লাশকাটা ঘরের পলিথিন বিছানো নোংরা টেবিলে আমার শরীর চিৎ হয়ে আছে। গায়ে কোনো কাপড় নেই। টেবিল থেকে ফিনাইলের কঠিন গন্ধ আসছে। ঘরের জানালা আছে। জানালায় হলুদ রঙের পর্দা ঝুলছে। পর্দা নোংরা। সেখানে কিছু বড় বড় নীল রঙের মাছি বসে আছে। মাছিগুলো কিছুক্ষণ বসে থাকে আবার ওড়াউড়ি করে পর্দার ওপর বসে। ঘরের চারটা দেয়ালের একটায় চুনকাম করা হয়েছে। সেখানে কেউ নোংরা কথা লিখেছে। নোংরা কথাটা—এইখানে মরা লাশের পোদ… হয়। যে কথাটা লিখেছে, সে নিজেকে অন্ধকারে রাখতে চাইছে না। মহৎ বাণীর নিচেই সে লিখেছে—ইতি জসিম। তার নিচে মোবাইল ফোনের নম্বর।

ঘরে নিশ্চয়ই অসহনীয় গরম। মুখে রুমাল চেপে দাঁড়ানো ডাক্তার দরদর করে ঘামছে। ডাক্তারের চেহারা সুন্দর। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে সোনালি চশমা। ডাক্তার মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে সিলিংফ্যানের দিকে তাকাচ্ছে। সিলিংফ্যান শব্দ করে ঘুরছে, তবে কোনো বাতাস পাওয়া যাচ্ছে না।

টেবিলের কাছে কাঁচি ও ছুরি হাতে ডোম দাঁড়িয়ে আছে। ডডামের গা খালি। ঘোর কৃষ্ণবর্ণের বেঁটে মানুষ। তার সারা শরীরে ঘন লোম। নির্দেশের অপেক্ষা। ডাক্তার বললেন, পেটটা কেটে শুধু স্টমাক বের করো। ভিসেরা হবে।

ডোম বলল, ফুসফুস-কলিজা নিকালব না?

বললাম তো, শুধু স্টমাক। এত কথা বলো কেন? কাজ শেষ করো। গরমে মারা যাচ্ছি।

ডোম পেট কাটার বদলে, ফ্যানের সুইচ অফ করে দিল। ডাক্তার ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ফ্যান বন্ধ করলা কেন?

ফ্যান চললে কাম করতে পারি না।

ইয়ার্কি করো? ফ্যান চললে কাজ করতে পারো না।

ফ্যান চালায়া দিতেছি—কাটাকাটি আফনে করেন। আমি কাটব না। আর আমার সঙ্গে মিজাজ করবেন না। কালু ডোম মিজাজের ধার ধারে না।

কাজ করবে না?

না। যান, ‘রিপোর্ট’ করেন। আমার চাকরি খান। দেখি, আপনে কত বড় চাকরি খানেওয়ালা।

ডোম দরজার দিকে এগোচ্ছে। ডাক্তার ভীত গলায় বলল, ঠিক আছে। ফ্যান বন্ধ করেই কাজ করো। অল্পতে চেতে যাও কেন?

চলন্ত ফ্যান বন্ধ হয়েছে। মাছিরা পর্দা ছেড়ে আমার মুখের চারপাশে ওড়াউড়ি করছে। কখন নামবে বুঝতে পারছে না।

যতই সময় যাচ্ছে, আমার শীত বাড়ছে। শীতে শরীর কাঁপছে না, আমার শরীর বলে কিছু নেই। শীতের অনুভূতি বাড়ছে। একেকবার ঠান্ডা বাতাস আসে, সেই বাতাস কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়, তারপর বাতাস হঠাৎ থেমে যায়। শীত মনে হয় এই বাতাস নিয়ে আসছে। ঠান্ডা বাড়ার হার কি এক্সপানশিয়াল? তাহলে একটা সময় আসবে যখন আমরা এক্সপোনেনশিয়াল রেখার কাঁধে চলে আসব। সেই সময় শীত অসহনীয় পর্যায়ে বাড়তে শুরু করবে।

কালু ডোম কাটাকাটি শুরু করেছে। আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উপায় নেই, দেখতে হচ্ছে। দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর ব্যবস্থা এ জগতে নেই। মাছি যেমন চারদিক দেখতে পায়, আমিও পাচ্ছি।

ডাক্তার চোখ বন্ধ করে জানালার হলুদ পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিল, সে হঠাৎ চোখ মেলে একপলকের জন্য শবদেহের দিকে তাকিয়ে ছুটে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। ডাক্তার পেটে হাত দিয়ে লাশকাটা ঘরের বারান্দায় বসে বমি করছে। আহা, বেচারা!

কী যেন হয়েছে। মুহূর্তের জন্য আমার দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে আবার স্পষ্ট হয়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখি বড় মামার ফার্মেসি। এইমাত্র ফার্মেসি খোলা হয়েছে। বাচ্চা একটা ছেলে মেঝেতে পানি ছিটিয়ে ঝাঁট দিচ্ছে। বড় মামা কাউন্টারে বসে আছেন। তিনি বললেন, পত্রিকা এখনো আসে নাই?

কাজের ছেলেটা বলল, আসলে তো আমাদের সামনেই থাকত। পত্রিকা কি আমি বাড়ি নিয়া যাই?

বড় মামা বললেন, একটা সহজ প্রশ্ন করেছি, সহজ উত্তর দিবি। সব সময় চ্যাটাং চ্যাটাং। যা, তোর চাকরি নট।

কাজের ছেলে বলল, নট হইলে নট। সে ঘর ঝাট দেওয়া শেষ করে বলল, চা আনব?

আন।

দুধ-চা, না রং-চা?

বড় মামা বিরক্ত গলায় বললেন, আমি যে রং-চা খাই তুই জানিস। প্রতিদিন রং-চা এনে দিস। কেন জিজ্ঞেস করলি, রং-চা, না দুধ-চা?

প্রতিদিন রং-চা খাইলেও আইজ দুধ-চা খাওনের ইচ্ছা হইতে পারে, এই জন্য জিগাইছি।

তোর চাকরি নট, বেতন নিয়ে চলে যা।

আপনের চা-টা দিয়া তারপর যাই।

কাজের ছেলে ঘর থেকে বের হওয়ার পরপরই টেলিফোন বাজা শুরু করল। আমি বুঝতে পারছি, কাদের টেলিফোন করেছে। সে আমার মৃত্যুসংবাদ দিতে শুরু করেছে। এটা তার প্রথম টেলিফোন। জীবিত মানুষের কোনো টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা নেই, মৃতদের আছে। সবার আছে কি না জানি না, অন্তত আমার আছে। আমি বড় মামা ও কাদেরের টেলিফোনের কথাবার্তায় মন দিলাম। হতভম্ব বড় মামা বললেন, কখন মারা গেছে?

শেষ রাতে।

ডেডবড়ি কি হাসপাতালে?

জ্বে না। দেশের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে।

কখন রওনা হয়েছে?

সকাল সাতটায়।

আমি কিছুই জানলাম না, ডেডবডি দেশের বাড়িতে রওনা হয়ে গেছে?

রুবিনা কোথায়?

উনি রেস্টে আছেন।

রেস্টে আছেন মানে কী?

শোবারঘরে দরজা বন্ধ করে আছেন।

রুবিনাকে টেলিফোন দাও।

ক্যামনে দিব? দরজা বন্ধ।

 দরজা ভাঙ। কুড়াল দিয়ে দরজা কেটে ফেল।

কী বলছেন?

হারামজাদা ঠসা, কানে শুনস না? কুড়াল দিয়ে দরজা কাট।

এই বলেই তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুকে হাত দিয়ে কাউন্টারের পেছনে পড়ে গেলেন। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে নিশ্চয়ই। অস্পষ্ট গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থা। আমি শুধু দেখছি, সাহায্য করতে পারছি না। আমি অবজার্ভার।

কোয়ান্টাম ফিজিকসের ক্লাসে ছাত্রদের অবজার্ভার কী, তা অনেকবার পড়িয়েছি। অবজার্ভার হচ্ছে এমন একজন, যার উপস্থিতি ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটবে না। কিংবা ঘটনা ঘটবে কি না, তা অবজার্ভারের ওপর নির্ভর করবে। মনে করো, আকাশে পূর্ণচন্দ্র। চন্দ্রের পাশেই বড় এক খণ্ড মেঘ। কোয়ান্টাম মেকানিকস বলছে, আকাশের চাঁদ একই সঙ্গে মেঘে ঢাকা এবং মেঘমুক্ত। একজন অবজার্ভার যখন চাঁদের দিকে তাকাবে, তখনই শুধু নির্ধারিত হবে চাঁদ মেঘমুক্ত, না মেঘে ঢাকা।

প্রথম দিন যখন এই বক্তৃতা করি, তখন এক ছাত্রী ভয়ে ভয়ে বলল, স্যার, পুরো ব্যাপারটা ভুয়া বলে মনে হচ্ছে। আমি বললাম, কোয়ান্টাম ফিজিকস হচ্ছে সম্ভাবনার জগৎ। সেখানে এই পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সিরও ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই, তা নয়।

আমি এখন কোয়ান্টাম মেকানিকসের অবজার্ভার। আশপাশের সব কর্মকাণ্ড সে শুধু দেখবে। কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবে না। বড় মামা মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে আছেন। পড়ার সময় কাঠের চেয়ারে বাড়ি খেয়ে তার থুতনি কেটে গেছে। সেখান থেকে রক্ত পড়ছে। এতক্ষণ গোঁ গোঁ শব্দ করছিলেন, এখন সেই শব্দও নেই। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কে নেবে? আমি কোয়ান্টাম মেকানিকসের অবজার্ভার। আমার কাজ শুধু দেখা।

কাজের ছেলেটা ফিরেছে। তার হাতে চায়ের কাপ। বগলে খবরের কাগজ। এই খবরের কাগজ সে কিনে এনেছে। ছেলেটা বড় মামার স্বভাব খুব ভালোমতো জানে। বড় মামা চায়ের কাপে চুমুক না দিয়ে খবরের কাগজ পড়তে পারেন না।

কাউন্টারে চায়ের কাপ ও খবরের কাগজ রেখে সে বলল, গেল কই! বলেই সে ঝাঁটা নিয়ে ফার্মেসির পেছনে চলে গেল। সেখানে ছোট একটা ঘর আছে। মাঝে মাঝে এই ঘরে শুয়ে মামা বিশ্রাম নেন, কাজের ছেলেটা তখন মামার পা টিপে দেয়।

ফার্মেসির পেছনে ঘর ঝাঁট দেওয়া হচ্ছে, তার শব্দ পাচ্ছি। যে ঝাঁট দিচ্ছে, সে এখনো আমার চোখের আড়ালে। চোখের আড়াল’ কথাটা ঠিক হলো না। চোখ নেই, তখন আবার চোখের আড়াল কী?

পুরোনো স্মৃতি কীভাবে কীভাবে যেন থেকে যায়। আমরা এখনো বলি, বাটা দপ করে ফিউজ হয়ে গেল। অতি প্রাচীনকালে প্রদীপ জ্বলত। প্রদীপ নেভার সময় দপ করে শব্দ হতো। সেই ‘দপ’ শব্দ এখনো আমাদের স্মৃতিতে আছে। আমরা বলছি, বাল্বটা দপ করে নিভে গেছে।

জীবিত মানুষের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে মস্তিষ্কে। একজন মৃতের স্মৃতি কীভাবে সংরক্ষিত হয়? আমার স্মৃতি এখন কোথায় জমা?

কাজের ছেলেটা ঘর ঝাঁট দিয়ে ফিরে এসেছে। সে আবারও বলল, মানুষটা গেল কই? চা ঠান্ডা হইতেছে।

ফার্মেসির পত্রিকা নিয়ে লোক এসেছে। সে বাইরে থেকে পত্রিকা ছুঁড়ে ফেলতেই কাজের ছেলেটি বলল, এত বেলা কইরা কাগজ দিলে আমরার পুষে না। স্যারের সক্কালবেলা কাগজ লাগে। আইজ থাইকা কাগজ বন। নগদ পয়সায় কাগজ খরিদ করব।

মামার কাজের ছেলেটা কাগজ ভাঁজ করে কাউন্টারে রাখতে গেছে, একটু উকি দিলেই সে তার স্যারকে দেখতে পাবে। মনে হচ্ছে, সে উকি দেবে। মামা কি মারা গেছেন? কোয়ান্টাম সূত্রে মামা এখন শ্ৰয়ডিংগারের বিড়াল। একই সঙ্গে জীবিত এবং মৃত। কাজের ছেলে উঁকি দেওয়ামাত্র বিষয়টির মীমাংসা হবে। মামা কোনো একটি রিয়েলিটি গ্রহণ করবেন। হয় মৃত রিয়েলিটি অথবা জীবিত রিয়েলিটি।

কাজের ছেলেটা পত্রিকা ভাঁজ করে রেখে চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল। মনে হয়, চায়ের দোকানে কাপ ফেরত দিতে গেছে।

আচ্ছা, আমি কি আপনা-আপনি মামার শেফা ফার্মেসিতে চলে এসেছি, নাকি কেউ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে? আমাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। সেই ‘কেউটা কে? আ ডিভাইন অবজার্ভার—পবিত্র দর্শক; যিনি সবকিছুই দেখেন। মর্গের জানালায় বসে থাকা মাছি দেখেন, শবদেহের নাড়িভুড়ি কাটা দেখেন, আবার শেফা ফার্মেসির মালিকের কুঁকড়ি-মুকড়ি হয়ে পড়ে থাকা দেখেন। শুধু যে দেখেন তা না, অন্যকেও দেখান। আমি এই দৃশ্যটি দেখতে চাইছি না, কিন্তু আমাকে দেখতে হচ্ছে।

ক্লাসের এক বক্তৃতায় বলেছিলাম, একজন মানুষের পক্ষে একই সঙ্গে দুই জায়গায় থাকা সম্ভব নয়, কিন্তু ইলেকট্রন যে থাকতে পারে তা অঙ্কের মাধ্যমে তোমাদের বোঝানো হয়েছে। তোমার শরীরের একটি ইলেকট্রন চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহে পাওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু আছে। ছাত্রদের একজন শব্দ করে হেসেই নিজেকে সামলে নিয়ে সিরিয়াস হয়ে গেল। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আধুনিক পদার্থবিদ্যা দ্রুত ব্ল্যাক ম্যাজিকের দিকে যাচ্ছে। এখন প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের কথা বলা হচ্ছে, মাল্টিভার্সের কথা বলা হচ্ছে। তোমার নাম কী?

সে ভীত গলায় বলল, সুমন।

আমি বললাম, সুমন! ঠিক তোমার মতো একজন, তার নামও সুমন, সে এই মুহূর্তে অন্য একটি জগতে আমার মতো দেখতে একজনের দিকে তাকিয়ে আছে। একটাই শুধু প্রভেদ—তুমি এখানে চশমা পরেছ, সেখানে হয়তো তোমার চোখে চশমা নেই। দুইটা রিয়েলিটি—একটায় তোমার চোখ ভালো, অন্যটায় চোখ খারাপ। তোমার অসীম সংখ্যার রিয়েলিটি নিয়ে অসীমসংখ্যক জগৎ বহমান। বিশ্বাস হচ্ছে?

বুঝতে পারছি না, স্যার। মাথা ঘুরাচ্ছে।

আমি কতক্ষণ স্মৃতির ভেতর ঢুকে ছিলাম জানি না। হঠাৎ স্মৃতি থেকে বের হলাম, এখন আর আমি বড় মামার শেফা ফার্মেসিতে নেই। আমাদের গ্রামের বাড়ি কলমাকান্দায়। দূরে কোথাও মাইকিং হচ্ছে। অস্পষ্টভাবে মাইকিংয়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি :

একটি বিশেষ ঘোষণা—কলমাকান্দার কৃতী সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেচর’ ইফতেখার ইসলাম সাহেব ইন্তেকাল ফরমায়েচেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। অদ্য বাদ জোহর তার নামাজে জানাজা ঈদগাঁ মাঠে অনুষ্ঠিত হইবে। আপনারা দলে দলে যোগদান করুন।

একটি বিশেষ ঘোষণা-কলমাকান্দার কৃতী সন্তান…

.

মায়ের কবরের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে। জুম্মঘরের মুয়াজ্জিন কবর খোঁড়া তদারক করছেন। ইনার গলার স্বর মিষ্টি। তিনি হাত নেড়ে নেড়ে কবর খোঁড়া বিষয়ে কথা বলছেন। গোরখোক অবাক হয়ে তার কথা শুনছে। মুয়াজ্জিন বলছেন, কবর দুই প্রকারের হয়। সিন্দুক কবর আর বোগদাদি কবর। তোমরা শুধু পারো সিন্দুক কবর। আফসোস! শোননা, কবরের গভীরতা এমন হবে, যেন মুর্দাকে যখন জিন্দা করা হবে, সে যেন বসতে পারে। মানকের নেকেরের প্রশ্নের জবাব তাকে বসে দিতে হবে, এটাই বিধান। মানকের নেকেরের প্রথম প্রশ্ন কি তুমি জানো?

জে না, হুজুর।

প্রথম প্রশ্ন বড়ই অদ্ভুত। প্রথম প্রশ্ন, ‘তুমি পুরুষ, না নারী?’

বলেন কী! আমি শুনছি, ‘তোমার ধর্ম কী?’ ‘তোমার নবী কে?’

এই সব প্রশ্নও করা হবে। তবে প্রথম প্রশ্ন তুমি পুরুষ, না নারী’। এই প্রশ্ন করার অর্থ কী জানো।

জে, না।

এই প্রশ্ন থেকে বোঝা যায়, মানকের নেকের মৃত ব্যক্তির বিষয়ে কিছুই জানে না।

আচানক হইলাম।

আচানক হওয়ার কিছুই নাই। সব সময় খেয়াল রাখবা, তুমি পুরুষ। মানকের প্রশ্ন করল, তুমি পুরুষ, না নারী। মানকের নেকেরের চেহারাসুরত দেখে তোমার কইলজা গেল শুকায়ে। তুমি ভুলবশত বলো, আমি নারী। তাহলেই ধরা খাইছ। শুরু হইব থানার মাইর।

থানার মাইর কী?

আসামি ধইরা নিয়া পুলিশ থানাত যে মাইর দেয়, তার নাম থানার মাইর।

এই মুয়াজ্জিন সাহেব বড় মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বড় মামা আমাদের বাড়িতে থাকতেন। বাবা তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। মুয়াজ্জিনের সঙ্গে বড় মামার মাদ্রাসায় পরিচয়। কথায় কথায় বড় মামা তাকে বলেন বুরবাক। মুয়াজ্জিন (তার নাম মুনসি রইস) সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তুমিও বুরবাক। বুরবাক, বুরবাক, বুরবাক।

বড় মামার খবরটা আমি তার বন্ধুকে বলতে পারছি না। জীবিত মানুষের এই ক্ষমতা আছে। মৃতের নেই।

একসঙ্গে অনেকগুলো পাখি ডাকছে। বড় মামা কি মারা গেছেন? বড় মামার মৃত্যুতে প্রচুর পাখি ডাকার কথা। মামা হলেন পক্ষীবন্ধু। তার একটাই নেশা, বনে-জঙ্গলে ফলের গাছ লাগানো। পাখিদের খাওয়ার জন্য ফল। প্রতিবছর বৈশাখ মাসে মিনি ট্রাকভর্তি ফলগাছের চারা নিয়ে তিনি বনে ঢোকেন।

গাজীপুরের শাল বনে তার লাগানো লিচুগাছের পাকা লিচু দেখতে একবার আমি তার সঙ্গে বনে ঢুকেছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মামা লিচুগাছ বের করতে পারেননি।

বনে-জঙ্গলে ফলের গাছ লাগানো নিয়েও মুনসি রইসের সঙ্গে মামার ঝগড়া। মুনসি রইস বলতেন, ফলের গাছ তুমি লাগাও মানুষের জন্য লাগাব। পশুপাখির খাদ্যের ব্যবস্থা আল্লাহপাক করেন। পিপড়ার কোনো খাদ্যের অভাব হয় না। মানুষের হয়। মানুষকে তিনি জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। বলে মানুষকে নিজের খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়।

মামা বিরক্ত হয়ে বলতেন, সব ফল মানুষ খেয়ে ফেললে পাখিরা কী খাবে? বুরবাক।

তুমিও বুরবাক। পশুবন্ধু সাজছে।

চুপ।

তুমি চুপ।

মাইকের ঘোষণা শুনে থালা হাতে ফকির-মিসকিন আসতে শুরু করেছে। তাদের চোখেমুখে আনন্দ। দুটা গরু জবেহ করা হবে। লাশ দাফনের পর ফকির-মিসকিন খাওয়ানো হবে।

ফকির-মিসকিনদের জন্য একটা গরু, দ্রদের জন্য আরেকটা গরু। যারা গরু খান না তাদের জন্য খাসির মাংস।

আমার মৃত্যুর কারণে যে তিনটি অবোধ প্রাণী মারা যাচ্ছে, তাদের দেখলাম। দুটা গরুই মহানন্দে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। ছাগলটা কিছু খাচ্ছে না। মৃত্যুর পর এই প্রাণীদের কি আলাদা কোনো জগৎ আছে? তাদের কি আত্মা আছে?

আমার ইচ্ছে করছে গ্রামের বাড়িতে যেতে। অনেক দিন এই বাড়ি দেখি না। বাড়ির পেছনের সবুজ শ্যাওলা ঢাকা পুকুরটা অদ্ভুত। এই পুকুরে প্রকাণ্ড দুটা গজার মাছ আছে। মাঝেমধ্যে গজার মাছ ধরার চেষ্টা চালানো হয়। কখনো ধরা যায় না। অনেকের ধারণা, এই দুটা মাছ না, জিন। মাছের রূপ ধরে পুকুরে বাস করে।

এই পুকুরের আরও রহস্য আছে। হঠাৎ হঠাৎ পুকুর ভর্তি হয়ে যায় পদ্মফুলে। তখন বুঝতে হবে, আমাদের বাড়ির কারও মৃত্যু হবে। ছোট চাচা যখন মারা গেলেন, তখন পদ্মফুলে পুকুর ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। আমার বড় ভাই যখন জামগাছের ডালে দড়ি ঝুলিয়ে ফাঁস নিলেন, তখনো পুকুর ভর্তি ছিল পদ্মফুলে। দাদাজান তখন বেঁচে, তিনি হুকুম দিলেন, সব পদ্ম শিকড় ছিঁড়ে তুলে আন। একটা পদ্মও যেন না থাকে। আমার মৃত্যুতে কি আবার পদ্মফুলে পুকুর ভর্তি হয়েছে? একবার যদি দেখতে পারতাম! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

ইচ্ছে করলেও বাড়িতে যেতে পারছি না। মৃতের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। অন্যের ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। সেই অন্যটা কে?

.

আমার ডেডবডি আসছে না, এই খবর মনে হয় পৌঁছে গেছে। গোরখোদক এবং মুয়াজ্জেন চলে গেছেন। অনেকেই চলে যাচ্ছে, শুধু ফকির মিসকিনদের দল যাচ্ছে না। তারা হতাশ, কী করবে বুঝতে পারছে না। এদের লিডারশ্রেণীর একজন ক্ষুব্ধ গলায় বলছে, খবর দিয়া আইন্যা কি ফাইজলামি?

লিডারের কথায় সবাইকে সায় দিতে হয়। বাকি ফকির-মিসকিনরা তা-ই করছে। সায় দিচ্ছে। লিডার বলল, আইজ খানা দিবে না মানলাম, কবে দিবে সেটা তো বলা লাগবে।

লিডারের পাশের জন বলল, অবশ্যই অবশ্যই। প্রয়োজনে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর হবে। এমন বদদোয়া দিব গুষ্টিমুদ্দা মইরা সাফ হয়ে যাবে।

মহিলা ফকির বলল, ন্যায্য কথা বলেছেন। অতি ন্যায্য।

লিডার বলল, ন্যায্য কি বলেন? এই কথা ন্যায্যের ওপরে দিয়া যায়। কোনো খোঁজখবর না দিয়া আয়োজন যারা করছে তারারে মাইর দেওয়া দরকার।

সমবেত আওয়াজ, অবশ্যই। অবশ্যই।

আয়োজক কারা বোঝা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বেশ কিছু গাড়ি ঢাকা থেকে চলে এসেছে। একটা মাইক্রোবাস ভর্তি করে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কলিগ চলে এসেছে। দীর্ঘ পথভ্রমণে তারা ক্লান্ত। ফকির-মিসকিনদের মতোই ক্ষুধার্ত। তারাও ফুডের কী ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। তাদেরকেও কিছুটা ক্ষিপ্ত মনে হচ্ছে। ক্ষুধা সব মানুষকে এক কাতারে ফেলে। মৃত্যুর পরের জগতে ক্ষুধা নেই। সেখানে এই কারণেই হয়তো সবাইকে এক কাতারে ফেলা যাবে না।

বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমাদের অঞ্চলের বিখ্যাত ঝুম বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যেই খোঁড়া কবরে পানি জমে গেল। বেশ কিছু ব্যাঙ পানিতে ঝাঁপাঝাপি করে আনন্দ প্রকাশ করছে। অপ্রত্যাশিতভাবেই তাদের জন্য পানির ব্যবস্থা হয়েছে, তাদের আনন্দিত হওয়ারই কথা।

শহরের ঝুম বৃষ্টি আর গ্রামের ঝুম বৃষ্টি আলাদা। শহরে ঝুম বৃষ্টি মানেই দুর্ভোগ। রাস্তায় একহাঁটু পানি। তীব্র যানজট, দূষিত বিষাক্ত পানিতে পা ডুবিয়ে পথচারীর বাড়ি ফেরা। গ্রামের ঝুম বৃষ্টি মানে বিশুদ্ধ আনন্দ।

অনেক দিন আগে বাড়ির পুকুরঘাটে বসে আছি, শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। দীঘির পানিতে বৃষ্টি পড়ছে, বুদ্বুদ উঠছে—দেখে মনে হচ্ছে পুকুরটা আনন্দে খলখল করে হাসছে। বাতাসে গাছের ডালপালা দুলছে, মনে হচ্ছে বৃষ্টির আনন্দে তারা নাচতে শুরু করেছে।

বৃষ্টি শুরু হয়েছিল বিকেলে। আমি ঠিক করলাম, বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত ঘাটে বসে থাকব। বৃষ্টি থামল এশার আজানের পর। তখন এক অদ্ভুত দৃশ্যের সূচনা হলো—হাজার হাজার জোনাক পোকা বের হয়ে এল। তারা সবাই একত্র হয়ে একটা বলের মতো বানাচ্ছে, আবার মুহূর্তের মধ্যে বল ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার বল তৈরি করছে। একসময় তারা আমার চারদিকে ঘুরতে লাগল, সেই ঘুরাও বিচিত্র। কিছুক্ষণ ক্লকওয়াইজ, আবার কিছুক্ষণ অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ। আমার মনে হলো, এই জোনাকিরা আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে, বলতে পারছে না। নিম্নশ্রেণীর কীটপতঙ্গের সঙ্গে আমাদের মানসিক যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা প্রকৃতি রাখেনি।

খ্রিষ্টান ধর্মযাজক লেমেট্রি একবার প্রার্থনা শেষ করে তার লেখার টেবিলে বসে ছিলেন। বেচারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কারণ, সেদিন সন্ধ্যায় তিনি মহান পদার্থবিদ আইনস্টাইনের ধমক খেয়েছেন। ১৯২৭ সালের কথা। ব্রাসেলসের সলভে কনফারেন্সে এই ধর্মযাজক আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির ওপর একটি রচনা পাঠ করেন। যেহেতু আইনস্টাইন স্বয়ং সেই সভায় উপস্থিত, লেমেট্রির আগ্রহের সীমা ছিল না।

লেমেট্রি তাঁর রচনায় দেখান যে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির সমাধান দাবি করে মহাবিশ্ব প্ৰসরণশীল। সর্বদিকে তা ছড়িয়ে পড়বে। আইনস্টাইন ধমক দিয়ে বলেন, অঙ্ক দিয়ে সবকিছু বিচার করবে না। অন্ধের মতো অঙ্ক অনুসরণ করলে যে পদার্থবিদ্যা তোমরা বের করবে, তা হলো ঘেন্নাকর (অববামিনে ফিজিক্স)।

লেমেট্রি তার ডায়েরিতে লিখলেন, আমি মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত অবস্থায় লেখার টেবিলে বসে ছিলাম। তখন একটা মশা এসে আমার কানের কাছে গুনগুন করতে লাগল। তার কাজ আমাকে বিরক্ত করা, কিন্তু আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, সে আমাকে সান্ত্বনার কথা বলছে। আমি কথাগুলো বুঝতে পারছি না। সে শুধু যে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তা না, আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিল।

তার দুবছর পরই অ্যাস্ট্রোনোমার হাবল সাহেব মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুরবিন দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঘোষণা করেন, সব গ্যালাক্সির মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল।

আইনস্টাইন লজ্জিত হয়ে লেমেট্রিকে চিঠি লিখে জানালেন—তোমার থিওরি বিস্ময়করভাবেই সুন্দর। আমার অভিনন্দন।

জীবিত মানুষের জীবনের একটি অংশ কাটে সুন্দরের অনুসন্ধানে। কেউ জোনাক পোকার ঝাঁকের সৌন্দর্য খোঁজে, আবার লেমেট্রির মতো মানুষেরা বিগ ব্যাং থিওরির ভেতর সুন্দর খোঁজে।

পরকালের মানুষেরা নিশ্চয়ই সৌন্দর্য খুঁজবে। কী সৌন্দর্য খুঁজবে?

আমি আমার শবদেহের জন্য খোঁড়া কবর দেখছি, বৃষ্টি দেখছি, দূরের মাইকিংয়ের শব্দ শুনছি। এদের মনে হয় কেউ খবর দেয়নি, ডেডবড়ি আসছে না।

একটি বিশেষ ঘোষণা-কলমাকান্দার কৃতী সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেচর’ ইফতেখার ইসলাম সাহেবের জানাজা…

দিনের আলো দ্রুত নিভে যাচ্ছে। আজও কি রাতে বৃষ্টি থামবে এবং ওই বিশেষ দিনটার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি বের হবে? মনে হচ্ছে তা-ই হবে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ