আকাশ ঘন নীল।

আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় চোখে নীল সানগ্লাস পরে আকাশ দেখা হচ্ছে। মীরু বলল, আকাশ কী রকম নীল দেখেছেন? হালকা নীলকে আমরা বলি আকাশী নীল। কিন্তু আসলে আকাশের নীল অনেক গাঢ়।

নাসের কিছু বলল না। হাসল।

মীরু বলল, নীল দিয়ে শুরু হয়েছে এমন একটা গানের কলি বলুন তো।

নাসের বলল, বলতে পারব না। আমি আসলে এত মন দিয়ে গান শুনি না।

গান না পারলে কবিতার লাইন বলুন যেটা শুরু হয়েছে নীল দিয়ে।

আমি পারছি না। বারসাত সাহেব নিশ্চয়ই পারতেন। তাই না?

হ্যাঁ ও পারত।

দুনিয়ার কবিতা ওর মুখস্ত।

নাসের বলল, আমি টেকো মাথার এক ব্যবসায়ী। পৃথিবীর সমস্ত ফাইনার ফিলিংস থেকে অনেক দূরে বাস করি। একেক জনের একেক লাইন। আমি যা বলতে পারব বারসাত সাহেব কিন্তু তা পারবেন না। হাজার চেষ্টা করলেও পারবেন না।

আপনি কী বলতে পারবেন?

কোন ব্রান্ডের সিমেন্টের কত দাম সেটা বলতে পারব। রডের দাম বলতে পারব।

মীরু বলল, বারসাত যেমন ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ। আপনিও সে রকম ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ।

থ্যাংক ইউ।

মীরু বলল, আপনার ঘড়িতে কটা বাজে একটু দেখবেন?

নাসের বলল, একটা দশ।

মীরু বলল, এতক্ষণে ওর চলে আসা উচিত না?

রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। এই জন্যেই আসতে দেরি হচ্ছে।

মীরু বলল, কাজি অফিসে ছেলে মেয়ে দুজনকেই আসলে একসঙ্গে আসা উচিত। একজন যদি আগে এসে অপেক্ষা করে তাহলে তার খুব। খারাপ লাগে।

নাসের বলল, বারসাত সাহেব একবার সারাদিন আপনার জন্যে অপেক্ষা করেছেন। আপনিও না হয় কিছুক্ষণ করলেন। আমি একটা কাজ করতে পারি। আমার গাড়িটা তাকে আনার জন্যে পাঠাতে পারি। পাঠাব?

না। আমার ক্ষিধে লেগেছে। আপনি বরং কিছু খাবার ব্যবস্থা করুন।

কী খাবেন?

মিনি সিঙাড়া।

সেটা কী জিনিস?

সবচে ছোট সাইজের সিঙাড়া। যে কারিগর এই সিঙাড়া বানায় তার নাম নেকমর্দ। আমি দোকানটা চিনিয়ে দিচ্ছি। আপনি নিয়ে আসুন। আমি বারসাতের জন্যে অপেক্ষা করি।

নাসের মীরুকে চমকে দিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, মনে পড়ছে।

মীরু বলল, কী মনে পড়েছে?

নীল দিয়ে শুরু কবিতার লাইন— নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাই আর নাহিরে।

মীরু বলল, এই তো পারলেন। নাসের বলল, আরেকটা মনে পড়েছে। এইটা অবশ্যি গান-– নীল কবুতর লয়ে নবীর দুলালী মেয়ে। নজরুল। গীতি। গানটা শুনেছেন?

না।

আরেকটা মনে পড়েছে। এবারে রবীন্দ্র সংগীত। বলব?

না বলতে হবে না। আপনি প্রথমে বললেন, আপনি টেকো মাথার এক ব্যবসায়ী, ফাইনার ফিলিংস থেকে অনেক দূরে বাস করেন। কিছুই বলতে পারবেন না। এখন একের পর এক বলে যাচ্ছেন। এর মানে কী?

নাসের হাসল।

মীরু রাগী গলায় বলল, হাসবেন না। শুরুতে আপনি মূখ সাজার ভান করেছিলেন। আমার সঙ্গে ভান করবেন না। আমি ভান পছন্দ করি না।

রাগ করছেন?

সামান্য করেছি।

রাগ করিয়ে দেই? হাসির কোনো একটা গল্প বলে আপনাকে হাসিয়ে দেই?

কোনো দরকার নেই।

আমি আপনাকে রাগিয়েছি। রাগ কমানোর দায়িত্বও তো আমার। গল্পটা বলি। এক ভদ্রমহিলা তার ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। বৌ ফিজিক্সে M.Sc. ছেলের বৌকে নিয়ে শাশুড়ির অহংকারের শেষ নেই। বাড়িতে যেই আসে তার সঙ্গেই বৌ-এর জ্ঞানের গল্প করেন। একদিন হয়েছে কী বাড়িতে অনেক মেহমান এসেছে। শাশুড়ি যথারীতি বৌ-এর প্রশংসা করছেন; এমন সময় চায়ের ট্রে হাতে বউ ঢুকল। শাশুড়ি দেখলেন চায়ে পিঁপড়া ভাসছে। তিনি বললেন, একি বৌমা চায়ে তো পিঁপড়া ভাসছে।

বৌ সঙ্গে সঙ্গে বলল, এত অবাক হচ্ছেন কেন মা? পিঁপড়া চায়ে ভাসবে এটাই তো স্বাভাবিক। পিঁপড়া চায়ের চেয়ে হালকা। আর্কিমিডিসের সূত্র অনুসারে সে ভাসছে। একটা মার্বেল চায়ে ছেড়ে দিয়ে দেখা যাবে মার্বেল ডুবে গেছে। মা একটা মার্বেল ছেড়ে দেখাব?

মীরু হাসছে। হাসি থামানোর চেষ্টা করেও পারছে না। যতই সে হাসি। থামানোর চেষ্টা করছে ততই হাসি বাড়ছে। আশেপাশের লোকজন কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। নাসের বলল, আরেকটা বলব? এরচে কড়া ডোজের?

মীরু বলল, আর লাগবে না। আপনি সিঙাড়া নিয়ে আসুন।

নাসের বলল, আরেকটা বলি। এটা বলে আমি খাবার আনতে চলে যাব। আপনি একা একা হাসতে থাকবেন। আশা করছি এর মধ্যে বারসাত সাহেব চলে আসবেন। তিনি অবাক হয়ে দেখবেন আপনি একা একা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন। তাঁর কাছে অদ্ভুত লাগবে। গল্পটা বলব?

বলুন।

না থাক। কেন জানি মনে হচ্ছে আপনাকে হাসাতে পারব না। আমি যাই সিঙাড়া নিয়ে আসি। আপনি কি লক্ষ্য করছেন— আকাশের নীল রঙটা কমে আসছে। মেঘ জমতে শুরু করেছে। বিকাল চারটার দিকে দেখবেন। বৃষ্টি নামবে।

মীরু কিছু বলল না। আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। এই মেঘ দেখতে ভালো লাগছে না। মোটেও ভালো লাগছে না।

 

ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। আকাশ মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে। মীরু বলল, বলুন তো বৃষ্টি কখন নামবে?

নাসের বলল, বলতে পারছি না। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে। এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে।

মীরু বলল, আমি লক্ষ্য করেছি আকাশে যেদিন খুব মেঘ হয় সেদিন বৃষ্টি হয় না। তবে আজ হবে। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ চলে এসেছে।

নাসের বলল, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে চান?

বৃষ্টি নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। আমি আপনার সারাটা দিন নষ্ট করলাম। সরি। এক কাজ করুন, আপনি চলে যান। আমার একা অপেক্ষা করতে কোনো সমস্যা নেই।

নাসের বলল, আপনার যদি একা অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করে তাহলে অবশ্যই একা অপেক্ষা করবেন। আমি চলে যাব। সে-রকম কোনো ইচ্ছা যদি না থাকে তাহলে অপেক্ষা করব।

মীরু বলল, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। বৃষ্টির একটা ফোঁটা গায়ে পরা মাত্রই আমি রওনা হব।

নাসের বলল, আপনি মোটেও চিন্তা করবেন না। আমি লোক লাগিয়ে দিয়েছি উনি কোথায় আছেন সেই খোঁজ আজ রাতের মধ্যে বের করে ফেলব।

মীরু জবাব দিল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। নাসের বলল, সময় কাটানোর জন্যে একটা মজার খেলা আছে। এই খেলাটা খেলবেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার সময় কাটছে না। ভিতরে ভিতরে আপনি ছটফট করছেন। খেলাটা খেলবেন?

কী খেলা?

আমি একটা শব্দ বলব। শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আপনার মনে যে শব্দটা আসবে আপনি সেটা বলবেন। আপনার কাছ থেকে শব্দটা শোনার পর আমার মনে যা আসবে তা বলব। এরকম চলতে থাকবে।

শেষ হবে কখন?

যেখান থেকে শুরু করেছি সেখানে পৌঁছার পর শেষ হবে। আসুন শুরু করি। আমি বলছি প্রথম শব্দ। বৃষ্টি। বৃষ্টি শব্দটা শুনে আপনার মনে যে শব্দটা আসবে সেটা বলুন।

মীরু : অশ্রু।

নাসের : নদী।

মীরু : নৌকার পাল।

নাসের : নীল আকাশ।

মীরু : আকাশে মেঘ।

নাসের : ঝড়।

মীরু :বৃষ্টি।

নাসের বলল, খেলা শেষ। আমরা বৃষ্টি দিয়ে শুরু করেছিলাম আবার বৃষ্টিতে ফিরে এসেছি।

মীরু বলল, বৃষ্টি নামতেও শুরু করেছে। কয়েক ফোঁটা আমার গায়ে পড়েছে। চলুন যাওয়া যাক।

মীরুর চোখ ভর্তি পানি। সে চোখের পানি আড়াল করার কোনো চেষ্টা করছে না।

নাসের দুঃখিত গলায় বলল, ঐন্দ্রিলা আপনি নিশ্চিত থাকুন আমি আজ রাতের মধ্যে বারসাত সাহেবের খবর বের করব।

———-

পরিশিষ্ট

মেয়েটির চেহারা অত্যন্ত মিষ্টি। চোখ বুদ্ধিতে ঝলমল করছে। সে এসেছে। তার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত করতে। আমি বললাম, তোমার নাম কী?

মেয়েটি বলল, আমার চারটা নাম, মরিয়ম, মীরু, ঐন্দ্রিলা এবং ঐ।

আমি বললাম, চার নামের মেয়ে আমি এই প্রথম দেখলাম।

মেয়েটি বলল, চারটা নামের মধ্যে কোন নামটা আমার সঙ্গে সবচে ভালো যায়।

আমি বললাম, মরিয়ম নামটা সবচে ভালো যায়। মরিয়ম নামের মধ্যে কোমল একটা ব্যাপার আছে। তোমার মধ্যেও কোমলতা আছে।

আমার মধ্যে কোনোই কোমলতা নেই। আমি খুবই কঠিন একটা মেয়ে। যাই হোক আমি কঠিন না কোমল তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমার বিয়েতে কিন্তু আপনাকে আসতে হবে। শুক্রবারে বিয়ে। শুক্রবারে আপনি কোনো কাজ রাখতে পারবেন না।

তোমার বিয়েতে আমাকে আসতে হবে কেন?

কারণ আমার জীবনটা অবিকল আপনার লেখা একটা উপন্যাসের মতো। উপন্যাসের নায়িকা গোপনে একটা ছেলেকে বিয়ে করার জন্যে কাজি অফিসে যায়। ছেলেটা কিন্তু আসে না। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসে। তার বিয়ে হয় অন্য আরেকজনের সঙ্গে। তার জীবন কাটে

কাঁদতে কাঁদতে। উপন্যাসের কথা কি আপনার মনে পড়েছে?

না। ছেলেটা আসে না কেন?

ছেলেটা খুবই অসুস্থ ছিল। তার হয়েছিল হেপাটাইটিস বি। ডাক্তাররা সন্দেহ করেছিলেন তার লিভার সিরোসিস হয়েছে। এক ধরনের ক্যানসার। কাজেই তার মনে হল দুদিন পরে সে মারা যাচ্ছে। এই অবস্থায় একটা মেয়েকে বিয়ে করে তার জীবন সে নষ্ট করতে পারে না। কাজেই বিয়ের দিন সে পালিয়ে গেল গ্রামে। এখন কি আপনার মনে পড়েছে?

হ্যাঁ মনে পড়েছে।

উপন্যাসের নাম রোদনভরা এ বসন্ত।

আমি বললাম, তুমিও কি সেই উপন্যাসের নায়িকার মতো অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করছ?

না আমি অসুস্থ ছেলেটাকেই বিয়ে করছি। তাকে গ্রাম থেকে ধরে আনা হয়েছে। আমার এক বন্ধু নাসের নাম উনি তাকে তার বাড়িতে গৃহবন্দি করে রেখেছেন।

ইন্টারেস্টিং তো!

অবশ্যই ইন্টারেস্টিং। আমাদের বিয়েতে আপনি উপস্থিত থাকবেন। এবং উপন্যাসের শেষটা পাল্টে দেবেন। ছেলেটার অসুখ অবশ্যই সারিয়ে দেবেন। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা যেন খুব সুখে জীবন কাটায়।

তাহলে তো উপন্যাসের নামও পাল্টাতে হয়। মিলনান্তক উপন্যাসের নাম–রোদনভরা এ বসন্ত হতে পারে না।

নাম পাল্টানোর দরকার নেই। আমি সারা জীবন কাঁদতে রাজি আছি কিন্তু বারসাতকে হারাতে রাজি না।

মেয়েটি কাঁদছে। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সুন্দর লাগছে দেখতে।

আমি বললাম, আমার উপন্যাসের নায়ক সুন্দর ছবি আঁকত। তোমার এই ছেলে বারসাত কি ছবি আঁকতে পারে?

ঐন্দ্রিলা চোখ মুছতে মুছতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

তার চেহারা থেকে কান্না চলে গেছে। সে এখন আনন্দে ঝলমল করছে। এই মেঘ এই রৌদ্র।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ