পুষ্পদের বাড়িওয়ালা আওলাদ সাহেব একজন স্কুল-টীচার। স্কুল-টীচার হয়েও তিনি শুধুমাত্র নিজের রোজগারে ঢাকায় দুটি বাড়ি করেছেন। একটি সোবহানবাগে, অন্যটি কল্যাণপুরে। কল্যাণপুরের বাড়িতে তিনি নিজে থাকেন। সোবহানবাগের বাড়িটা ভাড়া দেন। বর্তমানে চেষ্টা-তদবির করছেন লোনের জন্যে। লোন পেলেই বাড়ি ভেঙে চারতলা দালান তুলবেন। এই ব্যাপারটা তিনি অনেকক্ষণ ধরে রকিবকে বোঝাচ্ছেন। মাস্টারদের সবচেয়ে বড় ক্ৰটি হচ্ছে, তাঁরা সবাইকে তাঁদের ছাত্র মনে করেন। এবং মনে করেন কেউ তাঁদের কথা বুঝতে পারছেনা। আরো ভালোমতো বোঝনোদরকার। তিনি যে এই বাড়ি ভেঙে চারতলা দালান তুলতে চান, এটা রকিবকে বেশ কয়েক বার বললেন।

লোন পেয়ে গেলেই বাসা ছাড়তে হবে, বুঝতে পারতেছেন তো?

জ্বি, পারছি।

তখন এই অসুবিধা সেই অসুবিধা, এই রকম সতের ধরনের কথা বলতে পারবেন। না।

বলব না।

এইসব মুখের কথা সবাই বলে, কাজের সময় না। আমার বড় শ্যালক একটা বাড়ি করেছিল, বুঝলেন? একটা ভালো পার্টির কাছে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে। পার্টি এক বছরের ভাড়া অ্যাডভান্স দিয়ে দিল। তারপর আর ভাড়া দেয় না। ভাড়া চাইতে গেলে বলে, ভাড়া দেব কেন, বাড়ি কিনে নিলাম না!

বলেন কী?

এই হচ্ছে দেশের অবস্থা।

তারপর আপনার বড় শ্যালক কী করলেন?

মামলা-মোকদ্দমা করছে, আর কী করবে? দু বছর হয়ে গেল—এক পয়সা ভাড়া দেয় নাই।

আমাকে দিয়ে ঐ ভয় নেই। এক তারিখে বেতন পাব, দুই তারিখে বাড়িভাড়া শোধ। সামনের মাসের এক তারিখে চলে আসব।

এই মাসটা আমি কী করব? আসতে হয় এই মাসে আসবেন। গোটা মাসের ভাড়া দেবেন। আর যদি তা না চান, মামলা ডিসমিস। বুঝলেন?

মামলা ডিসমিস করার দরকার নেই, আমি এই মাসেই আসব।

ভালো কথা, চাবি নিয়ে যান। আমি সপ্তাহে একদিন এসে বাড়ি দেখে যাব। বাড়ি হচ্ছে নিজের সন্তানের মতো। দেখাশোনা না করতে পারলে ভালো লাগে না। আপনার স্ত্রীকে বলে দেবেন।

কি বলে দেব?

এই যে সপ্তাহে-সপ্তাহে আসব, এইটা আর কি।

জ্বি, বলে দেব।

উঠবেন কবে?

দুই-এক দিনের মধ্যে।

 

পুষ্প চৈত্র মাসে বাড়িতে উঠতে রাজি হল না। চৈত্র মাসে নাকি নতুন কোন কাজ শুরু করতে নেই। সে মাস শেষ হলে নতুন বাড়িতে উঠবে। এর মধ্যে অল্প-অল্প করে গুছিয়ে রাখবে। নতুন বছরে সে গোছাননা বাড়িতে গিয়ে উঠবে।

বাড়ি গোছানোর পর্ব শুরু হল। বেতের চেয়ার কেনা হল। জানালার নীল পর্দা। একটা ছোট পড়ার টেবিল। বুক-কে। একটা চৌকি। ভেতরের বারান্দায় পাতা থাকবে। হঠাৎ আত্মীয়স্বজন এসে পড়লে থাকবে। পুষ্প তার নিজের টাকা ভেঙে রান্নাঘরের জন্যে একটা মিটসেফ কিনল। প্লাস্টিকের লাল রঙের বালতি।

নতুন সংসার শুরু করার প্রচণ্ড আনন্দ আছে। পুষ্প ছোটখাটো একটা-কিছু কেনে, আনন্দে চোখ ছলছল করতে থাকে। দোকানে গেলেই বেহিসাবী হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কয়েক বার এরকম হয়েছে। এক শ পঁচিশ টাকা দিয়ে কিনেছে চিনামাটির লবণদান। জিনিসটা এত সুন্দর যে এতে লবণ রাখতে মায়া লাগে। সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে। প্রায়ই সে ভাবে, তার যদি প্রচুর টাকা থাকত, কী সুন্দর করেই-না সে ঘর সাজাত! যে-ই দেখত সে-ই মুগ্ধ হয়ে যেত। এক দিন নিশ্চয়ই তার টাকা হবে। প্রচুর টাকা। তখন হয়তো ঘর সাজাতেই মন চাইবে না।

পুষ্প ছেলেকে কোলে নিয়ে নিশাতের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে কলিংবেল টিপল। সে আজ একটা বিশেষ কারণে এসেছে। পল্টুকে এখানে রেখে যাবে যাত্রাবাড়িতে। তার নানিজানকে নিয়ে এসে তার নতুন সংসারের শুরুটা দেখাবে।

কি ব্যাপার পূ? বেশ কদিন পর তোমাকে দেখলাম?

খুব ব্যস্ত আপা। আমাদের নতুন বাসাটা সাজাচ্ছি।

কী রকম সাজাচ্ছ, এক দিন গিয়ে দেখে আসতে হয়।

আপনি কি সত্যি যাবেন?

হ্যাঁ, যাব। তোমার জন্যে একটা ছবি আঁকছি, সেই ছবি তোমাদের বাসায় সুন্দর একটা জায়গায় টাঙিয়ে দিয়ে আসব।

কি ছবি আপি? একটু দেখি?

না, এখন দেখা যাবে না।

আপা, আপনি কি পল্টুকে একটু রাখবেন? ঘন্টা দুয়েকের জন্যে।

ঘন্টা দুয়েকের জন্যে তো রাখতে পারব না। কারণ এখন যাচ্ছি মার বাসায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব। সন্ধ্যা পর্যন্ত রাখতে চাইলে রেখে যাও।

তা হলে তো আপা আরো ভালো হয়।

খুব সাজগোজ করেছ দেখছি! যাচ্ছ কোথায়?

নানিজানের কাছে যাব। তারপর তাঁকে আমার নতুন বাসা দেখাতে নিয়ে আসব।

চমৎকার!

এই ব্যাগে ওর বাড়তি জামা আর প্যান্ট আছে।

টেবিলের উপর রেখে দাও।

আমি যাই আপা?

যাও।

যেতে গিয়েও পুষ্প হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল, আপনি এত ভালো কেন আপা বলুন তো? জবাবের জন্যে অপেক্ষা করল না। ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল।

একটা ভুল হয়ে গেছে। রকিব যদি কোনো কারণে অফিস ফাঁকি দিয়ে চলে আসে, তা হলে ঘর বন্ধ দেখলে রেগে যাবে। একটা চিঠি লিখে দরজার সামনে টাঙিয়ে যেতে হবে। অবশ্যি চিঠি দেখলেও সে রাগ করবে। তবে নির্বোধ বলে গাল দিতে পারবে না। সে তো বুদ্ধি করে চিঠি লিখে যাচ্ছে।

পুষ্প লিখল, আমি নিজানকে দেখতে যাচ্ছি। চারটা বাজার আগেই চলে আসব। রাগ করবে না কিন্তু।

শেষ লাইনটা লেখা কি ঠিক হচ্ছে? অন্য কেউ যদি পড়ে? লাইনটা কাটতে ইচ্ছা। করছে না। আবার রাখতেও অস্বস্তি লাগছে।

ভাবি আসব? অধমের নাম মিজান—যদি ভুলে গিয়ে থাকেন। মিজানুর রহমান।

পুষ্প মুখ তুলে ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসল।

কোথাও বেরুচ্ছেন বুঝি? সাজসজ্জা দেখে তা-ই মনে হচ্ছে।

জ্বি।

সঙ্গে গাড়ি আছে, আসুন নামিয়ে দিই।

গাড়ি লাগবে না। আমি কাছেই যাব। ঐ তো পাশের বাসা।

আপনি কি আমাকে ভয় পান ভাবি?

জ্বি-না। ভয় পাব কেন? চা করে আনি? চা খাবেন?

আনুন। আপনার পুত্র কোথায়?

ওকে পাশের বাসায় নিয়ে গেছে, এক্ষুণি দিয়ে যাবে।

আই সী।

পুষ্প চা বানিয়ে নিয়ে এল। মিজান চেয়ারে বসে আছে। মুখের ভঙ্গি গম্ভীর। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট কিন্তু সিগারেট টানছে না। সে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল।

আপনি কি জন্যে আমাকে ভয় পান?

ছিঃ, কী বলেন ভাই! ভয় পাব কেন?

ভয় পান বলেই তো মিথ্যা কথাটা বললেন, ছেলে পাশের বাসায় আছে, এক্ষুণি দিয়ে যাবে যাতে আমি বুঝতে পারি যে এখানে আমাকে ভদ্র হয়ে থাকতে হবে। বেচাল কিছু করা যাবে না।

পুষ্প ক্ষীণ গলায় বলল, আমি সত্যি কথাই বলছি ভাই। নিশাত আপা এক্ষুণি বাবুকে দিয়ে যাবে।

মিজান সিগারেট ফেলে দিয়ে চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বলল, অন্ধকারে একটি সুন্দরী যেমন অসুন্দরী মেয়েও তেমনা পার্থক্যটা হচ্ছে আলোতে।

আপনি এ-সব কী বলছেন?

সত্যি কথাই বলছি। আপনার কি ধারণা, সুন্দরী মেয়ে আমি এর আগে দেখি নি? আপনাকে প্রথম দেখলাম?

ছিঃ ছিঃ ভাই। আমি যদি কোনো কারণে আপনার মনে কষ্ট দিয়ে থাকি আমাকে মাফ করে দিন।

আমাকে দেখলেই আপনি এমন একটা ভাব করেন যেন আমি আপনাকে রেপ করতে এসেছি।

পুষ্প কেঁদে ফেলল। সে কী বলবে বা কী করবে বুঝতে পারছে না। সিঁড়িতে শব্দ শোনা যাচ্ছে। নিশাত আপা বাবুকে নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। সে কি চিৎকার করে নিশাত আপাকে ডাকবে? এটা কি ঠিক হবে? এই লোকটি হয়তো ঠাট্টা করছে। এর

অভ্যাস হচ্ছে ঠাট্টা করা। সবার সঙ্গেই ইনি ঠাট্টা করেন। রকিব কত বার বলেছে।  পুষ্প।

পুষ্প চমকে উঠল। কী আশ্চর্য, নাম ধরে ডাকছে কেন? পুষ্প থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে কি ছুটে বেরিয়ে যাবে?

নাম ধরে ডাকলাম বলে চমকে উঠলেন নাকি? চমকে ওঠার কিছু নেই। মানুষের নাম দেওয়া হয় ডাকার জন্যে। তা ছাড়া কেউ তো তা জানতে পারছে না। আমি যদি এখন আপনাকে আরো মধুর কোনো নামে ডাকি তা হলেও কিছু যায়-আসে না।

আপনার কী হয়েছে। আপনি এরকম কথা বলছেন কেন?

আমার কিছুই হয় নি। আমি ভালো আছি। আপনি কাঁদছেন কেন?

মিজান ভাই, আজ আপনি চলে যান। অন্য আরেক দিন আসবেন।

এসেছি যখন একটু বসি। রোজ-রোজ আসা তো মুশকিল। কই, আপনার বান্ধবী তো এখনো বাচ্চা নিয়ে এল না?

মিজান উঠে দাঁড়াল। হয়তো এবার চলে যাবে। শুধু-শুধুই সে ভয় পাচ্ছিল। পুষ্প শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। মিজান দরজার সামনে কয়েক মুহুর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে রইল। এক বার তাকাল পুষ্পের দিকে এবং খুব সহজ ভঙ্গিতে দরজার হুক তুলে দিল।

পুষ্প কাঁপা গলায় বলল, দরজা বন্ধ করছেন কেন?

কেন বন্ধ করছি বুঝতে পারছ না?

মিজান ভাই, আমি আপনার পায়ে পড়ছি।

তুমি শুধু-শুধু ভয় পাম্। কেউ কিছু জানবে না। আমি তো কাউকে কিছু বলবই না, তুমিও মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারবে না। লোকলজ্জা বড় কঠিন জিনিস।

পুষ্প চিৎকার করে উঠতে চাইল, মুখ দিয়ে স্বর বেরুল না। রান্নাঘরের দিকে ছুটে যেতে চাইল, ছুটে যেতে পারল না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন। এই লোকটি তার গায়ে হাত দিচ্ছে কেন? এ কে? আমি চিৎকার করতে চাই। আমাকে চিৎকার করতে দাও। এই লোক আমাকে চিৎকার করতে দিচ্ছে না। মুখ চেপে ধরে আছে। আমা, আম্মা আমাকে বাঁচান আমা। আমি মরে যাচ্ছি।

পুষ্প জ্ঞান হারাল। মিজান তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট ধরাল। আয়নায় মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরবে বলে মনে হচ্ছে না। সিগারেটটা ধীরেসুস্থে শেষ করা যেতে পারে।

আয়নায় পুষ্পকে দেখা যাচ্ছে। অচেতন অর্ধনগ্ন একটি রূপবতী তরুণী হাত-পা এলিয়ে পড়ে আছে। শঙ্খের মতো সাদা বুক নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে। অপূর্ব দৃশ্য! মিজান মুগ্ধ হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃশ্যটি সরাসরি দেখার চেয়ে আয়নায় দেখতে বেশি ভালো লাগছে।

মিজান সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে শোবার ঘরের দরজা ভিড়িয়ে দিল, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

পুষ্প অচেতন অবস্থাতেই বিড়বিড় করে তার মাকে ডাকছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ