জরী দোতলার বারান্দায় চুল এলিয়ে বসে আছে।

শীতকালে রোদে বসে থাকতে এমন ভালো লাগে। আজ ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস ছিল। ভোরবেলাতেই বাবা বলে দিয়েছেন, যেতে হবে না।

সে বলেছে, আচ্ছা। কেন যেতে হবে না জিজ্ঞেস করে নি। এই বাড়ির কারো সঙ্গেই কথা বলতে তার ইচ্ছা করে না। বাবার সঙ্গে না, মায়ের সঙ্গে না, ছোট বোনের সঙ্গেও না। তার প্রায়ই মনে হয় সে যদি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে পারত। তাহলে কত চমৎকার হত। সিঙ্গেল সিটেড একটা রুম। সে একা থাকবে। নিজের মতো করে ঘরটা সাজাবে। তাকে বিরক্ত করার জন্যে কেউ থাকবে না। দুপুর রাতে তার ঘরে দরজা ধাক্কা দিয়ে মা বলবেন না—ও জরী তোর সঙ্গে ঘুমুবব। তোর বাবা বিশ্ৰী ঝগড়া করছে। জরীকে দরজা খুলে বলতে হবে না, সে কি মা। কেঁদো না। দুপুর রাতে এ রকম শব্দ করে কাঁদতে আছে? বাড়ির সবাইকে তুমি জাগাবে।

তোর বাবা আমাকে কুত্তী বলে গাল দিয়েছে।

চুপ কর মা, ছিঃ। গাল দিলেও কি নিজের মেয়ের কাছে বলতে আছে?

তোকে না বললে কাকে বলব?

অনেক কথা আছে কাউকেই বলতে হয় না। আমি কি আমার সব কথা তোমাকে বলি? কখনো বলি না। কোনদিন বলবাও না।

এটা খুবই সত্যি কথা জরী তার নিজের কথা কাউকেই বলে না। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে মনে হয় এমন এক জন কেউ যদি থাকতো যাকে সব কথা বলা যায়।

রোদে বসে জরী তাই ভাবছিল। তার হাতে একটা ম্যাগাজিন। মাঝে মাঝে সে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছে, তবে সে কিছু দেখছেও না পড়ছেও না। হাতে একটা ম্যাগাজিন থাকার অনেক সুবিধা, কেউ এলে ম্যাগাজিন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া যাবে। কথাবার্তায় যোগ দিতে হবে না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে—এখন একটা মজার জিনিস পড়ছি। পরে কথা বলব।

জরীর মা মনোয়ারা দোতলায় উঠে এলেন। খানিকটা উত্তেজিত গলায় বললেন, জামাই এসেছে। জামাই।

জরী ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে লাগল। যেন সে কিছু শুনতে পায় নি।

জামাই এসেছে। নিচে বসে আছে।

জরী শীতল গলায় বলল, জামাই বলছি কেন মা? বিয়ে এখনো হয় নি। বিয়ে হোক তারপর বলবে।

তুই শাড়িটা বদলে নিচে যা।

কেন?

তোকে নিয়ে বাইরে কোথায় যেন খেতে যাবে বলছে।

জরী তাকিয়ে রইল। তার খুব রাগ লাগছে। যদিও রাগ করার তেমন কোনো কারণ নেই। এক মাস পর যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সে যদি তাকে নিয়ে এক দুপুরে বাইরে খেতে যেতে চায় তাতে দোষ ধরার কিছু নেই। এটাই তো স্বাভাবিক।

মনোয়ারা বললেন, জামাই পরশু রাতেও এসেছিল। তুই তোর কোন এক বন্ধুর বাসায় ছিলি। শুনে খুব রাগ করল।

জরী বলল, রাগ করল মানে?

না। রাগ না ঠিক ঐ বলছিল আর কি—এই বয়েসী মেয়েদের বন্ধুবান্ধবদের বাসায় রাত কাটানো ঠিক না।

তুমি কি বললে?

আমি কি বলব? আমার সঙ্গেতো কথা হয়নি তোর বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে।

বাবাকে সে উপদেশ দিল?

তুই সবার কথার এমন প্যাঁচ ধরিস কেন? উপদেশ না। কথার কথা বলেছে। আয় মা চট করে শাড়িটা বদলে আয়।

আমি যেতে পারব না।

এটা কেমন কথা।

যেতে ইচ্ছা করছে না মা।

তোর বড় চাচা নিচে বসে আছেন। উনি শুনলে রাগ করবেন।

জরী উঠে দাঁড়াল। মনোয়ারা বললেন, আয় আমি চুলটা আঁচড়ে দেই। তুই শাড়িটা বদলা।। গোলাপী জামাদানীটা পর। তোর চাচীর মুক্তার দুল জোড়া পরবি? নিয়ে আসব?

নিয়ে এসো।

মনোয়ারা ছুটে গেলেন। মেয়েকে অতি দ্রুত সাজিয়ে দিতে হবে নয়ত জরীর বড় চাচা রাগ করবেন। যার আশ্রয়ে বাস করছেন তাঁকে রাগানো ঠিক হবে না। কিছুতেই ঠিক হবে না। আজ যদি তিনি বলেন, অনেক দিনতো হলো এখন তোমরা নিজেরা একটা ব্যবস্থা দেখ। তখন কি হবে? কোথায় যাবেন তিনি? অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে কার ঘরে উঠবেন?

জরী বেশ যত্ন করে সাজল। কানো দুল পরল। চোখে হালকা করে কাজল দিল। তার চোখ এম্নিতেও সুন্দর, কাজল দেয়ার কোনোই প্রয়োজন নেই। তবু কাজল দিলেই চোখে একটা হরিণ হরিণ ভাব চলে আসে। অবশ্যি সে জানে বসার ঘরের সোফায় বসে অতি দ্রুত যে লোকটি পা নাড়াচ্ছে সে ভুলেও তার চোখের দিকে তাকবে না। পৃথিবীতে দুই ধরনের পুরুষ আছে। এক ধরনের পুরুষ তাকায় মেয়েদের দিকে। চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করে। অন্য দল তাকায় শরীরের দিকে।

মনিরুদ্দিন আজ থ্রী পিস সুট পরে এসেছে। গা দিয়ে ভুর ভুর করে সেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে। সেই গন্ধের সঙ্গে মিশেছে। জর্দার কড়া গন্ধ। তার মুখ ভর্তি পান। পানের লাল রসের খানিকটা ঠোঁটের উপর জমা হয়ে আছে। সে অতি দ্রুত পা নাড়াচ্ছে। জরীকে ঢুকতে দেখে সে তাকাল। সেই দৃষ্টি কয়েকবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নড়াচড়া করল। জরীর চাচা বলল, বস মা।

মনিরুদ্দিন বলল, চাচাজানের সঙ্গে দেশের অবস্থা নিয়ে কথা বলছিলাম। এই দেশে ভদ্রলোকের ব্যবসা করা সম্ভব না। যারা জেনুইন ব্যবসা করে তাদের জন্যে এই দেশ না। দালালদের জন্যে এই দেশ।

জরীর চাচা বললেন, খুবই সত্য কথা।

মনিরুদ্দিন বলল, কি আছে। এই দেশে বলেন দেখি চাচাজান। সামান্য অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসার জন্যে যেতে হয় ব্যাংকক। চিকিৎসা বলে এক জিনিস এই দেশে নাই।

ঠিক বলেছ।

তারপর ধরেন এড়ুকেশন। এড়ুকেশনের ‘এ’টাও এদেশে নাই।

জরী মনে মনে বলল, এড়ুকেশনের ‘ই’। ‘এ’ নয়।

পলিটিকসের কথা যদি ধরেন চাচাজান তাহলে বলার কিছুই নাই।

খুবই সত্যি কথা।

বুঝলেন চাচাজন পুরো বঙ্গোপসাগরটা যদি তেল হয়ে যায় তবু এই দেশের কোনো উন্নতি হবে না। দশজন লুটে পুটে খাবে।

কারেক্ট।

মনিরুদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।

আচ্ছা বাবা যাও।

জারী উঠে দাঁড়াল। জর্দার কড়া গন্ধে তার মাথা ধরে গেছে। বমি বমি আসছে।

 

বাসার সামনে বিশাল লাল রং এর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। খাকি পোষাক এবং মাথায় টুপি পরা এক জন ড্রাইভার।

মুনিরুদ্দিন গাড়িতে উঠেই বলল, কুদ্দুস রবীন্দ্র সংগীত দাওতো। আমার আবার গাড়িতে রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। আর শোন কুদ্দুস স্লো চালাবে।

কুদ্দুস রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট চালু করল। মনিরুদ্দিন জরীর দিকে তাকিয়ে বলল, খানিকটা ঘুরাঘুরি করি।

জরী বলল, জী আচ্ছা।

চীন বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ ব্রিজ দেখেছ?

না।

কুদ্দুস ঐ খানে চলতো।

গাড়ি চলতে শুরু করল। পেছনের সীটে এত জায়গা। তবু সে বসেছে জরীর সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে। জরী এখন তার গায়ের ঘামের গন্ধ পাচ্ছে।

মনিরুদ্দিন তার ডান হাত জরীর হাটুর উপর রেখেছে। গানের তালে তালে সেই হাতে তাল দিচ্ছে।

পরশু দিন রাতে কোথায় ছিলেন?

আমার এক বন্ধুর বাসায়।

উচিত না।

উচিত না কেন?

বন্ধু বান্ধব থাকা ভালো। গল্প গুজব করাও ভালো। তাই বলে রাতে থেকে যাওয়া ঠিক না।

জরী প্রাণপণ চেষ্টা করছে পাশে বসে থাকা মানুষটিকে ভুলে গিয়ে গানে মন দিতে। যেন গানটিই সত্যি। আশে পাশের জগৎ সত্যি নয়। অরুন্ধতী হোম চৌধুরী কি অপূর্ব গলা।

মুখ পানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে–
ফিরেছ কি ফের নাই বুঝিব কেমনে।

মনিরুদ্দিন একটি হাত জরীর কাঁধে তুলে দিয়েছে। পায়ের উপর থেকে সেই হাত কাঁধে উঠে এসেছে। জরী খুব চেষ্টা করছে নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে। যা হবার হোক।

মনিরুদিন অস্পষ্ট স্বরে বলল, একটু এদিকে সরে বস তাহলেই ড্রাইভার ব্যাকভিউ মিররে কিছু দেখবে না। এ রকম শক্ত হয়ে আছ কেন?

মনিরুদ্দিন জরীর বুক স্পর্শ করল।

জারী শিউরে উঠল।

মনিরুদ্দিন অভয়ের হাসি হেসে বলল, গাড়ির কাঁচ টিনটেড। বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না।

জরী চেঁচিয়ে বলল, ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থামান। আমি নামব। থামান বলছি। এক্ষুণি থামান। এক্ষুণি।

ড্রাইভার আচমকা ব্রেক কষে গাড়ি থামাল।

আপনি একটি কথাও বলবেন না। আমি এই খানে নেমে যাব। আপনি যদি বাধা দিতে চেষ্টা করেন। আমি চিৎকার করে লোক জড় করব।

তুমি, তুমি যাচ্ছ কোথায়?

আমি দারুচিনি দ্বীপে যাব।

কি বলছি তুমি? দারুচিনি দ্বীপ কি?

আপনি বুঝবেন না।

জরী গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল।

 

জরী সন্ধার পর বাসায় ফিরল। জরীর মা সম্ভবত সারাক্ষণই গেটের দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি ছুটে এসে মেয়ের হাত ধরে ভীত গলায় বললেন, কি হয়েছেরে মা, কি হয়েছে?

জরী সহজ গলায় বলল, কিছু হয়নিতো।

জামাই তোর বড় চাচাকে টেলিফোন করেছিল। তুই নাকি রাগারাগি করে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেছিস। জামাইকে খারাপ খারাপ কথা বলেছিস। অপমান করেছিস। জামাই অসম্ভব রাগ করেছে।

রাগ করলে কি আর করা।

তোর চাচাও রাগ করছে। খুবই রাগ করেছে। বসে আছে তোর জন্যে।

জরী বলল, মা তোমার কাছে টাকা আছে? আমাকে দেবে। আমি পালিয়ে যাব মা।

কি বলছিস পাগলের মতো? আয় ভেতরে আয়। কি হয়েছে বলতো। চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেলি কেন? যদি এ্যাকসিডেন্ট হত?

চলন্ত গাড়ি থেকে নামি নি।

হয়েছিল কি?

কিছু হয় নি।

তোর বাবা টেলিফোন আসার পর থেকে ছটফট করছেন। তাঁর অসুখ খুব বেড়েছে। আয় প্রথমে তোর বাবার কাছে আয়।

 

জরীর বাবা হাঁপানির প্রবল আক্রমণে নীল বর্ণ হয়ে গেছেন। বিছানায় পড়ে আছেন চোখ বন্ধ করে। নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টায় তাঁর বুক উঠা নামা করছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। জরীর ছোট বোন বাবার মাথার কাছে মুখ কাল করে বসে আছে। জরী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল— এত কষ্ট, এত কষ্ট। এত কষ্টের কোনো মানে হয়? কোন অর্থ হয়?

জরীর বাবা একবার চোখ তুলে তাকালেন। পরমুহুর্তেই চোখ বন্ধ করে আগের মতোই ছটফট করতে লাগলেন। জরীর মা ফিস ফিস করে বললেন জামাই-এর টেলিফোনের খবর শোনার পর শ্বাস কষ্ট শুরু হলো।

জরী এই ঘরে আর থাকতে পারছে না। এই কষ্ট দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব নয়। সে এগিয়ে এসে বাবার মাথায় হাত রাখল। তিনি চোখ মেললেন এবং জরীকে অবাক করে দিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। যেন মেয়েকে দেখে খুশি হয়েছেন।

জরী বলল, বাবা আমি ভালো আছি।

তিনি মাথা নাড়লেন।

মনে হচ্ছে তার কষ্ট খানিকটা কমে এসেছে। বুক আগের মতো উঠা নামা করছে না। ওষুধ দেয়া হয়েছিল সেই ওষুধ হয়ত বা কাজ করতে শুরু করেছে। শ্বাসনালীর প্রদাহ কমার দিকে। জরী আবার বলল, বাবা আমি ভালো আছি।

তিনি ইশারা করে সবাইকে চলে যেতে বললেন, এর অর্থ তার কষ্ট এখন সত্যি সত্যি কমার দিকে। কষ্টটা কমলেই তিনি ঘুমিয়ে পড়বেন। সম্ভবত তার ঘুম আসছে। সবাই ঘর খালি করে বের হয়ে এল।

 

জরীর বড় চাচা ইউসুফ সাহেব বসে আছেন থমথমে মুখে।

তার সামনেই জরীর মা এবং জরী।

কথাবার্তা এখনো শুরু হয় নি। ইউসুফ সাহেব চা খাচ্ছেন। কি বলবেন এবং কি ভাবে বলবেন তা হয়ত ঠিক করছেন। মেয়েটার শান্ত মুখের দিকে যতবার তাকাচ্ছেন ততবারই তাঁর রাগ উঠে যাচ্ছে। এতবড় ঘটনার পর মেয়েটা এ রকম শান্ত মুখে বসে আছে কি করে? সে ভাবে কি নিজেকে?

তিনি কিছু বলার আগেই জয়ী বলল, চাচা আমি ঐ লোকটাকে বিয়ে করব না।

ইউসুফ সাহেব জরীর সাহস ও স্পর্ধা দেখে চমকে গেলেন। তিনি রাগ সামলে নীচু গলায় বললেন, বিয়ে করবে, কি করবে না। এই কথা আমি জিজ্ঞেস করি নি। আগ বাড়িয়ে কথা বলছ কেন? কি ভাব নিজেকে? আমি যা জিজ্ঞেস করি তার জবাব দেবে। কি হয়েছিল যে তুমি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামলে?

জয়ী চুপ করে রইল।

তুমি যে ছেলেটাকে অপমান করলে তুমি এদের ক্ষমতা জান? এদের অর্থ বিত্তের খবর রাখ? সে কি করেছে যে তাকে গালাগালি করে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামবে। চিৎকার করে লোক জড় করবো?

আমি চিৎকার করে লোক জড় করি নি।

তুমি বলতে চাও সে মিথ্যা কথা বলছে? কথা বলছ না কেন? না-কি বলার মতো কথা পাচ্ছ না?

ইউসুফ সাহেব জরীকে তুই করে বলেন, আজ তুমি বলছেন। এতে রাগ প্রকাশ পাচ্ছে এবং দূরত্বও প্রকাশ পাচ্ছে।

শোন জরী, মনির সব কথাই আমাকে বলেছে। কিছুই গোপন করে নি।

কি বলেছে?

তোমার সঙ্গে এই নিয়ে ডিসকাস করা উচিত না। তবু তুমি যখন শুনতে চোচ্ছ তখন বলছি- সে তার ভাবি স্ত্রীর হাত ধরেছে— এটা এমন কি অপরাধ? আমি যতদূর জানি তোমরা ক্লাসের ছেলের হাত ধরাধরি করে হাঁট। তখন অপরাধ হয় না? তারা কি পরিমাণ রাগ করেছে তা-কি তুমি জান? মুনির টেলিফোনে কাঁদছিল। মুনিরের বাবা টেলিফোন করেছেন, মুনিরের এক মামা পুলিশের এ আই জি উনি টেলিফোন করেছেন। জিয়ার আমলে পাটমন্ত্রী ছিলেন যে ভদ্রলোক উনিও টেলিফোন করেছেন।

জরীর মা ক্ষীণ গলায় বললেন, এখন কি করা?

ইউসুফ সাহেব বললেন, এইটা নিয়েই চিন্তা করছি। মুনিরের বাবার সঙ্গে কথা হলো।

জরী বলল, কি কথা হলো?

তোমার তা শোনার দরকার নেই। তুমি ঘরে যাও।

জরী উঠে চলে গেল। ইউসুফ সাহেব বললেন, মুনিরের বাবা বলেছেন তারা কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিতে চান। দেরী করতে চান না, কারণ ছেলে খুব মন খারাপ করেছে।

জরীর মা বললেন, বিয়ের পর ওরা আমার মেয়েটাকে কষ্ট দিবে।

কষ্ট দিবে কি জন্যে? বিয়ে হয়ে গেলে সব সমস্যার সমাধান। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে কেউ কিছু মনে রাখবে না।

বিয়ে কখন হবে?

ওরা পঞ্জিকা টঞ্জিকা দেখছে। যদি দিন শুভ হয় আজ রাতেও হতে পারে।

এইসব কি বলছেন ভাইজান।

চিন্তা ভাবনা করেই বলছি। চিন্তা ভাবনা ছাড়া কাজ করা আমার স্বভাব না।

জরী যে কাণ্ড করেছে তারপর এ ছাড়া অন্য পথ নেই।

মেয়েটার মত নাই।

বাজে কথা বলবে না। মত নাই আগে বলল না কেন? এনগেজমেন্টের আগে বলতে পারল না? জরীকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। ওদের টেলিফোন আগে পাই ওরা যদি আজ রাতে বিয়ের কথা বলে তখন আমি জরীকে বুঝিয়ে বলব।

জরীর মা ক্ষীণ গলায় বললেন, আরো কয়েকটা দিন সময় দিলে মেয়েটা ঠাণ্ডা হত।

আমার মতে আর এক মুহুর্ত সময়ও দেয়া উচিত না। সময় দিলে ক্ষতি। বিরাট ক্ষতি। ওদের কিছু না, ক্ষতি আমাদের… ।

ইউসুফ সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই টেলিফোন এল। মুনিরুদিনের বাবা টেলিফোন করেছেন। সবার সাথে কথা টথা বলে ঠিক করেছেন-বিয়ে আজ রাতেই পড়ানো হবে। রাত দশটার মধ্যে বিয়ে পড়ানো হবে। এগারটার দিকে তারা বৌ নিয়ে চলে যাবেন। সামনের সপ্তাহে হোটেল সোনারগাঁয়ে রিসিপশন।

ইউসুফ সাহেব জরীর মাকে বললেন, তুমি তোমার গুণবতী মেয়েকে আমার কাছে পাঠাও।

ভাইজান একটা বিষয় যদি বিবেচনা করেন।

সব দিক বিবেচনা করা হয়েছে। বিবেচনার আর কিছু বাকি নেই।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ