মুখে মেকআপ নিয়ে রেশমা বসে আছে

ন’টা থেকে মুখে মেকআপ নিয়ে রেশমা বসে আছে। ইন্টারকাটে তার একটা ক্লোজআপ যাবে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এক্সট্রাদের ক্লোজআপ কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয না। মূল শটগুলো ঠিকঠাক রাখার জন্যে এক্সট্রাদের দু’একটা ক্লোজআপ মাঝে মাঝে চলে আসে।

চোরাকারবারিদের আস্তানার সেট পড়েছে। নায়ক ফরহাদ চোরকারবারিদের হাতে ধরা পড়েছে। তাকে একটা খাম্বার সঙ্গে বাধা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হবে। এই উপলক্ষে চোরাকারবারিদের মধ্যে আনন্দের বান ডেকে যাচ্ছে। মদ খাওয়া হচ্ছে। ফ্লোরে নাচের ব্যবস্থাও আছে। একদিকে ছবির হিরো আগুনে পুড়বে। অন্যদিকে নাচ চলবে। নায়ক ফরহাদের শট নেয়া হচ্ছে, চোরাকারবারিদের শট নেয়া হচ্ছে।

ফরহাদ সুপারহিট নায়ক। পরপর তিনটা ছবি তার হিট করেছে, বিজ্ঞাপনে তার সম্পর্কে লেখা হয়–গ্যালাক্সি হিট রোমান্টিক হিরো–ফরহাদ খান।

সবার নজর হিরোর দিকে। হিরোর হাত বাঁধা বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর মিজান এখন তাকে সিগারেট খাওয়াচ্ছে। জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরছে এবং ঠোঁট থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। ক্যামেরা রেডি করা আছে। হিরোর সিগারেট খাওয়া শেষ হলেই শট নেয়া হবে। হিরো ‘ডায়ালগ’ বলবে। দীর্ঘ ডায়ালগ–

তোরা আমার শরীরকে ধরেছিস। আমার শরীর বন্দি, কিন্তু আমার মন? আমার মন মুক্ত বিহঙ্গীর মতো স্বাধীন। মনকে বন্দি করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো শক্তির নেই।

হিরো সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলল, ডায়ালগ কড়া, ক্ল্যাপ পড়বে। তবে বিহঙ্গী ফিহজী রিকশাওয়ালারা বুঝবে না–পাখি করতে হবে।

ডাইরেক্টর আজমল তরফদার হাসিমুখে বললেন, অবশ্যই। হারামজাদা স্ক্রিপ্ট রাইটারের মাথার মধ্যে ঘুরে ডিকশেনারি। বিহঙ্গ। বিহঙ্গ আবার কী? মিজান ডায়ালগ ঠিক করে খাতায় লিখে ফেল। ফরহাদ ভাই আপনি রেডি?

হুঁ।

একটা মনিটার দিবেন নাকি?

মনিটার লাগবে না। ডাইরেক্ট টেক।

ওকে লাইটস।

আলো জ্বলল। হিরো বলল, শটটা কী রকম, ক্লোজআপ?

হুঁ।

ক্লোজআপ ভালো হবে না। লং শট থেকে জুম করে ক্লোজে আসুন।

আজমল তরফদার মনে মনে বললেন–হারামজাদা এখন ডাইরেকশনে চলে আসছিস। শটের তুই বুঝস কী?

মনে মনে যা বলা হলো মুখে তা বলা হলো না। মুখে বলা হলো–ঠিক ধরেছেন ফরহাদ ভাই। আপনার শট সেন্স মারাত্মক। লাস্ট ডায়ালগে মুখের উপর জুম করে বিগ ক্লোজআপে চলে যাব–শুধু চোখ। কেমন হবে রে মিজান?

ভালো হবে ওস্তাদ। শটের মতো শট।

জুম লেন্স লাগা। ক্যামেরার পজিশন চেঞ্জ কর।

ক্যামেরার পজিশন চেঞ্জ করে জুম লেন্স লাগাতে সময় লাগল। জুম লেন্স ছিল না। বারি স্টুডিও থেকে ভাড়া করে আনতে হলো। এই ফাঁকে অন্য শট নেয়া যেত। তার জন্যে আবার নতুন করে লাইটিং। সেটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো–গ্যালাক্সি হিরো প্রতিটি শটে নাক গলাবেন। দরকার কী? তার শট না নিয়ে অন্যের শট নিলে তিনি রাগও করতে পারেন। তাঁকে বলা হয়েছে একনাগাড়ে তাঁর কাজ শেষ করে অন্য কাজ ধরা হবে।

গ্যালাক্সি হিরো বললেন, জুম লেন্স আনতে দেরি হবে?

আজমল তরফদার হাই তুলতে তুলতে বললেন, না দেরি হবে না।

এইসব আপনার আগে ব্যবস্থা রাখেন না–শেষ সময়ে দৌড়াদৌড়ি!

অপমানসূচক কথা। তবে গ্যালাক্সি হিরোর এ ধরনের অপমান গায়ে মাখতে নেই। দুধ দেবে গরু, লাথি দেবে, গায়ের উপর পেচ্ছাব করে দেবে। জগতের এই হলো নিয়ম। তবে দিন আসবে–তখন এই হিরোকেই মুখে রং মেখে সারাদিন বসে থাকতে হবে–কখন শটের জন্যে ডাক পড়ে। খুব সহজে সেই ডাক আসবে না।

হাতের বাঁধন খুলে দিন, বিশ্রাম করি।

ডাইরেক্টর সাহেবের ইঙ্গিতে ফ্লোর-ব্যয় হাতের বাঁধন খোলার জন্যে ছুটে গেল। হিরো বিরক্ত মুখে বললেন, কফি দিতে বলেন–নরম্যাল না, এক্সপ্রেসো। ইন্টার্ন প্লাজায় ভালো এক্সপ্রেসো পাওয়া যায়–একজন কাউকে পাঠিয়ে দিন, কাছেই তো।

ফ্লোর-ব্যয় আরেকজন চলে গেল এক্সপ্রেসো কফির সন্ধানে। হিরো চেয়ারে গা এলিয়ে বসতে বসতে বললেন, আজ আমাকে একটু সকাল সকাল ছাড়তে হবে–একটা জন্মদিন আছে, যেতেই হবে। আজমল ভাই, মাইন্ড করবেন না, পরে পুষিয়ে দেব।

আজমল তরফদার মনে মনে কুৎসিত একটা গালি দিলেন। মুখে কিছু বললেন না। তাঁর মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছে। বিকেল চারটা পর্যন্ত শিফট। ব্যাটা এগারটার মধ্যে চলে গেলে কাজ কিছুই হবে না। শিফটের টাকা পুরোটাই যাবে।

আজমল ভাই মুখ বেজার করে বসে আছেন কেন?

না, বেজার হব কেন?

আজ একটু আর্লি যাব ঠিকই কিন্তু পুষিয়ে দেব। দেখবেন টপটপ কাজ নামিয়ে দেব—‘বার্নিং সিন’ কি আজই হবে?

আজমল তরফদার আবার হাই তুললেন। মনে মনে বললেন–ক অক্ষর শূকরমাংস কিন্তু ইংরেজি বুলি বের হচ্ছে—‘বার্নিং সিন’–বার্নিং সিন আমি তোর পাছা দিয়ে…

 

রেশমার সকাল থেকেই মাথাধরা। কাল রাতে ঐ বুড়ো যখন চলে যেতে বলল, তখনই রাগে তার মাথা ধরে গিয়েছিল। সেই মাথা ধরা এখনো যায় নি। যতই সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে। এখন মনে হয় জ্বর আসছে। তার শট হয়ে গেলে সে বাড়ি চলে যেতে পারত। শট হবে না বলে মনে হয়। না হলেও রাত এগারটা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে। গরম এক কাপ চা খেলে মাথাধরাটা কমত। প্রাডাকশনের কাছে চা চাইলে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এক্সট্রাদের ঘনঘন চা দেবার নিয়ম নেই। তবু চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। চায়ের দায়িত্বে যে ফ্লোর-ব্যয় রেশমা তার কাছে গিয়ে মধুর গলায় বলল, সবুর ভাই, চা দেবেন? খুব মাথা ধরেছে।

চা নাই।

চা আছে। না বলছেন কেন? ছবির শুটিং চা ছাড়া চলে?

সবুর বিরক্ত চোখে তাকাল। ফ্লোর-বয়রা সাধারণত মেরুদণ্ড ছাড়াই জন্মগ্রহণ করে। এক্সট্রারা আশপাশে থাকলে মেরুদণ্ড ফিরে পায়। দিন না এক কাপ চা, অসম্ভব মাথা ধরেছে।

ক্যান্টিনে গিয়া চা খাও।

তাহলে ক্যান্টিনে চা খাওয়ার পয়সা দিন।

ওরে বাপরে! ম্যাডামের মতো কথা।

রেশমা ক্যান্টিনে যাওয়াই ঠিক করল। কাউকে বলে যাওয়া উচিত কিনা সে বুঝতে পারছে না। তার শট এখন নেয়া হবে না। এ ব্যাপারে সে এক শ ভাগ নিশ্চিত। তারপরেও প্ৰডাকশনের কারোর যদি চোখে পড়ে সে আশপাশে নেই অমনি মাথায় আগুন ধরে যাবে। প্ৰডাকশন সব সময় রেগে থাকে–রাগ ঝাড়ার মানুষ দরকার। এক্সট্রারা সেই মানুষ। রেশমা চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর মিজানের কাছে গেল। প্ৰায় ফিসফিস করে বলল, আমার শটটা কখন হবে? মিজান ভুরু কুঁচকে তাকাল যেন এমন অসৌজন্যমূলক কথা সে তার জীবনে শোনে নি।

দেরি হবে?

জানি না।

ক্যান্টিন থেকে এক কাপ চা খেয়ে আসি মিজান ভাই? যাব আর আসব।

মিজান জবাব দিল না। সে মুখ ভর্তি করে পান খাচ্ছিল। ফ্লোরের ভেতরই পানের পিক ফেলল। এত কথা বলার তার সময় নেই।

যাব মিজান ভাই?

মিজান খেঁকিয়ে উঠল—সব সময় বিরক্ত করিস ক্যান? কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান না করলে ভালো লাগে না? কাজের সময় যন্ত্রণা!

রেশমা সরে এল। জুম লেন্স চলে এসেছে। ক্যামেরায় মাউন্ট করানো হচ্ছে। হিরোর হাত খাম্বার সঙ্গে বাধা হচ্ছে। মেকআপম্যান চুল ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। চোরাকারবারিদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর ধরনের ধস্তাধস্তির পর সে ধরা পড়েছে। তাতে তার চুলের ভাঁজের কোনো ক্ষতি হয় নি। হিরোর শটে অনেক সময় লাগবে। এই ফাঁকে নিশ্চিন্ত মনে ক্যান্টিনে চা খেতে যাওয়া যায়।

 

ক্যান্টিনে গাদাগাদি ভিড়। কলিজির গরম সিঙ্গাড়া ভাজা হচ্ছে। দু’জন বয় সিঙ্গাড়া দিয়ে কুল পাচ্ছে না। রেশমা বসার জন্যে খালি চেয়ার খুঁজছে। দি রোজ মুভিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রডাকশন ম্যানেজার দিলদার খাঁ হাত উঁচু করে আগ্রহের সঙ্গে ডাকল, এই যে ম্যাডাম, এদিকে আসেন।

দিলদার খাঁ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রডাকশান ম্যানেজার হলেও তার মূল কাজ মেয়ে মানুষের দালালি। ফিল্ম লাইনের মেয়েদের প্রতি বাইরের মানুষের আগ্রহ প্রচুর। ভালো অঙ্কের টাকা খরচেও এদের আপত্তি নেই। যোগাযোগটা সমস্যা। দিলদার খাঁ এই সমস্যার সমাধান করে। ভালোমতোই করে। দু’পক্ষ থেকেই তার কমিশনের ব্যবস্থা আছে।

দিলদার বলল, ম্যাডাম, কী খাবেন বলেন?

কিছু না–চা।

শুধু চা খাবেন কেন ম্যাডাম? আমার উপর রাগ করেছেন?

ম্যাডাম ম্যাডাম বলবেন না তো দিলদার ভাই।

মেয়েছেলে মাত্রই আমার কাছে ম্যাডাম। তা সে চাকরানিই হোক কিংবা নায়িকাই হোক। ঐ দেখি ম্যাডামকে দু’টা সিঙ্গাড়া দে।

রেশমা সিঙ্গাড়া খাচ্ছে। খুব সাবধানে খেতে হচ্ছে যাতে ঠোঁটের লিপস্টিক উঠে না যায়। সিঙ্গাড়া খেতে গিয়ে সে টের পাচ্ছে তার খুব খিদে লেগেছে। প্ৰডাকশান থেকে সকালে ভালো নাশতা দেয়া হয়েছিল–কেক, চানাচুর, কলা, একটা মিষ্টি। তারপরেও এতটা খিদে থাকার কথা না।

দিলদার খ্যা রেশমার কাছে ঝুঁকে এসে বলল, ‘প্রেম দেওয়ানা’র শুটিং হচ্ছে?

হুঁ।

রোল কী?

রোল কিছু না।

কোনো ডায়ালগ আছে?

দু’টা ডায়ালগ আছে।

ফিল্ম লাইনে কতদিন হলো?

দু’বছর।

তাহলে তো চিন্তার কথা।

চিন্তার কথা কেন?

দিলদার খাঁ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তোমার চেহারা সুন্দর, বয়স সুন্দর, কথাবার্তা সুন্দর, তিন সুন্দর নিয়েও দু’বছরে যদি কিছু না হয় তাহলে আর হবে না। এক্সট্রা থেকে নায়িকার ছোটবোন, নায়িকার ছোটবোন থেকে নায়িকা। হয় না যে তা নয়, হয়। তবে দু’বছরের মধ্যে হয়। দু’বছরে না হলে–নো হোপ। দু’বছর পার করে দেবার পর ধরে নিতে হবে–এক্সট্রা হিসেবে রাইট ইন, এক্সট্রা হিসেবে লেফট আউট। হা-হা-হা!

হাসছেন কেন? এটা তো হাসির কোনো কথা না।

অবশ্যই হাসির কথা, শ্ৰীদেবীর মতো তোমার চেহারা। এই চেহারায় লাভ কী হলো? এক্সট্রার পার্ট আর মাঝেমধ্যে ক্ষেপ মারা।

আস্তে কথা বলেন দিলদার ভাই।

আস্তেই তো বলছি। শোন ম্যাডাম–বাইরের ক্ষেপ কমায়ে দাও, শরীরের সর্বনাশ হয়ে যায়। ফিল্ম লাইনে শরীরই আসল। মনে ভেঙে গেলে কোনো ক্ষতি নাই, শরীর ভাঙলে সর্বনাশ।

উঠি দিলদার ভাই।

উঠবে কী বস না, চা খাও আরেক কাপ।

না, কাজ আছে।

খাও খাও, আরেক কাপ চা খাও। ঐ ম্যাডামকে আরেক কাপ গরম চা।

সে দ্বিতীয় কাপ চা নিল। দিলদার খাঁ আরো খানিকটা ঝুকে এল। রেশমা অস্বস্তি বোধ করছে। দিলদার খাঁর মূল কাজ যে দালালি এটা কারো অজানা নয়। তার কোনো মেয়ের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলার একটাই অর্থ।

দিলদার খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, আমার বাসার ঠিকানা জান না?

রেশমা ঠিকানা জানে না, তবু বলল জানে।

টেলিফোন নিয়েছি। টেলিফোন নাম্বারটা লিখে রাখো। ইমার্জেন্সি টাকা-পয়সার দরকার হলে টেলিফোন করে দিও। আমার কাছে ভালো ভালো পার্টি আছে। সব ভদ্রলোক। একটাও দু’নম্বরী ভদ্রলোক না—আসল ভদ্রলোক। হাংকি পাংকি নাই।

এইসব কাজ এখন আমি করি না দিলদার ভাই।

দিলদার হাসল। পরক্ষণেই হাসি বন্ধ করে বলল, না করাটা তো ভালো। তারপরেও ধর হঠাৎ টাকা-পয়সার দরকার হয়ে গেল। টাকা তো আসমান থেকে পড়ে না। ব্যবস্থা করা লাগে। বর্তমানের ব্যবস্থা ছাড়াও ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে রাখতে হয়। আজ তোমার চেহারা আছে, স্বাস্থ্য আছে—দুদিন পরে কি থাকবে? থাকবে না। হঠাৎ একটা বড় অসুখ হয়ে গেল। তখন? পানি পড়া মাগনা পাওয়া যায়, ওষুধ মাগনা পাওয়া যায় না। খরিদ করা লাগে। কাগজ-কলম তোমার কাছে আছে?

না।

কাগজ-কলম আমার কাছেই আছে। টেলিফোন নাম্বার লিখে দিচ্ছি। যত্ন করে রেখে দিও। কখন দরকার হয়–কিছুই বলা যায় না।

উঠি দিলদার ভাই?

আচ্ছা। আমাদের প্রডাকশানের কাজ শুরু হচ্ছে। দেখি সেখানে তোমার জন্যে ভালো কোনো সাইড রোল পাওয়া যায়। কিনা।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ