আমার অপারেশনের ডেট দিয়েছে। বুধবার সকাল নটা। যে প্রফেসর অপারেশন করবেন, তিনি এক দিন দেখা করতে এলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, কি ভাই, কেমন আছেন?

ভালেই আছি।

ভয় লাগছে নাকি?

জ্বি-না।

দ্যাটস ভেরি গুড। আচ্ছা, আমি কি আপনাকে ঐ গল্পটা বলেছিলাম?–ঐ যে অপারেশন টেবিলে এক রুগী ভয়ে অস্থির। সে বলল, ডাক্তার সাহেব এটা আমার প্রথম অপারেশন

জ্বি, এই গল্পটা বলেছেন।

এই দেখেন, একই গল্প আমি দু বার তিন বার করে বলি। আরেকটা শোনেন, হাতির পেটে অপারেশন হবে। যন্ত্রপাতি সব পেট কেটে ভেতরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। দু জন নার্স ঢুকেছে পেটে। ডাক্তার সাহেব অপারেশন শেষ করে স্টি করবার পর আতকে উঠে বলেন–আরে নার্স দু জন কোথায়?

আমি হাসলাম। ডাক্তার সাহেবও প্রাণ খুলে হাসলেন। বেশ লাগল ভদ্রলোকে। আমি বললাম, ডাক্তার সাহেব, আপনি কি সব রুগীর সাথে অপারেশনের আগে দেখা করেন?

হা, করি।

কেন?

রুগীরা সাহস পায়। আমি নিজেও কেন জানি সাহস পাই। আসলে আমি এক জন ভীতু মানুষ। সার্জারি পড়াটা আমার ঠিক হয় নি।

তিনি আবার ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন। বেশ মানুষ। আমার পাশের বেডের নতুন রুগী বার-তের বছরের একটি বাচ্চা ছেলে। সেও ডাক্তার সাহেবের সাথে হাসল। ডাক্তার সাহেব বললেন, তোমার নামি কি খোকা?

টগর।

টগর আবার কি রকম নাম?

ফুলের নাম।

ফুলের নাম তো হয় মেয়েদের। বকুল, কদম, পারুল। ফুলের নামে ছেলেদের নাম হওয়া উচিত না। ছেলেদের নাম হওয়া উচিত ফলের নামে, যেমন–আপেল, কলা হা হা হা।

টগর খুব হাসল। এই ছেলেটিও জুবায়ের সাহেবের মত। হাসে না। কথা বলে না। সব সময় মুখ কালো করে বসে থাকে। আনন্দমেলার পাতা ওল্টায়।

ছেলেটির মা নেই বোধ হয়। তার বড়োবোন রোজ আসে এবং ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। চমৎকার একটি দৃশ্য। টগর বড়ো লজ্জা পায়। আড়চোখে বারবার তাকায় আমার দিকে। আমি ভান করি, যেন কিছু দেখছি না।

রাতের বেলা সে প্রায়ই ফিসফিস করে আমাকে ডাকে। আমি যদি বলি, কি? সে সাড়া দেয় না। বড় লাজুক ছেলে।

আমি তাকে জুবায়ের সাহেবের কথা বলি। তিনি কেমন ভয় পেয়েছিলেন। ভোরবেলা যখন তাঁকে নিতে আসে তখন কেমন কাঁদতে শুরু করেন। কিন্তু কী অদ্ভুত ভাবেই না হাসিমুখে ঘরে ফিরে যান। ছেলেটি এই গল্প বারবার শুনতে চায়। এটি এমন গল্প, যা কখনো পুরনো হবে না।

টগর চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ওনার অসুখ পুরোপুরি সেরে গেছে?

হ্যাঁ, এবং তোমার সারবে।

কেমন করে জানেন?

জানি। জানি।

কেমন করে জানেন, সেটা বলেন।

তা বলব না। এটা একটা গোপন কথা।

সে হাসে। সম্ভবত আমার কথা বিশ্বাস করে। শিশুরা সব কিছুই বিশ্বাস করে।

 

অপারেশনের দু দিন আগে বড়োভাই দেখা করতে এলেন, তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। হাতে আপেলের একটা প্যাকেট।

কি রে, কেমন আছিস?

ভালো।

এত বড়ো একটা ব্যাপার, তুই আমাকে মুখের কথাটা বললি না?

বলতে গিয়েছিলাম। আপনাকে পাই নি, চিঠি তো দিয়েছি।

আমার উপর সবার রাগ। এর কারণটা তো আমার জানা দরকার।

রাগ হবে কেন?

বড়োভাই গভীর গলায় বললেন, সংসারের জন্যে কি আমি কিছু করি নি? অনুর বিয়ের খরচ কে দিয়েছে?

আপনি দিয়েছেন, আর কে দেবে?

তোর আই. এ. পরীক্ষার ফিস? কলেজের বেতন? আমি এই সব দিই নি?

হ্যাঁ, দিয়েছেন।

এখন তো প্রতি মাসের তিন তারিখে বাবা এসে আমার কাছ থেকে এক শ টাকা নিয়ে যান হাতখরচ। নেন না?

এটা আমি জানতাম না। বাবার কথাবার্তায় কখনো প্রকাশ পায় নি। বড়োভাই নিচু স্বরে বললেন, অনেক কিছু আমার করার দরকার ছিল, আমি করতে পারি নি। কিন্তু তোরাও আমার জন্যে কিছু করি নি।

পুরনো কথা বাদ দেন।

বাদ দেব কেন? তোর ভাবী হাত ভেঙে এক মাস পড়ে রইল হাসপাতালে, কেউ তোরা গিয়েছিলি তাকে দেখতে? স্বীকার করলাম সে ভালো মেয়ে নয়। ঝগড়াটে। কিন্তু মানুষ তো? ডাক্তার বলল হাত কেটে বাদ দিতে হবে। কী কষ্ট, কী দৌড়াদৌড়ি। কেউ এসেছিলি দেখতে?

হাত কেটে বাদ দিতে হবে, এটা শুনি নি।

বড়োভাই আমাকে লজ্জায় ফেলে দিয়ে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করলেন।

টগর অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখল। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বললাম, ভাবী কেমন আছে? বাচ্চারা?

ভালোই। ওরা সবাই এসেছে। নিচে আছে।

নিচে কেন?

আমি আগে এসেছি তোর সঙ্গে ফায়সালা করতে। কেন এত বড় একটা ব্যাপারে আমি কিছু জানলাম না?

বাদ দেন। আমার ভুল হয়ে গেছে।

ভুলটা কেন কলি, সেটা বল? তোক বলতে হবে।

আমি থেমে থেমে বললাম, কাউকেই কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। আপনি আমার চিঠি কি আজই পেয়েছেন?

না, গত পরশু পেয়েছি। ভাবছিলাম আসব না।

এসে ভালো করেছেন।

আমি এলে না-এলে কারো কিছু যায় আসে না। আমি আবার কে? তোর এখানে সিগারেট খাওয়া যায়?

যায়। খান। নেন, আমার কাছে ভালো সিগারেট আছে। বাবা এখন বিরাট বড়লোক, শুনেছেন?

হ্যাঁ। তোর চিঠিতে পড়লাম। বাবা আমাকে কিছু বলেন নি।

আপনি দেখেশুনে বাবাকে একটা ছোটখাট বাড়ি বানিয়ে দিন। তাঁর বাড়ির খুব শখ।

আমি কেন? তুই দে।

আমি কিছু বললাম না। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দীর্ঘ সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার চোখ মুছতে শুরু করলেন।

 

আমি কি ভয় পাচ্ছি

মনে হয় পাচ্ছি। সারাক্ষণ কেমন এক নতুন ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করেছি। যেন সব কিছুই আছে, তবুও কিছুই নেই। স্বপ্ন দেখার মতো ব্যাপার। সব কিছুই ঘটছে। অথচ কিছুই ঘটছে না। মনের ভেতর কোথায় যেন চাপা একটা উত্তেজনাও অনুভব করছি। সেই উত্তেজনাটি কী কারণে, তাও স্পষ্ট নয়।

গত রাতে অনেকক্ষণ জেগে থেকে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমাবার আগে-আগে মুখে বসন্তের দাগওয়ালা এক জন নার্স এসে বলল, আপনি কি ওষুধ খেয়েছেন? কোন ওষুধের কথা বলছে বুঝতে পারলাম না। তবু হাসিমুখে বললাম, হ্যাঁ। সে বলল, ঘুমিয়ে পড়ুন। জেগে আছেন কেন? মেয়েটির চেহারা ভালো নয়, কিন্তু এমন মিষ্টি গলার স্বরা বারবার শুনতে ইচ্ছা করে।

ঘুম আসতে অনেক দেরি হল। এবং আশ্চর্য চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখলাম। কে যেন বলেছিল, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুলে কেউ স্বপ্ন দেখে না। কথাটা সত্যি নয়।

আমি দেখলাম, জেসমিনহাসপাতালে আমাকে দেখতে এসেছে। পিকনিকে যে শাড়ি পরে গিয়েছিল সেই শাড়ি তার গায়ে। গলায় চিকন একটি চেইন। চুল বেণীবাঁধা। আমার স্বপ্ন হল বাস্তবের চেয়ে স্পষ্ট। ঘুমের মধ্যেই আমি তার গায়ের ঘাণ পেলাম। জেসমিন বলল, আপনাকে দেখতে এলাম। অবেলায় ঘুমাচ্ছেন কেন, উইন তো! আমি উঠে বসলাম, সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটা অন্য রকম হয়ে গেল। দেখলাম হাসপাতাল নয়, আমি আছি আমার মেসে। জেসমিন চুল আচড়াচ্ছে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে, তার চুল এখন আর বেণী করা নয়। খুলে দেওয়া। সে-চুল হাওয়ায় উড়ছে।

স্বপ্নে সব কিছুই খুব স্বাভাবিক মনে হয়। হাসপাতাল থেকে মেসে চলে আসার দৃশ্যটিও আমার কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হল। এক বার অবশ্যি অস্পষ্টভাবে মনে হল এটা সত্যি নয়। এটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন। হয়তো এক্ষুণি আমার ঘুম ভেঙে যাবে। জেসমিন চুল বাঁধতে-বাঁধতে বলল, ইশ, আপার শাড়িটা ছিঁড়ে ফেলেছি। আপা যা রাগ করবে। বলতে বলতে সে হাসল। আমিও হাসতে শুরু করলাম। শাড়ি ছেড়ার প্রসঙ্গে দুজনের হাসার ব্যাপারটি মোটও অস্বাভাবিক বলে মনে হল না। যেন এটাই স্বাভাবিক। স্বল্প কত অর্থহীনই না হতে পারে।

জেগে উঠে দেখি বালিশ ভিজে গেছে। অর্থহীন হাসাহাসির একটি স্বপ্ন দেখেও খুব কেঁদেছি।

জেসমিন, জেসমিন, তোমার সঙ্গে এ জীবনে বোধহয় আর দেখা হবে না। এ জীবনের পরেও কি অন্য কোনো জীবন আছে? অনন্ত নক্ষত্ৰবীথির কোথাও কি আবার দেখব তোমাকে?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ