মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ তাকিয়ে আছেন। পুলিশেরা কোনো ব্যাপারেই কৌতূহলী হয় না। কৌতূহল ও বিস্ময় তাদের থাকে না। কিন্তু এই অফিসারটির গলায় খানিকটা আগ্রহ যেন আছে। তিনি নিশাতের চোখে চোখ রেখে বললেন, বলুন।

আমি কি একটু নিরিবিলিতে বলতে পারি?

থানা হচ্ছে একটা বাজার। মাছের বাজার। এর মধ্যে নিরিবিলি কোথায় পাবেন! যা বলতে চান এর মধ্যে বলতে হবে।

এর মধ্যে আমি কিছু বলতে পারব না।

বসুন, দেখি কি করা যায়।

অফিসার ইনচার্জ অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অতি দ্রুত মোটা খাতায় কী সব লিখতে লাগলো। এর মধ্যে টেলিফোন আসছে। রোগা একটা লোক প্রতি বারই দূর থেকে উঠে এসে টেলিফোন ধরছে, যদিও টেলিফোনের কাছেই অন্য একজন লোক বসে আছে। হাত বাড়ালেই সে টেলিফোন ধরতে পারে। ধরছে না। ঘরজোড়া বিরাট একটা টেবিল। রাজ্যের কাগজপত্র সেখানে। সেইসব কাগজপত্রের উপর প্লাস্টিকের বড় থালায় বানাননা পান। দেয়ালে বড় একটা ঘড়ি। ঘড়িটা পনের মিনিট ফাস্ট। ঘরের এক কোথায় কোমরে দড়ি বাঁধা দাড়িওয়ালা দু জন লোক বসে আছে। এরা প্রচণ্ড মার খেয়েছে। এক জনের ঠোট কাটা। কাটা ঠোঁট বেয়ে রক্ত পড়ছিল। সেই রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধেছে। লোকটি কিছুক্ষণ পরপর ও আল্লা গো বলে চেচিয়ে উঠে কাঁদছে। সেদিকে কেউ কোনো রকম গুরুত্ব দিচ্ছে না।

নিশাত বলল, আমরা কতক্ষণ অপেক্ষা করব?

হাতের কাজটা সেরে নিই। ওয়াসিম, রেকর্ড-রুমটা খুলে দাও। যান, আপনারা ঐ রুমে গিয়ে বসুন। ওয়াসিম, ওঁদের নিয়ে যাও। আমি দু-তিন মিনিটের মধ্যে চলে আসব।

সেই রেকর্ড-রুমেও তারা পনের মিনিটের মতো বসে রইল। একটা ছেলে এসে দু কাপ চা এবং প্লেটে করে পান দিয়ে গেল। এই ঘরটা বাথরুমের কাছে। বিকট গন্ধ আসছে। ঘোট ঘর, কিন্তু আলো খুব কড়া। দু শ পাওয়ারের একটা বা জ্বলছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ ককর করে।

পুষ্প চুপচাপ বসে আছে। একটি কথাও বলছে না। নিশাত দু-একটা টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছে। পুষ্প জবাব দিচ্ছে না। মাঝে-মাঝে একটু যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। খুব সম্ভবত তার জ্বর।

শরীর খারাপ লাগছে?

না।

বসে থাকতে ভালো লাগছে না, তাই না?

পুষ্প জবাব দিল না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। বাইরে ঘন অন্ধকার, দেখার কিছু নেই। তবু পুষ্প মনে হয় অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছে।

আমি অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। কিছু মনে করবেন না। ইচ্ছা করে বসিয়ে রাখি নি। আপনারা মনে হচ্ছে কোনো রেপ কেস রিপোর্ট করতে এসেছেন, তাই না?

নিশাত বিস্মিত হয়ে বলল, হ্যাঁ।

এগার বছর পুলিশে চাকরি করছি, কিছু-কিছু বুঝতে পারি। আমার নাম নুরুদ্দিনপুলিশ ইন্সপেক্টর। পুরো ঘটনা বলুন। ঘটনাটা কখন ঘটল? * নিশাত কাল পুষ্পের দিকে। পুষ্প মাথা নিচু করে বসে রইল। নুরুদ্দিন বললেন,

আপনি যা জানেন তাই বলুন। ওনার সঙ্গে আমি পরে কথা বলব।

নিশাত গুছিয়ে কিছু বলতে পারল না। তার বারবারই মনে হল অফিসারটি মন দিয়ে কিছু শুনছেন না। বারবার নড়াচড়া করছেন। কথার মাঝখানে দুবার উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে থুথু ফেললেন। একবার নিশাতকে চমকে দিয়ে খুবই উচু গলায় ডাকলেন, ওয়াসিম, ওয়াসিম। ওয়াসিম নামের কেউ-একজন এসে দাঁড়াল।

নিশাত কথা বন্ধ করে চুপ করে রইল। নুরুদ্দিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, গাড়ি এসেছে?

জ্বিনা স্যার। চাকা নাকি পাংচার হয়েছে।

চাকা ঠিক করতে সারা দিন লাগে? যান দেখুন কী ব্যাপার। দশ মিনিটের ভেতর গাড়ি চাই। যান যান, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

ওয়াসিম চলে যেতেই নিশাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, তারপর কী হল বলুন।

যা বলার বলে ফেলেছি। এর বেশি বলার কিছু নেই।

নুরুদ্দিন তাকালেন পুষ্পের দিকে। গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার স্বামী আসেন নি কেন? ওনার কি কেইস ফাইল করার ইচ্ছা নেই?

পুষ্প জবাব দিল না। সে এখনো জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে।

আপনি কেইস করতে চান?

হ্যাঁ।

আপনি গোসল করেছেন, তাই না?

হ্যাঁ।

বেশ কয়েকবার, তাই না?

হ্যাঁ।

এইখানেই একটা সমস্যা করেছেন। মেডিকেল রিপোর্টে হয়তো কিছু পাওয়া যাবে না।

নিশাত বলল, রিপোর্টে কিছু না পাওয়া গেলে কি কেইস হবে না?

অবশ্যই হবে। তবে যদি পাওয়া যায় তা হলে আমি আজ রাতেই ৩৭৬ ধারায় ভদ্রলোককে গ্রেফতার করব। এটা নন-বেইলেবল। কাজেই বেল হবে না। মিজান সাহেবের ঠিকানা কি জানা আছে?

পুষ্প বলল, না।

আপনার স্বামী নিশ্চয়ই জানেন।

হ্যাঁ।

আমরা ওনার কাছ থেকে জেনে নেব। চলুন যাওয়া যাক।

কোথায় যাব?

মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ডাক্তারি পরীক্ষাটা হয়ে যাক। এই জাতীয় : কেইসের শুরুটা খুব ঝামেলার। অনেকেই এ-সব ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে চান না।

নিশাত বলল, কি ধরনের শাস্তি হতে পারে বলতে পারেন?

পারি। প্রমাণ করতে পারলে কুড়ি বছরের সাজা হয়ে যাবে।

প্রমাণ করা কি শক্ত?

হ্যাঁ, শক্ত। বেশ শক্ত। তবে ভিকটিমের মনের জোর যদি থাকে তা হলে পারা যায়।

পুষ্প বলল, আমি ডাক্তারি পরীক্ষা করাব না। আমি বাসায় চলে যাব।

নুরুদ্দিন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। শান্ত গলায় বললেন, অসুবিধাটা কোথায়? মহিলা-ডাক্তাররা আপনাকে পরীক্ষা করবেন।

আমি বাসায় চলে যাব।

দশ মিনিটের ব্যাপার।

এক বার তো বললাম, আমি বাসায় যাব।

যদি আপনি মেডিকেল টেস্টটা করান তা হলে আমি এক ঘন্টার মধ্যে এই হারামজাদাকে ধরে হাজতে ঢুকিয়ে দেব। আর যদি না করান, সে রাতের বেলা আরামে ঘুমুবে। হয়তো অন্য কোনো মেয়ের কাছে যাবে। আমি নিজে খুব যে একজন অনেস্ট অফিসার, এটা দাবি করব না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই ভদ্র অপরাধীগুলিকে ধরতে চাই। তাদের চোদ্দ পুরুষের বাপের নাম ভুলিয়ে দিতে চাই। আপনারা যদি সাহায্য না করেন কীভাবে করব?

আমি বাসায় যাব।

নিশ্চয়ই যাবেন। মেডিকেল কলেজের ঝামেলাটা মিটিয়েই চলে যাবেন। আমি নিজে পৌছে দিয়ে আসব। আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলব।

পুষ্পের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। একট পরপর সে ফুঁপিয়ে উঠছে। নুরুদ্দিন বললেন, যে-ব্যাপারটা আজ আপনার জীবনে ঘটেছে, আপনার মেয়ের জীবনেও এটা ঘটতে পারে। পারে না? চলুন রওনা হই।

পুষ্প উঠে দাঁড়াল।

নিশাত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে-ঘরটায় বসে অপেক্ষা করছে, এটা সম্ভবত নার্সদের কমনরুমজাতীয় ঘর। নার্সরা আসছে-যাচ্ছে। মোটামুটি একটা বাজারের মতো ব্যাপার। এরা কেউ নিশাতকে তেমন লক্ষ করছে না। তবে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা নুরুদ্দিনকে দেখছে কৌতূহলী হয়ে এক জন জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার স্যার?

নুরুদ্দিন হাই তুলে বললেন, কোনো ব্যাপার না। আপনাদের দেখতে এলাম। আপনারা ভালো আছেন?

পুলিশ অফিসারের এই ভঙ্গিটি নিশাতের বেশ পছন্দ হল। খুবই স্বাভাবিক আচরণ। যেন কিছুই হয় নি। ব্লাড-প্ৰেশার মাপাবার জন্যে এক জন রুগীকে নিয়ে এসেছেন। সারাটা পথ রেপ কেস প্রসঙ্গে বা মিজান সম্পর্কে একটি কথাও বলেন নি, বরং প্রতিমন্ত্রীর বাড়ির সামনে কয়েকটা নেড়িকুত্তা জটলা পাকাচ্ছিল, তাতে কী সমস্যা হল সেই গল্প শুরু করলেন। মন্ত্রী টেলিফোনে পুলিশের সাহায্য চাইলেন। পুলিশ বলল, নেড়িকুত্তা তো স্যার আমাদের ব্যাপার না। এটা মিউনিসিপ্যালেটির ব্যাপার। প্রতিমন্ত্রী রেগে আগুন, মিউনিসিপ্যালেটি বুঝি না আপনাদের অ্যাকশন নিতে বলেছি, আপনারা অ্যাকশন নিন। প্রতি রাতে বাড়ির সামনে রাজ্যের কুকুর ঘেউঘেউ করবে, তা হলে আপনারা আছেন কি জন্যে?

আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ফায়ার ওপেন করতে হলে এক জন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগে। আমরা তা হলে এক জন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলি?

প্রতিমন্ত্রী ঘাবড়ে গিয়ে বললো, এই সামান্য ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেট লাগবে?

জ্বি স্যার লাগবে। গুলী কোনো সামান্য ব্যাপার না। এখন বাজে রাত তিনটা। আবাসিক এলাকায় গুলী চলবে। সবাই টেলিফোন করবে পত্রিকা অফিসে। পত্রিকার রিপোর্টাররা আসবে আমার কাছে। আমি তাদের পাঠাব আপনার কাছে। সম্পাদকীয় লেখা হবে। প্রেসিডেন্ট তদন্ত কমিটি গঠন করবেন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি….।

থামুন। আপনাকে কিছু করতে হবে না।

নিশাত বুঝতে পারছিল ভদ্রলোক এইসব বলছেন পরিস্থিতি হালকা করার জন্যে। এটা নিশাতের কাছে চমৎকার লাগল। এক জন সেনসেবল মানুষ।

এই যে এখন তারা দুজন মুখোমুখি বসে আছে, ভদ্রলোক একটি কথাও বলছেন। না—কারণ তাঁর কথা বলার প্রয়োজন নেই। কথা যারা বেশি বলে তারা কাজ তেমন করতে পারে না। এই অফিসারটি নিশ্চয়ই কাজের।

নুরুদ্দিন সাহেব!

বলুন।

এই জাতীয় কেইস কি আপনাদের কাছে অনেক আসে?

না। খুব কম আসে। লোকলজ্জার ভয়েই কেউ আসে না। যা আসে লোয়ার ক্লাস থেকে। রিকশাওয়ালা, মজুর—এই রকম। লোকলজ্জার ভয় ওদের তেমন নেই, আমাদের যেমন আছে। তা হয়তো ঠিক।

একেবারেই যে হয় না তা নয়। কিছু-কিছু হয়। মাঝপথে সেইসবও নষ্ট হয়ে যায়। পত্রিকাওয়ালারা বড় ঝামেলা করে। নানান রকম কেচ্ছাকাহিনী ছাপে। ধর্ষণের খবরগুলি যেন একটা চাটনি। ছবিটবি বক্স করে ছেপে দেয়। কোনো-কোনো খবরে ধর্ষণের বর্ণনাও থাকে। পড়লে মনে হবে পর্নোগ্রাফী। যিনি লিখেছেন, তিনি লেখার সময় খুব মজা পেয়েছেন এটা বোঝা যায়। আপনার কখনো চোখে পড়ে নি?

এইসব খবর আমি পড়ি না।

আমার পড়তে ইচ্ছা করে না, কিন্তু পড়তে হয়। বাধ্য হয়ে পড়তে হয়।

এত দেরি হচ্ছে কেন?

একটু সময় লাগবে। নানান ফ্যাকড়া আছে। এরকমও হয়েছেডাক্তার চমৎকার রিপোর্ট দিয়েছেন, রিপোর্টের উপরই কনভিকশন হয়ে যাবে এমন অবস্থা, কিন্তু আমরা সে-সব রিপোর্ট কাজে লাগাতে পারি নি।

কেন?

বাদীপক্ষ কেইস উইথড্র করে। এগোতে চায় না। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়তো হবে। দেখলেন না, স্বামী বেচারার কোনো আগ্রহ নেই। এল না পর্যন্ত। আমি যখন যাব আমার সঙ্গে কথাও বলবে না।

পুষ্পকে আসতে দেখা যাচ্ছে। তার সঙ্গে বুডোমতো এক জন ডাক্তার। রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। নুরুদ্দিন রিপোর্টে চোখ বোলালেন। নিশাত বলল, কী আছে রিপোর্টে?

নুরুদ্দিন জবাব দিলো না। রিপোর্টটা পকেটে রেখে দিলেন। ডাক্তার সাহেব নিশাকে বললেন, আমি কিছু সিডেটিভ প্রেসক্ৰাইব করেছি। সিডেটিভ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড মানসিক চাপ গেছে। পূর্ণ বিশ্রাম দরকার।

নুরুদ্দিন বললেন, চলুন পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার কিছু ইনফরমেশনও দরকার। ঐ সঙ্গে নিয়ে আসব।

গাড়িতে নিশাত আরেক বার বলল, রিপোর্ট কী পাওয়া গেছে? নুরুদ্দিন প্রশ্নের জবাব দিলেন না। অন্য একটা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর সম্ভবত এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করবার ইচ্ছা নেই। নিশাত আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

 

জহির এখন ফেরে নি।

নিশ্চয়ই বন্ধুবান্ধুব জুটিয়েছে। মাঝেমাঝে বন্ধুবান্ধব জুটে যায়। বাড়ি ফিরতে রাত হয়। তার চোখেমুখে অপ্ৰস্তুত ভাব লেগে থাকে। লজ্জিত-অনুতপ্ত মানুষের আচরণ দেখতে ভালো লাগে। নিশাতের মনে হল আজ তাই দেখবে।

সে রান্না চড়াল। সামান্য কিছু রান্না করবে—ভাত, দু পিস মাছ ভাজা, ডাল। ভাগ্যিস জহির তার বাবার মতো লোজনবিলাসী হয় নি। হলে মুশকিল হত। রান্নাঘরে সময় দিতে তার ভালো লাগে না।

রান্না শেষ করে নিশাত দ্বিতীয় বার স্নান করল। তবু নিজেকে ঠিক ফ্রেশ মনে হচ্ছে না। মনের কোথাও যেন খানিকটা কাদা লেগে আছে। এই কাদা কিছুতেই দূর হবে না। তার প্রচণ্ড খিদে লেগেছিল। এক বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে খেতে বসে গেল। রাত দশটার মতো বাজে। আর অপেক্ষা করার অর্থ হয় না। জহির নিশ্চয়ই খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফিরবে।

পুষ্প কিছু খেয়েছে কি না কে জানে। হয়ত খায় নি। খোঁজ নেওয়া উচিত। কিন্তু প্রচণ্ড আলসেমিতে শরীর কেমন করছে। মনে হচ্ছে কোনোমতে বিছানায় গড়িয়ে পড়তে পারলে বেঁচে যাবে। তা ছাড়া এরা স্বামী-স্ত্রী এখন কিছু সময় একা থাকুক। এর প্রয়োজন আছে।

ভাত শেষ না-করেই নিশাত উঠে পড়ল। খিদে আছে, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করছে না। অদ্ভুত শারীরিক অবস্থা!

জহির এল রাত এগারটায়। মুখে অনুতপ্ত মানুষের লাজুক হাসি। টাই খুলতে। খুলতে বলল, মহিউদ্দিনের পাল্লায় পড়েছিলাম। জোর করে ঢাকা ক্লাবে নিয়ে গেল। ইচ্ছা ছিল না। দু পেগ হুইস্কি খেতে হল। যত বলি লিকার আমার পছন্দ না, তত জোর করে। সব মাতালরা অন্যদের মাতাল বানানোর চেষ্টা করে। মনে করে এটা তাদের ডিউটি। ভাত খেয়েছ?

হ্যাঁ। তুমি নিশ্চয়ই খেয়ে এসেছ?

হুঁ। কেমন বমি-বমি লাগছে। হুইস্কি আমার একেবারেই সহ্য হয় না।

তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন কৈফিয়ত দিচ্ছ আমার কাছে। কৈফিয়ত দেবার কিছু নেই। খেতে ইচ্ছা করলে তুমি খাবে। মাতাল হতে চাইলে হবে। তোমার জীবন হচ্ছে তোমার, আমারটা আমার।

জহির বিস্মিত হয়ে বলল, তার মানে?

মানে কিছু নেই।

মনে হচ্ছে তুমি খুব রেগে গেছ।

না, আমি মোটও রাগি নি। এর আগেও তুমি অনেক বার লিকার খেয়ে বাড়ি ফিরেছ। কখনো আমি কিছু বলি নি। বলেছি?

তা বল নি, কিন্তু মুখ অন্ধকার করেছ। মুখ অন্ধকার করার চেয়ে বলে ফেলা ভালো।

আজও কি আমার মুখ অন্ধকার মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ।

দুঃখিত। মুখ অন্ধকার করতে চাই নি। হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়। তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছ না। বিশ্রাম নাও।

জিনিসটা আমার সহ্য হয় না, মাতালের পাল্লায় পড়ে……কড়া করে এক কাপ কফি করতে পারবে?

হ্যাঁ, পারব।

নিশাত রান্নাঘরে ঢুকল। কফি বানাল। টেবিলের উপর থেকে খাবারদাবার ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখল। জহির এসে উকি দিল রান্নাঘরে।

নিশাত, তোমার টেলিফোন। মোহাম্মদপুর থানা থেকে ইন্সপেক্টর নুরুদ্দিন তোমাকে চাচ্ছেন। ব্যাপারটা কি?

ব্যাপার কিছু না।

ব্যাপার কিছু না মানে? দুপুর-রাতে থানা থেকে তোমাকে টেলিফোন করবে। কেন? হয়েছেটা কি?

বললাম তো কিছু হয় নি।

নিশাত টেলিফোন ধরল। ইন্সপেক্টর নুরুদ্দিন বললেন, সরি, অনেক রাতে টেলিফোন করলাম।

অসুবিধা নেই। আমি জেগেই ছিলাম।

আমরা মিজানকে এই কিছুক্ষণ আগে গ্রেফতার করেছি, এই খবরটা আপনাকে দিলাম। আপনি যদি এঁকে খবরটা দেন, উনি হয়তো খুশি হবেন।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরেকটা কথা আপনি বারবার জানতে চাচ্ছিলেন যে, মেডিকেল রিপোর্টে কিছু পাওয়া গেছে কি না। কিছু পাওয়া যায় নি।

সে-কী।

এইসব ব্যাপারে সাধারণত ধস্তাধস্তি হয়। জখম থাকে ভিক্টিমের গায়ে। কামড়ের দাগ থাকে। সে-সব কিছুই নেই।

ও অজ্ঞান ছিল?

হ্যাঁ, তাই। আমি বুঝতে পারছি। আমাদের এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে। কোর্টকে বোঝাতে হবে। মুশকিল কি হচ্ছে জানেন, কোনোসিমেনও পাওয়া যায় নি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তার কারণ বুঝতে পারছি। মেয়েটি নিশ্চয়ই বেশ কয়েক বার গোসল করেছে। এইসব ক্ষেত্রে মেয়েরা তাই করে। বিপদে পড়ি আমরা। চিহ্ন থাকে না।

কেইস দাঁড় করাতে পারবেন না?

আমার নাম নুরুদ্দিন-আমি খুব খারাপ লোক। আমি কেইস দাঁড় করিয়ে দেব। আপনারা খুব ভালো এক জন লইয়ার দেবেন। আচ্ছা রাখি।

নিশাত টেলিফোন রেখে দিল। জহির তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে থমথমে গলায় বলল, কি হয়েছে?

পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটি রেপ্‌ড্‌ হয়েছে।

তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? তোমাকে টেলিফোন করেছে কেন?

আমি মেয়েটিকে পুলিশের কাছে নিয়ে গিয়েছি।

তুমি নিয়ে গেছ। কেন? তুমি কেন? তোমার কিসের মাথাব্যথা?

নিশাত চুপ করে আছে। জবাব দিচ্ছে না। এক বার ছোট্ট একটা হাই তুলল। জহির বলল, কথা বলছ না কেন?

তুমি সুস্থ না। কাজেই কথা বলছি না।

আমি সুস্থ না?

না। তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছ না। যা মনে আসছে বলছ। এখন আমি তোমার কোনো কথার জবাব দেব না।

নিশাত শোবার আয়োজন করছে। ঝাড়ন দিয়ে বিছানা ঝাড়ছে। মশারি জলে। কড়া বাতি নিভিয়ে নীল বাতি জ্বালাল, যেন কিছুই হয় নি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার যেন কোন অস্তিত্ব নেই। নিশাত মশারির ভেতর থেকে বলল, এস, শুয়ে পড়। রাত কম হয় নি।

জহির হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ঘুমুতে এল। কোমল গলায় বলল, ঘুমিয়ে পড়েছ?

না, চেষ্টা করছি।

কিছু মনে করো না নিশাত। হঠাৎ মাথা এলোমেললা হয়ে গেল। আই অ্যাম সরি।

আমি কিছু মনে করি নি।

জহির একটা হাত নিশাতের গায়ে তুলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। নিশাত খুব সাবধানে হাতটা সরিয়ে দিল। স্পর্শ সবসময় সুখকর হয় না। নিশাতের ঘুম আসছে না। অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে খুব একা লাগছে।

সে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আকাশে খুব তারা। ঝলমল করছে। আকাশ। কত নক্ষত্ৰ কত ছায়াপথ। সীমাহীন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একজন মানুষের নিঃসঙ্গতাও কি সীমাহীন হয়?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ