বাস শেষ পর্যন্ত ছাড়বে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। এগারোটায় এই বাস ছাড়বে এমন কথা ছিল। যাত্রী উঠে বসে আছে। বাস ছাড়ছে না। এখন বাজছে একটা। সমস্যা কি তাও বোঝা যাচ্ছে না। ভূয়াপুর থেকে একটা বাস এসে পৌঁছেছে বারটায়। তার ড্রাইভার কানে কানে অন্য ড্রাইভারকে কি সব বলেছে। ড্রাইভাররা বাস ছাড়ছে না।

অনিল জায়গা পেয়েছে একবারে পেছনের সিটে। এক কোণায় সে, বাকি সবটা জুড়ে এক পরিবার বসে আছেন। বোরকা পরা এক মহিলা, তাঁর স্বামী, এগারো-বারো বছরের একটি মেয়ে। আট বছর বয়েসী দুটি ছেলে, জমজ। অবিকল এক রকম দেখতে। এরা নিঃশব্দ, তবে খুব চালু। নিঃশব্দে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে চলছে। চার বছর বয়েসী একটি বাচ্চা মেয়ে। ভাইদের মারামারি সে আগ্রহ নিয়ে দেখছে এবং খুব মজা পাচ্ছে বলে মনে হয়।

পরিবারের কর্তা বসেছেন অনিলের পাশে। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের উপর। তিরিক্ষি মেজারের মানুষ। প্রচুর কথা বলেন। মারামারিরত দুই পুত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, কর মারামারি কর। খামচোখামচি কর। খামচি দিয়ে একজন আরেকজনের চোখ তুলে ফেল। কিন্তু খবরদার, টু শব্দ করতে পারবি না। শব্দ করলে কচুকাটা করে ফেলব। আমার নাম আয়ুব আলি। আমার এক কথা। গলা দিয়ে শব্দ বের করেছিস কি মরেছিস।

বড় মেয়েটি বাবার পাশে বসেছে। সে নিচু গলায় বলল, মা বলছে তার গরম লাগছে। বোরকা খুলে ফেলতে চায়।

খবরদার, বোরকা যেমন আছে তেমন থাকবে। যখনকার যে নিয়ম। এখনকার নিয়ম বোরকা। গরমে সিদ্ধ হলে উপায় কিছু নাই। মিলিটারীকে বলতে বলিস যে গরম লাগছে। মিলিটারী পাংখা দিয়ে হাওয়া করবে।

গাড়ি ছাড়বে কি ছাড়বে না কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ির হেল্পার এসে বলে গেলা— নাও যাইতে পারে। সামনে অসুবিধা আছে। মালিক আসন্তাছে। মালিক আসলে উনি যা বলবেন তাই হবে। উনি যাইতে বললে যাব। যাইতে না বললে নাই।

যাত্রীরা সবাই বসে আছে। কেউ নড়ছে না। বোঝাই যাচ্ছে সবারই যাওয়া প্রয়োজন। ড্রাইভারের সিটের ঠিক পেছনে বোরকা পরা দুজন মহিলা যাত্রী যাচ্ছেন। বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক তাদের নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বোরকা পরা মহিলা একজনকে তাল পাখায় ক্রমাগত হাওয়া করছেন। মহিলাটি কাঁদছেন ফুঁপিয়ে। এক সেকেন্ডের জন্যেও থামছেন না। বোরকা পরা অন্য মহিলা গাড়ির জানালায় মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছেন। কৌতূহলী যাত্রীরা বেশ কবার জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে। বৃদ্ধ কঠিন গলায় বলেছেন, কিছু হয় নাই।

পুরো গাড়িতে অনিল ছাড়া যুবক কেউ নেই। যুবকরা বাসে ট্রেনে চলাচল করে না। প্ৰায় স্টেশনেই ট্রেনের কামরা চেক করা হয়। যুবকদের নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হাতের মাসল টিপে দেখা হয়। হাত শক্ত কি-না। শক্ত হলে অস্ত্ৰ-ট্রেনিং নিয়েছে। সামান্যতম সন্দেহ হলে যুবকরা ফিরে আসে না।

বাসের জন্যেও চেক পোস্ট আছে। মিলিশিয়া নামের এক বস্তুর সম্প্রতি আমদানি হয়েছে। কালো কুর্তা পরে, কোমরে বাধা থাকে গুলির বেল্ট। এরা ইংরেজিও জানে না, উর্দুও জানে না। বিচিত্ৰ ভাষায় কথা বলে। এরা ভয়ংকর চরিত্রের মানুষ এই জাতীয় কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কালো পোশাকের মিলিশিয়া চোখে পড়লে মানুষের বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগে।

আয়ুব আলি বিড়ি ধরালেন। মেয়েটি বলল, বাবা, মা বিড়ি ফেলতে বলছে। বিড়ির গন্ধে মার বমি আসতেছে।

আয়ুব আলি মুখ বিকৃত করে বললেন, বমি আসলে বমি করতে বল। তোর মায়ের হুকুমে এখন দুনিয়া চলবে না। সে জেনারেল টিক্কা খান না।

আয়ুব আলি অনিলের দিকে ফিরে বললেন, ব্রাদার, আপনার কি অসুবিধা হচ্ছে?

না।

আপনার অসুবিধা হলে ফেলে দিতাম। কিন্তু পরিবারের কথায় আমি পয়সায় কেনা বিড়ি ফেলে দিব, তা হয় না। আপনি যাবেন কই?

রূপেশ্বর।

কোন রূপেশ্বর?

অনিল পুরো ঠিকানা বলল।

টাঙ্গাইল পৌঁছতে পৌঁছতেই তো রাত হয়ে যাবে। রূপেশ্বর যাবেন কীভাবে?

রাতে রাতে যাব। হেঁটে চলে যাব।

এইটাই ভালো। রাতে রাতে যাওয়া ভালো। মিলিটারী বলেন আর মিলিশিয়া বলেন সন্ধ্যার পর তারার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর গলায় গামছা দিয়ে টেনেও এদের বের করতে পারবেন না।

মেয়েটি বলল, বাবা, মা এসব কথা বলতে নিষেধ করতেছে।

তোর মারে চুপ থাকতে বল। কি বলব কি বলব না সেটা আমার বিষয়। ভাই সাহেব, বিড়ি খাবেন?

জ্বি-না।

খেলে খেতে পারেন। এক সুটকেস ভর্তি বিড়ি নিয়ে নিয়েছি। এই যে যাচ্ছি। যদি আটকা পড়ে যাই! কিছুই তো বলা যায় না?

যাচ্ছেন কোথায়?

শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি। আমার এক শ্যালক বিয়ে করবে। আমি বড় জামাই। না গেলে বিয়ে হয় না। তা ভাই বলেন, এটা কি বিয়ের সময়? মাছির মতো মানুষ মরতেছে আর তুই ব্যাটা বউয়ের সাথে…আচ্ছা যা, বিয়ে করবি কর। তা আমি এমন কি রসগোল্লা দুলাভাই যে আমি ছাড়া বিবাহ হবে না। আরো ব্যাটা, আমরা যে তোর কারণে এতগুলা মানুষ যাচ্ছি। যদি পথে ভালো-মন্দ কিছু হয়! ধরা যদি তোর বোনরে মিলিটারী পথে নামায়ে রেখে দেয় তখন কি অবস্থােটা হবে? আমার শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ গাধা। একবারে গ আকারে গা, ধ আকারে ধা।

মেয়েটি বলল, বাবা, মা বলছে নিচে গিয়া চা খেয়ে আসতে।

স্ত্রীর এই পরামর্শ আয়ুব আলির মনে ধরল। তিনি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। অনিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্রাদার, আসেন চা খাবেন। অনিলও উঠে দাঁড়াল। ছেলে দুটির একটি অন্যটির কান কামড়ে ধরেছে। ছেলেদের মা, কান ছাড়াবার চেষ্টা করছেন। আয়ুব আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, খেয়ে ফেল। কামড় দিয়ে কান খেয়ে ফেল। যন্ত্রণা কমুক।

আয়ুব আলি নামার সময় সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে কৌতূহলী চোখে তাকে দেখল। ভদ্রলোক ইতোমধ্যেই সবার কৌতূহল আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন। ক্ৰন্দনরত বোরকা পরা মহিলার কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, মা, কান্নাকাটি যা করার এখন করে নেন। মিলিটারী চেকিংয়ের সময় গলা দিয়ে টু শব্দ বের করবেন না। এরা অনেক কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে। শেষে বিপদে পড়ে যাবেন। আর মা যদি কিছু মনে না করেন- ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। যদি মোজা থাকে মোজা পরে নেন। সুন্দরী মেয়ে দেখলে হারামজাদাগুলোর ইস থাকে না। যদি বেয়াদবী কিছু করে থাকি নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।

 

বাস স্ট্যান্ডের লাগোয়া দুটি স্টল। দুটিই ফাঁকা। একটিতে রেডিও বাজছে, খবর হচ্ছে খুব চিকণ গলায় একজন মহিলা খবর পড়ছেন ; আয়ুব আলি সেটিতেই ঢুকলেন। অনিল পেছনে পেছনে গেল। রেডিওর প্রধান খবর হল, নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। কোনটিতে কত পানি বাড়ছে তা বলা হল। বন্যার সম্ভাবনা সম্পর্কে বলা হল। উরুগুয়েতে মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। রেক্টর স্কেলে যার মাত্রা ৩.৪, এই তথ্যও জানা গেল। তারপর বলা হতে লাগল নিউ মেক্সিকোতে সড়ক দুঘর্টনায় এগারো ব্যক্তির নিহত হবার সংবাদ।

আয়ুব আলি মুখ বিকৃত করে বললেন, শালা।

অনিল বলল, কাকে বলছেন?

রেডিওটারে বললাম, নিজের দেশের খোঁজ নাই, অন্য দেশে এগারো জন নিহত। আরে শালা, তোর দেশে কয়টা নিহত সেইটা বল।

অনিল হেসে ফেলল এবং খুবই আশ্চর্য হল যে এই অবস্থাতেও সে হাসতে পারছে। তার মধ্যে এই মুহুর্তে কোন দুঃখবোধ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পথের বিপদ নিয়েও সে ভাবছে না। কিছুই ভাবছে না। আয়ুব আলি স্টলের মালিকের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলেন, রেডিও বন করেন।

দোকানের মালিক ঠাণ্ডা গলায় বলল, রেডিও খোলা রাখা লাগে। কোন সময় কি বলে জানা দরকার। ধরেন, হঠাৎ কাফুর্ঘ্য দিল তখন কি করবেন? খাইবেন কি চা-নাশতা?

চা দাও। কাপ গরম পানি দিয়া ধুইয়া দিবা। চিনি কম।

যাইবেন কই আপনারা?

তা দিয়া আপনার প্রয়োজন নাই। চা দিতে বলছি চা দেন। চা দিয়া দাম নেন। অধিক কথা বলার সময় এখন না।

রেডিওতে নজরুল গীতি হচ্ছে। নজরুলের প্রেমের গান, নয়ন ভরা জল গো…

বিপ্লবী গানগুলো বাজানো হচ্ছে না। স্বাধীন বাংলা বেতার বাজাচ্ছে বিপ্লবী গান।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নজরুলের প্ৰেম বিষয়ক সংগীতে এমন খুব উৎসাহী। হামদ এবং নাতে উৎসাহী, উচ্চাঙ্গ সংগীতে উৎসাহী।

আয়ুব আলি চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ভাইসাব, আপনার নামটা তো জানা হল না। নাম জানা দরকার।

আমার নাম অনিল।

কি বললেন, অনিল?

জ্বি, অনিল বাগচী।

খাইছে আমারে। হিন্দু না-কি?

জ্বি।

সাহস তো কম না। হিন্দু হয়ে বাসে করে রওনা দিলেন? চেকিং-এ ধরা পড়বেন। এরা চার কলমা জিজ্ঞেস করে। প্যান্ট খুলে দেখে খৎনা হয়েছে কি-না। জানেন না?

শুনেছি।

আপনার কোন দিকে যাওয়ার দরকার না— যেখানে ছিলেন সেখানে চলে যান। আর যদি ট্রেনে-বাসে যেতে হয় তবে আগে গোপনে খৎনা করায়ে ফেলেন। এর মধ্যে লজ্জা-শরমের কিছু নাই। জান বাঁচান ফরজ। আমি অনেক হিন্দু ছেলের কথা জানি খৎনা করায়ে ফেলেছে। চার কলমা মুখস্থ করেছে। আপনার কলমা কয়টা মুখস্থ?

একটা শুধু জানি।

আমি জানি মোট দুটা। চাপে পড়ে তিন নম্বরটা মুখস্থ শুরু করলামখালি বেড়াছেরা লাগে। তবে দুটা জানলেও চলে, এরাও দুটার বেশি জানে না। একটু সুর দিয়ে, দরদ-টারদ মাখায়ে কেরাতের মতো পড়লেই এরা খুশি। বেকুবের জাত তো। বেকুবের জাত অল্পে খুশি হয়, অল্পে বেজার হয়। ঠিক বললাম না?

জ্বি।

শুধু বেকুব না। এরা হল হায়ওয়ানের জাত। হায়ওয়ান কি জানেন? হায়ওয়ান হল পশু। এরা পশুর জাত। পশু না হলে প্যান্ট খুলে খৎনা কেউ দেখে? বলেন। আপনি, দেখে? এটা কি মানুষের কাজ না পশুর কাজ? আমি তো ঠিক করে রেখেছি। কেউ যদি আমার প্যান্ট খুলতে বলে প্যান্ট খুলব, তারপর হিস করে হারামজাদার মুখে পেশাব করে দেব। এরপর যা হয় হবে। মৃত্যু কপালে থাকলে হবে। কি বলেন?

অনিল কিছু বলল না। আয়ুব আলি বিড়ির প্যাকেট বের করে বললেন, নিন, বিড়ি ধরান। বিড়িতে একটা টান দেন। মাথা পরিষ্কার হোক। হিন্দু মানুষ, সময়মতো হিন্দুস্থানে চলে গেলে ঝামেলা হত না। এতক্ষণ বাড়িতে বসে আরাম করে কচ্ছপের কোরমা খেতেন। ভালো কথা অনিল বাবু, কচ্ছপের কোরমা হয়?

জানি না হয় কি-না।

গভীর আগ্রহ নিয়ে আয়ুব আলি জিজ্ঞেস করলেন, কচ্ছপের মাংস খেতে কেমন? গোসতের মতো না মাছের মতো?

অনিল নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না।

সময়টাই খারাপ রে ভাই, সময়টাই খারাপ। কারোর কথা বলতে ভালো লাগে না। আমি তো বলতে গেলে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। চুপচাপ ঘরে থাকি। এর মধ্যে বড় শালার বিয়ে লেগে গেল। আরো ব্যাটা বলদ, এটা বিয়ে করার সময়? বড় শালি আবার একটা বাচ্চা দিয়ে ফেলল। মেয়ে বাচ্চা। নাম রেখেছে পি। আমাকে বলল, দুলাভাই, নামটা সুন্দর না? আমি বললাম, পি আবার কেমন নাম? পিসাব হলেও একটা কথা ছিল। বুঝতাম। ঘন ঘন পিসাব হয় বলে নাম পিসাব। এই শুনে সে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ের আকিকা করেছে আমাকে বলে নাই। কত বড় ছোটলোকের জাত চিন্তা করে দেখেন।

গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে। আয়ুব আলি উঠে দাঁড়ালেন। চায়ের দাম অনিল দিতে গেল। তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন অত্যন্ত আহত হয়েছেন।

চায়ের দাম দিবেন মানে? আমার কি টাকার শর্ট না-কি? ভাই শুনেন, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আপনিও দেখলাম। আমার মতো কম কথার মানুষ। পথে যদি চেকিং হয়— অনিল বাগচী নাম বলার কোন প্রয়োজন নাই। নাম জিজ্ঞেস করলে বলবেন— মহসিন। মহসিন হল আমার বড় শ্যালকের নাম। যে গাধাটার বিয়ে করছে। ঐ গাধাটার নাম। বলবেন যে আপনি বিবাহ করতে দেশে যাচ্ছেন। কেউ বিয়ে-শাদী করতে যাচ্ছে শুনলে এদের মন একটু নরম হয়। মারধোর করলেও গুলি করে মারে না। নাম মনে থাকবে তো? মহসিন। বিপদের সময় মানুষ আসল নামই ভুলে যায়, আর নকল নাম! গাড়িতে বসে কয়েকবার মনে মনে বলেন- মহসিন, মহসিন, মহসিন। দানবীর হাজি মোহাম্মদ মহসিনের নাম ইয়াদ রাখবেন, তাহলেই হবে।

বাসে উঠে নিজের জায়গায় বসতে বসতে আয়ুব আলি ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইনি তোমার বড় মামা। ইনার নাম মহসিন।

আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী বোরকার পর্দা তুলে অবাক হয়ে তাকালেন অনিলের দিকে। আয়ুব আলি বললেন, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছ কেন? ড্যাব ড্যাব করে তাকানোর কিছু নাই। বোরকার পর্দা ফেল।

আয়ুব আলি সাহেবের যমজ বাচ্চা দুটি এখন মারামারি করছে না। দুজনেরই মুখ এবং হাত ভর্তি চকলেট। ছোট মেয়েটারও মুখ ভর্তি চকলেট। চকলেটের রস গড়িয়ে তার জামা মাখামাখি হয়ে গেছে। বড় মেয়েটা অনিলের দিকে তাকিয়ে বলল, এরা আপনার চকলেটের টিন খুলে ফেলেছে।

অনিল বলল, ভালো করেছে। তুমি চকলেট খাওয়া না? খাও, তুমিও খাও। তোমার নাম কি?

পাপিয়া।

কোন ক্লাসে পড়?

সিক্সে।

খুব ভালো।

পাপিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, আমি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছি।

বল কি? কি কর বৃত্তির টাকা দিয়ে?

কিছু করি না। বাবা টাকা নিয়ে যায়।

খুবই অনুচিত। তোমার নিজের টাকা অন্যে নিয়ে যাবে কেন?

আয়ুব আলি কোন কথা বলছেন না, কারণ কথা বলার মতো অবস্থা তার নেই। তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। তাঁর নাক ডাকছে।

বাসের ড্রাইভার বলল, সবাই বিসমিল্লাহ বলেন। গাড়ি ছাড়তেছি।

সবাই শব্দ করে বলল, বিসমিল্লাহ।

গাড়ি ছেড়ে দিল।

ছোট্ট একটা শিশু কাঁদছে। দুমাস বয়স। সেই তুলনায় গলার শক্তি প্ৰশংসনীয়। শিশুটির কান্নার আওয়াজ ছাপিয়ে উঠেছে। বাবা এবং মা দুজনেই তাকে নিয়ে খুব বিব্রত বোধ করছে। এটিই তাদের প্রথম সন্তান। কপালে বড় করে কাজলের ফোটা দেয়া। সেই কাজলে সমস্ত মুখ মাখামাখি হয়ে গেছে। বাচ্চাটির বাবা তাকে কিছুক্ষণ কোলে রেখে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিছুক্ষণ করছে মা। লাভ হচ্ছে না।

একজন বলল, ছোট শিশু সঙ্গে থাকা ভালো। শিশুর উপর আল্লাহপাকের খাস রহমত থাকে। এই শিশুর কারণে ইনশাআল্লাহ কারো কিছু হবে না। আমরা জায়গামতো নিরাপদে পৌঁছাব।

বাবার মুখে আনন্দের আভা দেখা গেল। মার মুখেও নিশ্চয়ই আনন্দের হাসি। বোরকার কারণে সে হাসি দেখা যাচ্ছে না। বাচ্চার কান্না এখন আর কারো খারাপ লাগছে না, বরং ভাল লাগছে। কাঁদুক সে, কাদুকা। গলা ফাটিয়ে কাঁদুক।

একজন জিজ্ঞেস করল, ছেলে না মেয়ে?

বাবা লাজুক গলায় বলল, মেয়ে?

কি নাম রেখেছেন মেয়ের?

বাবা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, মুক্তি। বলেই অস্বস্তি নিয়ে চারদিকে তাকালেন। সেই অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল যাত্রীদের সবার চোখে-মুখে।

ভালো নাম কি?

ভালো নাম ফারজানা ইয়াসমিন।

মিলিটারী নাম জিজ্ঞেস করলে ভালো নামটা বলবেন। ডাক নাম বলার প্রয়োজন নাই।

বাচ্চাটা কান্না থামিয়েছে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গের বোরকা পরা মহিলার কান্না শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ তাকে এখন আর পাখার হাওয়া করছেন না। গাড়ির ভেতর প্রচুর হাওয়া। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মনে হচ্ছে তিনিও ঘুমিয়ে পড়েছেন। আকাশে মেঘ দেখা যাচ্ছে। রোদে তেজ নেই। বাতাস আর্দ্র, বৃষ্টি আসবে বলে মনে হচ্ছে। রাস্তা ভালো না, গাড়ি খুব ঝাঁকুনি দিচ্ছে। ঝাঁকুনিতে অনেকেরই ঘুম পেয়ে যাচ্ছে।

যাত্রীদের প্রায় সবার হাতেই কিছু না কিছু বই। বেশ কয়েকজনের হাতে কোরান শরীফ। অনেকের হাতে প্রচ্ছদে কায়দে আযমের ছবিওয়ালা বই। এ সব বই এখন খুব বিক্রি হচ্ছে। এসব বই হাতে থাকলে একধরনের ভরসা। পাওয়া যায়। মনে হয়, বিপদ হয়ত বা কাটবে।

প্ৰচণ্ড গরমে সুৰ্যটে পরা একজন বাসযাত্রী যাচ্ছেন। লাল রঙের টাই, থ্রি পিস সুট। কোটের পকেটে লাল গোলাপের কলি। তেকোনা লাল রুমাল। সঙ্গে একটা ব্রিফকেস। তিনি ব্রিফকেস কোলে নিয়ে বসেছেন। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতছাড়া করছেন না। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে গেলেন বখশি হাট বাজারের কাছে তাকে নামিয়ে দেয়া যাবে কি-না। তখনো ব্রিফকেস হাতে ধরা। ভদ্রলোককে খুব নার্ভাস মনে হচ্ছে, খুব ঘামছেন। একটু পর পর রুমাল দিয়ে মুখ মুছছেন, ঘাড় মুছছেন। জানোলা দিয়ে ঘন ঘন থুথু ফেরছেন। তাঁর সঙ্গে পানির বোতল আছে। মাঝে মাঝে বোতল থেকে পানি খাচ্ছেন।

এই প্ৰচণ্ড গরমে সুট পরে আসার রহস্য হল তিনি শুনছেন মিলিটারীরা ভদ্রলোকদের তেমন কিছু করে না। সুট পরা থাকলে খাতির করে। তারপরেও তিনি ঢাকা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এসেছেন। চিঠিতে লেখা–

— মোহাম্মদ সিরাজুল করিম, পিতা মৃত বদরুল করিম, গ্রাম বখশি হাট, আমার পরিচিত। সে পাকিস্তানের এজন খাদেম। দেশ ভক্ত এক ব্যক্তি। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সে জীবন কোরবান করতে সর্বদা প্ৰস্তৃত। আমি তাহার সর্বাঙ্গিণ মঙ্গল কামনা করি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

এত কিছু পরেও ভদ্রলোক স্বস্তি পাচ্ছেন না। এক সময় দেখা গেল। গাড়ির জানোলা দিয়ে মুখ বের করে তিনি বিকট শব্দে বমি করছেন।

ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাড়ি এগুচ্ছে। গাড়ির গতি বেশি না। এত খারাপ রাস্তায় গতি বেশি দেবার প্রশ্ন উঠে না।

ঢাকা থেকে বেরুবার মুখেই একটা চেকপোস্ট। চেকপোষ্টে মিলিশিয়ার কিছু লোকজন। ড্রাইভার গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। যাত্রীরা শক্ত হয়ে বসে আছে। কেউ জানালা দিয়ে তাকাচ্ছে না। গাড়ির ভেতর কোন রকম শব্দ নেই। শুধুমাত্র ঘুমন্ত আয়ুব আলির নাক ডাকার শব্দ আসছে। বোরকা পরা মহিলাও কান্না থামিয়েছেন।

মিলিশিয়াদের একজন হাত ইশারা করে গাড়ি চালিয়ে যেতে বলল। কেউ এসে গাড়ির ভেতর উঁকি পর্যন্ত দিল না। কি অসীম সৌভাগ্য! গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ছোট বাচ্চাটি কাঁদতে শুরু করেছে। কাঁদুক। ছোট বাচ্চারা তো কাঁদবেই।

রাস্তা এখন কিছুটা ভালো। ড্রাইভার গাড়িতে স্পীড দিতে শুরু করেছে। তাকে দ্রুত যেতে হবে। সন্ধ্যার আগে আগে টাঙ্গাইল পৌঁছতে হবে।

মুক্তি কাঁদছে। হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে। মুক্তি যার নাম, অবরুদ্ধ নগরীতে যার জন্ম, সে তো কাঁদবেই। কাদাটাই তো স্বাভাবিক।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ