সম্পূর্ণ অচেনা একটা বাড়িতে ঢুকে পড়া এবং প্রায়ান্ধকার একটি ঘরে নিঃশব্দে বসে থাকা খুব সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু বাইরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। বুড়ো ভদ্রলোক সদরদরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। সব কটি জানালাও বন্ধ করা হয়েছে। চারদিকে গা চমকানো একটা অন্ধকার। বুড়ো লোকটি সাজ্জাদের দিকে তাকালেন। তার চোখে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা। একটু রাগী চেহারা। গায়ে সাদা রঙের একটা চাদর। নুয়ে নুয়ে হাঁটেন।

তোমার নাম কী?

সাজ্জাদ।

আর তোমার নাম?

শাহজাহান।

তোমাদের ভয় লাগছে?

জি-না।

সাজ্জাদ, তোমার পা কেটে গিয়েছে দেখছি, ব্যথা করছে?

জি-না।

এসো আমার সাথে। পা ধুইয়ে ডেটল লাগিয়ে দিচ্ছি।

আমার কিছু লাগবে না।

বাজে কথা বলবে না। বাজে কথা আমি পছন্দ করি না। নীলু। নীলু।

সাজ্জাদ এবং টুনু দেখল, ওদের বয়েসী একটি মেয়ে এসে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়েছে। বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, এই মেয়েটি আমার নাতনি। ওর নাম নীলাঞ্জনা। আর এদের একজনের নাম শাহজাহান, অন্যজনের নাম সাজ্জাদ। বলো তো নীলু কার নাম সাজ্জাদ?

সাজ্জাদ এবং শাহজাহান মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। বুড়োটা পাগল নাকি? মেয়েটি কিন্তু ঠিকই সাজ্জাদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। বুড়ো মহাখুশি।

ঠিক হয়েছে। এখন যাও ডেটল নিয়ে আসো। তুলা আনো। আর সাজ্জাদ শোনো, তুমি বাথরুমে গিয়ে পা ধুয়ে আসো। নীলুর সঙ্গে যাও। নীল দেখিয়ে দেবে।

আমার কিছু লাগবে না।

একটা চড় লাগাব। যা বলছি করো।

সাজ্জাদ উঠে পড়ল। বাথরুমটা বাড়ির একেবারে শেষপ্রান্তে। নীলু বলল, দাদুমণির রাগ খুব বেশি। তিনি যা বলেন তা সঙ্গে সঙ্গে না করলে খুব রাগ করেন।

সাজ্জাদ মুখ গোমড়া করে বলল, আমি কাউকে ভয় পাই না।

কাউকে না?

শুধু হেড স্যারকে ভয় পাই।

আমার দাদুমণিও তো হেড স্যার।

তাই নাকি?

হুঁ। অবশ্যি এখন রিটায়ার করেছেন।

এই বাড়িতে আর কেউ থাকে না।

না। শুধু আমরা দুজন আর একটি কাজের মেয়ে আছে। সে এসে রান্না করে দিয়ে যায়। আজকে আসেনি।

তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। এইবার সেভেনে উঠব।

সাজ্জাদ বানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, তুমি রাইনোসেরাস বানান করতে পারো?

নীলু অবাক হয়ে বলল, না, রাইনোসেরাস কী?

এক ধরনের গণ্ডার।

রাইনোসেরাস বানান করার দরকার কী?

কোনো দরকার নেই। আমি নিজেও জানি না।

পা ধুতে ধুতে সাজ্জাদের মনে হলো, এই ছোট্ট মেয়েটি মন্দ নয়। পায়ে পানি ঢালছে চোখ বন্ধ করে। সাজ্জাদ বলল, অ্যাই, চোখ বন্ধ করে পানি ঢালছ কেন?

রক্ত দেখতে পারি না যে, এইজন্যে। তোমার ব্যথা লাগছে?

না। আমার ব্যথা-টেথা লাগে না।

ইস, কী মিথ্যুক!

সাজ্জাদ ফিরে এসে দেখে বুড়ো ভদ্রলোক মস্ত একটা জাবদা খাতা খুলে কা যেন লিখছেন। সাজ্জাদকে ঢুকতে দেখেই বললেন, তোমরা কোন ক্লাসে পড়ো?

ক্লাস সেভেনে।

সবাই এক স্কুলে পড়ো?

জি।

মিছিলে গিয়েছিলে নাকি?

জি-না।

আবার মিথ্যা কথা!

জি, গিয়েছিলাম।

বুড়ো লোকটি পাতা বন্ধ করে গম্ভীর গলায় বললেন, একটা জিনিস অপছন্দ করি, সেটা হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা। কেউ যদি মিথ্যা কথা বলে আমি সঙ্গে ধরতে পারি।

এই সময় বাইরের রাস্তায় খুব হইচই হতে লাগল। ঘণ্টা বাজিয়ে একটা দমকল গেল। লোকজন ছোটাছুটি করতে লাগল। একটা ভারী ট্রাক গেল। সম্ভবত মিলিটারি ট্রাক। বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, মনে হচ্ছে আজ রাতটা তোমাদের এখানেই কাটাতে হবে। শোনো, নীলু আমাকে দাদুমণি ডাকে। তোমরাও তাই ডাকবে। এখন যাও, নীলুর সঙ্গে গল্প-টল্প করো। পরে তোমাদের সঙ্গে কথা বলব। দাদুমণি খাতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

.

এদের বাড়িটি বেশ বড়। অনেকগুলি কামরা নীলুর দখলে। একটিতে নীলুর লাইব্রেরি। সেই লাইব্রেরি দেখে সাজ্জাদ ও বল্টুর আক্কেল গুড়ুম। একটা পুচকে মেয়ের এত বই! নীলু বলল, সব আমার দাদুমণি কিনে দিয়েছেন।

তুমি পড়েছ সবগুলি?

পড়ব না কেন?

বল্টু বলল, নীল আতঙ্ক পড়েছ? দারুণ বই!

না, পড়িনি।

আমি নিয়ে আসব তোমার জন্যে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নীল তার সমস্ত সম্পত্তি দেখিয়ে ফেলল। তাদের সবচেয়ে মজা লাগল দাদুমণির মিথ্যা খাতা দেখে। মিথ্যা খাতায় দাদুমণি সব মিথ্যা খবরগুলি তুলে রাখেন। খবরের শেষে মজার সব মন্তব্য লেখা থাকে। দুএকটা নমুনা দেওয়া যাক।

অদ্ভুত গাছ
(নিজস্ব সংবাদদাতা)

নোয়াখালীর ছাগলনাইয়াতে জনৈক আহমেদ আলীর একটি অদ্ভুত খেজুরগাছ দেখিবার জন্যে মানুষের ঢল নামিয়াছে। উক্ত খেজুরগাছটি নামাজের সময় সেজদার ভঙ্গিতে নুইয়া পড়ে। খেজুরগাছের এই অদ্ভুত কাল্পে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া যাইতেছে না।

মন্তব্য : নোয়াখালীর ছাগলনাইয়াতে আমি নিজে গিয়েছিলাম। এই জাতীয় গাছের কোনো সন্ধান আমাকে কেহ দিতে পারে নাই। এই মিথ্যা সংবাদ প্রচারের আসল উদ্দেশ্য কী? বুঝিতে পারিতেছি না।

আমগাছে কাঁঠাল

প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে সম্প্রতি সাতক্ষীরার কুণ্ডচরণ বৈরাগীর একটি আমগাছে প্রকাণ্ড কাঁঠাল ফলিয়াছে। কুণ্ডচরণ আমাদের নিজস্ব সংবাদাতাকে জানান যে, উক্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করিবার জন্যে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসিতেছে। সাতক্ষীরা মহকুমার এসডিও সাহেবও আসিয়াছিলেন।

মন্তব্য : আমি সাতক্ষীরার এসডিও সাহেবকে একটি চিঠি লিখে জানতে পারি যে, তিনি নিজে সেই কাঁঠাল দেখেননি, তবে খবর শুনেছেন। আমি পত্রিকার সম্পাদকের কাছে নিজস্ব সংবাদদাতার ঠিকানা জানতে চাই। সম্পাদক সাহেব আমাকে জানান, উক্ত সংবাদদাতা বর্তমানে ছুটিতে আছেন।

ছাগলের গর্ভে সর্পশিশু

সম্প্রতি একটি ছাগল দুটি সপশিশু প্রসব করিয়াছে। ঘটনাটি ঘটে ময়মনসিংহ জেলার নীলগঞ্জে। প্রসবের দুই ঘণ্টার মধ্যে একটি সর্পশিশুর মৃত্যু ঘটে। তবে অন্যটি এখন সুস্থ আছে। ব্যাপারটি স্থানীয় জনগণের মনে দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করিয়াছে।

মন্তব্য : গাঁজাখুরির একটা সীমা থাকা দরকার।

নীলু হাসিমুখে বলল, দাদুমণি মিথ্যা কথা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।

তিনি নিজে বুঝি সবসময় সত্যি কথা বলেন।

তা বলেন।

যখন আমাদের মতো ছোট ছিলেন তখনো বলতেন?

তা তো জিজ্ঞেস করিনি।

সাজ্জাদ গম্ভীরভাবে বলল, তখন তিনি ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা বলতেন। জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।

নীল হেসে ফেলল। হাসি আর থামতেই চায় না। এই সামান্য কথায় কেউ এত হাসে নাকি?

একসময় তারা নীলুর পোষা ময়না দেখতে গেল। এই ময়নাটিকে নীলু নিজেই নাক কথা বলা শিখিয়েছে। এমনভাবে শিখিয়েছে যাতে মনে হয় ময়না বুঝি সত্যি সত্যি কথা বলে। কেউ কাছে গিয়ে দাড়ালেই ময়না বলবে, তোমার নাম কী? তোমার নাম কী?

নাম বলার পর ময়না দুএক মিনিট চুপ করে থেকে বলবে, তুমি কেমন আছ?

এই প্রশ্নের জবাব দিলেই ময়না নেবে, ওগো বাড়িতে মেহমান এসেছে।

দারুণ মজার ব্যাপার।

কেলবেলা দাদুমণি বললেন, এইবার রান্নাবান্না শুরু করা যাক। কী খাবে তোমরা।

বল্টু গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের খিদে নেই।

এটা তো ঠিক বললে না। তোমার খিদে না থাকতে পারে, কিন্তু অন্যদের নেই সে বুঝল কী করে?

নীল খিলখিল করে হেসে উঠল।

সন্ধ্যার পর বল্টু বিনা নোটিসে কাঁদতে শুরু করল। দাদুমণি প্রথম কিছু ভাব করলেন যেন দেখতে পাননি। সাজ্জাদ খুব অস্বস্তি বোধ করছিল। তার ধারণা নীলু খুব হাসাহাসি করবে। কিন্তু নীলু হাসল না। সেও এমন ভাব করল যেন কিছু দেখতে পায়নি। শেষপর্যন্ত দাদুমণি বললেন, তোমার বোধহয় পেট ব্যথা করছে, তাই না? বল্টু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, হ্যাঁ।

আমিও তাই ভেবেছিলাম। বাসার জন্যেও পহয় একটু খারাপ লাগছে। লাগছে?

লাগছে।

বাসায় তোমার কে কে আছেন?

আব্বা, আম্মা আর দাদি।

সকাল হলেই ওরা কার্ফু তুলে নেবে। তখন সবার আগে আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব। কেমন?

বল্টু মাথা নাড়ল।

একটা তো মোটে রাত। দেখাত দেখতে কেটে যাবে। মাঝে মাঝে দেশের খুব বড় দুঃসময় আসে। তখন দেশের মানুষকে কষ্ট করতে হয়। এই যেমন আমরা করছি।

দাদুমণি কিছুক্ষণ থেমে থেকে মৃদুস্বরে বললেন, এই গণ্ডগোল, মিছিল কেন হচ্ছে তোমরা জানো?

জানি।

কেন হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেছে, সেইজন্যে।

কিন্তু এর আগেও তো আমরা অনেক মিছিল-টিছিল করেছি। করিনি?

করেছি।

সেগুলি কী জন্যে করেছি জানো?

সবাই চুপ করে রইল। দাদুমণি বললেন, তোমাদের এসব জানা উচিত। চোখের সামনে এত বড় একটা অন্দোলন হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানা উচিত না?

জি।

আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি; গোড়ার কথাগুলি অনেকেই জানে না। সমগ্র পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে, এই জিসিটা জানো?

না।

একধরনের মানুষ হচ্ছে শোষক, যারা শোষণ করে। আর অন্যধরনের মানুষ হচ্ছে শোষিত। অর্থাৎ এদের শোষণ করা হয়। পাকিস্তানের জন্ম হলো মুসলমানদের নিয়ে। তখন শোষিত মানুষ ভাবল আর তাদের দুঃখকষ্ট থাকবে না। এইবার সুখ আসবে।

সুখ কিন্তু এল না। কারণ পাকিস্তানেও একদল আছে যারা শোষক। তারা ধনী, তাদের হাতে ক্ষমতা আছে। এদের বেশিরভাগই হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি। দেশের রাজধানীও তার অংশে। কাজেই তারা জোরেসোরে শোষণ শুরু করল। এবং আমরা পূর্বপাকিস্তানের মানুষরা হলাম শোষিত। আমাদের শোষণ করতে লাগল তারা যাতে কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি। কাজেই আমরা তাদের ঘৃণা করতে শুরু করলাম। আমাদের এই ঘৃণা তারা কখন প্রথম বুঝতে পারল জানো?

না, কখন?

ভাষা আন্দোলনের সময়।

ভাষা আন্দোলনের সময় তাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। তখন তারা বুঝতে পারল, আরে পূর্বপাকিস্তানের এই মানুষগুলি তো সহজ পাত্র নয়। কাজেই তারা এখন খুব সাবধান। এবং আমার কী মনে হয় জানো? আমার মনে হয় এরা কিছুতেই শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা দেবে না।

সাজ্জাদ হঠাৎ বলে বসল, আমাদের হাতে ক্ষমতা আসলে আমরাও কি শোষক হয়ে যাব?

যেতে পারি। হয়তো দেখা যাবে আমরা তখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ করতে শুরু করেছি। তখন হয়তো তারাও আন্দোলন শুরু করবে।

নীলু বলল, এসব শুনতে ভালো লাগছে না দাদুমণি। একটা ভূতের গল্প বলো।

দাদুমণি বললেন, এখন আর ভূতের গল্প বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ঠিক তখন কারেন্ট চলে গিয়ে চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। উত্তরদিক থেকে খুব হইচই হতে লাগল। দাদুমণি দরজা খুলে কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ফিরে এসে বললেন, কোথায় যেন আগুন লেগেছে, উত্তরদিকে। বিরাট আগুন।

রাতের ভাত খাওয়ার সময় রেডিওতে বলল লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্বপাকিস্তানে আসছে।

বল্টু আবার কাঁদতে শুরু করল। দাদুমণি বললেন, কী হয়েছে বল্টু? পেট ব্যথা করছে।

না, বাসার জন্যে খারাপ লাগছে।

কার্ফু উঠলেই আমি তোমাকে বাসায় দিয়ে আসব।

বল্টু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, যদি কার্ফু না ওঠে?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ