খিলখিল করে কে যেন হাসছে।

জাহানারা একতলা থেকে দোতলায় উঠছিলেন— তিনি থমকে দাঁড়ালেন। হাসির শব্দ শুভ্ৰর ঘর থেকে আসছে। শুভ্ৰর ঘরের দরজা বন্ধ। বন্ধ দরজার ওপাশে তরুণী কোনো মেয়ে হেসে ভেঙ্গে পড়ছে। এর মানে কী? জাহানারার হাত পা, ঠাণ্ডা হয়ে এল। এখনো তিনি দোতলায় পুরোপুরি উঠেন নি। চারটা ধাপ বাকি আছে। মনে হচ্ছে এই চারটা ধাপ আর উঠতে পারবেন না। শেষধাপে পা দেবার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। তিনি বুকে একটা চাপ ব্যথা অনুভব করলেন।

বিনু মেয়েটা কি গিয়েছে শুভ্রর ঘরে! রাত একটার সময় এই মেয়ে তার ছেলের ঘরে কেন থাকবে? আর মেয়ের এত সাহস সে খিলখিল করে হাসবে?

জাহানারা শুভ্রর বন্ধ দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। হয়ত দরজা বন্ধ না, হয়ত দরজা ভেজানো। জাহানারা দরজার গায়ে হাত রাখলেন। দরজার পাল্লা খানিকটা ভেতরের দিকে সৱে গেল। এইত শুভ্ৰকে দেখা যাচ্ছে। চেয়ারে বসে আছে। পা তুলে দিয়েছে বিছানায়। তার হাতে বই। টেবিল ল্যাম্পের আলো এসে পড়েছে তার গায়ে। শুভ্ৰ পরেছে সাদার উপর ফুলতোলা শার্টটা। এই শার্টটা তাকে খুব মানায়। শার্টটায় ইস্ত্রি নেই। তাঁর লক্ষ করা উচিত ছিল।

ঘরে কোনো মেয়ে নেই। ঘরে আর কেউ থাকলে শুভ্ৰ নিশ্চয়ই এত মন দিয়ে বই পড়ত না। জাহানারা নিশ্চয়ই ভুল শুনেছেন। হয়ত বিনু মেয়েটা তার ঘরে হাসছে। বাতাসে সেই হাসি এমনভাবে ভেসে এসেছে যে মনে হয়েছে হারামজাদি মেয়ে শুভ্রর ঘরে। জাহানারা দরজাটা আরেকটু ফাঁক করলেন। দরজায় ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হল— শুত্র দরজার দিকে তাকল না।

শুভ্ৰ!

শুভ্র বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, ভেতরে এসো মা।

তুই এখনো ঘুমুস নি?

উঁহু।

জাহানারা ঘরে ঢুকলেন। ফাঁকা ঘর। তিনি লজ্জিত বোধ করলেন। ঘরতো ফাঁকাই থাকবে। তিনি কি ভেবেছিলেন কেউ একজন ঘরে বসে থাকবে? ছিঃ ছিঃ। শুভ্ৰ কি এমন ছেলে? সে তার নামের মতই শুভ্ৰ।

এত মন দিয়ে কী বই পড়ছিস?

প্রাচীন কথামালা।

সেটা আবার কী?

প্রবচন। উদাহারণ দিলে বুঝবে- একটা আরবি প্রবচন হল, If you meet a blind man, kick him. Why should you be kinder than God?

বুঝতে পারলাম না।

মনে কর তুমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ। হঠাৎ একটা অন্ধ লোক দেখলে। তখন তোমার উচিত তাকে একটা লাথি মারা।

কেন?

কারণ আল্লাহর চেয়ে বেশি দয়ালু হবার তোমার দরকার কী?

এখনোতো কিছু বুঝলাম না।

থাক বুঝতে হবে না। এটা শুধু মনে রাখলেই চলবে— আমি যখন অন্ধ হয়ে যাব তখন আমাকে দেখলেই হয় লাথি দেবে নয়। চড় বসাবে।

এই সব কী ধরনের কথা? তুই অন্ধ হবি কোন দুঃখে। আর তোকে আমি খামাখা চড় লাথিই বা মারব কেন?

শুভ্ৰ মিটমিট করে হাসছে। মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়! জাহানারা ছেলের সামনে বসলেন। শুভ্ৰ সঙ্গে সঙ্গে পা নামিয়ে নিল। জাহানারা বললেন- আমি একতলা থেকে দোতলায় উঠছি হঠাৎ মনে হল তোর ঘর থেকে হাসির শব্দ আসছে। মনে হল একটা মেয়ে যেন খিলখিল করে হসছে।

তোমার বুকে একটা ধাক্কার মত লাগল। তাই না মা?

ধাক্কার মত লাগবে কেন?

রাত একটিার সময় তোমার ছেলের ঘর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে, তোমারতো মা হার্ট এ্যাটাক হবার কথা।

আমার সম্পর্কে তোর ধারণাটা কী বলতে শুভ্ৰ?

তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা হচ্ছে তুমি খুবই সন্দেহপ্রবণ একজন মহিলা। তবে সরল টাইপ। তোমার মনে যদি কোনো সন্দেহ হয়। সেই সন্দেহ লুকিয়ে রাখার কায়দা কানুনও তোমার জানা নেই! তুমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী মনে কর। তুমি কিন্তু তা না। বোকা টাইপ মাদার।

জাহানারা চুপ করে রইলেন। তাঁর খুবই অবাক লাগছে। ছেলে কত অবলীলায় তার মা সম্পর্কে কঠিন কঠিন কথা বলছে। শুভ্ৰ কি বদলে যাচ্ছে? বদলে যাবার পেছনে বিনু মেয়েটার হাত নেই তো? একজন খারাপ মানুষ অতি দ্রুত একজন ভালমানুষকে খারাপ বানিয়ে ফেলতে পারে।

মা তুমি রাগ করেছ?

না।

আমার ঘর থেকে যে হাসির শব্দ শুনলে সেই হাসি কেমন ছিল? মিষ্টি ছিল?

জানি না।

আরেকবায় শুনে দেখতো মা। মন দিয়ে শুনে আমাকে বলবে হাসিটা কেমন। রেডি, গেট সেট, ওয়ান-টু-থ্রি গো।

জাহানারা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন। শুভ্র তার পাশে রাখা ক্যাসেট প্লেয়ার কোলে তুলে নিল। বোতাম টেপা মাত্র খিলখিল হাসি শোনা গেল। শুভ্র বলল, ময়নাটাকে শেখানোর জন্যে হাসি রেকর্ড করে রেখেছি। ময়নার খাচার পাশে এই ক্যাসেট প্লেয়ার রেখে দেব। ময়না অসংখ্যবার এই হাসি শুনবে। তারপর একদিন দেখা যাবে সে হাসতে শিখে গেছে। হাসিটা কেমন মা?

ভাল।

তোমার মনে কোনো প্রশ্ন থাকলে করে ফেল।

কী প্রশ্ন?

অনেকগুলি প্রশ্নইতো তোমার মনে এসেছে। যেমন- রেকর্ড করা হাসিটা কোন মেয়ের? তার পরিচয় কী? বয়স কত? মেয়েটার বাবা কী করেন? বাড়ির অবস্থা কী? ইত্যাদি ইত্যাদি।

জাহানারা দুঃখিত গলায় বললেন, তুই আমাকে দেখতে পারিস না তাই না?

দেখতে পারব না কেন? আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম।

জাহানারা নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবার শরীরটা আজ আবার খারাপ করছে।

শুভ্র বলল, ও।

ভাত খায় নি, শুয়ে পড়েছে।

উপোস অসুখের জন্যে ভাল মা। উপোসী মানুষের অসুখবিসুখ খুব কম হয়।

কে বলেছে?

কেউ বলে নি। আমি ভেবে ভেবে বের করেছি। মুনী ঋষিদের অসুখ বিসুখ হয় না। কারণ তারা বেশির ভাগ সময়ই উপোস থাকেন। খেলেও একবেলা খান। আবার ভিক্ষুকরাও তেমন খেতে পায় না বলে ওদের অসুখ বিসুখ হয় না।

ভিক্ষুকদের অসুখ বিসুখ হয় না, তোকে কে বলল?

আমার মনে হয়। আমার ধারণা সব ভিক্ষুক শরীরের দিক দিয়ে খুব ফিট। সারাদিন হাঁটাহাটি করেতো ভাল একসারসাইজ হয়।

ভিক্ষুকদের ব্যাপারে তুই মনে হয়। অনেক কিছু জেনে ফেলেছিস।

শুভ্ৰ মার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, মা বলতো দেখি আমরা সবচে বেশি ক্ষমা চাই কাদের কাছে।

জাহানারা ভুরু কুঁচকে বললেন, ক্ষমা চাইব কেন। ক্ষমা চাইবার মত অপরাধ কী করলাম?

অপরাধ না করেও ক্ষমা চাও। বলা দেখি কার কাছে।

আল্লাহর কাছে?

হয় নি ভিক্ষুকদের কাছে – দিনের মধ্যে অনেকবার তোমাকে বলতে হয়— মাফ কর। ভিক্ষা নাই। তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর ভিক্ষুকদের কাছে তাই না?

জাহানারা চুপ করে আছেন। শুভ্ৰ হাসছে। সে ক্যাসেট প্লেয়ার আবার চালু করেছে। ক্যাসেটের মেয়েটাও হাসছে।

জাহানারার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। পানি কেন আসছে কে জানে? চোখে পানি আসার মত কোনো ঘটনাতো ঘটেনি। তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের এক কোণায় কালো পর্দায় ঢাকা ময়নার খাঁচা। লোকজনের কথাবার্তায় বেচারার ঘুম ভেঙে গেল। সে কয়েকবার ডানা ঝাণ্টাল। তারপর পরিষ্কার গলায় বলল,

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

শুভ্ৰ ভাত খাইছ?

মোতাহার সাহেব এতক্ষণ কাত হয় ছিলেন, এখন চিৎ হলেন। এই সামান্য কাজটা করতে গিয়ে তাঁর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কপালে ঘাম জমল। এর মানে কী? তিনি কি মারা যাচ্ছেন? দরজার বাইরে কি আজরাইল এসে দাঁড়িয়েছে? আজরাইলের চেহারা দেখতে কেমন? সবার ধারণা তার চেহারা হবে কুৎসতি। কিন্তু তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে আজরাইল হবে সুপুরুষ যুবা। আজরাইল হচ্ছে ফেরেশতা। তাঁকে আল্লাহ কেন কুৎসিত করে বানাবেন?

কোমরের কাছে ব্যথার মত হচ্ছিল। সুচ ফুটানোর মত ব্যথা। ব্যথাটা দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। হাত-পা অসাড় হয় গেল। যেন কয়েকজন মিলে একটা শীতল ভারী পাথর পায়ের উপর দিয়ে দিয়েছে। এই পাথর নাড়ানোর সাধ্য তার নেই। মৃত্যু কি এ রকম? শরীরে পাথর বসানো দিয়ে এর শুরু? প্রচণ্ড ভারী একটা পাথর পায়ের উপর নিয়েই তিনি কাত অবস্থা থেকে চিৎ হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় পাথরটা গড়িয়ে পড়ে যাবার কথা। তা পড়ে নি। বরং পাথরটা আরো ভালমত বসেছে। তাঁর মন বলছে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটা ভারী পাথর তাঁর বুকের উপর দিয়ে দেয়া হবে। তিনি বুক ভর্তি করে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করবেন। বুকের উপর ভারী পাথরের কারণে তা পারবেন না। তিনি যতই নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করবেন পাথর ততই চেপে বসবে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাঁর মৃত্যু হবার কথা না। ভাই পাগলা পীর তাকে স্পষ্ট করে বলেছে— তোর মৃত্যু একসিডেনে। একসিডেন মানে এক্সিডেন্ট। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী রকম এক্সিডেন্ট? রোড এক্সিডেন্ট না অন্য কিছু? ভাই পাগলা পীর মিচিকি মিচিকি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, অন্য কিছু। অনেক রক্ত বাইর হইব বুঝছস। রুক্তের মইধ্যে তুই সিনান করবি। মোতাহার সাহেব চিন্তিত এবং ভীত গলায় বলেছিলেন, হুজ্বর আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন। ভাই পাগলা পীর পিচ করে একদলী থুথু ফেলে বললেন, দূর ব্যাটা আমি দেয়া করি না। আর দোয়া কইরা কোনো ফয়দা নাই। আল্লাহপাক তাঁর চিকন কলম দিয়া তোর কপালে যা লেখছেন। তাই হইব। তোর কপালে যদি লেখা থাকে মিত্যুর আগে গরম রক্ত দিয়া সিনান, তাইলে তাই হইব। দোয়া না করলেও হইব। করলেও হইব। খামাখা সময় নষ্ট কইরা ফয়দা কী?

ভাই পাগলা পীর সাহেবের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। তিনি মারা যাচ্ছেন। কাজেই তিনি পীর সাহেবকে গিয়ে বলতে পারবেন না— হুজ্বর আপনের কথা সত্য হয় নাই। আমার মৃত্যু হয়েছে বিছানায়। সবাই বলে ভাই পাগলা পীর সাহেবের কথা কখনো মিথ্যা হয় না। এইবার কেন হচ্ছে?

তাঁর পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। তিনি এই তৃষ্ণাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছেন। মৃত্যুর আগে আগে তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার মত হয়, কিন্তু তখন পানি খাওয়া যায় না। পানির স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, পানি তিতা লাগে।

মোতাহার সাহেব তাঁর স্ত্রীকে ডাকার চেষ্টা করলেন। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। একজন ডাক্তার ডাকা দরকার। হাসপাতালে তাকে নেবার প্রয়োজন হতে পারে। ড্রাইভার কি আছে? এই ড্রাইভারের চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি। রাতে তার একতলায় কোণার ঘরষ্টীয় শুয়ে ঘুমানোর কথা। তিনি খবর পেয়েছেন প্রায়ই সে তা করে না। বাইরে রাত কাটিয়ে ফজরের নামাজের সময় উপস্থিত হয়। আজও হয়ত সে নেই।

হাসপাতালে তিনি যেতে চান না। তাঁদের পরিবারের একটা ধারা আছে। এই পরিবারের মানুষ যদি হাসপাতালে যায় তাহলে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসে না। মোতাহার সাহেবের বাবা ফিরেন নি। তাঁর বড় ভাই ফিরেন নি।

কাজেই হাসপাতালে যদি যেতেই হয় কিছু জরুরি কথা ফিসফিস করে হলেও বলে যেতে হবে। শুভ্ৰকে একটা কথা বলা দরকার। শুভ্ৰ যেন তার উপর রাগ না। করে। তাকে ঘৃণা না করে। সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পুত্র এবং কন্যার ঘৃণা সহ্য করা যায় না। যে ব্যক্তিকে তাহার পুত্র এবং কন্যা ঘৃণা করে দোজখের অগ্নিও তাহাকে ঘৃণা করে। কথাটা কে বলেছে? কার কাছ থেকে শুনেছেন? ভাই পাগলা পীর সাহেবের কাছ থেকে?

ভাই পাগলা পীর সাহেব মজার মজার কথা বলেন। দোজখের প্রসঙ্গে বলতেন— দূর ব্যাটা। দোজখের আগুন দোজখের আগুন। সব দোজখে আগুন আছে না-কি? আগুন নাই এমন দোজখও আছে। ঠাণ্ডী দোজখ। বড়ই ঠাণ্ডা। সেই দোজখের নাম জাহীম। বড়ই ভয়ংকর সেই ঠাণ্ডা দোজখ। জাহিম দোজখবাসী চিৎকার কইরা কী বলে জানস? বলে ওগো দয়াল আল্লা। দয়া করি আমারে কোনো আগুনের দোজখে নিয়া পুড়াও ।

মোতাহার সাহেবের দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে ভাই পাগলা পীর বলেছিলেন- দোজখের নামগুলি মুখস্ত করে রাখ, তুইতো সেইখানেই যাবি। হি-হি হি। আশ্চর্যের ব্যাপার সাতটা দোজখের নাম তাঁর ঠিকই জানা–জাহান্নাম, হাবিয়া, সাক্কার, হুতমাহ, সায়ীর, জাহীম, লাজা।

বেহেশতের নামগুলির মধ্যের শুধু দুটার নাম জানেন- জান্নাতুল ফেরদাউস এবং জান্নাতুল মাওয়া।

মোতাহার সাহেবের উপর আরেকটা ভারী পাথর চাপানো হয়েছে। এই পাথর আগেরটার মত না। এর ওজন বাড়ে কমে। যখন কমে তখন মনে হয়— ওজনহীন একটা পাথর বুকে নিয়ে থাকা কতই না আনন্দের।

মোতাহার সাহেব লক্ষ করলেন জাহানারা ঘরে ঢুকছেন। জাহানারা ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে কফির মগ। শোবার আগে তিনি মগ ভর্তি কফি খান। এই অভ্যাস আগে ছিল না। কোন পত্রিকায় পড়েছেন যাদের অনিদ্রা রোগ আছে, শোবার আগে কফি খেলে তাদের সুনিদ্রা হয়। জাহানারার অনিদ্রা রোগ আছে। মােতাহার সাহেবের মনে হল তাঁর মৃত্যুর পর জাহানারার অনিদ্রা রোগ সেরে যাবে। বিছানায় যাবার আগে তাকে গোসল করতে হবে না। তিনটা চারটা ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হবে না, মগ ভর্তি কফি খেতে হবে না।

কফির গন্ধ মোতাহার সাহেবের নাকে আসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার প্রবল কষ্টের মধ্যেও গন্ধটা ভাল লাগছে। ইশ এখন যদি সহজ স্বাভাবিক মানুষের মত এক মগ কফি হাতে নিয়ে একটা সিগারেট ধরানো যেত। ভাই পাগলা পীর সাহেবকে একদিন কে যেন জিজ্ঞেস করেছিল— হুজ্বর বেহেশতে কি সিগারেট আছে? পীর সাহেব বললেন, আছে। দশ ফুটি সিগারেট। এক এক শলা দশ ফুট লম্বা। তবে বেহেশতে আগুন নাইতো। এই কারণে সিগারেট ধরানো যাবে না। সিগারেট ধরানোর জন্যে যাওয়া লাগবে দোজখে। হিহিহি।

মোতাহার সাহেব গভীর বিস্ময় নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। কফির কাপ নিয়ে ঘরের ভেতর হাঁটছে জাহানারা। বুঝতেও পারছে না, কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। একবার সে যদি তাঁর দিকে তাকাতো তাহলেই বুঝতে পারতো। সে তাকাচ্ছে না। মোতাহার সাহেব স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত কিছু করতে পারছেন না। না, জাহানারার দোষ নেই। তিনি আছেন মশারির ভেতর। জাহানারা তাকে দেখতে পারছে না। অথচ তিনি জাহানারীকে দেখতে পারছেন। জাহানারার বিছানায় আসতে অনেক সময় লাগবে। সে তার কফি শেষ করবে, তারপর তার ভেজা চুল হেয়ার দ্রায়ারে শুকাবে! এই কাজটা সে করবে। অন্য ঘরে যাতে হেয়ার ড্রায়ারের শব্দে তাঁর ঘুম না ভাঙ্গে; এইতো জাহানারা চলে যাচ্ছে। মোতাহার সাহেব প্ৰাণপণে ডাকলেন- জাহানারা। জাহানারা। না গলায় স্বর নেই। মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না।

পায়ের কাছের মশারিটা কে যেন তুলছে। অপরিচিত একজন মানুষের মুখ। মোতাহার সাহেব আতংকে অস্থির হলেন। মশারির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে কে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে? মাথার কাছের মশারিটা এখন উঁচু হচ্ছে। আরেকজন কেউ মাথা বের করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এইতো আরেকটা মুখ দেখা যাচ্ছে। এই মুখটাও অচেনা। দুজনই তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাদের দৃষ্টিতে ভালবাসা নেই, মমতা নেই, করুণা নেই। পায়ের ডানপাশের মশারি উঁচু হচ্ছে— তৃতীয় একজনের মাথা দেখা যাচ্ছে। মোতাহার সাহেব চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। তাও পারলেন না।

আতংক এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন তার চারপাশের অসংখ্য মুখের দিকে। এদের সবাইকেই তিনি এক সঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন এটাও একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। হেয়ার ড্রায়ারের একঘেয়ে শব্দ তাঁর কানে আসছে। শব্দটা কী কুৎসিত! কী কুৎসিত! একটা মশা ঠিক তাঁর চোখের সামনে এসে উড়ছে। মশারও চোখ আছে। সেই চোখ টানা টানা- মনে হয় কাজল পরানো। মোতাহার সাহেব এই তথ্য আজ প্রথম জানলেন। মশােটা তার চোখের মণির ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়তে চেষ্টা করছে। মোতাহার সাহেব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে গভীর অতলে তলিয়ে গেলেন।

 

মোতাহার সাহেব মারা গেছেন। এই ব্যাপারটা ধরা পড়ল সকালে। জাহানারা না, কাজের মেয়ে চা নিয়ে ডাকতে এসে হতভম্ব গলায় বলল, খালুজানের কী হইছে?

জাহানারা বাথরুম থেকে বললেন, চায়ের কাপ পিরিচ দিয়ে ঢেকে রেখে চলে যা। চিৎকার করে ঘুম ভাঙবি না।

কাজের মেয়ে তখন হাত থেকে চায়ের কাপ ফেলে বিকট চিৎকার করল। জাহানারা ভেজা শরীরে বাথরুম থেকে বের হলেন। মোতাহার সাহেবের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। মানুষটা এখন মারা যায় নি। অনেক আগেই মারা গেছে। তিনি সারা রাত মৃত মানুষটাকে পাশে নিয়ে শুয়েছিলেন। রাতে জাহানারার ভাল ঘুম হয় না, কিন্তু কাল রাতে তাঁর সুনিদ্রা হয়ছে। শেষ রাতে বৃষ্টি নেমে ঘর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। তিনি পায়ের কাছে রাখা পাতলা চাঁদর গায়ে দিয়েছেন। শুধু নিজের গায়েই দেন নি। স্বামীর গায়েও তুলে দিয়েছেন। একজন মৃত মানুষের সঙ্গে একটা চাঁদরের নিচে রাত কাটিয়েছেন। কী ভয়ংকর কথা! জাহানারার শরীর যেন কী রকম করছে। পেটের কাছে পাক দিচ্ছে। তিনি ছুটে গিয়ে বেসিন ভর্তি করে বমি করলেন। কী ভয়ংকর বমি। মনে হচ্ছে পাকস্থলী উঠে আসছে। বিনু ছুটে এসে তাকে ধরেছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। ভয়ে তাঁর শরীর কাঁপছে। শুভ্ৰর বাবা মারা গেছেন তার জন্যে ভয় না। এক চাঁদরের নিচে একজন মৃত মানুষকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন সেই কারণে ভয়। ভয়টা কিছুতেই যাচ্ছে না।

খবরটা শুভ্ৰকে দিতে হবে। কীভাবে দেবেন। শুভ্ৰই বা খবর শুনে কী করবে? চিৎকার করে কেঁদে উঠবে? কেঁদে উঠবে তো অবশ্যই। কিন্তু তাঁর নিজের কান্না আসছে না কেন?

 

দরজার কাছে বিনু দাঁড়িয়ে আছে। সকালের নরম আলোয় সব কিছুই দেখতে সুন্দর লাগে। বিনুকেও দেখতে সুন্দর লাগছে; শুভ্রর মনে হল বিনু গোসল করেছে। মেয়েরা গোসল করলেই তাদের চেহারায় এক ধরনের স্নিগ্ধতা চলে আসে। শুভ্র স্বাভাবিক গলায় বলল, বিনু তুমি কি গোসল করেছ?

বিনু বলল, না।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র গোসল করলে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে এসে বোস।

বিনু ভেতরে ঢুকল না। বিনুর খুবই অবাক লাগছে— এই মানুষটা কিছুক্ষণ আগে তার বাবা মারা যাবার খবর শুনেছে। চিৎকার করে কাদছে না, হৈচৈ করছে না। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। কথা বলছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।

বিনু!

জ্বি।

চা খেতে ইচ্ছা করছে। চা খাওয়াতে পারবে?

বিনু কিছু বলল না। আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। শুভ্ৰ বলল, আচ্ছা বিনু আমার আচরণ কি তোমার কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগছে। বাবা মারা গেছেন এই খবর শোনার পরও চুপ করে বসে আছি। এখনও তাকে দেখতে যাই নি। সতি্যু করে বল, তোমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে?

লাগছে।

আমার নিজের কাছে কিন্তু লাগছে না। বড় ধরনের দুঃখ বা বড় ধরনের আনন্দ মানুষ নিতে পারে না। বড় ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হলে মানুষ রবোটিক আচরণ করে। আমি রুবোটিক আচরণ করছি। তার মানে এই না যে আমি বাবাকে ভালবাসি না।

খাচার ভেতর ময়নাটা খচমচ করছে। শুভ্ৰ তাকিয়ে আছে ময়নাটার দিকে। আজ সারাদিন এ বাড়িতে অনেক ঝামেলা যাবে। ঝামেলার ভেতর ময়নাটাকে হয়ত খাওয়া দিতে ভুলে যাবে। সেও কাউকে মনে করিয়ে দিতে পারবে না— যে ময়নাকে খাবার দেয়া হয় নি।

বিনু!

জ্বি।

ময়নাটাকে খাবার দেয়ার ব্যাপারটা তুমি আজ খেয়াল রেখো। মৃত মানুষের বাড়ি হল নানান ঝামেলার বাড়ি। ময়নাকে খাবার দেবার কথা হয়ত কারোর মনেই থাকবে না।

আমি লক্ষ রাখব।

মা কোথায় জান?

বারান্দায়। ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন।

আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের খবর দেয়া হয়ছে কি-না জান?

এখনো খবর দেয়া হয় নি। ম্যানেজার সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে। উনি এসে সবাইকে খবর দেবেন।

ও আচ্ছা।

আমার এক চাচা থাকেন দেশের বাইরে। তাকেও যেন খবর দেয়া হয়। ম্যানেজার সাহেবকে মনে করিয়ে দিও!

জ্বি দেব।

মানুষের জন্ম-সংবাদ যেমন সবাইকে দিতে হয়; মৃত্যু-সংবাদও দিতে হয়।

বিনু বলল, আপনি উঠে হাত মুখ ধোন। আমি চা নিয়ে আসছি।

হঠাৎ করেই ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। শুভ্র চমকে উঠে বলল, কে কাঁদছে?

বিনু বলল, বুয়া কাঁদছে।

শুভ্ৰ অবাক হয় বলল, এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। বাবা মারা গেছেন, অথচ আমি কাঁদছি না, মা কাঁদছেন না— কাঁদছে কাজের মেয়েটা। মেয়েটা এসেছে মাত্র গতকাল।

বিনু বলল, সে দায়িত্ব মনে করে কাঁদছে। আপনি কাঁদবেন। দুঃখে।

আমারটা বাদ দাও। মা কেন কাঁদছে না এটাই আমার প্রশ্ন! তুমি কি জান মা কেন কাঁদছে না?

আপনি চাচির সামনে দাঁড়ালেই উনি কাঁদতে শুরু করবেন। তার আগে না।

আমি সামনে না যাওয়া পর্যন্ত মা কান্দবে না?

না।

আর আমি, আমি কখন কাঁদব?

আপনি কাঁদবেন অনেক দিন পর।

শুভ্ৰ বিছানা থেকে নামল। ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। বিনুর কথা ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। তাকে দেখে মা কাঁদতে শুরু করবে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু সে কাঁদবে না, এটা ঠিক না। মাকে কাঁদতে দেখেই তার চোখে পানি আসবে।

জাহানারা চোখ বন্ধ করে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। একটু আগে মাথায় পানি দিয়ে এসেছেন বলে তার মাথা ভেজা। শাড়িও ভেজা। ভেজা শাড়ি মাথায় দিয়ে তিনি শুয়ে আছেন। তাকে ঘিউ বউ লাগছে। শুভ্ৰকে দেখেই তিনি চিৎকার করে। কেঁদে উঠলেন। শুভ্র এগিয়ে গিয়ে মার হাত ধরল। জাহানারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন। কিন্তু শুভ্রর চোখ একটু ছলছল পর্যন্ত করছে না। তার খুবই লজ্জা লাগছে। তার মনে হচ্ছে এই অস্বাভাবিক দৃশ্যটা তার বাবাও দেখছেন। শুভ্র লজ্জা পাচ্ছে দেখে তিনি সান্তুনা দিতে চেষ্টা করছেন। তিনি যেন বলছেন সব মানুষ কি এক রকম হয়? তুই একটু আলাদা। আলাদা হবার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। চোখে পানি আসছে না। তাতে কী হয়েছে। চোখের পানি এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। তুই হলি অন্যরকম। আলাদা।

 

আলাদা হবার মধ্যে যেমন লজ্জার কিছু নেই তেমন আনন্দেরও কিছু নেই। যারা আলাদা তাদের সবাই অন্য চোখে দেখে। খুব যারা আলাদা তাদের রেখে দেয়া হয় পাগলা গারদে।

বিনু চা নিয়ে এসেছে। জাহানারা বিনুর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, এই অবস্থায় তুমি চা নাশতা নিয়ে এসেছ? তোমার কাণ্ডজ্ঞান কোনোদিন হবে না?

শুভ্র বলল, মা আমি চা চেয়েছি। ও নিজে থেকে আনে নি।

জাহানারা চট করে রাগ সামলে নিয়ে বললেন, আমাকে ঠাণ্ড এক গ্লাস পানি দাও।

বিনু শান্ত গলায় বলল, আপনাকেও চা দেই! কড়া এক কাপ চা খেলে ভাল লাগবে।

জাহানারা হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। বিনু চা আনতে গেল।

আশ্চর্যের ব্যাপার। আজকের চা অসাধারণ হয়েছে। শুভ্ৰ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। সব দিনের চা এমন হয় না। কোনোদিন লিকার বেশি থাকে, কোনোদিন চিনি কম হয়। আবার কোনোদিন সবই ঠিক আছে কিন্তু হয় ঠাণ্ডা।

শুভ্ৰ হঠাৎ বলল, মা, তোমার বিয়ে হয়েছে কত দিন?

জাহানারা বললেন, ছাব্বিশ বছর। কেন জিজ্ঞেস করছিস?

এমনি।

মার মানসিক অবস্থা শুভ্ৰ চিন্তা করতে চেষ্টা করছে। একজন মানুষের সঙ্গে ছাব্বিশ বছর কাটানোর পরে এই মহিলার আজ কেমন লাগছে? খুব কষ্টতে লাগছেই – সেই কষ্টের সঙ্গে কি সামান্য আনন্দও নেই? মুক্তির আনন্দ। এই মহিলা আজ রাতে যখন ঘুমুতে যাবেন তখন একটু কি ভাল লাগবে না। এই ভেবে যে তাঁকে এখন আর সারাক্ষণ সাবধান থাকতে হবে না। পাশের মানুষটার ঘুম ভেঙ্গে গেল কি গেল না তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হবে না। বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুতে পারবেন। রাত-দুপুরে বাতি জ্বালালে কেউ বলবে না— এ-কী বাতি নেভাও। চোখে আলো লাগছে। সব আনন্দের সঙ্গে যেমন কষ্ট মিশে থাকে- সব কষ্টের মধ্যেও তেমনি কিছু আনন্দ থাক।

বিনু চা নিয়ে এসেছে। জাহানারা কঠিন গলায় বললেন, চা এনেছ কেন? আজ আমার চা-কফি খাওয়ার দিন?

শুভ্র বলল, খাও মা! ভাল লাগবে।

জাহানারা চায়ের কাপ হাতে নিলেন। বিনুর দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলেন চলে যেতে। বিনু চলে গেল। শুভ্ৰ বলল, বাবার মধ্যে সবচে ভাল জিনিস কী ছিল মা?

জাহানারা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, রাগ এক বস্তু তাঁর মধ্যে ছিল না। কখনো রাগ করত না। তাঁকে কেউ উঁচু গলায় কথা বলতে শুনে নি।

এটাতো কোনো ভাল ব্যাপার না মা। যে মানুষ রাগ করে না সে তো রোবট। আমি নিজেও রাগ করি না। কিন্তু আমি এটাকে কোনো গুণ বলে মনে করি না। বাবার মধ্যে ভাল আর কী আছে?

জাহানারা জবাব দিচ্ছেন না। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। শুভ্রর মনে হল, মা ভাল কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না।

বাড়ির সামনে একটী বেবীটেক্সি এসে থেমেছে।

বেবীটেক্সি থেকে ম্যানেজার ছালেহ নামছেন। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গভীর। চোখ লাল এবং ফোলা ফেলা। মৃত্যুসংবাদ শুনে তিনি নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করছেন। পুরুষ মানুষ সামান্য কাঁদলেই চোখ ফুলে যায়। ম্যানেজার সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে হঠাৎ করে তাঁর বয়সও বেড়ে গেছে। হাঁটছেন কুঁজো হয়ে।

লোকজন আসতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ভর্তি হয়ে যাবে। শুভ্ৰ চায়ের কাপ হাতে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। মৃত বাড়িতে কে কীভাবে ঢুকবে তার দেখতে ইচ্ছা করছে। কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে ঢুকবে। কারো কান্না হবে মেকি। কারো কান্না হবে। আসল। আসল এবং মেকি কান্নার ভেতর প্রভেদ করা কি যাবে? না, যাবে না। এ রকম কোনো ব্যবস্থা যদি থাকত যে দুঃখের কান্নায় অশ্রু হবে হালকা নীল রঙের তাহলে ভাল হত। চোখের জলের রঙ দেখে আসল দুঃখ না বানানো দুঃখ বোঝা যেত।

কাপের চা শেষ হয়ে গেছে। শুভ্ৰ খালি কাপেই চুমুক দিচ্ছে। সে চোখের জলের রঙ নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে। তার বাবার মৃত দেহ বিছানায় পড়ে আছে। সে এখনো তাঁকে দেখতে যায় নি। সে নিতান্ত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ভাবছে। তবে তার জন্যে সে লজ্জিত বোধ করছে না। কারণ সে জানে প্রবল শোকের সময় মস্তিষ্ক শোক তুলিয়ে রাখার জন্যে নানান উদ্ভট কাণ্ড কারখানা করে। চোখের জলের রঙ নিয়ে উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা মস্তিষ্ক তাকে দিয়ে করাচ্ছে।

গভীর দুঃখের চোখের জলের রঙ : গাঢ় নীল

মোটামুটি ধরনের দুঃখের অশ্রুজল : হালকা নীল

শারীরিক ব্যথার অশ্রদ্ধ : কালো

আনন্দের অশ্রু : গোলাপি

চিন্তা নিয়ে বেশি দূত্র আগানো গেল না। ম্যানেজার সাহেব শুভ্রর পেছনে এসে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন— ছোট বাবু, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

শুভ্ৰ বলল, কী কথা?

তোমার ঘরে চল। নিরিবিলিতে বলি।

শুভ্রর বারান্দা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। আরো দুটা বেবীটেক্সি এসে থেমেছে। গাড়ি এসে থেমেছে। লোকজন নামছে। এদের সবার মুখের দিকে সে আলাদা করে তাকাতে চায়। বেশির ভাগ মানুষকেই সে চেনে না। গাড়ি থেকে বৃদ্ধ এক ভদ্রলোকের সঙ্গে উনিশ কুড়ি বছরের দুটা মেয়ে নেমেছে। দুজনই খুব হাসছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাদের কী যেন বললেন। তারা হাসি থামিয়ে ঘরে ঢুকছে। মেয়ে দুটির হাসি দেখতে ভাল লাগছিল।

ছালেহ গম্ভীর গলায় বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। এসো আমার সঙ্গে।

শুভ্ৰ নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বারান্দা থেকে ঘিরে এল।

 

ম্যানেজার সাহেব বসেছেন চেয়ারে। শুত্র বসেছে তাঁর সামনের খাটে। ছালেহ সরাসরি শুভ্ৰর চোখের দিকে তাকালেন। শুভ্ৰর কাছে মনে হল— ভদ্রলোক খানিকটা বিরক্ত। এই বিরক্তির কারণটা কী— শুভ্র ধরতে পারছে না।

ছোট বাবু!

জ্বি।

খুবই দুঃজনক ঘটনা ঘটে গেছে। ঘটনার উপর আমাদের হাত নাই।

জ্বি।

এখন ঠাণ্ডা মাথায় বাকি কাজগুলি করতে হবে। মৃত্যুর পর স্যারকে কোথায় কবর দেয়া হবে এই সম্পর্কে স্যার কি কিছু বলে গেছেন?

জ্বি না।

কোথায় কবর দিতে চাও?

এই সম্পর্কে কিছু ভাবি নি।

তোমার আম্মাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে; কারণ দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। আজ আবার ছুটির দিন।

ছুটির দিনে নিশ্চয়ই কবরস্থান বন্ধ থাকে না?

কবরস্থান বন্ধ থাকে না। কিন্তু ব্যাংক বন্ধ থাকে। সব কিছুতেই টাকা লাগে। জন্মের সময় টাকা লাগে। মৃত্যুর সময়ও টাকা লাগে।

তা ঠিক।

টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। স্যার টাকা তুলে রেখে গেছেন। আমার কাছে টাকা আছে।

তাহলেতো ভালই।

স্যারের সমস্ত একাউন্ট— জয়েন্ট একাউন্ট। তোমার সঙ্গে জয়েন্ট একাউন্ট। তুমি ইচ্ছা করলেই টাকা তুলতে পারবে।

বাবার সঙ্গে আমি কোনো জয়েন্ট একাউন্ট করেছি বলে আমার মনে পড়ে না।

আমি নিজে এসে তোমার কাছ থেকে কিছু সিগনেচার নিয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে জয়েন্ট একাউন্ট খোলার কথা কিছু বলা হয় নি।

ও আচ্ছা।

স্যার উইল করে তাঁর সমস্ত ব্যবসার মালিক তোমাকে করে গেছেন। উইলের কপি উকিলের কাছে আছে। আমাদের অফিসেও আছে। এর মধ্যে স্যারের একটা ব্যবসা আছে খুবই সেনসিটিভ। এই বিষয়ে তোমাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সম্ভব হলে আজই নিতে হবে।

কী সিদ্ধান্ত?

ব্যবসাটা তুমি রাখবে না ছেড়ে দেবে। যদি বল— এই ব্যবসা তুমি রাখবে না— আমি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবসা বিক্রি করে দেব। ব্যবসা হাত বদল হয়ে যাবে। কেউ কিছু জানবেও না। আমরাও ক্ষতিগ্রস্থ হব না।

শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, কী ব্যবসা?

ছালেহ ভুরু কুঁচকে সিগারেট ধরালেন। তাঁর মুখের বিরক্তির ভাব আরো প্রবল হয়েছে। অতিরিক্ত রকমের বিরক্ত হলে মানুষের মুখে থুথু জমে। ভদ্রলোকের মুখে থু থু জমেছে। তিনি জানালার কাছে গিয়ে থু থু ফেলে আবার এসে চেয়ারে বসলেন। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন— খারাপ পাড়ার তিনটা বাড়ি স্যারের। তিনটা বাড়িতে বাহান্নজন মেয়ে থাকে। এটা তোমাদের তিন পুরুষের ব্যবসা। তোমার দাদাজান তার বাবার কাছ থেকে এই বাড়ি তিনটা পেয়েছিলেন। এখন উত্তরাধিকার বলে তুমি। ভেবে দেখ— এই ব্যবসা তুমি রাখবে কি-না!

শুভ্ৰ তাকিয়ে আছে। তার চোখে পলক পড়ছে না। ম্যানেজার সাহেব বললেন, আমি কী বলছি তুমি কি বুঝতে পারছ?

পারছি।

একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানাও। দুটা পার্টির সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়ে আছে।

আমার মা কি বাবার এই ব্যবসার কথা জানেন?

অবশ্যই জানেন।

বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

অনেক লোকজন চলে এসেছে এখন কান্নাকাটি হবেই। ছালেহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শুভ্ৰকে দেখছেন। ময়না পাখি হঠাৎ বলে উঠিল— শুভ্ৰ ভাত খাইছো?

এই কথাটা পাখি সব সময় তিনবার করে বলে- আজ বলল একবার।

ছালেহ হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা ধরাতে ধরাতে বললেন, আজ তোমার বড় দুঃখের দিন। এই দিনে ব্যবসার কথা বলা উচিত না। আমি নিরুপায় হয়ে বললাম। খারাপ পাড়ার ব্যবসার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তুমি যদি আমার কোনো পরামর্শ চাও, পরামর্শ দিতে পারি।

শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, আমি আপনার কাছ থেকে কোনো পরামর্শ চাচ্ছি না।

 

শুভ্ৰ চেয়ারে বসে আছে। তার চোখে চশমা নেই। চশমা খুলে সে দৃশ্যমান জগত থেকে নিজেকে আলাদা করেছে। কিন্তু পৃথিবী শব্দময়। শব্দময় পৃথিবী থেকে নিজেকে আলাদা করার সহজ কোনো উপায় নেই। সব কিছু থেকেই নিজেকে আলাদা করে ফেলার তীব্ৰ ইচ্ছায় শুভ্রের শরীর কাঁপছে। ভয়ঙ্কর কিছু করতে হচ্ছে। ভয়ঙ্কর কিছু।

বারান্দায় কোরানপাঠ হচ্ছে! যে ক্বারী সাহেব কোরান পাঠ করছেন তার গলা অসম্ভব সুরেলা। একটু পর পর সেই বিখ্যাত বাক্যটি ফিরে ফিরে আসছে— ফাবিয়ায়ে আল ওয়া রাব্বিকুমা তুকাজজিবান। শুভ্রর ইচ্ছা করছে কোরানপাঠের মাঝখানে সে উপস্থিত হয়। ক্বারী সাহেবকে বলে— ভাই আপনি হয়তো জানেন না আমার বাবা নোংরা মানুষ ছিলেন। তাঁর মঙ্গলের জন্যে আপনি প্রার্থনা করবেন না।

বন্ধ দরজায় টোকা পড়ছে। শুভ্র বলল, কে? ওপাশ থেকে বিনু ক্ষীণ গলায় বলল, আমি।

কি চাও?

চাচী আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনি কী করছেন দেখে যাবার জন্যে।

আমি কিছুই করছি না। চুপচাপ চেয়ারে বসে আছি। বিনু তুমি কী মাকে একটু পাঠাবে আমার কাছে।

জ্বি আচ্ছা।

শুভ্ৰ টেবিল থেকে চশমা নিয়ে চোখে দিল। মাকে সে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবে। সেই সময় মার চেহারাটা কেমন বদলায় তার দেখার ইচ্ছা। না বেশি প্রশ্ন না। মোটে তিনটা প্রশ্ন।

প্রথম প্রশ্ন, মা তুমি বাবার এই ভয়ঙ্কর ব্যবসার কথা জানতে। তুমি তাকে এর থেকে মুক্ত করার চেষ্টা কেন কর নি।

মার উত্তর হবে- চেষ্টা করেছিলাম। পারি নি। ওদের কয়েক পুরুষের ব্যবসা।

তখন দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে- যখন পারলে না। তখন বাবাকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে চলে গেলে না কেন?

এর সম্ভাব্য উত্তর হবে, আমার কোথাও যাবার জায়গা ছিলো না।

তখন শেষ প্রশ্ন। মা আমাকে কিছু জানাও নি কেন? তুমি কি মনে মনে চাচ্ছিলে বাবার পর তার এই ব্যবসা আমি দেখব? এখন বল আমি যদি তাই ঠিক করি তুমি কী করবে? পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ঐ ভয়ঙ্কর বাড়িগুলিতে আমি যদি রাত্রি যাপন করা শুরু করি তোমার কেমন লাগবে?

জাহানারা শুভ্রর ঘরে ঢুকলেন। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন বাবারে তুই এমন ভাবে বসে আছিস কেন? একদিনে তোর চোখ মুখ কেমন হয়ে গেছে। তুই শুয়ে থাক। আয় তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।

শুভ্ৰ চোখ থেকে চশমা নামিয়ে ফেলল।

জাহানারা বললেন, তুই এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? তোকে পাগল পাগল লাগছে।

শুভ্ৰ বলল, মা আমি ঠিক আছি। তুমি এখন যাও। আমি কিছুক্ষণ একলা বসে থাকব। বলেই শুভ্র তার সুন্দর হাসিটা হাসল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ