উত্তর বন্দের সমস্ত ধান কাটা হওয়ার পরপরই ফিরাইল সাব চলে গেলেন। যাবার পর দিন প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হল। তা তো হবেই, মাঠ-বন্ধন নেই। শিল আটকাবার আসল লোকই নেই। কালাচান খবর নিয়ে এল–ফিরাইল সাবের জন্যে উত্তর বলে যে খড়ের ছাউনি করা হয়েছিল, তার চিহ্নমাত্র নেই। শিলাবৃষ্টিতে সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সোহাগীর লোকজন স্তম্ভিত।

ফিরাইলের সাবের উপরে রাগ রইছে, বুঝলা না বিষয়টা?

রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। ফিরাইল সাব এই বৎসর উত্তর বলে শিল পড়তে দেন নি। সমস্ত নিয়ে ফেলেছেন নিমতলির বন্দে। ফিরাইল সাব বিদায় নেওয়ার আগে গ্রামে এসে উঠলেন কিছুক্ষণের জন্যে। গ্রামের বউ-ঝিরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে অবাক হয়ে ঢাকায়। দেখেই বোঝা যায় বড়ো সহজ লোক ইনি নন। তাঁর সাথে চালাকি চলবে না। শুকনো দড়ি-পাকান চেহারা। মাথার লম্বা চুলে জট বেঁধে গিয়েছে। হাতে জীয়ল গাছের শিকড়ে তৈরী একটি বাঁকা লাঠি। ফিরাইল সাব যাবার আগে বারবার বলে গেলেন–নিমতলির তালগাছের নিচে তিনটা বড়ো শউল মাছ পুড়িয়ে ভোগ দিতে। তালগাছে যে বিদেহী প্রাণীটি বাস করে, তাকে তুষ্ট রাখা খুবই প্রয়োজন। বাজ পড়ে যদি তাল গাছ দুটির একটিও পুড়ে যায়, তাহলে সমূহ বিপদ। বিপদ যে কী, তা তিনি ভেঙে বললেন না। পোয়াতি মেয়েছেলেদের উপর কঠোর নির্দেশ, তারা যেন কোনক্রমেই অমাবস্যা এবং পূর্ণিমা–এই দুই চাঁদে উত্তর বন্দে না যায়।

 

এ বৎসর খুব ভালো ফলন হয়েছে সোহাগীতে। লগ্নির ধান দেওয়ার পরও ধান। রাখার জায়গা নেই। আবুল কালামের মতো হতদরিদ্র ভাগচাষীরও খোরাকি ছাড়াই পঁচিশমণ ধান হল। এমন অবস্থায় জমকালো বাঘাই সিন্নি হবে, তা বলাই বাহুল্য। ধন কাটা শেষ হবার পরই প্রথম পূর্ণিমায় বাঘাই সিনির দল বেরুল। এই সব সাধারণত ছেলেহোকরার ব্যাপার। কিন্তু আমিন ডাক্তারের সে-খেয়াল নেই। দলের পুরোভাগে সে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেচে-কুঁদে এক হুলস্থূল ব্যাপার। মূল গায়ক এক জন, অন্য সবাই ধুয়া ধরে :

(মূল গীত)
আইলাম গো
যাইলাম গো
বাধাই সিন্নি চাইলাম।
(ধুয়া) চাইলাম গো। চাইলাম গো।

 

এই পর্যায়ে হাত-পা ছুঁড়ে নাচ শুরু হয়। মেয়েরা মুখে আচল চাপা দিয়ে হাসতে-হাসতে বাঘাই সিন্নির জন্যে ধামাভর্তি চাল বের করে দেয়।

আমিন ডাক্তারকে দেখে বয়স্কদের অনেকেই দলে ভিড়ে গেল। সুবহান আলির মতো রাশভারি মাতবর ব্যক্তি পর্যন্ত বাঘাই সিনির গানের ধুয়ায় সামিল হল।

সিন্নির আয়োজন হয়েছে উত্তর বন্দে। চারদিকে ফকফকা জ্যোৎস্না, দূরে সোহাগী গ্রাম ছবির মতো দেখা যায়। খোলা প্রান্তরে হাওয়া এসে শো-শোঁ বোঁ-বোঁ শব্দ তোলে। বাঘাই সিৱি দিলের উৎসাহের কোনো সীমা থাকে না। এক দিকে সিন্নি রান্না হয়, অন্য দিকে খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে বাঘাই সিনির গান হয়। বড়ো গাঙ দিয়ে বিদেশী নৌকা যায়। তারা কৌতূহলী হয়ে হাঁক দেয়, কোন গ্রাম?

সোহাগী?

বাঘাই সিনি নাকি গো?

হ ভাই।

কেমন জমল?

জব্বর।

হই হো হেই হো।

 

শুধু খোরাকির ধান রেখে বাকি সব ধান আজরফ নীলগঞ্জের হাটে বিক্রি করে দিল। শরিফা আপত্তি করছিল। কিন্তু আজরফ শক্ত সুরে বলল, ধান থাকলেই খরচ হইব–যে জিনিসের দরকার নাই, সেইটাও কিনা হইব।

যুক্তি অকাট্য। ইতোমধ্যেই নৌকা সাজিয়ে বেদেনীরা আসতে শুরু করেছে। শাড়ি চুড়ি থেকে শুরু করে পিঠা বানানর ছাঁচ–কী নেই তাদের কাছে? কিনতে কারোর গায়ে লাগে না। নগদ টাকা দেওয়ার ঝামেলা নেই, ধান দিলেই হয়।

আজরফ নীলগঞ্জের হাটে ধান বেচে কত টাকা পেল, তা শরিফা পর্যন্ত জানতে পারল না। শরিফা খুব বিরক্ত হল, কিন্তু নিজে থেকে জানতে চাইল না। টাকাপয়সার হিসাব পুরুষমানুষের কাছে থাকাই ভালো। আর এই সংসারে পুরুষ বলতে তো এখন আজরফই আছে। কয়েক দিনের মধ্যেই যেন ছেলেটা বড়ো হয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে চলাফেরা করে। যন্ত্রের মতো কাজ করে। নীলগঞ্জ থেকে সে এবার অনেক জিনিসপত্র কিনেছে। নুরুদ্দিনের জন্যে এনেছে লুঙ্গি আর মাছ মারার বড়শি। তার এবং রহিমার জন্যে এসেছে শাড়ি। শরিফা দুঃখিত হয়ে লক্ষ করল, দুটি শাড়ির জমিনই এক রকম। দামও নিশ্চয়ই এক। রহিমা তার কে? থাকতে দেওয়া হয়েছে দয়া করে, এর বেশি আর কী? তার জন্যে সস্তার শাড়ি কি নীলগঞ্জের হাটে ছিল না? শুধু এখানেই শেষ নয়, অনুফার জন্যে সে একটা জামাও এনেছে। জামায় বড়ো বড়ো ছাপার ফুল। মেলা দাম নিশ্চয়ই।

বর্ষা এসে গেছে। ক দিন ধরেই ক্ৰমাগত বৃষ্টি হচ্ছে। পথঘাটে এক হাঁট কাদা। আজরফ ঘরেই বসে থাকে। করার তেমন কিছু নেই। আগামী পাঁচ মাস ধরে জোয়ান মর্দ ছেলেরা ফড় খেলবে, যোলকটি খেলবে। কেউ কেউ ফুর্তির খোঁজে চলে যাবে উজান দেশে। এই পাঁচ মাস বিশ্রামের মাস, ফুর্তির মাস।

শরিফা খবর পেল। আজরফ যাচ্ছে উজান দেশে। কী সর্বনাশের কথা। এইটুক ছেলে, সে যাবে উজানে? উজানের মেয়েগুলি ফষ্টিনষ্টিতে ওস্তাদ। কী থেকে কী হবে–কে জানে। তার উপর বাজারের খারাপ মেয়েমানুষের পাল্লায় পড়লে ফতুর হয়ে আসতে হবে। কিন্তু আজরফের উদ্দেশ্য ভিন্ন। সে কাজকর্মের খোঁজে যাবে। উজান মুলুক থেকে কিছু টাকাপয়সা যদি আনা যায়, তাহলে ধানবেচা টাকার সঙ্গে যোগ করে জমি রাখা যাবে। শরিফা স্তম্ভিত।

আমরারে দেখাশোনা করব কে?

নূরা আছে। রহিমা খালা আছে, তারা দেখব।

শরিফা কাঁদে খুনখুন করে। আপন মনে বিড়বিড় করে, রক্তের মধ্যে দোষ। ঘরে মন টিকে না। রহিমাকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ছেলেডা কি বিয়া করতে চায়?

রহিমা মুখে কাপড় দিয়ে হাসে। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে, না বুজি।

হাস ক্যান রহিমা? হাসির কথা কিছু কই নাই। বিয়া যখন করতে চায় তখন পুলাডি এই রকম ঘর ছাড়নের ভয় দেখায়।

না বুজি, বিয়া করব কি। বাচ্চা পুলা।

আজরফকে এখন আর বাচ্চা পুলা বলা যায় না। গম্ভীর হয়ে দাওয়ায় যখন বসে থাকে, তখন শরিফার পর্যন্ত সমীহ করে কথা বলতে ইচ্ছা করে।

এর মধ্যে হঠাৎ মতি মিয়ার একটি চিঠি এসে উপস্থিত। শম্ভুগঞ্জ থেকে লেখা। আমিন ডাক্তার এসে চিঠি পড়ে দিয়ে যায় ও মদন থানার রাধাপুর ইউনিয়ন বোর্ডর প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাকে একটি সোনার মেডেল দিয়াছেন। মেডেলটি ছয়আনি ওজন—-

মেডেলের ব্যাপারটি সর্বৈব মিথ্যা। রূপার একটি মেডেল সাড়ে তিন টাকা খরচ করে মতি মিয়া নিজেই কিনেছে। আসরে নামার সময় গায়ে কোনো মেডেল না থাকলে লোকজনের ভক্তি পাওয়া যায় না। আমিন ডাক্তারকে চিঠিটি তিন-চার বার পড়ে শোনাতে হয়। সেরাত্রে তাকে খাওয়াদাওয়াও করতে হয়। ডাক্তার হৃষ্ট চিত্তে শরিফাকে বলে, বুঝছেন নি দোস্তাইন, মতি মিয়া কানা নিবারণরে ছাড়াইয়া যাইব কইয়া রাখলাম।

শরিফাকে এই সংবাদে খুব উল্লসিত মনে হয় না।

 

বর্ষার জন্যে অসুখবিসুখ হতে শুরু করেছে। পেট খারাপ, জ্বর–অসুখ বলতে এই দুটিই। মানুষের হাতে টাকা আছে। কিছু হতেই ডাক্তারের ডাক পড়ে। কাজেই আমিন ডাক্তারের ভালো সময় যাওয়ার কথা। কিন্তু তা যাচ্ছে না। বর্ষার আগে আগে নতুন এক জন ডাক্তার এসে পড়েছে।

এই অঞ্চলের লোকদের হাতে যখন টাকাপয়সা থাকে, তখন হঠাৎ করে শহুরে ডাক্তার এসে উদয় হয়। লোকদের টাকাপয়সা যখন কমে আসতে শুরু করে, তখন বিদেয় হয়। আগেও এরকম হয়েছে। এতে আমিন ডাক্তারের তেমন কোনো অসুবিধা হয় নি। সোহাগীর লোকজন পুরন ডাক্তারকেই ডাকে। কিন্তু এই বৎসর অসুবিধা হচ্ছে। নতুন যে ডাক্তার এসেছেন, তিনি সোহাগীর লোকজনদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছেন।

ডাক্তারটির নাম শেখ ফজলুল করিম। এসেছেন মোহনগঞ্জ থেকে। সেখানে ডাক্তার সাহেবের বড়োফার্মেসি আছে– শেখ ফার্মেসি। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে যে এ্যাসিসটেন্ট এসেছে, সে আরেক বিস্ময়। লোকটির বাড়ি জৌনপুরে। বাংলা বলতে পারে না। সন্ধ্যাবেলা ডাক্তার সাহেবের ঘরের উঠোনে বসে সুর করে তুলসীদাসের রামচরিতমানস পড়ে। ডাক্তার সাহেব নিজেও কম বিস্ময় সৃষ্টি করেন নি। তিনি সঙ্গে একটি ঘোড়া নিয়ে এসছেন। এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে ঘোড়া কী কাজে লাগবে। জিজ্ঞেস করলে উচ্চৈঃস্বরে হেসে বলেছেন–শীতকালের জন্যে ঘোড়া আনা হয়েছে। তার মানে লোকটি শুধু বর্ষার সময়ের জন্য আসে নি, দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত মধুর স্বভাব। ক দিন হয় এসেছেন, এর মধ্যেই গ্রামের সবার নাম-ধাম জানেন। দেখা হলেই খোঁজখবর করেন। অষুধের জন্য গেলে প্রথমেই বলেন–বিনা পয়সায় অষুধ দিতে পারি। কিন্তু অযুধে কাজ হবে না। পয়সা দিয়ে অষুধ নিলে তবেই অষুধ কাজ করে। গ্রামের সবার ধারণা, কথাটি খুব লেহ্য।

ডাক্তার সাহেবের কাছে সপ্তাহে একটি কাগজ আসে–দেশের ডাক। তিনি উচ্চৈঃস্বরে সেই কাগজ পড়ে শোনান। পড়া শেষ হলে চিন্তিত মুখে বলেন, ইস, দেশের সর্বনাশের আর বাকি নাই। গ্রামের লোকজন সর্বনাশের কারণ ঠিক বুঝতে পারে না, কিন্তু ডাক্তার সাহেবের বিদ্যাবুদ্ধিতে চমৎকৃত হয়।

আমিন ডাক্তার মহা বিপদে পড়ে গেল। রুগীপত্তর একেবারেই নেই। পাওনা টাকাপয়সাও কেউ দিচ্ছে না। সোহাগীর লোকজন যেন ভুলেই গেছে এই গ্রামে আমিন ডাক্তার নামে পুরনো এক জন ডাক্তার আছে। সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে অনেক ফন্দিফিকির করে, কোনোেটাই কোন কাজে আসে না। যেমন– এক দিন সকালে সেজেগুজে গম্ভীর মুখে তার ব্যাগ হাতে বেরুল। যার সঙ্গে দেখা হল তাকেই বলল, নিমতলি থেকে কল এসেছে, রুগীর অবস্থা এখনতখন, আমিন ডাক্তারকে ছাড়া ভরসা পাচ্ছে না। বিশেষ করে নিমতলির কথা বলার কারণ হচ্ছে–নিমতলিতে সিরাজুল ইসলামের মতো নামী ডাক্তার থাকেন।

আষাঢ় মাসের গোড়াতেই আমিন ডাক্তার মহা মুসিবতে পড়ল। না-খেয়ে থাকার যোগাড়। এক দিন চৌধুরী সাহেব এসে দেখেন আমিন ডাক্তার দুপুরবেলা শুকনো চিড়া চিবাচ্ছে। তিনি বড়ই অবাক হলেন। ভাটির দেশে ভাতের অভাব নেই, আর এখন সময়টাই হচ্ছে ফেলে-ছড়িয়ে খাবার। চৌধুরী সাহেব গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রোজগারপাতি কেমুন ডাক্তার?

ইয়ে, আছে কোন মত।

হুঁ।

কলেরা শুরু হইলে কিছু বাড়ব। অখন কম।

চৌধুরী সাহেব যাবার আগে বলে গেলেন, সে যেন অতি অবশ্যি আজ রাত থেকে দু বেলা তার ওখানে খায়। আমিন ডাক্তারের চোখে পানি এসে গেল। সন্ধ্যাবেলা সে গেল নতুন ডাক্তার শেখ ফজলুল করিম সাহেবের কাছে। দেশের ডাক কাগজটি এসেছে। সেইটি পড়া হচ্ছে। প্রচুর লোকজন ঘরে। ফজলুল করিম সাহেব আমিন ডাক্তারকে খুব খাতির করলেন। আমিন ডাক্তার এক পর্যায়ে বলল,

আপনের কাছে একটা পরামর্শের জইন্যে আসলাম ডাক্তার সাব।

কী পরামর্শ?

এই গ্রামে একটা ইস্কুল দিতাম চাই।

আপনি ডাক্তার মানুষ, আপনি স্কুল কি দেবেন।

ডাক্তারী আমি করতাম না। আমার চেয়ে ভালা ডাক্তার ওখন এই গ্রামেই আছে।

লোকজনকে অবাক করে দিয়ে আমিন ডাক্তার উঠে পড়ল। অনেক রাত্রে প্রথম বারের মতো খেতে গেল চৌধুরীবাড়ি। ছোট চৌধুরী বসে ছিল বারান্দায়।

তার গায়ে একটি সূতাও নেই। আমিন ডাক্তারকে দেখেই সে লাফিয়ে উঠল, এই শালা আমিন, তরে আজই আমি খুন করবাম। শালা তুই আমারে দেইখ্যা হাসছস। শালা তর বাপের নাম আজই ভুলাইয়া দিয়াম।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ