তেইশ বছর আগে একবার পরী ড়ুবতে বসেছিল। তাকে সেদিন টেনে তুলেছিল পরীর বড়োচাচী। তেইশ বছর পর আবার এক জন পরীর মেয়েকে টেনে তুলল। বাহ! বেশ মজার ব্যাপার তো! কিন্তু পরীর কি সেই শৈশবের কথা মনে আছে? অনেক বড়ো বড়ো ঘটনা মানুষ চট করে ভুলে যায়। আবার অর্থহীন সামান্য অনেক অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার মানুষের অন্তরে দাগ কেটে বসে যায়।

বড়োচাচার এগার বছরের বিবাহিত জীবনে কত বড়ো বড়ো ঘটনাই তো ঘটেছে। কিন্তু সে-সব ছবি বড়ো ঝাপসা। কষ্ট করে দেখতে হয়, ঠিক ঠিক মনে পড়তে চায় না। শিরীন মরবার সময় তাঁকে যেন কী সব বলেছিল। সে-সব কেমন আবছাভাবে মনে আসে। এমন কি শিরীনের চেহারাও ঠিকঠক মনে পড়ে না। কিন্তু একটি ছোট্ট ঘটনা, একটি অতি সামান্য ব্যাপার, আজও কী পরিষ্কার ভাবে মনে আছে তাঁর।

সেদিন ভীষণ গরম পড়েছি। দুপুরে একটু ঘুমিয়েছিলেন। ঘোমে একেবারে নেয়ে গেছেন। ঘুম যখন ভাঙলি, তখন বেলা পড়ে গেছে।

তিনি বারান্দার ইজিচেয়ারে এসে বসেছেন। একটি কাক কোথেকে এসে কা-কা শুরু করেছে। তিনি হাত নেড়ে কাক তাড়িয়ে দিলেন, সেটি আবার উড়ে এল, আর ঠিক তখনি শুনলেন ঘরে ভেতর থেকে শিরীন খুব মৃদু স্বরে সুর করে বলছে, রসুন বুনেছি, রসুন বুনেছি।

কত দিন হয়ে গেল, তবু তাঁর মনে হয় যেন সেদিনের ঘটনা। কাকটির তাকানির ভঙ্গিটিও তাঁর মনে আছে। এ রকম হয় কেন মানুষের? বড়ো বিচিত্র মন আমাদের।

বড়োচাচা দুপুরের খাবার খেতে আনিসের ঘরে চলে গেলেন। আনিস অসুস্থ হয়ে এখানে পড়ে আছে প্রায় এগার মাস। এই এগার মাসের প্রতি দুপুরে তিনি আনিসের সঙ্গে খেতে বসেছেন। খাওয়ার ঘণ্টাখানিক সময় তিনি আনিসের ঘরে কাটান। এটা-সেটা নিয়ে হালকা গল্পগুজব করেন। আজ ঘরে ঢুকে দেখলেন খাবুর দিয়ে গিয়েছে এবং আনিস গোগ্রাসে খাচ্ছে। সে চাচাকে দেখে লজ্জিত হয়ে বলদৰ্ল, বড়ো খিদে পেয়েছে। চাচা।

খিদে পেলে খাবি। আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে নাকি রে গাধা।

আপনি হাত ধুয়ে আসুন।

তোর শরীর কেমন বল?

ভালো।

ব্যথা হয় নি, না?

সকালের দিকে অল্প হয়েছিল, এখন নেই।

বড়োচাচা খেতে বসে আনিসের দিকে বারবার তাকাতে লাগলেন। আনিসের চেহারায় তার বাবার চেহারার আদল আছে। খুব পুরুষালি গড়ন। তবে মেয়েদের মতো ছোট্ট বরাফি-কাটা চিবুক। এইটুকুতেই তার চেহারায় অনেকখানি ছেলেমানুষী এসে গেছে। আনিস বলল, বড়োচাচা, আপনার সানাই শুনে আজ জেগেছি।

সানাইয়ের কথায় বড়োচাচার মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি যেমন হবে ভেবেছিলেন, তেমনি হয় নি। তিনি চেয়েছিলেন বিয়ের এই আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে একটি সকরুণ সুর কাঁদতে থাকুক। সবাইকে মনে করিয়ে দিক এ-বাড়ির সবচেয়ে আদরের একটি মেয়ে আজ চলে যাচ্ছে। আর কখনো সে জ্যোৎ মারাতে ছাদে দাপাদাপি করে ভুল সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে না। কিন্তু তিনি যেমন চেয়েছিলেন, তেমনি হল না। অল্প বেলা বাড়তেই তুমুল হৈচৈ-এ সানাইয়ের সুর ড়ুবে গেল। তিনি মনমরা হয়ে রেডিওগ্রাম বন্ধ করে দিলেন।

বড়োচাচা হাত ধুয়ে এসে বসলেন আনিসের বিছানায়। আচমকা প্রশ্ন করলেন, তোর কি খুব খারাপ লাগছে আনিস?

কই না তো!

আমেরিকা থেকে ফিরে এসে একটা সাদাসিধা ভালো মেয়ে বিয়ে করিস তুই।

আনিস হেসে ফেলল। বড়োচাচা গম্ভীর হয়ে বললেন, হাসির কী হল? হাসছিস কেন?

আমি আর বাঁচব না। দিস ইজ এ লস্ট গেম।

বড়োচাচা কথা বললেন না। আনিসের সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু বড়োচাচা না যাওয়া পর্যন্ত সেটি সম্ভব নয়। সে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন তিনি ওঠেন, কিন্তু তিনি উঠলেন না। আনিসের সিগারেট-পিপাসা আরো বাড়িয়ে দিয়ে একটি চুরুট ধরালেন। আনিসের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, কোনো কারণে আমার ওপর তোর কি কোনো রাগ আছে?

কী যে বলেন চাচা। রাগ থাকবে কেন?

না, সত্যি করে বল।

কী মুশকিল, আমি রাগ করব কেন? কী হয়েছে। আপনার বলুন তো।

আমার কিছু হয় নি।

বড়োচাচা হঠাৎ ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। কাল রাত থেকে তাঁর মনে হচ্ছিল, আনিসের মনে তাঁর প্রতি কিছু অভিমান জমা আছে। আনিস। যদিও এখন হাসছে, তবু সেই হাসিমুখ দেখে তাঁর কষ্ট হতে থাকল। তিনি নিজের মনে খানিকক্ষণ বিড়বিড় করলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে যাই আনিস বলে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।

বড়োচাচা হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ, যাঁরা সামান্য ব্যাপারে অভিভূত হন না। আজ আনিসকে দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। তিনি চাইছিলেন কিছু একটা করেন, কিন্তু কী করবেন তা তাঁর জানা নেই। আনিসের জন্যে তাঁর একটি গাঢ় দুর্বলতা আছে। নিজের দুর্বলতাকে তিনি কোনো কালেই প্রকাশ করতে পারেন না। প্রকাশ করবার খুব একটা ইচ্ছাও তাঁর কোনো কালে ছিল না। কিন্তু আজ তাঁর মন কাঁদতে লাগল। ইচ্ছে হল এমন কিছু করেন যাতে আনিস বুঝতে পারে এই গৃহে তার জন্যে একটি কোমল স্থান আছে। কিন্তু আনিস বড় অভিমানী হয়ে জন্মেছে। তার জন্যে কিছু করা সেই কারণেই হয়ে ওঠে না।

খুব ছোটবেলায় আনিসের যখন এগার-বার বৎসর বয়স, তখনই বড়োচাচা আনিসের তীব্র অতিমানের খোঁজ পান। বড়ো হয়েছে বলে আনিস তখন আলাদা ঘরে ঘুমায়। তার ঘরটি একতলায়। পাশের ঘরে আনিস, জরী ও পরীদের মাস্টার সাহেব থাকেন। এক রাত্ৰিতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। বড়োচাচা আনিসের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনলেন আনিস কাঁদছে। তিনি ডাকলেন, আনিস, কী হয়েছে রে?

আনিস ফুঁপিয়ে বলল, ভয় পাচ্ছি।

আয় আমার ঘরে। আমার সঙ্গে থাকবি?

না।

তাহলে আমি সঙ্গে শুই?

দরজা খোল তুই।

আনিস দরজা খুলল না। তিনি অনেকক্ষণ বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। বড়োচাচার মনে হল জরীর বিয়ের এই দিনটি আনিসের জন্যে খুব একটা দুঃখের দিন। কিন্তু তাঁর কিছুই করবার নেই।

যে-ছেলেটির সঙ্গে জরীর বিয়ে হচ্ছে, তার খোঁজ বড়োচাচাই এনেছিলেন। তাঁর আবাল্যের বন্ধু আশরাফ আহমেদের বড়ো ছেলে। নাম ও বিনয়ী। লাজুক ও হৃদয়বান; দেখতে আনিসের মতো সুপুরুষ নয়। রোগা ও কালো। জরীর বাবা আপত্তি করেছিলেন। বারবার বলেছেন, ছেলের ধরনধারণ যেন কেমন। জরীর মারও ঠিক মত নেই; মিনমিন করে বলেছেন, ইউনিভার্সিটির মাস্টার, কয় পয়সা আর বেতন পায়। কিন্তু বড়োচাচার প্রবল মতের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তিই টিকল না। তাঁর যুক্তি হচ্ছে জরীর মতো একটি ভালো মেয়ের জন্যে এ-রকম এক জন ভাবুক ছেলেই দরকার, যে গল্প-কবিতা লেখে—জরী সুখ পাবে। কিন্তু আপত্তি উঠল সম্পূৰ্ণ ভিন্ন জায়গা থেকে। বড়োচাচা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

তিনি সেদিন শয্যাশায়ী। দাঁতের ব্যথায় কাতর। সন্ধ্যাবেলা ঘরের বাতি জ্বলেন নি। অন্ধকারে শুয়ে আছেন। জয়ী এসে কোমল গলায় ডাকল, বড়োচাচা।

কি জরী?

আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি।

বড়োচাচা বিছানায় উঠে বসলেন!। বিস্মিত হয়ে বললেন, বাতি জ্বালা, জরী।

না, বাতি জ্বালাতে হবে না।

জরী এসে বসল। তাঁর পাশে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কী হয়েছে, জরী?

বড়োচাচা, আমি—

বল, কী ব্যাপার!

জরী থেমে থেমে বলল, বড়োচাচা, আমি ঐ ছেলেটিকে বিয়ে করব না।

কেন, কী হয়েছে?

বড়োচাচা, আমি আনিস ভাইকে বিয়ে করতে চাই।

জরী কাঁদতে লাগল। বড়োচাচা স্তম্ভিত হয়ে বললেন, আনিস জানে?

জরী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, জানে। তাকে আসতে বলেছিলাম, তার নাকি লজ্জা লাগে।

দু জনেই বেশ কিছু সময় চুপচাপ কাটাল। বড়োচাচা এক সময় বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে।

সে-রাতে তিনি একটুও ঘুমুতে পারলেন না। অনেক বার তাঁর ইচ্ছে হল তিনি আনিসের কাছে যান, কিন্তু তিনি নিজের ঘরেই বসে রইলেন। তাঁর অনেক পুরনো কথা মনে পড়তে লাগল।

জরীর অনেক অদ্ভুত আচরণ অর্থবহ হল। একটি মেয়ে তো শুধু শুধু একা ছাদে বসে কাঁদতে পারে না। সে চোখের জলের কোনো-না–কোনো কোমল কারণ থাকে। আশ্চর্য! এ সব তার চোখ এড়িয়ে গেল কী করে?

বিয়ে বড়োচাচাই ভেঙে দিয়েছিলেন। যদিও কাউকেই বলেন নি, এত আগ্রহ যে-বিয়ের জন্য ছিল। হঠাৎ তা উবে গেল কেন।

আজ জরীর বিয়ে হচ্ছে। এবং আশ্চৰ্য, সেই ছেলেটির সঙ্গেই। মাঝখানে একটি ভালোবাসার সবুজ পর্দা দুলছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কী? জীবন বহতা নদী। একটি মৃত্যুপথযাত্রী যুবকের জন্যে তার গতি কখনো থেমে যায় না। থেমে যাওয়া উচিত নয়।

বড়োচাচার কষ্ট হতে লাগল। জরীর জন্য কষ্ট। আনিসের জন্য কষ্ট! এবং সেই সঙ্গে তাঁর মৃতা স্ত্রীর জন্যে কষ্ট। তাঁর ইচ্ছে হল আবার আনিসের ঘরে যান। তার মাথায় হাত রেখে মৃদু গলায় বলেন, আনিস তোর মনে আছে, এক বার আমার সঙ্গে জন্মাষ্টমীর মেলায় গিয়েছিলি, সেখানে–

তিনি আবার আনিসের ঘরে ফিরে এলেন।

আনিস পা দোলাতে দোলাতে সিগারেট টানছিল। বড়োচাচাকে দেখে সে সিগারেট লুকিয়ে ফেলল।

কিছু বলবেন চাচা?

না-না, কিছু বলব না। বড়োচাচা আবার ফিরে গেলেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ