আশ্বিন মাস আসতেই সাজ সাজ পড়ে গেল স্কুলে।

স্কুলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। গান, তো হবেই, সেই সঙ্গে নাটক হবে স্টেজ বেঁধে। হিরণ্য রাজা নাটকের নাম। হিরণ্য রাজার পাঠ করেছেন বাদশা মামা। উৎসাহের সীমা নেই। আমাদের। খালারাও ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগলেন নাটক দেখবার জন্যে। মেয়েদের জন্যে পর্দাঘেরা আলাদা জায়গা করা হয়েছে। এ বাড়ির মেয়েরা আগে কখনো নাটক-ফাটক কিছুই দেখেনি। দেখবার সখ খুব। ছোট নানী আর্জি নিয়ে গেলেন নানাজনের কাছে।

এ সব কি দেখবে! না, না। বলে প্রথম দিকে প্রবল আপত্তি তুললেও শেষের দিকে তাকে কেমন নরম মনে হল। সুযোগ বুঝে নানীজান বলে চলেছেন, একদিনের মোটে ব্যাপার। আমোদ-আহাদ তো কিছু করে না।

না করে না, রাতদিনই তো আমোদ চলছে। আচ্ছা যাক। পালকি করে যেন যায়।

স্কুলঘরে স্টেজ সাজানো হয়েছে। হ্যাঁজাকের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। হ্যাঁরিকেন হাতে নিয়ে গ্রামের লোকজন আসছে। কাতারে কাতারে। পর্দায় আড়াল করা মেয়েদের জায়গায় তিল ধারনের ঠাই নেই। আমি আর নবুমামা বসেছি মেয়েদের সঙ্গে। ছোট নানী আর দুখালা চাদর গায়ে চুপচাপ বসে আছেন। নাটক শুরু হতে হতে রাত হয়ে গেল। বাদশা মামা সেজেছেন হিরণ্য রাজা। এমন মহান রাজা দীন-দুঃখীদের জন্য সমস্ত বিলিয়ে দিচ্ছেন। দুশ্চরিত্র মন্ত্রি ঘোট পাকাচ্ছে তলে তলে। রাজা আপন-ভোলা মানুষ, কিছু জানতেও পারছেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছি সবাই। এক সময় হিরণ্য রাজা মনের দুঃখে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। রানীও তাঁর পিছু পিছু। নানীজান চমকে বললেন, মেয়ে কোথেকে এলো। কার মেয়ে?

ও হচ্ছে হারু দাদা, মেয়ে সেজেছে।

ওমা, হারু নাকি?

নানীজনের চোখে আর পলক পড়ে না। বিবেকের পাঠ করল আজমল। খালারা কাঁদতে কাঁদতে চাদর ভিজিয়ে ফেলল। শেষ দৃশ্যে হিরণ্য রাজা মন্ত্রীকে বলছেন–এই রাজ্য তুমি লাও ভাই। কাজ নাই রাজ্যপাটে, আমি বনবাসে যাব।

সেইখানে শান্তি অপার।

ছোট খালা বললেন, বেকুবটা মন্ত্রীকে মেরে ফেলে না কেন?

মন্ত্রী বলছে, দ্বন্দ্ব যুদ্ধ হোক রাজা, বৃথা তর্কে কোনো ফল নাই।

ঝন ঝন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নবুমামা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। নানীজান পেছনে থেকে চেঁচাচ্ছেন, ও নবু বস, দেখতে পাচ্ছি না। বসে পড়। কী তীব্র উত্তেজনা! রাজার মৃত্যুতে চোখে জল। বাদশা মামার জয়জয়কার। কী পাঠাটাই না করলেন!

নানাজানও যে শেষ পর্যন্ত অভিনয় দেখবেন, তা কেউ ভাবিনি। পালকিতে খালারা উঠতে যাবে, এমন সময় তিনি এসে হাজির। বাদশা তো বড় ভালো করেছে। এই বলে পালকিতে উঠবার তাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন হেডমাস্টার সাহেবের বাড়ি। সেখানে তার রাতের দাওয়াত।

বাড়ি গিযে দেখি মেহমানে বাড়ি ভর্তি। নন্দিপুর থেকে নানাজানের ফুপাতো বোন এসেছেন। ছেলেমেয়ে নিয়ে। সকাল-সকালই পৌঁছতেন, নৌকার দাঁড় ভেঙে যাওয়ায় দেরি হয়ে গেছে। আমি আর নবুমামা অবাক হয়ে গেলাম মেহমানদের মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটি মেয়েকে দেখে। নানাজানের ফুপাতো বোনের বড় মেয়ে। ডাকনাম এলাচি। এমন সুন্দরও মানুষ হয়।

দু’মাসের ভেতর এলাচির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল বাদশা মামার। আপাত কাৰ্যকারণ ছাড়াই যে সমস্ত ক্ষুদ্র ব্যাপার ঘটে তা-ই কেমন করে পরবর্তী সময়ে মানুষের সমস্ত জীবন বদলে দেয়, ভাবতে অবাক লাগে।

সে রাতে নাটক দেখে সবাই বাদশা মামার উপর মহাপ্রসন্ন ছিলেন। বাড়ি এসে দেখেন, ফুলেব মত একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাদশার সঙ্গে এর বিয়ে হলে কেমন হয়? এই ভাবনা চকিতে খেলে গেল সবার মনে। এলাচি স্থায়ীভাবে নানাজানের বাড়িতে উঠে এলেন। নাম হয়ে গেল। লাল বউ, আমি ডাকতাম লাল মামি, নবুমামা ডাকত লাল ভাবী। টকটকে বর্ণ, পাকা ডালিমের মত গাল। আর কি নামেই-বা ডাকা যায়!

নবুমামা এবং আমি দুজনে একইসঙ্গে লালমামির প্রেমে পড়ে গেলাম! সদা ঘুর ঘুর করি, একটু যদি ফুট-ফরমাস করতে দেন এই আশায়। লালমামি কাকে বেশি খাতির করেন, আমাকে, না নবুমামাকে এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে যায় দুজনের। স্কুলে যাবার পথে বইখাতা নামিয়ে হয় হাতাহাতি। লালমামির বড়ই খাবার ইচ্ছে হয়েছে, খেলা বন্ধ করে দুজনেই ছুটেছি ইন্দু সাহার বাড়ি। ইন্দু সাহার বাড়িতে দুটি বড়ই গাছ, মিষ্টি যেন গুড়। লালমামির ইচ্ছে হয়েছে কামরাঙ্গা খাবেন, ঝাল লংকা মাখিয়ে। বাড়ির পেছনে বিস্তৃত বন। এখানে-ওখানে গাছ আছে লুকিয়ে। দুজনেই গেছি বনে।

মেয়েরা খুব সহজেই ভালবাসা বুঝতে পারে। লালমামি আমাদের দুজনকেই বুঝে ফেললেন। পোষা বেড়ালের মত আমরা তার সঙ্গে বেড়াই। মোহরের মা বলে, পুলা দুটা মাইয়া স্বভাবের, এসব ভাল না গো।

আমি আর নবুমামা তখন নির্বাসিত হয়েছি পাশের ঘরে। কতটুকুই বা দূরে? লালমামি হাসছেন, আমরা শুনতে পারছি। লালমামি বলছেন, উঁহু, চুল ছিঁড়ে গেল। আমরা উৎকৰ্ণ হয়ে শুনছি। লালমামি যদি কখনো বলেছেন, এই যা, আজ খাওয়ার পানি-আনি নাই, ওমনি নবুমামা তড়াক করে লাফিয়ে পড়েছে বিছানা ছেড়ে, ভাবী, পানি নিয়ে আসছি আমি।

একঘেয়ে কোনো আকর্ষণেই আকর্ষণ থাকে না। মায়ের প্রতি মানুষের অন্ধ ভালবাসা ফিকে হয়ে আসে একঘেয়েমির জন্যেই। ভাই-বোনের ভালবাসার ধরনও বদলাতে থাকে। লালমামির প্রতি আমাদের ভালবাসা ফিকে হওয়ার কোনো ভয় ছিল না। তার মত বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে আমি পরবর্তী জীবনে আর একটিমাত্র দেখেছিলাম।

যে কথা বলছিলাম–লালমামি আমাদের বিচিত্রভাবে আকর্ষণ করলেন। হয়ত আমি আর নবুমামা দুজনে বসে আছি তাঁর ঘরে। মামি হুকুম করলেন, নবু, দরজা বন্ধ করে দে। খোল, এবার আলমারি খোল। রাজার পোশাকটা বের করত।

আমি আঁৎকে উঠে বলেছি, বাদশা মামা মেরে ফেলবে। ঠোঁট উল্টে মামি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করেছেন, নে, তুই এই মুকুটটা পরে ফেলে। নবু, তুই কী সাজবি, সন্ন্যাসী?

নবুমামা বললেন, তুমি কী সাজবে আগে বল?

আমি রানী সাজব।

তাহলে আমি রাজা সাজব। ততক্ষণে আমি ঢলঢলে মুকুটটা মাথায় পরে ফেলেছি। তারস্বরে চেঁচাচ্ছি, না, আমি রাজা সাজব।

মামি বললেন, যুদ্ধ হোক দুজনার মধ্যে। যে জিতবে, সেই রাজা। কথা শেষ না হতেই নবুমামা ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমার উপর। দুজন ধুলোমাখা মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকি। যেন এই যুদ্ধে জীবন-মরণ নির্ভর করছে। আল্লাহ জানেন, নবুমামা এই লিকলিকে শরীরে এত জোর পান কী করে?

জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতে দীর্ঘ সময় লাগে। মুখে নখের রক্তাভ আঁচড়ে, ধূলি-ধূসরিত শার্ট নিয়ে যখন যুদ্ধজয়ী রাজা দাঁড়ান। তখন মামি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, আজ আর না, আজ থাক, যা, তোরা আমার জন্য তেঁতুল নিয়ে আয়।

বল তো তুই, টানলে ছোট হয় কোন জিনিস?

লালমামি বিছানায় শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে বলেন। হাজার চিন্তাতেও মাথায় সে জিনিসটার নাম আসে না, টানলে যা ছোট হতে থাকে।

পারলি না? দেশলাই আন আমি দেখাচ্ছি।

নবুমামা দৌড়ে দেশলাই নিয়ে আসেন। মামি আমাদের দুজনের স্তম্ভিত চোখের সামনে ফস করে একটা বার্ডসাই সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকেন। কোন ফাকে জানি বাদশা মামার কাছ থেকে জোগাড় করে রেখেছিলেন। আমাদের দুজনের নিঃশ্বাস পড়ে না। মামি বলেন, এই দেখ, যতই টানছি, ততই ছোট হচ্ছে। আমরা হা করে তাকিযে থাকি মামির দিকে। মামি আধা-খাওয়া সিগারেট বাড়িয়ে ধরেন আমাদের দিকে, শান্ত গলায় বলেন, নে এবাব তোরা টান। হা করে দেখছিস কি? কসে টান দে। নাইলে তো বাড়িতে বলে দিবি। মামিব মুখেব গন্ধ দূব করবাব জন্যে পানি আনতে হয়, এলাচ দানা আনতে হয়। সেই সঙ্গে মামির প্রতি আমাদের এক নিষিদ্ধ আকর্ষণ জড় হতে থাকে।

বাড়ির বউ-ঝিরা লালমামিকে বিষ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। এ কেমন ধারা বউ? লাজ নেই, সহবত নেই।

কোথায় শাশুড়ীকে দেখে একহাত ঘোমটা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, তা নয়, টগবগিয়ে ঘোড়ার মত চলে যায়। নতুন বউ রান্নাঘরে গিয়ে বসুক না দুদণ্ড। ননদের হাত থেকে আনাজ নিয়ে জোর করে কুটে দিক, তা নয়, গলায় বাঁশ দিয়ে হাসছে হিহিহিহি। মোহারের মা সময় বুঝে ছড়া কাটে। —

“রূপ আর কয়দিনের?
নিমতা ফুল যায়দিনের।”

নিমতা ফুল সক্কাল বেলাতেই ফোটে, রোদ একটু উঠতেই ঝর ঝর করে ঝড়ে পড়ে। কিন্তু যার জন্যে বলা সে শুনছে কই? শাশুড়ি মুখের ওপর কিছু বলেন না। লোকে বলবে, বউ কাটকী শাশুড়ী। কী লজ্জার কথা!

একমাত্র চাবিকাঠি বাদশা মামা। সে-ই তো পারে বউয়ের রীতিনীতি শুধরে দিতে। কিন্তু দেখেশুনে মনে হয়, বউ জাদু করেছে বাদশা মামাকে।

বিয়ের পর পরই বাদশা মামা ভয়ানক বদলে গেছেন। চাল-চলনে, কথা-বার্তায় ভয়ানক অস্থিরতা এসেছে। আগে সমস্ত দিন বাইরে পড়ে থাকতেন। রাতের বেলা খেতে আসতেন, বাড়ির সঙ্গে এইটুকুই যা সংযোগ। এখন সমস্ত দিন বাড়িতে থাকেন। কিন্তু সে-ও অন্যরকম থাকা। হয়ত মিনিট খানিকের জন্যে লাল মামির ঘরে এসেছেন, চোখে-মুখে ব্যস্ততার ভার। যেন কোনো দরকারী জিনিস খুঁজে পাচ্ছেন না। লাল মামি ভ্র কুঁচকে বললেন, কি চাও?

কি না, কিছু না।

বলে মামা বিব্রত ভঙ্গিতে চলে গেলেন। বসে রইলেন বাইরের ঘরে একা একা। আবার হয়ত আসলেন কিছুক্ষণের জন্যে, আবার বাইরে গিয়ে বসে থাকা। নানীজান একদিন বললেন— বাদশা, কী হয়েছে রে?

বাদশা মামা কিছু বললেন না। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলেন।

 

সবাই অবাক হল, যেদিন বাদশা মামা কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন। নানাজান সে দিনই প্রথম লালমামির ঘরে এসে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এলাচি বাদশার কী হয়েছে?

লালমামি চুপ করে রইলেন। নানাজান বললেন, তোমাদের মিল হয় না কেন? কি ব্যাপার?

মামি চুপ করে রইলেন। নানাজান শান্ত গলায় বললেন, এলাচি, সরফরাজ খানের বাড়িতে কোনো বেচাল হয় না। খেয়াল থাকে যেন।

নানাজান বেরিয়ে এসে ছোট নানীজনকে কিছুক্ষণ বকে নিচে নেমে গেলেন। সারাদিন বাড়ি থম থম করতে লাগল। সে সন্ধ্যায় কানাবিবি যখন সাপ-খেলানো সুরে কোরান পড়তে শুরু করল তখন কেন জানি না। ভয়ে আমার বুক কাঁপতে লাগল।

তৃতীয় দিনের দিন সকালবেলা বাদশা মামা ফিরে এলেন। ভেতরের বাড়িতে না এসে বাইরের ঘরে বসে রইলেন। নানীজান এসে তাকে নিয়ে গেলেন ভেতর বাড়িতে। নানা সারক্ষণই সংকুচিত হয়ে রইলেন। যখন লালমামির সঙ্গে তার দেখা হল তিনি ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন।

সবচেয়ে অবাক হওয়ার ব্যাপারটি হল রাতে। বাদশা মামা লালমামির ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। মামি বললেন, কে?

বাদশা মামা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, আমি।

এদিকে পাশের ঘরে আমি আর নবুমামা কান খাড়া করে বসে আছি। কিন্তু আর কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। বাদশা মামা নিচু গলায় বললেন, দরজাটা খোল।

লালমামি কোনো সাড়া-শব্দ করলেন না। শেষ পর্যন্ত বাদশা মামা আমাদের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। আমরা তিনজন একখাটে শুয়ে রইলাম। মামা বার বার বলছেন, কাউকে বলবি না, খবরদার।

না!

বললে কান ছিঁড়ে ফেলব। দুজনের মনে থাকে যেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ