বিয়েবাড়ি খুব জমে উঠেছে।

বাড়ির সামনে খোলা মাঠে ছেলেমেয়েরা হৈহৈ করে চি-বুড়ি খেলছে। তাদের চিৎকারে কান পাতা দায়। শিশুদের আরেকটি দল গম্ভীর হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেখানে বাবুচরা রান্না বসিয়েছে, সেখানেও অপেক্ষাকৃত কমবয়সী। শিশুদের জটিল। ছাদে সামিয়ানা খাটান হয়ে গেছে। সেখানে চেয়ার-টেবিল সাজান হয়েছে। অনেকেই ভারিকি চালে চেয়ারে বসে আছে।

কিশোরী মেয়েদের ছ-সাত জনের একটি দল জোট বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিগ্ল উপলক্ষে তারা আজ সবাই শাড়ি পরেছে। সবাই আপ্ৰাণ চেষ্টা করছে যেন তাদেরকে মহিলার মতো দেখায়। এদের মধ্যে শীলা নামের একটি মেয়ে বাড়ি থেকে এক প্যাকেট দামী সিগারেট এনেছে। বিয়েবাড়ির একটি নির্জন আড়াল খুঁজে পেলেই সিগারেট টানা যায়। কিন্তু কোথাও সে-রকম জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। কিশোরীর এই দলটির সবাই কিছু পরিমাণে উত্তেজিত। তারা কথা বলছে। ধীরে ধীরে; মাঝে মাঝেই হেসে উঠছে, তবে সে-হাসির স্বরগ্রামও খুব নিচু।

শেষ পর্যন্ত তারা একটি জায়গা খুঁজে পেল। দোতলায় সবচেয়ে দক্ষিণের একটি ঘর। পুরনো আসবাবে সে-ঘরটি ঠাসা। দুটি জানালাই বন্ধ বলে ঘরের ভেতরটা আর্দ্র ও অন্ধকার! একটি নিষিদ্ধ কিছু করবার উত্তেজনায় সবাই চুপচাপ।

বড়ো রকমের একটি ঝগড়াও শুরু হয়েছে বিয়েবাড়িতে। এসব ঝগড়াগুলি সাধারণত শুরু করেন নিমন্ত্রত গরিব আত্মীয়রা। তাঁরা প্রথমে খুব উৎসাহ নিয়ে বিয়েবাড়িতে আসেন, কোনো একটা কাজ করবার জন্যে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু কিছু করতে না পেরে ক্রমেই বিমর্ষ হয়ে ওঠেন। একসময় দেখা যায় একটি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তাঁরা মেতে উঠেছেন। চিৎকারে কান পাতা যাচ্ছে না। বরপক্ষীয়দের তরফ থেকে দুটি রুই মাছ পাঠান হয়েছিল, মাছ দুটি নাকি পচা–এই হচ্ছে আজকের ঝগড়ার বিষয়।

তবে সব বিয়েতেই চরম গণ্ডগোলাগুলি যেমন ফস করে নিভে যায়, এখানেও তাই হল। দেখা গেল। বরপক্ষীয় যারা বিয়ের তত্ত্ব নিয়ে এসেছিল (দুটি মেয়ে, একটি অল্পবয়সী ছেলে এবং এক জন মাঝবয়সী ভদ্রলোক), মহানন্দে রঙখেলায় মেতে গেছে। বরের বাড়ির রোগামতো লম্বা মেয়েটিকে দু-তিন জনে জাপটে ধরে সারা গায়ে খুব করে কালো রঙ মাখাচ্ছে! মেয়েটি হাত-পা ছুড়ছে এবং খুব হাসছে।

রঙ ছোঁড়াছুড়ির ব্যাপারটা দেখতে দেখতে ক্ষ্যাপামির মতো শুরু হল। একদল মেয়ে দৌড়াচ্ছে, তাদের পিছু পিছু আরেক দল যাচ্ছে রঙের কৌটো নিয়ে। খিলখিল হাসি, চিৎকার আর ছোটাছুটিতে চারিদিক সরগরম। ছেলেদের দলও বেমালুম জুটে গিয়েছে। অল্পপরিচিত, অপরিচিত মেয়েদের গালে রঙ মাখিয়ে দিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করছে না। মেয়েরাও যে এ ব্যাপারে কিছু একটা মনে করছে, তা মনে হচ্ছে না। তাদেরও ভালোই লাগছে।

পরী যখন এসে পৌঁছল, তখন বরের বাড়ির রোগা মেয়েটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।–যাকে দেখাচ্ছে ভূতের মতো। পান্না ভয় পেয়ে বলল, মা, একটা পাগলী, ওমা, একটা পাগলী।

পরীকে দেখতে পেয়ে সবাই ছুটে এল। নিমেষের মধ্যে পরীর ধবধবে গাল আর লালচে ঠোঁট কালো রঙে ড়ুবে গেল। লীনা ও পান্না দু জনেই হতভম্ব। লীনা বলল, এরকম করছে কেন?

হোসেন সাহেব ব্যাপার দেখে সটকে পড়েছেন। সটান চলে গিয়েছেন দোতলায়।

লীনা ও পান্না হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ততক্ষণে রঙ-খেলা চরমে উঠেছে। ভেতরের বাড়ির উঠোনে বালতি বালতি পানি ঢেলে ঘন কাদা করা হয়েছে। মাঝবয়েসী একটি ভদ্রমহিলাকে সবাই মিলে গড়াগড়ি খাওয়াচ্ছে সেই কাদায়। ভদ্রমহিলার শাড়ি জড়িয়ে গেছে, ব্লাউজের বোতাম গিয়েছে খুলে। তিনি ক্রমাগত গাল দিচ্ছেন। কিন্তু সেদিকে কেউ কান দিচ্ছে না। সবাই হাসছে, সবাই চেঁচাচ্ছে। লীনা ও পান্নার বিমর্ষ ভােব কেটে গিয়েছে। তারাও মহানন্দে জুটে পড়েছে সে— খেলায়। পান্না ফূর্তিতে ঘন ঘন চেঁচাচ্ছে। এমন মজার ব্যাপার সে বহু দিন দেখে নি।

জরী এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। সে সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। তার একটু লজ্জা-লজ্জা করছে। পরী কাদামাখা শরীরে জরীকে জড়িয়ে ধরল। জরী বলল, আপা, কখন এসেছিস?

এই তো এখন। তোর কেমন লাগছে জরী?

কী কেমন লাগছে?

বিয়ে।

জরী হাসতে লাগল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ