জামান বড় সাহেবের কাছে ফাইল নিয়ে গিয়েছিল। এক মিনিটে কাজ হয়ে যাবার কথা–দুটা সই দেবেন। সে ফাইল নিয়ে চলে আসবে। সে জায়গায় সময় লাগল এক ঘন্টা দশ মিনিট। বড় সাহেবের টেলিফোন চলে এল। তিনি একটা সিগনেচার দিয়ে টেলিফোন ধরলেন এবং কাঁটায় কাঁটায় এক ঘণ্টা কথা বললেন।

এই এক ঘণ্টা জামানকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। কারণ কেরানি শ্রেণীর কেউ বড় সাহেবের ঘরে চেয়ারে বসবে না। এটাই অলিখিত নিয়ম। জামানকে ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হল, বড় সাহেব বসার জন্যে ইশারা করলেন না। ঘরে যে একজন মানুষ ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছে এই ব্যাপারটা তিনি যেন পুরোপুরি ভুলে গেলেন। স্মৃতিভ্রষ্ট হলেন।

টেলিফোনের কথা শেষ হওয়া মাত্র আবার তাঁর স্মৃতি ফিরে এল–তিনি জামানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর কোথায় সই করতে হবে? সব দেখে দিয়েছেন তো?

জি স্যার?

গুড। প্রয়োজনে একবারের জায়গায় দশবার দেখবেন কিন্তু ভুল যেন না থাকে।

জামান ফাইল হাতে নিজের ঘরে এসে দেখে নায়লা তার সামনের চেয়ারে বসে আছে। নায়লার মুখ হাসি হাসি। কাজেই কোন দুঃসংবাদ দিতে আসেনি। সাহেবদের স্ত্রীরা অফিসে গল্প-গুজব করতে আসেন। তার মতো মানুষের স্ত্রীরা অফিসে আসে দুঃসংবাদ নিয়ে।

কি ব্যাপার লায়লা?

তোমার ভাত নিয়ে এসেছি।

কোন দরকার ছিল না তো। ক্যান্টিনে খেয়ে নিতাম।

লায়লা হাসল। জামানকে অবাক করে দিতে পেরেছে এতেই সে আনন্দিত। আজ সকালে সে জামানের ভাত রাধতে পারেনি। এমন ঝামেলা বেঁধে গেল! একদিকে বাবু কাঁদে, অন্যদিকে ফিরুর মার চিৎকার–সে কাজ করবে না। তাকে বেতন দিয়ে বিদায় দিতে হবে।

এই মহা ঝামেলার ভেতর ভাত হবে কি ভাবে? জামান বলেছে, তুমি ব্যস্ত হয়ে না, আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নেব। নায়লা বলেছে, আচ্ছা। কিন্তু তখনি সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, ভাত বেঁধে সে টিফিন কেরিয়ারে করে অফিসে নিয়ে আসবে।

জামান বলল, বাবু কোথায়? ওকে কার কাছে রেখে এসেছ? ফিরুর মার কাছে?

পাগল! ওর কাছে আমি বাবুকে রেখে আব? মার কাছে রেখে এসেছি।

কলাবাগানে গিয়েছিলে?

হুঁ।

এত ঝামেলা করার কোন দরকার ছিল না।

একটু না হয় করলামই ঝামেলা। রোজ রোজ তো করি না। এখন বল ভাতটা খাবে কোথায়, এখানে?

না, ক্যান্টিনে।

তাহলে চল ক্যান্টিনে যাই।

তুমি বাসায় চলে যাও, আমি খেয়ে নেব।

নায়লা হাসিমুখে বলল, আমি তোমার সঙ্গে গেলে কি কোন অসুবিধা আছে? নাকি তোমাদের ক্যান্টিনে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ?

নিষেধ না, চল।

প্লেট-গ্লাস এগুলি কি ক্যান্টিন থেকে নেবে?

হুঁ।

তাহলে দুটা প্লেট নিও তো। আমিও তোমার সঙ্গে খাব। দুজনের খাবার এনেছি।

জামান খানিকটা ব্রিত ভঙ্গিতেই স্ত্রীকে নিয়ে কোণীর দিকে একটা টেবিলে বসেছে। তাদের ক্যান্টিনে দুজন মাত্র মহিলা কাজ করেন, তারা কখনো ক্যান্টিনে খেতে আসেন না। কাজেই এই ক্যান্টিন মহিলা বর্জিত। ক্যান্টিনের বয়-বাবুর্চি সবাই কৌতূহলী চোখে দেখছে।

নায়লা বলল, মার বাসায় আজ খাসির গোশত রান্না হয়েছে। তোমার কাছে আসছি শুনে মা গোশত দিয়ে দিয়েছেন। আমি এনেছি শুধু বেগুন ভাজা আর ডাল। এদেরকে বলেলে কি এরা কাঁচামরিচ দেবে? আমি কাঁচামরিচ আনতে ভুলে গেছি।

জামান কাঁচামরিচ দিতে বলল।

নায়লা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রায়ই দুপুরে এই ক্যান্টিনে এসে সে খেয়ে যায়। নায়লা বলল, তুমি নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছ, ব্যাপার কি? কথা বল।

কি কথা বলব?

যা ইচ্ছা বল।

অফিসে তুমি কথাবার্তা বল না? আচ্ছা, আজ অফিসে সবচে মজার ঘটনা কি ঘটেছে?

অফিসে মজার ঘটনা কিছু ঘটে না।

নায়লা বলল, আজ তো একটা মজার ঘটনা ঘটেছে, সেটাই না হয় বল।

জামান বিস্মিত হয়ে বলল, কই, আজ তো কিছু ঘটে নি।

ঘটবে না কেন? এই যে আমি এসেছি এটা একটা মজার ঘটনা না?

নায়লা হাসছে। হাসলে তার বাম গালে টোল পড়ে। দেখতে জামানের বেশ মজা লাগে। ভরাট গালের মেয়ে, হঠাৎ সেখানে একটা গর্ত হয়ে গেল।

নায়লা বলল, অবাক হয়ে কি দেখছ?

কিছু না।

অবশ্যই কিছু দেখছ। বল না কি?

কিছু দেখছি না নায়লা।

তুমি আরাম করে খচ্ছি না। বার বার শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ। আরাম করে খাও তো। তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে বসে খাচ্ছ, এটা কোন গুরুতর অপরাধ না যে এমন সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে। খাসির গোশতটা খেতে কেমন হয়েছে?

ভাল।

মেথি দিয়ে রান্না। এই রান্নাটা আমি জানি না। কতবার ভেবেছি শিখে নেব, আর শেখা হয় না। তোমার বন্ধুকে দাওয়াত করে একদিন মার হাতের মেথি দিয়ে রান্না করা গোশত খাওয়াব। তাহলে সে বুঝবে রান্না কাকে বলে।

আচ্ছা।

তোমার বন্ধু ভাল খাবার খুব পছন্দ করে, তাই না।

হুঁ।

এরকম লোককে খাইয়ে অনিন্দ আছে। তোমাকে খাইয়ে কোন আনন্দ নেই। তোমার কাছে মনে হয় সব খাবারই এক রকম লাগে, তাই না?

জামান হাসল।

সঙ্গে সঙ্গে নায়লাও হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমি কিন্তু পান খাব। তোমাদের এখানে পান পাওয়া যায়?

যায়।

তাহলে আনতে বল। মিষ্টিপান খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। আমি কিন্তু কিছুক্ষণ এখানে বসে তোমার সঙ্গে গল্প করব। এই অপরাধে তোমার বড় সাহেব আবার তোমার চাকরি নট করে দেবে না তো?।

জামান কিছু না বলে নিজেই পান আনতে গেল। মিষ্টিপান এখানে পাওয়া যায় না। রাস্তার ওপাশে একটা দোকানে ভাল মিষ্টিপান করে।

দুটা পান এক সঙ্গে মুখে দিয়ে নায়লা বলল, ঐ মেয়েটা কি পান খেত?

জামান বিস্মিত হয়ে বলল, কোন মেয়ে?

যে মেয়েটার প্রেমে তোমার বন্ধু হাবুডুবু খাচ্ছিল।

ও আচ্ছা, রেশমার কথা বলছ?

ওর নাম রেশমা?

হুঁ।

রেশমা কি পান খেত?

জানি না তো। এত লক্ষ্য করিনি।

মেয়েটা দেখতে কেমন ছিল?

সুন্দর ছিল।

সুন্দর মানে কি রকম সুন্দর? খুব সুন্দর?

হ্যাঁ, খুব সুন্দর। মেয়েটা দেখতে অনেকটা তোমার মতই ছিল।

সত্যি?

হুঁ।

নায়লা আগ্রহের সঙ্গে বলল, ওর কোন জিনিসটা আমার মত ছিল, চোখ, চুল, নাক, মুখ–কোনটা?

আমি বলতে পারব না। আলমকে জিজ্ঞেস করো। ও বলতে পারবে।

ঐ মেয়ের গালেও কি টোল পড় তো?

হুঁ।

এটা দেখি আবার মনে আছে।

আলম সব সময় বলতে, এই জন্যে মনে আছে।

আচ্ছা, তুমি আমাকে আগে কিছু বলনি কেন?

আগে কি বলব?

এই যে মেয়েটার চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার এত মিল–এটা।

বলে কি হবে? বলার কি আছে?

আমার সঙ্গে তুমি কথা বলে কোন আরাম পাও না, তাই না?

জামান তাকিয়ে আছে। নায়লা কি বলতে চাচ্ছে সে ঠিক বুঝতে পারছে না। নায়লা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমাকে বিয়ে না করে অন্য কাউকে বিয়ে করলে তুমি অনেক সুখি হতে। এটা বলায় রাগ করলে নাকি?

না।

তোমার এই গুণটা ভাল। কিছুতেই রাগ কর না। যার যা ইচ্ছে বলুক, তোমার কিছু যায় আসে না।

জামান বলল, নায়লা, তুমি এখন বাসায় চলে যাও–আমি কিছু কাজকর্ম করি।

কাজকর্ম তে সারাজীবনই করলে, একদিন না হয় না করলে। আজ ছুটি নিয়ে নাও না। চল আজ দুজনে ঘুরে বেড়াই।

কোথায় যাব?

সাভার স্মৃতিসৌধে যাব। এত সুন্দর জায়গাটা! ঐখানে পর্যটনের একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চল আজ বিকেলের চটা ঐ রেস্টুরেন্টের বারান্দায় বসে খাব।

আরেকদিন যাব নায়লা। অনেক কাজ আছে। অফিসের অবস্থা ভাল না। নানা রকম গুজব শোনা যাচ্ছে। এবার নাকি অনেক ছাটাই হবে।

সারা বছর কাজ করেছ, একদিন শুধু আধবেলা কাজ না করার জন্যে তুমি ছাটাই হয়ে যাবে?

তা না।

তাহলে চল।

আজ থাক লায়লা। বড় সাহেব আমাকে একটা ফাইল দিয়েছেন–ফাইলটা আজই শেষ করে উনাকে দিতে হবে।

উনাকে গিয়ে বল–স্যার, আজ আমার স্ত্রীর জন্মদিন। ও এসে বসে আছে। ওকে নিয়ে একটু বাইরে না গেলে পারিবারিক সমস্যা হবে। তুমি বলতে না পারলে আমি বলি।

জামান বলল, আজ তোমার জন্মদিন নাকি?

না। সামান্য একটু মিথ্যা না হয় স্ত্রীর কারণে বললে।

জামান বলল, সামনের শুক্রবারে চল সাভার থেকে ঘুরে আসব। টেনশান নিয়ে কোথাও যাওয়া ঠিক না।

নায়লা ক্লান্ত গলায় বলল, আচ্ছা। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে সে চোখের পানি আটকে রাখছে। আজ সত্যি তার জন্মদিন।

একা একা সে কি করবে? রাস্তায় হাঁটবে? আচ্ছা, সে যদি আলমের হোটেলে উপস্থিত হয়ে বলে–আচ্ছা শুনুন, আজ আমার জন্মদিন। আজ সারাদিন আমি আপনাকে নিয়ে ঘুরব? তাহলে কেমন হয়?

নায়লা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। মানুষ যা ভাবে খুব কম সময়ই তা করতে পারে।

আচ্ছা, একা একা সাভার চলে গেলে কেমন হয়?

রাস্তায় নেমে নায়লা চোখ মুছতে লাগল। বার বার তার চোখ পানিতে ভিজে উঠছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ