ময়মনসিংহ থেকে উত্তরের দিকে যে-ব্রাঞ্চ লাইনটি গিয়েছে, তার শেষ স্টেশনটির নাম মোহনগঞ্জ। স্থানীয় লোকজন একে উজান দেশ বলেই জানে, যদিও নাবাল অঞ্চলের শুরু এখান থেকেই। শুকনো মরশুমে কিছু বোঝার উপায় নেই। দিগন্তবিস্তৃত বৃক্ষহীন বিশাল মাঠ। এঁকেবেঁকে তার ভেতর দিকে চলে গেছে পায়ে-চলা পথ। সেই পথ ধরে উত্তরে যাওয়া মানেই ভাটি অঞ্চলে গিয়ে পড়া। চট করে কিছু বোঝার উপায় নেইউজান দেশেও এরকম বিশাল মাঠ আছে, কিন্তু ভাটির মাঠগুলি কেমন যেন অন্যরকম। এই মাঠের হাওয়ায় কিছু-একটা যেন আছে। এ-অঞ্চলের সঙ্গে পরিচয় নেই এমন মানুষজন এক ধরনের চাঞ্চল্য অনুভব করেন। তাঁদের কাছে মনে হয় এমাঠ শুধু মাঠ নয়, এর অন্য কোন পরিচয় আছে।

সে-পরিচয় বোঝা যায় বর্ষায়। কী বিপুল পরিবর্তন। মাঠ কোথায়, এ তো বিশাল সমুদ্র। জল থৈথৈ করছে চারদিকে। প্রকাণ্ড সব ঢেউ উঠছে, গুমগুম শব্দ আসছে কোনো গোপন জায়গা থেকে। এ কেমন দেশ।

অচেনা মানুষের কাছে মনে হতে পারে এ বোধহয় বিরান জলাভূমি। সহজে কিছু চোখে পড়বে না। বিশাল জলরাশির মধ্যেই খানিকটা উঁচু জায়গা। অল্প কিছু ঘর নিয়ে ছোট্ট জনপদ। হাওড়ে দিক-হারিয়ে-ফেলা কোনো নৌকার মাঝি চিৎকার করলে এরা সাড়া দেবে। রাতের বেলা লণ্ঠন ঝুলিয়ে আলো দেখাবে।

এরা ছ মাস থাকবে জলবন্দি অবস্থায়। সেটাই সম্ভবত তাদের সুখের সময়। কাজকর্ম নেইগান-বাজনা, বাঘবন্দি খেলা, আর লম্বা ঘুম। এ-সময়ে এখানকার মানুষদের শরীরে নেমে আসে অদ্ভুত এক আলস্য। মেজাজ হয়ে যায় রাজা-বাদশাদের মতো।

বিয়ে-শাদির উৎসবে জমানোটাকাপয়সা সব খরচ করে ফেলে। তারপর এক সময় জল নেমে যায়। জেগে ওঠে থকথকে কাদার মাঠ। পলিভতি সোনা-ফলানো জমি। ভাটি অঞ্চলের মানুষরা গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠে। শুরু হয় অমানুষিক পরিশ্রম। জমি তৈরি হয়, ফসল বোনা হয়। ফসল কেটে ঘরে তুলে তারা আবার জলবন্দি হয়ে যায়। বড় সুখের সময় সেটা।

বানিয়াবাড়ি এরকমই একটি গ্রাম তিনটি বিশাল হাওড় একে জড়িয়ে ধরে আছে। উত্তরে নাও ড়ুবির হাওড়। দক্ষিণে ও পশ্চিমে পাগলা হাওড়। পুবে মতিবিবির হাওড়।

মতিবিবির হাওড়ের পানি শীতেও পুরোপুরি শুকায় না। থকথকে কাদার উপর হাত তিনেক পানি থাকে। রাজ্যের দেশান্তরী পাখি উড়ে আসে। নাও ড়ুবির হাওড় এবং পাগলা হাওড়ের পানি শুকিয়ে যায়। চাষবাষ হয়।

বানিয়াবাড়ি খুব ছোট গ্রাম নয়। প্রায় সত্তরটির মত ঘর আছে। পাকা বাড়ি আছে দুটি। সবচেয়ে বড়টির বর্তমান ওয়ারিশান হচ্ছেন গোলাম আলি। তিনি ভাটি অঞ্চলে থাকেন না। উজান দেশে বাসাবাড়ি বানিয়েছেন। পানির উপর দিয়ে আসা ভেজা বাতাস তাঁর সহ্য হয় না। তিনি বছরে এক বার ভাগীদারদের কাছ থেকে ফসলের ভাগ নিতে আসেন, এবং যাবার সময় কিছু জমি বিক্রি করে যান। জমির উপর যাদের বেঁচে থাকা, তারা জমি বিক্রি কখনোই ভালো চোখে দেখে না। গোলাম আলির জন্যে কেউ বিন্দুমাত্র মমতা পোষণ করে না। বানিয়াবাড়িতে গোলাম আলির প্রসঙ্গ উঠলেই এরা বলে—গোলামের পুত গোলাম। গ্রামের দ্বিতীয় পাকা বাড়িটি বজলু সরকারের। লোকটি মহাকৃপণ। তাঁর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীর মরক্ষার জন্যে তিনি পাকা বাড়ি করেন বলে সবার ধারণা। ধারণা সম্ভবত সত্যি। বজলু সরকার পাকা বাড়ির মতো ব্যাপারে পয়সা খরচ করবার মানুষ নন। গ্রামের পাঁচ-ছ ঘর পরিবার অসম্ভব ধনী, যদিও তাদের বাড়িঘর বা জীবনযাপন পদ্ধতি দেখে তা আঁচ করবার কোনো উপায় নেই। গ্রামের বাদবাকি মানুষদের তেমন কোন জমিজমা নেই। এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথাও নেই। অন্যের জমি চাষ করে তাদের দিনকাল খারাপ যায় না। হয়তো ভাটি অঞ্চলের প্রকৃতিই এদের খানিকটা নিয়তিবাদী করে দিয়েছে। অনিত্য এই জগৎ-সংসারে ঘরবাড়ি দালানকোঠার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই, এ-ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত গান এরা খুব আগ্রহ নিয়ে গায়।

মনিরউদ্দিন এর ব্যতিক্রম। তার মাথায় অল্প বয়সে একটা পোকা ঢুকে গেল। যেকরেই হোক নিজের একটা ঘর লাগবে। নিজের জমিজমা লাগবে। একটা নৌকা লাগবে। এখানেই শেষ নয়, বজলু সরকারের মতো একটি দোনলা বন্দুকও সে কিনবে।

এইসব স্বল্প সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মনিরউদ্দিনের বেলায় কেমন করে হয়ে গেল। টাকা জমানোর নেশায় পেয়ে বসল। জোয়ান বয়স, বর্ষার সময় উজান দেশে গিয়ে কাঁচা পয়সা ওড়াবে, গঞ্জের মেয়েদের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা করবে তা নয়, বাঁশ কেটে কাঁচা টাকা জমায়। ঈদ উপলক্ষে নতুন লুঙ্গিগেঞ্জি কেনার টাকা দেন বজলু সরকার, সেই টাকাও ফেলে দেয় মাটির ব্যাংকে। এবং একদিন সত্যি-সত্যি মুখ কাঁচুমাচু করে বজলু সরকারকে জানায় সে একটা ঘর বাঁধতে চায়।

বজলু সরকার বিরক্ত হয়ে বলেন, ঘর দিয়া তুই করবি কি? বাংলাঘরে ঘুমাইতে কোনো অসুবিধা আছে? অত বড় ঘর পইড়া আছে।

নিজের একখান ঘর……।

নিজের ঘর দিয়া কী করবি? বিয়া-শাদি করনের মতলব নাকি?

মনিরউদ্দিন চুপ করে থাকে। বজলু সরকার দরাজ গলায় বলেন, সময় হইলে বিয়া আমিই দিমু। জমির অভাব নাই। একখান ঘর বানাইয়া থাকবি। গেল ফুরাইয়া। যা, কাম কর্‌ গিয়া।

একখান নিজের ঘর করতাম চাই।

নিজের ঘর, নিজের ঘর, বিষয় কি?

জমি কিন্যা ঘর বানাইতাম চাই।

তুই জমি কিনবি? পয়সা কই পাইবি?

জমাইছি।

কত জমাইছ? যা, নিয়া আয়।

টাকা তেমন কিছু না, কিন্তু এখানকার জমি সস্তা। ঘর বানানোর মতো জমি কেনা যায়।

বজলু সরকার গম্ভীর হয়ে বলেন, টাকা নষ্ট করনের দরকার দেখি না। ঘর। বানাইবার শখ হইছে, ঘর বানা। পুরান ভিটার কাছে আমার জমি পইড়া আছে। জংলা সাফ কইরা ঘর তোল।

টেকাডি রাইখ্যা দেন।

নিজের কামলার কাছে জমি বেচুম, পাইছস কি তুই আমারে? ঐটা তুরে দিলাম আমি, যা ভাগ।

একটা দলিল।

আরে ব্যাটা আমারে দলিল দেখায়……হইব,হইব। দলিলও হইব। যা যা, বিরক্ত করিস না।

দেখতে দেখতে মানকচু আর হেলেঞ্চার জঙ্গল কেটে চমৎকার একটা ঘর তুলে ফেলল মনিরউদ্দিন। বজলু সরকার সেই ঘর দেখে কেন জানি অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। লোকজনদের বলতে লাগলেন, পিরীতির গন্ধ পাই। হারামজাদা পিরীত করছে—অখন বিয়া করব। ঘর সাজায়। পাখনা উঠছে হারামজাদার।

পিরীতির ব্যাপারটা সত্যি নয়। তবে ঘর সাজানোর ব্যাপারে মনিরউদ্দিনের উৎসাহের সীমা নেই। গঞ্জে গেলেই এটাসেটা কিনে আনছে ঘরের জন্য। একবার কিনল একটা কাঠের চেয়ার। বিরাট ওজন সেই চেয়ারের। শীতের মরসুমে গঞ্জ থেকে সেই চেয়ার ঘাড়ে করে আনতে হল তাকেই। এগার মাইল রাস্তা—সোজা কথা নয়। পিঠের ব্যথায় কাজে যেতে পারে না। শুয়ে থাকতে হয় দু দিন।

বজলু সরকারের স্ত্রী রহস্য করে বলেন, কেমুন চিয়ার দেখন লাগে। হাতির মতো জোয়ানও কাবু হইছে। চিয়ারটা আমরারে দেখাইসরে মনির……।

গরিব মানুষের চিয়ার আম্মা।

তুই অখন আর গরিব কই? থানার দাবোগা আইলে অখন তোর বাড়িতে গিয়া উঠব। চিয়ার আছে, টেবিল আছে।

টেবিল নাই।

অখন নাই, দুই দিন পরে হইব।

টেবিল হয় না, তবে গ্রামের লোকজন অবাক হয়ে দেখে, মনির টিন কিনেছে। টিনের ঘর বাঁধবে। ব্যাপারটা কি, কেউ বুঝতে পারে না। বজলু সরকার বলেন, বেকুব মানুষ, কি করবা কও? দুই দিন পরে দেখবা ইট কিনছে, দালান দিব।

সত্যি-সত্যি এক বর্ষায় নৌকায় করে একগাদা ইট কিনে আনে মনিরউদ্দিন। বজলু সরকার চোখ কপালে তুলে বলেন, বিষয় কী?

মনিরউদ্দিন নিচু গলায় বলে, উঠানের মইধ্যে দিমু। বাদলার সময় বড় প্যাককাদা হয়।

হইছে কি তোরক দেহি! ভূতে ধরছে, না জিনে ধরছে? ব্যাটা, তুই জমিদার হইছ?

বজলু সরকারের স্ত্রী বললেন, এরে বিয়া দেন : বিয়ার সময় হইলে মরদমাইনষে উল্টাপাল্টা কাম করে।

এরে বিয়া করব কে? পাগল-ছাগল!

বিয়ের ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ দেখা যায় না। একেকটা বৰ্ষা যায়, নতুননতুন কিছু জিনিসপত্র আসে তার বাড়িতে।

তারপর এক সময় প্রায় জোর করেই বজল সরকার তার বিয়ে দিয়ে দেন। মেয়ে। পাশের গ্রাম কলমাকান্দার। হতদরিদ্র বাবা-মার ছ ছেলেমেয়ের সবচেয়ে বড় মেয়ে শরিফা। চোদ্দ বছরের রোগা একটি মেয়ে। সে স্বামীর সম্পত্তি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়। কী সুন্দর টিনের ঘর। ঘরের ভেতর কাঁঠালকাঠের বিশাল সিন্দুক। সে ভয়ে-ভয়ে বলে, কী আছে সিন্দুকে?

মনির উদাস গলায় বলে, কিছু নাই। একদিনে কিছু হয় না। আস্তে আস্তে হয়। সিন্দুকটা ঝাড়পোছ কবি। ময়লা না-হয় যেন। খবরদার।

শরিফা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। নতুন বৌকে মনিরের বড় ভালো লাগে। কিন্তু এই কথাটি বৌকে সে জানতে দিতে চায় না। জানলে লাই পেয়ে যাবে।

মেয়েজাতকে লাই দিতে নেই।

মনির বৌয়ের জন্যে শাড়ি কিনে আনে। অবহেলার সঙ্গে ফেলে রাখে সিন্দুকের উপর। হঠাৎ করে সেই শাড়ি পেয়ে শরিফার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করে, শাড়ি কার?

মনিরউদ্দিন এমন ভাব করে যেন শুনতেই পায় নি। তারপর নিতান্ত বিরক্ত মুখ করে বলে, শাড়ি পিন্দনের মানুষ এই বাড়িত আর কেউ আছে?

শরিফা কল্পনাই করতে পারে না, তিনটি শাড়ি থাকা সত্ত্বেও কেউ আরেকটি শাড়ি কিনতে পারে। সে দীর্ঘ সময় নাকের সামনে শাড়িটা ধরে রাখে। নতুন শাড়িতে মাড়ের গন্ধটা তার বড় ভালো লাগে।

শুধু শাড়ি নয়, আরো সব জিনিসপত্র কাঠের সিন্দুকের উপর পড়ে থাকতে দেখা যায়। মিের কৌটা। এক শিশি গন্ধরাজ তেল। এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল। এত সৌভাগ্যে শরিফার ভয় করে। আবার বড় আনন্দও হয়। সব সময় ইচ্ছা করে স্বামীর জন্যে কিছু-একটা করতে। সেই সুযোগ বড়-একটা আসে না। মনিরকে ঘরেই পাওয়া যায় না। ভূতের মতো পরিশ্রম করে। সব সময় চিন্তা-কী করে বাড়তি দুটা পয়সা আসবে, মাটির ব্যাংক ভরে উঠবে-জমিজমা কিনবে। গোয়ালঘরে থাকবে নিজের গরু। গঞ্জে যাবে নিজের একটা নৌকায়। দিন কারোর একভাবে যায় না। আজ সে হতদরিদ্র। তার মানে এই নয় যে, সারা জীবন সে হতদরিদ্রই থাকবে। একদিন-না-একদিন সে দোনলা বন্দুক কিনবে। সেদিন খুব দূরে নয়।

গভীর রাতে মাঝে-মাঝে তার সে-সব স্বপ্নের কথা সে শরিফাকে বলে।

ও শরিফা।

কিতা?

পাকা দালান দিমু, বুঝছস? দোতলা দালান।

শরিফা কিছু বলে না।

দেখবি একদিন, লাখের বাতি জ্বলব আমার বাড়িত।

লাখের বাতি কী জিনিস?

শরিফার অজ্ঞতায় মনির হাসে, ভেঙে কিছু বলে না। লাখের বাতি হচ্ছে পুরোনো কালের এক উৎসব। কেউ লক্ষপতি হলে একটি উৎসব করা হয়। সেই উৎসবে লম্বা বাঁশের মাথায় বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। দূর-দূরান্তের মানুষ সেই বাতি দেখে এবং বলাবলি করে লাখের বাতি জ্বলছে।

শরিফা।

কিতা?

লাখের বাতি জ্বলব ঘরে, দেখিস। জ্বললে কেমন হইব ক দেহি?

কিছু না-বুঝেই শরিফা বলল, ভালেই হইব।

শইলে আছে কাম করনের শক্তি। শ‍ইলের শক্তিটাই আসল।

মনির একটা হাত রাখে শরিফার দিকে। শরিফার বড় লজ্জা লাগে, আবার ভালো লাগে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ