মিরপুর দুনম্বরের চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ির ডানদিকের ফ্ল্যাটটায় (D4, দরজার পাশে টবে কামিনী ফুলের বড় একটা গাছ।) সফিক গত এক সপ্তাহ ধরে বাস করছে। ফ্ল্যাটের মালিক সফিকের মেজো মামা আব্দুল গফুর। তিনি স্বপরিবারে আজমীর শরিফে গিয়েছেন খাজা বাবার দোয়া নিতে। বিয়ের পনেরো বছর পরেও ছেলেমেয়ে হচ্ছে না। খাজা বাবার দরবার শরিফ থেকে স্বামী-স্ত্রী হাতে সুতা বেঁধে আসবেন। সুতা বাঁধার পর ইন্ডিয়াতে ঘুরবেন। তাজমহল-টাজমহল দেখবেন। তাদের এক মাসের পরিকল্পনা। সফিকের দায়িত্ব হলো, সে এক মাস বাড়ির দেখাশোনা করবে। কামিনী ফুলের গাছে পানি দেবে। ভেতরের বারান্দায় টবে পাঁচটা গোলাপ গাছ লাগানো হয়েছে। গোলাপ গাছে কলি দেখা দিলেই কাঁচি দিয়ে কলি কেটে ফেলবে। এতে নাকি পরবর্তীতে ফুল অনেক বড় হবে। আব্দুল গফুর সাহেব সফিকের হাতে বসার ঘর এবং রান্নাঘরের চাবি দিয়ে গেছেন। বাকি ঘরগুলি তালাবন্ধ করে গেছেন। সফিককে তিনি হাতখরচ হিসেবে এক হাজার টাকাও দিয়ে গেছেন। সফিক খুবই ব্ৰিত গলায় বলেছে— ছিঃ ছিঃ মামা, টাকা দিতে হবে কেন? অসম্ভব, টাকা তুমি রাখো তো।

সফিকের মামা বলেছেন, বেকার মানুষ, তোর টাকা লাগবে না? পকেটখরচ হিসেবে রেখে দে। আর শোন, চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতে থাকতে হবে তা-না। রাতে গিয়ে শুধু ঘুমালেই হবে। সোফাতে শুয়ে থাকবি। ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলে মশা ধরবে না। মশার কয়েল জ্বালাবি না। নতুন কার্পেট কিনেছি। কার্পেট পুড়ে-টুরে যেতে পারে।

মশা কামড়ে খেয়ে ফেললেও আমি মশার কয়েল ধরাব না। কয়েলের গন্ধে আমার মাথা ধরে যায়।

রান্নাঘরে ঢুকে রান্নাবান্নার চেষ্টা যেন আবার করিস না। বেসিন নোংরা করে রাখবি, তোর মামি রাগ করবে।

আমি খাওয়া-দাওয়া করেই বাড়িতে ঢুকব। তুমি মোটেই চিন্তা করবে না।

বন্ধু-বান্ধব জমিয়ে আড্ডা দিস না যেন।

আরে না। রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে টুক করে বাড়িতে ঢুকব। ভোরবেলা বের হয়ে আসব। বন্ধু-বান্ধবকে এই বাসার খবরই দেব না। সিগারেট খেয়ে তারা যেখানে-সেখানে ছাই ফেলবে। দরকার কী!

বের হয়ে আসার সময় ভালোমতো তালা দিবি। তালা লাগাবার পর ভালোমতো টেনে টেনে দেখবি ঠিকমতো লাগল কি-না।

অবশ্যই।

ফুলগাছে পানি ঠিকমতো দিবি। গোলাপ গাছগুলিতে একদিন পর পর। কামিনী গাছে রোজ দিতে হবে। আজমীরে যাচ্ছি, তোর জন্যেও দোয়া করব। খাজাবাবার কাছ থেকে খালি হাতে কেউ ফিরে না। দেখবি বছর না ঘুরতেই চাকরি হবে ইনশাল্লাহ।

দুই-তিন গজ সুতা নিয়ে এসো। নিজে পরব, বন্ধু-বান্ধবকে দেব।

 

প্রথম দিনেই সন্ধ্যার পর থেকে সফিকের বন্ধু-বান্ধবরা জড়ো হতে শুরু করল। সফিক মাত্র দুজনকে খবর দিয়েছিল। সেই দুজন বাকিদের খবর দিয়েছে। রাত নটার মধ্যে সফিকের আট বন্ধু এসে উপস্থিত হয়ে গেল।

বসার ঘর ছোট। আটজনের আরাম করে বসা সম্ভব না। সোফা বের করে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হলো। এখন কার্পেটের উপর আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে আড্ডা দেয়া যায়। সফিক বলল, রাত এগারোটার মধ্যে আড্ডা শেষ। এগারোটা বাজার এক মিনিট পরে যেন আমি কাউকে দেখতে না পাই। এটা কোনো অনুরোধ না। আদেশ। আরেকটা কথা এখানে যতক্ষণ থাকবি ফিসফিস করে কথা বলবি। কথার শব্দ যেন এক দেড় ফুটের বাইরে না যায়।

সফিকের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইয়াকুব বলল, ফিসফিস করে কথা বলতে হবে কেন?

এটা ফ্ল্যাটবাড়ি, এখানে হৈচৈ করা যাবে না। ঘটনা ঘটানো যাবে না।

ইয়াকুব অবাক হয়ে বলল, এখনো তো কোনো ঘটনাই ঘটে নি। তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?

সফিক বলল, ঘটনা ঘটে নি কিন্তু তোরা ঘটনা ঘটাবি— এই জন্যে এডভান্স রেগে যাচ্ছি।

ইয়াকুব বলল, জগতের নিয়ম হলো প্রথমে Cause তারপর Effect. তোর তো দেখি উল্টা, প্রথমে Effect তারপর Cause। ঠিক আছে, এত চেচেতির দরকার নাই। আমরা চলে যাই।

চলে যা, কাউকে আমি পায়ে ধরে সেধে আনি নি।

ইয়াকুব বলল, তুই বরং এক কাজ কর, তিনটা সিডাকসিন ট্যাবলেট খেয়ে ঝিম ধরে সোফায় শুয়ে থাক। আমরা আড্ডা দেই। মামা হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াচ্ছে। তার ভয়ে তুই কেঁচোরও অধম হয়ে গেলি। তোর সামনে এখন কেঁচোও আলেকজান্ডার দি গ্রেট।

বক্তৃতা দিবি না।

আমরা থাকব, না চলে যাব— স্ট্রেইট বল। হাংকি পাংকি না।

চলে যেতে বলেছি?

ভাব বাচ্যে কথা বলবি না। হয় ইয়েস কিংবা নো।

তোদের থাকতে ইচ্ছা হলে থাকবি। চলে যেতে চাইলে চলে যাবি।

এত কথার দরকার নাই–চলে যাচ্ছি।

ঠিক আছে, যা চলে যা।

রাত এগারোটার সময় দেখা গেল কেউই যায় নি। বরং আরো দুজন এসে যুক্ত হয়েছে। সফিককে সবচে আনন্দিত মনে হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে তার অতি প্রিয় সঙ্গীত গাইছে–আমরা পুতুলওয়ালা, পুতুল বেচে যাই…। সফিকের গানের গলা নেই। কেউ গান গাইলে সে বিরক্ত হয়। কিন্তু নিজে গভীর আবেগে ভুল তালে ভুল সুরে পুতুলওয়ালা গান গায়। তখন কেউ যদি কোরাসে অংশ নেয় সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। তাকে আনন্দ দেয়ার জন্যে অনেকেই তার সঙ্গে গলা মেলায়।

বড় একটা কাচের গ্লাসে বিশেষ এক ধরনের শরবত বানানো হয়েছে। তার রঙ ঘন কালো। বিশেষ ধরনের শরবত প্রস্তুতের কাজটা সবসময় করে মহসিন। জিনিসটা বানানো হয় গোপনে। তাতে কী কী মিশানো হয় তাও গোপন। অতি সামান্য জিনিস দিয়েও মহসিন অসামান্য জিনিস বানিয়ে ফেলতে পারে। খেতে স্বাদু হয়। তারচে বড় কথা অতি অল্পতেই নেশা হয়ে যায়। শরবতের দিকে তাকিয়ে ইয়াকুব বলল, রঙ দেখে মনে হচ্ছে মারাত্মক হয়েছে। এই ড্রিংকের নাম দিলাম— শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ শরবত। মহসিন বলল, ঠাণ্ডা না হলে খেয়ে মজা পাওয়া যাবে না।

ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, কারণ সফিকের মামা ফ্রিজ তালাবন্ধ করে গেছেন।

সফিকের নির্দেশে তার দিয়ে খুঁচিয়ে অতি দ্রুতই ফ্রিজ খুলে ফেলা গেল। জিনিস ডিপ ফ্রিজে ঠাণ্ডা করতে দেয়া হলো। ইয়াকুব বলল, সফিক, তোর মামার এই বাড়িতে এসি আছে?

সফিক শঙ্কিত গলায় বলল, মামির শোবার ঘরে আছে। কেন?

এসি ছেড়ে দিয়ে ঐ ঘরে সবাই আড্ডা দিতাম। এসি ঘরের সুবিধা হলো হৈচৈ হলেও দরজা-জানালা টাইট করে বন্ধ থাকে, শব্দ বাইরে যায় না।

সফিক বলল, অসম্ভব! মামা-মামির শোবার ঘর খোলাই যাবে না। মামা যদি টের পায় আমাকে খুন করে ফেলবে।

হারুন বলল, নিজের মায়ের আপন ভাই তোকে খুন করে ফেলবে, কারণ তুই তার শোবার ঘরে কিছুক্ষণ বসে ছিলি?

কিছুক্ষণ তো তোরা বসবি না— একবার ঢুকলে ঐখানেই থাকবি।

হারুন বলল, খুব ভালোমতো চিন্তা করে দেখ, মহসিন যে শরবত বানিয়েছে ঐ শরবত খাবার পর অবশ্যই কিছু হৈচৈ হবে। আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোক জানবে। তোর মামার কাছে খবর পৌঁছে যাবে। তারচে কি এসি ঘরে বসা ভালো না?

ঐ ঘর তালাবন্ধ। আমার কাছে চাবি নেই।

চাবি নেই, চাবির ব্যবস্থা হবে। ফ্রিজ যেভাবে খুলেছে ঐ ঘরের দরজাও সেইভাবে খুলে যাবে। চিচিং ফাঁক।

সফিক হতাশ গলায় বলল, যা ইচ্ছা কর। আসলে তোদের খবর দেয়াই ভুল হয়েছে। মিসটেক অব দা সেঞ্চুরি।

হারুন বলল, ভুল করবার জন্যেই তো মানুষ হিসেবে আমাদের জন্ম হয়েছে। আল্লাপাক চাচ্ছেন আমরা ভুল করি। এই জন্যেই আমাদের মানুষ বানিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি যদি চাইতেন আমার শুধু শুদ্ধ করি তাহলে আমাদের ফেরেশতা বানিয়ে পাঠাতেন। আমাদের ভুল করার কোনো উপায় থাকত না।

মহসিন বলল, ফেরেশতাও তো ভুল করে। শয়তান ফেরেশতা ছিল, সে ভুল করেছে। ভুলিয়ে ভালিয়ে গন্ধম খাইয়েছে। যার ফলে স্বর্গ থেকে পতন। এখন আমরা হা চাকরি হা চাকরি করছি।

হারুন বলল, শয়তান ফেরেশতা ছিল তোকে কে বলেছে? শয়তান ছিল জ্বিন।

মহসিন বলল, শয়তান জ্বিন ছিল এই খবর তোকে কে দিয়েছে? শয়তান এসে তোকে দিয়ে গিয়েছে? সারা জীবন শুনে এসেছি শয়তান ছিল ফেরেশতা। আদমকে সেজদা না করায় সে অভিশপ্ত। আর আজ তুই জ্বিনের থিওরি নিয়ে এসেছিস। একশ টাকা বাজি শয়তান ফেরেশতা।

হাজার টাকা বাজি শয়তান ফেরেশতা।

হাজার টাকা তোর কাছে আছে? তুই হাজারপতি কবে থেকে?

হাজার টাকা সঙ্গে নাই, তাই বলে এক হাজার টাকা জোগাড় করতে পারব না? আমি পথের ফকির?

জোগাড় করতে পারলে তো ভালোই আয় হাজার টাকা বাজি।

অবশ্যই।

মহসিন গম্ভীর গলায় বলল, আজ রাতের মধ্যেই ফয়সালা হবে। তুই যদি হাজার টাকা দিতে না পারিস তাহলে তুই নেংটো হয়ে চারতলা থেকে সিড়ি বেয়ে একতলায় দারোয়ানের ঘর পর্যন্ত যাবি। দারোয়ানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলবি, হ্যালো মিস্টার! তারপর আবার ফিরে আসবি।

মহসিনের হাত কাঁপছে। রেগে গেলে তার হাত কাঁপে।

হারুন শান্ত গলায় বলল, ওকে। তুই হারলে তোকেও এই কাজ করতে হবে। তোকেও গিয়ে দারোয়ানকে হ্যালো মিস্টার বলতে হবে।

বলব। আমার কোনো সমস্যা নেই। নো প্রবলেম। আমি রাজি।

আন্ডারওয়ার পরে দৌড় দিলে হবে না। নেংটা মানে নেংটা। পুরো নেংটা বাবা ভোম ভোম। নেংটা কুমার।

ওকে। নেংটা কুমার।

 

এসি ঘর খোলা হয়েছে। হাই কুলে দিয়ে ঘর ঠাণ্ডা করে ফেলা হয়েছে। মহসিনের বিশেষ শরবত সবাই দুকাপ করে খেয়েছে। জিনিসটার স্বাদ টকমিষ্টি। সফিক বলল, টেস্ট তো মারাত্মক হয়েছে। এর মধ্যে আছে কী?

মহসিন বলল, আছে কী তা দিয়ে দরকার কী? একশান হচ্ছে কি-না বল।

সফিক বলল, একশান হচ্ছে না। খেতে মজা লাগছে, কিন্তু নো একশান। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো একশান হবে না। সময় লাগবে।

হারুন খাটে উঠে বসেছে। তার কোলে টেলিফোন। শয়তান ফেরেশতা নাকি জ্বিন–এই সমস্যা সমাধানের জন্যে সে নানান জায়গায় চেষ্টা চালাচ্ছে। সে এতই ব্যস্ত যে মহসিনের শরবত খাবার প্রতিও তার আগ্রহ নেই। হারুন বলল, রাতে ডিনারের কোনো ব্যবস্থা আছে?

সফিক বলল, না।

হারুন বলল, চান্দা তুলে কাউকে পাঠা, নানরুটি আর শিক কাবাব নিয়ে আসুক। পারহেড একটা শিক আর একটা নান। আমার পকেটে দশ টাকা আছে। আমি দিয়ে দিলাম। এই আমার সম্বল।

মহসিন বলল, দশ টাকা সম্বল আর তুই হাজার টাকার বাজি ধরেছিস?

হারুন বলল, বাজিতে তুই যদি জিতে যাস হয় তোকে হাজার টাকা দেব, আর নয় তো এখান থেকে নেংটো হয়ে বাসায় ফিরব।

রাত একটা দশ। পুরো দল ঝিমুচ্ছে। শিক কাবাব এবং নানরুটি এসেছে, কেউ কিছু মুখে দেয় নি। শুধু হারুন একাই পাঁচটা শিক এবং তিনটা নানরুটি খেয়ে ফেলেছে। সফিকের অবস্থা খুব খারাপ। সে পাঁচ-দশ মিনিট করে ঘুমাচ্ছে, আবার জেগে উঠছে। তার চোখ গাঢ় লাল।

শয়তান ফেরেশতা না জ্বিন— এই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। শয়তান। জ্বিন।

বাজির শর্ত অনুসারে মহসিন নেংটো হয়ে দারোয়ানের কাছে যেতে এবং ফিরে আসতে রাজি হয়েছে। হারুন দয়াপরবশ হয়ে বলেছে— যা মাফ করে দিলাম। নেংটো হওয়ার দরকার নেই। সফিক হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে অবশ্যই দরকার আছে। তার উচিত শিক্ষা হতে হবে। না জেনে তর্ক করে। না জেনে বাজি ধরে।

হারুন বলল, এই কাজটা করলে ফ্ল্যাট বাড়িতে জানাজানি হবে। তোর মামার কানে যাবে। তোরই অসুবিধা।

হোক অসুবিধা। আমি কি মামাকে কেয়ার করি? Who is মামা?

সাবের চাদর গায়ে দিয়ে কোলবালিস বগলে নিয়ে শুয়েছিল। তার চোখ বন্ধ। এই দলে তার নাম নীরব ঘাতক। সে কখনোই কোনো কথা বলে না। হঠাৎ হঠাৎ দুএকটা এমন কথা বলে যে পুরো দলের মুড বদলে যায়। সাবের চোখ না মেলেই বলল, Who is মে মে। মে মে।

বারুদে আগুন পড়ার মতো হলো। সবাই বলা শুরু করল— মে মে। মে মে। তারা কিছুক্ষণ মে মে করে, তারপর হো হো করে হাসে। আবারো মে মে করে আবারো হাসে। রাত দুটার দিকে তাদের হাসি বন্ধ হলো। মহসিনকে পাঠানো হলো বাজির শর্তপূরণের জন্যে। মহসিন নির্বিকার ভঙ্গিতেই কাপড় খুলে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে গেল।

 

রাত আটটা। সফিক বসার ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। আজ সারাটা দিন তার ঘুমে ঘুমে কেটেছে। মাঝে কয়েকবার ঘুম ভেঙেছে, তাও অল্প সময়ের জন্যে। একবার ঘুম ভাঙল সকাল এগারোটার সময়। সে রেস্টুরেন্ট থেকে হাফ প্লেট তেহারি খেয়ে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম ভাঙল বিকাল তিনটায়। রেস্টুরেন্টে গেল। পরোটা আর গোশত খেয়ে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত ঘুমাল। ঘুম ভাঙল টেলিফোনের শব্দে। দিল্লি থেকে সফিকের মামা টেলিফোন। করেছেন। তাঁর গলা থমথম করছে। সফিক মামার থমথমে গলা অগ্রাহ্য করে আনন্দিত স্বরে বলল, কেমন আছ মামা? বেড়ানো কেমন হচ্ছে? তাজমহল দেখেছ?

সফিকের মামা বললেন, বাসায় তুই ছাড়া আর কে কে আছে?

জুতিয়ে তোর আমি পিঠের খাল তুলে ফেলব।

সফিক বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বলল, এইসব তুমি কী বলছ মামা! ঘটনা কী?

চুপ শুয়োর। বদমায়েশের বদমায়েশ।

মামা, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কেউ কি তোমার কাছে কিছু লাগিয়েছে?

শাটআপ হারামি।

কী আশ্চর্য, বলবে তো কী হয়েছে?

আমি খবরাখবর নেয়ার জন্যে আরজু সাহেবের বাসায় টেলিফোন করেছি…

কী বলেছেন আরজু সাহেব… উল্টা পাল্টা কিছু বলেছেন? মাই গড! মানুষকে বিশ্বাস করা মুশকিল। উনার সঙ্গে একবার আমার দেখা হয়েছিল সিঁড়িতে। আমার তো মনে হলো খুবই ভদ্র মানুষ।

তুই অস্বীকার করতে চাস বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমার বাড়িতে মচ্ছব বসাস নি? হৈচৈ-চেঁচামেচি-ড্রাগ খাওয়া খাওয়ি করিস নি? সবাই মিলে নেংটো হয়ে সিড়ি দিয়ে ওঠানামা করিস নি?

সফিক মধুর স্বরে বলল, মামা, তুমি রাগের মাথায় কী বলছ নিজেই বুঝতে পারছ না। তোমার রাগ কমানোর জন্যে স্বীকার করলাম তুমি যা বলছ সবই সত্যি। তারপরেও আমার একটা কথা শুনবে। প্লিজ মামা, প্লিজ।

তোর আর কী কথা থাকতে পারে?

মামা শোন, আমার বন্ধু-বান্ধব সবাই ন্দ্র ঘরের ছেলে। শিক্ষিত ছেলে। এমন একজনও নেই যে এম.এ পাস করে নি। আমাদের সমস্যা একটাই— আমরা কোনো চাকরি পাচ্ছি না। আমরা খুবই মন খারাপ করে থাকি। মাঝে মধ্যে এক সঙ্গে হই, চাকরির কোনো লাইন পাওয়া যায় কিনা— এই নিয়ে আলাপআলোচনা করি। আমাদের বয়েসি যুবকদের সবাই সন্দেহের চোখে দেখে বলেই কয়েকজন একত্র হলেই মনে করে কিছু করছি, ড্রাগ নিচ্ছি বা মদ খাচ্ছি।

চুপ। চুপ। মিথ্যুক কোথাকার।

ঠিক আছে মামা, তর্কের খাতিরে স্বীকার করলাম আমরা খারাপ। খুবই খারাপ। তোমার বাসায় বসে মদ-ফদ খাচ্ছিলাম। এখন তুমি বলো মামা, আমরা যত খারাপই হই আমাদের পক্ষে কি সম্ভব নেংটো হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করা? এটা কি কোনো লজিকে পড়ে?

আরজু সাহেব মিথ্যা কথা বলছেন?

এই কথাটা উনি কেন বলছেন মামা আমি সত্যি জানি না। তবে আমি উনাকে জিজ্ঞেস করব। তুমি টেলিফোন রেখে দিলেই আমি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করব।

তোকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না। তুই এক্ষুণি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যা। এক্ষুণি! এই মুহূর্তে।

এখন চলে যাব?

হ্যাঁ এখন যাবি। আমি টেলিফোন রাখব আর তুই বাসায় তালা লাগিয়ে বের fa

মামা, চাবিটা কি আরজু সাহেবকে দিয়ে যাব?

হ্যাঁ দিয়ে যা। আমি ঢাকায় এসে তোর বদমায়েশি বের করছি।

উল্টোটাও হতে পারে মামা। দেখা যাবে তুমি লজ্জিত হয়ে আমার কাছে গেলে বললে, ভুল হয়েছে কিছু মনে করিস না। রাগের মাথায় তোকে অনেক আজেবাজে গালি দিয়েছি।

শাটআপ। এক্ষুণি যা— আরজু সাহেবকে চাবি দিয়ে আয়।

যাচ্ছি। মামা তুমি ভালো থেকো। মামিকে আমার সালাম দিও। কুতুব মিনার দেখে আসতে ভুল করো না। অনেকেই তাজমহল দেখে চলে আসে, কুতুব মিনার দেখে না।

সফিকের কথা শেষ হবার আগেই তার মামা টেলিফোন রেখে দিলেন। সফিক মুখ ভেঁতা করে বসে রইল। এই মুহূর্তে একটা সিগারেট দরকার। তার সঙ্গে সিগারেট নেই। দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনতে ইচ্ছা হচ্ছে না। বন্ধুবান্ধবদের আসার সময় হয়ে গেছে। যে কেউ একজন এলেই সিগারেটের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। শুধু সাবের এবং মহসিন হলে সমস্যার সমাধান হবে না। এই দুই জন সিগারেট খায় না। মুহিব এলেও হবে না। মুহিব সিগারেট খায় না। মুহিব হাবিজাবি কিছুই খায় না। গল্প-উপন্যাসের ভালো ছেলে। এদের চেহারা হয় রাজপুত্রের মতো। এদের চরিত্রে কোনো ত্রুটি থাকে না। অত্যন্ত রূপবতী মেয়ের সঙ্গে এদের প্রণয় হয়। এরা পরীক্ষায় ফাস্ট-সেকেন্ড হয়। এদের চাকরি পেতেও কোনো সমস্যা হয় না। ফর্মুলাতে মুহিব খুব ভালো মতোই পড়ে, শুধু একটা জায়গায় ফর্মুলা মিলছে না। অনেক ঘোরাঘুরি করেও বেচারা চাকরি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তাকে সোনা-রুপার পানি দিয়ে থোয়াতে হবে। সোনারুপার পানি দিয়ে ধোয়ালে দোষ কাটা যায়।

সাবের, মুহিব, মহসিন— এই তিনজনের যে কেউ এলে তাৎক্ষণিকভাবে সিগারেট পাওয়া যাবে না। সিগারেট কেনার জন্য এদের আবার নিচে পাঠাতে হবে। মাফিজ ল বলছে আজ এরাই প্রথম আসবে। মাফিজ ল খুবই মজার সূত্র। এই সূত্র বলে— গাদা করে রাখা বইয়ের ভেতর কেউ যদি কোনো একটা বিশেষ বই খোজে তাহলে সেই বইটা থাকবে সবার নিচে। সে যদি বুদ্ধি করে নিচ থেকে বইটা খুঁজতে শুরু করে তাহলে বইটা থাকবে সবার উপরে।

সফিক চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, আল্লাহপাক, তুমি দয়া করে সবার প্রথম সাবের, মুহিব কিংবা মহসিন— এই তিনজনের একজনকে আমার কাছে পাঠাও গো দয়াময়। তুমি দয়ার সাগর। তোমার কাছে এটা কোনো ব্যাপারই না। সফিক এই প্রার্থনা করল কারণ সে দেখেছে আল্লাহর কাছে সে যেটা চায় তার উল্টোটা হয়। যেহেতু সাবের, মুহিব কিংবা মহসিনকে চাওয়া হয়েছেএই তিনজন আসবে না। অন্য যে কেউ আসবে। তাৎক্ষণিকভাবে সিগারেট সমস্যার সমাধান হবে।

আজ সফিকের দোয়া আল্লাহ ঠিকঠাকমতো শুনলেন। সবার প্রথম মুহিব এসে উপস্থিত হলো। মুহিব এই আডর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। সফিক তাকে বিশেষ স্নেহ করে। মুহিব গত তিনদিনের আসরে অনুপস্থিত। আজ তাকে দেখে সফিকের ভালো লাগছে, তবুও সে বিরক্তি চাপতে পারছে না।

সফিক বলল, মুহিব, তুই চট করে নিচে যা তো, আমার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়। টাকা নিয়ে যা। যাবি আর আসবি।

মুহিব কিছু বলল না। পলিথিনের ব্যাগে মোড়া এক প্যাকেট সিগারেট বের করে এগিয়ে দিল।

সফিক বিস্মিত হয়ে বলল, ব্যাপার কী! সিগারেট ধরেছিস?

মুহিব বলল, না। আপনার জন্যে এনেছি।

সিগারেট এনেছিস কেন? কারণ কী? ভালো খবর আছে?

জি।

চাকরি পেয়েছিস?

জি।

অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার সাথে আছে?

আছে।

দেখি কী ব্যাপার।

সফিক গভীর মনোযোগে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার পড়ল।

আনন্দিত গলায় বলল, চাকরি তো খুবই ভালো পেয়েছিস।

মুহিব চুপ করে রইল।

সফিক বলল, আজ আর কাউকে কিছু বলিস না। সবাই মন খারাপ করবে। চেপে যা।

মুহিব হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

সফিক বলল, আগামীকাল কোনো এক সময় সবাইকে তোর খবরটা দেব। তুই কিন্তু আর আড্ডায় আসবি না। বুঝেছিস? তুই তোর মতো থাকবি। নতুন বন্ধু-বান্ধব তৈরি করবি। বাসার সবাই খুশি?

বাসায় কাউকে বলি নি।

কেন?

ইচ্ছা করল না।

ইচ্ছা করল না কেন? আচ্ছা থাক, ইচ্ছা না করলে বলতে হবে না। কারো উপর এখন রাগ রাখবি না। মন দিয়ে চাকরি করবি। মামার টেলিফোন পেয়ে মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল, এখন তোর চাকরির খবর শুনে মনের কিছুটা রিপেয়ারিং হয়েছে। হাবিজাবি কিছু খেতে পারলে ফুল রিপেয়ারিং হয়ে যাবে।

মুহিব বলল, আজকের হাবিজাবির খরচ আমি দিব।

তুই দিলে সবাই সন্দেহ করবে। টাকা আমার কাছে দে। কত দিবি?

এক হাজার টাকা সঙ্গে আছে।

দেখি দে টাকাটা–অন্য সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে আজ না হয় কিছু ভালো হাবিজাবি খাই। গতকাল মহসিন এমন এক জিনিস বানিয়ে দিয়েছে যে ঘুমায়ে কূল পাই না। মনে হয় আফিম-টাফিম মিশিয়েছে। মহসিনের এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করতে হবে। কোন দিন দেখা যাবে সবাই মরে পড়ে আছি। আজ রাতে কি তোকে বাসায় ফিরতে হবে?

না ফিরলেও চলে।

তাহলে আজ রাতে থেকে যা। বাসায় যদি দুশ্চিন্তা করে একটা টেলিফোন করে দে। আজ রাতটা সবাই মিলে হৈচৈ করে কাটাই— কারণ অদ্য শেষ রজনী।

শেষ রজনী কেন?

এই বাড়িতে শেষ রজনী। মামা গেট আউট করে দিয়েছে। খুবই খারাপ। ব্যবহারও করেছে। কুৎসিত গালাগালি। আমি আপন ভাগ্নে, সেই দিকে খেয়াল নেই। কুত্তার বাচ্চা শুয়োরের বাচ্চা বলে যাচ্ছে। এর ফল মামাকে ভোগ করতে হয়। মামা হোক চাচা হোক— সস্তায় পার পাবে কেন?

আপনি কী করবেন?

অনেকগুলি প্ল্যান মাথার ভেতর আছে। কোন প্ল্যান এক্সিকিউট করব বুঝতে পরছি না। দেখি সবাই আসুক। সবার সাথে আলোচনা করে দেখি। একা একা ডিসিশান নেয়া ঠিক হবে না।

 

রাত নটা পঁচিশ। এমন কিছু রাত না, কিন্তু আসর জমে গেছে। ঝড়-বৃষ্টির কারণে সবাই আগে-ভাগে এসে পড়েছে। দুই দফা হাবিজাবি খাওয়া হয়েছে। সবাই উৎফুল্ল এবং সামান্য উত্তেজিত। তবে অন্যদিনের মতো কারো গলাই চড়ছে না। সবাই কথা বলছে নিচু গলায়। আজ আবহাওয়া শীতল। সবার খানিকটা শীত শীতও করছে। তারপরেও এসি চলছে। ঘর ক্রমেই ঠাণ্ডা হচ্ছে।

আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু সফিকের মামাকে (ইতিমধ্যে তার নাম হয়েছে আজমীর মামা) কী শাস্তি দেয়া যায়? অনেকগুলি প্রস্তাব এসেছে। প্রথম প্রস্তাব দামি দামি সমস্ত ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র নষ্ট করে দেয়া। এসি, টিভি, ফ্রিজ, মিউজিক সিস্টেম।

সফিক এই প্রস্তাবে রাজি হয় নি। সে বলেছে মামা খুবই কৃপণ মানুষ। এই জিনিসগুলি তাঁর সন্তানের মতো। নিজের কোনো সন্তান নেই বলে এইগুলিকে তিনি সন্তানের চেয়েও বেশি স্নেহ করেন। এদের ক্ষতি হলে তিনি হার্টফেল করে মারা যাবেন। তাঁকে শাস্তি দিতে হলে মানসিক শাস্তির লাইন ধরতে হবে।

তখন প্রস্তাব হলো (নীরব ঘাতক সাবেরের প্রস্তাব) গরু, ছাগলের রক্ত এনে শোবার ঘরে রক্ত দিয়ে মাখামাখি করে রাখা হোক। রক্তমাখা একটা ছুরি রেখে দেয়া হবে। রক্ত শুকিয়ে জমে থাকবে। বিছানার চাদরেও রক্ত মাখানো থাকবে। সব থাকবে লণ্ডভণ্ড। ভদকার একটা বোতল ভেঙে চারদিকে কাচ ছড়িয়ে রাখা হবে। যাতে এই ঘরে ঢুকেই মনে হবে এখানে একটা হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তখন আজমীর মামার বিচি আসল জায়গা ছেড়ে কপালে উঠে যাবে।

প্রস্তাব সবার পছন্দ হলো। শুধু মহসিন বলল, আজমীর মামা যদি থানা পুলিশ করেন, তখন কী হবে? পুলিশ তো আমাদের খোঁজ করবে।

সফিক বলল, খোঁজ করলে করবে। আমরা তো কাউকে খুন করি নি। আমাদের সমস্যা কী! দুএকদিন যদি থানাতে থাকতে হয় থাকলাম।

রেজা বলল, রক্ত এনে কখন ফেলা হবে?

সাবের বলল, এখন ফেলা হবে। কাল ভোরে তো আমরা চলে যাচ্ছি। আজমীর মামার বাসায় আর আসব না।

রেজা বলল, রক্ত কে আনবে?

হারুন বলল, আমি আনব। আমাদের বাসার কাছে সাত মসজিদ রোডে কসাই আছে। আমার পরিচিত। দুলা ভাইয়ের কুকুরের জন্যে তার কাছ থেকে প্রায়ই মাংসের ছোবড়া কিনি। মাঝে মাঝে রক্ত কেনা হয়।

সফিক বলল, তাহলে দেরি করছিস কেন, চলে যা। পরে দেখা যাবে কসাই চলে গেছে।

কসাই চলে গেলে নিউমার্কেট থেকে নিয়ে আসব। রক্ত নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। দেখি আমাকে ভর্তি করে এক গ্লাস হাবিজাবি দাও। গাজা থাকলে ভালো হতো। আমার কাছে খুবই একসাইটিং লাগছে। এর মধ্যে গাজার বাতাস পড়লে…।

সফিক বলল, একজন কেউ গাঁজা নিয়ে আস। আজ একটা বিশেষ দিন। আমাদের মধ্যে একজন চাকরি পেয়েছে। একজন মেম্বার আমরা হারাতে যাচ্ছি। সেই উপলক্ষে একই সঙ্গে আনন্দ এবং নিরানন্দ পার্টি। গাঁজা ছাড়া এই পার্টি হবে কীভাবে?

হারুন বিস্মিত গলায় বলল, চাকরি কে পেয়েছে?

সফিক বলল, চাকরি কে পেয়েছে সেটা তো আমি আজ বলব না।

হারুন বলল, তুই না তো?

সফিক বলল, আমি না।

আল্লাহর কসম বল।

আল্লাহর কসম বলতে পারব না। তবে আমি না।

হারুন বলল, তোর ভাব-ভঙ্গি, কথাবার্তার ধরন-ধারণ সবই অন্যরকম লাগছে। আমার তো ধারণা তুই চাকরি পেয়েছিস।

সফিক বলল, আমি চাকরি পেয়েছি এটা বলব না, আবার চাকরি পাই নি এটাও বলব না। এই বিষয়ে আজ কোনো ডিক্লারেশন দেয়া হবে না। কথা বলে সবাই সময় নষ্ট করছে কেন— এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। রক্ত কই? গাজা কই?

 

রাত এগারোটার ভেতর গরুর রক্ত দিয়ে ঘর মাখামাখি করে ফেলা হলো। রক্তের মধ্যে একটা মাছ কাটা বটি ড়ুবিয়ে রাখা হলো। ভয়াবহ অবস্থা। মহসিন মিনমিনে গলায় বলল, সর্বনাশ! দেখে তো আমার নিজেরই ভয় লাগছে। শরীর ঝিমঝিম করছে।

হারুন বলল, বোতল ভেঙে দেয়ার দরকার নেই। এমনিতেই যথেষ্ট হয়েছে। জিনিসপত্র বেশি থাকলে Fake মনে হতে পারে। কোনো কিছুই ওভার ড়ু করতে নেই।

ইয়াকুব বলল, একটা ছবি তুলে রাখা দরকার ছিল। জিনিসটা যে এত ইন্টারেস্টিং হবে আগে বুঝতে পরি নি। আগে বুঝতে পারলে বাসা থেকে ক্যামেরা নিয়ে আসতাম। আজমীর মামার খবর আছে। মামার বিচি শুধু যে কপালে উঠে থেমে থাকবে তা না, মাথা ফুড়ে বের হয়ে যাবে।

নীরব ঘাতক সাবের বলল, আমরা শুধু আজমীর মামাকে শাস্তি দেয়ার কথা ভাবছি। আসল যে লোককে শাস্তি দেয়া উচিত তার কথা ভাবছি না। মূল অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না।

সফিক বলল, কার কথা বলছিস?

আরজু সাহেবের কথা বলছি। উনার কারণেই তো এই অবস্থা। আজ আমরা আশ্রয়হারা। গৃহহারা। আজ আমরা পথহারা পাখি।

সফিক বলল, কথা সত্যি। উনাকে কী শাস্তি দেয়া যায়?

সাবের বলল, উনাকে ডেকে নিয়ে এসে এই ঘর দেখিয়ে দেই। তাতেই উনার খবর হয়ে যাবে। তারপর উনাকে বলি— ডিয়ার স্যার, আপনি খবর দিয়েছেন আমরা সবাই না-কি নেংটো হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করেছি। কাজটা তো স্যার ঠিক করেন নি। আমরা সামান্য রাগ করেছি। এখন আপনি যদি স্যার দয়া করে একবার শুধু নেংটো হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করেন তাহলে আমাদের রাগটা কমে। আমরা আবার রেগে গেলে ভয়ঙ্কর হয়ে যাই।

সাবেরের কথা শেষ হবার পর দলের সবাই কিছুক্ষণের জন্যে নীরব হয়ে গেল। নীরবতা ভঙ্গ করে ইয়াকুব বলল, অসাধারণ আইডিয়া! একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আইডিয়া! আমার হাতে নোবেল পুরস্কার থাকলে আইডিয়ার জন্যে সাবেরকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে দিতাম।

হারুন বলল, আরজু সাহেবকে এখানে কে ডেকে আনবে? ঘণ্টা কে বাঁধবে?

সফিক বলল, এটা কোনো ব্যাপার না। মুহিব যাবে। মুহিবের রাজপুত্রের মতো চেহারা। সে যা বলে সবাই তা বিশ্বাস করে। মুহিব উনাকে বলবে যে, আমরা তার হাতে বাড়ির চাবিটা দিতে চাই। চাবি দেয়ার আগে ঘরগুলি খুলে উনাকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাই যে সব ঠিক আছে। কী-রে মুহিব, তুই গুছিয়ে সুন্দর করে বলতে পারবি না?

মুহিব বলল, পারব।

সফিক বলল, মুহিবকে পাঠানোর সবচে বড় সুবিধা হলো, ওর মুখে কোনো হাবিজাবির গন্ধ নেই। আমি নিজেই যেতাম কিন্তু আমার মুখ থেকে ভকভক করে হাবিজাবির গন্ধ বের হচ্ছে।

মুহিব বলল, কোনো অসুবিধা নেই। আমি যাচ্ছি।

ইয়াকুব বলল, ঘুমিয়ে পড়লে ঘুম থেকে ডেকে তুলবি।

 

কলিংবেল বাজতেই আঠারো-উনিশ বছরের কিশোরী ধরনের মুখের একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। মুহিবকে দেখে সে খুবই হকচকিয়ে গেল। এই সময়ের মেয়ে এত সহজে হকচকিয়ে যায় না। মুহিব বলল, স্লমালিকুম। মেয়েটা এতে আরো ঘাবড়ে গেল। মুহিব বলল, আরজু সাহেব কি আছেন?

মেয়েটি ক্ষীণ গলায় বলল, বাবা শুয়ে পড়েছেন। এখনো ঘুমান নি। আমি এক্ষুণি উনাকে ডেকে নিয়ে আসছি। বলেই ছুটে বের হয়ে গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবাকে নিয়ে উপস্থিত হলো।

মুহিব বলল, স্যার, আপনি একটু উপরে আসবেন? ফ্ল্যাট নাম্বার D4। আব্দুল গফুর সাহেবের ফ্ল্যাট।

কী ব্যাপার বলো তো? আমি কিন্তু বাবা তোমাকে চিনতে পারছি না।

D4 ফ্ল্যাটের মালিক আব্দুল গফুর সাহেবের ভাগ্নে সফিকের আমি বন্ধু।

ও আচ্ছা আচ্ছা।

মুহিব বলল, গফুর মামা সফিকের উপর খুব রাগ করেছেন। উনি বলেছেন। সবগুলি ঘর দেখিয়ে তারপর যেন আপনার হাতে চাবি দেয়া হয়।

বাবা কোনো দরকার নেই। তুমি চাবিটা আমার কাছে দিয়ে যাও।

গফুর মামা ঘরগুলি দেখিয়ে আপনার হাতে চাবি দিতে বলেছেন। উনি খুবই আপসেট।

আমার আসলে উনাকে কিছু জানানোই উচিত হয় নি। তোমাকে দেখে এখন তো আমার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছে। আসলে হয়েছে কী, একটা ছেলেকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে… আমি নিজেই দেখলাম। সে আমাকে দেখে মোটেই লজ্জা পেল না। খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যালো মিস্টার।

মুহিব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও আমাদের বন্ধু। মহসিন নাম। জুলজিতে M.Sc পাস করেছে। অনার্স এমএসসি দুটাতেই ফার্স্টক্লাস পাওয়া। তিন বছর চেষ্টা করেও কোনো চাকরি পাচ্ছিল না। মনটন খুব খারাপ থাকত। হঠাৎ খবর এসেছে তার মা মারা গেছে। আমরা তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। খবরটা শোনার পর হঠাৎ কী যেন হলো।

বলো কী! খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমার বোঝার ভুল।

ভদ্রলোক মেয়ের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, যূথী মা, দেখ তো কী লজ্জার মধ্যে পড়লাম— মার মৃত্যুতে একটা ছেলের সুখে-দুখে মাথা ইয়ে হয়ে গেছে আর আমি কি-না… ছিঃ ছিঃ।

যূথী বলল, বাবা, তুমি উনার সঙ্গে যাও। ঐ ভদ্রলোক যদি থাকেন তার কাছে ক্ষমা চাও।

অবশ্যই ক্ষমা চাইব। বাবা, তোমার নাম কী?

আমার নাম মুহিব।

চা খাও।

জি-না, আমি চা খাব না।

চা তো খেতেই হবে। চলো উপরে যাই, সবার সঙ্গে কথা বলে আসি। তারপর না হয় সবার সঙ্গেই চা খাব। মুহিব বাবা শোন, এ হলো আমার বড় মেয়ে— ডাক নাম যূথী। ভালো নাম শায়লা। খুবই ভালো ছাত্রী। এসএসসিতে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফিফথ হয়েছে। মেয়েদের মধ্যে প্রথম। এর ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ বিটিভিতে প্রচার করেছিল। টিভিতে তাকে অবশ্যি অনেক বড় বড় লেগেছে। আমি নিজেই চিনতে পারি নি।

যূথী লজ্জিত গলায় বলল, বাবা চুপ করো তো।

ভদ্রলোক মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা চলো যাই।

 

আরজু সাহেব আজমীর মামার শোবার ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার শরীর কাঁপছে। কপাল ভর্তি ঘাম। কপালের ঘাম নাক বেয়ে টুপটুপ করে পড়ছে। তিনি ভাঙা গলায় বললেন, এখানে কী হয়েছে?

সফিক বলল, তেমন কিছু হয় নি। আমরা কাটাকুটি খেলেছি।

তার মানে কী?

সব কিছুর মানে কি পরিষ্কার করে বলা যায়? বলা যায় না। বলা উচিতও না।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

সাবের বলল, বুঝতে না পারাই তো ভালো। এই জগতে যত কম বুঝবেন তত ভালো। বেশি বুঝলে ধরা খেয়ে যাবেন। একজন বেশি বুঝেছিল বলে ধরা খেয়েছে মামার শোবার ঘরটা নোংরা হয়েছে।

আমি যাই।

সাবের বলল, অবশ্যই যাবেন। যাবার আগে আমাদের জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে হয় যে।

আরজু সাহেব কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, কী কাজ?

মফিজ বলল, আমাদের বন্ধু যেমন নেংটো হয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে গিয়েছিল সে-রকম একটা নেংটা দৌড় দেবেন। আপনার পরনে লুঙি। নেংটা হওয়া আপনার জন্যে কোনো ব্যাপারই না।

আরজু সাহেব বললেন, বাবা তুমি কী বলছ?

নেংটা হতে যদি লজ্জা লাগে তাহলে তারও ওষুধ আছে। দুগ্লাস মাল খেয়ে নিন। দেখবেন লজ্জা-শরম কোথায় চলে যাবে।

ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, মাল খাব। মাল।

মহসিন এগিয়ে এসে আচমকা টান দিয়ে ভদ্রলোকের লুঙি খুলে ফেলল। তিনি কোনো আপত্তি করলেন না বা চেঁচিয়ে উঠলেন না। অদ্ভুত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাতে লাগলেন। একবার শুধু বিড়বিড় করে ডাকলেন— যূথী, ও মা যূথী।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ