রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতেই রাশেদ পুরোপুরি ভিজে গেল। বৃষ্টির পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। দমকা বাতাস। বাতাস পেছন দিক থেকে আসছে। তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। রাশেদের একবার মনে হল সে ফিরে যায়। হট সাওয়ার নিয়ে খেয়েদেয়ে কম্বল গায়ে শুয়ে থাকে। রূপাদের বাড়ি খুঁজে বের করা সমস্যা না। গাছপালায় ভর্তি বাড়ি। বাড়ির নাম রূপা। ফিরে গেলেই হয়, রূপা যদি জিজ্ঞেস করে, চলে গিয়েছিলেন কেন? তখন সত্যের মতো করে কিছু মিথ্যা বলতে হবে। যেমন হঠাৎ সিগারেট খাবার ইচ্ছা করল। ডিনারের শেষে সিগারেট খাব। এই জন্যেই সিগারেটের সন্ধানে গিয়েছিলাম। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়ব ভাবিনি।

রাশেদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মাথার ভেতরের লজিক অংশ বলছে ফিরে যাও। আবেগ অংশ বলছে না।

রূপার ওপর হঠাৎ রাগ উঠে যাওয়াতেই সমস্যা হয়েছে। এমন মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে, কি কোমল গলার স্বর, সে কি করে বলে, আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন না। তুমি বলার মতো ঘনিষ্ঠতা আপনার সঙ্গে আমার হয়নি। সে কি ভেবেছে ঘনিষ্ঠতা করার জন্যে তুমি বলা? মেয়েটিকে অনেকগুলি কারণে তুমি সে বলতে পারে। কারণগুলো ভাবতে ভাবতে হাঁটা যাক। কোনকিছু নিয়ে ব্রেইনকে ব্যস্ত রাখলে সে ঝড়-বৃষ্টি তুচ্ছ করবে। ক্ষিধের কষ্টও কমিয়ে দেবে। আচ্ছা এখন তুমি সমস্যা–

আমি বয়সে তোমার চেয়ে বড়। কাজেই তুমি বলেছি। এটা বড় কোনো অন্যায় না। অসৌজন্যমূলক কোনো আচরণও না। সামাজিকভাবে স্বীকৃত আচরণ ব্যবস্থা।

আমি যে দেশে বাস করছি সেখানে আপনি তুমি তুই নেই। সবাই তুমি। আমার ভুল সেখান থেকেও হতে পারে।

কোনো মানুষই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ না। সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক। তুমি আমার সঙ্গে অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করেছ। ভুল করে তোমার বাড়িতে উঠে পড়েছি জেনেও তুমি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বের করে দাওনি। বরং ঝড়-বৃষ্টিতে বের না হয়ে রাতে ডিনার করে থেকে যেতে বলেছ। কাজেই তোমার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়নি তা-না। ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এই ঘনিষ্ঠতার কারণে আমি তোমাকে তুমি বলতে পারি।

আচ্ছা ঠিক আছে ধরে নিলাম আমি তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করার জন্যে তুমি বলেছি। এতেই সমস্যা কি? মানুষের স্বভাব হচ্ছে ঘনিষ্ঠ হওয়া। দূরে সরে যাওয়া না।

রাশেদের হঠাৎ পা পিছলালো। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে উঠে দাড়াল। বিদেশের অচেনা পথঘাটে সাবধানে হাঁটতে হয়। বাংলাদেশ এখন তার কাছে বিদেশ। তার পাসপোর্ট আমেরিকান। তার অনেক সাবধানে হাঁটা উচিত ছিল।

ঠাণ্ডায় শরীরে কাঁপুনি উঠে গেছে। বুকে ঠা না বসলেই হল। তার লাংসে সমস্যা আছে। যে পরিমাণ রক্ত তার লাংসের পরিষ্কার করার কথা সে পরিমাণ করতে পারে না।

চারদিক জনশূন্য। এমন কিছু রতি হয়নি যে সব লোকজন ঘরে ঢুকে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ঝড়-বৃষ্টির দেশ। সামান্য দমকা বাতাসে শহরের পথঘাট জনশূন্য হবার কথা না। রাশেদ অন্যমনস্কভাবে কিছুদূর হাঁটল। রাস্তার মাথায় একটা চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে। চুলায় আগুন জ্বলছে। আগুন দেখা যাচ্ছে। দোকানি চাদর গায়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। দোকানির সঙ্গে ছয় সাত বছরের একটা ছেলে। সে একই চাদরের নিচে। সম্ভবত দোকানির ছেলে। রাশেদ এগিয়ে গেল।

শীতে তার শরীর কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে কটকট শব্দ হচ্ছে। রাশেদ বলল, আমাকে আগুন গরম এক কাপ চা খাওয়াতে পারবেন?

দোকানি বলল, পারব স্যার। ইশ আপনার কি অবস্থা!

পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।

আপনার কপাল কাটছে? রক্ত পড়তাছে।

পড়ুক রক্ত। আপনার দোকানে খাবার কি আছে? আমি খুব ক্ষুধার্ত। দুপুরে লাঞ্চে দিয়েছিল স্যালমন মাছ। মাছ খেতে পারি না বলে খাইনি। এখন ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি।

কেক আছে, খাবেন? কেক কিন্তু টাটকা না, বাসি।

কত দিনের বাসি?

এক হপ্তা।

কেক বাদ। আর কি আছে?

ডিম আছে। ডিম সিদ্ধ করে দিলে খাবেন?

হ্যাঁ খাব। থ্যাংক য়্যু।

আপনে বাইরে দাঁড়ায়া বিষ্টিতে ভিজতেছেন। ভিতরে আসেন। একটা গামছা দেই। মাথাটা মুছেন।

থ্যাংক য়্যু এগেইন। ভাই আপনার নাম কি?

সামছু।

সামছু আমি একটা জরুরি কথা বলতে ভুলে গেছি। আমার সঙ্গে বাংলাদেশি কোনো টাকা নেই। আমেরিকান টাকা আছে, ডলার।

স্যার টেকা পরে দিয়েন অসুবিধা নাই। আপনে কই মেলা দিছেন?

মেলা দিছেন মানে কি?

যান কই?

ভাল কোনো হোটেলে যাব। রাতটা হোটেলে থাকব।

সামছু চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। কেটলিতে দুটা ডিম ছেড়ে দিতে দিতে বলল, সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে স্যার? একটা সিগারেট দেই। টান দিলে শীতটা কমব।

সিগারেট খাই না।

স্যার গরিবের একটা কথা কি শুনবেন?

অবশ্যই শুনব।

ঢাকা শহর নষ্ট হয়ে গেছে, ছিনতাইকারী, মলম পার্টি, মরিচগুড়া পার্টি। এত রাইতে হোটেলে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেন।

রাতে থাকব কোথায়? আমার রাতে থাকার কোনো জায়গা নেই।

আমার এই দোকানে থাকবেন? আমরা বাপ-বেটায় রাইতে দোকানে থাকি। নয়া একটা লুঙ্গি খরিদ করেছি। সেলাই হয় নাই বইল্যা পরি নাই। লুঙ্গি পেঁচায়া শুইয়া পড়বেন। এক ঘুমে রাইত পার।

আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে এবং আনন্দের সঙ্গে আপনার দোকানে থাকব। এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আপনার দয়ার কথা সারাজীবন মনে রাখব।

সামছু জিভে কামড় দিয়ে বলল, স্যার কি যে কন। আমি গরিব মানুষ, আমার কি দয়া করার কোনো ক্ষমতা আছে? গরম পানি দেই সিনান করেন।

গরম পানি কোথায় পাবেন?

কেতলিতে গরম পানি বলক উঠতাছে। সিনান কইরা দোকানে উঠেন। তারপর খানা।

 

রাশেদের হট বাথের শখ ছিল সে আয়েশ করেই হট বাথ নিল। বালতিতে গরম পানি, মাথায় পড়ছে ঠাণ্ডা পানি। একইসঙ্গে হিমশীতল পানি এবং গরম পানির ধারা স্নান। খেতে বসেও চমক। খিচুড়ি সঙ্গে ডিমের ভর্তা। রাশেদ আনন্দিত গলায় বলল, খিচুড়ি কোথায় পেয়েছেন?

সামছু বলল, বাপ-বেটা না খায়া থাকব? খিচুড়ি সইন্ধ্যা ওয়াক্তে আমরা খাইছি। সকালের নাশতার জন্য কিছু ছিল সেইটা আপনারে দিলাম! খাইতে কি সোয়াদ হইছে স্যার?

অমৃতের মতো লাগছে। আপনাকে ধন্যবাদ।

আমারে খামাখা ধন্যবাদ দেন কি জন্যে? আল্লাপাক আপনের রিজিক রাখছে এইখানে, প্রত্যেকটা দানার মধ্যে আপনার নাম লেখা।

প্রতি দানায় আমার নাম লেখা?

জ্বে। যে দানায় নাম লেখা নাই সেই দানা মুখে দিতে পারবেন না। ভুলক্রমে মুখে দিলেও থু করে ফেলে দিতে হবে। আল্লাহ পাকের এমনই হিসাব।

 

দোকানে পাটিপাতা। তার উপরে পত্রিকার কাগজ বিছানো হয়েছে। সামছু বলল, কম্বলটা গায়ে দেন। গত বছর শীতের সময় দুইটা কম্বল পাইছিলাম। কমিশনার সাব দিছিলেন। রাতটা কষ্টমষ্ট কইরা পার করেন।

রাশেদ বলল, আমি খুব আনন্দ করে রাতটা পার করব।

সামছু বলল, আমার পুলা কিন্তু গাতক আছে।

গাতক কি?

সংগীত যে জানে তারে কয় গাতক। আপনেরে সরম পাইতেছে। সরম ভাঙলে গানে টান দিব। খুব ইচ্ছা ছিল তারে ক্ষুদে গান রাজ-এ দিব। ক্যামনে দিতে হয় জানি না বইল্যা পারলাম না।

ক্ষুদে গান কি?

টেলিভিশনে পুলাপানের গান। যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হয় তারা লাখ লাখ টেকা পায়, বাড়ি পায় তারপর ধরেন লন্ডন যায়, বিলাত যায়।

আপনার ছেলে কি ফাস্ট হওয়ার মতো গান গায়?

অবশ্যই। যদি না পায় তাইলে আমি একটা কান কাইট্যা আপনেরে দিয়া দিব। আপনে কুত্তারে দিয়া খাওয়ায় দিবেন। বাকি জীবন এক কান নিয়া ঘুরব। এই ওয়াদা করলাম।

রাশেদ বলল, খোকা শুনি একটা গান।

পামু না।

কেন না?

আমি আপনেরে সরমাই।

 

বৃষ্টির জোড় বেড়েছে। টিনের ছাদে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ। রাশেদ বলল, I am a blessed person no doubt of that, what an experience.

সামছু বলল, স্যার কি কইছেন বুঝি নাই।

বললাম, আমি একজন সুখী মানুষ।

সামছু বলল, অনেক বকর বকর করেছি। স্যার ঘুম দেন। মশা নাই। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে মশা আসে না। আর যদিও আসে মশার কয়েল দিয়া দিব।

বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে রাশেদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। ঘুমের মধ্যেই শুনল কে যেন গান করছে—

মানুষ ধর মানুষ ভজ শুন বলি এ পাগল মন।
মানুষের ভিতর মানুষ করিতেছে বিরাজন॥

সামছুর ছেলে গান করছে। সামছু একটু পর পর বলছে–সব্বাস ব্যাটা। সাব্বাস। স্যার ঘুমায়া পড়ছেন। স্যার জাগনা থাকলে পুরস্কার পাইতি।

স্বর্গের অপ্সরাদের আরেক নাম কিন্নর। কিন্নরদের আছে ত্রিকাল ভুলানি কণ্ঠ। হতদরিদ্র সামছুর মাতৃহারা শিশুটি পৃথিবীতে এসেছে কিন্নর কণ্ঠ নিয়ে। সেই কিন্নর কণ্ঠ প্রকাশিত হবার জন্যেই হয়ত বৃষ্টিস্নাত রজনিতে রাশেদের প্রয়োজন ছিল। প্রকৃতি রাশেদকে নিয়ে এসেছে কিন্নর কণ্ঠের কাছে। প্রকৃতি লীলাময়, তার লীলা বোঝা বড়ই কঠিন।

 

সামছু মিয়া খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে চুলা ধরাল। বৃদ্ধের দলের কেউ কেউ মর্নিং ওয়াকে যাবার সময় তার স্টলে চা খায়। দুধ চিনি ছাড়া লিকার চা, আদা চা এবং লেবু।

আজ কেউ আসবে না, এখনো বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ ঘন কালো। দীর্ঘ জীবন পিয়াসী বৃদ্ধের দল আজ এই বৃষ্টিতে বের হবে না। সকালের প্রথম ব্যবসা মার গেল।

রাশেদ জেগেছে। তার চোখ খোলা। সামছু বলল, ঘুম ভাল হইছে স্যার?

রাশেদ বলল, না। সারারাত আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছি।

স্বপ্ন কি দেখছেন?

জন্তুর মতো একটা কি যেন কামড়ে কামড়ে আমার পা খাচ্ছে। আমার প্যারালাইসিস। হাত পা নাড়াতে পারছি না। চিৎকার করে কাউকে ডাকতেও পারছি না। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না।

একটা মুরগি ছদকার ব্যবস্থা করেন স্যার।

মুরগির ছদকা ব্যাপারটা কি?

একটা মুরগি কিনবেন। গরিব মিসকিনরে দিয়া দিবেন। স্বপ্নের দোষ কাটা যাবে। স্যার চা খাবেন?

না। আমার ধারণা আমার জ্বর এসেছে। মুখ দিয়ে ভাপ বের হচ্ছে। আপনার কাছে থার্মোমিটার আছে? জ্বর মাপার যন্ত্র?

জ্বে না। আমরা গরিব মানুষ। মাথায় হাত দিয়া জ্বর মাপি।

আমার মাথায় হাত দিয়ে জ্বরটা মাপুন তো।

সামছু রাশেদের মাথায় হাত রাখল। রাশেদ বলল, জ্বর আছে?

আছে।

বেশি? জী বেশি। খুব বেশি।

আমার নিজেরও তাই ধারণা। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। জনু থেকেই আমার লাংসে কিছু সমস্যা আছে। আপনি কি আমাকে ভালো কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবেন?

অবশ্যই পারব।

ঢাকার সবচে বড় হাসপাতালের নাম কি?

সেটা তো স্যার জানি না।

সামছু লক্ষ করল মানুষটার চোখ লাল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মুখ থেকে শাঁ শাঁ শব্দ আসছে।

সামছু বলল, কি করি কিছুই তো বুঝতে পারতেছি না। স্যার পানি খাবেন?

না। বমি আসছে। আপনি একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পারবেন?

স্যার পারব। ডাক্তারের ভিজিট ক্যামনে দিব?

আমার কাছে ডলার আছে।

রাশেদ কথা শেষ করতে পারল না। বমি শুরু করল। বমির সঙ্গে রক্ত আসছে।

সামছু বলল, ইয়া খোদা এখন কি করি? বাবা কেনতু! এখন করবটা কি?

কেনতু বলল, ডাক্তার ডাক। দৌড় দেও।

সামছু দোকান থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ