আমাকে খুনি বলছেন কেন?

আমি খুন করি নি। খুন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি সামান্য ভয় দেখিয়েছি। আমাদের সমাজে ভয় দেখানো নিষিদ্ধ না। আমরা সবসময় কাউকে না কাউকে ভয় দেখাচ্ছি। আপনি আপনার নিজের কথা চিন্তা করুন। আপনি নিশ্চয়ই আপনার এক জীবনে অনেককে ভয় দেখিয়েছেন। কাউকে না কাউকে নিশ্চয়ই বলেছেন–জানে মেরে ফেলব, বদমাশ কোথাকার! ভূত সেজে কাউকে ভয় দেখান নি? অবশ্যই দেখিয়েছেন। আপনার ভয় দেখানোতে কেউ মারা যায়। নি। আমার ক্ষেত্রে একজন দুর্বল হার্টের কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে মারা গেছে। এতেই আমি খুনি হয়ে গেলাম? আপনার হিসাব-নিকাশ তো অদ্ভুত!

উনিশ শ’ একাত্তর সনের একটা গল্প বলি। মুক্তিবাহিনী ইন্ডিয়ান আর্মি নিয়ে আমাদের গ্রামে ঢুকেছে। রশীদ মণ্ডল নামের নিতান্তই নিরীহ একজনের সঙ্গে তাদের দেখা। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার কী মনে করে রশীদ মণ্ডলের হাত চেপে ধরে বলল, এই তুই কি রাজাকার?

সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল করে রশীদ মণ্ডল মারা গেল। এখন আমরা কি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারকে খুনি বলব? মানুষ খুন করার দায়ে আদালতে কি তার বিচার হবে?

তবে একটা কথা ঠিক যে, মানুষকে বিচার করা উচিত তার কর্মের পেছনের উদ্দেশ্য দিয়ে। কর্ম দিয়ে নয়। উদ্দেশ্য যদি হয় ভয় দেখিয়ে মজা করা, তাহলে কোনো অপরাধ হবে না। কিন্তু উদ্দেশ্য যদি হয় ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলা, তাহলে অবশ্যই অপরাধ হবে।

ভয় দেখিয়ে সাথীকে মেরে ফেলব–এরকম উদ্দেশ্য আমার ছিল না। এই ক্ষেত্রে আমি অবশ্যই অপরাধী না, তবে তার ছোটবোনের মৃত্যুর জন্যে আমাকে দায়ী করতে পারেন। কোনো প্রমাণ অবশ্যি নেই। আদালত আমাকে দোষী প্রমাণ করে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারবে না। তবে আমি দোষী ঠিকই। দ্বিতীয় মৃত্যুটা অবশ্যই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

আচ্ছা ভাই, আপনি এত অস্থির হয়ে পড়েছেন কেন? ঠাণ্ডা মাথায় আগে গল্পটা শুনুন। একজন সিজিওফ্রেনিক রোগী খোলামেলাভাবে তার গল্প বলছে। আপনার তো উচিত মন দিয়ে শোনা। আপনি একজন লেখক মানুষ। লেখকরা। গল্প খুঁজে বেড়ায়, সেখানে আপনাকে কোনো খোঁজাখুঁজি করতে হয় নি। আমি নিজেই গল্প নিয়ে উপস্থিত হয়েছি। মানুষ খুব সহজ প্রাণী’–এরকম কেন ভাবছেন? কেন ভাবছেন মানুষের মস্তিষ্ক শূন্য আকাশের মতো নির্মল?

‘সাধু সাধু সাধু’ রবে কাঁপে চারিধার–
সবে বলে, পরিষ্কার অতি পরিষ্কার’!
দুর্বোধ্য যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল,
শূন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল!

কার কবিতা বলুন তো? ঠিক ধরেছেন–রবীন্দ্রনাথের ‘হিং টিং ছট’। কবিতাটা কখন লেখা হয়েছে, কোথায় লেখা হয়েছে, বলতে পারবেন?

পারবেন না। কারণ আপনি আমার মতো খুঁটিয়ে পড়েন না। বেশিরভাগ মানুষই পড়ে না। বেশিরভাগ মানুষ জলের উপর উড়াউড়ি করে। জল স্পর্শ করে না। আমি করি। হিং টিং ছট’ কবিতাটা লেখা হয়েছে শান্তিনিকেতনে। প্রচণ্ড গরমের সময় জ্যৈষ্ঠ মাসে। বাইরের উত্তাপ তাঁর কবিতাতেও চলে এসেছে—

গ্রীষ্মতাপে উম্মা বাড়ে ভারি উগ্রমূর্তি
গায়ে কালো মোটা মোটা ছাঁটাছোটা কুর্তি।

দেখেছেন আমি কত মন দিয়ে পড়ি? মন দিয়ে যেমন পড়ি–জীবনটাকে সে-রকম মন দিয়েই দেখার চেষ্টা করি। জীবনের ব্যাখ্যায় আমি ভুল করতে পারি কিন্তু জীবনকে দেখায় কোনো ভুল নেই।

আপনারা মানুষের মাথার ভেতরের আলোকিত করিডোরগুলি জানেন, কিন্তু অন্ধকার করিডোরগুলি জানেন না। জানতে চানও না। আমি জানতে চাই।

গল্পে ফিরে যাই?

পৃথিবীতে তিন রকম বাড়ি আছে। সাধারণ বাড়ি; যেখানে লোকজন কখনো হাসে, কখনো কাঁদে।

কান্না বাড়ি; যেখানে সবসময় কেউ না কেউ কাদছে।

হাসি বাড়ি; যেখানে কেউ না কেউ সবসময় হাসছে।

সাথীর মৃত্যুর পর আমার বাড়িটা হয়ে গেল কান্না বাড়ি। দুই বোন সবসময় কাঁদছে। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তাদের কান্না দেখতে লাগলাম। অনেক কিছু লক্ষ করলাম, যা আগে লক্ষ করি নি। যেমন, দীর্ঘস্থায়ী কান্না যখন চলে তখন এক সময় চোখের পানি শুকিয়ে যায়। শুরু হয় অশ্রুশূন্য কান্না। আবার চোখে পানি আসে ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিটের মাথায়।

কী বললেন, সাথীর মৃত্যুর ব্যাপারে আমাকে কেউ সন্দেহ করেছে না-কি?

না তো! সন্দেহ কেন করবে? তাছাড়া আমি তো রূপা এবং তার ছোটবোনকে বলেছি যে আমি জানালা দিয়ে সাথীর মুখে টর্চের আলো ফেলেছি। আমি সত্য গোপন করি নি। তবে পূর্ণ সত্য বলি নি। আমি বলেছি Half truth. অর্ধ সত্য মিথ্যার চেয়েও খারাপ। এটা তো নিশ্চয়ই জানেন।

টর্চলাইটের ব্যাপারটা আমি কীভাবে বলেছি শুনুন। আমি রূপাকে বলেছিঝড়-বৃষ্টি যখন হচ্ছিল, তখন আমি বারান্দায় বসা। আকাশে বিজলি চমকাচ্ছে, তাই দেখছি। হঠাৎ শুনলাম তোমার আপা বলছে–কে কে? কথা শুনে মনে। হলো ভয় পেয়েছে। ব্যাপার কী দেখার জন্যে আমি টর্চলাইট নিয়ে গেলাম–জানালা দিয়ে টর্চ ফেললাম। দেখি কিছু না। তিনি তার ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছেন। আমি চলে এসেছি। তখন যদি জানতাম এমন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেছে, তাহলে…

দেখলেন সত্যি কথাকে সামান্য এদিক-ওদিক করলে কী হয়? সত্যিকে এদিক-ওদিক করলে বিরাট উলট-পালট হয়ে যায়। মিথ্যার বেলায় তা হয় না।

যে কথা বলছিলাম, আমার বাড়িটা হয়ে গেল কান্না বাড়ি। কখনো রূপা কাদছে, কখনো ছোটন কাঁদছে এবং কখনো দেখা যাচ্ছে দু’জনই কাঁদছে। কান্না যখন থামছে তখন হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। ইনহেলার হাতে নিয়ে দু’বোন পাশাপাশি বসা। দু’জনই বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। একজনের হাতে ইনহেলার। ইনহেলারটা গাজার কল্কের মতো হাতবদল হচ্ছে। অসম্ভব বিরক্তিকর ব্যাপার।

এই ধারাবাহিক কান্নাকাটির জন্যে আমার একটা ক্ষতিও হয়ে গেল। কাঁসাকন্যা উধাও হয়ে গেল। তার কথাবার্তা শোনা যায় না। তাকে দেখতে পাওয়া তো আরো দূরের ব্যাপার। কাঁসা-কন্যার গলার শব্দ শোনার জন্যে আমি অনেক চেষ্টা চালালাম। দীর্ঘ সময় ছাদে বই নিয়ে বসে রইলাম। সারাক্ষণ অপেক্ষা করলাম এই বুঝি কাচের চুড়ির টুনটন শব্দ শুনব। কাঁসা-কন্যা বলে উঠবে, এখানে একা একা কী করেন?

কাঁসা-কন্যার সঙ্গে কথা বলার তীব্র বাসনা আমার মধ্যে তৈরি হলো। তাকে আমার অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। তার মধ্যে একটি হলো–সাথীর মৃত্যু সে কীভাবে দেখছে? আমি জানি তাকে জিজ্ঞেস করার অর্থ নিজেকেই জিজ্ঞেস করা। সে জবাব যা দেবে তা আমারই জবাব। সেই জবাবও আমার জানা দরকার। আমি কথা বলতে চাই আমার সাব-কনশাস মনের সঙ্গে। সেটা তো এমনিতে সম্ভব না। অবচেতন মনের সঙ্গে কথা বলার জন্যে আমার অবশ্যই কাঁসা-কন্যাকে প্রয়োজন। এ বাড়ির কান্না বন্ধ না হলে সে হয়তো আসবে না।

আমি কান্না বন্ধ করার ব্যবস্থা করলাম। দু’বোনের যে-কোনো একজনের কান্না বন্ধ হলে অন্যজনেরটা বন্ধ হবে। আমি বেছে নিলাম ছোটনকে। ঠিক করলাম তাকে ছোটখাটো একটা শক দেয়া হবে। তার মন’ নামক বিষয়টাকে নাড়া দেয়া হবে। এমন এক ধরনের নাড়া যার জন্যে সে মোটেই প্রস্তুত না। সে পুরোপুরি হকচকিয়ে যাবে। মাথা যাবে এলোমেলো হয়ে। আমি এক সন্ধ্যায় তাকে ছাদে ডেকে পাঠালাম।

সে ছাদে উঠে এলো। তার মুখ বিষণ্ণ। চোখ লাল। বোঝাই যাচ্ছে ছাদে উঠে আসার আগে আগে সে চোখ মুছেছে।

আমি কোমল গলায় বললাম, কেমন আছ ছোটন?

ভালো আছি।

এটা কি ভালো থাকার নমুনা? চোখে এখনো পানি।

ছোটন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, দুলাভাই, আমি ভালো নেই। আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ছোটন, শোন, আমি নিজেও ভালো নেই। আমারও মরে যেতে ইচ্ছা করছে। আমি প্রায়ই ছাদে উঠে আসি, যাতে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যেতে পারি। আমার সাহস কম বলে কাজটা করতে পারছি না।

ছোটন খুবই বিস্মিত হয়ে বলল, আপনার কী হয়েছে?

আমি বললাম, আমার কী হয়েছে আমি তোমাকে বলছি, তার আগে। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি–তুমি কি জানো আমি ভয়ঙ্কর একজন মানুষ?

না তো।

আমার যে মাথা খারাপ এটা তুমি জানো না? তোমার আপা তোমাকে কিছু বলে নি?

আপনার মাথা খারাপ এটা বলে নি। আপনি মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করেন এটা বলেছে।

তোমাকে বলে নি সে আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিল?

হ্যাঁ বলেছে।

কোনো ভালো মানুষকে নিশ্চয়ই কেউ সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যায় না?

আপনি সামান্য একসেনট্রিক। আপা অল্পতেই ভয় পায় বলে আপনাকে নিয়ে গেছে। মানুষ হিসেবে আপনি স্বাভাবিক।

ছোটন, তুমি ভুল করছ। মানুষ হিসেবে আমি মোটেই স্বাভাবিক না। আমার মাথায় অনেক এলোমেলো ব্যাপার আছে যা তুমি বা তোমার আপা কেউই

জানে না।

[ভাই, লক্ষ করছেন যে আমি সত্যি কথা বলছি। এই সত্যের মাঝে ছোট ছোট মিথ্যা ঢুকাব। সত্য হলো স্বর্ণ আর মিথ্যা হলো খাদ। সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মেশানোয় সত্য হবে কঠিন এবং ঝলমলে। আমি যে ছোটনকে নাড়া দিতে শুরু করেছি–এটা বুঝতে পারছেন? ছোটনের মুখ থেকে কিন্তু কান্না সম্পূর্ণ চলে গেছে। এখন তাকে আমি বড় শকটা দেব।]

ছোটন শোন, কারো শরীরে যদি দগদগে ঘা হয় সে কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করে ঘা লুকিয়ে রাখতে। মনের অসুখ বিষাক্ত ঘায়ের মতো। মানুষ এই বিষাক্ত ঘা। কাউকে দেখিয়ে বেড়ায় না। লুকিয়ে রাখে।

আপনি এত নিশ্চিত হলেন কীভাবে যে আপনার সত্যি সত্যি মনের অসুখ আছে?

তোমরা দু’বোন এ বাড়িতে উঠে আসার পর থেকে আমার তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে তোমার রূপা আপাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। তখনি বুঝেছি আমার অসুখটা মারাত্মক পর্যায়ের।

আপনি এসব কী বলছেন?

[বড় শকটা দিলাম। এরচে’ও বড় শক আছে। সেটা এখনি দেয়া হবে। প্রথম শকটা সামলানোর আগেই দেয়া হবে। কামারের দোকানে কামারকে লোহার কাজ করতে দেখেছেন? কামার কী করে, আগুনে পুড়িয়ে লোহাকে টকটকে লাল করে। তারপর সেই লোহাকে বাঁকায়। আমিও তাই করছি। বড় শকটা দিয়ে লোহা গনগনে করেছি। এখন আরেকটা শক দিয়ে লোহা বাঁকানো হবে। Ready get set go…]

ছোটন শোন, মন দিয়ে শোন, আমি এখন যা বলব তা শুনলে তুমি আমাকে ভয়ঙ্কর খারাপ ভাববে। তোমার কাছে মনে হবে আমার চেয়ে খারাপ মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নেয় নি। তুমি যা ইচ্ছা ভাব। আমাকে আমার কথা বলতেই হবে। যে-কোনো কারণেই হোক তুমি এ বাড়িতে উঠে আসার পর আমার মনে হলো আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।

দুলাভাই, আপনি এসব কী বলছেন?

কথা বলবে না। প্লিজ! আমি আগে কী বলছি মন দিয়ে শোন, তারপর চিক্কার চেঁচামেচি যা ইচ্ছা কর। যখন মনে হলো তোমাকে ছাড়া বাঁচব না–তখনি মাথায় এলো তাহলে গলা টিপে রূপাকে খুন করে ফেলি। ছোটন, এখন কি বুঝতে পারছ যে আমার মাথা খারাপ?

বুঝতে পারছি। আমি আপনার পায়ে পড়ি, আপনি এইসব কিছুই আপাকে জানাবেন না। আপা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে। কষ্টেই সে মরে যাবে।

বলো আমি কী করব? আমি কি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ব? ছোটন, তুমি আমার কাজটা সহজ করে দাও। আমি রেলিং-এর উপর দাঁড়াচ্ছি। তুমি ধাক্কা দিয়ে আমাকে নিচে ফেলে দাও। আমার পক্ষে নিজে নিজে লাফ দেয়া সম্ভব না। পাগলরা সাহসী হয়। কিন্তু আমি সাহসী না। আমি ভীতু।

বলতে বলতে আমি টলোমলো ভঙ্গিতে রেলিং-এ উঠে দাঁড়ালাম। ছোটন। আতঙ্কিত গলায় বলল, দুলাভাই, আপনি নামুন। আপনার পায়ে পড়ি, আপনি। নামুন।

তুমি যদি আমার প্রতি সামান্য দয়া কর তাহলে নামব।

আপনি আগে নামুন। প্লিজ প্লিজ!

আমি নামলাম। নেমেই গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করলাম—

প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।

ছোটন ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের এই অশ্রুর ধরন অন্য।

নিজের অভিনয় প্রতিভায় আমি নিজেই চমকৃত হলাম। মনে হলো শেক্সপিয়রের নাটকে একই সঙ্গে দুটি চরিত্রে অভিনয় করছি, Hamlet এবং Ghost.

Hamlet : Alas poor Ghost.

Ghost : Pity me not, but lend thy serious hearing to what I shall unfold.

Hamlet : Speak, I am boond to hear.

Ghost : So art thou to revenge.

একটি তরুণী মেয়ে যদি হঠাৎ কোনো ছেলেকে এসে বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচব না। তখন ছেলেটির মানসিক অবস্থা কী হয়? সে আনন্দে আত্মহারা হয়। কিছুক্ষণ সে থাকে On the top of the world. তারপর সে চারদিকে এই গল্প ছড়িয়ে দেয়। পরিচিত অপরিচিত সবাই এই গল্প কয়েকবার শুনে ফেলে। যারা আশেপাশে থাকে না তাদেরকে চিঠি লিখে জানানো হয়–তুমি শুনে খুবই আশ্চর্য হবে, লিলি নামের অত্যন্ত রূপবতী এক তরুণী গত বৃহস্পতিবার বিকাল চারটা পঁচিশ মিনিটে হঠাৎ করে…। যুবকটি এই গল্প যতই ছড়াতে থাকে ততই তার আবেগ কমতে থাকে। ঘটনার নভেলটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। সে তখন অপেক্ষা করতে থাকে কখন অন্য কোনো তরুণী তাকে এসে এ জাতীয় কথা বলবে।

মেয়েদের বেলায় এই ব্যাপারটি একেবারেই ঘটে না। কোনো তরুণীকে যদি কোনো যুবক এসে বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তখন তরুণী আনন্দে আত্মহারা হয় না, বরং খানিকটা ভীত হয়ে পড়ে। সে এই ঘটনা কাউকেই জানায় না। যে কারণে ঘটনাটা তার নিজের মনের ভেতরে বড় হতে থাকে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে পুরো বিষয়টা মাথা থেকে মুছে ফেলতে। যতই সে চেষ্টা করে ততই এই ঘটনা শিকড় গজিয়ে বসতে থাকে। এক সময় তরুণীটির মনে হয়–আহারে বেচারা! সত্যি বোধহয় সে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। এক সময় সে ‘আহারে বেচারা’কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। দু’জন এক সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছে। ছেলেটা তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সে বিরক্ত হয়ে বলল, সবসময় তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাক কেন? লোকে কী ভাববে। ছেলেটা গাঢ় স্বরে বলল, ভাবুক যার যা ইচ্ছা। এই বলে সে আগের মতোই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে লাগল।

 

ভাই, বলুন তো আমার এনালাইসিস ঠিক আছে না? এনালাইসিসটা অবশ্যই অতি সরলীকরণ দোষে দুষ্ট। তারপরেও মনে হয় ঠিক আছে। যদি এনালাইসিস ঠিক হয় তাহলে অবশ্যই ছোটন মেয়েটি আমাকে নিয়ে নানান চিন্তাভাবনা শুরু করবে। চিন্তাভাবনা পানির মতো। যে পানি খাল দিয়ে প্রবাহিত। কোন দিকে প্রবাহিত হবে তা নির্ভর করবে খালটা কোন দিকে কাটা হবে। খাল অবশ্যই ছোটন নিজেই কাটবে, তবে আমাকে সাহায্য করতে হবে। সাহায্য করা মানে। খাল কাটা নিয়ন্ত্রণ করা। আমি আগ্রহ নিয়েই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় নামলাম।

পরের দিনের কথা। দু’বোন ঝিম ধরে বারান্দায় বসে আছে। আমি তাদের কাছে গিয়ে ছোটনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম, তোমরা দু’জন সবসময় দেখি মূর্তির মতো বসে থাক। এটা তো ঠিক না। কাজকর্ম শুরু কর। কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাক। ছোটন, তোমার কলেজ নেই?

ছোটন মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, আছে। যাব না।

সে সম্ভবত আমার চোখের দিকে তাকাতেই ভয় পাচ্ছিল। আমি বললাম, কলেজ আছে কিন্তু যাবে না তা কেন হবে? ডাক্তারি পড়াটা তো এমন না যে ঘরে বসে পড়ে পুষিয়ে নেবে। তুমি অবশ্যই যাবে। চল, আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।

রূপা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছ। চল, আমরা দুজন মিলে ওকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আসি।

আমি বললাম, তোমরা দু’বোন সবসময় এক সঙ্গে ট্যাগ হয়ে থাকবে এটা কেমন কথা? তোমার যাবার কোনো দরকার নেই। তুমি থাক। আমি নামিয়ে। দিয়ে আসছি।

রূপা বলল, ঠিক আছে এটাই ভালো। তুমিই নামিয়ে দিয়ে আস।

ছোটন ভীত গলায় বলল, না আপা, না। আমি যাব না।

রূপা বলল, তুই অবশ্যই যাবি।

আমি ছোটনকে কলেজে নামিয়ে দিতে গেলাম। আমার অতিরিক্ত আগ্রহের কারণে ছোটন খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমি নিশ্চিত সে কলেজে যাবার পথে আমি তার সঙ্গে কী আচরণ করব তা নিয়েই তার দুশ্চিন্তা। কী করবে মানুষটা? চট করে হাত ধরে ফেলবে? তার দিকে ঘেঁসে আসবে? গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে গদগদ গলায় প্রেমের কথা বলার চেষ্টা করবে?

ছোটন যা ভাবছে সে-রকম কোনো কিছুই করা যাবে না। উদ্ভট কিছু করা যাবে না। মেয়েরা প্রেমিকের উদ্ভট আচরণ পছন্দ করে। অন্যদের কাছ থেকে উদ্ভট আচরণ আশাও করে না, পছন্দও করে না।

আমি গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসলাম। পেছনের সিটে ছোটনের সঙ্গে বসলাম না। গাড়িতে সারা পথে একটি কথাও বললাম না, একবারও পেছন ফিরে তাকালাম না। ছোটন গাড়ি থেকে নেমে আমার জানালার পাশে ঝুঁকে এসে ভয়। পাওয়া গলায় বলল, আমি যাই।

আমি ছোটনের দিকে না তাকিয়ে বললাম, আমি বুঝতে পারছি আমার অদ্ভুত কথাবার্তায় তোমার খুব মন খারাপ হয়েছে। তোমার চেয়ে একশ’ গুণ মন। খারাপ হয়েছে আমার। তুমি কিছু মনে করো না। আমি ঠিক করেছি, যে অপরাধ করেছি তার জন্যে আমি নিজেকে শাস্তি দেব।

ছোটন বলল, কী শাস্তি?

আমি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, সেটা তোমার জানার দরকার নেই।

ছোটনকে দেখে মনে হলো সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। তবে আমি জানি এই স্বস্তি সাময়িক। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মধ্যে জন্ম নেবে হতাশা। এবং দুঃখবোধ। কী রকম দুঃখবোধ–ব্যাখ্যা করি? মনে করুন সাত-আট বছরের একটি শিশু হঠাৎ রাস্তায় তার খুব পছন্দের খেলনা কুড়িয়ে পেয়েছে। খেলনাটা হাতে নিতে তার খুব ইচ্ছা করছে কিন্তু সাহস করে নিতে পারছে না। অন্যের খেলনা কেন সে নেবে? তারপরে সে ঠিক করল সে খেলনাটা বাড়িতে নিয়ে যাবে না, শুধু হাতে নিয়ে একটু দেখবে। এই ভেবে যেই সে খেলনার দিকে তাকাল সে দেখল খেলনাটা নেই। এরকম কিছু যদি ঘটে তাহলে শিশুটির মনে যে দুঃখবোধ তৈরি হবে, ছোটনের মনেও ঠিক এরকম দুঃখবোধই তৈরি হয়েছে। আমি সেই দুঃখবোধকে ব্যবহার করে এগুব।

কেন এরকম করছি?

আমি এক ধরনের খেলা খেলছি। খেলার মধ্যে সবচে’ আনন্দময় খেলা হলো মনের খেলা। এই খেলা সবাই খেলতে পারে না। কেউ কেউ পারে। যারা পারে। তারা এই খেলা খেলে খুব আনন্দ পায়। আমি পারি।

সে-রাতে আমরা তিনজন খেতে বসেছি। আমি প্লেটে ভাত নিলাম। ইলিশ মাছ ভাজার প্লেটটা কাছে টেনেই হাত গুটিয়ে নিয়ে বললাম, আমি খাব না।

রূপা বলল, কেন, ক্ষিধে হয় নি?

আমি বললাম, ক্ষিধে হয়েছে। কিন্তু আমি খাব না। না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দেব।

ছোটন চমকে আমার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। রূপা বিস্মিত হয়ে বলল, নিজেকে কষ্ট দেবে কেন?

আমি বললাম, আমি পাপ করেছি। পাপের শাস্তি দেয়ার কেউ নেই। আমাকেই শাস্তিটা দিতে হবে।

রূপা বলল, কী পাপ করেছ?

আমি বললাম, সেটা তোমার জানার দরকার নেই।

পরের দু’দিন এবং দুই রাত্রি সর্বমোট আটচল্লিশ ঘণ্টা আমি পানি ছাড়া কিছুই খেলাম না। রূপা এবং ছোটন হতভম্ব হয়ে গেল। আটচল্লিশ ঘণ্টা পার। হবার পর ছোটনের সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা হলো। ছোটন এসে বলল, দুলাভাই, আপনি যদি অনশন ভঙ্গ করেন তাহলে আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনব। আমার নিজের স্বার্থে আমি এটা বলছি না। আপার মুখের দিকে তাকিয়ে বলছি। আপনি লক্ষ করছেন না যে আপা পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছে। সে কিছুই। খেতে পারছে না। যা খাচ্ছে বমি করে দিচ্ছে। সে যে আপনাকে কতটা ভালোবাসে তা আপনি জানেন না। কারণ অন্যের ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। আপার একটা ডায়েরি আছে। ডায়েরিটা পড়ে দেখবেন।

আমি ছোটনের কথা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, আমি অনশন ভঙ্গ করলে তুমি আমার যে-কোনো কথা শুনবে?

হ্যাঁ।

অন্যায় কথাও শুনবে?

হ্যাঁ।

ভয়ঙ্কর অন্যায় কথাও শুনবে?

হ্যাঁ।

বেশ, রাতে তোমাদের দু’বোনের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে বসব। রাতের খাওয়া শেষ হবার পর আমি জর্দা দিয়ে একটা পান খাব। একটা সিগারেট ধরাব–তারপর কথাটা বলব। ঠিক আছে?

ছোটন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ঠিক আছে।

আমি বললাম, মনে রেখো, তুমি কিন্তু বলেছ আমার ভয়ঙ্কর অন্যায় আবদারও তুমি রাখবে।

ছোটন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। পাথরের মূর্তির সঙ্গে তার একটাই তফাত–পাথরের মূর্তির ঠোট কাঁপে না, ছোটনের ঠোট কাপছে। ছোটনের মনে হয় শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। সে হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি তার সমস্ত চিন্তা চেতনায় আছে–ভয়ঙ্কর অন্যায় চাওয়াটা কী হতে পারে?

আমি বললাম, ছোটন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? রাতের খাবারের আয়োজন কর। খাবারটা যেন ভালো হয়। তোমার কি দুশ্চিন্তা লাগছে?

সে জবাব দিল না।

আমি বললাম, আজ রাতে যখন খেতে বসবে, সুন্দর করে সেজে খেতে বসবে। শাড়ি পরবে। কপালে টিপ দেবে। চুল বাঁধবে।

কেন?

তুমি এমনিতেই খুবই রূপবতী। সাজলে তোমার রূপ বাড়ে না কমে এটা দেখার ইচ্ছা। খুব রূপবতীরা সাজতে পারে না। সাজলে তাদের ভালো দেখায় না।

ছোটন শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। আমার সামনে থেকে চলে গেল না। দাড়িয়েই রইল।

রাতে খেতে বসেছি। ছোটন শাড়ি পরেছে, কপালে টিপ দিয়েছে, চুল বেঁধেছে। রূপা বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে?

ছোটন বলল, কিছু হয় নি তো।

রূপা বলল, এমন সাজগোজ করেছিস কেন?

ছোটন বলল, এমনি।

রূপা বলল, ঠিক করে বল তো ছোটন, তোর কি কোনো সমস্যা হয়েছে? কয়েকদিন ধরে লক্ষ করছি তোর আচার-আচরণ যেন কেমন কেমন।

ছোটন বলল, আমার কিছু হয় নি।

রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে না ওর আচার-আচরণ অস্বাভাবিক?

আমি বললাম, মনে হচ্ছে।

রূপা বলল, কী মনে হচ্ছে বলো তো?

মনে হচ্ছে ও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। প্রবল ঘোর। কোনো মেয়ে যদি প্রথম কারো প্রেমে পড়ে তাহলে তার মধ্যে এমন ঘোর তৈরি হয়। তার মধ্যে শশক-প্রবৃত্তি চলে আসে।

কী প্রবৃত্তি?

শশক-প্রবৃত্তি।

সেটা আবার কী?

শশক হলো খরগোশ। খরগোশ কী করে দেখ না? কিছুক্ষণ চুপচাপ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। নড়বে না। প্রায় পাথরের মূর্তি। তারপর হঠাৎ ছুটে কিছুদূর গিয়ে আবার মূর্তির মতো হয়ে যাবে। প্রথম প্রেমের সময় মেয়েরা এরকম করে।

ছোটন হঠাৎ হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। আমি বললাম, তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছিলে?

ছোটন বলল, এখন বলতে চাচ্ছি না।

রূপা বলল, তোর কিছু বলার থাকলে বল। ঝিম ধরে থাকবি না। তোর এই খরগোশের মতো ঝিম ধরে থাকাটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না।

আমি বললাম, ছোটনের মনে একটা প্রশ্ন এসেছিল। প্রশ্নটা সে করত। হঠাৎ মনে হলো–প্রশ্নটা এমন কিছু জরুরি না। না করলে কিছু যায় আসে না। তাই না ছোটন?

হ্যাঁ।

তোমার প্রশ্নটা আমি জানি। উত্তর দেব?

ছোটন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। রূপা বলল, ওর মাথায় কী প্রশ্ন তুমি জানবে কী করে? তুমি তো থট রিডিং জানো না।

আমি বললাম, থট রিডিং জানব না কেন? কিছু তো অবশ্যই জানি। প্রকৃতি সমস্ত প্রাণীজগতকে থট রিডিং-এর ক্ষমতা দিয়েছে।

রূপা বলল, ছোটন কী প্রশ্ন করতে চাচ্ছিল যদি জানো তাহলে উত্তর দাও। ওর ভাবভঙ্গি আমার মোটেই ভালো লাগছে না।

আমি বললাম, ছোটনের প্রশ্ন ছিল প্রথম প্রেমে পড়ার সময় মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় শশক-প্রবৃত্তি। ছেলেদের মধ্যে কী দেখা যায়? ছোটন, এটাই তো তোমার প্রশ্ন? ঠিক ধরেছি না?

ছোটন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

আমি বললাম, প্রথম প্রেমে পড়লে ছেলেদের মধ্যে দেখা যায় বানর-প্রবৃত্তি। বানর যেমন অকারণে লাফ ঝাপ দিয়ে ডিগবাজি খায়, সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালায়, প্রথম প্রেমে পড়া পুরুষের ক্ষেত্রে তাই হয়। লাফ ঝাপ ডিগবাজি। সবাইকে জানানো–দেখ আমি প্রেমে পড়েছি।

রূপা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মনে হচ্ছে সেও কিছু বলতে চাচ্ছে। সে কিছু বলল না। ছোটনের প্লেটে ইলিশ মাছ তুলে দিল।

ছোটন বোনের দিকে একবার তাকিয়ে খাওয়া বন্ধ করে উঠে চলে গেল।

রূপা বিস্মিত হয়ে বলল, ওর কী হয়েছে?

আমি নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলাম। হাত ধুতে ধুতে রূপাকে বললাম, আমি কিছুক্ষণ ছাদে শুয়ে থাকব। তারা দেখব। ছোটনকে দিয়ে আমার কাছে এক কাপ চা পাঠিও। ওকে নিরিবিলিতে জিজ্ঞেস করব ওর কী হয়েছে?

 

আমি ছাদে পাটি পেতে শুয়ে আছি। আকাশে তারা আছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখা যাচ্ছে। প্রশ্নবোধক চিহ্নের এই সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। যেন কেউ একজন তার প্রশ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশের গায়ে।

দুলাভাই, চা নিন।

ছোটন চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এক দৃষ্টিতে আকাশ দেখছিলাম বলেই বোধহয় তাকে লক্ষ করি নি। আমি বললাম, কেমন আছ ছোটন?

সে যন্ত্রের মতো বলল, ভালো। এখন বলুন আপনি আমার কাছে কী চান? আমাকে কী করতে হবে?

আমি চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললাম, তোমাকে যা করতে হবে তা হলো সবসময় সুন্দর করে সেজেগুজে থাকতে হবে। হাসতে হবে। দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করা চলবে না।

এই আপনার চাওয়া?

হ্যাঁ, এই আমার চাওয়া।

এটাকে আপনি কেন বলছেন ভয়ঙ্কর অন্যায় চাওয়া?

তুমি দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ। পরিবারের দু’জন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে, এর মধ্যে আমি তোমাকে বলছি হাসিখুশি থাকতে, সেজেগুজে থাকতে এটা অন্যায় না? এই চাওয়া কি ভয়ঙ্কর চাওয়া না?

ছোটন বলল, এখন কি আমি চলে যাব?

হ্যাঁ, যাও।

তারপরেও ছোটন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। আমি যখন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারো আকাশ দেখতে থাকলাম তখন তার পায়ের শব্দ শুনলাম। সে চলে যাচ্ছে। পায়ের শব্দেই বলে দিতে পারছি সে এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছে।

আপনি কি বুঝতে পারছেন ছোটন মেয়েটি এই ঘটনার পর আমার প্রেমে হাবুড়ুবু খেতে থাকবে? একবার ড়ুববে আবার ভাসবে। আবার ড়ুববে। শুরু হবে ভাসা ড়ুবার খেলা। নানান জটিলতা তৈরি হবে তার মনে। ত্রিমুখি জটিলতা। একদিকে তার দু’কুল ভাসানো প্রেম। অন্য আরেক দিকে তার অতি আদরের বোন রূপা, রূপার সংসার। তৃতীয় দিকে তার মৃতা বড় বোন এবং পিতা। ত্রিমুখি টানাটানির যন্ত্রণা থেকে সে মুক্তির পথ খুঁজবে। মুক্তির পথও কিন্তু আমি দেখিয়ে দিয়েছি। নিজে রেলিং-এ দাঁড়িয়ে ঝাঁপ দেয়ার কথা বলেছি। সেই স্মৃতি অবশ্যই ছোটনের মাথায় ঢুকে গেছে। সেই স্মৃতি ড়ুব দিয়ে আছে মস্তিষ্কের সাব-কনসাস লেভেলের নিচে। যথাসময়ে সেই স্মৃতি বের হয়ে আসবে। যাতে বের হয়ে আসে, সূক্ষ্মভাবে সেই চেষ্টা আমি করব। আমাকেও এগুতে হবে সাবধানে। ডমিনো প্রাসাদ তৈরি হয়েছে। টোকা দিলে সেই প্রাসাদ ভেঙে পড়বে। কোন দিকে ভাঙবে তা নির্ভর করবে টোকাটা কোথায় দেয়া হবে তার উপর।

 

অনেকদিন পর সেই রাতে কাঁসা-কন্যার দেখা পেলাম। আমি আকাশের তারা দেখছি, সে মিষ্টি গলায় বলল, কী দেখছেন?

আমি বললাম, তারা দেখছি।

সে হাসল। আমি বললাম, হাসছ কেন?

কাঁসা-কন্যা বলল, ছোটন বেচারির আশাভঙ্গ দেখে মজা পেয়ে হাসছি। বেচারি ভয়ঙ্কর কিছু আশা করেছিল। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান আছে না? ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।’

গানটা কি তুমি জানো?

কেন জানব না! আমি পৃথিবীর সব গান জানি, সব সুর জানি।

বেশ, তাহলে গানটা শোনাও।

এটা না, অন্য একটা গান শোনাই। তুমি তারা দেখতে থাক, আমি গান গাইতে থাকি।

আমাকে তুমি আপনি করে বলতে; আজ হঠাৎ ‘তুমি করে বলছ কেন?

আমরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি তো, এই জন্যে তুমি করে বলছি। আরো যখন কাছাকাছি আসব তখন তুমিও বলব না। কিছুই বলব না।

আরো কাছাকাছি আসার সুযোগ কি আছে?

অবশ্যই আছে। যখন কেউ থাকবে না, যখন শুধু তুমি আর আমি থাকব তখন…।

রূপা কোথায় যাবে?

কাঁসা-কন্যা বলল, এত কথা বলতে ভালো লাগছে না। এখন গান শোনো।

কাঁসা-কন্যা গান শুরু করল। আহারে কী মধুর কিন্নর কণ্ঠ! আমি তাকিয়ে আছি, গান হচ্ছে। আকাশের তারারা ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে। তাদের আলো নরম হয়ে চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কাঁসা-কন্যা গাইছে—

বঁধু, কোন্ আলো লাগল চোখে!
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে!
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে–
জন-জনম গেল বিরহশোকে।

জন্ম-জনম গেল বিরহ শোকে লক্ষ করেছেন কি সুন্দর লাইন? জন্ম গেল, আবার জনমও গেল। তিনি লিখতে পারতেন–জনম জনম গেল বিরহশোকে। সেটাও কম সুন্দর হতো না। কাজী নজরুল লিখেছেন–জনম জনম তব তরে কাদিব।’ এত সুন্দর লাইন মানুষের মাথায় আসে কী করে? মানুষ হলো অস্বাভাবিক ক্ষমতাধর এক প্রাণী। সে পারে না এমন কিছু কি আছে? তার চিন্তা এবং কল্পনার বাইরে কি কিছু আছে? পেটেন্ট অফিসের সামান্য একজন কেরানি মাথা চুলকাতে চুলকাতে হঠাৎ একদিন বলে বসলেন–আলোর গতি বিষয়টা তো গোলমেলে। গোলমালটা ঠিক করা দরকার। বের হয়ে গেল আপেক্ষিক তত্ত্ব। মানব সভ্যতা একদিনে হাজার বছর এগিয়ে গেল।

আমরা খুবই এলোমেলো পৃথিবীতে বাস করি। এলোমেলো ব্যাপারটা ঠিক করতে করতে এগিয়ে যাই। একটু এগুতেই আবার পঁাচ লেগে যায়। আমি ভয়ঙ্কর এলোমেলো এক জগতে বাস করছি। ঠিক করতে পারছি না। কাঁসা-কন্যা কি পারবে? তাকে জিজ্ঞেস করব?

না থাক, বেচারি দরদ দিয়ে গান করছে। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। গানের কোন লাইনে অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ে এটা দেখা দরকার। আমি কাঁসাকন্যার চোখের জল এবং গানের লাইন লক্ষ করছি। দু’টি পর্যবেক্ষণ কি একই সঙ্গে সম্ভব? হাইজেনবার্গের Uncertainity principle কী বলে? অবশ্যি অনিশ্চয়তার এই সূত্র Macro বস্তুজগতে কাজ করে না। কাঁসা-কন্যা কি Macro বস্তু?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ