আপনার নাম রূপা?

রূপা জবাব দিল না। একটু আগে সে একবার বলেছে তার নাম রূপা। দ্বিতীয়বার আবার নাম জানতে চাওয়া কেন? কিছু কিছু মানুষ আছে, একই প্রশ্ন কয়েকবার করতে ভালোবাসে। তার বাবার বন্ধু সুলতান চাচা এরকম একজন। একই কথা দুবার করে বলবেন, কেমন আছিস মা? কেমন আছিস মা? মুখটা শুকনা কেন? মুখটা শুকনা কেন? অত্যন্ত বিরক্তিকর ব্যাপার।

সোফায় যিনি বসে আছেন তাঁর সঙ্গে অবশ্যি সুলতান চাচার কোনো মিল নেই। সুলতান চাচা ভোতা চেহারার মানুষ। ইনি তা-না। কাটা কাটা চোখ মুখ। পাতলা ঠোঁট। গায়ের রঙ ফর্সা। ফর্সা একটু কম হলে ভাল হত। চোখ মেয়েলি ধরনের সুন্দর। চোখের পল্লব দীর্ঘ। রূপা মনে করার চেষ্টা করলকার লেখায় সে পড়েছে, তার দীর্ঘ আঁখি পল্লব সব সময় চোখে ছায়া ফেলে রাখে। মনে পড়ছে না।

রূপা বলল, আপনি কি চা খাবেন?

খাব।

চায়ে চিনি খান?

চিনি কেন খাব না?

রূপা বলল, অনেকেই চায়ে চিনি খায় না এই জন্যে জিজ্ঞেস করেছি। ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন।

তুমি কি আমার কথায় বিরক্ত হয়েছ?

রূপা তাকিয়ে রইল। তাকে লোকটা তুমি তুমি করে বলা শুরু করেছে। পাঁচ মিনিটের মাথায় আপনি থেকে তুমি। চোখে আঙ্গুল দিয়ে ব্যাপারটা কি বুঝিয়ে দেয়া যায় না? ভদ্রভাবে কাজটা কীভাবে করা যায়? রূপা যদি বলে, না তোর কথায় আমি বিরক্ত হই নি। তুই চুপ করে বসে থাক, আমি তোর জন্যে চা বানিয়ে আনছি। তাহলে সে বুঝবে। ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের কথা বলা সম্ভব না। রূপা রানাঘরের দিকে গেল।

রান্নাঘরের দুটা চুলার কোনটাই খালি নেই। রাতের খাবার রান্না হচ্ছে। রূপাদের কাজের মেয়ে মলিনা হাড়িতে চামুচ নাড়ছে। রূপা বলল, উনি চা খাবেন।

লোকটা কে আফা?

রাশেদ নাম। বাবার কাছে এসেছেন।

মলিনা বলল, লোকটার চেহারা কত সুন্দর দেখছেন আফা? আমি অবাক মানছি। রাজার কুমারের মতো চেহারা।

রূপা বলল, রাজার কুমার হলেই চেহারা সুন্দর হয় না। আফ্রিকার সব রাজকুমার কুচকুচে কালো মোটা ঠোঁট। মোটা নাক।

আফা, উনি বিদেশ থিক্যা আসছে?

হ্যাঁ।

কেমনে বুঝছি জানেন? যারা বিদেশ থাইক্যা আসে তারার স্যুটকেসের হাতায় কাগজ থাকে

রূপা বলল, মলিনা তুমি এত বেশি কথা বল যে মাঝে মাঝে আমার অসহ্য লাগে। ভাল করে দুকাপ চা বানাও।

এখন পারব না আফা। চুলা বন। চুলা খালি হোক চা বানায়া দিব। আপনে যান, উনার সাথে গফ করেন। আমি চা নিয়া আসতেছি। উনি কি রাইতে খাকবে?

জানি না। জিজ্ঞাস করেন। যদি থাকে গেস্টরুম ঠিক করা লাগবে। তিন আইটেম পাকাইছি। অতিথি থাকলে আইটেম বাড়াইতে হবে। ফিরিজে সরপুঁটি মাছ আছে। ড়ুবা তেলে ভাইজা দিব।

এত কথা বল কেন মলিনা?

আপনের সাথেই তো কথা বলি। ছাদে গিয়া অন্য বাড়ির কারো সাথে গফ করি না। আমার অত শখ নাই।

রূপা বসার ঘরে ঢুকল। রাশেদ নামের মানুষটা মেরুন কালারের বিশাল স্যুটকেস খুলে ঘাটাঘাটি করছে। মেয়েদের স্যুটকেসের রঙ হয় মেরুন। এই মানুষটার চোখ যেমন মেয়লি, রুচিত্ত মেয়েলি। স্যুটকেসের কিছু কাপড় মেঝেতে, কিছু সোফায়। রূপা বলল, দুটা মাই বন্ধ। চা দিতে সামান্য দেরি হবে।

চুলা বন্ধ মানে কি? গ্যাস আসছেন? আমি ঠিক করে দিতে পারি। আমার সঙ্গে টুল সেট আছে।

রূপা বলল, চুলা বন্ধ মানে দুটা বানরই এনগেজড। রাতের খাবার তৈরি হচ্ছে।

রাতে কি রান্না?

রূপা অনেক কষ্টে বিরক্তি চাপা দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, জানিনা কি রান্না।

আপনার খুব জানতে ইচ্ছে হলে মলিনাকে জিজ্ঞেস করে জেনে দিতে পারি।

মনিনা কে?

আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে।

তার সঙ্গেতে আমার দেখা হয়েছে। সে-ই দরজা খুলে দিয়েছে। এত মিষ্টি চেহারা। সে যে House Maid বুঝতে পারিনি। রূপা আমি তোমার জন্যে এক প্যাকেট চকলেট এনেছি। ব্রাজিলের চকলেট, একটু তিতকুট ভাব আছে।খেতে খুব ভাল।

থ্যাংক য়্যু।

তোমার নাম তাহলে রাপা!

হ্যাঁ। বারবার নাম জিজ্ঞেস করছেন কেন? নাম পছন্দ হচ্ছে না?

না।

সরি। বাবা আমার নাম রাখার সময় আপনার কথা চিম্বা করেন নি। আপনার কথা মাথায় থাকলে তিনি হয়ত অন্য নাম রাখতেন।

তুমি মনে হচ্ছে আমার কথায় রাগ করেছ। ঘটনা হচ্ছে, আমার সঙ্গে আন্ডার। গ্রাজুয়েটে রূপা ব্যানার্জি নামে এক মেয়ে পড়ত। মেয়েটা গাধা টাইপ ছাত্রী,ঔীষন পাজি। গাঁজা-টাজা খেত। সমস্যাটা এইখানেই।

কী সমস্যা?

তোমার নাম রূপ শোনার পর থেকে বারবার তোমার মধ্যে রূপার ছায়া চলে। আসছে।উচিত না, কিন্তু চলে আমছে।এই ফিলিংসের ইংরেজি একটা নাম আছে। নামটা মনে করতে পারছি না, সরি।

অকারণে সরি বললেন কেন?

তুমিই বা অকারণে রাগ করছ কেন? রূপা ব্যানার্জি অতি পাজি এক মেয়ে, সেই দোষ তো আমার না।

আমার নাম যে রূপা, এই দোষও আমার না। আমি আমার নিজের নাম রাখি নি।

রাশেদ বলল, সরি।

মলিনা ট্রেতে করে দুকাপ চা নিয়ে ঢুকল। রাশেদ বলল, মলিনা আরেক কাপ চা নিয়ে এসো, তিনজন মিলে চা খেতে খেতে গল্প করি। আর এই নাও, এই চকলেটের প্যাকেট তোমার জন্য।

মলিনা হতভম্ব হয়ে তাকালো রূপার দিকে। রূপা বলল, আমি চা খাব না। মলিনা তুমি আমার চা-টা খেতে খেতে উনার সঙ্গে গল্প কর। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে আসি।

রাশেদ অবাক হয়ে বলল, মলিনা তো আমাকে দরজা খোলার সময় বলেছে উনি রাজশাহী গেছেন।

রূপা বলল, রাজশাহীর মানুষের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা যায়। বাংলাদেশের টেলিফোন সার্ভিস যথেষ্ট উন্নত।

আরে তাই তো। সরি। রূপা দেখ তো এটা কি তোমার পছন্দ হয়?

জিনিসটা কি?

দেখতে অবিকল কলম। তাই না? আসলে ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার। দশ ফুট দূরের শব্দও সে রেকর্ড করবে। নিখুঁত সাউন্ড! ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ বাদ দেয়ার ব্যবস্থা আছে। নাও।

নিতান্ত অনিচ্ছায় রূপা হাত বাড়াল। নিতান্ত অপরিচিত কারো কাছ থেকে উপহার নেয়া যায় না। ভদ্রলোক তার বাবার পরিচিত। তাতে কি?

আরো অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস নিয়ে এসেছি। লাই ডিটেকটর। খেলনা ভাসান, তবে ভাল কাজ করে। মিথ্যা বললেই লাল বাতি জ্বলবে। পিপ পিপ শব্দ হবে। চা খেয়ে বের করে দিচ্ছি। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে এসো।

 

রূপার বাবা হারুনুর রশিদ, একটা প্রাইভেট কলেজে ইতিহাস পড়াতেন। দুবছর হলো রিটায়ার করেছেন। অবসর জীবনে তার দুটা কাজ। বঙ্গ ইতিকথা নামে একটা ইতিহাসের বই লেখা এবং পীর ফকিরের অনুসন্ধানে যাওয়া। রূপার ধারণা পীর ফকিরের অনুসন্ধান তার একটা উপলক্ষ। তিনি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন বলেই পীর ফকির। তাঁর মাথা সামান্য এলোমেলো। কারণ বঙ্গ ইতিকথা নামে যে বিশাল গ্রন্থ তিনি লিখছেন তার সবটাই কবিতার ছন্দে। সুলতানি আমলের লেখা এইভাবে শুরু করেছেন।

ছটফটে স্বভাব হলে ধৈর্য ধরুন
সুলতানি আমল কথা মন দিয়ে শুনুন।
১৩৪২ থেকে আমলে শুরু
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে মানা যাক গুরু।
বখতিয়ার খিলজিতে পূর্ণ হয় নাম
সুলতানি আমল কথা শুরু করিলাম॥

হারুন এখন আছেন রাজশাহীর বিরামপুরে। সেখানে মদিনা নামের একজনকে পেয়েছেন। মদিনার প্যারানরমাল ক্ষমতা দেখে তিনি মুগ্ধ। হারুনুর রশিদ অতি দ্রুত মুগ্ধ হন আবার তারচেয়েও দ্রুততায় তাঁর মুগ্ধতা ভাঙে।

রূপার টেলিফোন পেয়ে তিনি প্রথম কথা যেটা বললেন, তা হল, রূপা। মাই ডটার। অনেক দিনের চেষ্টার পর জেনুইন জিনিস পেলাম। বাংলাদেশ হয়েছে ফ্রন্ডের আখড়া। সব নকল। এই প্রথম আসল পেয়েছি। ঘটনা শোন।

রূপা বলল, আগে আমার কথা শোন, তারপর তোমার আসল জিনিসের কথা শুনব।

না না শোন, আমি এত এক্সাইটেড যে আমি আমার পেটের কথা না বললে তোর কথা শুনতেই পারব না। মন বসবে না।

আচ্ছা বল।

রাজশাহীর একটা লোকাল নিউজ পেপারে প্রথম খবরটা পড়লাম। খবরের হেডিং–ঘড়ি-কন্যা। মূল বিষয়, ঘড়ি-কন্যা ঘড়ি না দেখে টাইম বলতে পারে। মনে কর কেউ গেল মদিনার কাছে। সে বলল, মদিনা! আমার ঘড়িতে কয়টা বাজে? মদিনা সঙ্গে সঙ্গে টাইম বলে দেবে। আমি চিন্তা করলাম মেয়েটার কাছে লুকানো ঘড়ি থাকতে পারে। হয়ত জামার আড়ালে এমনভাবে রাখী যে সে শুধু দেখতে পায়। অন্যরা পায় না। আমি করলাম কি নিজের ঘড়ি পঁয়তাল্লিশ মিনিট পিছিয়ে রাখলাম। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম–সে হুবহু বলে দিল। এক মিনিট এদিক ওদিক হল না। অদ্ভুত না?

অদ্ভুত। প্যারানরমাল ক্ষমতা নিয়ে অনেক মানুষ জন্মায় আমরা তার খবর রাখি। এই নিয়ে বিখ্যাত কবিতা আছে

Full many a flower is born to blush unseen
And washed its sweetness in the desert air.

রূপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা তোমার কথা মন দিয়ে শুনলাম। এখন আমার কথা শোন, রাশেদ সাহেব এসেছেন।

রাশেদ সাহেব কে?

জানি না কে।

আরে গর্দভ মেয়ে জিজ্ঞেস করবি না? আপনি কে? আপনার পরিচয় কি? কি করেন?

বাবা আমি কোর্টের উকিল না। জেরা করতে পারি না। ভদ্রলোক বলেছেন তুমি তাকে খুব ভাল করে চেন। বেশ কয়েকবার টেলিফোনে তার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?

হারুন বললেন, রাশেদ নামের একজনকেই আমি চিনি। সে চিটাগাংয়ে থাকে। কাঠের দোকান আছে। চেড়াইকল আছে। কাঠের গুতা খেয়ে তার একটা চোখ নষ্ট হয়েছে বলে সবাই তাকে ডাকে কানা রাশেদ। আমেরিকার কোনো রাশেদের সঙ্গে আমার কথা হয় নাই।

বল কি?

আমার তো মনে হচ্ছে বাজে মতলব নিয়ে কেউ ঢুকেছে। ঢাকা শহরে এরকম আজকাল হচ্ছে। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ঢুকে সর্বনাশ করে চলে যাচ্ছে। খুন-খারাবি পর্যন্ত হচ্ছে। আজকের পেপারেই তো আছে। গাধা মেয়ে, খবরের কাগজ পড়িস না। ঘুম ভাঙ্গার পর প্রথম কাজ খবরের কাগজ পড়া।

তুই বুঝতে পারছিস না যে ভয়ঙ্কর কেউ ঢুকেছে?

আমার সেরকম মনে হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে উনি ভুল করে এ বাড়িতে এসেছেন।

এক্ষুণি বিদায় কর।

উনি চা খাচ্ছেন। চা খাওয়া হোক তারপর বলব।

চা খাচ্ছে মানে কি? তাকে তো ঘরেই ঢুকতে দেয়া ঠিক হয় নাই। গেট থেকে বিদায় করে দেয়া উচিত ছিল। দারোয়ান একটাকে রেখেছি গাধার গাধা। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আন ওয়ান্টেড লোকজন কোলে করে এনে সোফায় বসিয়ে দিয়ে যাবে। আর তুইও এমনি অতিথিপরায়ণ, কিছু জিজ্ঞেস না করেই চা-কফি-কেক-পেস্ট্রি।

বাবা! তুমি উত্তেজিত হয়ো না। আমি ব্যবস্থা করছি।

ব্যবস্থা করাকরির কিছু নাই। তুই তাকে বলবি, আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন। Now get fost. বিদায় হবার পর আমাকে টেলিফোনে জানাবি যে বিদেয় হয়েছে। আমি দুই রাকাত শুকরানা নামাজ পড়ব।

বসার ঘর ফাঁকা। মলিনার হাতে চায়ের ট্রে। সে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। রূপা বলল, উনি কোথায়?

মলিনা বলল, ঘুমাইতাছে! গেস্টরুম খুইল্যা দিলাম। সাথে সাথে বিছানায় শুইয়া ঘুম। আমারে বলেছেন খাওয়ার সময় ডাক দিতে। আগে ডাক দিলে আমার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা। কি শাস্তি দিব কে জানে। কি সুন্দর কইরা বলছে–ডাকলে শাস্তি।

রূপা বলল, শাস্তি দিলে দিবেন। এক্ষুণি ডাক। উনি ভুল বাড়িতে এসেছেন।

কি কন আপা?

ডেকে তোল। তোমাকে যে চকলেটের প্যাকেট দিয়েছে সেটা ফিরত দাও।

মলিনা বলল, সর্বনাশ প্যাকেট খুইল্যা তিনটা চকলেট খায়া ফেলছি। খেয়ে ফেলেছ ভাল করেছ। এখন উনাকে ডেকে তোল।

মলিনা চিন্তিত মুখে গেস্টরুমে ঢুকল। পেছনে পেছনে গেল রূপা। রাশেদ মরার মতো ঘুমাচ্ছে। অনেক ডাকাডাকির পর চোখ খুলল। তার চোখ টকটকে লাল। দৃষ্টি এলোমেলো। রূপা বলল, আপনি ঠিকানা ভুল করেছেন। বাবা আপনাকে চেনেন না। তার সঙ্গে আপনার কথাও হয় নি। তিনি একজন রাশেদকেই চেনেন যার একটা চোখ নষ্ট। সবাই তাকে ডাকে কানা রাশেদ।

ও আচ্ছা।

রূপা বলল, আমি দারোয়ানকে বলছি সে একটা সিএনজি এনে দেবে। আপনি সিএনজি নিয়ে চলে যাবেন।

সিএনজি কি?

সিএনজি হল ইয়েলো ক্যাব। গ্যাসে চলে। Concentrated Natural Gas, CNG.

ও আচ্ছা।

ও আচ্ছা বলেই রাশেদ আবার বিছানায় শুয়ে চোখ বুজল। মলিনা বলল, আফা উনারে জাগানি অসম্ভব। দেখেন না কি ঘুম ঘুমাইতাছে।

রূপা বলল, কিছুক্ষণ পর আবার ডাক।

রাইতে খাওয়ার সময় ডাকি আফা? খাওয়া দাওয়া কইরা চইলা যাবে। জিগাইতেছিল রাইতে রান্ধা কি? বিদেশ থাকে। দেশি খানা খায় না। আমি বললাম, মুরগির সালুন করেছি, বেগুন ভর্তা, আলু ভর্তা, মাষের ডাল, সরপুঁটি ভাজি।

মলিনা কথা বন্ধ। আরেকবার ডাক।

মলিনা কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করল। রাশেদ চোখ মেলে আবারও চোখ বন্ধ করল। মলিনা বলল, ভাইজানরে এখন হাতি দিয়া টাইন্যাও তুলতে পারবেন না।

এর মধ্যে ভাইজান পাতিয়ে ফেলেছ?

আমি তো উনারে রাশেদ বইল্যা ডাক পাড়তে পারি না। ভাইজান ছাড়া উপায় কি?

তুমি যেভাবেই পার তোমার ভাইজানকে ডেকে তোল। প্রয়োজনে গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দাও।

দশটা মিনিট পরে পানি ঢালি আপা? আরামের ঘুম দিছে মায়া লাগে। ঘুমন্ত মানুষরে জোর কইরা তুলতে নাই। যে তোলে তার শইল কাঁপানি রোগ হয়।

শইল কাঁপানি রোগ কি?

ঘুমের মধ্যে শইলে ঝুঁকির মতো হয়।

অদ্ভুত অদ্ভুত কথা কোথায় পাও?

মলিনা বলল, আপনি আপনার ঘরে যান। এক ঘণ্টা পরে আসেন দেখবেন সব কিলিয়ার। আমি নিজে সিএনজিতে তুইল্যা বলব–ভাগ।

একটু আগে বলেছ দশ মিনিট। এখন বলছ এক ঘণ্টা।

হাতে কিছু সময় রাইখা বলছি। উনার জিনিসপত্র গুছাইতেও সময় লাগব। দেখেন কি করছে, দুইটা সুটকেসের সব জিনিস বাইর করছে। ঐ যে হইলদা জিনিসটা দেখতেছেন, এইটা মিথ্যা যন্ত্র। এই যন্ত্রে মিথ্যা বললে ধরা খাইতে হয়। লাল বাতি জ্বলে। পিপ পিপ শব্দ হয়।

রূপা বলল, উনি আমাকে এক প্যাকেট চকলেট অরি ভয়েস রেকর্ডার দিয়েছেন। তোমাকে দিচ্ছি তুমি উনাকে ফেরত দেবে। আমি নিজের ঘরে এক ঘণ্টা থাকব। এর মধ্যে তুমি সব ব্যবস্থা করবে। যাবার সময় উনি যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, তুমি বলবে আপার জ্বর এসেছে। আপা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন।

মিথ্যা কথা বলব? উনি যন্ত্রপাতি নিয়া আসছে। মিথ্যা বললে কোন বিপদ জানি হয়।

রূপা জবাব না দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। এখানে যতক্ষণ থাকবে মলিনার বকবকানি শুনতে হবে। মেয়েটা নন-স্টপ কথা বলতে পারে। রূপার ধারণা সুযোগ দিলেই মলিনা এক নাগারে কথা বলার একটা বিশ্ব রেকর্ড করে গিনিজ বুকে নাম তুলে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের কাজের মেয়ে বলে সুযোগটা সে পাচ্ছে না।

 

দোতলায় রূপাদের তিনটা কামরা। একটায় তার বাবা থাকেন। সেটা সবচে ছোট। বড় ঘরে তার নাকি ফাপড় লাগে। ঘুম ভাঙলে মনে হয় মাঠে শুয়ে আছেন। তার ধারণী শোবার ঘর এমন হবে যে বিছানায় শুয়ে সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। বুকশেলফ, টেবিল, ওয়ারড্রোব সব থাকবে বিছানার সঙ্গে লাগানো।

দোতলার বিশাল সাইজের দুটা ঘরই রূপার। একটাকে রূপা ছবি আঁকার স্টুডিও বানিয়েছে। এই ঘরের ছোট দুটা জানালা ভেঙে বড় একটা জানালা করা হয়েছে। ঘরে প্রচুর আলো আসে। এই ঘরের সঙ্গে টেরাসের মতো আছে। টেরাসে সুন্দর বাগান। এক কোনায় বিশাল চৌবাচ্চা বানানো হয়েছে হারুন সাহেবের উৎসাহে। সেখানে দেশী মাছ ছাড়া হয়েছে, শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া মাছগুলি আনন্দে আছে। হারুন চৌবাচ্চা আরো বড় করে সেখানে গলদা চিংড়ি চাষের চেষ্টা করার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। রূপা রাজি হচ্ছে না। সে বলেছে বাড়ির ছাদে পুকুর বানানোর কিছু নেই। ছাদ হচ্ছে সুন্দর বেড়ানোর একটা জায়গা। সেখানে মাছ চাষ করতে হবে কেন?

হারুন বলেছেন, মাছ কি অসুন্দর?

মাছ অসুন্দর না। চৌবাচ্চা থেকে ছিপ দিয়ে তোমার মাছ ধরাটা অসুন্দর।

অসুন্দরকে বাদ দিয়ে সুন্দর হয়? বাবা তোমার সঙ্গে আমি বাজে তর্কে যাব না। যাবি না কেন?

কোনো একটা তর্কে গেলেই তুমি টিচার ভাব ধরে ফেল। ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছ এরকম ভঙ্গি। আর আমি যেন তোমার ছাত্রী। তাও বুদ্ধিমান কোনো ছাত্রী না। বোকা ছাত্রী।

রূপা যদিও বলে মাছের চৌবাচ্চা তার খুব অপছন্দ, ঘটনা তা না। সে চৌবাচ্চার পাশে বসে মাছ দেখে অনেকটা সময় কাটায়। গত মাসে মাছের একটা জল-রঙ ছবি এঁকেছে। ছবিতে একটা ড়ুবন্ত মাছের গায়ে আলো পড়েছে। ছবির নাম–জনে মীন রাশি। পুরো ছবিতে একটাই রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। নীল রঙের নানান শেড।

হারুন ছবি দেখে বলেছেন, নামের অর্থ কি? জন্মে মীন রাশি বলতে তুই কি বুঝাচ্ছিস?

ছবিটা দেখে তোমার কেমন লাগছে সেটা বল। নাম কোনো ব্যাপার না।

হারুন বললেন, দর্শক নামের সঙ্গে ছবি রিলেট করবে। নাম ব্যাপার হবে না কেন? মনে কর আমি একটা গোলাপের ছবি এঁকে ছবির নাম দিলাম হংস ডিম্ব! তার কোনো অর্থ হবে?

বাবা! ধরে নাও ছবিটার কোনো নাম নেই। এখন বল ছবি কেমন লাগছে।

হারুন গম্ভীর গলায় বললেন, ছবি দেখে মনে হচ্ছে পেইন্টারের কাছে নীল রঙের একটা টিউবই ছিল। সে তা দিয়েই ছবি আঁকার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা খুব যে সফল হয়েছে তাও না।

বাবা তুমি ইতিহাস বুঝ, ছবি বুঝ না।

সেটাই তো স্বাভাবিক রে মা। তোরা যারা ছবি আঁকিস তারা ছবি বুঝবি। ইতিহাস বুঝবি না।

বাবা, আমি ওয়াটার কালারে গোল্ড মেডেল পাওয়া মেয়ে।

ক্রিয়েটিভ ক্ষেত্রে গোল্ড মেডেল কোনো কাজের কথা না। পিকাসো কখনো গোল্ড মেডেল পান নি। জয়নুল আবেদিন কোলকাতা আর্ট স্কুল থেকে পাস করেছিলেন। তার রেজাল্ট ভাল ছিল না। পাকিস্তানের ওরিয়েন্টাল পেইন্টার আবদুর রহমান চুঘতাই আর্ট কলেজের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন।

বক্তৃতা বন্ধ কর বাবা।

শেষ কথাটা শোন Louvre Museum-এ ভারতবর্ষের মাত্র একজন পেইন্টারের ছবি আছে। তিনি কখনো আর্ট স্কুলে বা কলেজে পড়েন নি। তার নাম জানতে চাস?

না।

জেনারেল নলেজ বাড়াবি না?

না।

তার নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের কে হন সেটা বল।

আমি জানি না। দয়া করে এখন চুপ কর।

আচ্ছা যা চুপ করলাম। জন্মে মীন রাশি নিয়ে মন খারাপ করিস না। যখন ভাল ছবি আঁকবি আমিই প্রথম বলব।

তোমার কিছু বলার দরকার নেই। রূপা বসে আছে চৌবাচ্চার দক্ষিণ দিকে। আকাশে মেঘ জমছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চৌবাচ্চার পানিতে বিদ্যুৎ চমকের প্রতিবিম্ব পড়ার সঙ্গে মাছদের জগতে এক ধরনের আলোড়ন তৈরি হচ্ছে। রূপার দেখতে মজা লাগছে। মাছরা ভয় পাচ্ছে। সবচে বেশি ভয় পাচ্ছে তেলাপিয়াগুলি। বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে সঙ্গে এরা লাফিয়ে পানি থেকে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। একটা মাছ তো রূপার কোলে এসে পড়তে পড়তে পড়ে নি।

 

রূপাদের দোতলা বাড়িটা কলাবাগানের ভেতরের দিকে। তাদের বাড়ির পাশ দিয়েই ভূতের গলি গিয়েছে। রূপার দাদা এক বিঘা জমিতে ছোট্ট একটা দোতলা বাড়ি বানিয়ে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ভূতের বাড়ি। তিনি বৃক্ষপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। বাড়ি ঘিরে নানান ধরনের গাছপালা লাগিয়েছিলেন।

ভূতের বাড়ি নামকরণের জন্যেই কি-না কে জানে এই বাড়িতে ভূতের খুব উপদ্রপ শুরু হয়। নিশিরাতে ছাদে নূপুর পায়ে হাঁটার শব্দ। ঝড় নেই, বাতাস নেই, আপনাআপনি জানালা বন্ধ হচ্ছে, খুলছে। রান্নাঘরের মিটসেফের সব খাবার দেখা যায় রান্নাঘরময় ছড়ানাে।

রূপার দাদা হাজী শরিফউদ্দিন নিজেও একদিন ভূতের হাতে পড়লেন। রাতে বাথরুমে গিয়েছেন। তারপর আর বাথরুম থেকে বের হতে পারেন না। দরজা খুলে না। তিনি ছিলেন দোতলায় একা। এক তলায় একজন দারােয়ান আর রান্নার ছেলে। শরিফউদ্দিন চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছেন। কেউ শুনছে না।

দরজা খুলল ফজরের আযানের পর। শরিফউদ্দিন বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে গেলেন। ভূতের বাড়ি পরিত্যক্ত হয়ে গেল।

রূপার জন্মের পর বাড়ির নাম বদলে হারুন বসবাস শুরু করলেন। বাড়ির নতুন নাম হল রূপা। রূপার ধারণা তাদের বাড়িতে এখনাে ভূত আছে তবে ভূতদের আগের সেই ক্ষমতা নেই। আশেপাশে বিশাল সব অ্যাপার্টমেন্ট হাউস হওয়ায় তারা কোনঠাসা হয়ে আছে।

বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। রূপা দোতলা থেকে একতলায় নামল। মলিনার সঙ্গে সিঁড়ির গােড়াতেই দেখা। মলিনা বলল, আফা খানা লাগামু?

উনি বিদায় হয়েছেন?

জ্বে না। একবার আমারে বললেন, ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও। পানি দিলাম। পানি খাইয়া আবার ঘুম। আমারে বললেন, তােমার নাম মলিনা, অর্থাৎ মলিন। নামটা সুন্দর না। এখন থেকে আমি তােমাকে ডাকব মলি। আমি বললাম, ভাইজান আপনের যা মনে চায় ডাকবেন। আমার কোনাে সমস্যা নাই। আমারে মহারানী ডাকলেও যা, মরনি ডাকলেও তা।

রূপা বলল, তুমি কি তাকে বলেছ যে উনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন ?

বলার সুযোগ কই পাইলাম আফা। উনি আছেন ঘুমের মধ্যে। আমারে বলেছেন প্লেইনে উঠলে কি জানি হয়। তখন খালি ঘুম ধরে। দুই তিন দিন সমানে ঘুমাইতে হয়। আজব ব্যাপার না আফা? আল্লাহ বাচাইছে যে আমি কোন দিন প্লেইনে উঠি নাই।

 

হারুন আবার টেলিফোন করেছেন। তাঁর উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেল।

ব্যাটা বিয়ে হয়েছে?

না।

কেন? কি করছে?

ঘুমাচ্ছে।

রূপা! তুই ঠিক করে বল তো সমস্যা কি?

আমি তেমন কোনো সমস্যা দেখছি না। জেট লেগের ধাক্কায় পড়ে ঘুম দিয়েছে। তার ঘুম ভাঙানো যাচ্ছে না।

আমি টেলিফোন ধরে আছি–যা থাপ্পড় দিয়ে ঘুম ভাঙ্গা। কষে থাপ্পড় দিবি যেন আমি টেলিফোনে থাপ্পড়ের শব্দ শুনতে পাই।

বাবা অস্থির হয়ো না।

অজানা অচেনা একজন ট্রেসপাস করেছে আমি অস্থির হব না?

না। কারণ এতদূর থেকে অস্থির হয়ে তুমি কিছু করতে পারবে না। যে ট্রেসপাস করেছে সে কোনো সন্ত্রাসী না।

বুঝলি কি করে?

চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছি।

চোখের ডাক্তার হয়ে গেছিস? ফাজিল মেয়ে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, এর মধ্যে যন্ত্রণা বিদায় করবি। পাঁচ মিনিট পর আবার টেলিফোন করব।

বাবা, তোমার ঐ আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর মেয়ের বিষয়ে একটা কথা জানতে চাচ্ছি। তোমার রাগ একটু কমিয়ে প্রশ্নের জবাব দাও।

কি জানতে চাস?

মনে কর তুমি মদিনার কাছে গেলে। তোমার হাতে হাতঘড়ি সেখানে বাজে বঁটা, পকেটে আছে পকেট ঘড়ি। তার টাইম সেট করা হয়েছে আটটায়। তোমার সঙ্গের মোবাইল টেলিফোনের ঘড়িতে নয়টা। এখন মদিনা কোন সময়টা বলবে?

এই পরীক্ষা তো করি নি। ইন্টারেস্টিং পরীক্ষা।

বাবা! তুমি ইন্টারেস্টিং ঘড়ি পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাক। এখানে কি হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।

মেয়েদের বুদ্ধি কাজে লাগে না।

বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারলেই কাজে লাগে। বেশির ভাগ মানুষ কাজে লাগাতে পারে না। বাবা টেলিফোন রাখি ঐ লোকের ঘুম মনে হয় ভেঙেছে।

রাশেদ গেস্টরুম থেকে বসার ঘরে এসেছে। রূপাকে দেখে বলল, আপনি বললে হয়ত বিশ্বাস করবেন না, আমার জীবনটা ভুলে ভর্তি। ছোটখাটো ভুল না। বড় বড় ভুল। আপনি যখন বললেন, আপনার নাম রূপা তখনই আমার বুঝা উচিত ছিল, যে ঠিকানায় আমার যাবার কথা সে বাড়ির মেয়েটির নাম রুনা। রুনার সঙ্গেও আমার কথা হয়েছিল। একবার না অনেক বার। যাই হোক, আমি তিন মিনিটের মধ্যে বিদায় হচ্ছি।

রূপা বলল, এখন রাত দশটা চল্লিশ। বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। এই অবস্থায় বের হবেন এবং ভুল করে আবারও অন্য একটা বাড়িতে উঠবেন। সেই বাড়ির মেয়ের নাম হয়ত রুমা। তাকে ব্রাজিলের চকলেট দেবেন, ভয়েস রেকর্ডার দেবেন। এটা ঠিক হবে?

আমি হোটেলে উঠব। দিনে ঠিকানা খুঁজে বের করব।

যাদের কাছে যাচ্ছেন তাদের টেলিফোন নাম্বার নিশ্চয়ই আছে। তাদের টেলিফোন করে দিন তারা এসে আপনাকে নিয়ে যাক।

টেলিফোন বুক আনতে ভুলে গেছি।

ভাল করেছেন। আসুন খেতে বসি। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে যাবেন।

থ্যাংক য়্যু। তুমি খুবই ভাল মেয়ে।

আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন না। তুমি বলার মত ঘনিষ্ঠতা আপনার সঙ্গে আমার হয় নি।

সরি।

যান হাত মুখ ধুয়ে আসুন। আমরা ডিনার করি। ক্ষিধে লেগেছে না?

হুঁ।

রূপা খাবার টেবিলের দিকে রওনা হল। তার মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করেছে। হারুন টেলিফোন করেছেন। রূপা ধরল না। খাওয়া-দাওয়া শেষ হোক তারপর বাবাকে সব জানানো যাবে।

মলিনা শুকনা মুখে খাবার ঘরে ঢুকে বলল, আফা উনি তো চলে গেছেন। জিনিসপত্র সব ফালায় ধুইয়া বৃষ্টির মধ্যে রওনা।

সে কি!

আমি বললাম, বৃষ্টির মধ্যে যান কই? উনি বললেন, হোটেলে। তারপর ইংরেজিতে কি যেন বললেন। মনে হয় ভাবছেন আমি ইংরেজি জানি। আমিও ভাব ধরলাম ইংরেজি জানি। আমি বললাম, ইয়েস। ইয়েস।

রূপা বলল, কথা বন্ধ করে খাবার দাও। আগে মোমবাতি জ্বালাও। যে রকম ঝড়-তুফান হচ্ছে এক্ষুণি কারেন্ট চলে যাবে।

কারেন্ট গেল মোমবাতি জ্বালানোর পর। রূপা টেলিফোন করল তার বাবাকে।

বাবা, ঢাকায় ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে–তোমার দিকের খবর বি কি হচ্ছে।

না। ঐ লোক কি গেছে?

হ্যাঁ বাবা, চলে গেছে। তুমি শোকরানা নামাজ পড়তে পার।

ভেরি গুড। আমি তো টেনশানে পড়ে গিয়েছিলাম

ভদ্রলোক তিনটা স্যুটকেস ফেলে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নেমেছে। রাস্তাঘাট কিছুই চিনে না, কোথায় যাবে কে জানে। হয়ত মলম পার্টির হাতে পড়বে মলম পার্টি চোখে মলম ডলে মানিব্যাগ নিয়ে চলে যাবে। কিংবা ক্ষুর পার্টির হাতে পড়বে। তারা পেটে ক্ষুর বসাবে। রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে।

এত রাতে ছাড়লি কেন?

বাবা! তোমার কি এখন মায়া লাগছে।

হারুন চুপ করে রইলেন। রূপা বলল, তোমার মায়া লাগছে তার কারণ কি জান বাবা? তার কারণ লোকটা তার সবকিছু ফেলে গেছে। জিনিসপত্র সব নিয়ে গেলে মায়া লাগত না। এই লোক কিন্তু তার জিনিসপত্র নিতে ফিরে আসবে না।

কীভাবে জানিস ফিরে আসবে না।

তুমি তো প্যারানরমাল ক্ষমতাধর মানুষের খোঁজে সারা দেশ ঘুরে বেড়াও, তোমার নিজের মেয়েরই যে এই ক্ষমতা আছে তা জান না। বাবা রাখি? প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে।

কি রান্না করেছে?

জানি না কি রান্না করেছে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আর ভাল লাগছে

রূপা লাইন কেটে দিল। হারুন লাইন কাটার পরেও হ্যালো হ্যালো করতে লাগলেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ