ট্রেন গফরগাঁও স্টেশনে থেমে আছে।

দুপুর একটা।

ঢাকার দিকে যাবার মেল ট্রেনটিও থেমে আছে। কোথাও কিছু ঝামেলা হয়েছে। কোনো ট্রেনই নড়ছে না। কড়া রোদ। বাতাস নেই। মরিয়ম খুব ব্যস্ত। যাত্রীদের পানির পিপাসা পাচ্ছে। ঘন ঘন মরিয়মের ডাক পড়ছে।

অন্তু খুব খুশি, কারণ বেশ কিছু বাদামওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে। সে মনে মনে বলছে–খাও, খুব বেশি করে বাদাম খাও। বাদাম যত বিক্রি হবে, পানিও তত বিক্রি হবে। বাদাম খেলেই গলা যাবে শুকিয়ে, পানি ছাড়া গতি নেই।

মরিয়ম ছাড়াও আরো দু জনে পানি বিক্রি করছে। এক জন বুড়ো লোক। সে ভেজা গামছা জড়ানো কলসী নিয়ে এসেছে। সুর করে বলছে, কলসির ঠাণ্ডা পানি। বরফের লাহান ঠাণ্ডা। তার ব্যবসাই জোরেসোরে চলছে। যাত্রীরা তাকেই বেশি ডাকছে। অন্য জন অন্তুর বয়সী। তার ব্যবসা সবচেয়ে খারাপ। বলতে গেলে কেউই তাকে ডাকছে না। তাকে না ডাকার কারণ হচ্ছে সে অসম্ভব নোংরা। এক নাকে সর্দি উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে।

বুড়ো পানিওয়ালাকে কোনো রকমে সরিয়ে দিতে পারলেই এক চেটিয়া ব্যবসা করবে মরিয়ম। অন্তু মুহূর্তে মনস্থির করে ফেলল। উকার গতিতে ছুটে এসে বুড়োর ঘাড়ে পড়ে গেল। কলসি ছিটকে পড়ল। বুড়ো বিড়বিড় করে বলল, এইটা কি করলা? দশ টেকা দামের নয়া কলসি।

অন্তু ভেবেছিল বুড়ো তাকে ধরে মারধোর করবে। বুড়ো সে রকম কিছু করল না। দুঃখী ভঙ্গিতে ভাঙা কলসির দিকে তাকিয়ে রইল। অন্তুর মন খারাপ হয়ে গেল। না ভাঙলেই হত বেচারার কলসিটা।

মরিয়ম একা-একা সামলাতে পারছে না। পুতুল তাকে সাহায্য করছে। পানি ভরে গ্লাস এগিয়ে দেয়া ও পয়সা নেয়া। খালি জগ পানিতে ভর্তি করে আনা। অনেক কাজ। শুরুতে পুতুলের একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছিল। এখন লাগছে না। সে প্রবল উৎসাহে ছোটাছুটি করছে। সুর করে চেঁচাচ্ছে-পানি, ঠাণ্ডা পানি, কলের পানি। সে কল্পনাও করে নি,পানি বিক্রির ব্যাপারটায় যে এত আনন্দ আছে। এর মধ্যে অন্ত খবর এনেছে– ঢাকা মেইল আরো এক ঘন্টা থাকবে। লাইনে নাকি গণ্ডগোল হয়েছে। খুব ভালো খবর। এক ঘন্টা না থেমে দশ ঘন্টা থেমে থাকলে আরো ভালো।

ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে একটি মেয়ে হাতের ইশারায় পুতুলকে ডাকছে। পুতুলের বুক ধ্বক করে উঠল। চেনা কেউ নাকি? না, চেনা কেউ নয়। মেয়েটি বলল, এই, তুমি আমার ফ্লাস্ক ভর্তি করে পানি এনে দিতে পারবে?

পুতুল মাথা কাৎ করে জানাল, পারবে।

আগে ভালো করে ধুয়ে নিও, কেমন?

আচ্ছা।

মেয়েটির স্বামী ইংরেজিতে বলল, এত দামি ফ্লাস্ক ওর হাতে দিচ্ছ। কেন? নিয়ে ভেগে যাবে।

মেয়েটি ইংরেজিতে বলল, ভাগলে ভাগবে। আমার তো একে চোর বলে মনে হচ্ছে না।

লোকটি বলল, এইসব বিচ্ছুরা সবাই চোর। ছোটবেলায় করে চুরি, বড় হলে করে গুণ্ডামি।

কথাবার্তা ইংরেজিতে হচ্ছে। পুতুল সবই বুঝতে পারে। এ্যাংলো এক মেম সাহেব তাকে ইংরেজি পড়ায়। সে বুঝবে না কেন? এদের চেয়ে ভালো ইংরেজি সে নিজেও বলতে পারে।

মেয়েটি বিরক্ত মুখে ফ্লাস্ক এগিয়ে দিল। ফ্লাস্ক হাতে নিতে নিতে পুতুল চমৎকার ইংরেজিতে বলল, বাচ্চাদের চোর বলতে নেই। চোর বললে আল্লাহ্ তোমাদের পাপ দেবেন।

মেয়েটি এবং তার স্বামী কী যে অবাক হয়েছে! চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি বলল, এই ছেলে, এই শোন শোন। ততক্ষণে পুতুল চলে গিয়েছে। ফ্লাস্ক ভর্তি করে সে নিজে নিয়ে এল না। অন্তুকে দিয়ে পাঠাল।

মেয়েটি বলল, ঐ ছেলেটা কে?

অন্তু উদাস গলায় বলল, কেউ না।

কেউ না মানে? তোমার কে হয়?

ভাই হয়।

তোমরা কী কর?

পানি বিক্রি করি। ভিক্ষা করি।

ঐ ছেলেটাকে ডেকে আনতে পারবে? ডেকে আনতে পারলে দশটা টাকা দেব। যাও তাড়াতাড়ি কর, গাড়ি ছেড়ে দেবে।

অন্তুর কোনো রকম তাড়া দেখা গেল না। সে তার ইয়েলো টাইগারকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুতুলকে ডেকে আনলেই টাকা দেবে– এই কথা তার এক বিন্দু বিশ্বাস হল না। টাকা এত সস্তা নয়।

ঢাকা মেইল এক ঘন্টা থাকবে, এই গুজব সত্যি হল না আধ ঘন্টার মাথায় গার্ড সবুজ নিশান উড়িয়ে দিল। পুতুলদের রোজগার মন্দ নয়। এগারো টাকা আট আনা। এর মধ্যে একটা টাকা চালান যাবে না বলে মনে হচ্ছে। ছেঁড়া টাকা। তবু দশ টাকা আট আনাই-বা মন্দ কি? টাকা সব অন্তুর পকেটে। খরচ সে-ই করবে। পুতুল মৃদু গলায় বলল, আমাকে একটা টাকা দেবে?

ক্যান?

এক কৌটা কর্ণ সুন্দর কিনব।

কর্ণ-সুন্দর দিয়া কী করবা?

ঐ লোকটা কিছু বিক্রি করতে পারে নি। আমার খুব খারাপ লাগছে। বেচারা।

অন্তুর টাকা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। মরিয়মের পীড়াপীড়িতে রাজি হল।

এক টাকায় এক কৌটা কর্ণ-সুন্দর পাওয়ার কথা। লোকটি দু’টি কৌটা দিয়ে দরাজ গলায় বলল, পাইকারি দরে দিলাম। তুমি পুলাপান। মানুষ, এই জইন্যে খাতির করলাম। কোম্পানির লোকসান হইল। বেজায় লোকসান।

পুতুল বলল, কোম্পানির লোকসান হলে একটাই দিন। দুটি দিতে হবে না।

না-না, অসুবিধা নাই। তোমারে খুশি হইয়া দিলাম।

পুতুল কর্ণ-সুন্দর হাতে নিয়ে একটু দূরে সরে এল। আড়েআড়ে সে লোকটিকে দেখছে। লোকটি তৎক্ষণাৎ এক টাকার বাদাম কিনছে। কী আগ্রহ করেই না সে বাদাম খাচ্ছে। বেচারা সারাদিন হয়তো কিছু খায় নি। দ্রুত তার বাদাম ফুরিয়ে যাচ্ছে।

মরিয়ম এসে দাঁড়িয়েছে পুতুলের পাশে। সে চোখ বড় বড় করে বলল, কী দেখ?।

ঐ লোকটাকে দেখি।

দুই বিলাইয়ের ঝগড়া শুনবা? আও যাই।

লোকটি ওদের দু’ জনকে দেখে অপ্রস্তুতের হাসি হাসল। উদাস গলায় বলল, বাদাম খাইবা?

বাদাম খেতে বলা অর্থহীন। কারণ বাদাম নেই। চারদিকে শুধু বাদামের খোসা পড়ে আছে। মরিয়ম বলল, দুই বিলাইয়ের ঝগড়া দেখমু।

লোকটি মনে হল সঙ্গে সঙ্গে রাজি। একটা হাত মুখের উপর রেখে বেড়ালের ঝগড়া শুরু করল। মাও মাও ফ্যা ফ্যাচু–ভয়াবহ ঝগড়া। পুতুল মুগ্ধ। তার কাছে মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি দুটি বেড়াল ঝগড়া করছে। একটা পারছে না, কিছুক্ষণ পরপরই মিউ মিউ করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। পুতুল বলল, আপনি আর কী জানেন?

মেলা জিনিস জানি। জানলে কি হইব, পেটে ভাত জুটে না।

ভাত জোটে না কেন?

হেইডাই তো বুঝি না। কপালে লেখা নাই।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, ভাতের কথা কপালে লেখা থাকতে হয়!

মরিয়ম হেসে ফেলল। এই ছেলেটার অদ্ভুত অদ্ভুত কথায় তার খুব হাসি পায়। ভাতের কথা যে কপালে লেখা থাকতে হয়, কপালে না থাকলে যে ভাত জোটে না–এই অতি সাধারণ কথাও এই ছেলেটার জানা নেই। কি অবাক কাণ্ড!

লোকটি বাদামের খোসাগুলো হাতড়ে হাতড়ে দেখছে। সে একটা আস্ত বাদাম পেয়ে গেছে। বাদামটা ভাঙতে গিয়েও ভাঙল না। এগিয়ে দিল পুতুলের দিকে। নরম গলায় বলল, নেও, খাও।

পুতুল হাত বাড়িয়ে নিল। লোকটি কী সুন্দর করেই না হাসছে।

.

ট্রেন ময়মনসিংহ এসে পৌঁছল সন্ধ্যা মেলাবার পর।

ঠিক ময়মনসিংহ স্টেশনে নয়। একটু দূরে, আউটার সিগন্যালে। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ বাতি না জ্বলায় স্টেশনে ঢুকতে পরছে না। পুতুল সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অন্তু ধাক্কা দিয়ে জাগাল। ফিসফিস করে বলল, লাফ দিয়ে নামুন লাগব।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, কেন?

ইস্টিশনে মবিল কোর্ট আছে।

সেটা আবার কি?

পুলিশ! বিনা টিকেটে গেলে পুলিশে ধরে।

ট্রেন চলতে শুরু করেছে। এত ব্যাখ্যা করার সময় নেই। অন্তু খোলা দরজা দিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়েছে। অন্তুর পেছনে পেছনে মরিয়ম। পুতুলের ভয় করছে। বাইরে অন্ধকার। ঝোঁপঝাড়ের মতো দেখাচ্ছে। ট্রেনেও গতি চলে এসেছে। সে চোখ বন্ধ করেই লাফিয়ে পড়ল। বড় রকমের একটা ধাক্কা লাগল গায়ে, তারপর গড়িয়ে নিচে নেমে যেতে লাগল। কোথায় নেমে যাচ্ছে কে জানে। চোখ মেলতে সাহসে কুলুচ্ছে না। সে প্রাণপণে ডাকল, অন্তু, এই অন্তু।

না, তার তেমন কিছু হয় নি। দুই হাঁটুর অনেকখানি শুধু ছিলে গেছে। ব্যথা করছে, রক্ত বেরুচ্ছে, তবু পুতুলের মনে হচ্ছে–এটা খুবই সামান্য ব্যাপার। তারা হাঁটছে রেল লাইনের স্লীপারে পা ফেলে ফেলে। পুতুল ভয়ে। মরছে, যদি কোনো ট্রেন এসে পড়ে। অন্তু এবং মরিয়ম নির্বিকার। মরিয়ম সুর করে এক্কা-দোক্কা খেলার মতো করে স্লীপারে পা দিচ্ছে। যেন লাইন ধরে হাঁটাও একটা খেলা। অন্তু আবার স্লীপার ছেড়ে উঠে এসেছে লাইনে। একটা মাত্র লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া খুব সহজ নয়। কিন্তু সে দ্রুত এগুচ্ছে। যেন এইভাবে হাঁটতেই সে অভ্যস্ত। মাঝে মাঝে শিস্ দেবার চেষ্টা করছে। শিটা ঠিক হচ্ছে না। ফুঁ দেয়ার মতো শব্দ হচ্ছে।

অন্তু ইয়েলো টাইগারটাকে ফেলে এসেছে ট্রেনে। এই নিয়ে তার মনে কোনো রকম ক্ষোভ বা দুঃখ লক্ষ করা যাচ্ছে না। কুকুরের কথা এখন সে পুরোপুরি ভুলে গেছে।

পুতুলের শীত করছে। বেশ ভালো শীত। খোলা মাঠের উপর দিয়ে বইছে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। পুতুল কাঁপছে ঠকঠক করে। সে অবশ্যি কিছু বলল না। অন্তুর গা খালি। সে কিছু বলছে না। পুতুল কেন শুধু শুধু বলবে? সে দুটি হাত গুটিয়ে বুকের উপর নিয়ে এসে বাতাসের ঝাঁপটা সামাল দেবার চেষ্টা করছে।

অন্তু অন্ধকারেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। কানে কানে মরিয়মকে কী যেন বলতেই সে তার স্যুয়েটার খুলে দিল। পুতুল বলল, আমার লাগবে না।

মরিয়ম খিলখিল করে হেসে ফেলে বলল, শীতে কাঁপছে, আর কয়, আমার লাগবে না। হি হি হি।

পুতুল বলল, তোমাদের শীত লাগে না?

অন্তু বলল, না।

লাগে না কেন?

আমরা হইলাম গিয়া গরিব। গরিব মাইনষের শীত লাগে না।

গরিব মানুষের শীত লাগে না কেন?

অন্তু বিরক্ত হয়ে বলল, জানি না।

মরিয়ম বলল, গরিবের শীত কম লাগে। এইডা হইল গিয়া নিয়ম।

কে বানিয়েছে এই নিয়ম?

আল্লা বানাইছে।

আল্লা দু রকম নিয়ম বানিয়েছেন কেন–ধনী মানুষের জন্যে এক রকম নিয়ম, আবার গরিব মানুষের জন্যে অন্য রকম নিয়ম?

এইডা তুমি আল্লারে জিগাও। হি হি হি। খালি পাগলের লাহান কতা কয়।

তারা ময়মনসিং রেল স্টেশনে এসে উঠেছে। প্রচুর আলো, ভিড়, হৈচৈ। একসঙ্গে দুটি ট্রেন এসে থেমেছে। অনেকেই কুলি কুলি করে চেঁচাচ্ছে। কুলি পাচ্ছে না। এক জন প্রকাণ্ড একটা স্যুটকেস কিছু না বলেই অন্তুর মাথায় তুলে দিয়ে বলল, রিকশায় তুলে দে, এক টাকা পাবি। স্যুটকেস মাথায় নিয়ে অন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার পা কাঁপছে। দেখে মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে।

অন্তু বলল, স্যুটেকেস নিমু না। অন্য লোক দেখেন।

চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। কাজ দিলে কাজ করবে না। আছে শুধু চুরির মতলবে। হাঁটা শুরু কর, নয় তো টান দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলব।

লোকটা একটা ধাক্কা দিল অন্তুর পিঠে। অন্তু দুলতে দুলতে এগুচ্ছে। মরিয়ম ছুটে গিয়ে স্যুটকেসের একমাথা ধরল, যাতে ভাইয়ের কিছু সাহায্য হয়। পুতুল ভেবে পেল না মানুষরা এত খারাপ কীভাবে হয়। সে নিজে যে-স্যুটকেস নিয়ে হাঁটতে পারে না, সেই স্যুটকেস একটা বাচ্চা ছেলের মাথায় কী করে তুলে দেয়!

পুতুল হঠাৎ দেখল অন্তু এবং মরিয়ম ভিড় কাটিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগুচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাদের তাড়া করছে। তারা খানিকটা উত্তেজিত, তবে দু জনের মুখই খুব হাসি হাসি। দ্রুত এরা ওভারহেড ব্রীজে উঠে পড়ল। পুতুল ছুটে গেল ওদের দিকে। একটা কোনো মজার কাণ্ড নিশ্চয়ই হয়েছে। কারণ দূর থেকেই অন্তু এবং মরিয়মের খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছে।

কাণ্ডটা এ রকম–অন্তু এবং মরিয়ম বহু কষ্টে স্যুটকেসটা গেট দিয়ে বের করেছে। গেটের বাইরে বড় নর্দমা। অন্তু হঠাৎ কেউ কিছু বুঝবার আগেই স্যুটকেস ফেলে দিল নর্দমায়। ফেলেই এক দৌড়। স্যুটকেসের মালিক স্যুটকেস ফেলে পেছনে পেছনে আসতে পারছে না।

ঘটনায় মরিয়ম খুব বেশি মজা পেয়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই হি হি হি। শেষ পর্যন্ত চিমটি দিয়ে তার হাসি থামাতে হল। তার হাসিরোগটা এমন, যে মাঝে মাঝে চিমটি দিয়ে থামাতে হয়। প্রচণ্ড রকম ব্যথা পেলে তবেই হাসি থামে।

তারা ওভারব্রীজে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল। বলা যায় না, লোকটা ফিরে আসতে পারে। ফিরে আসতে দেখলে দ্রুত পালিয়ে যেতে হবে।

ওভারব্রীজে বসে থাকতে বড় মজা লাগছে পুতুলের। ওপর থেকে ট্রেনগুলোকে কেমন সাপের মতো দেখায়। যখন চলতে শুরু করে মনে হয় সাপটার ঘুম ভেঙেছে। হেলে-দুলে যাচ্ছে খাবারের খোঁজে।

অন্তু পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা মজা দেখবা?

কী মজা?

এইখানে থাইক্যা লাফ দিয়া ট্রেনের ছাদে পরমু।

ইশ।

ইশ না, এই দেখ।

বলতে না-বলতেই অন্তু সত্যি সত্যি লাফিয়ে ট্রেনের ছাদে পড়ে গেল। পুতুল স্তম্ভিত। মরিয়ম ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, খালি বাহাদুরি দেখায়। লাফ দিতে সবেই পারে।

তুমিও পার?

হ। দেখবা?

না, আমি দেখতে চাই না। আমার ভয় লাগছে।

দেখার মইদ্যে আবার ডর ক্যান!

না, তোমাকে দেখাতে হবে না। আমার সত্যি ভয় লাগছে।

মরিয়ম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল বাজানরে খুইজ্যা বাইর করি। খিদা লাগছে।

পুতুলের কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না! সে মুগ্ধ চোখে অন্তুর কাণ্ডকারখানা দেখছে। অন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে ট্রেনের একটা কামরা থেকে অন্য কামরায় যাচ্ছে। এর মধ্যে গার্ড বাঁশি বাজিয়ে সুবজ বাতি দেখাচ্ছে। ট্রেন হুইসেল দিয়ে চলতেও শুরু করেছে, অথচ অন্তু নির্বিকার। ভয়ে পুতুলের বুক কাঁপছে। সে কাঁপা গলায় বলল, অন্তু আসছে না কেন?

মরিয়ম বলল, আসব।

ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে তো।

ছাড়লেও সে আসব।

মরিয়ম প্রায় জোর করে পুতুলের হাত ধরে তিন নম্বর প্ল্যাটফরমের দিকে এগুচ্ছে। সে তার বাবাকে খুঁজে বের করবে। রান্না হবে। তারপর খাওয়া হবে।

অন্তু এবং মরিয়মের বাবা জ্বরে প্রায় অচেতন। তবু এই অবস্থাতেও মরিয়মকে দেখে হাসল। নিচু গলায় বলল, অন্তু কই?

আইতাছে।

জ্বরে কাবু হইলাম, বুঝছস! বেজায় জ্বর।

খাইছ কিছু?

না।

পুতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অন্তুর বাবা তাকে একটি কথাও জিজ্ঞেস করল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল। মরিয়ম মুহূর্তের মধ্যে কাজে লেগে পড়ল। তিনটি ইটের উপর একটা এলুমিনিয়ামের ডেকচি বসিয়ে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যে চুলায় আগুন ধরাল। কল থেকে পানি আনল।

অন্তুর বাবা মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখছে, আবার চোখ বন্ধ করে ফেলছে। রান্না সম্পর্কে দু-একটা কথা বলছে। যেমন একবার বলল, লবণ নাই, বুঝছস? অন্তুরে দিয়া এক ছটাক লবণ আনাইস।

পুতুল বসেছে মরিয়মের পাশে। মরিয়মের দেখাদেখি হাত মেলে দিয়েছে আগুনের ওপর। আগুনের আঁচ বড় ভালো লাগছে! পুতুল বলল, কী রান্না হচ্ছে?

তিন মিশাল।

তিন মিশাল আবার কি?

ভাত ডাইল আর তরকারি। তিনটা একত্রে! খাইতে খুব মজা।

তাদের পাশেও আরেকটি পরিবার রান্না চাপিয়েছে। চার পাঁচটা ছোট ছোট শিশু হাঁড়ির চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। তাদের মা খুন্তি দিয়ে হাঁড়ি নাড়ছে এবং গল্প করছে। খুব মজার কোনো গল্প নিশ্চয়ই, কারণ মরিয়মও কান পেতে আছে সেই গল্পের দিকে।

পুতুল কিছু জিজ্ঞেস করলে এখন আর সে জবাব দিচ্ছে না। পুতুলও গল্প শুনছে। তবে কিছু বুঝতে পারছে না। গ্রাম্য ভাষায় গল্প বলা হচ্ছে, উচ্চারণও কেমন অদ্ভুত! মেয়েটি কেমন টেনে টেনে বলছে। মাঝে মাঝে গানের মতো আছে–সুর করে গাইছে।

তুলারাশি রাইজ কইন্যা তখন আর কী করে? উত্তরে চায়, দক্ষিণে চায়, পুব আর পশ্চিমে চায়। কোনো দিশা পায় না।

চউক্ষের পানিতে কইন্যার
বদন ভাইস্যা যায়
কইন্যা বলে ভাই গো আমার
কি হইবে উপায়?

তখন রাইজ কইন্যার ভাই কইল, ও আমার সোনা ভইন। চউখ মুছ। আমি থাকতে তোমার কোনো বিপদ নাই। দেখি আমি থাকতে কে তোমারে কি কয়। এই কথা বইল্যা হে তলোয়ার হাতে নিল।

তলোয়ার হাতে লইয়া ভাইয়ে
ভইনের দিকে চায়।
ভইনের দুঃখ দেইখ্যা তাহার
কইলজা পুইড়া যায়।

ভাষা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও পুতুলের শুনতে চমৎকার লাগছে। গানের সুরে তুলারাশি কন্যার দুঃখের কথা বলতে বলতে মেয়েটি কেঁদে ফেলল। পুতুলেরও চোখ ভিজে গেল। গলা ভার ভার হল। এত কষ্ট কেন তুলারশি কন্যার?

তিন মিশাল হাঁড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই অন্তু এসে উপস্থিত। হাত ধুয়ে সে সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসে গেল! অন্তুর বাবা খাবে না। তার জ্বর বোধ হয় আরো বেড়েছে।

একেবারেই লবণবিহীন রান্না। পাশের মেয়েটির কাছ থেকে লবণ এনে মরিয়ম প্লেটে ছিটিয়ে দিল। তরল এক ধরনের জিনিস তৈরি হয়েছে। পুতুলের কাছে মনে হচ্ছে–এত চমৎকার খাবার সে বহুদিন খায় নি। দু’বার সে চেয়ে নিল। আরো একবার নিত, কিন্তু তার লজ্জা করছে। হাঁড়িতে অল্প কিছু খাবার এখনো রয়েছে। অন্তুর বাবার জন্যে রয়েছে। জ্বর কমলে খাবে।

অন্তু এবং মরিয়ম থালা বাসন ধুতে গেল। পুতুল বসে রইল অন্তুর বাবার কাছে। অন্তুর বাবা বলল, ঘুম ধরলে ঘুমাও। জায়গা আছে।

পুতুল বলল, আমার ঘুম ধরে নি। আর ধরলেও এত নোংরা বিছানায় আমি ঘুমূব না। অন্তুর বাবা অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসল।

তোমার নাম কি?

আমার নাম পুতুল। আপনার কি হয়েছে?

আমার কি হইছে, হেইডা কোনো কথা না। তুমি কেডা ঠিক কইর্যা কও।

বলছি তো আপনাকে। আমার নাম পুতুল।

বুঝছি তুমি বাড়ি থাইক্যা পালাইছ।

পালাই নি তো। কাউকে না বলে চলে এসেছি।

কী সব্বনাশের কথা!

এখন চলে যাব। রাতে ঢাকায় যাবার ট্রেন আছে। অন্তু আমাকে দিয়ে আসবে।

তুমি যে ধনী মাইনষের পুলা এইডা বুঝি নাই। তোমার কথা শুইন্যা বুঝলাম।

অন্তুর বাবা আবার শুয়ে পড়ল। জ্বরের ঘোরে সে বসে থাকতে পারছে না। বড় মায়া লাগছে পুতুলের। এই লোকটি এত অসুস্থ, অথচ ডাক্তারের কথা কেউ বলছে না।

অন্তু এবং মরিয়ম ফিরে এসে টাকা গণায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজ সারা দিনে যে ক’টাকা পাওয়া গেছে সেগুলো গুণল। একটা বালিশের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে আরো কিছু টাকা বের করল। সব মিলিয়ে তিন শ’ ছ’ টাকা আছে। মরিয়ম হাসিমুখে বলল, ট্যাকা জমাইতাছি।

কেন?

কেনর জবাব দিল অন্তু। তারা সবাই মিলে টাকা জমাচ্ছে, যখন পাঁচ শ’ টাকা হবে, তখন জমান শেষ হবে। সবাই মিলে তারা দেশের বাড়িতে চলে যাবে। তাদের বাবা এ টাকায় একটা ছোট্ট দোকান দেবে। ঐ দোকানের টাকায় তাদের সংসার চলবে। দুই ভাই-বোন ভর্তি হবে স্কুলে। তারপর তারা ছোট্ট এক টুকরা জমি কিনবে। সেই জমিতে তাদের বাড়ি হবে। একটা নৌকাও কিনবে। নৌকা নিয়ে বিলে মাছ মারতে যাবে।

মুগ্ধ কণ্ঠে বলছে অন্তু। মাঝে মাঝে কিছু বাদ পড়ে গেলে মরিয়ম তা ধরিয়ে দিচ্ছে। যেমন গাই কেনার কথা বলতে অন্তু ভুলে গিয়েছিল। মরিয়ম মনে করিয়ে দিল।

পুতুল বলল, তখন তোমাদের বাড়িতে আমি বেড়াতে যাব। আমরা খুব আনন্দ করব।

তোমাদের আম-কাঁঠালের বাগান আছে?

গেরামে আছে। বেত ফলের বন আছে। ডেফলের গাছ আছে। ডেফল চিন?

না।

তিনটা কইরা কোয়া থাকে। মিষ্টি।

অন্তুর বাবার জ্বর খুব বেড়েছে। সে বিড়বিড় করে কী সব বলছে। মরিয়ম বা অন্তু কেউ সে-দিকে তেমন নজর দিচ্ছে না। রাত এগারোটায় ঢাকা মেইল আসবার ঘন্টা পড়তেই সে অন্তুকে বলল, পুলাডারে তার বাসাত দিয়ে আয়। কার না কার পুলা–বাপ মায় কানতাছে।

অন্তু এবং মরিয়ম দু জনই উঠে দাঁড়াল। তারা পুতুলকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। পুতুলের হঠাৎ খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এখান থেকে সে চলে যাবে। আর কোনো দিনও হয়তো এদের সঙ্গে তার দেখা হবে না।

.

রাত একটা।

ঢাকার সব ক’টি খবরের কাগজে এই মুহূর্তে হারানো বিজ্ঞপ্তিতে পুতুলের ছবি ছাপা হচ্ছে। বড় বড় করে পুরস্কারের কথা লেখা আছে। যে কেউ পুতুলের সন্ধান দিতে পারলেই এক লক্ষ টাকা পুরস্কার।

পুতুলের মাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। পুতুলের বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি নিজেও আর সহ্য করতে পারছেন না। তিনি বসে আছেন টেলিফোনের সামনে। টেলিফোন বাজতেই তিনি রিসিভার তুলে বলছেন, কোনো খবর আছে?

কোনো খবর নেই।

.

এরা কেউ জানে না, পুতুল ঢাকা ফিরে আসছে। সে রেলের তৃতীয় শ্রেণীর একটি কামারায় মেঝেতে বসে আছে। তার পিঠে মাথা রেখে মরিয়ম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

ট্রেন দ্রুত ঢাকার দিকে ছুটে আসছে। কামরার গাড়ি-ভরা ঘুম।

কমলাপুর রেল স্টেশনে তারা পৌঁছুল শেষ রাতে। অন্ধকার কাটে নি। তবে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। তারা ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। যেন তাদের সব কথা ফুরিয়ে গেছে।

বাড়ির কাছাকাছি এসে অন্তু এবং মরিয়ম থমকে গেল। কী বিশাল বাড়ি! কী প্রকাণ্ড গেট! অন্তু বলল, এই বাড়ি?

হ্যাঁ।

তোমার বাড়ি!

হ্যাঁ।

সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

মরিয়ম ফিসফিস্ করে বলল, তোমরা কি দেশের রাজা?

পুতুল হা বা না কিছুই বলল না। তার চোখে পানি এসে গেছে। এই পানি সে তার বন্ধুদের দেখাতে চায় না। চোখের জল গোপন করবার জন্যেই সে ছুটে বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকে পড়ল।

.

মরিয়ম এবং অন্তু হাত ধরাধরি করে ফিরে চলল স্টেশনের দিকে। শীতে দু জনই কাতর। একেবারেই খালি গা বলে অন্তুর শীতটা বেশি লাগছে। সে কাঁপছে থরথর করে। মরিয়ম বলল, শীত লাগে ভাইজান?

না, লাগে না।

এক বুড়ো ছেঁড়া কাগজ, শুকনো পাতা জড় করে আগুন করেছে। হাত মেলে বুড়ো চুপচাপ বসে আছে। দু’ ভাই-বোন এগিয়ে গেল আগুনের পাশে। তাদের কচি কচি হাত মেলে ধরল আগুনের ওপর।

বুড়ো বলল, শীতে বড় কষ্ট হয়, না রে?

তারা দু জন এই প্রশ্নের জবাব দিল না। কারণ এই মুহূর্তে শীতের জন্যে তাদের কষ্ট হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে অন্য কোনো কারণে। সেই কারণটা কী তারা পুরোপুরি জানে না। জানার কথাও নয়। যখন বড় হবে তখন হয়তো জানবে। কিংবা কে জানে হয়তো কোনো দিনই জানবে না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ