অলিকের ক্লাস ছিল এগারটায়-পোয়েট্রি ক্লাস। আজ পড়ানো হবে টেড হিউজের থট ফক্স। রাতের বেলা সে একবার পড়ল। পড়ে মনে হল—বাহ বেশ তো। সুন্দর কবিতা।

Till with a sudden hot stink of fox
It enters the dark hole of the head.
The window is starless still: the clock ticks,
The page is printed.

এর বাংলা কী হবে? কবির মাথায় হঠাৎ কবিতার একটা বোধ ঢুকে পড়ল। কি অদ্ভুত ভাবেই না বোধটা এল। যেন—বোধ হচ্ছে নিশাচর এক শেয়াল। যে শেয়াল তার গায়ের তীব্র গন্ধ নিয়ে অন্ধকার গর্তে ঢুকে পড়ে।

কবিতার বোধ জাতীয় ব্যাপারগুলো সাধারণত স্বগীয় বলে মনে করা হয়, কিন্তু এই কবি কী অদ্ভুত উপমাই না দিলেন। শেয়ালের গায়ের তীক্ষ্ণ গন্ধের কথা বললেন। আসলেই কি শেয়ালের গায়ে কোনো গন্ধ আছে, না, এটাও কবির কল্পনা?

ময়নার মা চা নিয়ে এসেছে। সে ভয়ে ভয়ে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। ক্ষীণ স্বরে বলল, আইজ ইউনিভার্সিটিতে যাইবেন আফা?

হ্যাঁ যাব। আচ্ছা ময়নার মা, তুমি শেয়াল দেখেছ?

ময়নার মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

শেয়াল দেখ নি?

দেখছি আফা।

শেয়ালের গায়ে কি গন্ধ আছে?

ক্যামনে কই আফা।

ঠিক আছে তুমি যাও।

অলিকের মন খারাপ হয়ে গেল। তার একুশ বছর বয়স। অথচ সে শেয়াল দেখে। নি। চিড়িয়াখানায় কি শেয়াল আছে? থাকলে একবার দেখে আসা যেত। চিড়িয়াখানায় টেলিফোন করে দেখবে নাকি? অলিক চায়ের পেয়ালা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা। হতেই বোরহান সাহেবের মুখোমুখি হয়ে গেল।

অলিকের বাবা বোরহান সাহেব ইদানীং মাথায় কলপ দিচ্ছেন। মাথার চুল হঠাৎ সব চকচকে কালো হয়ে যাওয়ায় তাঁর বয়স অনেকখানি কম মনে হয়। কম বয়েসী একটা ভাব তাঁর চলা ফেরায়ও চলে এসেছে। এখন তাঁর গায়ে নীল রঙের একটা হাওয়াই শার্ট। তিনি হাসিমুখে বললেন, মাই ডিয়ার মাদার, তুমি কেমন আছ?

ভালো আছি। তুমি যুবক সেজে কোথায় যাচ্ছ বাবা?

বোরহান সাহেব লজ্জা পেয়ে গেলেন। অপ্ৰস্তুত গলায় বললেন, শার্টটা কি বেশি। ছেলেমানুষী হয়ে গেল?

কিছুটা হয়েছে।

আগলি দেখাচ্ছে?

হুঁ।

বলিস কী—আমার কাছে তো মনে হচ্ছে সোবার কালার। আটচল্লিশ বছর বয়সে এই কালার পরা যায়।

আটচল্লিশ না বাবা পঞ্চাশ।

ও সরি। ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে আটচল্লিশ। কাগজপত্রের বয়সটাকেই কেন জানি সব সময় সত্যি বয়স মনে হয়।

অলিক বাবার দিকে তীক্ষ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হালকা গলায় বলল, বয়স কমানোর দিকে তুমি হঠাৎ এমন মন দিলে কেন? তোমার কি অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে?

বোরহান সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের তুখোড় সচিবদের একজন। যে কোনো জটিল পরিস্থিতি তিনি ঠাণ্ডা মাথায় সামলে নিতে পারেন। তাঁকে নিয়ে প্রচলিত কিছু-কিছু গল্প সচিবালয়ে প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে। সেই গল্পের একটি হচ্ছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়কার।

সচিবদের বৈঠক বসেছে। প্রেসিডেন্ট এসে ঢুকলেন এবং চুরুট হাতে বোরহান সাহেবকে দেখে শীতল গলায় বললেন, চুরুট ফেলে দিন।

বোরহান সাহেব সহজ ভঙ্গিতে বললেন, কেন স্যার?

চুরুটের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না।

একসঙ্গে কাজ করতে হলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয় স্যার। আপনি যেমন আমাদের অনেক কিছু সহ্য করতে পারেন না আমরাও আপনার অনেক কিছু সহ্য করতে পারি না। তবু চুপ করে থাকি।

আমার কোন্ জিনিসটি আপনারা সহ্য করতে পারেন না?

ঘরের ভেতরে মিটিং চলার সময়ও আপনি সানগ্লাস পরে থাকেন এইটি।

জিয়াউর রহমান সাহেব সানগ্লাস খুলে টেবিলে রাখলেন। বোরহান সাহেব তার চুরুট ফেলে দিলেন। মিটিং শুরু হল।

বোরহান সাহেব মানুষটা স্মার্ট। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত স্মার্ট। তবু নিজের মেয়ের কাছে মাঝে-মাঝেই তিনি অসহায় বোধ করেন। এই মুহূর্তে করছেন। অলিক জানতে চাচ্ছে-তোমার কি অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে?

তাঁর উচিত খুব সহজভাবে এর উত্তর দেয়া। কিন্তু তিনি দিতে পারছেন না। প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না—অলিকের সঙ্গে লুকোচুরি চলবে না। তিনি খুব ভালো করেই জানেন তাঁর এই পাগলা ধরনের মেয়েটি তাঁর মতোই স্মার্ট।

বোরহান সাহেব প্রাণহীন গলায় বললেন, পরে তোমার সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলব।

ঠিক আছে।

আজ রাতেই কথা বলা যাবে।

ওকে।

ফাদার এন্ড ডটার, ক্লোজ ডোর টক।

তুমি এত নার্ভাস হচ্ছ কেন বাবা? তুমি কী বলবে আমি জানি। তুমি চাইলে এখনো কথা বলতে পার। আমার হাতে সময় আছে। আমার ক্লাস এগারটায়। মনে হচ্ছে এই ক্লাসটা করব না।

ক্লাস না করে কী করবে? ঘরে বসে থাকবে?

হ্যাঁ।

সারাদিন ঘরে বসে কী কর?

কিছু করি না।

তোমার কি বন্ধু-বান্ধব নেই?

এক জন আছে।

মাঝে-মাঝে ওর সঙ্গে গল্প-টল্প করতে পার না?

আমি ওর ঠিকানা জানি না বাবা।

সে কী।

জানি না বলাটা ঠিক হচ্ছে না। এক সময় জানতাম। ওদের বাসায়ও একদিন গিয়েছিলাম। ওর দাদী আমাকে বলল, মর হারামজাদী।

কি সব পাগলের মতো কথা বার্তা।

ঠিক বলেছ বাবা। মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

বোরহান সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মেয়ের প্রতি যথেষ্ট সময় দেয়া হচ্ছে না, আরো সময় দেয়া দরকার। প্রচুর সময়। মেয়েকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলে কেমন হয়? ছুটি কি পাওয়া যাবে?

 

টেলিফোনের শব্দে অলিকের ঘুম ভাঙল। টেলিফোন করেছেন বড় মামীর মেয়ে শি। শিকে অলিক পছন্দ করে না আবার করেও। অর্থাৎ শিপ্রার কিছু কিছু ব্যাপার তার ভালো লাগে তার মধ্যে একটা হচ্ছে নতুন কিছু করা। এমন কিছু যা আগে কোনো মেয়ে করে নি। মুশকিল হচ্ছে এ রকম নতুন কিছু সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। শালবনে রাত জেগে জ্যোৎস্না দেখা বা নকল দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে ছেলে সেজে ঢাকা থেকে গাড়ি করে টঙ্গি যাওয়া তেমন নতুন কিছু না।

হ্যালো অলিক কেমন আছিস?

ভালো।

ঘুমুৰ্চ্চিস নাকি?

হ্যাঁ ঘুমাচ্ছি। ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কথা বলছি।

ভ্যাট ফাজিল—একটা একসাইটিং ব্যাপার হয়েছে। এক জন ভবঘুরের সঙ্গে পরিচয় হল।

কার সঙ্গে পরিচয়।

ভবঘুরে। তোদের ইংরেজি সাহিত্যে যাকে বলা হয় ভ্যাগাব। চলে আয়, তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। এখন বাসায় বসে আছে। এই মুহূর্তে দাড়ি চুলকাচ্ছে। ব্যাটার আবার রবীন্দ্রনাথের মতো লম্বা দাড়ি।

ভ্যাগাবন্ডের সঙ্গে পরিচয় করবার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ বোধ করছি না শিপ্রা।

তুই যা ভাবছিস তা না কিন্তু। ইংরেজ ভ্যাগাবন্ড।

ভ্যাগাবন্ড হচ্ছে ভ্যাগাবন্ড, সে ইংরেজই হোক আর বাঙালিই হোক।

অলিক, তুই বুঝতে পারছি না, এই ব্যাটা দস্তয়েভস্কির উপন্যাস থেকে উঠে আসা চরিত্র।

দস্তয়েভস্কির কোনো উপন্যাস তো তুই পড়িস নিজানলি কী করে উপন্যাসের চরিত্রগুলি কেমন?

তোর সঙ্গে বক-বক করতে ভালো লাগছে না। আমি ব্যাটাকে নিয়ে আসছি। ব্যাটার চোখের দিকে তাকালে তুই পাগল হয়ে যাবি–sky blue. রওনা হচ্ছি কিন্তু।

 

অনেক রাতে বোরহান সাহেব মেয়ের ঘরে ঢুকে হাসি মুখে বললেন—কোন এক বিদেশি নাকি এসেছিল?

অলিক বলল, হ্যাঁ।

অনেক গল্প-টল্প করল?

হ্যাঁ। খুব বক-বক করতে পারে। সারা পৃথিবী ঘুরছে। আন্টার্কটিকায়ও নাকি গিয়েছিল।

বলিস কি?

হ্যাঁ সত্যি। ছবি দেখাল। পেঙ্গুইন কোলে নিয়ে ছবিতার ধারণা পৃথিবীর সবচে সুন্দর দেশ হচ্ছে আন্টার্কটিকা।

সুন্দরের কী আছে? সব তো বরফে ঢাকা।

এই জন্যেই নাকি সুন্দর। ওখানে গেলেই নাকি পবিত্র ভাব হয়। আমি ঠিক করেছি একবার আন্টার্কটিকা যাব।

বেশ তো যাবি।

আন্টার্কটিকা যেতে কি ভিসা লাগে বাবা?

লাগার তো কথা না। আমি যতদূর জানি ঐটি একমাত্র মহাদেশ যেখানে পৃথিবীর সব দেশের মানুষদের অধিকার আছে।

বাহ খুব একসাইটিং তো।

বোরহান সাহেব হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, তুই একা যাবি, নাকি ঐ ইংরেজকে নিয়ে যাবি?

ওকে সঙ্গে নেব কেন? ও এক জন বাজে ধরনের লোক।

একটু আগে তো অন্যরকম বললি।

মোটও অন্যরকম বলি নি। ঐ লোকটা ফস করে আমার হাত ধরল।

ওদের মধ্যে মেয়েদের হাত ধরা তেমন দোষণীয় কিছু না।

তা জানি বাবা। কিন্তু শিপ্রা যখন আমাদের ছবি তুলতে গেল তখন সে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে দাঁড়াতে গেল। আমি দিলাম এক ধমক।

বোরহান সাহেব চুপ করে গেলেন। অলিক বলল, চমৎকার ইংরেজিতে আমি তাকে বললাম—কোনো সাদা চামড়ার লোক আমাকে জড়িয়ে ধরে, এটা আমার পছন্দ নয়। আমার গা ঘিন ঘিন করে। তুমি কালো হলে একটা কথা হত।

সত্যি বললি?

হ্যাঁ বললাম। ব্যাটার মুখটা দেখতে দেখতে ছোট হয়ে গেল। সবচে রাগ করল শি। সে বলল, এইভাবে এক জনকে অপমান করার নাকি আমার কোনো রাইট নেই। বাবা আমার কি রাইট আছে?

অবশ্যই আছে।

বোরহান সাহেব রাত একটা পর্যন্ত মেয়ের সঙ্গে গল্প করলেন। যে কথাগুলো বলতে এসেছিলেন সেগুলো বলতে পারলেন না। কথাগুলো তেমন জরুরি নয়। It can wait.

বাবা চলে যাবার পরও অলিক জেগে রইল। প্রতি সপ্তাহে একটি করে কবিতা মুখস্থ করার কথা। দুসপ্তাহ বাদ গেছে। মুখস্থ করার মতো তেমন কোনো কবিতা পাওয়া যাচ্ছে না। কোনোটাই ভালো লাগছে না।

ঘুমুতে যাবার ঠিক আগে আগে অলিক আয়নার সামনে দাঁড়াল। তার গায়ে নীল রঙের সুতির নাইটি। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাইটির ফিতা খুলে নিজের অনাবৃত দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। বাঁ দিকের পাঁজরের নিচে এবং নাভীর ডান পাশের চামড়া কেমন বিবর্ণ হয়ে ফুলে আছে। মার অসুখের প্রথম অবস্থায় ঠিক এই রকম হয়েছিল।

অলিকের শরীরটা বড় সুন্দর। অলিক নিজেই মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখেছে। এখনো দেখছে। তার দৃষ্টি বার বার ফিরে যাচ্ছে দাগ দুটির দিকে।

এই দাগ দুটিকে সে কী বলবে? চাঁদের কলঙ্ক? না-কলঙ্ক না। চাঁদের কলঙ্ক স্থির থাকে, এরা স্থির থাকবে না। বাড়তে থাকবে। বাড়তে বাড়তে থাক ঐ নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না। সুন্দর কিছু নিয়ে ভাবা যাক। শ্বেত শুভ্র আন্টার্কটিকা, নির্মল পবিত্র। কিংবা টেড হিউজের থট ফক্স। Till with a sudden sharp hot stink of Fox.

বাংলা অনুবাদ করা যায় না? কেন যাবে না? চেষ্টা করলেই হবে–

জানালার ও পাশে ছিল নিস্তব্ধ আকাশ।
চারদিকে আদিগন্ত ধূসর প্রান্তর।
সময় দাঁড়িয়ে ছিল এক পায়ে, ফেলছিল ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস।
মস্তিষ্কের লক্ষ নিওরোনে—গাঢ় অন্ধকার।
হঠাৎ উড়ে এল বোধ।
অলৌকিক স্বপ্নময় বোধ।
কবির লেখার খাতায়–গান, সুর ও স্বর।

ব্যাপারটা কেমন হল? শেয়াল বাদ পড়ে গেল না? কোথাও একটা লাইন ঢোকানো দরকার ছিল, যেখানে ঝাঁঝাল গন্ধের নিশাচর শেয়াল গর্তে ঢুকবে।

অলিক বিছানায় শুয়ে বাতি নেভানো মাত্ৰ বৃষ্টি শুরু হল। চমৎকার কাকতালীয় ব্যাপার। বৃষ্টিটা পাঁচ মিনিট আগে বা পরেও শুরু হতে পারত। তা হল না। বাতি নেভানো এবং বৃষ্টির শুরুটা হল একই সঙ্গে।

এ রকম কাকতালীয় ব্যাপার মানুষের জীবনে নিশ্চয়ই খুব বেশি আসে না।

কিংবা কে জানে হয়ত খুব বেশিই আসে, কেউ কখনো লক্ষ করে না। মানুষ কখনো কিছু লক্ষ করে না। তার চোখের সামনে কত কিছু ঘটে সে তাকিয়ে থাকে কিন্তু দেখে না। মানুষের দেখতে না পারার ক্ষমতা অসাধারণ।

অলিকের এখন একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে। তবে চিঠিটা লেখা হবে। অন্ধকারে। মুশকিল হচ্ছে অন্ধকারে চিঠি লেখার কোনো উপায় নেই। থাকলে ভালো হত।

চিঠি কাকে লেখা যায়? কবি কিটসকে লিখলে কেমন হয়? মৃত মানুষদের কাছে চিঠিপত্র লেখার আলাদা আনন্দ আছে। চিঠির উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ