ছেড়ে দিয়েছে। ডেকে চেয়ার পেতে বসেছি। এক হাতে সিগারেট অন্য হাতে চায়ের কাপ। আমার চমক্কার লাগছে।।

অসংখ্য ছেলেমেয়ে তীরে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের চাঞ্চল্য দেখে মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম তারা লঞ্চ নামক জলযান দেখল। শিশুদের সংখ্যা আরও বাড়ছে। ভাটি অঞ্চল সম্পর্কে প্রচলিত কথা হলো, সাতটার কম কারোর ছেলেমেয়ে থাকলে তাকে আঁটকুড়া বলা হয়। কথা সত্যি হতে পারে।

সর্পরাজ মুখভর্তি পান নিয়ে আমার পাশে বসে আছে। শুধু ঝড়ের সময় তার মুখে পান দেখি নি। এই সময়টুকু ছাড়া সারাক্ষণ তার মুখে পান। আমার ধারণা ঘুমের মধ্যেও সে পান খায়। তার স্ত্রী (আমি ডাকি সর্পরানী) ঘুমন্ত স্বামীর মুখে পান ঠেলে দেয়।

সর্পরাজ বলল, স্যার, এই জায়গাটার নাম তারানগর।

আমি বললাম, এমন অজপাড়াগাঁর নাম নগর।

এর উত্তরে মুখভর্তি পান নিয়ে সে কী বলল, ঠিক বোঝা গেল না। তার সিলেটি ভাষা আমার কাছে বেশিরভাগ সময় দুর্বোধ্য মনে হয়।

সর্পরাজ লঞ্চের ডেকে টকটকে লাল রঙের পিক ফেলে বলল, স্যার, মুনশি সাবরে খবর দিয়া আনব? আলাপ করলে মজা পাবেন।

আমি বললাম, কাউকে খবর দিয়ে আনতে হবে না। আমি যথেষ্ট মজা এমনিতেই পাচ্ছি। আমরা মূল লোকেশনের দিকে কখন রওনা হব?

সর্পরাজ বলল, সমইস্যা আছে।

সমস্যার বিষয়টা শুনলাম। আমরা মূল লোকেশন থেকে অনেক উত্তরে চলে এসেছি। সুনামগঞ্জ ফিরে যাওয়ার মতো ডিজেল লঞ্চে নেই। ডিজেলের সন্ধানে লোক গেছে।

আমি বললাম, এত সামান্য ডিজেল নিয়ে আমরা রওনা হয়েছিলাম?

এই প্রশ্নের উত্তরে অদ্ভুত কথা শুনলাম। লঞ্চ যখন আল্লাহর হাতে সোপর্দ করা হলো তখনই এক ড্রাম ডিজেল ফেলে দেওয়া হলো। আল্লাহ যেন বোঝেন লঞ্চযাত্রীরা এখন সম্পূর্ণ অসহায়। তাঁর রহমত ছাড়া এদের গতি নেই।

 

শিশুদের সঙ্গে এখন কিছু বয়স্ক ব্যক্তিও যুক্ত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্যে সর্পরাজ এগিয়ে গেল।

সর্পরাজ : মুনশি সাব আছুইন নি?

সমবেত উত্তর : অয় অয়। (অর্থাৎ হ্যাঁ হ্যাঁ।)

সর্পরাজ : মুনশি সাবরে খবর দেউক্কা। লিখক হমায়ূন সাব লঞ্চে আইছুইন। মুনশি সাবের লগে উনার খুবই আলাপের খায়েশ।

শিশুর দলের একজন : লইয়া আইরাম। (অর্থাৎ নিয়ে আসছি)

এই শিশু ছুটে যাচ্ছে। তার পেছনে কম করে হলেও আরও কুড়িজন যাচ্ছে। আমার বিরক্তির সীমা রইল না। সর্পরাজকে স্পষ্ট জানিয়েছি, আমি কারও সঙ্গেই কথা বলতে চাচ্ছি না। নিতান্ত পরিচিত বলয়ের বাইরে আমি মুখ খুলতে পারি না। আশপাশে কয়েকজন অপরিচিত মানুষ থাকলেই আমার মনে হয় আমি কোনো সেমিনারে এসেছি। সেমিনারে প্রধান বক্তা আমি। কোন বিষয়ে সেমিনার এখনো জানি না। বক্তৃতায় কী বলব তাও জানি না

সর্পরাজ আমার সামনে বসতে বসতে বলল, মুনশিরে খবর দিছি। চইলা আসবে।

মুনশি সাবকে খবর দিতে আমি বলি নি।

সর্পরাজ বলল, উনারে যদি আপনার পছন্দ না হয় আমার দুইগালে দুইটা চড় দিবেন।

উনি করেন কী?

মসজিদের ইমাম। মিজিক দেখায়।

কী দেখায়?

মিজিক। জুয়েল আইচ উনার কাছে দুধের শিশু।

মসজিদের ইমাম ম্যাজিক দেখান?

জি অয়।

আমি খানিকটা অবাক হলাম। মসজিদের ইমাম ম্যাজিশিয়ান? প্রায় দেড় শ বছর আগে নেত্রকোনায় মসজিদের জুনৈক ইমাম গান লিখতেন। গানে সুর দিয়ে গাইতেন। তাঁর নাম উকিল। মসজিদে ইমামতি করতেন বলে নামের শেষে মুনশি যুক্ত হয়েছে। তিনি পরিচিত হয়েছিলেন উকিল মুনশি হিসেবে।

উকিল মুনশির একটি গান—শোয়া চান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি? আমি শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতে ব্যবহার করেছিলাম। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির জ্ঞানী বিচারকরা শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার উকিল মুনশিকে দিলেন। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো, উকিল মুনশির ঠিকানা কী? তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?

আমি বললাম, কবর খুঁড়লেই পাওয়া যাওয়ার কথা। দেড়শ বছর পার হয়েছে এটা একটা সমস্যা।

কোনো ছবির মৌলিক গানের জন্যে গীতিকারকে পুরস্কার দেওয়ার বিধান আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, হাছন রাজার গান ব্যবহার করলে তাদের শ্রেষ্ঠ গীতিকার পুরস্কার দেওয়া যায় না। উকিল মুনশি যে সেই দলেরই পুরস্কার কমিটি তা জানতেন না। বাংলাদেশের যে-কোনো কমিটিতে বেশিরভাগ সদস্য মূর্খ থাকবেন এটা নিপাতনে সিদ্ধ।

গায়ক উকিল মুনশির পর আরেকজন পাওয়া গেল ম্যাজিক মুনশি। খারাপ কী!

সর্পরাজ বলল, স্যার কি আমার উপর নারাজ হয়েছেন? মিজিক মুনশি খবর দিলাম এই কারণে।

কিছুটা নারাজ হয়েছি। আমার একা থাকতে ভালো লাগছিল।

আপনি তো মিজিক ভালো পান।।

তা অবশ্য পাই।। তাহলে উনার মিজিক দেখলে আপনার দিলখোশ হবে।

আমি দিলখোশ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছি। মুনশি সাহেব আসছেন না। সন্ধ্যা পুরোপুরি মিলিয়েছে। আকাশে আলোর আভা নেই। শত শত জোনাকি পোকা বের হয়েছে। অনেকদিন পর একসঙ্গে এত জোনাকি পোকা দেখলাম।

এক যাত্রায় অনেক অভিজ্ঞতা। শাওন সঙ্গে থাকলে বলতাম, জোনাকি ঝিকিমিকি গানটা করো তো। সঙ্গে সঙ্গে সে গান ধরত কি না জানি না। বিয়ের আগে তাকে গান গাইতে বললে এক সেকেন্ডের মাথায় গান ধরত। বিয়ের পর সাধ্যসাধনা করতে হয়।

পুত্র নিষাদকে খুব মিস করছি। একসঙ্গে এত জোনাকি পোকা দেখে সে কী কত কে জানে। নুহাশপল্লীতে মাঝে মাঝে কিছু জোনাকি পোকা দেখা যায়। নিষাদ তাদের ধরার জন্য পেছনে পেছনে ছছাটে। তার কী আনন্দ!

শিশুর দল এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত বাড়িতে তাঁদের করার কিছু নেই। বাবা-মারাও চান না তারা ঘরে ফিরুক।

আমি সর্পরাজকে বললাম, তোমার ম্যাজিক মুনশি সাহেব সম্ভবত আসবেন। আমি আমার কেবিনে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ একা থাকব।

লেখালেখি করবেন?

কাগজে-কলমে করব না, মনে মনে করব।

মনে মনে কীভাবে লিখবেন?

আমি বললাম, লেখকরা মনে মনে যত লেখা লিখেন তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ লিখেন কাগজে কলমে।

সর্পরাজ পান মুখে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল, অয় অয়। তার অয় অয় ধ্বনির পরপরই সোনালি মেয়েটি প্রায় দৌড়ে উপস্থিত হয়ে প্রথমে আমাকে তারপর সর্পরাজকে কদমবুসি করল। সর্পরাজ এই ঘটনায় কোনো অস্বাভাবিকত্ব খুঁজে পেল না। তরুণী মেয়েরা ছুটে এসে তাকে কদমবুসি করবে এটাই যেন স্বাভাবিক। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে পান চিবুতে লাগল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ব্যাপার কী?

সোনালি বলল, আপনি আমাকে সিনেমায় রোল দিবেন এটা শোনার পর থেকে মাথা আউলা হয়ে গেছে।

ঝোল দেব তোমাকে কে বলেছে?

ম্যানেজার স্যার বলেছেন।

সামনের চেয়ারটায় বসো।

মেয়েটি বসল। আমি বললাম, পড়াশোনা কতদূর করেছ?

ইন্টার পর্যন্ত পড়েছি। পরীক্ষা দিতে পারি নাই। পরীক্ষার আগের দিন ডিরেক্টর সবুজ ভাই বললেন, ব্যাংককে ধারাবাহিক নাটক করব, ভগ্ন সৈকত। চলো আমাদের সঙ্গে, একটা সাইড রেলি দিয়ে দিব।

সাইড রোল পেয়েছিলে?

জি-না। আমি আর সবুজ ভাই ব্যংককে গেলাম শনিবারে। রোববারে নাটকের দলের বাকি সবার আসার কথা। তারা ভিসা পায় নাই বলে আসতে পারল না।

তুমি সবুজ ভাইয়ের সঙ্গে কত দিন ব্যংককে ছিলে?

সাত দিন। সবুজ ভাই অপেক্ষায় ছিলেন যদি নাটকের দল চলে আসে। ব্যাংককে খুব মজা করেছিলাম। সবুজ ভাই খুব আমুদি মানুষ।

তুমি এখন যাও। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।

সোনালি আনন্দিত গলায় বলল, আপনার মাথা বানায়ে দিব স্যার? আমি নাপিতের চেয়েও ভালো মাথা মালিশ করতে পারি।

আমি বললাম, মা মালিশ করতে হবে না।

সর্পরাজ বলল, দেখি আমার মাথা বানাও। মাথা বানানি কেমন হিখছ পরীক্ষা হউক।

সোনালি মহানন্দে সর্পরাজের মাথার চুল টানতে লাগল। আমি কেবিনের দিকে রওনা হলাম।

 

কেবিনে বসে আছি। নুহাশপল্লীর ম্যানেজার দুটি মোমবাতি এবং একটি লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। দুটি মোমবাতির একটি বাতাসের ঝাপটায় নিভে গেছে। অন্যটি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাতাসের বিরুদ্ধে তার জীবনযুদ্ধ দেখতে ভালো লাগছে।

ম্যানেজার বলল, স্যার আপনার জন্য একটা খাসি ছদকা দিয়েছি।

কেন?

আল্লাহপাক আপনার জীবন রক্ষা করেছেন এইজন্য।

ছদকার সিস্টেমটা কী? কোনো গরিব মানুষকে খাসি দিয়ে দেওয়া হয়েছে?

ম্যানেজার বলল, মুরগি দুদকায় এই বিধান। গরু-খাসির বেলায় অন্য বিধান। আল্লাহর নামে জবেহ করা হয়। যার নামে ছদকা সে খেতে পারে না। অন্যরা পারে। আপনি যাতে খেতে পারেন তার জন্য আলাদা একটা খাসি কাটা হয়েছে। খানা দিতে সামান্য বিলম্ব হবে।

হোক বিলম্ব। এখন সামনে থেকে যাও।

আমি আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসে আছি। ম্যাজিক মুনশির কারণেই হয়তো মাথায় ঘুরছে ম্যাজিক।

বলা হয়ে থাকে ম্যাজিকের শুরু প্রাচীন মিসরের ফারাওদের সময়ে। ফারাওরা (ফেরাউন) ছিলেন ম্যাজিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তাদের রাজসভাতে নামী ম্যাজিশিয়ানরা মন্ত্রীর পদমর্যাদায় থাকতেন। অবিশ্বাস্য সব কর্মকাণ্ড করে আঁরা সম্রাটকে আনন্দ দান করতেন। পবিত্র কোরান শরীফ এবং বাইবেলে তার উল্লেখ আছে।

সূরা আরাফের ১১৫ থেকে ১১৭ নম্বর আয়াতে আছে—

তারা (জাদুকররা) বলল, হে মুসা! তুমি ছুড়বে না আমরা ছুড়ব? মুসা বলল, তোমরাই ছোড়ো। যখন তারা ছুড়ল লোকের চোখে ভেলকি লেগে গেল। এবং তারা ভয় পেয়ে গেল যেন তারা ভোজবাজি দেখছে।

মুসার প্রতি আমি হুকুম করলাম, তুমিও তোমার লাঠি ছোড়। হঠাৎ লাঠিটা ওদের ভুয়া সৃষ্টি গ্রাস করে ফেলতে

লাগল। এখানে কিন্তু লাঠির সাপ হয়ে যাওয়ার কথা নেই। বাইবেলে আছে। বাইবেলে মুসা (আঃ)-এর কথা বলা হয় নি। বলা হয়েছে তার ভাই এরন-এর কথা।

এরন প্রথমে তার লাঠি ফেললেন, সেটা সাপ হয়ে গেল। তখন ফেরাউনের নির্দেশে তার জাদুকররা লাঠি ফেলল। সেগুলি সাপ হয়ে গেল। তখন এরনের সাপ সবগুলিকে গিলে খেয়ে ফেলল। {Exodus vil 10, 11, 12}

ঊনবিশং শতাব্দীর বিখ্যাত জাদুকর রবার্ট হেলার (১৮৩৩-১৮৭৮) দাবি করেন তিনি লাঠি সাপ হয়ে যাওয়ার জাদু কায়রো শহরে বেশ কয়েকবার দেখেছেন। তিনি এই জাদুর ব্যাখ্যাও করেন। তার মতে লাঠিটা আসলেই সাপ। হিপনোটিক পদ্ধতিতে কিংবা কোনো ড্রাগ খাইয়ে সাপকে শক্ত লাঠির মতো করা হয়। সাপকে ছুড়ে ফেললে তার হিপনোটিক spell কিংবা ড্রাগের প্রভাব কেটে যায়।

অতি প্রাচীন ম্যাজিকের কিছু তথ্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামের লাইব্রেরিতে সংক্ষিত আছে। যীশুখ্রিষ্টের জন্মের ৩৭৬৬ বছর আগে সম্রাট কুফুর দরবারে এই জাদু দেখানো হয়। জাদুকরের নাম চাচা আংখ (Tchatcha-en-ankk}, জাদুকর একজনের মাথা কেটে তা জোড়া দিয়ে সম্রাটের বিস্ময় উৎপাদন করেন।

আধুনিক জাদুকররা ইলেকট্রিক করাতে তরুণীর দেহ দুভাগ করে আবার জোড়া দেন। এই কাজে তাদেরকে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়। প্রায় চার হাজার বছর আগেকার জাদুকরের হাতে নিশ্চয়ই এই প্রযুক্তি ছিল না। সম্রাট কুফুর দরবারের জাদুকর কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন আজ আর তা জানার কোনো উপায় নেই।

 

স্যার আসব?

আমি চমকে তাকালাম। দরজার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে তিনিই যে ম্যাজিক মুনশি তাতে সন্দেহ রইল না। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। মুনশি মাওলানারা দাড়ি রাখেন। গোঁফ রাখেন না। পানি পান করার সময় গোফ পানি স্পর্শ করলে পানি নষ্ট (বা হারাম হয়ে যায়, এই কথা প্রচলিত। যদিও হজরত আলী (রাঃ) -র গালপাট্টা ছিল। গোঁফ ছিল, দাড়িও ছিল।

দরজার সামনে যিনি দাড়িয়ে আছেন তার মাথার চুল গ্রামের বয়াতিদের মতো লম্বা। মধ্যবয়স্ক মানুষ। অত্যন্ত সুপুরুষ। চোখের তারা ঘন কালো। চোখ যক্ষা রোগীর মতো ঝকমক করছে। তবে মানুষটির যক্ষা নেই। থাকলে খুকখুক কাশি শুনতাম।

মুনশি সাহেব সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরেছেন। নবিজী (দঃ) সবুজ রঙ পছন্দ করতেন। তার মাথার পাগড়ি ছিল সবুজ। ম্যাজিক মুনশির সবুজ পাঞ্জাবির পেছনে নবিজীর (দঃ) পছন্দের রঙ কাজ করতে পারে।

তিনি পাঞ্জাবির সঙ্গে লুঙ্গি পরেছেন। লুঙ্গির রঙ ধবধবে সাদা। পায়ে খড়ম। বিশেষ ধরনের খড়ম। ময়মনসিংহ অঞ্চলে এই খড়মকে বলে বউলওয়ালা

খড়ম।

আপনিই কি ম্যাজিক মুনশি?

জি জনাব। আসসালামু আলায়কুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

আপনার খবর অনেক আগে পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আসা উচিত ছিল। মাগরেবের নামাজ শেষ করে এসেছি বলে বিলম্ব হয়েছে। আপনার কাছে ক্ষমা চাই।

আমি বললাম, ক্ষমা করার মতো কোনো অপরাধ আপনি করেন নি। ভাই, ভেতরে আসুন।

ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলেন। আতরের গন্ধে কেবিন ভরে গেল। আতরটা সাধারণ আতরের মতো না। চা-পাতা জাল দিলে চায়ের যে মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায় সেই গন্ধ। চা-পাতা থেকে আতর তৈরি হয় বলে আমার জানা নেই।

ভাই বসুন।

ভদ্রলোক বসতে বসতে বললেন, শাজারাতি মুমবারাকাতিন যাইতুনাতিন।

আমি বললাম, এর অর্থ কী?

মুনশি বললেন, এটা সূরা আননুনের একটা আয়াত। এর অর্থ পূতপবিত্র জয়তুন বৃক্ষ। আপনি আমার আতরের গন্ধে চমকেছেন। এই আতরটা জয়তুনের তেল থেকে তৈরি।

আমি চমকেছি কীভাবে বুঝলেন?

আপনার চোখের তারা চমকায়েছে। তার থেকে বুঝেছি।

আতরের গন্ধেই যে চমকেছি তা তো নাও হতে পারে।

আপনার চোখের তারা যখন চমকায়েছে তখন নাকের চামড়াও কুঁচকেছেন, সেই থেকে বুঝেছি।

আমি বললাম, আপনার পর্যবেক্ষণশক্তি ভালো। আমি বেশ অবাক হয়েছি। আপনার আতর খানিকটা কি আমাকে দিতে পারবেন? আমি আমার স্ত্রীকে দিতাম। অদ্ভুত আতরের গন্ধে সে খুশি হবে। সুগন্ধির প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা আছে।

মুনশি কিছু বললেন না। হাসলেন। ভদ্রলোকের হাসি সুন্দর।

আমি বললাম, শুনেছি আপনি খুব ভালো ম্যাজিক দেখান। আপনার কাছে নাকি জুয়েল আইচ শিশু। জুয়েল আইচকে চিনেছেন তো?

জি জনাব। বাংলাদেশে বাস করব উনাকে চিনব না, তা হয় না।

তাঁর কোনো জাদু কি দেখেছেন?

জি-মা। হাওর অঞ্চলে থাকি, কীভাবে দেখব?

আমি বললাম, মসজিদের একজন ইমাম জাদু দেখান এই প্রথম শুনলাম।

মুনশি জবাব দিলেন না। মনে হচ্ছে তিনি কম কথা বলেন। ভদ্রলোকের ভাষা শুদ্ধ, কিছুটা পোশাকি। বাড়ি মনে হয় সিলেট অঞ্চলে না। তবে কিছুদিন সিলেটে থাকলে ভাষায় সিলেটি ঢুকে যাওয়ার কথা। সিলেটি ভাষার আগ্রাসী রূপ আছে। এই প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তিগত কাহিনী বলি—

নিউইয়র্ক বইমেলায় গিয়েছি। আমি এবং শাওন গানের একটা অনুষ্ঠান দেখব। বইমেলার আয়োজক বিশ্বজিৎ সাহার জনৈক কর্মচারীর হাতে দুঘণ্টার জন্যে পুত্র নিষাদকে ছেড়ে দিয়েছি। নিষাদের বয়স তিন। বিশ্বজিতের কর্মচারীর নাম শাহীন, বাড়ি সিলেট।

দুঘণ্টা পর ফিরে আসতেই নিষাদ বলল, বাবা, আইসক্রিম খাইমু।

এই দুঘণ্টাতেই তার ভাষায় সিলেটি ঢুকে পড়েছে।

 

আমি ম্যাজিক মুনশির দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি কি চা খাবেন?

মুনশি বললেন, চা খাব না। চা খেলে অজু ভেঙে যাবে। এশার নামাজ শেষ করে চা খাব।

আপনার পড়াশোনা কতদূর?

খুবই সামান্য। উলা পাশ করেছি। মৌলানায়ে মুহাদ্দেস হওয়ার ইচ্ছা ছিল। দরিদ্র ঘরের সন্তান। অর্থের অভাবে পড়তে পারি নাই। কোরানে হাফেজ হওয়ার শখ ছিল। মেধার অভাবে পারি নাই।

মাঝখান থেকে ম্যাজিক শিখে ফেলেছেন?

ম্যাজিক মুনশি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। কিছু বললেন না।

আমি বললাম, এখন কি আমি আপনার ম্যাজিক দেখব?

আপনি চাইলে অবশ্যই দেখবেন।

আমি ম্যাজিক দেখার প্রস্তুতি নিলাম।

অদ্ভুত কিছু দেখবু তা ভাবলাম না। গ্রামের মুনশি মানুষ শুত ম্যাজিক জানবেন কীভাবে? দড়ি কেটে জোড়া লাগানো, কিংবা পয়সার কোনো খেলা।

তবে ম্যাজিশিয়ান না এমন অনেকের কাছ থেকে আমি বিস্ময়কর কিছু ম্যাজিক দেখেছি। অভিনেতা রহমত (বিভাগীয় প্রধান, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এমন একজন।

নাটকের শুটিং শেষে রহমতকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ সে বলল, স্যার একটা কয়েন দিন।

আমি কয়েন দিলাম। রহমত বলল, স্যার দেখুন কয়েনটা ঘসতে ঘসতে কীভাবে ভ্যানিশ করি। বলেই সে কয়েনটা বাঁ হাতের কনুইতে ঘসতে শুরু করল। চোখের সামনে কয়েন অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের আমার এক শিক্ষক ড. তৌফিকুর রহমান অপূর্ব সব তাশের ম্যাজিক জানেন।

একবার নুহাশপল্লীতে রাত্রি যাপন করতে এসে আমাদের এক ঘণ্টা তাশের ম্যাজিক দেখিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন।

পামিং-এর অদ্ভুত এক কৌশল আমি দেখেছিলাম একজন মাঝির কাছে। সে নিজের মনে সিগারেট টানছিল। আমাকে দেখে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে লুকিয়ে ফেলল। তার দুটা হাতই আমার সামনে মেলে ধরা। হাতে সিগারেট নেই। অথচ আঙুলের ফাঁক দিয়ে ধােয়া আসছে।

সিগারেট পামিং-এর কৌশল আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। তবে তার মতো ভালো পারি না।

ম্যাজিক মুনশি কী করবে কে জানে!

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ