বুলুদের এই বাড়ির মতো বাড়ি বোধহয় ঢাকা শহরে খুব বেশি নেই।

পুরানো আমলের হিন্দু বাড়ি। তুলসি মঞ্চ আছে। ছোট্ট একটা ঠাকুর ঘর আছে। ঠাকুর ঘরের দক্ষিণে গহীন একটা কুয়া। বাড়ির গেটে সিংহের দুটি মূর্তি।

প্রায় ত্রিশ বছর আগে, ১৯৫৮ সনে বাড়ির মালিক নিত্যরঞ্জন বাবুর কাছ থেকে। বুলুর বাবা মিজান সাহেব এই বাড়ি জলের দামে কিনে নিয়েছিলেন। এত সস্তায় বাড়ি পেয়ে মিজান সাহেবের আনন্দের সীমা ছিল না। পরে দেখা গেল নিত্যরঞ্জন বাবু এই বাড়ি দুজনের কাছে বিক্রি করেছেন এবং তৃতীয় এক জনের কাছ থেকে বায়নার টাকা নিয়েছেন। নিত্যরঞ্জন বাবুর মতো ভালোমানুষ ধরনের বোকা সোকা একটা লোক যে এই কাণ্ড করতে পারে তা মিজান সাহেব স্বপ্নেও ভাবেন নি।

মিজান সাহেবকে বাড়ির দখল নেয়ার জন্যে নানান কাণ্ড করতে হল। টাকা-পয়সা দিতে হল, কোর্ট কাছারি করতে হল। নিত্যরঞ্জন বাবুর খোঁজে একবার কোলকাতায়ও গেলেন। দেখা গেল ঠিকানাটাও ভুয়া। অনেক হাঙ্গামা করে বাড়ির দখল মিজান সাহেব পেলেন কিন্তু তাঁর কোমর ভেঙে গেল। শুরুতে তাঁর কাছে এ বাড়ি যত সুন্দর লেগেছিল বাড়িতে উঠার পর তা লাগল না। বার-বার মনে হল এই বাড়িটা ভালো না, অশুভ কিছু এখানে আছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখানে আসা উচিত হয় নি।

গেটের সিংহ দুটিকে কোনো-কোনো রাতে জীবন্ত মনে হয়। বাড়ির পেছনের কুয়া থেকে মাঝেমাঝে গভীর রাতে তিনি পানি ছিটানোর কল কল শব্দ পান। এ রকম শব্দ হবার কথা নয়। হয় কেন? তিনি গেটের সিংহ দুটি ভেঙে ফেললেন। কুয়ার কিছু করতে পারলেন না।

বুলুদের অবশ্যি এই কুয়া খুব পছন্দ। তারা যখন ছোট তখন কুয়ার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলত—টু টু টু। কুয়া সেই শব্দ অনেকগুণে বাড়িয়ে ফেরত পাঠাত। পরে সেই টু-টু খেলার অনেক রকমফের হল। দেখা গেল কুয়া শব্দ উল্টো করে ফেরত পাঠাতে পারে। বুল বলে কেঁচালে কিছুক্ষণ পরে শোনা যায়, লুবু-লুবু-লুবু। খুবই মজার ব্যাপার। এক দুপুরে বুলু কুয়ার পাড়ে বসে খুব চেঁচালচাপ, চাপ, চাপ। সেই শব্দ উল্টো হয়ে ফেরত এল—পচা, পচা, পচা। বুলুর মহা আনন্দ।

এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না। মিজান সাহেব কুয়ার ওপর ভারি পাটাতনের ব্যবস্থা করলেন। এক সময় সেই পাটাতনও গলে পচে শেষ হয়ে গেল। ততদিনে বুলুরা বড় হয়েছে। বুলুর ছোট বোন বীণা কুয়ার পাশে একটা চাঁপা গাছ লাগিয়েছে। সেই গাছও দেখতে দেখতে বড় হয়ে এক চৈত্র মাসে কিছু ফুল ফুটিয়ে ফেলল। আনন্দে বীণা গাছে হেলান দিয়ে খানিকক্ষণ কাঁদল। গাছ সম্ভবত মানুষের ভালবাসা বুঝতে পারে। কাজেই পরের বছর আরো বেশি ফুল ফুটল। তার পরের বছর আরো বেশি। একটা ডাল ঝুঁকে এল কুয়ার ওপর। কে জানে গাছেরও হয়ত নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে ইচ্ছা করে। পুকুর পাড়ের সব গাছ সে কারণেই জলের দিকে ঝুঁকে যায়।

শ্রাবণ মাসের এক মেঘলা দুপুরে মিজান সাহেব তাঁর স্ত্রী এবং দুবছর বয়েসী বুলুকে নিয়ে কল্যাণপুরের এই বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। শ্যাওলা-ধরা পাঁচিলের নোনা-লাগা বাড়ি, চারদিকে ঝোপ ঝাড়। বাড়ির বাঁ দিকে ডোবার মতো আছে। ডোবার চারপাশে ঘন কচুবন। তাঁদের চোখের সামনেই ডোবার পানি কেটে একটা খয়েরি রঙের সাপ চলে গেল।

ফরিদা আঁৎকে উঠে বললেন, কোথায় নিয়ে এলে? এ যে সাপ-খোপের আড্ডা।

মিজান সাহেব বললেন, সব সময় ফালতু কথা বলবে না। ফালতু কথা আমার মোটই ভালো লাগে না।

ফরিদা থমথমে গলায় বললেন, চারদিকে একটা বাড়ি ঘর নেই। ডাকাত মেরে রেখে গেলেও কেউ জানবে না। তুমি থাকবে বাইরে-বাইরে আমি ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে এত বড় বাড়িতে থাকতে পারব না। আমাকে তুমি দেশে পাঠিয়ে দাও।

মিজান সাহেব বললেন, আবার ফালতু কথা শুরু করলে?

এখানে থাকব কী করে?

প্রথম দিনেই বড় যন্ত্রণা শুরু করলে তো?

মিজান সাহেব ভুরু কুঁচকে এমনভাবে তাকালেন যে ফরিদা চুপ করে গেলেন। তবে তাঁর মনটা ভেঙে গেল। প্রথম রাতে একটা অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখে ভয় পেলেন। বারান্দায় হাত ধুতে এসে দেখেন কুয়ার পাশে লম্বা ঘোমটা দিয়ে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বিকট চিৎকার দিলেন। মিজান সাহেব বললেন, ফালতু কথা বলা তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে, জ্যোৎস্নার আলো পড়েছে আর তুমি বলছ হেন তেন।

 

এক শ্রাবণ মাসের মেঘলা দুপুরে তিনি এই বাড়িতে ঢুকেছিলেন। আজ আরেক শ্রাবণ মাস। মাঝখানে চব্বিশ বছর পার হয়েছে। তাঁর সংসার বড় হয়েছে। বীণার জন্ম হয়েছে ঢাকা আসার পরের বছর। তার পরের বছর আরেকটি শিশুর জন্ম দিয়ে ফরিদার শরীর ভেঙে গেল। মাথার চুল উঠে গেল, বুকে ফিক ব্যথা। সামান্য কিছুতেই বুক ধড়ফড় করে। ফর্সা মুখ নীল হয়ে যায়।

লম্বা ঘোমটা পরা মেয়েটাকে এখনো ফরিদা হঠাৎ হঠাৎ দেখেন তবে কাউকে কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন। ছেলেমেয়েরা শুনলে ভয় পাবে। কী হবে ওদের ভয় দেখিয়ে? তাছাড়া ঐ ঘোমটা দেয়া মেয়ে তো তাঁর কোন ক্ষতি করছে না। এই অশরীরী মেয়ে নিজের মনে আসে। হঠাৎ-হঠাৎ দেখা দিয়ে চলে যায়।

কুয়ার ভেতরের সেই কল কল শব্দ মিজান সাহেবও মাঝে-মাঝে শোনেন। তিনিও কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন। সেইসব রাতে তাঁর একেবারেই ঘুম হয় না। বারান্দায় জলচৌকিতে বসে রাত কাটিয়ে দেন।

মিজান সাহেব যতটা আশা নিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন তার কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনোরকম উন্নতি তিনি করতে পারেন নি। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পর লবণ এবং পেঁয়াজের ব্যবসা করে কিছু টাকা করেছিলেন, সেই টাকায় বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায় একটা ঘর তোলা শুরু করেছিলেন। ছাদটলাই হবার আগেই কাজ বন্ধ হয়ে গেল। চিটাগাং থেকে বুক করা দুই ওয়াগন লবণ আখাউড়া পর্যন্ত এসে উধাও হয়ে গেল। কত ছোটাছুটি, কত লেখালেখি, উকিলের চিঠি, একে ধরা, তাকে ধরা। লাভ হল না। দেশে আইন-কানুন নেই। যার যা ইচ্ছা করছে। সে অভিজ্ঞতা বড়ই তিক্ত।

এক বন্ধুর সঙ্গে কিছুদিন কন্ট্রাক্টারি করলেন। এ দেশে কন্ট্রাক্টারি করে মানুষ ধনবান হয়। তিনি হলেন নিঃস্ব। সেই বন্ধুর কল্যাণে জেলে যাবার উপক্রম হয়েছিল। পৈত্রিক জমি-জমা বিক্রি করে অনেক কষ্টে তা ঠেকালেন।

মা বাবাকে দেশের বাড়ি থেকে উঠিয়ে এখানে এনে রাখলেন। তাঁর বাবা দেশের বাড়িতে সুখেই ছিলেন। এখানে এসে বড়ই অসহায় হয়ে পড়লেন। বেশিরভাগ সময় কুয়াতলায় বসে থাকতেন। যখন তখন চিকন গলায় বলতেন, কোনহানে আনলিরে মিজান? ও বাপধন কোনহানে আইন্যা ফেললি? দম বন্ধ হইয়া যায়। খোলা বাতাস নাই।

মিজান তিক্ত গলায় বলতেন, খোলা বাতাস, খোলা বাতাসের দরকারটা কি তোমার?

জানটা খালি শুকাইয়া আহে।

বড় যন্ত্রণা করছ বাবা তুমি। বড়ই যন্ত্ৰণা করছে।

মিজান সাহেবের বাবা দীর্ঘদিন যন্ত্রণা দিলেন না। ভাদ্র মাসের এক দপুরে হঠাৎ করে মরে গেলেন। তবে মেয়েদের জীবন বেড়ালের জীবনের মতো। কিছুতেই সে জীবন বের হতে চায় না। মিজান সাহেবের মা বেঁচে রইলেন। তিনি চোখে এখন প্রায় দেখতেই পান না। বোধ শক্তিও নেই। গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না। মিজান সাহেবের সবচে ছোট ছেলে বাবলু কোনো কোনো দিন দাদীর ঘরে ঢুকে চেচিয়ে ওঠে, দাদী নেংটা, ছি ছি দাদী নেংটা।

পঁচাশি বছরের বৃদ্ধাবাবলুর চেয়েও উঁচু গলায় চেঁচান, মর হারামজাদা মর। বদের বদ। শয়তানের শয়তান। মর তুই মর। এই জাতীয় গালি শুনলে সব সময় ফরিদার গা কাঁপে তবে তাঁর শাশুড়ির গালিতে তিনি খুব একটা বিচলিত হন না। কোথায় যেন শুনেছেন রক্ত সম্পর্কের মুরবী যদি মর-মর করে গালি দেয় তাহলে আয়ু বাড়ে।

পঁচাশি বছরের বৃদ্ধাও বাড়ির সকলের আয়ু ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেন। শুধু মানুষ না জীব-জন্তু, পশু-পাখির আয়ুও তিনি বাড়ান। একটা কাক হয়ত ডাকছে কাকা। তিনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গালি দেবেন, মর হামজাদা মর। ভাত খাবার সময় পাশ দিয়ে একটা বেড়াল গেল, তিনি চেঁচাবেন, মর হারামজাদা বিলাই। তুই মর।

মিজান সাহেবের মাঝে-মাঝে অসহ্য বোধ হয়। তিনি তীব্র গলায় বলেন, চুপ। তাঁর মা তার চেয়েও উঁচু গলায় বলেন, তুই চুপ। হারামজাদা ছোড লোক। আমারে বলে চুপ। মুর হারামজাদা।

মিজান সাহেবের সত্যি-সত্যি মরতে ইচ্ছা করে। সংসার বড় হচ্ছে। তিনি সামাল দিতে পারছেন না। মাঝে-মাঝে রাতে তাঁর একেবারেই ঘুম হয় না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেন। মাথার দুপাশের রগ দপদপ করে। সত্যি-সত্যি তিনি যদি মরে যান তাহলে এই সংসারটার কী হবে এটা ভাবলে শরীর অবশ হয়ে আসে। তাঁর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না, তবু শুধু সংসারের জন্যে তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে এই চিন্তা তাঁকে কাবু করে ফেলে। তাঁর অসহ্য বোধ হয়। অসহ্য বোধ হলেও তিনি ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মে প্রতিদিন তাঁর জীবন শুরু করেন। বাজার করেন, অফিসে যান, অফিস থেকে ফিরে মার ঘরে উঁকি দিয়ে বলেন, কেমন আছ মা? আজ শরীরটা কেমন? বৃদ্ধা তীক্ষ্ণ গলায় বলেন, মর হারামজাদা। রোজ ঢং করে।

মিজান সাহেব বর্তমানে মেঘনা এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেডের ক্যাশিয়ার। এই প্রাইভেট কোম্পানির অনেকরকম ব্যবসা ট্রান্সপোর্ট, ইন্ডেন্টিং, কেমিক্যালস এবং হোটেল। মিজান সাহেবের হাত দিয়ে রোজ যে পরিমাণ টাকার লেন-দেন হয় তা দেখে তিনি বিস্ময় বোধ করেন। দেশের কিছু কিছু মানুষের হাতে এত টাকা কী করে চলে আসছে তিনি তা ভেবে পান না। মেঘনা এন্টারপ্রাইজেসের মালিক-ওসমান গনি। হোট-খাটো মানুষ। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে। থুতনীতে অল্প কিছু দাড়ি। ধবধবে একটা পাঞ্জাবি গায়ে দেন। চোখে সামান্য সুরমা দেন। রিভলভিং চেয়ারে পা তুলে বসেন। ঘন-ঘন পান খাওয়া ছাড়া তাঁর অন্য কোনো বদ অভ্যাস নেই। গলার স্বর খুবই মোলায়েম। ব্যবহারও ভদ্র। অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে দেখা হলে তিনি সবার আগে বলেন, স্লামালিকুম। চড়া গলায় কারো সঙ্গে একটা কথাও বলেন না। তবু সবাই তাঁর ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। এই ভয়ের উৎস গনি সাহেবের ব্যক্তিত্ব নয়—ক্ষমতা। ক্ষমতা বড়ই শক্ত জিনিস।

গনি সাহেবের কয়েকটি অফিস আছে। প্রতিটি অফিসে তাঁর একজন প্রিয়পাত্র আছেন। এই সব প্রিয়পাত্রদের প্রতিদিনই তিনি কিছুটা সময় দেন। নিজের কামরায় ডেকে নিয়ে গিয়ে নানান গল্প করেন। অন্যদের সঙ্গে তিনি কী গল্প করেন কে জানে কিন্তু মিজান সাহেবের সঙ্গে গল্পের বিষয়বস্তু একটাই। তা হচ্ছে—গনি সাহেবের বয়স হয়ে যাচ্ছে। যে কোনো একদিন মরে যাবেন। মরবার আগে দেশের জন্যে তিনি কিছু করতে চান। টোটকা-ফাটকা কিছু না। স্থায়ী কিছু। গনি সাহেব, মধুর স্বরে জানতে চান—কী করা যায় বলুন দেখি মিজান সাহেব? স্কুল-কলেজের কথা আমাকে বলবেন না। এই জাতিকে লেখাপড়া শিখিয়ে কিছু হবে না। অন্য কিছু ভাবুন। চট করে বলার দরকার নেই। চিন্তা ভাবনা করুন। আমি নিজের কোনো নাম চাই না। আমি চাই টাকাটা কাজে লাগুক। বুঝতে পারছেন?

বুঝতে না পেরেও মিজান সাহেব হা সূচক মাথা নাড়েন। মাসের মধ্যে এক দুদিন গনি সাহেবকে দেশ নিয়ে খুবই চিন্তিত মনে হয়। সুরমা পরা চোখে দেশের জন্যে মমতা ঝরে পড়ে। তিনি উদাস গলায় বার-বার বলেন, চিন্তা করে কিছু বের করুন। ভাবুন। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন।

মিজান সাহেব ভাবেন। তবে দেশ নিয়ে না। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। ইদানীং তিনি চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন। বুলু এইবারও পাশ করতে পারে নি। তিনবার বি.এ ফেল করলে আর কোনোবারই পাশ করতে পারে না। এটাই নাকি নিয়ম। পাশ যারা করার তারা প্রথম দুবারেই করে। যারা করার না তারা আর করে না।

বুলু পাশ করতে পারল না অথচ বীণা এত ভালো রেজাল্ট করল। বীণার এই রকম রেজাল্টের দরকার ছিল না। দুজন যদি কোনোেমতে টেনে-টুনেও পাশ করত তিনি খুশি হতেন।

শ্রাবণ মাসের এই মেঘলা সকালে মিজান সাহেব রেজাল্টের পত্রিকা হাতে বারান্দায় জলচৌকির উপর স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। বুলু বোধ হয় আগেই খবর পেয়েছে। সে গতরাত থেকে বাসায় নেই। ফরিদা খানিকক্ষণ কান্নাকাটি করে এখন নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। তাঁর বুকের ফিক ব্যথা আবার উঠেছে।

বীণা কয়ার পাশে একা একা বসে আছে। সেও খানিকক্ষণ কেটেছে। বি, এ পরীক্ষায় ছেলে-মেয়েদের মধ্যে তৃতীয় হবার কোন দরকার ছিল না। সে তো এমন কোনো ভালো ছাত্রী না। ম্যাট্রিকে একটা মাত্ৰ লেটার পেয়ে ফার্স্ট ডিভিসন পেয়েছিল। অথচ তার বান্ধবীরা চারটা পাঁচটা করে লেটার পেয়েছে। ইন্টারমিডিয়েটেও অনেক কষ্টে একটা ফার্স্ট ডিভিসন। এই গুলোও কোনো কাজে লাগল না। ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় এ্যালাউ হল না।

বীণার খুব খারাপ লাগছে তার দাদার জন্যে। বেচারা এ বছর খুব পরিশ্রম করেছে। তবু এ রকম হল কেন কে জানে। বেচারা সোজা সরল ধরনের মানুষ। একা একা কোথায় ঘুরছে কে জানে। সে ফেল করে তার দাদা পাশ করলে আনন্দের একটা ব্যাপার হত। বাবা নিশ্চয়ই মিষ্টি আনতেন। সে তার নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকত। এক সময় বাবা বলতেন, এত কান্নাকাটির কি আছে? পাশ ফেল ভাগ্যের ব্যাপার। পরের বছর আরেকবার দিলেই হবে।

আবহাওয়া সহজ হয়ে যেত। বাবাকে জলচৌকির ওপর মুখ শুকনো করে বসে থাকতে হত না। ফিক ব্যথা উঠত না। বীণাকে একা একা কুয়ার পাশে থাকতে হত না।

কিংবা তারা দুই ভাই-বোনই যদি পাশ করত তাহলে কি অদ্ভুত একটা ব্যাপার। হত। দুজনে মিলে সালাম করত বাবা মাকে। বাবা গম্ভীর গলায় বলতেন, থাক থাক সালাম লাগবে না। বলতে বলতে গাম্ভীর্যের কথা ভুলে তরল গলায় নিশ্চয় বলতেন, ফরিদা, মিষ্টি-টিষ্টির ব্যবস্থা কর।

বীণা এক দৃষ্টিতে কুয়ার পানির দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ নিচু করে একবার সে বলল, নাবী, নাবী। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়া গম্ভীর গলায় ডাকল, বীণা। বীণা। কুয়া কি চমৎকার করেই না মানুষের মতো ডাকে। প্রাচীন এক জন মানুষ, যার গলার স্বরে ব্যাখ্যার অতীত কোনো রহস্যময়তা।

আপা, এই আপা।

বীণা পেছনে ফিরল। লীনা পা টিপে টিপে আসছে। বীণা বলল, কিরে?

বাবা চা খেতে চাচ্ছে।

বীণা রান্নাঘরের দিকে রওনা হল। তার পেছনে পেছনে লীনা আসছে। সে ফিস-ফিস করে বলল, তুমি ফার্স্ট হয়েছ আপা?

না।

পত্রিকায় তোমার ছবি উঠবে না?

বীণা কিছু বলল না। লীনা বলল, ওরা তোমার ছবি কোথায় পাবে আপা?

জানি না। এত কথা বলিস না, ভালো লাগছে না।

বীণা চা বানিয়ে বাইরে এসে দেখে বাবা নেই। কাউকে কিছু বলে চলে গেছেন। খবরের কাগজটা কুচি-কুচি করে ছেড়া।

লীনা বলল, চা আমাকে দাও আপা আমি খেয়ে ফেলি।

বীণা চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। মার জন্যে হালকা করে সাগু বানাল। সাগু খেলে ব্যথা খানিকটা কমে। ফরিদার ব্যথা কমল না। তিনি ছটফট করতে লাগলেন।

মিজান সাহেব বাসায় ফিরলেন সন্ধ্যা মিলাবার পর। তাঁর হাতে একগাদা কাগজপত্র। ক্যাশের হিসাবে গণ্ডগোল হচ্ছে। রাত জেগে হিসাব মিলাবেন। তিনি হাত মুখ ধুয়ে খাতা নিয়ে বসলেন। পাশের ঘরে ফরিদা ছটফট করছেন—তা নিয়ে মোটেই বিচলিত হলেন না। কখনো হন না।

বীণা এসে বলল, চা দেব বাবা?

তিনি হ্যাঁ না কিছুই বললেন না।

বীণা চা বানিয়ে বাবার পাশে রাখল। বাবার কাছাকাছি সে বেশিক্ষণ থাকে না। খুব ভয়-ভয় লাগে। আজ অন্যদিনের চেয়েও বেশি ভয় করছে। বীণা চলে যেতে ধরেছে-মিজান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, বোস।

বীণা হকচকিয়ে গেল। বসল না। মিজান সাহেব পকেট থেকে একটা ছোট্ট চৌকা বাক্স বের করে মৃদু স্বরে বললেন, নে।

বীণা হাত বাড়িয়ে নিল। বাক্স খুলে মুগ্ধ হয়ে গেল। একটা সোনালি হাত ঘড়ি। বীণা কী করবে ভেবে পেল না। মিজান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এত ভালো রেজাল্ট করেছিস-বাবা মাকে তো সালাম করলি না? সালাম কর মা!

রাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। ঘরে ইলেকট্রিসিটি নেই। দমকা বাতাসের ঝাপটা। সারা বাড়িতে একটা মাত্র হারিকেন। মিজান সাহেব সেই হারিকেনে খাপত্ৰ দেখছেন। লীনা এবং বাবলু অন্ধকার বারান্দায় বসে আছে। আপার ঘড়িটা লীনা হাতে পরেছে। তার বড় ভালো লাগছে।

বীণা রান্নাঘরে। চূলার আগুনের সামান্য আলোতেই রান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। ফরিদা তার পাশে বসে আছেন। তাঁর ব্যথা পুরোপুরি সেরে গেছে তবে শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে।

মিজান সাহেব অনেক রাতে শুতে গেলেন। ঝড় থেমে গেছে তবু অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। শীত লাগছে, কাঁথা বের করতে হয়েছে। মিজান সাহেব বিছানায় উঠতে উঠতে বললেন, ফরিদা জেগে আছ নাকি?

ফরিদা বললেন, হ্যাঁ।

বীণার হাত-টাত একেবারে খালি। ছোট-খাটো কিছু গয়না গড়িয়ে দিও। এই বয়সে শখ থাকে। আমি টাকার ব্যবস্থা করব।

ফরিদা কিছু বললেন না। মিজান সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, কাল কিছু মিষ্টি টিষ্টি আনিও। মেয়েটা এত ভালো করেছে। পাশের বাসায় দিও।

আচ্ছা।

বুলু আসে নি?

না।

জুতিয়ে হারামজাদার আমি বিষ ঝাড়ব।

ফরিদা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ছেলেটা কোথায় ঘুরছে কে জানে। রাতে হয়ত কিছু খায়ও নি।

বীণা তার দাদীর সঙ্গে এক খাটে ঘুমায়। রাতে যখন বীণা ঘুমুতে আসে তখন এই অপ্রকৃতিস্থ বৃদ্ধা সহজ স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন। বীণার তখন ধারণা হয় দাদী আসলে ভালেই আছেন। পাগলামী যা করেন তা বোধ হয় ভান।

আজ বীণা ঘুমুতে এসে দেখল দাদীর গায়ের ওপরের অংশে কোনো কাপড় নেই। শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে রেখেছেন।

বীণা বলল, শাড়ি ঠিকমতো পর দাদী, বিশ্রী লাগছে।

গরম লাগে।

খুব খারাপ দেখায় দাদী।

দেখাইলে দেখায়। তুই ঘুমা।

বীণা শুয়ে পড়ল। দাদী বসেই রইলেন। বীণা বলল, ঘুমুবে না দাদী?

উঁহুঁ।

আমি পাশ করেছি দাদী।

বুলু ফেল হইছে?

বীণা কিছু বলল না।

ঐ হারামজাদা আছে কোন হানে?

ঘুমাও দাদী।

দাদী শুয়ে পড়লেন। অল্পক্ষণেই তাঁর নাক ডাকতে লাগল। তাঁর ঘুম চট করে আসে আবার চট করে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর ঘুম ভেঙে যাবে। তখন অনবরত কথা বলতে থাকবেন।

বীণার ঘুম আসছে না, শুয়ে শুয়ে সে নানান কথা ভাবছে। কাল সে মার কাছ। থেকে টাকা নিয়ে একা একা খানিকক্ষণ ঘুরবে। অলিকের বাসা খুঁজে বের করতে পারলে একবার যাবে দেখা করতে। অলিকের কথা তার প্রায়ই মনে হয়।

দাদীর ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি উঠে বসলেন, টেনে টেনে বললেন, বুলুটা কি আবার ফেইল করল? ও বীণা, ঐ হারামজাদা আবার ফেইল করল? পর-পর তিনবার। হারামজাদার লজ্জা নাই? ও বীণা ঘুমালি?

বীণা ঘুমায় নি কিন্তু সে জবাব দিল না। জবাব দিলে দাদী অনবরত কথা বলতে থাকবেন।

ও বীণা। বীণা।

জবাব দেবে না দেবে না করেও বীণা বলল, কি দাদী?

তোর বাপ তোর বিয়ার ব্যবস্থা করে না ক্যান?

চুপ কর তো দাদী।

তার বাপরে আমি বলব। তোর বাপটার মাথা খারাপ—এত বড় মাইয়া ঘরে….

চুপ কর দাদী। তুমি বিশ্রী সব কথা বল।

শরম লাগে? ইস্ কি যে যন্ত্রণা। হা শরম লাগে।

বুড়ি গা দুলিয়ে খিক খিক করে সে। মাঝেমাঝে রাত দুপুরে তাঁর মনে ফুর্তির ভাব আসে। আজ বোধ হয় সে রকম একটা রাত। বুড়ি নিচু গলায় মেয়েদের যৌবন নিয়ে এমন একটা কথা বলল যে বীণার কান ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ