মনিরউদ্দিনের বাড়ির ভিড় পাতলা হয়ে গেছে।

বয়স্ক মানুষের মধ্যে আছে জলিল মিয়া। সে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। বসে আছে মুখ গম্ভীর করে। পরপর দুটি বিড়ি খেয়ে তৃতীয়টি সে সবেমাত্র ধরিয়েছে। সে ক্রুদ্ধ চোখে তাকাচ্ছে নিবারণের দিকে। নিবারণ তার গায়ের ফতুয়া খুলে ফেলেছে। মাথায় পানিতে ভেজানো গামছা।

মনিরউদ্দিনকে ভেতরে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। সে ঘুমুচ্ছে, না অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে, বোঝা মুশকিল। শরিফা পাখা দিয়ে হাওয়া করছে। শরিফার চোখ টকটকে লাল। সে কাঁদছে না। তবে মাঝে-মাঝে হিকার মতো উঠছে।

চৌকির কাছে মতির মা বসে আছে। সে বসেছে পা ছড়িয়ে। যখন কিছু লোকজন হয়, তখনই সে সাড়াশব্দ করে কাঁদে। এখন লোকজন নেই বলে চুপচাপ আছে। কিছুক্ষণ আগে একটা পান মুখে দিয়েছে। মুখভর্তি পানের রস। সে বেশ আয়েশ করেই পান চিবুচ্ছে। প্রতি গ্রামেই আশ্ৰয়হীনা কিছু মেয়েমানুষ থাকে। বেঁচে থাকার তাগিদেই এদের স্বভাব হয় অতি মধুর। মানুষের বিপদে-আপদে এরা সারাক্ষণ সঙ্গে থাকে। বাড়ির মানুষদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কাঁদে। তবু কেন জানি মনে হয় অন্যের বিপদে এরা এক ধরনের মানসিক শান্তি পায়। কোনো—এক বিচিত্ৰ উপায়ে অন্যের দুঃসময় থেকে এরা আনন্দের উপকরণ সংগ্রহ করে। মতির মা এখন সম্ভবত তাই করছে।

সে উঠে দাঁড়াল এবং অস্বাভাবিক নরম গলায় বলল, পাংখাড়া আমার হাতে দেওগো বৌ। তুমি এট্টু জিরাও।

শরিফার পাখা দেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মতির মা জোর করে পাখা নিয়ে নিল।

ওঝা হারামজাদা কোন কামের না। বিষ নামাইব কি, বিষ আরো উজাইছে। দেখ না, চেহারা কেন হইছে।

মতির মা বেশ শব্দ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

কেমুন কালা হইয়া গেছে শইলডা, দেখছ?

শরিফা কোন কথা বলল না। মতির মা গলা নিচু করে বলল, কপালের লিখুন। কপালের লিখন না হইলে কি আর……।

সে কথা শেষ করল না। কারণ মনিরউদ্দিন নড়ে উঠেছে। তার চোখ বন্ধ। নিঃশ্বাস ফেলেছে শব্দ করে।

বুঝলা বৌ, যেবছর অজন্মা গেল, হেই বছর ফরিদের বাপেরে সাপে কাটল। কী জোয়ান মানুষ। হাতির মত শইল। ওঝা আইল তিন জন গরু মানত করল তার বৌ। লাভ হইল না। সকালে কাটছে, দুপুরের মইধ্যে কাম শেষ। ওঝারা কইল, কলার ভোরাত কইরা মড়া ভাসাইয়া দেও। তার বৌ রাজি না। সে কবর দিতে চায়। তা, মাইয়ামাইনষের কথার দাম কী? মাইয়ামাইনষের কথার দাম হইল এক পয়সা। গ্রামের দশ জনে মিইল্যা কলাগাছের ভোরা বানাইল। নিশান লাগাইল। সাত দিনের খোরাকি দিয়া ভাসাইয়া দিল। তারপরে কী হইল, শুনবা?

শরিফার শোনার কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু সে হ্যাঁ-না কিছুই বলল না।

হেই কলার ভোরা গিয়া লাগল দুই মাইল দূরের নিশাপুরে। শিয়াল-কুত্তায় লাস কামড়াইয়া খাইয়া ফেলল। একটা হাত শিয়ালে কামড় দিয়া লইয়া আইল এই গেরামে। বুঝলা বৌ, একটা কথা কই হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। যদি কিছু হয়, কলার ভোরাত তোমার সোয়মীরে তুলবা না। কোন লাভ হয় না। এককালে হইত, যখন বেউলার মতো সতী নারী ছিল। অখন কি বেউলার মতো সতী নারী পাইবা? না, পাইবা না। ত্ৰিভুবনে নাই। ও বৌ, দানাপানি চাইর মুখে দেও। আহা রে, মাইয়ার মুখটা শুকাইয়া কী হইছে।

মতির মার হাত এক মুহূর্তের জন্যেও থামছে না। পাখা নড়ছে। এই অবস্থায় ঘন্টার পর ঘন্টা পাখা নেড়ে যেতে পারবে। দেখে মনে হবে না, ক্লান্তি তাকে স্পর্শ করেছে। মাটির গামলায় পানি। মাঝে-মাঝে মতির মা পানিতে গামছা ভিজিয়ে মনিরউদ্দিনের কপাল মুছে দিচ্ছে।

ও বৌ, আসমানের অবস্থা দেখছ? কপাল তোমার একলার পুড়ছে না। গেরামের কপাল পুড়ছে। দুই আনি ধানও তুলা যাইত না। সব শেষ। ভিক্ষা করুন লাগব গ্রামচুক্তি। দেহি, আরেকটা পান দেও।

শরিফা পান এনে দিল। ঠিক তখন মনিরউদ্দিন ক্ষীণ স্বরে বলল, ভিজা গামছা শ‍ইলে ছোঁয়াইবা না। খবরদার, শীত লাগে।

শরিফা এবং মতির মা দু জনকেই চমকে দিল। বেশ শক্ত সবল মানুষের কথা। মতির মা বলল, শইল কেমুন বাজান?

শইল আছে শইলের মতো। মাথার কাছে বইস্যা ভ্যাজভ্যাজ করবা না। শরিফা কই?

শরিফা এগিয়ে এল।

কিছু খাইতে দে। খিদা লাগছে। ভাত আছে?

শরিফা রান্নাঘরে ছুটে গেল। সাপে-কাটা বাড়িতে উনুন ধরানোর নিয়ম নেই। কিন্তু মানুষটা ভাত খেতে চেয়েছে। চারটা গরম ভাত, একটা ডিম ভাজা, সেই সঙ্গে গোটা দুই পোড়া শুকনো মরিচ। কতক্ষণ আর লাগবে?

মতির মা শরিফার পেছনে-পেছনে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হল। চোখ কপালে তুলে বলল, চুলা ধরাইতাছ, কী সর্বনাশ।

ভাত খাইতে চায়।

অন্য বাড়িত থাইক্যা আইন্যা দিমু। চুলা ধরাইবা, এইটা কেমুন কথা! দেখি, বর্তন দেও।

মতির মা থালা নিয়ে বেরিয়ে গেল। তাকে অনেকখানি পথ যেতে হবে। মনিরউদ্দিনের বাড়িটি একেবারে এক পাশে। কার বাড়িতে যাবে, সেও এক সমস্যা। অসময়ে খাবারদাবার পাওয়া যাবে এমন বাড়ির সংখ্যা এখানে বেশি নয়। মতির মা ঠিক করল, সে যাবে নিয়ামত খাঁর বাড়ি। খাওয়াদাওয়া ভালো। মনিরউদ্দিনের এটাই হয়তো শেষ খাওয়া। ভালোমতো খাক।

 

নিবারণ বলল, আমারে একটা বিড়ি দ্যান।

জলিল মিয়া না-শোনার ভান করল। নিবারণ দ্বিতীয় বার বলল, একটা বিড়ি দ্যান।

সে আগে জলিলকে তুমি করে বলেছে, এখন আপনি করে বলছে। জলিলের খুশি হওয়ার কথা। খুশি হওয়ার বদলে রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। এই লোককে বহু হাঙ্গামা করে আনা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি। খানিকক্ষণ হামহাম করে নিজেই বমিটমি করে ভাসিয়েছে। এখন আবার বিড়ি চায়। জলিল বলল, বিড়ি নাই।

হাতেরডা দ্যান।

জলিল বিড়ির টুকরাটা ছুঁড়ে দিল। এমনভাবে দিল যেন নিবারণকে উঠে গিয়ে আনতে হয়। নিবারণ তাই করল। জলিল বলল, অখন করবেন কী আপনে?

করনের কিছু নাই। কালনাগের বিষ।

কালনাগের না হইয়া অন্য সাপের হইলে, পারতেন?

নিবারণ জবাব দিল না। জলিল কড়া গলায় বলল, শিং মাছের বিষ নামানির ক্ষ্যামতাও আপনের নাই।

এইটা কেন কথা কন?

যে সত্যি, হেইডা কই।

আমি নিজ থাইক্যা তো বাবাজি আসি নাই। তুমি গিয়া আমারে আনছ।

বেকুবি করছি।

বাজান, অখন আমার বাড়িত যাওন দরকার। শ‍ইলটা যুত নাই। খুব বেযুত।

রুগী মরে-মরে, আপনের বাড়িত যাওনের চিন্তা।

বইয়া থাইক্যা লাভ নাই।

বইয়া থাকতে আপনেরে কয় কে? মন্ত্রট পড়েন। কড়ি চালান দেন। কড়ি চালান জানেন?

নিবারণ লাল চোখে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা তাকে অপমান করার চেষ্টা করছে। এটা নতুন কিছু না। অতীতে তার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। হয়তো রুগীর বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। মন্ত্রন্ত্র পড়া শুরু করার কিছুক্ষণ পরই রুগীর চোখ উল্টে গেছে। রুগীর আত্মীয়স্বজন চড়াও হয়েছে তার উপর যেন মৃত্যুর দায়ভাগ তার। যেন সে সাপকে শিখিয়ে দিয়েছে একে কাটবার জন্যে।

এখানেও তাই হবে। আগের ভক্তি-শ্রদ্ধা মানুষের মনে নাই। মানিগণ্যিও নাই। বিশ্বাসের বড় অভাব। বিশ্বাস ছাড়া এই দুনিয়ার কিছু হয় না। নিবারণ উদাস গলায় বলল, জলিল ভাই, আমারে দিয়া আসনের ব্যবস্থা করেন। শইলডা খারাপ।

কী যে পাগলের কথা ক! দিনের অবস্থা দেখেন। কে দিয়া আইব?

যে আমারে আনছে, হে।

আমার খেতে যাওন লাগব। এই যে আইয়া বইলাম, না-পাইরা বইলাম। দোস্ত মানুষ মইরা যাইতাছে।

তয়, আমি যাই ক্যামনে?

জলিল তার জবাব না-দিয়ে উঠে গেল। অনেকখানি সময় সে এখানে কাটিয়েছে। উচিত হয় নি। সে বসে থাকায় মনিরের কোন লাভ হয় নি।

নিবারণ তাকিয়ে দেখল, জলিল হনহন করে যাচ্ছে। এক বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। বিশ্বাস মানুষের মন থেকে উঠে গেছে। মানুষের মনে ভক্তি নাই, শ্রদ্ধা নাই, কিছুই নাই। মানুষগুলি এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? নিবারণ তলপেটে ব্যথা অনুভব করল। প্ৰচণ্ড খিদে লেগেছে। খিদে লাগলেই পেটে ব্যথা হয়। বমি-বমি ভাব হয়। দিন বোধহয় শেষ। সে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। গা থেকে খুলে-ফেলা ফতুয়াটি ভাঁজ করে কাঁধে রাখল। খাওয়ার জোগাড়ের ব্যবস্থা দেখা দরকার। সাপে-কাটা বাড়িতে রান্না হয় না, কিন্তু অন্য বাড়ি থেকে খাওয়া আসতে দোষ নাই। সেই দিকে কারো নজর নাই। তার দিকে কে নজর দেবে?

নিবরণ উঁচু গলায় বলল, মা লক্ষ্মী, একটু জল দেও।

শরিফা বের হয়ে এল। হাতে অ্যালুমিনিয়ামের একটা জগ। নিবারণ নিচু গলায় বলল, বাড়ির ভিতরে গিয়া কন, আমি বিদায় নিছি। বহু দূরের পথ।

শরিফা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, যাইবেন ক্যান? কিছু করনের নাই। কালনাগের দংশন।

শরিফা শীতল গলায় বলল, রুগী ভালো আছে। আপনে যাইয়েন না, থাকেন। ভালো কইরা ঝাড়েন।

নিবারণ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বলে কী এই মেয়ে! রুগী নাকি ভালো আছে। এতক্ষণে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

কী কইলা?

রুগী ভালো আছে। ভিতরে আইস্যা দেখেন।

কও কী তুমি!

খাওয়াদাওয়া করেন। ভালো কইরা ঝাড়েন।

তুমি রুগীর কে হও? পরিবার?

শরিফা মাথা নাড়ল।

যে-ঝাড়া দিছি, এর উপরে ঝাড়া নাই। কি করবা কও? মাইনষের বিশ্বাস নাই। বুঝলা, এই নিবারণের ঝাড়ার কারণে তিন দিনের মড়া হাঁইট্টা বাড়ি গেছে। আমার ওস্তাদ ছিল……পাপমুখে তার নাম নেওন যায় না। কিন্তু মা, এই ওস্তাদের নামে দোহাই দিলে অখনও বিষ আটকায়া যায়।

দেন, আপনে ওস্তাদের নামে দোহাই দেন।

পাপমুখে তার নাম নেওন যায় না মা লক্ষ্মী। আমি পাপী মানুষ।

না, আপনের উপরে আল্লাহ্‌র কিরা লাগে।

শরিফা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। নিবারণের মনটা খারাপ হয়ে গেল। আহা রে, বাচ্চা মেয়ে, কী কষ্টের মধ্যে পড়ছে। সে উদাস গলায় বলল, কাইলো না, ব্যবস্থা করছি। চিন্তার কিছু নাই। কালা গাইয়ের দুধ আরেক বাটির জোগাড় দেখ। বিষের গতিকটা দেখি।

অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে নিবারণ মুখে পানি ছিটাতে লাগল। শরিফা বলল, রুগীর সঙ্গে কথা কইবেন?

কথা? কথা কওনের অবসর নাই। মেলা কাম বাকি।

নিবারণ লাল গামছা মাথায় জড়িয়ে দিল। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও এখন তার মধ্যে নেই। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল। আশেপাশে লোজন বিশেষ নেই। কয়েকটা ছেলে-ছোকরা। তাতে কিছুই যায়-আসে না। চড়কির মতো সে তার ডান হাত ঘোরাতে শুরু করল–

ও বিষ বিষ রে
কালনাগের বিষ রে।
শীশ নাগের ইস রে
মা মনসার রীশ রে–
এর বাড়িতে আইস না,
আসমান জমিন চাইস না
তোর পায়ে ধইরা সতী বেহুলা কান্দে রে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ