নায়লাদের বাসাটা ফ্ল্যাটবাড়ি বলতে যা বোঝায় তা না। ফ্ল্যাটের মালিক শুরুতে ছাদে ড্রাইভারদের থাকার জন্য কিছু ঘর করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, এই ঘরগুলি বেশ ভাল টাকায় ফ্ল্যাটের মালিকরা কিনে নেবেন। বাস্তবে দেখা গেল, ড্রাইভারদের জন্যে ঘর নিতে কেউ আগ্রহী নয়। ফ্ল্যাট-মালিক তৈরী ঘরগুলি নষ্ট করলেন না। রাজমিস্ত্রীকে দিয়ে আরো কিছু কাজ করিয়ে তিনটা ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট বানালেন। একটা শোবার ঘর। একটা বসার ঘর। ডাইনিং টেবিল বসানোর জন্যে সামান্য কিছু ফাঁকা জায়গা। এই ফ্ল্যাটগুলি বিক্রির চেষ্টা হচ্ছে–খুব সস্তা। ন লক্ষ টাকা। এক সঙ্গে ক্যাশ পেমেন্ট করলে আরো কম–আট লাখ পঞ্চাশ হাজার।

মিনি ফ্ল্যাটও বিক্রি হল না। শেষ পর্যন্ত ভাড়াটে খাজা হতে লাগলো। জামানের মতো কয়েকজনকে পাওয়া গেল। এদের মধ্যে জামান সবচে ভাগ্যবান, কারণ তাকে স্বচে কম ভাড়া দিতে হয়–মাত্র ১৭ শ টাকা। তার ভাড়া কম হওয়ার কারণ হলো, সে ফ্ল্যাটওয়ালাদের এসোসিয়েশনের কিছু কাজকর্ম করে দেয়। সে তাদের একজন পার্ট-টাইম এমপ্লোয়ি।

জামানের এই ফ্ল্যাট খুব পছন্দ! প্রথম দিনেই মুগ্ন গলায় বলেছিল, ফ্ল্যাট যেমন তেমন, কতবড় ছাদ দেখেছ? ছাদের মালিক তো আমরাই। ছাদটা সব সময় থাকবে আমাদের দখলে। বাবু ছোটাছুটি করে খেলতে পারবে। নায়লা, তোমার পছন্দ হয়েছে?

নায়লা হাসলো। তার হাসি দেখে মনে হতে পারে মিনি ফ্ল্যাট তার খুব পছন্দ হয়েছে। আসলে তার মোটেই পছন্দ হয়নি। এত উঁচুতে মানুষ থাকে? পায়ের নিচে মাটি নেই–এ কেমন থাকা? তাছাড়া ছাদের রেলিং নিচু। বাবু আরেকটু বড় হলেই রেলিং-এ চড়ার চেষ্টা করবে। তখন?

বুঝলে নায়লা, ১৭ শ টাকায় এরকম বাড়ি ঢাকা শহরে পাওয়া ভাগ্যের কথা। আমি হলাম একজন মহাভাগ্যবান ব্যক্তি। কি রকম হওয়া দেখেছ? ভাদ্র মাসেও দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হবে। এমনই হবে হাওয়ার যন্ত্রণা। মশারিও খাটাতে হবে না।

মশারি খাটাতে হবে না কেন?

মশা পাখায় ভর করে এত উঁচুতে উঠতে পারে না। যত উপরে উঠবে হাওয়া তত

হালকা হবে। এটা হল সায়েন্সের কথা।

নায়লা বলল, তোমার বাড়ি খুব পছন্দ হয়েছে?

অবশ্যই হয়েছে। পছন্দ না হওয়ার কোন কারণ আছে? ছাদের উপর জুটা চেয়ার ফেলে রাখব। দুজনে বসে চা খাব। জোছনা রাতে ছাদে বসে চা খাবার মজাই আলাদা। শুধু সিঁড়ি ভেঙে এতদূর উঠা একটা কষ্টের ব্যাপার হবে। তবে বার বার উঠা-নামার দরকার কি?

সিড়ি ভেঙে উঠতে হবে কেন? লিফট আছে না?

লিফট তো আর ছাদ পর্যন্ত আসবে না।

আটতলা পর্যন্ত তে আসবে। সেখান থেকে একতলা হেঁটে উঠবে।

জামান লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো, লিফটে উঠা যাবে না নায়লা।

কেন?

ওরা নিষেধ করে দিয়েছে। এসোসিয়েশন। কারণ আমরা ছাদে যারা আছি তারা তো আর লিফটের খরচা দিচ্ছি না। আমরা হচ্ছি ফ্ল্যাটের থার্ড গ্রেড সিটিজন। ড্রাইভার শ্ৰেণী। আমাদের উঠতে হবে হেঁটে হেঁটে।

এটা কেমন কথা?।

জামান উজ্জ্বল মুখে বলল, এর একটা ভালো দিকও আছে। আত্মীয়স্বজন সহজে কেউ আসবে না। মেহমানদারির খরচ বেঁচে গেল। এই জমানায় মেহমানদারির খরচ তে! সহজ খরচ না। বেজায় খরচ।

তুমি সিড়ি ভাঙবে কি ভাবে? অল্প খানিকটা উঠতেই তোমার যে অবস্থা হয়। নিঃশ্বাস নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

আমার কোনই অসুবিধা হবে না। আস্তে আস্তে উঠব। তাছাড়া এক্সারসাইজ হবে। এক্সারসাইজের তো দরকার আছে। এমনিতে তে এক্সারসাইজ হয়ই না। সিড়ি ভাঙার কারণে যদি হয়। শাপে বর হলো আর কি? হা হা হা।

 

শাপে বর ঠিক হয় নি।

আজ একদিনে চারবার জামানকে উঠা-নামা করতে হয়েছে। বাইরের একজন মেহমান খাবে। বাজার আছে। সব কিছু একসঙ্গে হয় না। প্রথমবার পান আনতে ভুলে গেলো।

পান আনার পর মনে হল, মিষ্টি কিছু থাকা দরকার। জামান আবার রওনা হলো। নায়লা বলে দিল, শোন, লিফটে করে আসবে। হঠাৎ হঠাৎ উঠা। কেউ দেখবেও না।

জামান হাসল, তার মানে সে লিফটে উঠবে না। হেঁটেই উঠবে। কোন মানে হয়?

শোন, তুমি কিন্তু তোমার বন্ধুকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে রওনা দেবে না। অবশ্যই লিফটে আসবে।

আচ্ছা, সেটা দেখা যাবে।

দেখা যাবে টেখা যাবে না। অবশ্যই লিফটে উঠবে।

জামান আবার হাসল।

সব সময় এরকম হাসি দেখতে ভাল লাগে না। রাগ লাগে। নায়লার রাগ লাগছে।

 

আলম ফুলের তোড়া কিনেছে। পঞ্চাশটা গোলাপের বিশাল-তোড়া। আড়াই শ টাকা নিল তোড়ার দাম। এত টাকা দিয়ে ফুল কেনার কোন মানে হয়? জামান বলল, ফুল কেনাকেনির দরকার কি?

আলম বলল, কোন দরকার নেই। ফুল দিয়ে কি হয়? কিছুই হয় না। লাউ ফুল হলেও একটা কথা ছিল। বড়া বানিয়ে তুই খেয়ে ফেলতিস।

জামান বলল, ঘরে ফুলদানি-টুলদানি নেই। এত ফুল রাখবে কোথায়?

ফুলদানি নেই? বলবি তো। চল ফুলদানি কিনি।

আরে না না।

সব সময় না না করবি না। চল, সুন্দর একটা ফুলদানি কিনি। তোর বৌ খুশি হবে।

জামানের অস্বস্তির সীমা রইল না। ফুলদানির কথাটা বলাই ভুল হয়েছে। কেন যে বলল। জার্মান ক্রিস্টালের ফুলদানির দাম পড়ল সতের শ টাকা। এতটাকা দিয়ে লোকজন ফুলদানি কেনে? এত টাকা মানুষের আছে?

আলম বলল, আর কি কেনা যায়?

যথেষ্ট হয়েছে। আর কি কিনবি?

তোর বাচ্চার জন্যে খাবার। সে চকলেট খায় তো?

আলম, তোর পায়ে পড়ি, আর কিছু কিনতে হবে না।

চকলেট তো কিনতেই হবে। ছোট বাচ্চাদের ফুল দিয়ে ভুলানো যায় না। ওদের ভুলাতে হয় খাবার দিয়ে।

এক প্যাকেট চকলেট কেনা হলো। ইংল্যাণ্ডের কেডবেরিজ কোম্পানীর চকলেট। সাড়ে চার শ টাকা খরচ হল চকলেটে। জামান দ্রুত হিসেব করছে কত খরচ হল। আড়াই শ টাকা ফুল, সতেরো শ টাকা ফুলদানি, সাড়ে চার শ টাকা চকলেট–সব মিশিয়ে দু হাজার চার শ। কি সর্বনাশের কথা।

জামান।

কি?

আর এখন তোর বৌয়ের জন্যে একটা শাড়ি কিনি। তার কি রঙ পছন্দ বল তো?

অসম্ভব। আর কিছু তোকে কিনতে দেব না।

তুই না বললে তো হবে না। কেনার ব্যাপারটা আমার। তোর দায়িত্ব হচ্ছে উপহারের ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘোর। এখানে কি ভাল কফি শপ আছে? কড়া করে এক কাপ কফি খেয়ে নতুন উত্তেজনায় শাড়ি কেনা শুরু হবে। কফি শপ এখানে নেই?

আছে কি না জানি না। নিউ মার্কেটে এসে তো কখনো কফি খাইনি। চায়ের দোকান আছে।

চা-তেও চলবে। চল চা খওয়া যাক।

চায়ের দোকানে জামান লজ্জিত ও সংকুচিত ভঙ্গিতে বসে আছে। বড় অস্বস্তির মধ্যে পড়া গেল। আলম পাগলা টাইপের সব সময়ই ছিল। এখন কি তার পাগলামি আরো বেড়েছে? সামান্য দাওয়াত খেতে যাবার সময় এত কিছু কেউ কেন? এটা কি বাড়াবাড়ি না?

জামান?

হুঁ।

তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোর উপর দিয়ে একটা রোলার চলে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও তো বেশ হাসিখুশি ছিলি। এখন হয়েছে কি?

কিছু না।

কিছু না হলে পুরানো বন্ধুর সঙ্গে হাসিমুখে চা খা। তোকে দেখে মনে হচ্ছে এক কাপ ইদূর-মারা বিষ সামনে নিয়ে বসে আছিস। চ-টা ভাল হয়েছে। চুমুক দে।

জামান যন্ত্রের মতো চায়ে চুমুক দিল। আলম ঝুঁকে এসে বলল, শেনি রে ব্যাটা, তোর এত অস্বস্তি বোধ করার কিছুই নেই। আমি হত-দরিদ্র ছিলাম, এখন ভাল টাকাপয়সা হয়েছে। কি পরিমাণ হয়েছে শুনলে তুই ভড়কে যাবি। সামান্য খরচ করি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের জন্য যে খরচ করব সেই উপায়ও তো নেই। নো আত্মীয়স্বজন, নো বন্ধু-বান্ধব। তা ছাড়া এইসব উপহার-টুপহার কেনার পেছনে আমার উদ্দেশ্যও আছে। আমি এখন একজন ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসায়ীরা বিনা উদ্দেশ্যে কিছু করে না।

উদ্দেশ্যটা কি?

এটা হল আমার এক ধরনের ইনভেস্টমেন্ট। আমি ইনভেস্ট করছি।

কিসের ইনভেস্টমেন্ট?

আমি বিয়ে করব। আমাকে একটা মেয়ে খুঁজে দিতে হবে। কে খুঁজবে? তোর বৌকেই খুঁজতে হবে। তাকে খুশি না করলে এই কাজটা সে আগ্রহ নিয়ে করবে না। এটা হল আমার প্রথম উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল, এক থেকে থেকে আমার জীবন অসহ্য হয়েছে। একটা ফ্যামিলীর সঙ্গে থাকা যে কি জিনিস আমি ভুলেই গেছি। তোর বৌ যদি বলে ফেলে, আপনি হোটেলে পড়ে আছেন কেন? অল্প কদিন থাকবেন। আমাদের সঙ্গে থাকুন। তখন পোটলা-পুটলি নিয়ে উঠে আসব। তোর কি ধারণা? এ রকম কলার সম্ভাবনা আছে?

না।

আলম অবাক হয়ে বলল, না কেন? সে কি বন্ধু-বান্ধব পছন্দ করে না?

খুবই পছন্দ করে। তোকে সে রাখবে কোথায়? থাকার জন্যে একটা ভালো বিছানা তে অদ্ভুত দিতে হবে। আমাদের বাসায় একটা মাত্র বাথরুম, সেই বাথরুমে যেতে হয় শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে।

তুই বলতে চাচ্ছিস সে কখনোই আমাকে থাকতে বলকে না?

না।

হোটেলে যে কি ভয়াবহ অবস্থায় আছি সেটা করুণ গলায় বললেও লাভ হবে না?

না।

তোর সঙ্গে এক হাজার টাকা বাজি–সে আজ রাতেই বলবে হোটেল ছেড়ে দিতে। নে, সিগারেট নে। ধোয়া দিয়ে মাথাটাকে একটা ওয়াশ দে। তারপর চল্ সুন্দর দেখে শাড়ি কিনি। কি রঙ তোর বৌয়ের পছন্দ?

জানি না।

জানি না মানে? স্ত্রীর কোন ব্রঙ পছন্দ সেটা হাসবেন জানবে না। আমেরিকা হলে এই অপরাধে তোর ডিভোর্স হয়ে যেত। তুই কি তোর স্ত্রীকে নিয়ে কখনো শাড়িটারী কিনতে আসিস নি?

এসেছি। খেয়াল করিনি।

তোর স্ত্রীর গায়ের রঙ ফর্সা না কালো? না-কি এটাও খেয়াল করিসনি?

ফর্সা।

তাই-ই বল–বেঁটে না লম্বা?

লম্বা।

কি রকম লম্বা–তালগাছ না বাঁশ গাছ?

মোটামুটি।

চল দেখা যাক। শাড়ির দোকানের সঙ্গে ব্যবস্থা করে যাব, পছন্দ না হলে যাতে ফেরত নেয়।

আলম উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, বুঝলি আলম, এই পৃথিবীতে সবচে সহজ কাজ হলো মেয়েদের খুশি করা। এরা খুশি হবার জন্যেই বসে আছে। অথচ আমাদের রবীন্দ্রনাথ ভুল কথা বলে গেলেন–রমণীর মন। সহস্র বৎসরের সখ সাধনার ধন। সহস্র বৎসর লাগে না। ঘণ্টা খানিকের সাধনাতেই কাজ হয়।

জামান বলল, আমি জানতাম না।

সবচে সহজে খুশি করা যায় কাদের জানিস? বিবাহিত মেয়ে, যার ছোট একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চাটাকে মার সামনে টেনে নিয়ে শুধু বলবি, এই রাজপুত্র কার? ব্যস, The battle is won. বাচ্চাটার খেলনা নিয়ে তার সঙ্গে খেলবি। তাকে কাতুকুতু দিয়ে হাসবি। দেখবি কি অবস্থা হয়।

তোর কথাবার্তা আমার ভাল লাগছে না।

আলম হাসতে হাসতে বলল, ভাল না লাগারই কথা। যা বললাম সবই বইয়ের কথা। আমেরিকান এক মহিলা তিন শ পৃষ্ঠার এক বই লিখেছেন–কি করে মেয়েদের ভুলাতে হয়। How to tale the girls, এই বই অমি বাইবেলের মতো গভীর মনযোগের সঙ্গে পড়েছি। মুখস্থ করে ফেলব বলে ভাবছি! এইটা তোরও পড়া দরকার। স্বামী হিসেবে তুই ১০০-এর ভেতর ৩২/৩৩-এর বেশি পাস না বলেই আমার ধারণা। বই পড়লে তোর রেটিং বাড়বে।

 

নায়লা দরজা ধরে দাঁড়িয়েছিল।

সে হালকা রঙের সবুজ শাড়ি পরেছে। এটা তার খুব প্রিয় শাড়ি, কিন্তু এক জায়গায় সামান্য ভেঁড়া আছে। হেঁড়া অংশটি খুব সাবধানে রিপু করা, তারপরেও এই শাড়ি পরলেই মনে হয় রিপু করা অংশটা বুঝি বের হয়ে এল। রান্না-বান্না শেষ করে কিছুক্ষণ আগে গোসল করা হয়েছে বলে তার সারা শরীরে স্নিগ্ধ ভাব। চুল শুকায়নি তাই বাঁধা হয়নি। ভেজা চুল পিঠের উপর ছড়ানো বলে এক ধরনের অস্বস্তিবোধ আছে। নায়লার মন আজ অত্যন্ত প্রফুল্ল। গত মেরিজ এ্যানিভার্সারী উপলক্ষে সে কয়েকটা দামী চিনামাটির প্লেট কিনেছিল। একটা টেবিল ক্লথ এবং কঁচের একটা মোমদানি কিনেছিল। এক বছর পর এই প্রথম ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু মোমদানিটা বোধহয় ব্যবহার করা যাবে না। ইলেকট্রিসিটি গেলে মোমদানি কি করে ব্যবহার করা যাবে? তবুও সে মোম বসিয়ে মোমদানি সাজিয়ে রেখেছে। মোমদানির পাশে একটা নতুন দেয়াশলাই। এই দিকে রাত আটটা থেকে মস্টার মধ্যে একবার না একবার কারেন্ট যাবেই। ভাগ্য ভালো থাকলে আজও হয়ত যাবে। মোমদানিটা ব্যবহার করা যাবে।

আলম নায়লার সামনে দাঁড়িয়ে নায়লাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল, কেমন আছি নায়লা?

নায়লা পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। এ কেমন সম্বােধন? বিদেশে যারা থাকে তারা কি এই ভাবেই বন্ধুপত্নীর সঙ্গে কথা বলে? এখন কি এই মানুষটা হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবে? যদি সত্যি হাত বাড়ায় তাহলে সে কি করবে? হ্যান্ডশেক করবে? নায়লা কাতর চোখে স্বামীর দিকে তাকাল। জামানের মুখে কোন বিব্রত ভাব নেই। তার মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে নায়লার হকচকিয়ে যাওয়াটা উপভোগ করছ।

আলম আগের চেয়েও স্বাভাবিক গলায় বলল, নায়লা, আমি তোমার জন্যে কিছু ফুল নিয়ে এসেছি। ফুলগুলো কি নেবে?

নায়লার অস্বস্তির সীমা রইল না। মানুষটা এভাবে কথা বলছে কেন? জামান হাসিমুখে বলল, নাও, ফুলগুলো নাও। তুমি লজ্জায় মরে যাচ্ছ কেন? এ আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ রকম ভাল ছেলে সচরাচর পাবে না।

আলম বলল, নায়লা, তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। যদি দরজা থেকে সরে দাঁড়াও তাহলেই ভেতরে ঢুকতে পারি। আর আমি যে অতি ভাল ছেলে এই সার্টিফিকেট তো জামান দিলই।

নায়লা লজ্জা পেয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। আলম ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ভাবী, আপনি নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে খুব বিরক্ত হচ্ছেন। চিনে না শুনে না একজন মানুষ নাম ধরে ডাকছে, তুমি করে বলছে, Unacceptable. তবে ভাবী, আপনাকে না চিনলেও আপনার কর্তীকে হাড়ে-গোশতে চিনি। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমরা দুজন একসঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলাম। সেই ইতিহাস কি সে আপনাকে বলেছে?

জি-না।

খুবই মজার ইতিহাস। আমি বলব। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় ও যে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল। মাথা খারাপের মত অবস্থা। পীর-ফকির ধরাধরি। শেষটায় বিষ খাওয়ার জন্যে বিষ কিনে আনা। এই ঘটনা জানেন?

নায়লা বিস্মিত হয়ে বলল, না।

এই ঘটনাও আপনাকে বলব। এখন কথা হচ্ছে, আমি জামানকে ডাকি তুই করে। আর আপনাকে ডাকব আপনি করে। সেটা কি শোভন হবে? গুরুচণ্ডালী হয়ে যাচ্ছে না? আপনাকেও তুই করে বলা উচিত। সেটা সম্ভব না বলে আমি এখন থেকে তুমি করে বলব। আপনি রাগ করুন আর না করুন, কিছু যায় আসে না।

নায়লা বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, আপনি তুমি করেই বলবেন।

আমি ভাবীও বলতে পারব না। ভাবী বললেই মনে হয় বয়স্ক একজন পান-খাওয়া মহিলা। পরনে গরদের লালপাড় শাড়ি। এরকম বাচ্চা একতা মেয়েকে আমি ভাবী বলতে পারব না। নাম ধরে ডাকব।

নায়লা কিছু বলল না। জামান বলল, এত কথার দরকার কি? তুই নাম ধরে ডাকবি।

না, নাম ধরে ডাকব না। নায়লা ভাবী এখনো মুখ শক্ত করে রেখেছে। বাঙালী মেয়েদের বিয়ের পর নাম ধরে ধরে ডাকলে এরা খুব রাগ করে। আমি ভাবীই বলব, তবে তুমি করে বলবো। নায়লা ভাবী, ঠিক আছে?

হ্যাঁ, ঠিক আছে।

আরেকটা ব্যাপারে তোমার মনটা কালো হয়ে আছে, বুঝতে পারছি। স্বামীর প্রেম কাহিনী শুনলে মন কালো হয়েই। ভাবী শোন, জামান হচ্ছে এমন এক ছেলে যে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে মুখ তুলে তাকায়নি। তার কোন মেয়ের প্রেমে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। প্রেমে পড়েছিলাম আমি। হায় রে, কি প্রেম! মজনুর প্রেম এর কাছে কিছু না। ঐ মেয়ে রিকশা করে আসতো, আমার মনে হতো–রিকশাওয়ালাটার কি সৌভাগ্য! এক একবার ইচ্ছা করলে, রিকশাওয়ালাকেই কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করি।

নায়লা অনেক চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারল না। খিলখিল করে হেসে ফেলল। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, আপনাদের বিয়ে হয়নি কেন?

বিয়ে হবে কি ভাবে? ইন্টারমিডিয়েট ফেল ছেলের কাছে কোন মধ্যবিত্ত বাবা মেয়ে বিয়ে দেয়? তাও যদি মেয়েটার প্রেম থাকতো তাহলে একটা কথা হতো। পালিয়ে-টালিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যেত। ঐ মেয়ে আমাকে দুই চক্ষে দেখতে পারত না।

কেন?

কেন সেটা ঐ মেয়েই জানে। যাই হোক ভাবী, তোমার পুত্র কোথায়?

কাজের মেয়েটা নিচে হাঁটতে নিয়ে গেছে। কাঁদছিল।

ওর নাম যেন কি?

বাবু।

ওকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করা যায়? তোমার সামনে বাবুকে সিরিয়াস ধরনের আদর করতে হবে। বুঝলে নায়লা ভাবী, একটা বইতে পড়েছি–মাদের মন জয় করার একমাত্র উপায় হল–মার আদরের পুত্র-কন্যাদের আদর দেখানো। বাচ্চার নাক দিয়ে হয়তো সিকনি পড়ছে, তাকে টান দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে নাক মুছে তৎক্ষণাৎ সেই নাকে চুমু খেতে হবে। তাহলেই কর্ম কাভার। বাচ্চার হৃদয় অবশ্যি জয় করা যাবে না। বাচ্চারা এত সহজে ভুলে না তবে মার হৃদয় জয় করা যাবে। মা কেনা হয়ে যাবেন ফর গুড।

আপনি কি আমাকে কিনে ফেলতে চান?

না, তা চাই না। তবে আমি তোমার ফেভার চাই। তোমার ভোর ছাড়া আমার গতি নেই। তুমি আমাকে বিয়ে করার জন্যে একটা মেয়ে জোগাড় করে দেবে। এই পবিত্র কাজটি যে আর কেউ করে দেবে সেই উপায় নেই, কারণ–আমার আর কেউ নেই।

আচ্ছা সে ব্যবস্থা হবে। আলম ভাই, ভাত কি এখনই দেব না আরো পরে?

খাবার এখন দিলে তো খেয়েই চলে যেতে হবে। পরে খাওয়াই ভাল। তবে এই ফাঁকে কফি খেতে পারি।

কফি নেই।

আমি নিয়ে এসেছি। ইনসটেন্ট কফি। এই প্যাকেটে কফি আছে। আর এই প্যাকেটে একটা শাড়ি আছে। তোমার জনে সামান্য উপহার। আমাকে যদি তোমার পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে দয়া করে নতুন শাড়িটা পর। তোমার যে শাড়িটা পরে আছে সেটা খুবই সুন্দর। তবে শাড়ির ভেঁড়া অংশটা ঢেকে রাখার জন্যে যে পরিশ্রম করছ সেটা চোখে লাগছে।

নায়লা অস্বস্তি নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে গেল। কি অদ্ভুত মানুষ! ছেঁড়া শাড়ির কথা এই ভাবে কেউ বলে? না বলা উচিত? সব কিছুরই শোভন-অশোভন বলে একটা সীমা আছে। চট করে এই সীমা অতিক্রম করা কি উচিত? নায়লার খুব জ্জাও লাগছে। ভদ্রলোক দামী একটা শাড়ি উপহার নিয়ে এসেছেন ভাল কথা–তাই বলে তাঁর এমন কোন অধিকার জম্মেনি যে তিনি বিপু করা শাড়ির প্রসঙ্গ তুলেন। নতুন শাড়ি এখন পরতে ইচ্ছা করছে না। না পরলেও ভাল দেখায় না। কফি বানাতে হবে। কফি কি করে বানায় সে জানে না। তাদের বাড়িতে কফির চল ছিল না। কৌটার গায়ে কি লেখা আছে? এক কাপে কতটা করে দিতে হয়? এক চামচ?

আলম জুতা-মোজা খুলে ঘরোয়া হয়ে বসেছে। বসার ঘরে বেতের চেয়ারের সঙ্গে একটা খাট পাতা। আলম বসেছে খাটে। ঠিক বসা নয়। আধশোয়া হয়ে বসা। তার সামনেই জামান বেতের চেয়ারে বসে আছে। জামানের মাথা ধরেছ। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় হঠাৎ মাথাটা ধরে উঠল। ঘরে মাথাধরার কোন ট্যাবলেট খুব সম্ভব নেই। ট্যাবলেটের জন্যে তাকেই নিচে নামতে হবে। এখন আর তা সম্ভব না।

জামান!

হুঁ।

তুই এমন চোখ-মুখ শুকনো করে বসে আছিস কেন? ইজ এনিথিং রং?

না। মাথা ধরেছে।

শোবার ঘরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাক। আমার ক্রমাগত কথা শুনে মাখী ধরেনি তো? আসার পর থেকে আমি তো ক্রমাগতই কথা বলে যাচ্ছি।

জামান ক্লান্ত গলায় বলল, আমার শরীরটা বোধহয় ভাল না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে বুকে হাঁপ ধরে। মাথাধরা তো লেগেই আছে। সামান্য পরিশ্রমেই কাহিল।

তুই কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাক। রাতের পাঁচ ঘণ্টা ঘুমে যত উপকার হয়, অন্য সময়ের দশ মিনিটের বিশ্রামেও সমান উপকার। তুই যা তো।

জামান সত্যি সত্যি উঠে গেল।

নায়লা কফি বানিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে আলম একা একা খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। নায়লা বলল, ও কোথায়?

আলম হাসতে হাসতে বলল, খুব সম্ভবত ঘুমুচ্ছে। আমি ওকে ঘুমুতে পাঠিয়ে দিয়েছি। বলেছে, মাথা ধরেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব টায়ার্ড। আচ্ছা, ওর কি কোন অসুখ-বিসুখ আছে?

কেন বলুন তো?

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখি হা হা করে শ্বাস নিচ্ছে। হার্টের কোন সমস্যা থাকতে পারে বলে আমার ধারণা। যদি সমস্যা থাকে তাহলে তো সিঁড়ি ভেঙে এত দূর উঠা ঠিক না। লিফট থাকতে সিড়ি বেয়ে উঠার ব্যাপারটা আমি বুঝিনি।

আপনার না বোঝাই ভাল। নিন, কফি নিন। আমি কফি কখনো বানাইনি। কাজেই ঠিকমত হয়েছে কি না বুঝতে পারছি না। হয়ত তিতা হয়ে গেছে।

কফি তিতা হতে হয়। আমি কফি খাই গন্ধের জন্যে, স্বাদের জন্যে না। ভাবী, তুমি বোস।

নায়লা বসল। সে শাড়ি বদলেছে। নতুনটা পরেছে, কিন্তু তার ধারণা তাকে আগের শাড়িতেই অনেক বেশি সুন্দর লাগছিল।

নায়লা ভাবী!

জি।

তুমি কি রাগ করেছ আমার উপর?

রাগ করার মতো আপনি কি কিছু করেছেন?

হ্যাঁ, করেছি। আমি ছেড়া শাড়ির কথা বলেছি। এটা অভদ্রতা, অন্যায় এবং চূড়ান্ত রকম অশোভন একটা কাজ।

অশোভন যদি জানেন তাহলে কেন করলেন?

জানি না কেন করেছি। আর কোনদিন করব না। শেনি নায়লা ভাবী, এই শাড়িটায় তোমাকে মোটেই মানাচ্ছে না।

আমি জানি। বদলে কি ভেঁড়াটা পরে আসব?

প্লীজ।

নায়লা উঠে চলে গেল। আলম লক্ষ্য করলো–নায়লা বের হল অতিরিক্ত ব্যস্ততার সঙ্গে। যেন কোন রকমে পালিয়ে যেতে পারলে সে বাঁচে।

শোবার ঘরে কুণ্ডলী পাকিয়ে জামান ঘুমুচ্ছে। জ্বর আসছে না-কি? নায়লা খুব সাবধানে কপালে হাত ছুঁয়াল। না, জ্বর নেই, তবে গা একটু বোধহয় গরম। নায়লা স্বামীর পাশে খানিকক্ষণ বসল। ওকে একজন ডাক্তার দেখাতে হবে। বেচারা সিঁড়ি দিয়ে একেবারেই ওঠানামা করতে পারে না। বড় কোন অসুখ বাধায়নি তো। সংসারের যে হাল–বড় কোন অসুখ হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

ফিরুর মা বাবুকে কোলে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকল। বাবু ঘুমুচ্ছে। নায়লা সাবধানে ছেলেকে বাবার পাশে শুইয়ে দিলো। দুজনই আরাম করে ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে এই দুজকে! এই দৃশ্য বোধহয় অনন্তকাল ধরে দেখা যায়।

ফিরুর মা।

জি।

খাবার-দাবারগুলি সব গরম করতে থাকো।

চইদ্দবার তরকারি গরম করলে তরকারির স্বাদ নষ্ট হয়গো আম্মা।

তোমাকে যা করতে বলছি, কর। মুখে মুখে তর্ক করবে না।

পরনের শাড়িটা কি নয়া আম্মা?

হুঁ।

ব্যাটাটা যে বইয়া আছে হে আনছে?

এত কথা কেন বলছ?

ভাব-ভালবাসার দুই-একটা কথা হুনলেই ওমন গোসা হন ক্যান?

গোসা হই না। তুমি যাও।

 

খাবারের আয়োজন বেশ ভাল। চিকন চালের ভাত, মাছের ভর্তা, কুমড়ো ফুলের বড়া, ছোট মাছের চচ্চড়ি, কইমাছ ভাজা, একটা শুটকির আইটেম, দু পদের ডাল।

আলম বললো, এত ভাল খাবার আমি সারাজীবনেও খাইনি। যত দিন আমি বেঁচে থাকবে ততদিন এর কথা মনে থাকবে। এরকম ভালো খাবার কি প্রায়ই হয়?

জামান বলল, ভাল খাবারের কি দেখলি? সামান্য ভাজা-ভুজি। অবশ্য ভালো খাবারের সামর্থও নেই।

এটা যদি ভাল খাবার না হয় তাহলে ভাল খাবার কোনটা? রোস্ট, পোলাও, মুরগি–মোসাল্লাম? মোঘলরা আমাদের রুচি নষ্ট করে দিয়েছে। এখন ভাল খাবার মানেই রোস্ট পোলাও! নায়লা ভাবী।

জি।

পরের বার তুমি আমার জন্যে লাউ শাকের একটা তরকারি করবে। আমার মা করতেন। পাতাগুলি আস্ত আস্ত থাকতো। সরুয়াটা হত খুব পাতলা। প্রায় পানি পানি। আস্ত কাঁচামরিচ থাকতো এক গাদা। ঝালের চোটে মুখে দেয়া যেতো না কিন্তু অসাধারণ …

জি আচ্ছা, পরের বার লাউ পাতার তরকারি করব।

নায়লা! ভাবী, বল তো স্বর্গের অমৃতের স্বাদ কি? টক না মিষ্টি, না নোনতা?

জানি না তো। স্বর্গের অমৃত তো কখনো খেয়ে দেখিনি …

আমি না খেয়েই বলতে পারছি–স্বর্গের অমৃতের স্বাদ টকও না, মিষ্টিও না, ঝাল-ঝাল।

মানুষটা এত আগ্রহ করে খাচ্ছে যে দেপ্ততে ভাল লাগছে। কুমড়ো ফুলের বড়া সব কষ্টা শেষ করার পর বলেছে, ভাবী, আর কি আছে?

জ্বি না। আর নেই।

নায়লার খুব লজ্জা লাগল। পরের বার এই রান্নাটাও রাঁধতে হবে।

নায়লা ভাবী, তুমি কি পাতুরী রাঁধতে পার? মশলা দিয়ে মাখিয়ে, কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে মাছটাকে পুড়ানো হয় …

পারি।

ওটাও খেতে ইচ্ছা করে। বুঝলে নায়লা ভাবী, তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আমি ঢাকায় অপ্রচলিত খাবারের একটা দোকান দেব। দেশে যেখানে যত অপ্রচলিত রান্না আছে জোগাড় করা হবে। ভাল বাবুর্চি দিয়ে যত্ন করে রান্না করানো হবে। মনে কর, কেউ খেতে গেলো কুমরো ফুলের বড়া, তার পছন্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে কুমড়ো ফুলের বড়ার রেসিপি তাকে দিয়ে দেয়া হবে। আইডিয়া তোমার কাছে কেমন লাগছে?

বুঝতে পারছি না।

আলম জামানের দিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে বলল, বুঝেছিস জামান, ঢাকায় পথে পথে ঘুরি আর নানান ধরনের আইডিয়া মাথায় ঘোরে। আমেরিকা ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না। মনে হয়, আমার তো যথেষ্ট টাকাপয়সাই আছে, এ দিয়ে দেশেই একটা কিছু শুরু করি না কেন?

জামানের মাথাধরা সেরেছে, তবে শরীর এখনো কেমন দুর্বল দুর্বল লাগছে। আলোচনা ভাল লাগছে না। সে হাই তুলতে তুলতে বলল, এই দেশে ভর্তা-ভাজাভুজির দোলন চলবে না।

চলবে না কেন? খাবারের মধ্যে মানুষ বৈচিত্র্য খুঁজে না? সব সময় কি চায়নীজ খেতে হবে?

ভাজা-ভুজির মধ্যে বৈচিত্র্য কিছু নেই। এগুলি অপরিচিত কোন খাবার তো না। সব ঘরেই এসব রান্না হয়।

আলম বললো, নায়লা ভাবী, তোমার কি ধারণা?

আমার ধারণা, চলবে। খুব ভাল চলবে, তবে …

তবে কি?

শায়লা চুপ করে গেল। আলম আগ্রহের সঙ্গে বললো, বল, তুমি কি বলতে চাও। স্পষ্ট করে বল।

ধরুন, আপনি যদি চারতলা একটা বাড়ি নেন, খুব সাজানো, খুব সুন্দর, সামনে বাগান, পানির ফোয়ারা…

তুমি থেমো না,বলে যাও।

সেই চারতলায় এক একতলায় এক এক রকম খাবার। একতলায় দেশীয় খাবার, দোতলায় চাইনীজ, তিন তলায় …

আলম নায়লার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগলো, তিনতলায় ফাস্ট ফুড–বার্গার, পিজা। চারতলায় কন্টিনেন্টাল ফুডস। শুধু চারতলায় হবে না। পাঁচতলা লাগবে। পাঁচতলায় সুন্দর হলঘর, যেটা ভাড়া দেয়া হবে। জন্মদিন, পার্টি এইসব।

আলম চুপ করে গেল। তার কপালের চামড়ায় ভাজ পড়েছে। মনে হচ্ছে, সে গভীর চিন্তায় পড়েছে। আমান বলল, তুই কি সত্যি সত্যি হোটেল দিচ্ছিস না কি?

আলম তার জবাব দিল না। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে বলল–নায়লা ভাবী, বিয়ের কথাটা এখন বলি। তুমি আমাকে একটা মেয়ে জোগাড় করে দাও।

কি রকম মেয়ে?

ভাল একটা মেয়ে। বুদ্ধিমতী। জীবনের বড় অংশ যার সঙ্গে কাটাতে হবে সে বৃদ্ধিমতী না হলে তো মুশকিল। একটা রসিকতা করব–বুঝতে পারবে না, হা করে তাকিয়ে থাকবে, তা হয় না।

মেয়েটাকে নিশ্চয়ই সুন্দর হতে হবে? পুরুষদের প্রথম কথাই সুন্দর মেয়ে।

মেয়েদেরও কিন্তু প্রথম কথাই হচ্ছে সুন্দর পুরুষ। তুমি কি এমন কোন মেয়ে পেয়েছ যে অসুন্দর পুরুষ বিয়ে করতে চায়? চায় না। একটা কথা প্রচলিত আছে–টাকাওয়ালা কুশ্রী পুরুষরা টাকার জোরে সুন্দর সুন্দর মেয়েদের বিয়ে করে। আছে না এমন কথা?

হ্যাঁ, আছে।

নায়লা ভাবী, এই কথাটা কিন্তু আমরা উল্টো করেও বলতে পারি। আমরা বলতে পারি যে, সুন্দর মেয়েরা টাকার লোভে কুশ্রী পুরুষদের হাতে ধরা দেয়। বলতে পারি না?

আলম ভাই, মেয়েদের সেই স্বাধীনতা নেই। সবাই মিলে যা ঠিক করে দেয় তাদের তাই করতে হয়। তবে কিছু মেয়ে হয়ত নিজেই আগ্রহ করে টাকাওয়ালা বর খুঁজে। তাদেরও দোষ নেই। ওরা অভাবে অভাবে বড় হয়। অভাব অসহ্যবোধ হয়। মুক্তি পেতে চায়।

টাকার মধ্যে মুক্তি আছে?

হ্যাঁ, আছে। টাকার মুক্তিই বড় মুক্তি। আনন্দময় মুক্তি।

আলম বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, সেটা আবার কি?

আরেকদিন আপনাকে বুঝিয়ে বলব।

না, আজই বল।

এই যে আপনি আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছেন, কত উপহার কিনে এনেছেন। কিনতে গিয়ে আনন্দ পেয়েছেন, আমরাও উপহারলি পেয়ে আনন্দ পেয়েছি। এই আনন্দ আপনার টাকা আছে বলে আপনি কিনতে পারলেন। আমাদের টাকা নেই। আমরা কোনদিন কিনতে পারব না।

নায়লা ভাবী, তুমি কি প্রচুর টাকা চাও?

কেন চাইব না? চাই।

আলম হাসতে হাসতে বলল–আচ্ছা দেখি এমন কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা যাতে একদিন তোমার প্রচুর টাকা হয়। এখন পান খাওয়াও। পান খেয়ে চলে যাব।

জামান বলল, রাত অনেক হয়েছে। এত রাতে আর যাবি কি? খেকে যা।

নো। থ্যাংক ইউ।

যাবার সময় আলম মানিব্যাগ থেকে দুটা পাঁচ শ টাকার নোট বের করে জামানের দিকে এগিয়ে দিল। জামান বিস্মিত হয়ে বললো, টাকা কিসের?

বাজির টাকা। এক হাজার টাকার একটা বাড়ি ছিল না তোর সঙ্গে? তুই বাজি জিতেছিস।

নায়লা বিশিত হয়ে বললো, কিসের বাজি?

আলম গম্ভীর গলায় বলল, জামানের সঙ্গে বাজি রেখেছিলাম যে তুমি আমাকে বলবে, হোটেলে আপনি কষ্ট করে কেন খাবেন? অল্প কদিন তো আছেন, আমাদের এখানে থাকুন। জামান বলল তুমি কখনো এ জাতীয় কথা বলবে না। এইন ইয়ে এক টাকা বাজি ছিল। তুমি কিছু বললে না। কাজেই জামান বাজি জিল। নে জামান, টাকা রাখ। বাজির টাকা নিতে হয়।

জামান অস্বস্তির সঙ্গে তাকিয়ে আছে।

আলম নোট দুটো টেবিলে নামিয়ে বের হয়ে এল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ