ভাই, আমার গল্পটা কেমন লাগছে?

রূপকথার গল্পের মতো না? রূপকথার গল্পে দুই রানী থাকে–সুয়োরানী ও দুয়োরানী। আমার গল্পেও তো দুই রানী একজন রূপা, আরেকজন কাঁসা।

রূপকথার গল্প শেষ হয় কীভাবে? শেষ লাইনটি থাকে এরকম—‘অতঃপর তাহারা সুখে দিন কাটাইতে লাগিল।’

আমিও সুখে দিন কাটাচ্ছি। রূপকথার চেয়েও ভালো আছি।

রূপকথায় শেষপর্যন্ত দুই রানী থাকে না। ভালোটা থাকে, খারাপটা চলে যায়। আমি আছি দু’জনকে নিয়েই। সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। মাঝে মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি।

গাছের গোড়ায় পানির বদলে রক্ত দেয়ার পরীক্ষাটা শুরু করেছি।

আরেকটা পরীক্ষা করছি বিড়াল দিয়ে। একটা বিড়ালকে অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছি যেখানে সামান্যতম আলোও নেই। আমার দেখার ইচ্ছা দীর্ঘদিন অন্ধকারে থাকার কারণে বিড়াল অন্ধ হয়ে যায় কি-না। কেউ কোনো বাধা দিচ্ছে। না। বরং কাঁসা-কন্যার কাছ থেকে উৎসাহ পাচ্ছি। বেশিরভাগ সময় সে আড়ালে আড়ালে থাকে। তবে ডাকলেই চলে আসে।

কাঁসা-কন্যার জন্যে আমি একটা নাম খুঁজে বেড়াচ্ছি। আপনার জানা সুন্দর নাম কি আছে?

আপাতত একটা নাম ঠিক করে রেখেছি ‘প্লবঙ্গ’। তারার নামে নাম।

ধ্রুবতারার কাছাকাছি একটা তারা আছে, যাকে বলা হয় মেরু প্রহরী (Gurdian of the pole)। এই তারা ধ্রুবতারাকে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেয় এরকম মনে হয়। পাহারাদার সেই তারার বাংলা নাম প্লবঙ্গ। ইংরেজিতে Kochab.

কাঁসা-কন্যা তো আমাকে পাহারাই দিচ্ছে, কাজেই তার নাম প্লবঙ্গ হতে পারে।

তবে যুক্তাক্ষর দিয়ে শুরু নাম আমার পছন্দ না। সব নাম হওয়া উচিত যুক্তাক্ষর বর্জিত। আমি কাঁসা-কন্যার জন্যে ভালো নাম খুঁজছি। আপনার সন্ধানে থাকলে বলবেন।

রূপাকে একটা হোমে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। সেখানে সে ভালো আছে। খাওয়া-থাকার কোনো সমস্যা নেই। চিকিৎসা চলছে। মানসিক রোগ তো। জীবাণুঘটিত কোনো ব্যাপার না যে এন্টিবায়োটিক দিয়ে সারিয়ে দেয়া যাবে। সাত দিনের কোর্স। প্রতি আটঘণ্টা পর পর দুশ’ পঞ্চাশ মিলিগ্রাম এন্টিবায়োটিক।

কঠিন মানসিক ব্যাধি সারতে সময় লাগে। সবসময় যে সারে তাও না।

রূপা ভালো আছে। বেশ ভালো। সে তার নিজের ঘরে দিনরাত বসে থাকে। ঘর থেকে বের হতে ভয় পায়। শুধু আমি যখন তাকে দেখতে যাই, সে ঘর থেকে বের হয়। আমার সঙ্গে অনেক গল্প করে। তার শৈশবের গল্প। বাবা, মা, ভাইবোনের গল্প। ইউনিভার্সিটির গল্প। গল্প করতে করতে হঠাৎ থেমে যায়। মুখ করুণ করে বলে আমাকে এখান থেকে কবে নিয়ে যাবে?

আমি বলি, খুব শিগগিরই নিয়ে যাব।

আজ নিয়ে যাবে? আমাকে বের করে নিয়ে চল। কতদিন ধরে যে এই ঘরটার মধ্যে আছি!

বেশিদিন তো হয় নি রূপা। মাত্র দু’বছর হয়েছে। মাত্র সাত শ তিরিশ দিন।

 

 

আমার কাছে মনে হচ্ছে কয়েক লক্ষ বছর ধরে এইখানে আছি। যেন আমার জন্মই হয়েছে এই ঘরে।

এই তো আর অল্প কিছু দিন। আমি তোমার জন্যে চকলেট এনেছি। চকলেট খাও।

তুমি কি এখন চলে যাবে?

না, আরো কিছুক্ষণ থাকব।

আবার কবে আসবে?

আবার কবে আসব সেটা তো তুমি জানো। আমি প্রতিমাসের প্রথম রবিবারে আসি।

ভুলে যাবে না তো?

না, ভুলব না। আমার স্মৃতিশক্তি খুব ভালো।

আমি জানি তোমার স্মৃতিশক্তি ভালো। কেন জানি আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। আমার কিছু মনে থাকে না। তুমি যে প্রতিমাসের প্রথম রবিবারে আস—এটা আমার মনে ছিল না। আমার মনে হচ্ছিল তুমি ছয়-সাত বছর পর পর একবার আস।

তুমি যদি চাও মাসে দু’বার আসব।

দরকার নেই, তোমার কষ্ট হবে।

রূপা বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমার চলে যাবার সময় হলেই তার শ্বাসকষ্ট হয়। বেচারি বড় কষ্ট পায়।

 

রূপার সঙ্গে দেখা করে আমি গেলাম ইফতেখার মামাকে দেখতে। তিনি একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে আছেন। পুরো শরীর অবশ। শুধু মাথা নাড়তে পারেন। কথা বলতে পারেন। তাঁর সেবার জন্যে একজন সার্বক্ষণিক নার্স আছে। নিউরোলজিস্ট প্রফেসার আবিদ তার চিকিৎসা করছেন। ফিজিওথেরাপিস্টও একজন আছেন। চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমি দিচ্ছি।

মামা আমাকে দেখে খুশি হলেন। তাঁর চোখ ঝলমল করে উঠল। আমি বললাম, মামা, ভালো আছেন?

মামা বললেন, হু। ভালো আছি। তুমি কেমন আছ বাবা?

আমি জবাব দিলাম না। মামার পাশে বসলাম। আমি যে ভালো আছি এটা মামাকে বলতে ইচ্ছা করছে না।

 

সারাটা দিন আমার নানান কাজকর্মে কাটে। ‘বাংলাদেশের পাখি’ বিষয়ে আমি একটা বই লেখার চেষ্টা করছি। পাখি দেখার জন্যে বায়নোকুলার নিয়ে প্রায়ই আমাকে বনে-জঙ্গলে যেতে হয়। দিনের সময় পাখিদের জন্যে থাকলেও রাতটা আমি রেখে দেই প্রবঙ্গের জন্যে।

আমার রাত কাটে প্লবঙ্গের সঙ্গে গল্প করে। কত বিচিত্র বিষয় নিয়েই না। আমরা গল্প করি! মাঝে মাঝে তাকে কবিতা পড়ে শোনাই। সে মুগ্ধ হয়ে শোনে। তার চোখে ছলছল করে অশ্রু। সে চোখ মুছে গাঢ় গলায় বলে, এই কবিতাটা আবার পড় তো!

আমি আবারো পড়ি

If we shall live, we live;
If we shall die, we die;
If we live we shall meet again;
But to night, goodbye.

রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে রূপার ডায়েরির কয়েকটা পাতা পড়ি। কী গুছিয়েই না সে তার আবেগের কথা লিখেছে–

আজ বুধবার। ওকে দেখলাম বারান্দায় বসে আছে। তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ও আকাশ খুব ভালোবাসে। দিনে আকাশ দেখে। রাতেও আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকে। ও যখন একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন আমার এত মায়া লাগে। আমার ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলি–তোমার কিসের কষ্ট বলো তো?

রাতে হঠাৎ যদি আমার ঘুম ভেঙে যায় আমি উঠে বসি। তাকিয়ে থাকি ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে। আমার মনে হয় আমি আমার বাকি জীবনটা তার মুখের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিতে পারব। আমার আর কিছু লাগবে না।

রূপার লেখা পড়তে পড়তে আমার চোখ ছলছল করে। আমার মনে হয়–আমাদের জীবনটা তো সুখেই কাটছে।

—–x—–

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ