আনিসের ঘুম ভাঙল এগারটায়।

সে কয়েক মুহূর্ত নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না, সত্যি সত্যি এগারটা বাজে। আজ শুক্রবার, সাড়ে নটায় একটা ক্লাস ছিল। তিন শ ছয় নম্বর কোর্স পলিমার রিয়োলজি। এখন অবশ্যি করার কিছুই নেই। মিস ক্যাথরীনকে টেলিফোন করে দিতে হবে। ক্লাস মিস করা তেমন কোনো ব্যাপার নয়। সময় করে নিয়ে নিলেই হবে। কিন্তু ঘুমের জন্যে ক্লাসে না যেতে পারাটা লজ্জার ব্যাপার।

আনিস টেলিফোন হুঁক লাগান মাত্রই টেলিফোন বেজে উঠল।

হ্যালো আনিস ভাই? আমি শফিক।

বুঝতে পারছি।

কাল রাত থেকে এই নিয়ে ছয় বার টেলিফোন করেছি। আপনি কি টেলিফোন ডিসকানেক্ট করে রেখেছিলেন?

হ্যাঁ।

আমি ভাবলাম, কী ব্যাপার? এদিকে আপনার মহিলা কবির নাম পেয়েছি, নাম হচ্ছে মেরি স্টুয়ার্ট।

আনিস ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, মেরি স্টুয়ার্ট নয়। ভদ্রমহিলার নাম এমিলি জোহান। রাত্ৰে মনে করতে পারছিলাম না, এখন মনে হয়েছে।

আনিস ভাই, আপনার কি শরীর খারাপ?

না, শরীর ঠিক আছে।

আমিন সাহেবের বাসায় যাবার কথা মনে আছে তো?

আজকে তো নয়, কাল।

হ্যাঁ, কাল। শুনুন আনিস ভাই, আমি আসছি।

এখন?

এই দশ মিনিটের মধ্যে। সিরিয়াস কথা আছে।

আনিস টেলিফোন রেখে চায়ের পানি বসিয়ে দিল। পানি গরম হতে–হতে হাতমুখ ধুয়ে আসা যাবে। হাত-মুখ ধুতে গিয়ে মনে পড়ল, আরেকটি প্রাণী আছে। আশ্চৰ্য, এত বড়ো একটা ব্যাপার। এতক্ষণ মনে পড়ল না কেন?

কিন্তু মালিশা ছিল না। ঘরের বিছানা সুন্দর করে পাতা। বিছানার উপর এক টুকরো সাদা কাগজ পড়ে আছে। আনিস দেখল। সেখানে পেন্সিলে লেখা–তুমি ঘুমোচ্ছ দেখে জাগালাম না। অনেক ধন্যবাদ। আনিসের কেন যেন একটু মন খারাপ লাগল। অথচ মন খারাপ হবার কোনো কারণ নেই। আজকের দিনটি খুবই খারাপ যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এ-রকম খারাপ দিন আসে। কোনো কিছুই ঠিক মতো হয় না।

শফিকের দশ মিনিটের মধ্যে আসার কথা। সে দু ঘণ্টার মধ্যেও এল না। মিস ক্যাথরীনকেও টেলিফোন করে পাওয়া গেল না। ইউনিভার্সিটিতে এখন গিয়ে হাজির হওয়ার কোনো মানে হয় না। আনিসের মনে হল তার জ্বর আসছে। কী ভয়ঙ্কর খারাপ দিন। টিভি-র নিউজ চ্যানেলে পর্যন্ত একটিও ভালো খবর নেই–

ক্যান্টাকিতে দুটি শিশুকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।

সল্ট টু ট্রিটির আলোচনা ভেস্তে গেছে।

বেলজিয়ামের লিয়েগো শহরে একটি ট্রেন নদীতে পড়ে দেড় শ লোকের সলিলসমাধি হয়েছে।

 

বাগানে চেয়ার সাজান হয়েছে।

রুনকির মনে হল, তার মা কিছুটা বাড়াবাড়ি করছে। দু বার টেবিলক্লথ পাল্টান হয়েছে। ফুলদানিতে ফুল সাজান হয়েছে স্টেরিও সিস্টেমকে টেনে আনা হয়েছে বাইরে।

রুনকি বলল, মা তুমি বড্ড হুলস্থূল করছ!

রাহেলা অসন্তুষ্ট হলেন। তাঁর কপালের চামড়ায় সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল, বাইরে চেয়ার পেতে বসলে বুঝি হুলস্থূল হয়?

তা হয় না, কিন্তু ফুলদানি রাখলে হুলস্থূল হয়। তুমি ছয় ডলার খরচ করে ফুল আনিয়েছ মা।

বেশ তো, তোমার অপছন্দ হলে ফুলদানি তুলে নাও।

রুনকি অপ্রস্তুত হল। তার মা স্পষ্টই রেগে গেছেন। সে তার মাকে ঠিক বুঝতে পারে না। অত্যন্ত ছোট কারণে তিনি অসম্ভব রেগে যেতে পারেন। রুনকি হাসিমুখে বলল, মা, তুমি যদি চাও তাহলে আমি নীল শাড়িটা পরব।

আমার আবার চাওয়াচাওয়ি কি রুনকি? আমি কখনো কারো কাছে কিছু চাই নি।

রুনকি মুখ কালো করে তার ঘরে চলে গেল। এমন একটি চমৎকার দিন কেমন করেই নি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রুনকি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। এই ঘরে নিজের মনে কাঁদা যায়। উঁচু ভল্যুমে গান বাজান যায়। এটি তার নিজের গোপন

থৈবী। পৃথি টুকটুক করে টোকা পড়ছে দরজায়। নিশ্চয়ই বাবা। এমন শালীন ভঙ্গিতে বাবা ছাড়া আর কেউ দরজা নক করতে পারেন না। রুনকি নরম গলায় বলল, কী চাও, বাবা?

দরজা খোল বেটি। তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে।

কী সারপ্রাইজ?

খুলেই দেখ।

রুনকি রেরিয়ে এল, তার দু চোখ ভেজা। চুল এলোমেলো।

তোমার জন্যে একটি গিফট প্যাকেট এসেছে। ইটালি থেকে। ইটালিতে কে আছে তোমার মা?

টম। সামার কাটাতে গিয়েছে।

রুনকি প্যাকেট খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেল। প্লাষ্টার অব প্যারিসের তৈরি অপূর্ব একটি নারীমূর্তি। নিশ্চয়ই মাইকেল এঞ্জেলোর কোনো ভাস্কর্যের ইমিটেশন। রুনকি গাঢ় স্বরে বলল, কী সুন্দর, দেখেছি!

শ্যাঁসুন্দর। খুবই সুন্দর।

মাকে দেখিয়ে আনি।

রুনকি ছুটে বেরিয়ে গেল।

রাহেল রানাঘরে। রানাবান্নার কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। খাবার দাবার গরম রাখার জন্যে শুধু ওভেনে দিয়ে রাখা। অনেক রকম আয়োজন হয়েছে, তবু রাহেলার মনে হচ্ছে আয়োজন পূর্ণাঙ্গ হয় নি। কাঁচামরিচ নেই ঘরে। হর্নবাকারসে কাঁচামরিচ পাওয়া যায় নি। তিনি বা আমিন সাহেব কেউ অবশ্যি ঝাল খান না, তবে প্রবাসী বাঙালীরা খাবার টেবিলে কাঁচামরিচ দেখতে ভালোবাসে।

মা দেখ, টম কী পাঠিয়েছে।

কোন টম, পাগলা টম?

রুনকি রেশ বিরক্ত হল। টম আবার ক জন আছে যে, পাগলা টম বলতে হবে? রুনকি বলল, মূর্তিটি আমি বাগানে সাজিয়ে রাখি মা? তোমার অতিথিরা দেখলে অবাক হবে।

রাহেলা থেমে থেমে বললেন, না রুনকি, এটি তোমার ঘরেই থাক। মূর্তিটি অশালীন।

রুনকি স্তম্ভিত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঝড়ের বেগে দোতলায় উঠে গেল।

অতিথিদের মধ্যে প্রথম এলেন নিশানাথ রায়। গ্ৰাণ্ড ফোকস ইউনিভাসিটির অঙ্কের প্রফেসর। ভদ্রলোকের বয়স ৫৫, কিন্তু দেখায় ৭০-এর মতো। লম্বা দড়িপাকান চেহারা। যে-কোনো নিমন্ত্রণে সবার আগে এসে উপস্থিত হন এবং নিরিবিলি একটি কোণ বেছে চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন কিংবা ঘুমান। আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতেও ক্লাস নিতে গিয়ে একই কাণ্ড। তবু তিনি টিকে আছেন, কারণ টপলজিতে এক জন প্রথম শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁকে এখনো ধরা হয় (যদিও টপলজি তিনি ছেড়েছেন দশ বছর আগে)। অনেকের ধারণা, গ্রাণ্ড ফোকাস ইউনিভার্সিটির নাম লোকে জানে, কারণ প্রফেসর নিশানাথ এখানে মাস্টারি করেন।

নিশানাথ বাবু তাঁর স্বভাবমতো পাঁচটার দিকেই এসে পড়লেন এবং লজ্জিত স্বরে বললেন, দেরি করে ফেললাম নাকি?

আমিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, না, দেরি হয় নি। চা দেব, না লিকার?

নিশানাথ বাবু বিড়বিড় করে কী-যেন বললেন। পরিষ্কার বোঝা গেল না। তিনি বেছে বেছে সবচেয়ে পেছনের একটি চেয়ারে পা উঠিয়ে বসলেন। আমিন সাহেব মার্টিনির একটি বড়ো গ্লাস নিয়ে এসে দেখেন, নিশানাথ বাবু চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন।

নিশানাথ বাবু নিন, মার্টিনি এনেছি।

ইয়ে–কি যেন বলে, আমি অবশ্যি চা চেয়েছিলাম।

চা নিয়ে আসতে পারি, পানি গরম আছে।

নিশানাথ বাবু তার উত্তর দিলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন।

রাত আটটা বেজে গেল। অন্য দু জন নিমন্ত্রিতের কোনো খোঁজ নেই। শফিকের ঘরে টেলিফোন করা হল কয়েক বার, কেউ ধরল না। রুনকি বলল, নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা হয়েছে মা। তুমি এমন মুখ কালো করে থেক না।

কী আজেবাজে কথা বল রুনকি? মুখ কালো করব কেন?

আমি সরি মা।

ঠিক আছে খেতে বাস।

নিশানাথ বাবু নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছেন। আমিন সাহেব একবার বললেন, রান্না কেমন হয়েছে নিশানাথ বাবু?

নিশানাথ বাবু তার জবাব দিলেন না। তিনি কখনো অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের জবাব দেন না। রুনকি বলল, নিশা চাচার জিহ্বায় কোনো টেষ্টব্যাড নেই। তিনি যাই খান তাই তাঁর কাছে ঘাসের মতো লাগে। তাই না চাচা?

নিশানাথ বাবু তার উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তখন টেলিফোন বাজল। টেলিফোন ধরল রাহেলা।

হ্যালো, আমি শফিক।

রাহেলা শুকনো গলায় বললেন, আমরা সবাই খেতে বসেছি, একটু পরে ফোন করতে পার?

রাহেলা কঠিন মুখ করে খেতে বসলেন। রুনকি মায়ের দিকে না তাকিয়ে বলল, মা, এটা কিন্তু তুমি ঠিক করলে না।

রাহেলা উত্তর দিলেন না। নিশানাথ বাবু বললেন, প্রচুর আয়োজন করেছেন। মনেই হয় না বিদেশ।

রুনকি বলল, মা ওদের হয়তো বিশেষ কোনো ঝামেলা হয়েছে। টেলিফোন নামিয়ে না রেখে তোমার উচিত ছিল

আমার কী উচিত-অনুচিত তা আমি তোমার কাছ থেকে শিখতে চাই না! তুমি ভাজা মাছ আরো নেবে?

না।

নিশানাথ বাবু, আপনি নেবেন?

নিশানাথ বাবু অবাক হয়ে বললেন, এটা ভাজা মাছ? আমি ভাবছিলাম…

রুনকি বলল, তুমি শুধু শুধু রাগ করছ মা। ওদের নিশ্চয়ই বড়ো রকমের কোনো ঝামেলা হয়েছে।

নিশানাথ বাবু বললেন, কাদের ঝামেলা হয়েছে?

যাদের আসবার কথা ছিল, তাদের।

কী ঝামেলা?

সেটা এখনো জানা যাচ্ছে না। হয়তো ভদ্রলোক বাথরুমে গিয়ে দেখেন বাথটাবে একটি ডেডবিডি পড়ে আছে। ডেডাবডিটির পিঠে একটি ওরিয়েন্টাল কাজ করা ছুরি।

আমিন সাহেব হেসে ফেললেন।

হাসির কী হল বাবা? হতেও তো পারে।

নিশিনাথ বাবু বললেন, এদেশে সবই সম্ভব। খুন খারাবি এদের কাছে কিছুই না, অতি অসভ্য বর্বরের দেশ।

ঝামেলাটা কী হয়েছে তা জানা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। গাড়ি নিয়ে হাইওয়েত আটকা পড়েছে। শফিকের প্রাচীন ফোর্ড ফিয়াসটার ট্রান্সমিশন কাজ করছে না। হাইওয়ের একটি রেস্ট হাউসে বসে আছে দু জন। রুনকি বলল, রাস্তার মাঝখানে গাড়ি নিয়ে আটকা পড়া দারুণ এক্সাইটিং।

রাহেলা ভ্রূ কোঁচকালেন। ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, এর মধ্যে এক্সাইটিং কী দেখলে তুমি? সাধারণ মানুষদের মতো ভাবতে শেখ। গাড়ি নিয়ে আটকা পড়াটা হচ্ছে যন্ত্রণা। এক্সাইটমেন্ট নয়।

তুমি এত রেগে রেগে কথা বলছ কেন মা?

রুনকি, কথা বন্ধ করে গাড়ি নিয়ে ওদের খোঁজে যাও। তোমার বাবাকে পাঠাব না। সন্ধ্যা থেকে মার্টিনি খাচ্ছে, ওর হাত স্টেডি নেই।

কথাটা ঠিক নয়। দু পেগের মতো মার্টিনি আমিন খেয়েছেন। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। রাহেলার মেজাজ চড়ে আছে। চুপ করে থাকাই ভালো। নিশানাথ বাবু বসার ঘরের সোফায় পা গুটিয়ে আবার ধ্যানস্থ হয়েছেন। আমিন তাঁর পাশে এসে বসতেই তিনি বললেন, বুঝলেন, অতি অনুসভ্য, অতি বর্বর জাত।

রাহেলা রুনকির সাথে গ্যারাজ পর্যন্ত গেলেন। রুনকির হাতে চাবি দিয়ে বললেন, নতুন ছেলেটির সঙ্গে খুব ভদ্র ব্যবহার করবে।

রুনকি অবাক হয়ে বলল, আমি অভদ্র মা! কী বলছ তুমি? যা বলছি মন দিয়ে শোন। আমি চাই তুমি বাঙালী ছেলেদের সঙ্গে কিছুটা মেলামেশা কর।

রুনকি চুপ করে রইল। রাহেলা বললেন, তোমার একটি ভালো বিয়ে হোক, সেটাই আমি চাই। আমি তোমাকে হ্যাপি দেখতে চাই।

বাঙালী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলেই আম হ্যাপি হব? তোমার তো বাঙালি ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে। তুমি কি হ্যাপি?

রাহেলা উত্তর দিলেন না।

রুনকি বলল, এইসব নিয়ে আমি এখন ভাবতে চাই না। আর আমি চাই না, তুমিও ভাব। ইদানীং আমাকে নিয়ে তুমি বেশি চিন্তা করছি।

তুমি বলতে চাও, চিন্তার কিছু নেই?

রুনকি গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। রাহেলা বললেন, শাড়ি একটু উপরের দিকে টেনে নাও। এক্সিলেটরের সঙ্গে যেন না লেগে যায়।

হাইওয়েতে নেমেই রুনকি গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে সত্ত্বরে নিয়ে এল। গ্র্যাণ্ড ফোকস থেকে ফার্গো ইন্টারস্টেট হাইওয়ে ফাঁকা থাকে বলেই পুলিশটুলিশ তেমন থাকে না। যত ইচ্ছা স্পীড তোলা যায় গাড়িতে। রুনকির বান্ধবী শ্যারন এক বার পচানব্বুই পর্যন্ত তুলেছিল। কি প্রচণ্ড কাঁপুনি গাড়ির। রুনকির এতটা সাহস নেই। সত্ত্বরেই তার খানিকটা হাত কাঁপে। তা ছাড়া ফল সিজন বলেই গাছের পাতা ঝরছে। শুকনো পাতার উপর দিয়ে গাড়ি গেলেই অদ্ভুত শব্দ হয়, কেমন যেন ভয়ভয় করে।

 

আপনাদের নিতে এসেছি আমি।

আনিস মেয়েটিকে দেখে অবাক হল। হালকা-পাতলা গড়নের বাচ্চা একটি মেয়ে। শিশুদের চোখের মতো তরল চোখ। কেমন যেন অভিমানী পাতলা ঠোঁট!

আপনি বুঝি সেই টীচার? আনিস? আনিসের উত্তর দেওয়ার আগেই মেয়েটি বলল, আমি কিন্তু মাস্টারদের একটুও পছন্দ করি না। আপনি আবার রাগ করবেন না যেন।

আনিস হাসিমুখে বলল, না, আমি রাগ করব না।

মাস্টাররা ক্লাসের বাইরে কিছু জানে না। জানতে চায়ও না।

তাই কি? হ্যাঁ। আমি দশ ডলার বাজি রাখতে পারি, আপনি কবি কীটসের প্রণয়িনীর নাম জানেন না।

আনিস বেশ অবাক হল। মেয়েটির মুখ হাসি-হাসি কিন্তু ঝগড়া বাধানর একটা সূক্ষ্ম চেষ্টা আছে। শফিক তার গাড়ি নিয়ে এখনো ব্যস্ত। তার ধারণা ঝামেলাটা আসলে ট্রান্সমিশনে নয় কারবুরেটরে, আর খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলেই সে ঠিক করে ফেলতে পারবে।

আনিস একটি সিগারেট ধরিয়ে মৃদু স্বরে বলল, কবি কীটসের প্রণয়িনীর নাম জানা অত্যাবশ্যকীয় বিষয় নয়।

আইনস্টাইনের কয় স্ত্রী, সেটা জানা বোধ হয় অত্যাবশ্যকীয়?

না, তা নয়। এইসব হচ্ছে বিলাস।

শফিকের গাড়ি একটি ছোট গর্জন করে আবার ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে হাসিমুখে বলল, দেখলেন তো আনিস ভাই, প্ৰায় কায়দা করে ফেলেছি। আর দশ মিনিট।

আনিস সে-কথার জবাব দিল না। রুনকি মাথার স্কাযর্ক শক্ত করে বাঁধতেবাঁধতে মৃদু স্বরে বলল, আমি তর্ক করে আপনাকে রাগিয়ে দিতে চাই না। তাহলে মা খুব রাগ করবেন। মাকে আমি রাগাতে চাই না। তাঁর কিছুদিন আগেই নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল। আরেক বার হলে খুব মুশকিল হবে।

শফিকের গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে। বিকট শব্দ আসছে সেখান থেকে। শফিক কোমরে হাত দিয়ে গাড়িকে উদ্দেশ্য করে ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে ফেলল, শালা তুমি মানুষ চেন নাই। কত ধানে কত চাল বুঝি নাই। শালা এক চড় দিয়ে তোমার দাঁত খুলে ফেলব…

রুনকি খিলখিল করে হেসে ফেলল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ