আখলাক সাহেব একটা রুটিনের মতো করেছেন–রাতে ঘুমাতে যাবার আগে বাতি নিভিয়ে চারপায়ে বিছানায় কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে বিছানার এ মাথা থেকে ও মাথায় যান। আবার কখনো কখনো এক জায়গায় ঘুরপাক খান। এতে তাঁর শরীরটা বেশ হালকা ও ঝরঝরে লাগে। আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনা তো বটেই। শরীরের ভর দুটা পায়ে না থেকে চারটা পায়ে চলে যাওয়ায় মোটামুটি আরাম বোধ হয়। এভাবে থাকলে চিন্তা-শক্তি ভালো হয়। কিনা তাও তিনি পরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষার ফল সম্পর্কে তিনি এখনো নিশ্চিত হতে পারেন নি। তবে স্মৃতি-শক্তি এই অবস্থায় বাড়ে বলে তাঁর ধারণা। ছোটবেলায় স্কুলে পড়া অনেক কবিতা তাঁর এই অবস্থায় মনে পড়ে। যা অন্য সময় মনে পড়ত না। ক্লাস টেনে মাইকেলের খটমটে কবিতা মেঘনাদবধের একটা অংশ পাঠ্য ছিল। কোনোদিন সেটা তিনি মুখস্ত করার চেষ্টা করেন নি। প্রয়োজনও বোধ করেন নি। চারপায়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ সেই কবিতা তাঁর মনে পড়ে গেল। তিনি গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করলেন–

অন্যায় সমরে পড়ি, অসুরারি-রিপু
রাক্ষস কুল ভরসা পুরুষ বচনে
কহিলা লক্ষণ শূরে, বীরকুলগ্লানি
সুমিত্ৰানন্দন, তুই! শত ধিক তোরে!
রাবন নন্দন আমি, না ডারি শমনে
কিন্তু তোর অন্ত্রাঘাতে মরিনু যে আজি,
পামর এ চিরদুঃখ রহিলরে মনে!

তিনি পুরো কবিতাটাই বোধহয় বলতে পারতেন। কিন্তু তার আগেই মোতালেব এসে ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলে দিল। এবং চোখে মুখে রাজ্যের ভয় নিয়ে তাঁর দিকে তাকাল। আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কী চাস?

মোতালেব বলল, কিছু চাই না। আফনে কী করেন?

কী করি সে তো দেখতেই পাচ্ছিস। রিল্যাক্স করছি। ঘুমোবার আগে সামান্য একসারসাইজ। যা, বাতি নিভিয়ে চলে যা। গাধার মতো তাকিয়ে থাকিস না।

জ্বে আইচ্ছা।

ঘুমোবার আগে চারপায়ে থাকার ব্যাপারটায় হয়তো সামান্য হাস্যকর দিক আছে, তবে এটাকে একসারসাইজ হিসেবে নিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। ইয়োগার অনেক আসন আছে খুবই হাস্যকর। মাথা নিচে ঠ্যাং আকাশে। সেই ঠ্যাং দিয়ে আবার সাইকেল চালানোর ভঙ্গি করা। লোকজন সেটাকে হাস্যকর মনে করে না। কারণ ব্যায়াম হিসেবে ইয়োগো চালু হয়ে গেছে। চারপায়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই হাসির ব্যাপার হয়ে যায়। আশ্চৰ্য।

আখলাক সাহেবের মনে হলো চারপায়ের ব্যাপারটাকে ব্যায়াম হিসেবে চালু করতে পারলে কেউ এটাকে হাস্যকর মনে করবে না। বরং এটাকেই তখন স্বাভাবিক ধরে নেবে। সেই ক্ষেত্রে এই ব্যায়ামের একটা নাম দিতে হয়। কী নাম দেয়া যায়? ফ্রি হ্যান্ড একসারসাইজ বলা যাবে না, হ্যান্ড ফ্রি না। হাত মাটিতে পোতা, ফিক্সড হ্যান্ড একসারসাইজ বলা যেতে পারে। এই ব্যায়ামের উপকারিতা কী তাও লোকজনদের বলতে হবে।

১… শরীরের মাংসপেশি শিথিল হয়। শরীর বিশ্ৰাম লাভ করে।

২… স্মৃতি-শক্তি ও চিন্তা-শক্তি বৃদ্ধি পায়।

৩… মন প্ৰফুল্ল হয়।

৪… সুনিদ্রা হয়।

মন প্ৰফুল্ল হয়। কিনা এ ব্যাপারে আখলাক সাহেব এখনো নিশ্চিত নন। আরো পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ব্যাপারটা বোঝা যাবে। তবে সুনিদ্রা যে হয় সে ব্যাপারে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত। এই ব্যায়াম তিনি যে কদিন করেছেন ভালো ঘুম হয়েছে। শুধু গতরাতে ঘুম কম হয়েছে। ঘুমে যখন চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে তখন জ্ঞানী ভূত ঘুম থেকে তাকে ডেকে তুলেছে। তিনি বিবক্ত হতে গিয়েও হন নি, কারণ এবার ভূত অনেক দিন পর এসেছে। ভূত কাচুমাচু গলায় বলল, সরি স্যার, আপনার কাচা ঘুম ভাঙ্গালাম।

আখলাক সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, তারপর তোমার খবর কী? অনেক দিন দেখা সাক্ষাৎ নেই।

খবর বেশি ভালো না স্যার।

কেন কী হয়েছে?

ডাইরিয়াতে স্যার খুব কষ্ট পেলাম। এখনো পাচ্ছি, পুরোপুরি সারে নি। খাওয়া দাওয়া খুব বেসিট্রিকটেড।

ডাইরিয়া? তোমাদের ডাইনিয়া হয় নাকি?

খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করলে হয়। সেদিন এক বিয়েতে গিয়ে অনিয়ম হয়েছে। লোভে পড়ে এক গাদা খেয়ে ফেলেছি, তারপরেই পেট নেমে গেছে। ওষুধপত্র খেয়ে এখন কিছুটা আরাম হয়েছে। তবে শরীর খুবই দুর্বল।

কী ওষুধ খাচ্ছ?

ডাইরিয়ার ওষুধ তো একটাই–ওরস্যালাইন।

তোমাদেরও ওরস্যালাইন আছে নাকি?

কী বলেন স্যার, থাকবে না কেন? এক জংশ চাঁদের আলোর সঙ্গে তিন মুঠ গোলাপ ফুলের গন্ধ, তার সঙ্গে হাতের আঙ্গুলের এক চিমটি জোনাকি পোকার আলো। তারপর দে ঘোটা। জিনিস যা তৈরি হয় অতি অখাদ্য। নাড়ি ভূড়ি উল্টে আসে। কী আর করব, শরীরটা তো ঠিক রাখতে হবে।

তাতো বটেই।

এদিকে স্যার বিপদের উপর বিপদ… যাকে বলে মহাবিপদ। ৪ নম্বর দূরবতী বিপদ সংকেত।

কী বিপদ?

বলতেও লজ্জা লাগছে, না বলেও পারছি না।

বলে ফেল।

সত্যি কথা বলতে কী স্যার, এই বিপদে পড়েই আপনার কাছে আসা। আপনার কি স্যার মনে আছে প্ৰথম যেদিন আপনার কাছে এসেছিলাম সেদিন বলেছিলাম মহাবিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আমি একজন বিপদগ্ৰস্ত ভূত।

হ্যাঁ মনে আছে।

প্রতিবারই ভাবি বিপদের কথাটা আপনাকে বলব। শেষে নাসিকা লাজায় বলতে लेि भी।

নাসিকালজ্জা?

মানুষের লজ্জা সবটাই চোখে, এই জন্যে তারা বলে চক্ষুলজ্জা। আমাদের সবটাই নাকে। এই জন্যেই আমরা বলি নাসিকালজ্জা। এমনিতে স্যার আমরা মুখে কথা বলি। লজ্জা পেলে মুখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়, তখন কথা বলি নাকে।

ও আচ্ছা। এখন বলো তোমার বিপদের কথাটা শুনি।

বঁড় লঁজ্জা স্যাঁর।

লজ্জা দূর করে বলো–অন্য দিকে তাকিয়ে বলো তাহলে লজ্জা লাগবে না।

ভূত অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কথা শুরু করল।

বাড়ি থেকে আমাকে বিয়ের জন্যে খুব প্রেসাব দিচ্ছে স্যার। এদিকে আমার নিজের বিয়ের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। আমি পড়াশোনা, গবেষণা, লেখালেখি নিয়ে থাকি। একটু দেশ ভ্রমণেরও শখ আছে। গত সপ্তাহে ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঘুরে এলাম। সেখানে কালভৈরবীর মূর্তি দেখে এসেছি। বড়ই আনন্দ পেয়েছি। বিয়ে করলে এইসব আনন্দ থেকে বঞ্চিত হব।

কেন? স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে!

আপনি কি স্যার পাগল হয়েছেন? বাবা-মা যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছেন তাকে নিয়ে দেশ বিদেশে ঘোরার প্রশ্নই ওঠে না।

কেন?

তার নাম শুনেলই বুঝবেন কেন, তখন আর আমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না। তার নাম হলো ফা-চল্লিশ।

ফা-চল্লিশ মানে?

ফা-চল্লিশ মানে চল্লিশ নম্বর ফাজিল।

ফাজিল নাকি?

ফাজিল বলে ফাজিল। রাত দিন গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। একে ভয় দেখায়, তাকে ভয় দেখায়। সেদিন ধানমন্ডি থানার ওসিকে ভয় দেখিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে এইসব করা কি ঠিক? স্যার আপনি বলুন।

পুলিশের সঙ্গে রসিকতা না করাই ভালো।

এটা তো স্যার সাধারণ কথা। যে-কোনো বোকা জানে। সেও জানে, জানে না যে তা না। তবে এই যে বললাম।–ফাজিল।

দেখতে কেমন?

দেখতে ভালো। সর্বনাশ তো এতেই হয়েছে। মা-বাবা ভূতানির রূপ দেখে মুগ্ধ : তাদের এক কথা–বিয়ে ফা-চল্লিশের সঙ্গেই দিতে হবে। স্যার, এখন আপনিই বলুন রূপ বড় না জ্ঞান বড় ঢ় রূপ চিরস্থায়ী না জ্ঞান চিরস্থায়ী? স্যার বলুন, আপনিই বলুন?

দুটা দুজিনিস।

অবশ্যই। একটার সঙ্গে অন্যটার তুলনাই চলে না। আমি বাবা-মাকে বলে দিয়েছিচিরকুমাব থাকব। নো হাংকি পাংকি। বিয়ে-সংসার এইসব আমাকে দিয়ে হবে না। এইজন্যেই স্যার আপনার সাহায্য দরকার।

আমি কীভাবে সাহায্য করব তাতো বুঝতে পারছি না।

আপনি নিজেও তো স্যার চিরকুমার। আপনি আমাকে শলা পরামর্শ দেবেন। কীভাবে আত্মীয়স্বজনদের চাপ কাটানো দেয়া যায় সেটা বলবেন। আমি সেই মতো কাজ করব।

ও আচ্ছা।

শুধু ও আচ্ছা বললে হবে না স্যার। আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে। ফাচল্লিশ যেভাবে বিরক্ত করা শুরু করেছে–অসহ্য। ওফ।

মেয়েটা তোমাকে বিরক্ত করছে?

বিরক্ত মানে মহাবিরক্ত। হয়তো কোনো জ্ঞানের বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি তখন সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। হাসবে। নানান রকম ঢং করবে। এতে চিন্তার বিঘ্ন হয়।

হওয়ারই কথা।

মনে করুন। আমি কোনো রাস্তা দিয়ে যাব, সে করবে। কী আগে ভাগে সেই রাস্তার কোনো বাঁশ গাছে পা দুলিয়ে বসে থাকবে। পা নাচাবে। উপর থেকে গায়ে থুথু ফেলবে।

আমার মনে হয় মেয়েটা তোমাকে পছন্দ করে।

এক্কেবারে খাঁটি কথা বলেছেন স্যার। আমার জীবন অতিষ্ঠা করে তুলেছে। ইচ্ছা হচ্ছে বিষ খাই। এখন আপনি ভরসা। ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা করে অধমের জীবন রক্ষা করুন।

দেখি কী করা যায়।

তাহলে স্যার আমি আজ যাই। আপনি ঘুমান। অনেকক্ষণ ডিসটার্ব করলাম। নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন স্যার।

ভূত চলে যাবার পরেও অনেক রাত পর্যন্ত আখলাক সাহেব ঘুমাতে পারলেন না। একবার মনে হয় পুরো ব্যাপারটা কল্পনা; আবার মনে হয়–না কল্পনা না, সবই সত্যি। জগৎ খুবই রহস্যময় যে জন্যে মহাকবি শেক্সপিয়র বলেছিলেন–কী যেন বলেছিলেন? মনে পড়েছে না। তিনি অনেকক্ষণ বিছানায় এপোশ ওপাশ করে শেক্সপিয়রের বাণী মনে করার চেষ্টা করলেন। মনে পড়ল না। এই মনে আসছে, এই আসছে না–এমন ভাব। লাইনগুলি মনে না। আসা পর্যন্ত ঘুম আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কী করা যায়? তাঁর মনে হলো ঘোড়ার মতো চারপায়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মনে পড়বে। একটু লজ্জাও লাগছে। এত লজ্জা করলে জীবন চলে না। তিনি হামাগুড়ির ভঙ্গিতে বিছানায় বসলেন। চারপায়ে একটু হাঁটলেনও–বিছানাটা হাঁটাহাঁটির জন্যে ছোট হয়ে গেছে। অর্ডার দিয়ে একটা বড় খাট এবং বড় মশারি কিনতে হবে। আখলাক সাহেব অল্প জায়গার ভেতরই একটু চক্কর দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে শেক্সপিয়রের বাণী মনে পড়ল–There are many things in heaven and earth… ..বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ডে বহু কিছুই আছে যা মানবের চিন্তা ও কল্পনার অতীত… ..শেক্সপিয়র এইসব জিনিস তো আর গাজা খেয়ে লেখেন নি, জেনে শুনেই লিখেছেন। তাঁর মতো মানুষের গাজা খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

কাজেই ভূতের ব্যাপারটা সত্যি হতেও পারে। চারপায়ে হাঁটার যে সব উপকারিতার কথা ভূত বলেছে তাও সত্যি… স্মৃতিশক্তি যে বাড়ে তা তো তিনি নিজেই পরীক্ষা করে দেখলেন। অন্যদের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে পারলে ভালো হতো, সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এ দেশের মানুষ সবকিছু বিশ্বাস করে, যাবতীয় গুজব আগ্রহ নিয়ে শুনে, অন্যকে শোনায়; শুধু ভূতের মতো একটা সত্যি ব্যাপার বিশ্বাস করে না। তারপরেও তিনি ঠিক করলেন–মিলিকে খোলাখুলি ব্যাপারটা বলবেন। মিলিকে বলা আর একটা মাইক ভাড়া করে শহরে ঘোষণা দেয়া এক কথা, তারপরেও বলা দরকার। তবে মিলির স্বামী না শুনলেই ভালো–ব্যাটা অতিরিক্ত চালাবাজ। সব শুনে সে চালবাজি ধরনের কিছু বলবে, মেজাজ হবে খারাপ। কী দরকার।

কলিং বেল টিপতেই তাহের দরজা খুলে দিল। তাহেরের পেছনে উঁকি দিল মিলি, দুজনই সেজেণ্ডজে আছে, মনে হচ্ছে কোথাও বেরুচ্ছে। আখলাক সাহেব বললেন, কোথাও যাচ্ছিস?

মিলি হড়বড় করে বলল, তোমার কাছে যাচ্ছি।

আমার কাছে কেন?

মিলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মোতালেব এসে কী সব উলটা পালটা খবর দিয়ে গেল। চিন্তায় অস্থির হয়ে .

কী বলেছে মোতালেব?

দাদা তুমি নাকি এখন চারপায়ে হাঁটা। তুমি নাকি রাতে ঘুমাও না। মশাবি খাটিয়ে তার ভেতর চারপায়ে দাঁড়িয়ে থােক। মাঝে মাঝে ঘোড়ার মতো চিহি করে ডাক ছাড়।

বলতে বলতে মিলির চোখে পানি এসে গেল। গলা ধরে গেল। তাহের বলল, তুমি ভাইজানকে আগে ভেতরে এসে বসতে দাও। দরজাতেই কী শুরু করলে? মোতালেবের সব কথা বিশ্বাস করতে হবে তার কোনো মানে আছে? ভাইজান আপনি এসে আরাম করে

বসুন তো।

আখলাক সাহেব বসার ঘরের সোফায় এসে বসলেন। তাহের গম্ভীর মুখে তাঁর সামনে এসে বসল। মিলি তার ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো চোখ মুছছে। তাহের বুকে এসে বলল, মোতালেবের কথা সত্যি না, তাই না ভাইজান?

আখলাক সাহেব গলা পরিষ্কার করে বললেন, চিহি করে ডাক দেয়ার ব্যাপারটা সত্যি না। ঐ অংশটা বানানো।

বাকিটা সত্যি?

মোটামুটি সত্যি বলা যেতে পারে।

তাহেরের মুখ হা হয়ে গেল। অনেক কষ্টে সে মুখের হা বন্ধ করে বলল, আপনি তাহলে চারপায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?

সব সময় না, মাঝে মাঝে।

মাঝে মাঝে?

হ্যাঁ। এটা এক ধরনের একসারসাইজ। এর নাম হলো তোমার ফিক্স হ্যান্ড একসারসাইজ। এই একসারসাইজের অনেক উপকারিতা। স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্যে এরচেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।

মিলি চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বলল, কে শিখিয়েছে তোমাকে এই একসারসাইজ?

কেউ শেখায় নি, নিজে নিজেই বের করেছি।

মিলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, তুমি নিজে নিজে এই একসারসাইজ বের করেছ?

ঠিক নিজে নিজে বলাটা ঠিক হবে না। ভূতেল সাহায্য নিয়েছি।

দাদা, কার সাহায্য নিয়েছ?

ঐ যে একটা ভূত যে আমার কাছে প্রায়ই আসে, নাম হলো গিয়ে— লেখক ৭৪…

মিলি ভীত গলায় বলল, লেখক ৭৪?

ওদের নামকরণ পদ্ধতি আর আমাদের নামকবণ পদ্ধতি এক না। প্রথম দিকে ভুতদের নাম শুনলে একটু ধাক্কা লাগবেই।

মিলি বলল, দাদা তুমি যা বলছ সব কিছুতেই আমার ধাক্কা লাগছে। একী সর্বনাশ হয়ে গেল! বলতে বলতে সে আবারো শব্দ করে কেঁদে উঠল। তাহের বলল, মিলি তুমি রান্নাঘরে যাও তো, ভাইজান এবং আমার জন্যে সুন্দর করে চা বানিয়ে আন। অকারণে অস্থির হয়ে না। মাথা ঠাণ্ড রাখ। বি লেভেল হেডেড। সিচুয়েশন আন্ডার কনট্রোলে আছে। আর শোন, তুমি এখনো ভাইজানের মাথার উপর ফ্যানটা ছাড়ছ না কেন? সব কিছু বলে দিতে হবে? ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দাও।

মিলি ফ্যান ছেড়ে দিল। আখলাক সাহেব গম্ভীর হয়ে সেই ফ্যানের নিচে বসে রইলেন। তিনি খুবই বিরক্ত বোধ করছেন। এই বাড়িতে আসাটা তার জন্যে বোকামি হয়েছে।

তাহের তার দিকে ঝুঁকে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ভাইজান একটা কথা বলি?

আখলাক সাহেব বললেন, যা বলতে চাও বলো। ফিসফিস করছ কেন? ফিসফিস করার মতো কিছু কি হয়েছে? যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে।

ভাইজান, আপনার চিকিৎসা হওয়া দরকার।

তোমার সে-রকম মনে হচ্ছে?

জি।

তোমার ধারণা আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে?

জি আমার সেরকমই ধারণা। ঠিকমতো চিকিৎসা হলে আপনি আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিষ্ট আছেন। আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাব।

কবে নিয়ে যাবে?

যদি বলেন আজই নিয়ে যাব।

উনাকে আপনার ব্যাপারে সব বলে রেখেছি।

আখলাক সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, যদি সত্যি কোনোদিন পাগল হই তাহলে তোমাকে নিয়ে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাব। এখন আমার সামনে থেকে যাও। আমাকে বিরক্ত করো না।

আপনি কি একটা রিল্যাক্সেন খেয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকবেন? এতে মাথাটা ঠাণ্ডা হতো।

আমার মাথা নিয়ে তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

জি আচ্ছা।

আখলাক সাহেবের ইচ্ছা হচ্ছে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। যাচ্ছেন না, কারণ মিলি কষ্ট পাবে। এসেছেন যখন রাতে খেয়ে যেতে হবে। মিলি নিশ্চয়ই কুৎসিত কিছু রান্না করবে। যা মুখে দেয়া যাবে না। রাতে খাবাব সময় আবার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলবে। আবারো–৫২। এমন কোনো বয়স না! অসহ্য।

দরজার আড়াল থেকে তৃণা উঁকি দিচ্ছে। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। সে ফিসফিস করে ডাকল, বড় মামা।

আখলাক সাহেব বললেন, ফিসফিস করছিস কেন?

মা তোমার সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে, এই জন্যেই ফিসফিস করছি। মা শুনলে বকা দেবে।

কথা বলতে নিষেধ করেছে কেন?

তোমার যে খুব মেজাজ খারাপ। এই জন্যে।

আমার মেজাজ খারাপ না। আয় কাছে আয়।

তৃণা এগিয়ে এলো এবং কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, বড় মামা তুমি নাকি পাগল হয়ে গেছ?

আখলাক সাহেব বললেন, কে বলেছে?

বাবা বলেছে। মা সেটা শুনে সারা দুপুর কেঁদেছে। বড় মামা, তুমি কি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছ, না একটু বাকি আছে?

একটু বাকি আছে।

মোতালেব বলছিল তুমি নাকি এখন ঘোড়ার মতো হাঁট আর চিহি করে ডাক দাও।

ও একটু বেশি বেশি বলছে। চিহি করে ডাক দিই না।

যখন চিঁহি করে ডাক দেবে তখন পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবে, তাই না মামা?

হুঁ।

ঐ ভূতটা কি তোমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে মামা?

বুঝতে পারছি না, বোধহয় দিচ্ছে।

মিলি অনেক কিছু রান্না করেছে। পাবদা মাছ, কাতলা মাছের মাথার মুড়িঘণ্ট। কই মাছের ঝোল। ইলিশ মাছের সর্ষে বাটা। প্রতিটি পদই হয়েছে অখাদ্য। শুধু শুধু যে ভাত খাবেন সে উপায়ও নেই। চাল কিছু সেদ্ধ হয়েছে, কিছু হয় নি। একই হাঁড়ির ভাত অর্ধেক সেদ্ধ হয়, অর্ধেক হয় না কেন তা বোধহয় শুধু মিলিই জানে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ