রাত আটটা বাজতেই পুষ্পর ঘুম পেয়ে যায়। নটার দিকে সেই ঘুম এমন হয় যে, সে চোখ মেলে রাখতে পারে না। ঘুম কাটানোর কত চেষ্টা সে করে। কোনোটাই তার বেলায় কাজ করে না। অথচ রকিব রোজ ফিরতে দেরি করে। আজও করছে।

এখন বাজছে নটা তেত্রিশ। আজ বোধহয় দশটাই বাজাবে। পুষ্প চোখে পানি দিয়ে। এল। জিভে লবণ ছোঁয়াল। জিভে লবণ ছোঁয়ালে নাকি ঘুম কাটে। তার কাটছে না। আরো যেন বাড়ছে।

রকিব ফিরল দশটায়। বিরক্ত মুখে বলল, কী যে তোমার ঘুম, আধঘন্টা ধরে বেল টিপছি। তাড়াতাড়ি গোসলের পানি দাও। পুষ্প ঘুম-ঘুম চোখে রান্নাঘরে ছুটে গেল। প্ৰচণ্ড গরমেও রকিবের গোসলের পানিতে এক কেতলি ফুটন্ত পানি ঢালতে হয়। একটু ঠাণ্ডা পানি গায়ে লেগেছে কি লাগে নি, লোকটির ঠাণ্ডা লেগে যায়। খুখুক কাশি, গলা ব্যাথা। কী অদ্ভুত মানুষ।

রকিব বাথরুমে ঢুকে পড়ল। বাথরুমের দরজা বন্ধ করল না। রকিবের স্বভাব হচ্ছে গোলস করতে-করতে খানিকক্ষণ কথা বলা। বাথরুমের দরজা খোলা এই কারণেই। পুষ্পের এটা ভালো লাগে না। বলেছেও কয়েক বার।

রকিব কান দেয় নি।

পুষ্প, বাড়ি একটা পাওয়া গেছে।

তাই নাকি?

দুটো রুম। নেট দেওয়া বারান্দা। গ্যাস ইলেকট্রিসিটি দুই-ই আছে।

ভাড়া কত?

কম। খুবই কম।

কত?

আন্দাজ কর তো দেখি?

পনের শ?

রকিব মনের আনন্দে খানিকক্ষণ হাসল। যেন সে মজা পাচ্ছে।

বল না কত?

বার। ওনলি টুয়েলভ হাড্রেড।

সত্যি?

হুঁ। একটা সমস্যা আছে। সাময়িক সমস্যা। ফর দা টাইম বীইং একটু অসুবিধা হবে। ধর তিন-চার মা। তার পরই সমস্যার সমাধান।

সমস্যাটা কী?

পানির কানেকশন দেয় নি। মাস তিনেক লাগবে। ওয়াসার ব্যাপার।

পুষ্প অবাক হয়ে বলল, পানি ছাড়া চলবে কীভাবে?

সব ঠিক করে রেখেছি। একটা ড্রাম কিনে ফেলব। লোক রাখব। ঠিকা লোক। তার কাজই হবে সকালবেলা ড্রাম ভৰ্তি করে দেওয়া। এক ড্রামের বেশি পানি তো আমাদের লাগবে না।

পুষ্প ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। এক বার ভাবল বলবেপানি-ছাড়া বাড়িতে যাব না। বলল না, কারণ বললেই চেঁচামেচি শুরু করবে। রাতে হয়তো ভাতও খাবে না। ধীরেসুস্থে বললেই হবে। পুষ্প খাবার বাড়তে শুরু করল। খাবারের আয়োজন খুবই খারাপ। ডাল চচ্চড়ি আর ভর্তা।

পুষ্প বলল, আস্তে আস্তে খাও। আমি চট করে একটা ডিম ভেজে আনি।

ডিম লাগবে না। এতেই হবে।

না, হবে না।

তা হলে ঐ সঙ্গে দুটো শুকনো মরিচ ভেজে আনবে।

রকিবের চোখ উজ্জ্বল। বাড়ির সমস্যা মিটে গেছে, এই আনন্দ ফুটে বেরুচ্ছে। সে ভাত মাখতে-মাখতে বলল; পানির এত দরকারও আমাদের নেই। মরুভূমিতে লোকজন কী করে? এক গ্রাস পানি হলে তাদের তিন দিন চলে যায়।

আমরা তো আর মরুভূমিতে থাকি না।

তা না থাকলাম। তাই বলে অপচয় করব?

পুষ্প এক সময় বলল, তোমার বন্ধু মিজান সাহেবকে বল না, উনি যে এক বার বলেছিলেন বাড়ি দেখে দেবেন।

ওর কথা বাদ দাও। এক শ ধান্ধায় থাকে। ঝোঁকের মাথায় বলেছিল, এখন হয়তো মনেও নেই।

তবু এক বার বলে দেখা

আচ্ছা বলব। বাসায় চা খেতে এক দিন ডাকব। তখন মনে করিয়ে দিলেই হবে। লাভ হবে না। ঢাকা শহরে দুই হাজারের নিচে বাড়ি নেই। এটা হয়ে গেছে বড়লোকের শহর।

শোবার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া রকিবের স্বভাব। মশারির ভেতর থেকে আধখানা শরীর বের করে আয়েশ করে সিগারেট খায়। সিগারেটের শেষ অংশ হাতে থাকতে থাকতেই তার ঘুম এসে যায়। আজ রুটিনের সামান্য ব্যতিক্রম হচ্ছে। রকিব খাতাকলম নিয়ে বসেছে। পুষ্প বলল, চিঠি লিখছ?

উঁহু, একটা হিসাব। জটিল হিসাব।

কিসের হিসাব?

বার শ টাকা যদি বাড়িভাড়া হয়, তা হলে সেভিংস কিছু থাকে কি না। আমার খরচটা ধরি–বাসভাড়া, হাত-খরচ, পান-সিগ্রেট–ধর দুই শ।

দু শ-তে হবে না, তিন শ।

আচ্ছা, ধর তিন শ। চাল আমাদের কতটুকু লাগে? আধ মণ লাগে? আধ মণ তো লাগার কথা না। ধর আধ মণই। আধ মণের দাম কত? সরেসটা ধরবে, না প্লেইন? ইরি কত করে মণ।

সাড়ে চার শ টাকা মণ। আধ মণ হচ্ছে দুই শ পঁচিশ।

ধরলাম দুই শ পঁচিশ।

পুষ্প বলল, এস শুয়ে পড়ি। সকালে হিসাবনিকাশ করবে। ঘুম পাচ্ছে। বাবু দুপুরে ঘুমুতে দেয় নি।

কতক্ষণ আর লাগবে। খুব টাইট বাজেটের ভেতর দিয়ে চললে আমার মনে হয় কিছু সেভ করা যাবে।

পুষ্প মশারির ভেতর ঢুকে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার, শোয়ামাত্র তার ঘুম কেটে গেল। মনে হতে লাগল তার মতো সুখী মেয়ে এই পৃথিবীতে নেই। ছোট্ট সংসার। ভালোমানুষ ধরনের স্বামী। শাশুড়ি-ননদের কোনো ঝামেলা নেই। এর চেয়ে বেশি সুখী একটি মেয়ে কী করে হয় তার জানা নেই।

পুষ্প।

বল।

প্রতি মাসে একটা-দুটা প্রাইজবন্ড কিনে রাখব, বুঝলে। লেগে গেলে কেল্লা ফতে। আমাদের অফিসের এক জন দশ হাজার টাকা পেয়ে গেল। হাজার পাঁচেক টাকা সবসময় হাতে থাকা দরকার। কখন কি ঝামেলা হয় কিছুই বলা যায় না।

পুষ্প চুপ করে রইল। এক বার ভাবছিল বলবে, আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা আছে। আমার নানি দিয়েছেন। বলল না। নানিজান হজ্বে যাবার সময় তাদের তিন বোনের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নিজস্ব সম্পত্তির পুরোটাই বিলি-ব্যবস্থা করে গেলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল হজ্ব করে তিনি ফিরবেন না। ইশতেখারা করে নাকি এই খবর জেনেছেন। হজ্ব করে তিনি পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছেন। এখন একেক ছেলের সংসারে কিছু দিন করে থাকেন আর তাঁদের বিরক্ত করে মারেন। কারো সঙ্গেই তাঁর বনে না। পুষ্পের খুব ইচ্ছা নানিজানকে এ–বাড়িতে এনে কিছু দিন রাখে। সাহসে কুলায় না। কে জানে এসেই যদি নাতজামাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করেন। তা হলে বড় বিশ্রী ব্যাপার হবে।

রকিব মশারির ভেতর এসে ঢুকল। পুষ্প বলল, বাতি নেভালে না? বাতি নিভিয়ে আস।

একটু পরে নেব।

পুষ্পের লজ্জা করতে লাগল। রকিবের বাতি না-নিভিয়ে মশারির ভেতর ঢোকার অন্য অর্থ আছে। পুষ্প খুব সাবধানে তার ছেলের মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে দিল। সে যদি জেগে ওঠে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে। পুষ্প ক্ষীণ স্বরে বলল আমি বাতি নিভিয়ে দিয়ে আসি?

উঁহু। অন্ধকারে আমার ভালো লাগে না।

বাবু উঠে যাবে।

উঠবে না।

রকিব পুষ্পকে কাছে টেনে নিল। তার মুখে সিগারেটের কড়া গন্ধ। অন্য সময় এই গন্ধে পুষ্পের বমি আসে। এখন আসছে না। বরং ভালো লাগছে। রকিব কানের কাছে মুখ নিয়ে গাঢ় আদরের কথা বলছে। এই সময়ের আদরের কথার আসলে তেমন গুরুত্ব নেই, তবু পুষ্পের শুনতে ভালো লাগে। তারও অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে বলতে পারে না। লজ্জা লাগে। তবে অর্থহীন কিছু কথাবার্তা এই সময়ে সে বলে। রকিব মন দিয়ে শোনে কি না সে জানে না, তবে প্রতিটি কথারই উত্তর দেয়।

পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা হল।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, অনেক কথা বললেন। চা খাওয়ালেন। বাবুকে খুব আদর করলেন। বিসকিট দিলেন।

ভালোই তো।

ওঁকে দেখতে অহঙ্কারী মনে হয়, কিন্তু আসলে অহঙ্কারী না। বাবুর পল্টু নামটা ওঁর পছন্দ হয় নি।

তাঁদের ছেলেপুলেদের নাম কি?

ছেলেমেয়ে নাই। যখন হবে খুব সুন্দর নাম নিশ্চয়ই রাখবেন।

রাখুক যা ইচ্ছা। আমাদের পর্দুই ভালো। মেয়ে হলে মেয়ের নাম রাখব খুন্তি।

কী নাম রাখবে?

খুন্তি।

কী যে তুমি বল! এই দেখ না বাবু মনে হয় উঠে যাচ্ছে। কেমন পা নাড়াচ্ছে দেখ না।

ও ঘুমাচ্ছে মড়ার মতো। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে উঠবে না।

না না, বুঝতে পারছ না, ওর ঘুম ভাঙার সময় হয়ে গেছে।

উঁহু, হয় নি।

বাতিটা নেভাও, তোমার পায়ে পড়ি।

নেভাব না।

বাবু ঠিক এই সময় জেগে উঠল। বিকট স্বরে কেঁদে উঠল। পুষ্প থমথমে গলায় বলল, এখন শিক্ষা হল তো!

রকিব হাসছে। মনে হচ্ছে তার শিক্ষা এখনো হয় নি।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ