উৎসর্গ

হিমু নামের কেউ যদি থাকতো তাহলে কোন এক জোছনার রাতে তাকে বলতাম— এই বইটি কেন আপনাকে উৎসর্গ করা হল বলুনতো? দেখি আপনার কেমন বুদ্ধি!

———

০১.

মীরু রাত বারোটা দশ মিনিটে সেভেন পয়েন্ট ফাইভ মিলিগ্রামের একটা ডরমিকাম খেয়েছে। এখন বাজছে একটা পঁচিশ, ঘুমের ওষুধ খাবার পরেও এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট পার হয়েছে। ঘুমের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ঘুম কেটে যাচ্ছে। দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার শব্দ কানে আসছে! ঘুমের ওষুধ খাবার পর দেয়াল ঘড়ির শব্দ কানে আসা খারাপ লক্ষণ। তখন ধরে নিতে হবে–ঘুম কেটে যাচ্ছে।

মীরুর বিরক্তি লাগছে। আজ রাতে তার ঘুম হওয়াটা খুব দরকার। আগামীকাল তার বিয়ে। রাতে এক ফোঁটা ঘুম না হলে বিয়ের দিনে তাকে দেখা যাবে উলুম্বুষের মতো। চোখের নিচে লেপ্টে থাকবে কালি। কপালে এবং গালে তেল জমতে থাকবে। চোখ ইঞ্চিখানিক ডেবে যাবে। মীরুর এই এক সমস্যা, একরাত না ঘুমুলেই চোখ ডেবে যায়, চোখের নিচে ঘন হয়ে কালি পড়ে। কপালে এবং গালে তেলতেলে ভাব চলে আসে। সাবান দিয়ে ঘষলে তেলতেলে ভাব চলে যায় ঠিকই, কিন্তু বিশ-পঁচিশ মিনিট আবার আগের অবস্থা।

যে কোন মূল্যে মীরুকে ঘুমুতে হবে। সে গায়ের চাদর মাথা পর্যন্ত তুলে দিল। মনে মনে বলল, আমি এখন আর কোনো দুঃশ্চিন্তা করছি না। সে দুঃশ্চিন্তাহীন জীবনযাপন করছে এ রকম ভাব করে পাশ ফিরল। ঠিক করল আরো আধঘণ্টা দেখবে তারপর আরেকটা ডরমিকাম খাবে। তাতেও যদি না হয় আরেকটা। দানে দানে তিন দান।

মরিয়ম। মরিয়ম।

মীরু চাদরের ভেতর থেকে মাথা বের করল। তার নাম মরিয়ম না। তার নাম ঐন্দ্রিলা। মরিয়ম নাম অনেক আগেই বাতিল হয়েছে। কিন্তু বাবা এখনো মরিয়ম ডাকেন। অন্যরা মরিয়ম ভেঙে মীরু ডাকে। মীরু পর্যন্ত সহ্য করা যায় কিন্তু দুই হাজার তিন সনে মরিয়ম নাম সহ্য করা যায় না। পুরনো ফ্যাশন ঘুরে ঘুরে আসে। গয়নার জাবদা ডিজাইনগুলি আবার ফিরে এসেছে। একসময় হয়তো মরিয়ম টাইপ নাম রাখা ফ্যাশন হবে। তখন ঐন্দ্রিলা বদলে মরিয়ম রাখা যেতে পারে। এখন মীরুর যীশু খ্রিস্টের মা হবার কোনো শখ নেই।

সে খাট থেকে নামল। ঘুমঘুম ভাব চোখে যা ছিল, খাট থেকে নামতে গিয়ে সবটাই চলে গেল। সে বাবার শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

বাবা ডাকছিলে?

আফজল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ড্রয়িং রুমের দরজাটা বন্ধ কি দেখে তারপর ঘুমুতে যা। আমার ধারণা দরজা খোলা।

মীরু বলল, বাবা ড্রয়িং রুমের দরজা বন্ধ। আমি নিজে বন্ধ করেছি।

আফজল সাহেব বললেন, তোকে দেখতে বলেছি তুই দেখে আয়। এত কথার দরকার কী? কথা বলে যে সময় নষ্ট করলি তারচেয়ে কম সময়ে দেখে আসা যেত দরজা বন্ধ কি বন্ধ না।

মীরু বলল, আমি যাচ্ছি।

আফজল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, সেই পানি খাবি তবে ঘোলা করে খাবি। দরজা বন্ধ না-কি খোলা আমাকে জানিয়ে তারপর ঘুমুতে যাবি।

তোমাকে জানানোর দরকার কী?

এত ব্যাখ্যা তোকে দিতে পারব না। আমাকে জানাতে বলেছি আমাকে জানাবি।

ড্রয়িং রুমের দরজা খোলা। মীরুর কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে। তার স্পষ্ট মনে আছে সে নিজে দরজা বন্ধ করেছে। নিশ্চয়ই কাজের ছেলে জিতু মিয়া এর মধ্যে আছে। তার বয়স নয়-দশের বেশি হবে না। এর মধ্যেই সে সিগারেটে টান দেয়া শুরু করেছে। কাছে গেলেই সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যায়। জিতু নিশ্চয়ই দরজা খুলে বাইরে সিগারেট কিনতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছে।

মীরু দরজা বন্ধ করে বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। শীতল গলায় বলল, বাবা দরজা বন্ধই ছিল। তুমি শুধু শুধু আমাকে পাঠিয়েছ।

তুই দরজা খোলা পেয়েছিস না বন্ধ পেয়েছিস?

আমি বন্ধ পেয়েছি। বাবা তোমাকে তো আমি বলেছিলাম দরজা বন্ধ। আমি নিজে বন্ধ করেছিলাম। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করনি। অন্যকে এত অবিশ্বাস করতে নেই।

আফজল সাহেব চুপ করে রইলেন। জবাব দিলেন না। মীরু ইচ্ছা করে মিথ্যা কথাটা বলল যাতে তার বাবা কিছুটা হলেও অনুশোচনা ভোগ করেন। অন্তত একবার হলেও মনে হয়, আহারে দরজা তো বন্ধই ছিল! শুধু শুধু মেয়েটাকে ঘুম থেকে তুলেছি।

মিথ্যা বলার জন্যে মীরুর তেমন খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। সে গত এক বছর ধরে ক্রমাগত মিথ্যা বলছে। এখন মনে হচ্ছে। মিথ্যা বলাটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। যেখানে মিথ্যা বলার কোনোই

প্রয়োজন নেই সেখানেও সে মিথ্যা বলছে।

গত সোমবার সে যাচ্ছিল ইউনিভার্সিটিতে। তার মা জাহেদা বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?

মীরু বলল, এক বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি।

মা বললেন, তোর আজ ক্লাস নাই?

মীরু ফুরফুরে গলায় বলল, আছে। ক্লাসে যাব না। বান্ধবীর জন্মদিন। জন্মদিনের পার্টিতে যাব।

দিনের বেলা কীসের পার্টি?

মীরু রাগী রাগী গলায় বলল, সে যদি দিনে পার্টি দেয় আমি কী করব? তাকে বলব যে আমি দিনে আসতে পারব না। আমি আসব রাত দশটার দিকে। তুই রাতে পার্টি দে।

জাহেদা অবাক হয়ে বললেন, ঝগড়া করছিস কেন?

মীরু বলল, ঝগড়া করছি না মা। তোমাকে বিষয়টা বোঝাবার চেষ্টা করছি।

তোর বান্ধবীর বাসা কোথায়?

বাসা কোথায় জানতে চাচ্ছ কেন?

এম্নি জানতে যাচ্ছি।

তুমি এম্নি জানতে চাচ্ছ না। তুমি সন্দেহ করছ বলে জানতে চাচ্ছ।

আমি শুধু শুধু সন্দেহ করব কেন?

তুমি সন্দেহ করবে কারণ সন্দেহ করা হল তোমার অভ্যাস। আমি যে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ফেলি তুমি সেই নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকেও সন্দেহ কর। মা এক কাজ কর তো, চট করে শাড়িটা বদলে একটা ভালো শাড়ি পর।

কেন?

মীরু শান্ত গলায় বলল, তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। নিজের চোখে জন্মদিনের উৎসব দেখবে। এক পিস কেক খাবে। বারান্দায় গিয়ে এক বোতল কোক খাবে।

জাহেদা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই আমার সঙ্গে এরকম করছিস কেন?

কথা বাড়িও না তো মা। চট করে শাড়িটা বদলাও। গত ঈদে হালকা সবুজ রঙের যে শাড়িটা কিনেছিলে সেটা পর। ঐ শাড়িটাতে তোমাকে। মানায়। আমি তোমাকে না নিয়ে জন্মদিনের পার্টিতে যাব না। সত্যি যাব না।

জাহেদা কাঁদতে বসলেন। মীরু চলে গেল ইউনিভার্সিটিতে। এই কাজগুলি সে কেন করে নিজেও জানে না। তারচেয়ে বড় কথা তার একটুও খারাপ লাগে না। গত একবছর ধরে বাসার প্রতিটি মানুষকে তার অসহ্য লাগছে। বাজারে ডিনামাইট কিনতে পাওয়া গেলে ডিনামাইট দিয়ে সে তাদের কলাবাগানের এই বাড়ি উড়িয়ে দিত। ডিনামাইট কোথায় পাওয়া। যায় মীরু জানে না। আলফ্রেড নোবেল সাহেব বেঁচে থাকলে সে তাকে একটা চিঠি লিখত, স্যার আমাকে কিছু ডিনামাইট পাঠাবেন? আমি খুব কষ্টে আছি। ইতি আপনার বাধ্যগত ঐন্দ্রিলা।

আবার বিছানায় ওঠার আগে মীরু বাথরুমে ঢুকে মাথায় পানি ঢালল। মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করছে। পানি ঢালার কারণে মাথার দপদপানি না কমে আরো যেন বেড়ে গেল। দেয়াল ঘড়িতে এখন মনে হয় মাইক ফিট করা হয়েছে। হাতুড়ি পেটার মত শব্দ আসছে। টক টক। টক টক।

বিয়ের আগের রাতে সব মেয়েরই কি এরকম হয়? আচ্ছা বাংলাদেশে এমন মেয়ে কি আছে যে বিয়ের আগের রাতে ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমুতে পেরেছে? কেউ না পারলেও তার পারা উচিত ছিল। সব মেয়ে আর সে এক না। সব মেয়ের যা হবে তার তা হবে না। তাছাড়া যাকে সে বিয়ে করছে। তার সঙ্গে সে তিন বছর ধরে ঘটর ঘটর করেছে। সে অপরিচিত কেউ না। তার প্রতিটি খারাপ অভ্যাস মীরু জানে। তার সবচেয়ে খারাপ অভ্যাস হল নাক ঝেড়ে সেই হাত শার্টের কোণায় মুছে ফেলা। প্রথম বার দেখে মীরু হতভম্ব। সে চোখ কপালে তুলে বলল, এটা তুমি কী করলে?

বারসাত তার মতোই অবাক হয়ে বলল, কী করলাম?

নাক ঝেড়ে হাত শার্টে মুছে ফেললে। কী কুৎসিত!

কুৎসিতের কী আছে। সঙ্গে রুমাল নেই।

রুমাল নেই কেন?

এখন কেউ রুমাল নিয়ে ঘোরে না। তুমি পাঁচশ মানুষকে জিজ্ঞেস করে। দেখ তাদের কাছে রুমাল আছে কি না। সবাই বলবে নেই। পকেটে রুমাল রাখার ফ্যাশন চলে গেছে।

তুমি বলতে চাচ্ছ এখন সবাই নাক ঝেড়ে শার্টে হাত মোছে?

আমি বলতে চাচ্ছি যে আমার সঙ্গে রুমাল নেই।

মীরু বলল, তুমি কি জানো তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘেন্না লাগছে?

বারসাত হতাশ গলায় বলল, না জানি না। তোমার দৃষ্টি এত পবিত্র ধারণা ছিল না। এখন আমাকে কি করতে হবে সেটা বল। আমি কি লাইফবয় সাবান দিয়ে গোসল করে আসব? না কি তারকাদের সৌন্দর্য। সাবান লাক্স দিয়ে গোসল করব?

তোমার সঙ্গে এখানেই আমার সম্পর্ক শেষ। তুমি তোমার বাড়ি যাও। আমি আমার বাড়ি যাচ্ছি।

ভেরি গুড।

ভুলেও টেলিফোন করবে না।

  1. K. পবিত্র মহিলা টেলিফোন করব না। নাকের সর্দি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি আর টেলিফোন না।

বারসাত প্রতিজ্ঞা রাখতে পারল না। রাখতে পারবে না মীরু জানে। বারসাত হচ্ছে এমন একজন যুবক যে কোনো প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না। চব্বিশ ঘণ্টা পার হবার আগেই টেলিফোন।

হ্যালো, ঐন্দ্রিলা একটা বিশেষ খবর দেবার জন্য টেলিফোন করেছি।

মীরু গম্ভীর গলায় বলল, বিশেষ খবরটা কী?

বারসাত মীরুর চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, যে হাত দিয়ে আমি নাক ঝেড়েছি ঐ হাত কজি পর্যন্ত কেটে বাদ দিয়েছি। হাত তার শাস্তি পেয়েছে। আশা করি এখন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে।

হাত কজি পর্যন্ত কেটে বাদ দিয়েছ?

হুঁ, ভ্যানগগ টাইপ। উনি কেটেছিলেন কান আমি কেটেছি হাত। এখন কি আমার সঙ্গে কথা বলা যায়?

হ্যাঁ যায়।

তাহলে চলে এসো–তোমাকে এই সৌরলোকের শ্রেষ্ঠতম ফুচকার দোকানে নিয়ে যাব। রিকশা নিয়ে আমার মেসে চলে এসো। আজ আমাদের ফুচকা ডে। আধা কেজি করে ফুচকা খেয়ে আজ পেটে অসুখ বাধাবই।

তোমার কাটা হাতটা কোথায়?

কাটা হাত এখনো হাতের সঙ্গে লাগানো আছে। তুমি যেদিন বলবে সেদিন কেটে তোমাকে দিয়ে দেব। জার ভর্তি ফরমালিনে কাটা হাতটা প্রিজার্ভ করতে পারবে। তোমার ছেলেমেয়েদের দেখাবে, তারা খুব মজা পাবে।

এরকম মানুষের সঙ্গে রাগ করে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। বিয়ের পরেও মানুষটার স্বভাব-চরিত্র এরকম থাকবে কি না কে জানে। মনে হয় থাকবে না। থাকার কথা না। পুরুষ বদলে যায় স্ত্রীর গায়ের গন্ধে।

মীরু চেয়ারে উঠে দাঁড়াল। দেয়াল ঘড়িটা নামিয়ে পেনসিল ব্যাটারি খুলে ফেলল। সেকেন্ডের কাটার কট কট শব্দের হাত থেকে মুক্তি। মাথার দপদপানি সামান্য কমেছে। এখন অন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। টেনশান বেশি হলে মীরুর শ্বাসকষ্ট হয় তখন ইনহেলার নিতে হয়। ভেন্টোলিন ইনহেলার। ডাক্তার বলে দিয়েছেন চেষ্টা করতে হবে ইনহেলার ব্যবহার না করার। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে মিনিটে মিনিটে ইনহেলার নিতে হবে। মীরু অভ্যস্ত হতে চায় না। অভ্যস্ত হওয়া খুব খারাপ ব্যাপার। কোনো কিছুতেই অভ্যস্ত হওয়া ঠিক না। সে বারসাতের অদ্ভুত ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিয়ের পর বারসাত যখন স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করবে তখন নিশ্চয়ই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে।

নিঃশ্বাসের কষ্টটা দূর করার জন্যে টেনশান কমানো দরকার। আনন্দময় কিছু চিন্তা করলে টেনশান কমবে। সে রকম কোনো চিন্তাই মাথায় আসছে না। নিজের বিয়ে নিয়ে কি সে ভাববে? বিয়ে কোনো আনন্দময় ব্যাপার না। মোটামুটিভাবে ভয়ংকর একটা ব্যাপার। নিজের চেনা বিছানা ফেলে একজন পুরুষ মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধের মাঝখানে শুয়ে থাকা-– ভাবতেই গা গুলায়।

বিয়ের খবরটা বাসায় কীভাবে দেবে মীরু এখনো তা নিয়ে ভাবেনি। বারসাত বলেছে–প্রথমে একজনকে দিয়ে বাসায় টেলিফোন করাও। সে টেলিফোনে বলবে— এইমাত্র খবর এসেছে মীরু রোড একসিডেন্টে মারা গেছে। তার গায়ের উপর দিয়ে সাতটনি একটা ট্রাক চলে গেছে। তার ডেডবডি কোথায় আছে এক্ষুণি আপনাকে জানাচ্ছি–টেলিফোন লাইনটা দয়া করে খোলা রাখবেন। এই বলেই খট করে টেলিফোন রেখে দিতে হবে। বাসায় শুরু হবে কান্নাকাটি। আধঘণ্টা পর টেলিফোন করে জানাতে হবে সংবাদটা ভুল। আসলে মীরু মারা যায়নি। সে কাজীর অফিসে গিয়ে থার্ড ক্লাস টাইপ এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। মৃত্যু সংবাদের পরে এই ধরনের সংবাদে সবাই আনন্দে অভিভূত হবে। বাবা-মা দুজনই গদগদ গলায় বলবেন–যাকে বিয়ে করেছিস তাকে নিয়ে এক্ষুণি বাসায় আয়। তুই যে বেঁচে আছিস এতেই আমরা খুশি।

বারসাত বলছে, আমার প্রেসক্রিপশান মত যদি কাজ করতে পারতাহলে তুমি কিন্তু তোমার বাবা মার কাছে আমাকে হজম করিয়ে ফেলতে পারবে। হজমি বড়ি লাগবে না।

মীরুর ধারণা তা না। সে খুব ভাল করেই জানে বারসাতের তাদের বাড়িতে এন্ট্রি হবে না। কোনো ভাবেই না।

মীরুদের পরিবারে প্রেম নোংরা ব্যাপার। টেলিভিশনে এইসব নোংরা ব্যাপার দেখানো হয় বলে আফজল সাহেব টেলিভিশন দেখেন না। মাঝেমধ্যে টিভির খবর দেখেন এবং কিছুক্ষণ পর পর ভুরু কুঁচকে বলেন— সব মিথ্যা কথা।

মীরুর মা জাহেদা আদর্শ মধ্যবিত্ত মা। স্বামী যা করে তাকেও তাই করতে হবে। তিনিও শুধু খবর দেখেন এবং স্বামীর মতো ভুরু কুঁচকে বলেন—এত মিথ্যা কথা কীভাবে বলে? মুখে আটকায় না। আশ্চর্য!

মীরুর বড় বোন রুনি পছন্দ করে একটি ছেলেকে বিয়ে করেছিল বলে তার এই বাড়িতে ঢোকার অনুমতি নেই। তার বিয়েটা ভাল হয়নি। ছ মাসের মধ্যে ঝামেলা লেগে গেল। নয় মাসের মধ্যে ডিভোর্স। রুনি। কাঁদতে কাঁদতে স্যুটকেস হাতে বাড়িতে উঠে এসেছিল। আফজল সাহেব স্যুটকেস হাতেই তাকে বিয়ে করে দেন। সে এখন আছে তার বড় খালার সঙ্গে।

মীরুর দুই ফুপু হজ করে এসেছেন। তাঁরা বোরকা পরেন। সেই বোরকাও কঠিন বোরকা। দুই ফুপুর একজন (ছোট ফুপু সুলতানা বেগম) তাবিজ বিশেষজ্ঞ। তিনি মাঝে মধ্যে তাবিজ নিয়ে আসেন। সুতা পড়া আনেন। তাঁর কাছ থেকে তাবিজ পড়া সুতা পড়া অত্যন্ত ভক্তিসহকারে গ্রহণ করতে হয়। ফুপুর দেয়া একটা তাবিজ এখনো মীরুর গলায় ঝুলছে। এই তাবিজের বিশেষত্ব হচ্ছে, এই তাবিজ পরা থাকলে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে না।

মীরুর দুঃস্বপ্ন দেখার রোগ আছে। এর মধ্যে একটা দুঃস্বপ্ন ভয়াবহ। এই দুঃস্বপ্নে মীরু ইউনিভার্সিটির ক্লাসে বসে থাকে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। সে সম্পূর্ণ নগ্ন। তখন টিচার তার দিকে তাকিয়ে বলেন, ঐন্দ্রিলা এসো বোর্ডে এসো। জিনিসটা বুঝিয়ে দাও। মীরু বোর্ডে যায়। ছাত্রছাত্রীরা সবাই তার দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসতে থাকে। স্যারও হাসতে থাকেন।

ছোট ফুপুর তাবিজ গলায় পরার পর এই ভয়ংকর স্বপ্নটা মীরু দেখছে। এটা তাবিজের গুণ, না কি দুঃস্বপ্ন দেখা রোগ মীরুর সেরে গেছে কে জানে। মীরু ঠিক করে রেখেছে বিয়ের পর যেদিন থেকে সে বারসাতের সঙ্গে ঘুমুতে যাবে সেদিনই সে তাবিজ ছিঁড়ে কুয়ায় ফেলে দেবে। (তাবিজ যেখানে-সেখানে ফেলা যায় না। স্রোতহীন পানিতে ফেলতে হয়)

 

মীরু খুব ভালো করে জানে তাদের কঠিন পরিবারের কাছে বারাসাতকে হজম করানো কোনোক্রমেই সম্ভব না। কাজীর অফিসে গিয়ে বিয়ের কারণ এই একটাই। বাংলাদেশের কোনো মেয়ে কাজীর অফিসে বিয়ে করতে চায় না। সব মেয়ে বিয়ের দিনে বউ সাজতে চায়। বিয়ের আগের দিন গায়ে হলুদ মাখতে চায়। কাজী সাহেবের সামনে বউ সেজে কে উপস্থিত হবে? তবে আগামীকাল মীরু সুন্দর করেই সাজবে। একটা জর্জেট শাড়ি ঠিক করা আছে। সাদা জমিনে হালকা সবুজ কাজ। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ লাল ছোপ। লাল হল সবুজের কনটেম্পরারি কালার। একটা রঙ আরেকটাকে উজ্জ্বল করবে। মীরুর ধারণা শাড়িটাতে তাকে খুব মানাবে।

সাজগোছ নিয়ে বারসাতের অবশ্যি কোনো মাথাব্যথা নেই। আজ পর্যন্ত সে মীরুকে বলেনি— বাহ্ এই শাড়িটাতে তো তোমাকে সুন্দর মানিয়েছে! কিংবা বাহ্ আজ তো তোমাকে অদ্ভুত লাগছে! কপালের টিপটা নিজে হাতে একে দিয়েছ? সুন্দর তো! মাঝে মাঝে মীরুর মনে হয়। সুন্দর-অসুন্দরের কোনো বোধই বারাসাতের নেই। অথচ বারসাত নিজে সুন্দর সুন্দর শার্ট-প্যান্ট পরে। সব সময় তার চুল আঁচড়ানো থাকে। পকেটে চিরুনি থাকে। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি— এরকম তাকে মীরু কখনো দেখেনি। সব সময় ক্লিন শেভ।

বারাসাতের সঙ্গে বাবা-মা এবং ফুপুদের একটা ইন্টারভুর ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? চাকরির ইন্টারভুর মতো ইন্টারভু। বাবা ইন্টারভ্যু বোর্ডের চেয়ারম্যান। দুই ফুপু মেম্বার। মা সেক্রেটারি। মার হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। তিনি শুধু কথাবার্তা নোট করবেন। প্রশ্ন করবেন বাবা এবং ফুপুরা। মার কাজ হবে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকা। বাবা হাসলে তিনি হাসবেন। বাবার মুখ গম্ভীর হলে তিনি মুখ গম্ভীর করবেন। বাবা রাগ করলে তিনি রাগ করবেন। হিজ মাস্টারস ভয়েস।

মীরু কল্পনায় ইন্টারভু বোর্ডটা দেখতে পাচ্ছে এবং মনে মনে আশা করছে এই ইন্টারভু বোর্ড দেখতে দেখতে তার ঘুম পেয়ে যাবে এবং খুব ভালো ঘুম হবে। ঘুম ভাঙবে সকাল দশটার দিকে। তখন তাড়াহুড়া করে সে তৈরি হবে। কাজী অফিসে উপস্থিত হতে হবে সকাল এগারোটায়। হাতে একেবারেই সময় থাকবে না। তাকে গোসল করতে হবে। তাদের বাসায় হিটার নেই। গোসলের জন্য পানি গরম করতে হবে। আচ্ছা কাল কি হবে তা কাল দেখা যাবে। এখন বরং ইন্টারভু বোর্ডে কী হচ্ছে তা দেখা যাক।

তোমার নাম?

স্যার আমার নাম বারসাত আলি।

বারসাত আবার কেমন নাম?

আমার নানাজান রেখেছিলেন। নামের অর্থ বৃষ্টি। আমি হচ্ছি বৃষ্টি আলি।

পড়াশোনা কী?

এম. এ. পাস করেছি। সেকেন্ড ক্লাস ফোর্থ হয়েছিলাম।

বিষয়?

ফিলসফি।

এখন করছ কী?

চাকরিবাকরি তেমন কিছু জোগাড় করতে পারিনি। অল্প কিছুদিন একটা ইস্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করেছি। আমার এক বন্ধুর মামার ট্রাভেল এজেন্সি আছে। সেখানে কিছুদিন বসেছিলাম। এখন কিছু করছি না। রেস্টে আছি।

দিন চলছে কীভাবে?

তিনটা টিউশনি করছি। একটা কোচিং সেন্টারের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।

বাবা-মা জীবিত আছেন?

বাবা মারা গেছেন, মা জীবিত আছেন।

মা কোথায় থাকেন?

আমার তিন বোন। তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। মা ভাগাভাগি করে তিনজনের সঙ্গে থাকেন। একেক বোনের সঙ্গে চার মাস করে ব্যবস্থা।

আমি থাকি মেসে।

বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় উঠবে?

এই মুহুর্তে স্ত্রীকে নিয়ে ওঠার কোনো জায়গা নেই।

ঠিক আছে তুমি এখন যেতে পার।

চট করে আমাকে বাতিল করে দেবেন না স্যার। আমাকে আরো প্রশ্ন করুন। জেনারেল নলেজ থেকে যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করতে পারেন। জেনারেল নলেজে আমার দখল ভালো।

তুমি বিদেয় হও।

এক্সট্রা কারিকুলাম একটিভিটিজ সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি ভালো ব্যাডমিন্টন খেলতে পারি। রাজশাহী ডিভিশনে পরপর দুবছর আমি রানার্স আপ ছিলাম। দাবাও ভাল খেলতে পারি। গ্রান্ড মাস্টার নিয়াজ মোরশেদের সঙ্গে তিনবার দাবা খেলেছি। দুবার ড্র হয়েছে। একবার অবশ্যি উনি জিতেছেন।

ভালো যন্ত্রণা তো। তোমাকে যেতে বলছি তুমি যাচ্ছ না কেন?

ব্যাডমিন্টন খেলা ছাড়াও আমি খুব ভালো পোট্রেট আঁকতে পারি। আমাকে দয়া করে এক শিট ফুল স্কেপ কাগজ আর একটা পেনসিল দিন। দশ মিনিটের মধ্যে আমি আপনার ছবি এঁকে দেব। আমার পোট্রেট করার ক্ষমতা দেখেই আপনার মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছিল।

কী বললে, প্রেমে পড়েছে? এমন একটা অশ্লীল কথা তুমি আমার মেয়ের সম্পর্কে বললে কোন সাহসে? জানো তোমাকে আমি পুলিশে দিতে পারি?

প্রেমের কারণে আপনি আমাকে পুলিশে দেবেন? প্রেমের কারণে যদি আমাকে পুলিশে দেন তাহলে ভেলেনটাইনস দিবসে আপনার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হবে।

চুপ, অশ্লীল কথা মুখে আনবে না।

অশ্লীল কথা কোনটা?

আবার কথা বলে। বের হও বললাম।

আমাকে ছোট্ট একটা সুযোগ দিন স্যার। একটা টু বি পেনসিল আর এক শিট কাগজ। আমার আঁকা পোট্রেট দেখার পর আপনার মন অবশ্যই দ্রবীভূত হবে। পেনসিল না থাকলে বলপয়েন্টই দিন। সবচেয়ে ভালো হত চারকোল হলে। স্যার এক টুকরা কয়লা কি জোগাড় করা যায়?

মীরু উঠে বসল। ইন্টারভু বোর্ডের কথা ভাবতে গিয়ে তার ঘুম পুরোপুরি চলে গেছে। আজ রাতে ঘুম আসবে এরকম মনে হচ্ছে না। ঘুমের চেষ্টা করার কোনো মানে হয় না। বরং এখন গরম এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়া যায়। HBO মুভি চ্যানেলে মুভি দেখা যেতে পারে। অদ্রিা রোগীদের জন্যে মুভি চ্যানেলগুলি খুব ভালো। ইনসমনিয়া চ্যানেল চালু করলে চমৎকার হত। পৃথিবীর সব অন্দ্রিা রোগী আগ্রহ করে এই চ্যানেল দেখত।

মীরু চা বানিয়ে নিজের শোবার ঘরে চলে এল। টিভির সামনে বসল। আফজল সাহেবের ঘুম খুব পাতলা। টিভি ছাড়লেই তিনি জেগে উঠবেন এবং বিরক্ত গলায় বলবেন, কে? টিভি ছেড়েছে কে? তার চেয়ে বরং চা খেতে খেতে অন্য কিছু ভেবে সময় কাটানো যাক। সুলতানা ফুপুর সঙ্গে কাল্পনিক কথােপকথন। কঠিন ইসলামিক মহিলা হলেও সুলতানা ফুপুকে মীরুর ভালো লাগে, কারণ এই ফুপু বিস্মিত হতে ভালবাসেন। অতি তুচ্ছ জিনিসেও তিনি বিস্মিত হন। বোরকা পরে বের হবার আগে ঠোটে গাঢ় করে লিপস্টিক দেন। চোখে মাসকারা। রোজ দিয়ে গালে লালচে আভা আনেন।

ফুপুর সঙ্গে কাল্পনিক কথাবার্তা শুরু করা যাক। ফুপু এসেছেন। মীরুর হাত ধরে তাকে নিয়ে গেছেন বারান্দায়। গলা নিচু করে তিনি বললেন–

এইসব কী শুনছি মীরু? কী সর্বনাশ!

কী শুনছ ফুপু?

কোন এক বদ ছেলের সঙ্গে তোর নাকি খাতির হয়েছে?

বদ ছেলে তোমাকে কে বলল?

যেসব ছেলে-মেয়ের সঙ্গে খাতির করে তারা অবশ্যই বদ।

ছেলের সঙ্গে মেয়ের ভাব হবে না?

ভাব হবে। বিয়ের পর হবে। বিয়ের আগে কীসের ভাব? যা শুনছি তা কি সত্যি?

হুঁ।

কী সর্বনাশ! তুই তওবা কর।

তওবা করার মতো কোনো পাপ করিনি ফুপু।

বেগানা পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস এটা পাপ না? আমার তো এখন সন্দেহ হচ্ছে তোরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রিকশায় বসেছিস।

তোমার সন্দেহ ভুল না ফুপু। আমরা প্রায়ই রিকশায় চড়ি।

গায়ের সঙ্গে গা লাগে?

যা অজু করে আয়— এক্ষুণি তোকে তওবা করাব।

ছেলেটাকে তোমার পছন্দ হবে। খুব ভালো ছেলে।

অচেনা মেয়ের সঙ্গে এক রিকশায় ঘুরে বেড়ায় সেই ছেলে ভালো? তুই কি পাগল হয়ে গেলি?

বারসাতের সঙ্গে দশ মিনিট কথা বললে তুমি পটে যাবে।

পটে যাবে কী রকম কথা। এই ধরনের নোংরা কথা আমার সঙ্গে বলবি না মীরু। তোর মুখে নোংরা কথা মানায় না। নোংরা কথা বললে যে অজু ভেঙে যায় এটা জানিস?

বারসাতকে তুমি পনেরো মিনিট সময় যদি দাও তাহলে সে তোমার পোট্রেট করে ফেলবে। সেই পোট্রেট দেখলে তোমার চোখ কপালে উঠে যাবে।

পোট্রেট করে ফেলবে মানে কী? পোট্রেট কী?

তোমার ছবি এঁকে ফেলবে। এমন সুন্দর যে মনে হবে ক্যামেরায় তোলা।

ছবি আঁকা তো খুবই গুনার কাজ।

গুনার কাজ না সোয়াবের কাজ আমি জানি না তবে তার আঁকা ছবি। দেখলে তোমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাবে। ছবি আঁকা কীভাবে শিখেছে শুনবে?

না।

আহা শোনো না। বারসাত একদিন গিয়েছে নিউ মার্কেটে। ফার্মেসি থেকে এসিডিটির ওষুধ কিনবে। ওর মারাত্মক এসিডিটি। যাই হোক ওষুধ কিনতে গিয়ে দেখে ফার্মেসির সামনে এক লোক মেঝেতে বসে ফটোগ্রাফ দেখে দেখে পেনসিলে ছবি আঁকছে। ওয়ান ফুট বাই ওয়ান ফুট ছবি একে। দেয়, একশ করে টাকা নেয়। বারসাত লোকটার পাশে বসে পড়ল। দুঘণ্টা ছবি আঁকা দেখল। তারপর কাগজের দোকান থেকে কাগজ কিনল, পেনসিল কিনল। মেসে ফিরে নিজের পাসপোর্টের ছবি দেখে একটা ছবি আঁকল। খুবই সুন্দর হল ছবিটা— এই তার শুরু।

ছেলের ধৈর্য আছে।

এটা ধৈর্য না। এর নাম ক্ষমতা। কোনো কিছু করতে হলে শুধু ধৈর্যে হয় না। ক্ষমতা লাগে। বারসাত ছবি আঁকার ক্ষমতা নিয়ে এসেছে। নিজে বুঝতে পারেনি। তবে সে পোট্রেট ছাড়া আর কিছু করে না। যে পোট্রেট এত ভালো পারে সে সব কিছুই পারবে অথচ সে করবে না। তার না কি মানুষের মুখ ছাড়া অন্য কিছু আঁকতে ভালো লাগে না। ফুপু তাকে দিয়ে তোমার একটি ছবি আঁকাবে? বোরকা ছাড়া ছবি।

ফাজলামি করিস না তো।

আচ্ছা ঠিক আছে ছবি না আঁকালে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বল। কথা বলাতে তো দোষ নেই।

কথা বললে কী হবে?

কিছুক্ষণ কথা বললেই তাকে আপন মনে হবে। মনে হবে সে বাইরের কেউ না, ঘরের মানুষ। সে তিনটা প্রাইভেট টিউশনি করে। যে সব বাচ্চাদের সে পড়ায় তাদের মায়েদের সঙ্গে ওর খুবই খাতির। মায়েরা। তাকে প্রায়ই খবর দিয়ে নিয়ে যায়। তাকে নিয়ে শপিং-এ যায়। এটা-ওটা কাজ করায়। যে কোনো কাজ তাকে দাও সে নিখুঁতভাবে করবে। তার এক ছাত্রীর নানির চোখ অপারেশন হবে মাদ্রাজে। বারসাত একা তাঁকে নিয়ে মাদ্রাজ থেকে চোখ অপারেশন করে চলে এসেছে। মানুষটাকে তোমার এখন কেমন লাগছে ফুপু?

নাই কাজ খই ভাজ টাইপ লাগছে। এক ধরনের মানুষই আছে যাদের নিজের কোনো কাজ থাকে না তারা কাজের জন্যে অন্যের ওপর লেপ্টে থাকে।

ঠিক বলেছ ফুপু। বিয়ের পর আমি ওর এই অভ্যাস ঠিক করাব।

বিয়ে মানে? বিয়ের কথা আসছে কেন? তুই কি ঐ গাধাটাকে বিয়ের কথা ভাবছিস?

হুঁ।

হুঁ মানে?

হুঁ মানে Yes. আমি ঐ লোকটাকে কাজির অফিসে বিয়ে করব।

আমি তোর বিয়ে ঠিক করে রেখেছি। ছেলের নাম–জাহাঙ্গীর। হীরের টুকরো ছেলে। তুই কাজি অফিসে কেন বিয়ে করবি।

কাজি অফিসে বিয়ে করব কারণ আমি জাহাঙ্গীর সাহেবকে বিয়ে করছি। অন্য একজনকে বিয়ে করছি। হীরা আমার পছন্দের পাথর না। আমার পহন্দের পাথর হল রেললাইনের পাথর।

মীরু তুই বুঝতে পারছিস না, এরকম কিছু করলে কিন্তু বাসায় গজব হয়ে যাবে।

গজব যাতে না হয় তুমি সেই চেষ্টা চালাবে। তুমি কাজ করবে আমার হয়ে। তুমি হবে আমার স্পাই। ঘরের শত্রু বিভীষণ।

আমি কেন তোর হয়ে কাজ করতে যাব?

কারণ তুমি আমার অতি আদরের ফুপু। আমি তোমাকে পছন্দ করি। তুমিও আমাকে পছন্দ কর। ফুপু দেখ তো বিয়ের দিন আমি এই শাড়িটা পরব। ঠিক আছে না?

মোটেই ঠিক নেই। বিয়ের দিন সাদা শাড়ি কেউ পরে? সাদা হল বিধবাদের রঙ।

পশ্চিম দেশের সব মেয়েরা বিয়েতে সাদা পোশাক পরে। তাছাড়া শাড়িটা পুরোপুরি সাদাও না। মাঝে মধ্যে লাল-সবুজের খেলা আছে।

তুই তো পশ্চিমা মেয়ে না। তুই বাঙালি মেয়ে। বিয়ের দিন তুই পরবি টকটকে লাল রঙের শাড়ি।

তুমি পাগল হয়েছ? লাল শাড়ি পরে আমি কাজির অফিসে যাব না-কি?

এক কাজ কর, শাড়ির উপর বোরকা পরে ফেল। তাহলে কেউ বুঝবে।

এই বুদ্ধি খারাপ না। ঘোমটার নিচে খেমটা নাচ।

কাল্পনিক কথােপকথন আর ভাল লাগছে না। এখন সত্যি সত্যি কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। রুনির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা যায়। সে মনে হয় রাতে ঘুমায় না। মীরু যত রাতেই টেলিফোন করুক দুটা রিং বাজার আগেই রুনি টেলিফোন ধরে সহজ গলায় বলবে–হ্যালো। টেলিফোনটা থাকে বড় খালার ড্রয়িং রুমে। দুটা রিং হবার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন ধরতে হলে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে হয়। মীরার ধারণা তার বড় বোন রাত এগারোটার পর ড্রয়িং রুমেই চুপচাপ বসে থাকে। যার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে তার টেলিফোন কলের জন্যে অপেক্ষা। সেই কল আর আসে না।

মীরা টেলিফোন করল। একবার রিং হবার পরই রুনি মিষ্টি গলায় বলল, হ্যালো।

আমি মীরা। আপা তুমি জেগে আছ?

হুঁ।

ঐ লোকের কি টেলিফোন করার কথা?

কারোরই টেলিফোন করার কথা না। ঘুম আসছে না বলে জেগে আছি। তুই জেগে আছিস কেন?

আমি কেন জেগে আছি তা তোমাকে বলতে পারি কিন্তু তুমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা চারদিকে রাষ্ট্র করে দেবে, আমার হবে অসুবিধা।

মীরা বাসার খবর কি?

বাসার খবর ভাল।

বাবা আমাকে ত্যাজ্য কন্যা করেছেন এটা কি সত্যি?

হুঁ, সত্যি।

তার মানে আমি বাবার বিষয়-সম্পত্তি কিছুই পাব না?

না।

তুই এত সহজভাবে না বলতে পারলি? তোর একটুও খারাপ লাগল।?

খুট করে শব্দ হল। মীরুর বাবা দরজা খুলেছেন।

মীরু চট করে টেলিফোন রেখে দিল। বাবা যদি দেখেন সে টেলিফোনে কথা বলছে তাহলে গজব হয়ে যাবে। মীরু তাকাল ঘড়ির দিকে। চারটা একুশ বাজে। ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আফজল। সাহেব বাথরুমে যাবেন। অজু করবেন। ফজরের নামাজ শেষ করে সূরা। আর রাহমান পড়বেন। তারপর আবার ঘুমুতে চলে যাবেন। ঘুমুতে যাবার। আগে এক কাপ আদা চা খাবেন। একটা টোস্ট বিসকিট খাবেন। এই চা তাকে বানিয়ে দেবেন মীরুর মা জাহেদা বানু।

আজ আফজল সাহেবের চা হবে না। কারণ জাহেদা বানু বাসায় নেই। তিনি ফুলবাড়িয়াতে গিয়েছেন। তাঁর এক চাচাতো বোনের বিয়ে। বিয়ে সেরে ফিরতে ফিরতে আরো দুই-এক দিন লাগবে।

মীরু ঠিক করল সে যখন জেগেই আছে তখন আর বাবার রুটিনের ব্যতিক্রম করাবে না। এক কাপ চা নিজেই বানিয়ে দেবে। বাবা নিশ্চয়ই অবাক হবেন। খানিকটা খুশিও হয়তো হবেন। তবে তিনি তা প্রকাশ করবেন না। এমন একটা ভাব ধরবেন যেন এরকমই হবার কথা। মেয়ে তাকে চা বানিয়ে দিচ্ছে এতে খুশি হবার কিছু নেই। এটা মেয়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ছে।

তিনি একবার জিজ্ঞেসও করবেন না এত ভোরে তার মেয়ে জেগে আছে কেন? তার কি কোনো সমস্যা?

মীরু চায়ের পানি গরম করেছে। একটা জিনিস সে বুঝতে পারছে না। তার বাবা চা-টা কখন খান, সূরা আর রাহমান পাঠ করার আগে না পড়ে?

রান্না ঘরে শব্দ করে কে?

বাবার গলা। গলাটা যেন কেমন অন্যরকম। অসুস্থ মানুষের চিকন গলা। দীর্ঘ বাক্য শেষ করার মতো দমও যেন নেই।

মীরু বলল, বাবা আমি। চা খাবে? চা বানিয়ে আনি?

আজফল সাহেব হাঁপানি রোগীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, মা। একটু এদিকে আয়।

মীরু বাবার শোবার ঘরে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেল। বাবা জায়নামাজে আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছেন। তাঁর মুখ দিয়ে ফেনার মতো কি যেন বের হচ্ছে। ডান হাত একটু পরে পরে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মীরু হতভম্ব হয়ে। বলল, কী হয়েছে বাবা?

আফজল সাহেব থেমে থেমে বললেন, মারা যাচ্ছিগো মা। মারা যাচ্ছি। বুকে ব্যথা। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। গোঙাতে লাগলেন।

মীরু এখন কী করবে? জিতু মিয়া ছাড়া বাসায় পুরুষ মানুষ কেউ নেই। একতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। তারা দলবেঁধে আজমির শরিফ গিয়েছেন। বাড়িওয়ালার এক ভাগ্নেকে রেখে গেছেন বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে। সেই ভাগ্নে আধপাগল। সারাদিন বারান্দায় মাথা নিচু করে বসে থাকে। মেঝের দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসে। মীরু দৌড়ে টেলিফোন রিসিভার কানে নিল। ডায়াল টোন নেই। একটু আগেই সে কথা বলেছে আর এখন ডায়াল টোন নেই— এর মানে কি?

মীরু টেলিফোন রেখে বাবার কাছে গেল। আফজাল সাহেব বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মীরু বলল, বাবা খুব খারাপ লাগছে?

তিনি জবাব দিলেন না। মীরু বাবাকে ফেলে রেখে আবার টেলিফোনের কাছে গেল।

এমন তো হতে পারে হঠাৎ টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে। যে টেলিফোন কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ নষ্ট হয় সেই টেলিফোন কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ কি ঠিকও হতে পারে না? মীরু ছুটে গিয়ে টেলিফোন রিসিভার কানে দিল। পোঁ পোঁ শব্দ হবার বদলে কেমন যেন ঝড়-তুফানের শব্দ হচ্ছে। শোঁ শো আওয়াজ। বৃষ্টির শব্দ। মীরু অনেকক্ষণ বুঝতেই পারল না যে বৃষ্টি-বাদলার শব্দ টেলিফোন রিসিভার থেকে আসছে না। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। সেই শব্দ। শ্রাবণ মাস বৃষ্টি-বাদলারই সময়।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ